Wednesday, March 27, 2024

খালিফাহ আলীর(রা) বর্ম ও জনৈক ইহুদী

 


SONY DSC

ইসলামের চতুর্থ খালিফাহ আলী ইবনে আবি তালিব (রা) ও জনৈক ইহুদী লোকের গল্পটা হয়তো আমরা অনেকেই জানি। তারপরেও আবার বলছি। সাধারণত: গল্পটা যে কারণে বলা হয় আমি সে কারণে বলব না, অন্য একটা কারণ আছে – সেটা লেখার শেষের দিকে বলব।

 

আলী (রা) তখন আমিরুল মু’মিনীন। এক যুদ্ধে উনি তাঁর বর্মটা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এর কিছুদিন পরে একদিন বাজারে গিয়েছেন আলী। হঠাৎ চোখ আটকে গেল জনৈক ইহুদীর দোকানে – আরে! ওটা কি চক চক করছে ওখানে! এ যে আমার সেই হারানো বর্ম! খুশীতে আটখানা হয়ে আলী ছুটে গেলেন ইহুদী দোকানীর কাছে। বলে উঠলেন – ‘এই যে জনাব! ওটা আমার বর্ম, কিছুদিন আগে একটা যুদ্ধে হারিয়েছিলাম। তুমি কোত্থেকে পেলে এটা?’ আলী(রা) খালিফাহ হওয়া সত্ত্বেও মোটেও ঘাবড়ালো না ইহুদী – সে জানে এই রাষ্ট্রে আইন সবার জন্য সমান। জোর গলায় সে প্রতিবাদ করে উঠল – ‘জ্বী না! এটা এখন আমার হাতে, কাজেই এটা আমার বর্ম’।

 

অবাক হলেন আলী(রা)। তিনি নিশ্চিত এটা তাঁর বর্ম। আর তার উপর তিনি হলেন পুরো রাষ্ট্রের খালিফাহ। চাইলে নিজের ক্ষমতাবলে সেটা ইহুদী থেকে নিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু, তা তিনি করলেন না – কেইসটা নিয়ে গেলেন কাজীর (বিচারক) কাছে। কাজী আলীর (রা) কাছে জানতে চাইলেন – ‘আপনার কাছে প্রমাণ কি যে এটা আপনার বর্ম?’ আলী বললেন – ‘আমার দুই ছেলে হাসান আর হুসাইন সাক্ষ্য দেবে যে এটা আমার বর্ম’। কাজী মাথা নেড়ে বললেন – ‘উঁহু। ছেলের সাক্ষ্য বাবার পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়’। এবার কাজী ফিরলেন ইহুদীর দিকে। জিজ্ঞেস করলেন – ‘তোমার কি কোন সাক্ষী আছে নাকি তুমি শপথ করে বলবে এটা তোমার?’ ইহুদী জবাব দিল – ‘আমি কসম করে বলছি এটা আমার’। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর একটা হাদিস আছে – কেউ কোন অভিযোগ নিয়ে আসলে তাকে সাথে প্রমাণও আনতে হবে, আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে সে হয় প্রমাণ আনবে অথবা কসম করে বলবে। এই হাদিসের ভিত্তিতে কাজী রায় দিলেন – ‘দু:খিত আলী! আপনি কোন প্রমাণ আনতে পারেননি আর সে শপথ করে বলেছে এটা তার, কাজেই মামলার রায় আপনার বিপক্ষে যাচ্ছে এবং বর্মটা আপনি পাচ্ছেন না’।

 

আলী(রা) চুপচাপ রায় মেনে নিলেন। বললেন – ‘ঠিক আছে’। আর এদিকে মামলার রায়ে ইহুদী ব্যক্তি তো মহা হতম্ভব! সাথে সাথে সে বলে উঠল – ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাহ, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু! যে ধর্ম এই রকম সততার সাথে তার খালিফার বিরুদ্ধে রায় দেয় সেটা নিশ্চয়ই সত্য ধর্ম! কাজী সাহেব! আসলে খালিফাই সত্য কথা বলছিলেন, এটা উনারই বর্ম। যুদ্ধের ময়দান থেকে এটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। এটা উনারই পাওয়া উচিত’। ইহুদীর কথা শুনে একগাল হাসলেন আলী। বললেন – ‘ভাই তুমি যেহেতু এখন আমার মুসলিম ভাই হয়েই গেছ কাজেই বর্মের আমার আর দরকার নেই, এটা আমি তোমাকে গিফট করলাম’!

 

উপরের ঘটনাটা সাধারণত বর্ণনা করা হয় আদর্শ ইসলামী শাসনব্যবস্থার সুবিচার এর উদাহরণ হিসাবে। কিন্ত, এখানে আরেকটা ব্যাপার কিন্তু ভীষণ রকমের লক্ষণীয়। আলী(রা) নিশ্চিত জানতেন বর্মটা তাঁর, এবং আলী(রা) তখন মুসলিম জাহানের খালিফাহ পর্যন্ত ছিলেন – চাইলেই আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারতেন তিনি, নিজের ক্ষমতাবলে বর্মটা নিয়ে নিতে পারতেন। সমস্ত মুসলিম জাহানের খালিফাহ হওয়া সত্ত্বেও তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নেননি, ব্যাপারটা নিয়ে গেছেন বিচারকের কাছে। কারণ, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া ইসলাম সমর্থন করে না। যে ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সে শক্তি দিয়ে অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করবে, যার ‘ইলম আছে সে কথা দিয়ে অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করবে, আর এই দুইয়ের কোনটাই যার সামর্থ্যে নেই সে মনে মনে অন্যায়কে ঘৃণা করবে।

 

আমিরুল মু’মিনীন হওয়া সত্ত্বেও সামান্য একটা বর্ম ফিরে পাওয়ার জন্য আলী(রা) আইন নিজের হাতে তুলে নেননি, অথচ আজ তারই পথের পথিকেরা মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতেও আইন নিজের হাতে তুলে নিতে কুন্ঠাবোধ করে না।

 

(পাদটীকা:

১) ঘটনাটা শেইখ শাদী সুলাইমান তার একটি লেকচারে খুব সুন্দরভাবে বলেছিলেন। গুগলে সার্চ করলেই পাবেন।

২) অন্যায়ের প্রতিবাদ কিভাবে করতে হবে তা জানতে পারবেন ইমাম আন-নাওয়াবির ৪০ হাদিসের ৩৪ নং হাদিস থেকে। হাদিসটা প্রায়ই মিস-ইউজ হয়। এর খুব সুন্দর ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখা পাবেন নিচের লিঙ্কে গেলে।

No comments:

Post a Comment

Translate