Wednesday, March 27, 2024

সীরাত ২৯ – আব্দুল মুত্তালিবকে সর্বশ্রেষ্ঠ কুরাইশ কেন বলা হত?

 

আগের পর্বে আমরা জেনেছিলাম যে – প্রিয়নবী মুহাম্মাদ(সা) এর দাদা, যাকে আমরা আব্দুল মুত্তালিব নামে সাধারণত চিনি, তার জন্মগত নাম আসলে ছিল শাইবা (সাদা চুলওয়ালা), কারণ জন্মের সময় তার মাথায় কিছু সাদা চুল ছিল। এই পর্বে আমরা জানব শাইবা কিভাবে কুরাইশদের কাছে আব্দুল মুত্তালিব হল আর কিভাবেই আরবের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হল।

আগের পর্বে শেষে বলেছিলাম শাইবার বাবা বিখ্যাত কুরাইশ নেতা হাশিম (যে রাসূলুল্লাহ(সা) এর দাদার বাবা ছিল) যদিও মক্কায় থাকত, কিন্তু সে ইয়াত্রিবের (পরে যে শহরের নাম হয়েছে মদীনা)  সম্ভ্রান্ত বনু নাজ্জার গোত্রের সালমাকে বিয়ে করে সিরিয়ায় বাণিজ্য সফর করতে যেয়ে পথে মারা যায়। শাইবা বড় হতে থাকে ইয়াত্রিবেই, তার মায়ের কাছে। এমনকি মক্কার কেউ ভালমত জানতও না হাশিম ইয়াত্রিবে বিয়ে করেছিল।

হাশিম মারা যাওয়ার পর মক্কায় হাজিদের খাবার-পানির ব্যবস্থা করার ও আতিথেয়তার দায়িত্ব পেয়েছিল তার ভাই আল-মুত্তালিব। এই আল-মুত্তালিব খুব ভালো মানুষ ছিল। হাজিদের সেবা করতে যেয়ে থেকে থেকে ভাইয়ের কথা মনে পড়ত তার। আল-মুত্তালিবকে হঠাৎ একজন একদিন খবর দিল – ইয়াত্রিবে তোমার ভাই হাশিমের তো এক স্ত্রী আর সন্তান আছে! খবর শুনে আর বসে থাকতে পারল না আল-মুত্তালিব, চলে গেল ইয়াত্রিবে (মদীনায়)। সেখানে গিয়ে সে হাশিমের স্ত্রী-সন্তানকে খুঁজে বের করল ।

শাইবার তখন বালক বয়স। বাচ্চা শাইবাকে দেখেই তার মধ্যে নিজের ভাইয়ের ছায়া দেখতে পেল আল-মুত্তালিব। শাইবার মা’কে বলল – “শাইবা আমাদের বংশ, আমাদের রক্ত, ওকে আমি মক্কায় নিয়ে যাব।“ শাইবার মা প্রথমে কিছুতেই রাজী হল না। আল-মুত্তালিব জোরাজুরি শুরু করল। সে বলতে লাগল – মক্কায় এত বড় সম্মানের অধিকারী ছিল হাশিম, এত বড় ব্যবসায়ী ছিল, কুরাইশ বংশের শ্রেষ্ঠ পরিবারে তার জন্ম – সে কেন তার বাপের ভিটায় ফিরে যাবে না? তার বাবা মক্কায় হাজীরা আসলে তাদের দেখ-ভাল করত, খাওয়া-দাওয়া করাত – এই গৌরবের কাজ কেন তার ছেলে করবে না? এরকম অনেক কিছু বলার পর সালমার হাত থেকে শাইবাকে নিতে পারল আল-মুত্তালিব। কিন্তু, আল-মুত্তালিব যখন শাইবাকে নিয়ে মক্কায় ঢুকল, তখন মক্কার সবাই প্রথমে মনে করল এই বাচ্চা মনে হয় আল-মুত্তালিবের নতুন দাস। সে হয়ত এই সফরে এই দাসকে কিনে নিয়ে এসেছে। এর জন্য লোকে শাইবাকে আব্দুল মুত্তালিব (মুত্তালিবের দাস) নামে ডাকা শুরু করল। আর এই নামটাই তার সাথে রয়ে গেল, এই নামেই সেই পরিচিতি পেল।

আল-মুত্তালিব খুবই ভালো মানুষ ছিল। সে ভাতিজা আব্দুল মুত্তালিবকে ধীরে ধীরে হাজিদের কিভাবে আপ্যায়ন করতে হয়, কিভাবে তাদের খাবার-পানির ব্যবস্থা করতে হয় সব শিখিয়ে দিল। হাশিমের আরেক ভাই নওফেল ব্যাপারটাকে প্রথম থেকেই বাঁকা চোখে দেখত। কিন্তু, আল-মুত্তালিবের জন্য কিছু বলতে পারত না। আল-মুত্তালিব তার ভাতিজা আব্দুল মুত্তালিবকে তাই ভাইয়ের সব সম্পত্তিতে অংশও দিয়ে দিল। হাশিম যেহেতু অনেক ধনী ছিল, কাজেই আব্দুল মুত্তালিব হঠাৎ করেই উত্তারাধিকার সূত্রে অনেক ধনী হয়ে গেল। সেই ধন বিনা দ্বিধায় হাজিদের মধ্যে আর গরীবদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করল আব্দুল মুত্তালিব। দানশীলতা ও সততার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠল সে।

সব ভালই যাচ্ছিল। ঝামেলা বাধল যখন চাচা আল-মুত্তালিব মারা গেল। আল-মুত্তালিবের ভাই নওফেল আগে থেকেই আব্দুল মুত্তালিবের এত জনপ্রিয়তা এত টাকা-পয়সা সহ্য করতে পারত না। আল-মুত্তালিবের মৃত্যুর পর সে তার গুন্ডা-পান্ডা নিয়ে আব্দুল-মুত্তালিবের কিছু জমি-জমা দখল করা শুরু করল। আব্দুল মুত্তালিব কুরাইশের বিভিন্ন গোত্রের কাছে সাহায্য চাইলে কেউ এগিয়ে আসার সাহস করল না। আব্দুল মুত্তালিব তখন ইয়াত্রিবে তার মামা আবু আসাদ বিন আদি কে খবর পাঠাল। আবু আসাদ বনু নাজ্জার গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তি। সে তার দল-বল নিয়ে এসে নওফেল কে কঠিন করে শাসাল। নওফেল এর দলে ছিল হিশামের আরেক ভাই আব্দুশ-শামস। অন্যদিকে মক্কার বনু খুজা’আ গোত্র আব্দুল মুত্তালিব ও আবু আসাদের পক্ষ নিল। নওফেল দখলকৃত জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। কিন্তু, মনে মনে হিংসা পুসিয়ে রাখল। এই হিংসার আগুন যুগের পর যুগ চলবে – যা আমরা অনেক পরে দেখতে পাব।

এদিকে আব্দুল মুত্তালিবের দানশীলতা আর জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকল। শুধু হাজি বা অভুক্ত মানুষ নয়, মক্কার পাখিদেরকে পর্যন্ত খাবার দিত আব্দুল মুত্তালিব। বলা হয়ে থাকে – আব্দুল মুত্তালিব কখনো কোন বাজে কাজে জড়াত না, মূর্তির নামে জবাই করা মাংস খেত না। মানুষ বিপদে পড়লে তার কাছে এসে দু’আ চাইত, দু’আ কবুল হতো। অনেকে এ সময় তাকে শাইবাতুল হামদ (প্রশংসিত সাদা-চুল) নামে ডাকা শুরু করল।

আগেই বলেছি আব্দুল মুত্তালিবকে আরবের অবিসংবাদিত নেতা বলা হয়। কুরাইশ বংশের মান সে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। আমরা তো জানলাম সে প্রচন্ড দানশীল ও দয়ালু ছিল। কিন্তু শুধু কি এটুকই? না।  আব্দুল মুত্তালিবের আরবের অবিসংবাদিত নেতা হওয়ার পেছনে তিনটি মূল ঘটনা ছিল, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেছিলেন। এই তিনটি ঘটনা হল, এক – জমজম কূপ খুঁজে পাওয়ার ঘটনা, দুই – আব্দুল্লাহর কুরবানীর ঘটনা, আর তিন – আবরাহা ও হাতির ঘটনা। আমরা এই তিনটি ঘটনা সম্পর্কেই জানব। জমজম কূপ খুঁজে পাওয়ার ঘটনা দিয়ে শুরু করব – তবে সেটা বলব পরের পর্বে।

রেফারেন্স:

১) শেইখ ইয়াসির কাদি’র সীরাহ লেকচার – পর্ব ৫

২) ড. সাল্লাবির সীরাত বই

৩) উস্তাদা সামিরা আল যাইদের সীরাত বই

[মহানবীর মহাজীবন ফেইসবুক পেইজে (https://www.facebook.com/mohanobir.mohajibon.pbuh) এই লেখাটি পর্ব ৩৪নামে প্রকাশিত হয়েছিল । এই ব্লগে সেই একই লেখা পর্ব ২৯ নামে প্রকাশিত হল। ফেইসবুক পেইজের কিছু ছোট লেখাকে ব্লগে একত্রিত করে প্রকাশ করায় নম্বরের এই ভিন্নতা তৈরী হয়েছে। এতে পাঠকের অসুবিধা হয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।]

No comments:

Post a Comment

Translate