Wednesday, March 27, 2024

বিদ’আত পরিচয়

 BID'AH

মহাগ্রন্থ কোরআনের শেষের দিকে অবতীর্ন  নিচের আয়াতটিতে আল্লাহ্‌ বলেছেনঃ আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ন করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসাবে মনোনীত করলাম। – সূরা মায়িদাহ (৫:৩ আয়াতাংশ)

এই আয়াত প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ(সা) ইসলামী শরীয়াকে পূর্ণরূপে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। তিনি আমাদের যে জ্ঞান দিয়ে গেছেন আমরা তা বিশ্লেষণ করতে পারব, নতুন নতুন সমস্যার সমাধানে প্রয়োগ করতে পারব, কিন্তু নতুন ধরণের কোন ইবাদত বা নতুন কোন শরীয়া (ইসলামী আইন) আমরা তৈরী করতে পারব না।

রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন যে, আমার আগে যত নবী এসেছে তাদের প্রত্যেকের জন্য ফরজ ছিল তাদের জাতিকে সকল রকম ভাল কাজের দিক নির্দেশ দেয়া এবং সকল রকম খারাপ কাজের ব্যাপারে সতর্ক করা। (মুসলিম)

যেহেতু, রাসূলুল্লাহ(সা) সকল নবীর শ্রেষ্ঠ নবী, কোন সন্দেহ নাই আগের সব নবীর মতই তিনিও আমাদেরকে সব ভালো কাজ সম্বন্ধেই বলে গেছেন, আর সব খারাপ কাজ সম্বন্ধেই সতর্ক করে গেছেন, কোন কিছুই বাদ রাখেন নাই।

 বিশিষ্ট সাহাবা আবু দার আল গিফারী(রা) বলেছেনঃ নবী(সা) তাঁর মৃত্যুর আগে আমাদের সকল কিছুর ব্যাপারে বলে গেছেন। এমনকি আকাশে যে পাখিরা ওড়ে তাদের সম্বন্ধেও। (আহমাদ)

এত কিছুর পরেও মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে যায়, ইসলামের সঠিক শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায়। এর কারণ হলো, অনেক মানুষই অর্থ ও ব্যাখা বুঝে কোরআন পড়ে না, বুখারী, মুসলিম সহ বিশ্বস্ত হাদিসের গ্রন্থগুলো পড়ে না, পড়ে মনগড়া হাদিস দিয়ে লেখা বই, যেখানে কোন্‌ কথাটি কোন্‌ উৎস থেকে নেয়া হয়েছে তা লেখক নিজেও জানে না। এভাবে করেই সমাজে ছড়িয়ে পড়ে ধর্মপালনের বিভিন্ন মনগড়া প্রথা বা বিদা’আত।

বিদআত কি?

আসুন এবার খতিয়ে দেখা যাক, বিদ’আত কাকে বলে। ইসলামী শরীয়ায় বিদ’আত শব্দের অর্থ হল- ধর্মীয় কর্মকান্ডে এমন কিছু যুক্ত করা যেটা কোরআন মাজিদে বা হাদিসে নেই, এবং রাসূলুল্লাহ(সা) বা তাঁর অনুগত সাহাবারা যা পালন করেননি। বিদাআ’ত সম্পূর্ণরূপে হারাম এবং নিকৃষ্ট কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম।

মানুষের সকল কর্মকান্ডকে ২টি শ্রেনীতে ভাগ করা যায়। ১) ধর্মীয় কর্মকান্ড, ২) স্বাভাবিক কর্মকান্ড। কোন্‌ কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে কোন্‌ কাজটাকে হালাল বলব , আর কোন্‌ কাজটাকে হারাম বলব তা ভালোভাবে বুঝার জন্য এই দুই কর্মকান্ডের ব্যাপারে প্রযোজ্য ২টি সূত্র বলছি।

১) স্বাভাবিক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে – সকল কাজই হালাল যদি না কোরআন/হাদিসে কাজটিকে হারাম বলার জন্য কোন প্রমাণ থাকে। যেমনঃ রাসূলুল্লাহ(সা) কখনোই বিরিয়ানি খাননি। তাহলে, বিরিয়ানি খাওয়া কি হারাম? অবশ্যই না। কারণ, বিরিয়ানী খাওয়া একটি স্বাভাবিক কাজ এবং হাদিসে বা কোরআনে বলা নাই যে বিরিয়ানি বা এটা তৈরীর কোনও উপকরণ খাওয়া হারাম। কাজেই, রাসূলুল্লাহ(সা) বিরিয়ানী না খেলেও, বিরিয়ানী খাওয়া হারাম নয়, বিদ’আতও নয়। অন্যদিকে, মদ খাওয়া হারাম। কারণ, এ ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। লক্ষ্যনীয়, স্বাভাবিক কর্মকান্ড যদি হারামও হয়, তাকে বিদ’আত বলা যাবে না।  তাই, মদ খাওয়া হারাম, কিন্তু বিদ’আত নয়।

২) ধর্মীয় কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে – সকল কাজই হারাম যদি না কোরআন ও হাদিসে কাজটি করার জন্য স্পষ্ট দলীল থাকে। যেমনঃ কেউ যদি বলে আমি নেচে নেচে আল্লাহ্‌র ইবাদত করব, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, আল্লাহ্‌র ইবাদত করা একটি ধর্মীয় কাজ এবং কোরআন বা হাদিসে কোথাও বলা নাই যে নেচে নেচে আল্লাহ্‌র ইবাদত করা যাবে। হারাম ধর্মীয় কাজকে হালাল মনে করে করতে থাকলে সেটাকে বিদ’আত বলা হবে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কোন্‌টা স্বাভাবিক কাজ আর কোন্‌টা ধর্মীয় কাজ তা পার্থক্য বুঝব কিভাবে? যেমন, রাসূলুল্লাহ(সা) খুতবা দিতে মাইক ব্যবহার করতে বলেননি, তিনি ফেইসবুকের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করতে বলেননি। কাজেই, আমরা যদি এই কাজগুলি করি তাহলে কি বিদ’আত হবে না?

এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়া যাবে যখন আমরা স্বাভাবিক কর্মকান্ড আর ধর্মীয় কর্মকান্ডের সংজ্ঞা জানব (সূত্রঃ ইবনে তাইমিয়াহ)।

স্বাভাবিক কর্মকান্ডঃ যে কাজগুলো সকল ধর্মের মানুষ সাধারণভাবে করে থাকে বা করতে পারে তা-ই স্বাভাবিক কাজ। এই কাজগুলো করার জন্য কোন নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যেমনঃ নিজেদের কথা প্রচার করার জন্য মাইক ব্যবহার জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যেই আছে – তাই এটা স্বাভাবিক কাজ, তাই মাইক ব্যবহার ধর্মীয় কর্মকান্ডের মধ্যে পড়ে না। কাজেই এটা বিদ’আত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নাই। উপরন্তু, এটাকে হারাম প্রমাণ করতে হলে কোরআন বা হাদিসের স্পষ্ট প্রমাণ লাগবে। একই কারণে, ফেইসবুকের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারও বিদ’আত নয়।

ধর্মীয় কর্মকান্ডঃ যে কাজগুলো শুধু একটি নির্দিষ্ট ধর্মের লোকেরা এই কারণে করে যে তারা মনে করে এই কাজের মাধ্যমে তারা তাদের প্রভুর নৈকট্য লাভ করতে পারবে, সেটাই ধর্মীয় কাজ। উদাহরন স্বরূপ বলা যায়, অনেক মুসলিম নামাজ শেষে সম্মিলিতভাবে ইমামের সাথে মুনাজাত করে, তারা মনে করে এটা করে তারা ইবাদত করছে, আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন করছে, কিন্তু হাদিসে বা কোরআনে কোথাও সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করতে বলা নাই। কাজেই, সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা বিদ’আত। কারণ, এই ধর্মীয় কাজটি রাসূলুল্লাহ(সা) বা তাঁর অনুগত সাহাবারা পালন করেন নাই।

আমাদের সমাজে কয়েকটি প্রচলিত বিদ’আত হলঃ

১। ঈদ-ঈ-মিলাদুন্নবী

২। শব-ই-বরাত

৩। নামাজের আগে আরবীতে উচ্চারণ করে নিয়ত পড়া

৪। নামাজ শেষে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা

৫। চিল্লা দেয়া

৬। মনের কোন আশা পূরণের উদ্দেশ্যে বা আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে মাজার জিয়ারত করা

৭। মৃত ব্যক্তির জন্য কুলখানী/চল্লিশা/চেহলাম করা

৮। মৃত ব্যক্তির জন্য ১ লক্ষ ৪০ হাজার বার কালিমা পড়া

৯। মৃত ব্যক্তির জন্য একত্রিত হয়ে মাদ্রাসার ছেলেদের দিয়ে কোরআন খতম দেয়া

১০। সুন্নাত নামাজকে বাধ্যতামূলক মনে করা

১১। কোন বিশেষ রাতের নফল ও সুন্নাত নামাজের গুরুত্ব ফরজ নামাজের সমান বা বেশী মনে করা এবং আরও অনেক।

অনেকেই বলে থাকেন, ঈদ-ঈ-মিলাদুন্নবী, বা শব-ই-বরাত উপলক্ষ্যে তো কিছু ভাল কাজ করা হয়, তাহলে এই বিদ’আতগুলো পালন করলে ক্ষতি কি? এই প্রশ্নের অনেকগুলো উত্তর রয়েছে।

প্রথম উত্তর হলো, আপনি এই কথার মাধ্যমে বলতে চাচ্ছেন যে, রাসূলুল্লাহ(সা) দ্বীন ইসলামকে পূর্নভাবে আমাদের কাছে পৌঁছে দেন নাই (আ’উযুবিল্লাহ), আর তাই আপনি দ্বীনে নতুন ইবাদত সংযোজন করছেন। এই কাজগুলো যদি ভালই হত তাহলে আবু বকর (রা), উমর ফারুক(রা), ইমাম বুখারী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল উনারা এই কাজগুলো কেন করেন নাই? আপনার ঈমান কি উনাদের চেয়ে বেশী? অবশ্যই না।

দ্বিতীয় উত্তর হলো, বেশী করে নামাজ পড়াও তো ভাল কাজ। তাহলে, আপনি মাগরিবের নামাজ ৩ রাকা’আত না পড়ে ৪ রাকা’আত পড়েন না কেন? পড়েন না, কারণ রাসূলুল্লাহ(সা) আপনাকে এভাবে করে নামাজ পড়তে শিখিয়ে যাননি।

আয়েশা(রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেনঃ আমাদের ধর্মে আমরা (আমি ও আমার অনুগত সাহাবারা) যা বলি নাই, কেউ যদি তা শুরু করে তবে তা প্রত্যাখিত হবে। (বুখারী, মুসলিম)

 জাবের (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল(সা) তাঁর খুতবায় বলতেনঃ আম্মা বা’দ (আল্লাহর প্রশংসা ও সাক্ষ্যদানের পর) নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম কথা আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম রীতি মুহাম্মদ (সা) এর রীতি। সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ হল দ্বীনের ব্যাপারে নতুন কাজ উদ্ভাবন করা তথা বিদা’আত। আর প্রত্যেকটি বিদ’আতই ভ্রষ্টতা।  – (তাহকীক রিয়াযুস সালেহীন ১৭৪, মুসলিম, নাসায়ী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, আহমাদ)

পরিশেষে সবাইকে আহবান করব, আসুন আমরা ফিরে যাই কোরআন ও সুন্নাহ্‌তে – ধর্মে নতুন কিছু আবিষ্কার হতে বিরত থাকি। কোনো মৌলভী কোনও বিশেষ আমল করতে বললে তাকে জিজ্ঞেস করি, কোরআনের কোন্‌ আয়াত বা কোন্‌ হাদিসের ভিত্তিতে তিনি এই আমলটি করতে বলছেন। ইসলামকে সেইভাবে পালন করি যেভাবে পালন করেছেন রাসূলুল্লাহ(সা) এবং তাঁর অনুগত সাহাবারা। রাসূলুল্লাহ(সা) আল্লাহ্‌র নির্দেশে আমাদেরকে পরিপূর্ন ইসলাম দিয়ে গেছেন, নতুন কিছু সংযোজন করলে তা ইসলামকে নষ্ট করবে, কঠিন করবে, বিকৃত করবে, পরিবারে ও সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করবে,  আল্লাহ্‌ ও মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করবে, ইসলামকে সুন্দর করবে না।

সূত্রঃ

  1. Yasir Qadhi’s answer to the question: What can we do for our deceased ones? 

No comments:

Post a Comment

Translate