Wednesday, March 27, 2024

সীরাত ২৬ – সালমান আল ফারসি (রা) – মহানবীকে (সা) খুঁজে পেতে যে কোনদিন হাল ছেড়ে দেয়নি

 

আগের পর্বে আমরা জেনেছিলাম (হাদিসটি মুসনাদ ইমাম আহমদ গ্রন্থে বর্ণিত) কিভাবে সালমান আল ফারসি একের এক পর পাদ্রীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সঠিক ধর্মকে খুঁজে পাওয়ার জন্য সন্ধান চালিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত আম্মুরিয়ার পাদ্রী তার মৃত্যুশয্যায় সালমানকে বলে, তার আর নতুন কোন পাদ্রী খোঁজার দরকার নেই। শেষ নবীর আবির্ভাবের সময় চলে এসেছে। পাদ্রী তাকে বলে – তুমি খেজুরের দেশে যেয়ে এই নবীর সন্ধান কর, সেই দেশের মাটি কাদাযুক্ত হবে। এই নবী দান গ্রহণ করবেন না, কিন্তু উপহার গ্রহণ করবেন। আর তার পিঠে নবুয়তীর চিহ্ন থাকবে (রাসূলুল্লাহ(সা) এর দুই কাঁধের মাঝখানে কিছু রঙ্গীন চুল ছিল, একে নবুয়তের সীল বা খাতম বলা হয়)।

আম্মুরিয়ার পাদ্রীর কথা শুনে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে গেল সালমান। আমাকে খেজুরের দেশে যেতে হবে! আমার যা কিছু আছে সব বিক্রি করে দিয়ে হলেও ঐ দেশে যাব!

সালমান মানুষদের জিজ্ঞেস করল – খেজুরের দেশ কোনটা? তারা বলল – তোমাকে আরবে যেতে হবে। আম্মুরিয়ায় কাজ-কর্ম করে বেশ কিছু গবাদি পশু কিনেছিল সালমান। সে ওগুলো সব বিক্রি করে দিল। নিজের সঞ্চয়ের শেষটা দিয়ে হলেও সে শেষ নবীর সাথে দেখা করতে চায়, তার কাছ থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে চায়!

সালমান খোজ পেল তার এলাকায় এক আরব কাফেলা এসেছে। তাদেরকে টাকা-পয়সা দিয়ে বলল – ভাই আমাকে তোমাদের দেশে নিয়ে যাও। কিন্তু, এই কাফেলার লোকগুলো বদমাশ ছিল। তারা সিরিয়া থেকে মদীনা আসার পথে, মাঝরাস্তাতে সালমানকে এক ইহুদীর কাছে বিক্রি করে দিল। ইহুদী সালমানকে নিয়ে তার খেজুর-ক্ষেতে কাজে লাগাল। খেজুর-ক্ষেত দেখে সালমান এর মন খুশী হলো। মুক্ত ছিলাম, দাস হয়ে গেছি – তাতে কি? আল্লাহর নবীর কাছাকাছি তো চলে এসেছি! এবার মনে হয় নবীকে পেয়ে যাব!

কিন্তু নবীর দেখা এত সহজে মেলে না। দিন, মাস, বছর যায়। একদিন সালমানের এই ইহুদী মনিব তাকে বনু কুরাইদার অন্য এক ইহুদীর কাছে বিক্রি করে দেয়। এই মনিব তাকে মদীনায় নিয়ে আসে। যেই মাত্র সালমান মদীনায় আসে তখনই সে বুঝে যায় – এটাই সেই জায়গা! চারিদিকে বহু খেজুর বাগান, কাদামাখা মাটি – এটাই হবে সেই শহর যেখানে শেষ নবী হিজরত করবেন! আবারো দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় – খেজুর ক্ষেতে কাজ করে আর দিন গুনে সালমান – কবে পাব শেষ নবীর দেখা। দেখতে দেখতে সালমান ততদিনে মধ্য বয়স্ক হয়ে গেছে – আনুমানিক ৫০-৫৫ এর মত হবে সালমানের বয়স। গত প্রায় ৪০ বছর ধরে সে খুঁজে চলেছে আল্লাহর পাঠানো সঠিক ধর্মকে, সঠিক বাণীকে।

একদিন সালমান খেজুর গাছের উপর উঠে কাজ করছিল। আর নিচেই তার মনিব আর তার ভাগ্নে কথা বলছিল। ভাগ্নে বলল – “মক্কা থেকে নাকি এক নবী আসছে, শুনেছেন নাকি চাচা?” শুনেই কেঁপে উঠল সালমানের শরীর। মনে মনে চিৎকার করে উঠল – আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার! আমাকে এখন পাদ্রীর দেয়া বাকী লক্ষনগুলো মিলিয়ে দেখতে হবে। আমার অপেক্ষার দিন কি শেষ? নবী কি তবে চলে এসেছেন?

রাসূলুল্লাহ(সা) তখনও মদীনায় এসে পৌছাননি, তবে মদীনার কাছে কুবায় এসে পৌছেছেন। সালমানের তর সইল না। নাহ, নবী মদীনায় কবে আসবে, আর আমি এই কয়দিন বসে থাকব, এটা হবে না। এখনই কুবায় যেয়ে জানতে হবে ইনি কি সেই শেষ নবী কি না!

সালমান তার নিজের সঞ্চয়ের কিছু খাবার জড়ো করল। তারপর কুবায় গেল। কুবায় সরাসরি রাসূলুল্লাহ(সা) এর সাথে দেখা করতে চলে গেল। খাবার গুলো সামনে রেখে বলল – “শুনেছি আপনি খুব ভাল মানুষ। আর আপনার সংগী-সাথী যারা আছে সবাই ভিনদেশী আর সবারই  সাহায্যের দরকার। এই যে নিন –এগুলো আমার পক্ষ থেকে সাদাকাহ (দান)। আমি দেখছি সবার চাইতে আপনারই এগুলো সবচেয়ে বেশী দরকার, কাজেই এখান থেকে খান। ”   

রাসূলুল্লাহ(সা) সাহাবাদেরকে বললেন – “তোমরা খাও।“ কিন্তু, তিনি খেলেন না।

সালমান ভাবল – বেশ! প্রথম লক্ষন তাহলে মিলে গেল, ইনি নিজে দান গ্রহণ করেন না।

পরের দিন সন্ধ্যায় কাজ সেরে আবার কুবায় গেল সালমান। এবারও সামনে কিছু খাবার রাখল। এবার বলল – “আমি দেখলাম আপনি দান থেকে খান না। এগুলো রাখুন – আজকের গুলো উপহার।”

আজকে রাসূলুল্লাহ(সা) সাহাবাদেরকে খেতে বললেন, আবার নিজেও খেলেন।

সালমান মনে মনে বলে – দারুন! দারুন! দুইটি লক্ষনই মিলে গেছে। এবার তৃতীয় ও শেষ লক্ষন। তাঁর পিঠে নবুয়তীর চিহ্ন (খাতম) আছে কিনা দেখতে হবে।

এরপর আরেকদিন সালমান আবার আসল যখন রাসূলুল্লাহ(সা) একটা জানাযায় হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তার চতুর্দিকে অনেক সাহাবা ছিল। সালমান ভিড় ঠেলে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে আসল, পিছনের দিকে যেয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে খাতম টা দেখার চেষ্টা করতে থাকল। রাসূলুল্লাহ(সা) বুঝতে পারলেন সালমান কি দেখতে চাচ্ছে। তিনি তার পিঠের কাপড় সরিয়ে খাতম দেখিয়ে দিলেন। সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ(সা) কে জড়িয়ে ধরল সালমান, চুমু দিতে থাকল, চোখ বেয়ে পড়তে থাকল আনন্দের অশ্রু! দীর্ঘ ৪০ বছরের অনুসন্ধান বুঝি শেষ হল! তৎক্ষণাৎ সালমান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল।

সালমান মুসলিম হলেও সে ইহুদীর দাস হিসেবেই আরো কয়েকবছর ছিল। একদিন রাসূলুল্লাহ(সা) তাকে বললেন – “সালমান, তুমি মুক্ত হয়ে যাও।“

সালমান তার মালিকের কাছে তার দাম কত জানতে চাইল। সে মুসলিম হয়েছে জেনে ইহুদী মনিব চড়া দাম হাঁকল – তিনশ ফল-দেয়া খেজুর গাছ আর ৪০ উকিয়া স্বর্ণ। রাসূলুল্লাহ(সা) বাকী সাহাবীদের বললেন – “তোমাদের ভাইকে সাহায্য করো”। সাহাবীরা যে যার মত পারে ১৫-২০টা করে কচি খেজুর গাছ সালমানকে দিল। রাসূলুল্লাহ(সা) নিজে হাতে ঐ গাছগুলো বুনলেন। আল্লাহর হুকুমে এক বছরেই ওগুলো পূর্নাংগ খেজুর গাছ হয়ে গেল। ইহুদী মনিবকে গাছগুলো দেয়া হল। আর স্বর্ণের ব্যাপারে – এক অভিযানে মুসলিমরা কিছু স্বর্ণ আয়ত্ত করে। সেই স্বর্ণ রাসূলুল্লাহ(সা) সালমানকে দেন। আর এভাবেই সালমান কৃতদাস থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন মানুষ হয়।

সালমান তার সারাজীবন কাটিয়েছে আল্লাহকে খুঁজে, ইসলামকে খুঁজে, রাসূলুল্লাহ(সা) কে খুঁজে। নিজের বাবা-মা, জীবন, যৌবন, সম্পদ – সব কিছু দিয়ে দিয়েছে ইসলামকে পাওয়ার জন্য। আখিরাতে সে তো অবশ্যই জান্নাত পাবে, কিন্তু দুনিয়াতেও কি এর বিনিময়ে কিছু পেয়েছিল?

হ্যাঁ, পেয়েছিল। রাসূলুল্লাহ(সা) থেকে যে মর্যাদা সে পেয়েছিল তা অকল্পনীয়। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন – “সালমান হলো আহ্লুল বাইত (অর্থাৎ আমার পরিবারের একজন)!”

আলী(রা) সালমান সম্পর্কে বলে – “জ্ঞানের প্রথম থেকে শেষ – সবকিছু আয়ত্ত করেছিল সালমান। সে ছিল জ্ঞানের সাগর যার গভীরতা বোঝা সম্ভব ছিল না। আর সে তো আমাদের পরিবারের একজন, সে হলো আহ্লুল বাইত।”

যে ইরান থেকে বাবার ঘর ছেড়ে ইসলামকে খুঁজে পাওয়ার জন্য বের হয়েছিল সালমান, সেই ইরানে সে পরে ফিরে গিয়েছিল বিজয়ির বেশে। উমার ইবনুল খাত্তাবের খিলাফতকালে মুসলিমরা ইরান বিজয় করে। আর ইরানের গভর্নর হিসাবে সালমান আল ফারসিকে নিযুক্ত করা হয়।

উসমান ইবনে আফফান (রা) এর খিলাফতকালে ইন্তেকাল করে সালমান। ইমাম আয-যাহাবীর মতে তার বয়স তখন ৭০ এর কিছু বেশী ছিল। তবে অন্য অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, মৃত্যুকালে তার বয়স আরো অনেক বেশী ছিল।

রেফারেন্স:

১) শেইখ ইয়াসির কাদি’র সীরাহ লেকচার – পর্ব ৪

২) শেইখ ইয়াসির কাদি’র সালমান আল ফারসির উপর লেকচার

৩) Men and Women around the Messenger, Sa’d Yusuf Abu ‘Aziz, Darussalam Publications

[মহানবীর মহাজীবন ফেইসবুক পেইজে (https://www.facebook.com/mohanobir.mohajibon.pbuh) এই লেখাটি পর্ব ৩১ নামে প্রকাশিত হয়েছিল । এই ব্লগে সেই একই লেখা পর্ব ২৬ নামে প্রকাশিত হল। ফেইসবুক পেইজের কিছু ছোট লেখাকে ব্লগে একত্রিত করে প্রকাশ করায় নম্বরের এই ভিন্নতা তৈরী হয়েছে। এতে পাঠকের অসুবিধা হয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।]

No comments:

Post a Comment

Translate