Wednesday, March 27, 2024

আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই — আল-বাক্বারাহ ১৫৫

 

আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই — আল-বাক্বারাহ ১৫৫

কু’রআনে এমন  কিছু আয়াত রয়েছে যেগুলো আমাদেরকে জীবনের বাস্তবতা মনে করিয়ে দেয়। কিছু আয়াত রয়েছে যা আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়: আমরা কীভাবে নিজেরাই নিজেদের জীবনটাকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিই। আর কিছু আয়াত রয়েছে যা আমাদেরকে জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট, ভয় হাসিমুখে পার করার শক্তি যোগায়। এরকম একটি আয়াত হলো—

2_155_title

2_155

আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই: মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও। [আল-বাক্বারাহ ১৫৫]

আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই

আল্লাহ ﷻ শুরু করছেন: وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَىْءٍ — আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে এই দুনিয়াতে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষা নেবেনই, নেবেন। এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি আরবিতে দুই বার জোর দিয়ে এ কথা বলেছেন। কারো বেলায় সেই পরীক্ষা হয়তো চাকরি হারিয়ে ফেলে অভাবে, কষ্টে জীবন পার করা। কারো বেলায় হয়তো বাবা-মা, স্বামী, স্ত্রী, সন্তানদের জটিল অসুখের চিকিৎসায় দিনরাত সংগ্রাম করা। কারো বেলায় হয়তো নিজেরই নানা ধরনের জটিল অসুখ। কারো বেলায় আবার জমি-জমা, সম্পত্তি নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সাথে শত্রুতা, শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচার, দুশ্চরিত্র স্বামী, পরপুরুষে আসক্ত স্ত্রী, ড্রাগে আসক্ত ছেলে, পরিবারের মুখে কালিমা লেপে দেওয়া মেয়ে —কোনো না কোনো সমস্যায় আমরা পড়বোই। এই সমস্যাগুলো হচ্ছে আমাদের জন্য পরীক্ষা।

পৃথিবীতে আমরা এসেছি পরীক্ষা দিতে —এটা হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। হিন্দি সিরিয়াল, মিউজিক, ভিডিও গেম, রংবেরঙের পানীয়, হাজারো বিনোদন সবসময় আমাদেরকে চেষ্টা করে এই বাস্তবতাকে ভুলিয়ে দিতে। আমরা নিজেদেরকে প্রতিদিন নানা ধরনের বিনোদনে বুঁদ করে রেখে জীবনের কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করি। আমরা বিনোদনে যতই গা ভাসাই, ততই বিনোদনের প্রতি আসক্ত হয়ে যাই। যতক্ষণ বিনোদনে ডুবে থাকি, ততক্ষণ জীবনটা আনন্দময় মনে হয়। তারপর বিনোদন শেষ হয়ে গেলেই অবসাদ, বিরক্তি, একঘেয়েমি ঘিরে ধরে। ধীরে ধীরে একসময় আমরা জীবনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। “কেন আমার নেই, কিন্তু ওর আছে?” “কেন আমারই বেলায় এরকম হয়, অন্যের কেন এরকম হয় না?” —এই সব অসুস্থ প্রশ্ন করে আমরা আমাদের মানসিক অশান্তিকে জ্বালানী যোগাই। এত যে অশান্তি, তার মূল কারণ হলো: আমরা যে এই জীবনে শুধু পরীক্ষা দিতে এসেছি —এই কঠিন বাস্তবতাটা ভুলে যাওয়া।

মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, জান, মাল, ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে

আল্লাহ ﷻ আমাদের কীভাবে পরীক্ষা নেবেন, তার কিছু উদাহরণ তিনি আমাদেরকে দিয়ে দিয়েছেন। আমরা যদি ভালো করে বুঝে নিই পরীক্ষাগুলো কেমন হবে, তাহলে সেই পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আগে থেকেই আমরা তৈরি থাকবো। তারপর যখন পরীক্ষা শুরু হবে, তখন পরীক্ষা পার করা সহজ হয়ে যাবে। যারা জীবনে অনেকবার কঠিন বিপদে পড়েছেন, তারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে, যদি চিন্তা করে বের করা যায় কেন বিপদটা হয়েছে, কতদিন তা চলতে পারে এবং বিপদটা কীভাবে একসময় শেষ হয়ে যেতে পারে — তখন সেই বিপদটা ধৈর্য ধরে পার করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। একারণে পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে জীবনটা সহজ হয়ে যায়।

ভয়

এই আয়াতে আল্লাহ ﷻ ভয়ের জন্য خَوْف (খাউফ) ব্যবহার করেছেন। কু’রআনে বিভিন্ন ধরনের ভয়ের জন্য বারোটি আলাদা আলাদা শব্দ রয়েছে: خاف, خشي, خشع, اتقى, حذر, راع, اوجس, وجف, وجل, رهب, رعب, اشفق —যার মধ্যে এই আয়াতে বিশেষভাবে খাউফ ব্যবহার করা হয়েছে, যা একটি বিশেষ ধরনের ভয়: আমাদের জীবনে কোনো একটা বিপদ এগিয়ে আসছে বা এসে গেছে, এবং আমরা তা নিয়ে ভয়ে, আতঙ্কে আছি —এটা হচ্ছে খাউফ।

এই ভয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক, পারিবারিক যে কোনো বিপদের ভয় হতে পারে। দেশের সরকার মুসলিমদের ধরে ধরে মেরে ফেলছে। কেউ মুখ খুলতে পারছে না। সত্য কথা বললে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ভরা হচ্ছে, গুম করে ফেলা হচ্ছে। মুসলিমরা সবাই ভয়ে আছে। —এই ভয় হচ্ছে খাউফ। এটা একটা পরীক্ষা।

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। মহামারি, দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ছে। চারিদিকে মানুষের অভাব, অনটন, যে কোনো সময় গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। খাবারের দাম বাড়তে বাড়তে কেনার সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে সামনেই অচিরেই পরিবার নিয়ে এক বেলা না খেয়ে দিন পার করতে হবে। —এই ভয় হচ্ছে খাউফ। এটা একটা পরীক্ষা।

ছেলে রাতের বেলা ঘরের দরজা বন্ধ করে কী জানি করে। মাঝে মধ্যে কোনো মেয়ের গলা শোনা যায়। দিনের বেলা বখাটে দেখতে কিছু বন্ধুর সাথে ঘোরাঘুরি করে। ছেলেটা নিশ্চয়ই একটা বাজে কিছুতে জড়িয়ে যাচ্ছে। কোনদিন না অসামাজিক কিছু করে ফেলে। লজ্জায় আর ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। মানুষ থু থু দেবে। —এই ভয় হচ্ছে খাউফ। এটা একটা পরীক্ষা।

ক্ষুধার কষ্ট

আরেকটি পরীক্ষা হচ্ছে ক্ষুধার কষ্ট। ক্ষুধার কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য মানুষ এমন কিছু নেই যা করে না। একজন দিনমজুরের মাথায় সারাদিন একটা চিন্তাই ঘুরে, কালকে সে খাবার কেনার মতো যথেষ্ট টাকা অর্জন করতে পারবে কি? একজন চাকুরীজীবী সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকে: আমি মারা গেলে আমারা ছেলেমেয়েরা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে তো? একজন ব্যবসায়ীর মাথায় সবসময় হিসেব ঘুরতে থাকে: ব্যবসায় কতটা পর্যন্ত লোকসান হলে না-খেয়ে পথে বসতে হবে না। সকালে ঘুমের থেকে উঠে মাথায় চিন্তা আসে নাস্তায় কী খাবো, যা খেয়ে দুপুর পর্যন্ত ক্ষুধার কষ্ট লাগবে না। দুপুরে খাওয়ার সময় মাথায় চিন্তা আসে কত খেলে আর বিকেলে ক্ষুধার কষ্ট করতে হবে না, একবারে রাত পর্যন্ত থাকা যাবে। রাতে খাওয়ার সময় হিসেব চলে ফজরের সময় উঠলে আবার ক্ষুধা লেগে যাবে না তো?

খাবার কেনার মতো যথেষ্ট টাকা থাকবে কিনা –এই ভয়টা এতই কঠিন ভয় যে, ১৩-১৭ বছর বয়সীদের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে যে, ক্ষুধার কষ্টের ভয় তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা জন্ম দেওয়ার একটি অন্যতম কারণ। যে সমস্ত পরিবারের উঠতিবয়সী যুবক-যুবতীরা ক্ষুধার কষ্ট করে, তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে গিয়ে বাবা-মার কঠিন সংগ্রাম দেখে, মাঝে মধ্যেই এক-দুই বেলা না খেয়ে ক্ষুধার কষ্টে দিন বা রাত পার করে, তাদের মনের মধ্যে ক্ষুধার কষ্টের ভয় ঢুকে যায়। এই ভয় থেকে এক সময় তাদের মধ্যে অস্থিরতা এবং নানা ধরনের মানসিক ব্যাধি দেখা দেয়।[২৯৭]

যারা জীবনে এক সময় অনেক অভাবে পার করেছেন, প্রতিটি দিন সংগ্রাম করতেন কীভাবে মাস চলবে, কীভাবে বাচ্চাদের খাওয়াবেন, তারা যখন একসময় গিয়ে স্বচ্ছল হন, তারপরেও তাদের অনেকের ভেতরে আবার অভাবের জীবনে ফিরে যাওয়ার আতঙ্ক চলে যায় না। ব্যাংক ব্যালেন্সে একটা শূন্য কমে গেলে বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে যায়। কোনো একমাসে আয় একটু কম হলে আতঙ্ক শুরু হয়ে যায়। যদিও তাদের খাওয়া, পড়ার কোনোই সমস্যা নেই, আল্লাহ ﷻ তাদেরকে কয়েক মাস বা বছর স্বচ্ছন্দে চলার মতো যথেষ্ট সম্পদ দিয়ে রেখেছেন, তারপরেও তাদের ভেতরে আগের সেই অভাবী জীবনের দুঃস্বপ্ন কাটে না। তারা চেষ্টা করলেও আল্লাহর ﷻ প্রতি পুরোপুরি কৃতজ্ঞ হয়ে, মন থেকে অশান্তি দূর করে, শান্তির সাথে জীবন পার করতে পারেন না। ক্ষুধার কষ্ট, অভাবের জীবনের ভয় তাদেরকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়ায়।

 

অনিশ্চয়তা

ভয় এবং ক্ষুধা — এই দুটির মধ্যে একটি সাধারণ ব্যাপার রয়েছে, তা হলো অনিশ্চয়তা। মানুষ নিশ্চয়তা অর্জনের জন্য পাগল, অনিশ্চয়তাকে তার কাছে অসহ্য। সবসময় চেষ্টা করে কীভাবে বেতনের নিশ্চয়তা, সমাজে স্ট্যাটাসের নিশ্চয়তা, ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়ির নিশ্চয়তা, নিরাপদে রাস্তায় চলার জন্য গাড়ির নিশ্চয়তা, লোন শোধ করার জন্য নিয়মিত আয়ের নিশ্চয়তা —এই সব অনিশ্চয়তাকে সবসময় নিশ্চিত করে রাখার জন্য বাবা-মা, সন্তান, আত্মীয়, বন্ধু, যে কোনো সম্পর্ককে উপেক্ষা করে হলেও মানুষ দিনরাত খাটতে রাজি আছে। কিন্তু তার জীবনে নিশ্চয়তা চাই-ই চাই।

মানুষের মস্তিষ্ক এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, তা অনিশ্চয়তা সহ্য করতে পারে না। যখনি মস্তিষ্ক কোনো অনিশ্চয়তা হতে যাচ্ছে এই উপলব্ধি করে বসে, সাথে সাথে সেটি সতর্ক অবস্থায় চলে যায়। তখন অন্য সব চিন্তা বাদ দিয়ে সেই অনিশ্চয়তা কীভাবে দূর করা যায়, তা নিয়ে মস্তিষ্ক ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের মস্তিষ্ক হচ্ছে একটা বিরাট জটিল যন্ত্র, যার একটা মূল কাজ হচ্ছে সামনে কী হতে যাচ্ছে, তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখা।[২৯১]

আমরা শুধু শুনি না, আমরা শুনি এবং একইসাথে চিন্তা করি সামনে কী শুনতে যাচ্ছি। আমরা শুধু দেখি না, আমরা দেখি এবং একইসাথে চিন্তা করি সামনে কী দেখতে যাচ্ছি। আমরা শুধুই পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে ভবিষ্যৎ বোঝার চেষ্টা করি না। আমাদের দেহ প্রায় ৪০টি পারিপার্শ্বিক উৎস থেকে সবসময় সিগনাল প্রসেস করে। অবচেতনভাবে প্রায় ২০ লক্ষ ব্যাপার নিয়ে আমরা সবসময় ভাবছি ভবিষ্যৎ আগে থেকেই নিশ্চিত করার জন্য। কল্পনাতিত পরিমাণের তথ্য আমাদের মস্তিষ্ক প্রতি মুহূর্তে প্রক্রিয়া করছে, কারণ আমাদের মস্তিষ্ক সবসময় চেষ্টা করে ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার। এটি অনিশ্চয়তা একেবারেই পছন্দ করে না।[২৯১]

তথ্য আসক্তি

আধুনিক যুগে এক নতুন সমস্যা শুরু হয়েছে — তথ্য-আসক্তি। মানুষ প্রতিনিয়ত শত শত তথ্য গোগ্রাসে গিলছে, যদিও তার সেগুলোর কোনোই দরকার নেই। এর মূল কারণ: মানুষ এভাবে অনিশ্চয়তা দূর করে।[২৯২]ফেইসবুকে কেউ আমাকে নিয়ে কিছু বলল কিনা, কেউ আমার পোস্টে কমেন্ট করলো কিনা, কেউ আমার ছবিতে লাইক দিল কিনা —এই অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য সে দিনের মধ্যে বহুবার ফেইসবুকে গিয়ে দেখে কিছু হলো না।

একইভাবে শেয়ার বাজারের দালাল, তথ্য প্রণেতারা ব্যাপক ব্যবসা করে নেয় আমাদের শেয়ার সম্পর্কে অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে। একটার পর একটা সংবাদ চ্যানেল, পত্রিকা চালু হচ্ছে কারণ আমরা অলিতে গলিতে, দেশে, বিদেশে, ডানপন্থী, বামপন্থী, শাসকদল, বিরোধী দল, নিরপেক্ষ দল সব দিকের সব রকম তথ্য জানতে চাই। অনেকে একটা পত্রিকা না রেখে দুটো-তিনটে পত্রিকা রাখেন, তিন-চারটা সংবাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে খবর পড়েন, পাছে কোনো একদিকের মত, কোনো একটা খবর তার অগোচরে থেকে যায়। একদিন রাতের খবর না দেখলে বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে যায়, কী জানি হারিয়ে ফেললাম? এই তথ্য-আসক্তির মূল কারণ হলো অনিশ্চয়তা।

অনিশ্চয়তার নিশ্চয়তা

মানুষের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হাজারো ব্যবসা শুরু হয়েছে মানুষকে নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য। লাইফ ইনস্যুরেন্স, বাড়ির লোন, গাড়ির লোন, মোবাইল ফোনের প্যাকেজ, ব্রডব্যান্ড কানেকশন, ওয়ারান্টি, গ্যারান্টি —এরকম হাজারো ভাবে মানুষকে নিশ্চয়তার লোভ দেখানো হচ্ছে। মার্কেটিং কোম্পানিগুলো শিখে গেছে কীভাবে এই অনিশ্চয়তাকে কাজে লাগিয়ে তাদের পণ্যের বিক্রি বাড়ানো যায়। তাদের বিজ্ঞাপনে প্রথমে মানুষকে এক অজানা, অনিশ্চয়তার ভয় দেখানো হয়। তারপর বেশি দামে, চড়া সুদে নিশ্চয়তা বিক্রি করা হয়। বোকা মানুষ নিশ্চয়তার এই মিথ্যা ফাঁদে পা দিয়ে জীবন দুর্বিষহ করে ফেলে। নিশ্চয়তা কিনতে গিয়ে স্বাস্থ্য, সংসার, সন্তান, সুখ সব বিসর্জন দিয়ে দেয়।

আল্লাহ ﷻ মানুষকে এই আয়াতে সাবধান করে দিচ্ছে যে, তিনি মানুষকে অনিশ্চয়তা দিয়ে পরীক্ষা নেবেনই। সুতরাং অনিশ্চয়তাকে জয় করার জন্য হারাম পথে পা দিয়ে কোনো লাভ নেই। এক দিকে অনিশ্চয়তা দূর করলে আরেক দিকে আসবে। মাঝখান থেকে সব অনিশ্চয়তাকে জয় করার মিথ্যা স্বপ্ন যেন মানুষকে শেষ করে না দেয়।

সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানো

এরপর আল্লাহ ﷻ পরীক্ষা নেবেন সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আমাদের পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু ইত্যাদি নানা সম্পর্কের ভেতরে মৃত্যু আসবেই। এটাই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে কারো মৃত্যু হয়তো অল্প বয়সে হয়ে যায়। কারো হয়তো দুর্ঘটনা থেকে মৃত্যু হয়। আমরা তখন বলি ‘কপাল খারাপ’, ‘অকালে মৃত্যু’, ‘অপমৃত্যু’, ‘আহারে, বেচারা অল্প বয়সে মারা গেল’ ইত্যাদি —এগুলো সব ভীষণ রকমের ভুল কথা। মুসলিমদের কাছে কোনো ‘কপাল খারাপ’ নেই, ‘অকালে মৃত্যু’, ‘অপমৃত্যু’, ‘কম বয়সে’ মৃত্যু বলে কিছু নেই। এগুলো বিধর্মী এবং নাস্তিকদের ডিকশনারির শব্দ।

কারো কপাল কখনো খারাপ হয় না, আল্লাহ ﷻ তার জন্য ঠিক যে সব সমস্যা হওয়ার কথা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন, তার জীবনে ঠিক তাই ঘটে। কারো অকালে মৃত্যু হয় না, তার ঠিক যে সময় মৃত্যু হওয়ার কথা, ঠিক তখনি মৃত্যু হয়। কারো অপমৃত্যু হয় না, বরং মু’মিন অবস্থায় দুর্ঘটনায় মারা গেলে সে শহীদ হয়ে মরে। তখন এর চেয়ে বড় প্রাপ্য তার জন্য আর কিছু হতে পারে না। কারো অল্প বয়সে মৃত্যু হয় না, পৃথিবীতে তার আয়ু সেটুকুই নির্ধারণ করা ছিল। সে ঠিক সময়মতো মারা গেছে, আগেও না, পরেও না। —এই সত্যগুলো আমরা যদি উপলব্ধি করি, তাহলে আমরা নিজেদেরকে অপেক্ষাকৃত কম কষ্ট দেবো, অন্যের মাঝেও অপেক্ষাকৃত কম কষ্ট ছড়াবো।

এরপর আসবে সম্পদ, ফল, ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। স্টক মার্কেট ধ্বসে যাবে। কেউ লোনে জর্জরিত হয়ে যাবে। কেউ দেউলিয়া হয়ে যাবে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যায় ফসল ধ্বংস হয়ে যাবে। নদীর পাড় ভেঙ্গে বাড়ি, জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। —এই হচ্ছে জীবন। এগুলো সবই আল্লাহর ﷻ পক্ষ থেকে পরীক্ষা। আমরা যদি উপলব্ধি করতে পারি যে, আমাদের জীবনের কঠিন সময়গুলো আসলে এক একটা পরীক্ষা এবং আমাদের কাজ হচ্ছে এই পরীক্ষায় ঈমান বজায় রেখে পাশ করা, তাহলে জীবনের কঠিন সময়গুলো পার করা যেমন সহজ হবে, তেমনি আমরা পরীক্ষায় পাশ করে বিরাট প্রতিদান পাবো।

আর যদি তা না করি, তাহলে জীবনটা অসহ্য হয়ে যাবে। ডিপ্রেশনের ওষুধ খেয়ে দিন পার করতে হবে। ঘুমের ওষুধ খেয়ে রাতে ঘুমাতে হবে। হাজার হাজার ওষুধ খেয়ে নষ্ট করা কিডনি নিয়ে ডায়ালাইসিস করতে করতে ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতে হবে। আর আখিরাতে থাকবে অপমান এবং শাস্তি।

 

আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও

প্রশ্ন আসে: কীসের সুখবর? মুমিনদের জন্য সুখবর একটাই: জান্নাতের নিশ্চয়তা। আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে এই আয়াতে বলে দিলেন: কী করলে আমাদের আর জান্নাত পাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। আসুন আমরা আমাদের জীবনে ঘটে চলা পরীক্ষাগুলো বোঝার চেষ্টা করি। এই পরীক্ষাগুলো কীভাবে দিলে আমরা পরীক্ষায় পাশ করবো, তা চিন্তা করে বের করি। তারপর যথাসাধ্য চেষ্টা করি নিজেদের মধ্যে যা কিছু পরিবর্তন করতে হবে, তা করার। ঈমান বজায় রেখে প্রতিটি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে শেষ করি।

আল্লাহ ﷻ তখন আমাদেরকে কিয়ামতের দিন সবচেয়ে বড় সুখবর দিয়ে দেবেন। সেদিন সেই সুখবর পেয়ে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবো। পৃথিবীর জীবনটা তখন কয়েক মুহূর্তের দুঃস্বপ্ন মনে হবে। জান্নাতের সুখবর পেয়ে মুহূর্তের মধ্যেই আমরা ভুলে যাবো পৃথিবীতে কত কষ্ট, কত সংগ্রাম করেছিলাম, কত দুঃখ পেয়েছিলাম। সামনে যে এক নতুন অনন্ত জীবন শুরু হবে, শুধুই আনন্দ, সুখ, হাসি, তৃপ্তির জীবন, সেই জীবন নিয়ে আমরা তখন পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে যাবো। কখন জান্নাতে গিয়ে আল্লাহর ﷻ সাথে দেখা হবে, তাঁর কথা প্রথম বারের মতো নিজের কানে শুনতে পাবো, তাঁর সাথে মন উজাড় করে কথা বলতে পারবো –সেই তীব্র আনন্দে আমরা বাকি সবকিছু ভুলে যাবো।

এর পরের আয়াতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে জানাবেন এই সুখবর যারা পাবে, তারা কেমন মানুষ। তারা কোনো সাধারণ মানুষ নন। তারা প্রচণ্ড রকমের ধৈর্যশীল। কু’রআনের শিক্ষাকে তারা তাদের কথা, কাজ, চিন্তায় আত্মস্থ করে ফেলেছেন। জীবনের বাস্তবতা কী, বিপদ কেন আসে, কীভাবে আসে, তারা তা খুব ভালভাবে উপলব্ধি করেন। কোনো ধরনের বিপদ তাদেরকে তাদের ইস্পাত দৃঢ় ঈমান থেকে টলাতে পারে না।

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • collected from http://quranerkotha.com/

No comments:

Post a Comment

Translate