Wednesday, March 27, 2024

কোরআন পরিচয়

 koran

মুসলিমদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন, যা নাজিল হয়েছে সমগ্র মানবজাতির  জন্য জীবন নির্দেশিকা হিসাবে। কিন্তু, আমরা যারা নিজেদের মুসলিম বলি তারা কোরআন সম্বন্ধে কতটুকু জানি? অথচ, ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা আমাদের সকলের জন্য ফরজ। কোরআন সমন্ধে আমরা যখন জানব, তখন এই মহাগ্রন্থটির প্রতি আমাদের ভালবাসা বাড়বে। একই সাথে, কেউ যদি কোরআন সম্বন্ধে কোনো ভুল কথা বলা, তখন আমরা নিজে misguided হবো না এবং তার ভুল ধরিয়ে দিতে পারব।

এই লেখার উদ্দেশ্য কোরআনের প্রাথমিক পরিচয় তুলে ধরা। কোরআন শব্দের অর্থ কি, কোরআনের সংজ্ঞা, আর কোরআনের কয়েকটি নাম নিয়ে কথা বলব এই লেখায়।

১। কোরআন শব্দের অর্থঃ ‘কোরআন’ শব্দটির কয়েকটি অর্থ হতে পারে। যেমনঃ

১) ইমাম শাফেঈ এর মতে কোরআন শব্দটি বিশেষ্য, যার কোনো অর্থ নাই। এই মতামতটি অধিকাংশ উলামার কাছে গ্রহনযোগ্য নয়।

২) অনেকের মতে কোরআন শব্দটি এসে ‘কারানা’ থেকে যার অর্থ একত্রিত করা। যেহেতু আয়াত ও সূরাকে একত্রে নিয়েই কোরআন গঠিত, তাই এই মতামত অনুসারে কোরআন শব্দের অর্থ ‘একত্রিত গ্রন্থ’। এই মতামতটিও অপেক্ষাকৃত কম উলামার কাছে গ্রহনযোগ্য।
৩) সবচাইতে গ্রহনযোগ্য মতামতটি এরকমঃ কোরআন শব্দটি এসেছে কারাআ শব্দ থেকে। কারাআ শব্দের অর্থ হল আবৃত্তি করা। কাজেই কোরআন শব্দের অর্থ হল ‘যাকে আবৃত্তি করা হয়’।
২। কোন্‌ বইটাকে কোরআন বলবঃ সাধারণভাবে আমরা মুসলিমরা সবাই বুঝি কোন্‌ বইটাকে কোরআন বলে। কিন্তু, কোরআনকে সংজ্ঞায়িত করা কিন্তু অত সহজ নয়। কোরআনের বহুলভাবে গৃহীত সংজ্ঞাটির ৭টি অংশ রয়েছে। সংজ্ঞাটি এরকমঃ

কোরআন হল ১) আরবী ভাষায় আল্লাহ্‌র বাণী (কালাম), ২) যা নাজিল হয়েছে, ৩) মুহাম্মদ(সা) এর উপর, ৪) শব্দে এবং অর্থে, ৫) যা ‘মুসহাফ’- এ সংরক্ষিত, ৬) আমাদের কাছে এসেছে  ‘মুতাওয়াতির’ বর্ণনার মাধ্যমে, ৭) যার সমতুল্য কিছু তৈরী করা মানবজাতির জন্য চ্যালেঞ্জ

আসুন সংজ্ঞাটাকে বুঝার চেষ্টা করি। কোরআন সরাসরি আল্লাহ্‌র কথা, আরবী ভাষায়, অর্থাৎ কোরআনের কোনো অনুবাদকে কোরআন বলা যাবে না। মুহাম্মদ(সা) এর উপর এটি ২৩ বছর ধরে নাজিল হয়েছে, শব্দে এবং অর্থে। তার মানে, কোরআনের আয়াতগুলি শুধু অর্থের দিক থেকেই আল্লাহ্‌র বানী নয়, বরং এর প্রতিটা শব্দও আল্লাহ্‌র। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোরআনের আয়াতগুলি জিব্রাইল(আ) এর কাছে আবৃত্তি করেছেন, সেটা শুনে মুখস্থ করে একই ভংগিতে জিব্রাইল(আ) তা রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে আবৃত্তি করেছেন, এবং রাসূলুল্লাহ(সা) তা শুনে মুখস্থ করে একই ভংগিতে তা সাহাবাদের কাছে আবৃত্তি করেছেন। কাজেই আমরা যখন কোরআন পড়ি, তখন তা সরাসরি আমাদের স্রষ্টা, আমাদের রব, আমাদের প্রতিপালক, যিনি চিরজীবী, অসীম দয়ালু, পরম করুনাময়, তাঁর কথা পড়ি, তিনি যেভাবে পড়েছেন সেভাবে পড়ি। ব্যাপারটা কতটা থ্রিলিং একবার ভেবে দেখেছেন কি!

কোরআনের সকল সূরাকে সঠিক ক্রম অনুসারে একত্রিত করে, বই আকারে রূপ দেয়া লিখিত কপি, যার প্রথম সূরা ফাতিহা, শেষ সূরা নাস – তাকে ‘মুসহাফ’ বলে। কোরআনের সংজ্ঞায় মুসহাফ বলতে উসমান (রা) এর আমলে লিখিত ও সংকলিত কোরআনকে বুঝানো হয়। (এই মুসহাফ বা উসমানী কোরআন কি, তা কোরআন সংরক্ষণের ইতিহাস নিয়ে ভবিষ্যতের কোন এক লিখায় বলব ইনশাআল্লাহ্‌।)

সংজ্ঞায় এরপর বলা হয়েছিল ‘মুতাওয়াতির’ বর্ণনার কথা। যখন, কোন বিষয় সম্বন্ধে অনেক মানুষ আলাদা আলাদাভাবে বলে, কিন্তু একই কথা বলে, তখন ঐ বক্তব্যটি অবশ্যই সত্য। কারণ, বানিয়ে বানিয়ে বা ভুল করে অনেক ব্যক্তির পক্ষে কখনো একই বক্তব্য দেয়া সম্ভব নয়। বহুসূত্রের বর্ণনার এই ঐক্য পাওয়াকে ‘মুতাওয়াতির’ বলে। বিভিন্ন যুগের অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে আমরা কোরআনের যে কপিগুলো পাই তার সবগুলোই এক। কাজেই ‘মুতাওয়াতির’ অনুসারে, আমাদের হাতে এখন যে কোরআন আছে তা যে শুদ্ধ, তাতে কোন সন্দেহ নাই।

শেষের পয়েন্টটি কোরআনের অলৌকিকতা এবং মানবজাতির প্রতি আল্লাহ্‌র চ্যালেঞ্জের কথা বলে। কোরআন এমন একটি বই, যে এরকম একটি সম্পূর্ন বই তো দূরে থাক, বরং এর কোনও সূরার মত একটি সূরাও মানুষ কখনো আনতে লিখতে পারবে না। (বাক্বারাঃ ২৩-২৪)

৩। কোরআনকে পবিত্র কোরআন বলা ঠিক নয়ঃ  কোরআনে আল্লাহ্‌ এই বইটিকে কোরআন বলে সম্বোধন করেছেন ৭০ বারেরও বেশী। এছাড়াও, কোরআনে এবং হাদিসে কোরআনের আরও অনেক নাম এবং অনেক বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, কোথাও কোরআনকে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বা রাসূলুল্লাহ(সা) ‘পবিত্র’ (যার আরবি হলো ‘মুক্বাদ্দাস’) বলে সম্বোধন করেননি। কাজেই, আমাদের উচিত হবে এই সম্বোধনটি পরিত্যাগ করা। সম্ভবতঃ ‘পবিত্র’ বলার এই প্রবণতা আমরা অন্য ধর্মের লোকদের থেকে পেয়েছি। যেমনঃ খ্রীষ্টানরা তাদের ধর্মগ্রন্থকে The Holy Bible বা পবিত্র বাইবেল বলে থাকে। কিন্তু আমরা ইসলামের সঠিক পথে থাকতে চাই, তাই চাই কোরআন ও হাদিসকে অনুসরণ করতে এবং ধর্মে নতুন কিছু সংযোজন না করতে, আর তাই আমরা কোরআনকে ‘পবিত্র’ বলে সম্বোধন করব না।

আবুল মা’আলী এর মতে কোরআনে আল্লাহ্‌ কোরআনকে ৫০টিরও বেশী ভিন্ন ভিন্ন নামে সম্বোধন করেছেন। যেমনঃ আল-কিতাব  (বই), আল-কারীম (মহান), আল-হাকিম (জ্ঞানময়), আল-মাজিদ (মহিমান্বিত), আল-ফুরকান (সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী) , আল-জিক্‌র (সতর্ককারি, স্মারক) ইত্যাদি।

কাজেই, আমাদের উচিত হবে পবিত্র কোরআন না বলে কোরআনকে আল্লাহ্‌র দেয়া নাম, যেমনঃ কোরআন-উল-কারীম (মহাগ্রন্থ কোরআন), কোরআন-মাজিদ (মহিমান্বিত কোরআন) ইত্যাদি যে কোনো নামে একে সম্বোধন করা।

আজ এই পর্যন্তই। মহাগ্রন্থ কোরআন সম্বন্ধে জানুন, যতই জানবেন ততই এর প্রতি আপনার ভালবাসা বাড়বে, কারণ মানবজাতির জন্য এর চেয়ে সুন্দর উপদেশের বই এই পৃথিবীতে আর দুইটি নেই। ভবিষ্যতে কোরআন নাজিল এবং সংরক্ষণের ইতিহাস নিয়ে লিখব, ইন শা আল্লাহ্‌।

 

বাংলা উচ্চারণ, অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর(ব্যাখা) সহ কোরআন ডাউনলোডের ২টি লিংক নিচে দেয়া হল।

১। কোরআনের বাংলা উচ্চারণ ও অনুবাদসহ আশরাফ আলী থানভী এর সংক্ষিপ্ত তাফসীর – Download

২। কোরআনের বাংলা অনুবাদ ও প্রসিদ্ধ তাফসীরে আহসানুল বায়ান – Download

 

সূত্রঃ

১। An Introduction to the Sciences of The Qur’aan – Yasir Qadhi

২। An Introduction to the Sciences of the Qur’an – Ahmad von Denffer

৩। ইলমুত তাফসীর – মুফতী মুহাম্মাদ আবু ইউছুফ

No comments:

Post a Comment

Translate