Wednesday, March 27, 2024

সীরাত ২ – মহানবীর ﷺ কিছু নাম

 মহানবীর ﷺ বিশেষ বৈশিষ্ট্য – পর্ব ২: মহানবীর ﷺ  কিছু নাম

muhammad logo

আরবী ভাষায় কোন কিছুর গুরুত্ব বোঝাতে ও কোন কিছুর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করার অন্যতম একটা উপায় হচ্ছে তাকে বিভিন্ন নামে ডাকা। এই কারণেই, মহান আল্লাহ্‌ ﷻ কে আমরা বিভিন্ন নামে ডাকি – আর তার মধ্যে ৯৯টি নাম প্রসিদ্ধ। একইভাবে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এরও বহু নাম আছে – যার কিছু দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ্‌ ﷻ, কিছু দিয়েছেন সাহাবীরা, আর কিছু দিয়েছেন তাঁর প্রতি ভালবাসার প্রকাশ-স্বরূপ তাবে’ইরা ও পরবর্তী যুগের স্কলারেরা।  কোন কোন স্কলারের মতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ২৫০টিরও বেশী গুণবাচক নাম আছে। এখানে আমরা তাঁর এমন কিছু নাম নিয়ে আলোচনা করব যেগুলো স্বয়ং মহান আল্লাহ্‌ তাঁকে দিয়েছেন।

কুরআন মাজিদে বর্ণিত রাসূলের ﷺ নাম: 

কুরআন মাজিদে রাসূলুল্লাহ ﷺ কে অনেকগুলো বিশেষণে (Adjective) ভূষিত করা হয়ে থাকলেও তাঁর জন্য দুইটি মাত্র বিশেষ্য (Noun) ব্যবহার করা হয়েছে। এই দুইটি হলো –মুহাম্মাদ ও আহমাদ। মুহাম্মাদ নামটা কুরআনে মোট চারবার আছে, আর আহমাদ নামটা আছে একবার।

মুহাম্মাদ ও আহমাদ দুইটি নামই এসেছে “হামিদা” শব্দমূল থেকে। “হামদ” শব্দের অর্থ হলো প্রশংসা করা – এ প্রশংসা যেন-তেন রকমের প্রশংসা নয়, সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রশংসা, স্থান-কালের উর্দ্ধের প্রশংসা, যে প্রশংসা ধন্যবাদ জানানোর জন্য নয়, বরং গুণের কারণে করা হয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নামের মূলে “হামদ” ব্যবহারের অর্থ হলো – তিনি এমন একজন মানুষ যিনি সর্বসময়, সর্বাবস্থায় প্রশংসনীয়, তিনি যা তিনি তারই জন্য প্রশংসনীয়, তিনি তাঁর কর্মের কারণে প্রশংনীয়, আবার তিনি কিছু যদি না-ও করে থাকতেন তবুও শুধু সৃষ্টিগত কারণেই তিনি প্রশংসনীয়। তিনি বেঁচে থাকতে প্রশংসনীয়, মৃত্যুর পরেও প্রশংসনীয়, দুনিয়াতে প্রশংসনীয়, হাশরের মাঠে প্রশংসনীয়, এমনকি জান্নাতে প্রবেশের পরেও প্রশংসনীয় ।

এতো গেল সর্বসময়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর  প্রশংসিত হবার কথা। এবার আসুন দেখি কে কে তাঁর প্রশংসা করে? রাসূলুল্লাহ ﷺ এমন একজন মানুষ যার প্রশংসা স্বয়ং আল্লাহ্‌ ﷻ করেছেন, নবীরা করেছে, ফেরেশতারা করেছে, সমস্ত মানবজাতি করেছে – মুসলিমরা করেছে এমনকি অমুসলিমরাও করেছে।  মুসলিমরা তাঁর প্রশংসা করে তাঁর বাণীকে অনুসরণ করে। আর অমুসলিমরাও তাঁর প্রশংসা করে, যদিও তা সরাসরি নয়। অমুসলিমরা কিভাবে তাঁর প্রশংসা করে? তাঁর যে মানবীয় গুনাবলী – সত্যবাদীতা, দানশীলতা, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, স্নেহ, ন্যায়বিচার, কঠোর সংগ্রাম, মানব প্রেম, সেন্স অফ হিউমার – সেগুলো সকল যুগের সকল মানুষের কাছে গ্রহনীয়, প্রশংসনীয় – আর এই গুনগুলোর প্রশংসা করার মাধ্যমে অমুসলিমেরা ইনডাইরেক্ট ভাবে তাঁর প্রশংসা করে। মানব ইতিহাসে আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর চেয়ে বেশী প্রশংসিত মানুষ আর একটিও আসে নাই, আর একটিও আসবে না।

মুহাম্মাদ আর আহমাদ নাম দুইটার পার্থক্য কি? মুহাম্মাদ শব্দের অর্থ হচ্ছে যাকে অনবরত, একের পর এক প্রশংসা করে যাওয়া হয়। কাজেই, মুহাম্মাদ নামের মাধ্যমে আমাদের প্রিয়নবীর প্রশংসার সংখ্যাধিক্য কে বুঝানো হয়েছে (Quantity of praise)। আর আহমাদ বলতে বুঝায় সবচেয়ে ভালো উপায়ে যাকে প্রশংসা করা হয় (Quality of praise)। কাজেই, আহমাদ নামের মাধ্যমে আমাদের প্রিয়নবীর প্রশংসার গুনগত মানকে বুঝানো হয়েছে।  সকল ভালো গুণের সমারোহ , আর সকল ভালো গুনের আধিক্য – এই দুইয়ের সমন্বয়ই হলেন আমাদের প্রিয়নবী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ ﷺ ইবনে আব্দুল্লাহ।

আমরা যদি কুরআনে  রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নামগুলো কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে  সেদিকে তাকাই তাহলে দেখব – যখনই নবী মুসা (আ) এর মুখ দিয়ে রাসূলের ﷺ নাম উচ্চারিত হয়েছে তখনই ‘মুহাম্মাদ’ ব্যবহৃত হয়েছে; অন্যদিকে যখনই নবী ঈসা (আ) এর মুখ দিয়ে রাসূলের ﷺ নাম উচ্চারিত হয়েছে তখনই ‘আহমাদ’ ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনে রাসূলের ﷺ নামের ব্যবহারের এই পার্থক্য নিয়ে খুব চমৎকার একটা ব্যাখা দিয়েছেন ইবনুল কাইয়ূম (মৃত্যু ৭৫১ হিজরী)।

ইবনুল কাইয়ূম বলেন – আমরা জানি ‘মুহাম্মাদ’ নামের অর্থ হলো যাকে অনেক অনেক মানুষ প্রশংসা করে (Quantity of praise) আর ‘আহমাদ’ নামের অর্থ হলো যাকে সবচেয়ে ভালো গুণের মাধ্যমে প্রশংসা করা হয় (Quality of praise)। আমরা যদি নবী মুসা (আ) এর উম্মতের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব আমাদের নবী মুহাম্মাদের ﷺ পরে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক উম্মত ছিল মুসা (আ) এর। যেহেতু মুসা (আ) এর উম্মতেরা তাদের নিজেদের সংখ্যার কারণে গর্বিত, তাই মুসা (আ) তাঁর উম্মতদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, আমার পরে এমন এক নবী আসবে যে হবে কিনা ‘মুহাম্মাদ’ তথা তার উম্মতের সংখ্যা হবে তোমাদের চাইতেও বেশী। অন্যদিকে, নবী ঈসা (আ) এর হাওয়ারিদের (শিষ্য/Disciple) সংখ্যা ছিল কম, কিন্তু তাদের ইমান ছিলো খুবই মজবুত – শত অপবাদ, নিপীড়ন, অত্যাচারের মুখেও তারা নবী ঈসা (আ) কে দৃঢ়তার সাথে অনুসরণ করে গেছে। নবী ঈসা তার পরবর্তী নবীকে ‘আহমাদ’ নামে তাঁর উম্মতদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে – তিনি বলছেন – শোন, আমার পরে এমন এক নবী আসবে যে কিনা হবে আমার চেয়েও বেশী গুণে গুণান্বিত, ফলে তাঁর যারা হবে ছাত্র – সেই সাহাবা ও তাঁর উম্মতেরাও তোমরা হাওয়ারিদের চাইতেও বেশী গুণান্বিত হবে।

হাদিসে বর্ণিত রাসূলের ﷺ কিছু নাম:

“যুবাইর ইবনে মুত’ইম থেকে বর্ণিত। মহানবী ﷺ বলেছেন – আমার অনেকগুলো নাম আছে। আমি মুহাম্মাদ; আর আমি আহমাদ; আর আমি আল-মাহি, অর্থাৎ যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ কুফরী কে দূরীভূত করবেন; আর আমি আল-হাশির, কারণ আমার পদ অনুসরণ করে (অর্থাৎ আমার পরে) মানুষকে হাশর (উত্থান) করা হবে; আর আমি আল-‘আকিব, অর্থাৎ যার পরে আর কোন নবী আসবে না, আর আমি রহমতের নবী, আমি তাওবার নবী (অর্থাৎ আমাকে অনুসরণ করলে মানুষ ক্ষমা পাবে), আর আমি আল-মুকাফফা (একটা বৃহৎ চেইন এর সর্বশেষে এসে যে কোন কিছুকে পূর্নতা দেয়); আর আমি মালাহিমের নবী” । – (সাহিহ মুসলিম ও অন্যান্য) 

মালাহিম শব্দের অর্থ হলো – যিনি অনেক ফিতনার (trials and tribulations) বার্তা নিয়ে আসেন। রাসূল ﷺ নিজেকে মালাহিমের নবী বলেছেন কারণ – মানুষ সৃষ্টির পর থেকে সবচেয়ে বড় ফিতনা হলো দাজ্জাল, আর এই দাজ্জাল আসবে আমাদের নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উম্মাতের উপর। এছাড়া কেয়ামতের ছোট ও বড় যত আলামত আছে – সবই আসবে এই উম্মাতের উপর। নিজেকে মালাহিমের নবী বলার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে – তাঁর মৃত্যুর পর আমরা অনেক বেশী ফিতনা দেখতে পাব।

[মহানবীর মহাজীবন ফেইসবুক পেইজে (https://www.facebook.com/mohanobir.mohajibon.pbuh) এই লেখাটি পর্ব ২,৩ ও ৪ নামে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে ব্লগে ঐ তিনটি লেখাকে একত্রিত করে পর্ব-২ নাম প্রকাশ করা হলো।  ]

[ আগের পর্ব: মহানবীর ﷺ বিশেষ বৈশিষ্ট্য – পর্ব ১: অতুলনীয় মর্যাদা প্রাপ্ত একজন মানুষ ]

[মহানবীর ﷺ মহাজীবন সিরিজের লেখাগুলো মূলত: ১) শেইখ ইয়াসির কাযীর সীরাহ লেকচার ও ২) ড. সাল্লাবীর সিরাহ বইকে ভিত্তি করে লেখা হয়েছে।]

প্রাসঙ্গিক রেফারেন্স:

৩) http://corpus.quran.com/

৪) Meaning of Muhammad and Ahmad – http://en.islamtoday.net/quesshow-14-738.htm

No comments:

Post a Comment

Translate