ই লিখনিতে হিজরত সম্পর্কে মোট ৪টি প্রশ্ন ও উত্তর বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আশা করি এই লিখনি সম্পূর্ণ পড়লে হিজরত সম্পর্কে সকল সংশয় নিরসন হয়ে যাবে ইন শাহ আল্লাহ!!
প্রশ্ন ১: হিজরত কাকে বলে? হিজরত কত প্রকার ও কি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’আলার জন্য। দুরুদ বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর।
.
হিজরত’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘হাজর’ (الهجر) শব্দ থেকে, যার অর্থ: ত্যাগ করা বা পরিত্যাগ করা। অর্থাৎ, শিরকের দেশ পরিত্যাগ করে ইসলামের দেশে গমন করা।আর শরীয়তের পরিভাষায় হিজরত হলো যেসব বিষয় আল্লাহ অপছন্দ করেন এবং যেগুলোর প্রতি তিনি অসন্তুষ্ট, তা পরিত্যাগ করে, সেসব বিষয়ের দিকে ফিরে আসা,আগমন করা যা আল্লাহ পছন্দ করেন এবং যেগুলোর প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।” আরো সংক্ষিপ্তভাবে বললে, “আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দ্বীনের প্রতিকূল পরিবেশ ত্যাগ করে অনুকূল স্থানে গমন করাকে হিজরত বলে।”(বিস্তারিত জানতে দেখুন; “মু’জামু মাকায়িসিল লুগা”- ইবনে ফারিস; ১০২৩),”আস-সিহাহ” আল-জাওহারি; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৬৮২ ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ আলুশ শাইখ; শারহূ সালাসাতিল উসূল, পৃষ্ঠা: ২০৪)
.
কুরআন, সুন্নাহ এবং এই উম্মতের সালাফে সালেহীনের বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী, কিয়ামত পর্যন্ত জিহাদের পাশাপাশি হিজরতের বিধানও অব্যাহত ও প্রযোজ্য থাকবে।এটি কোনো কালে এই উম্মতের ওপর থেকে রহিত হয়নি, বরং কিয়ামতের বড় বড় নিদর্শন প্রকাশের আগে পর্যন্ত এর ওয়াজিব হওয়া অব্যাহত থাকবে।”মহান আল্লাহ বলেন:یٰعِبَادِیَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ اَرۡضِیۡ وَاسِعَۃٌ فَاِیَّایَ فَاعۡبُدُوۡنِ ﴿হে আমার মুমিন বান্দাগণ! নিশ্চয় আমার যমীন প্রশস্ত; কাজেই তোমরা আমারই ইবাদত কর।”(সূরা আনকাবুত;৫৬) আলোচ্য আয়াতে হিজরতের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে।যেখানে দ্বীন পালন করা যায় না, সেখানে বসবাসের ওজর গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহর জমিন প্রশস্ত তাই এমন স্থানে হিজরত করা আবশ্যক, যেখানে ইবাদত ও ইসলামী জীবন সহজে পালন করা যায়। সাহাবায়ে কিরামের হাবশা ও মদীনায় হিজরত তারই উদাহরণ। উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৭৪ হি.] বলেছেন:هذا أمر من الله لعباده المؤمنين بالهجرة من البلد الذي لا يقدرون فيه على إقامة الدين، إلى أرض الله الواسعة، حيث يمكن إقامة الدين، بأن يوحدوا الله ويعبدوه كما أمرهم” এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর মুমিন বান্দাদের জন্য একটি নির্দেশ, যে দেশে তারা যথাযথভাবে দ্বীন পালন করতে সক্ষম নন, সেখান থেকে হিজরত করে আল্লাহর এমন ভূমিতে চলে যাবে যেখানে দ্বীন পালন করা সম্ভব অর্থাৎ যেখানে তারা আল্লাহর তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী যথাযথভাবে ইবাদত করতে পারবেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ২৯০) হাদিসে রাসূল (ﷺ) বলেন, لاَ تَنْقَطِعُ الْهِجْرَةُ حَتَّى تَنْقَطِعَ التَّوْبَةُ وَلاَ تَنْقَطِعُ التَّوْبَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا‘হিজরত বন্ধ হবে না যতক্ষণ না তওবা বন্ধ হবে। আর তওবা বন্ধ হবে না যতক্ষণ না সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হয়’ (আবুদাউদ হা/২৪৭৯)। তিনি আরো বলেন, ‘যে পর্যন্ত কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ থাকবে, সে পর্যন্ত হিজরত বন্ধ হবে না।”(নাসাঈ হা/৪১৭২; সহীহুল জামে‘ হা/৫২১৮)
.
পক্ষান্তরে যে হাদিসে এসেছে, لَا هِجرةَ وَلَكِنْ جِهَادٌ وَنِيَّةٌ “মক্কা বিজয়ের পরে আর হিজরত নেই। কিন্তু জিহাদ ও হিজরতের নিয়ত অবশিষ্ট থাকবে”।(সহীহ বুখারী হা/১৮৩৪; মুসলিম হা/১৩৫৩; মিশকাত হা/২৭১৫)। হাদিসের বাক্য (لَا هِجْرَةَ) হিজরত নেই। এর অর্থ হল মক্কা বিজয়ের পূর্বে মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করা, কারণ তখন মক্কা ছিল কাফের মুশরিকদের অধীনে। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর এটি ইসলামী ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। সুতরাং মক্কা বিজয়ের পর এখন আর মক্কা থেকে হিজরত করার সুযোগ নেই। তবে যে সকল দেশ ও অঞ্চলে ঈমান ও দ্বীন রক্ষা করা কঠিন সে সকল স্থান থেকে অন্যত্র হিজরত করা ফরয যেখানে দ্বীন রক্ষা করা সহজ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা নিজদের প্রতি যুলমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবয করার সময় বলেন, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, আমরা যমীনে দুর্বল ছিলাম। ফেরেশতারা বলেন, আল্লাহর যমীন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম।আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল” (সূরা আন নিসা: ৪/৯৭)।শাইখুল ইসলাম ইমাম আবূ বাকার ইবনুল ‘আরাবী আল-মালিকী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৫৪৩ হি.] বলেন;الْهِجْرَةُ هِيَ الْخُرُوجُ مِنْ دَارِ الْحَرْبِ إلَى دَارِ الإِسْلامِ , وَكَانَتْ فَرْضًا فِي عَهْدِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَاسْتَمَرَّتْ بَعْدَهُ لِمَنْ خَافَ عَلَى نَفْسِهِ “হিজরতের অর্থ হলো দারুল হারব (অমুসলিমদের ভূমি) পরিত্যাগ করে দারুল ইসলাম (মুসলিমদের ভূমি)-এর দিকে গমন করা। এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে ফরজ ছিল এবং তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইন্তেকালের পরও যারা নিজের জানের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তাদের জন্য তা ফরজ হিসেবে অব্যাহত থাকবে।” (ইমাম শাওকানী; নায়েলুল আওতার, খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৩)
.
হিজরতের ফযীলত: এ বিষয়ে সূরা বাকারার এক আয়াতে রয়েছে- (إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَٰئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَتَ اللَّهِ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ) অর্থাৎ যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহ তা’আলারঅনুগ্রহ-প্রার্থী আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, করুণাময় [সূরা আল-বাকারাহঃ ২১৮] অনুরূপভাবে আছে- (الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ) অর্থাৎ যারা ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে মাল ও জান দ্বারা জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহ্র কাছে বিরাট পদমর্যাদার অধিকারী এবং তারাই সফলকাম”। [সূরা আত-তাওবাহঃ ২০] অন্যত্র এসেছে: (وَمَنْ يَخْرُجْ مِنْ بَيْتِهِ مُهَاجِرًا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ) অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও রাসূলের নিয়তে নিজ গৃহ থেকে বেরিয়ে পথেই মৃত্যুবরণ করে তার সওয়াব আল্লাহর যিম্মায় সাব্যস্ত হয়ে যায়”। [সূরা আন-নিসা: ১০০] মোটকথা, উপরোক্ত তিনটি আয়াতে দারুল কুফর থেকে হিজরতে উৎসাহ দান এবং এর বিরাট ফযীলত সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হিজরত পূর্বকৃত সব গোনাহকে নিঃশেষ করে দেয়।(সহীহ মুসলিম: হা/১২১; সহীহ ইবন খুযাইমাহ হা/২৫১৫] হিজরতের বরকত: হিজরতের বরকত সম্পর্কে সূরা নাহলের ৪১ নং আয়াতে বলা হয়েছে: “যারা আল্লাহর জন্য হিজরত করে নির্যাতিত হওয়ার পর, আমি তাদেরকে দুনিয়াতে উত্তম ঠিকানা দান করবো এবং আখেরাতের বিরাট সওয়াব তো রয়েছেই, যদি তারা বুঝে সূরা নিসার উল্লেখিত চার আয়াতে বলা হয়েছে: “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে হিজরত করবে, সে পৃথিবীতে অনেক জায়গা ও সুযোগসুবিধা পাবে”।
.
হিজরতের প্রকারভেদ:
.
এই উম্মতের নেককার পূর্বসূরি সালাফে সালেহীন ও বিশিষ্ট আলেমগণ বর্ণনা করেছেন যে, শরিয়তসম্মত হিজরত কয়েকভাগে বিভক্ত:
.
(১).“দারুল কুফর থেকে দারুল ইসলামের দিকে হিজরত অর্থাৎ এমন স্থান ত্যাগ করা, যেখানে ইসলামী জীবন বিধান পালন করা কঠিন বা অসম্ভব এবং কুফরি শাসনব্যবস্থা কার্যকর; সেই স্থান থেকে এমন ভূমিতে স্থানান্তর করা, যেখানে ইসলামের বিধান, শিক্ষা ও শরিয়াহ অনুযায়ী জীবনযাপন সহজ ও নির্বিঘ্ন।”
.
(২).বিদআতের ঘনঘটায় আক্রান্ত ভূমি হতে সুন্নাহর আলোপ্রাপ্ত ভূমিতে হিজরত: অর্থাৎ যে ভূখণ্ডে শরিয়তবিরোধী নতুন নতুন বিদআত সমাজে প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ ত্যাগ করে এমন ভূমিতে হিজরত করা, যেখানে রাসূল ﷺ)-এর পবিত্র সুন্নাহর আলো ছড়িয়ে আছে এবং তা পূর্ণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে বাস্তবায়িত হয় এই হিজরত প্রকৃতপক্ষে দ্বীনের সঠিক পথে ফিরে আসার এক গৌরবময় পদক্ষেপ।”
.
(৩).ফাসিকতা ও হারামের আধিপত্য বিস্তারকারী অঞ্চল থেকে পবিত্র ও সংযমী জীবনের পরিবেশে হিজরত:অর্থাৎ যে সমাজে প্রকাশ্য পাপাচার,লজ্জাহীনতা ও হারাম কাজের প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছে, সেখান থেকে হিজরত করে এমন এক পরিবেশে আশ্রয় নেওয়া, যেখানে পরহেজগারিতা, সংযম ও দ্বীনদারির চর্চা সুপ্রতিষ্ঠিত এটাই হলো এক পবিত্র ও নৈতিক জীবনযাপনের সন্ধানে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ।”
(৪).জুলুম ও নির্যাতনের আশঙ্কায় আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে হিজরত: অর্থাৎ যখন কোনো ব্যক্তি তার জান-মাল, পরিবার বা ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং নির্যাতনের আশঙ্কা থাকে, তখন সে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অন্যত্র গমন করে এটাই আত্মরক্ষামূলক হিজরত।”(ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭২৯৫৫)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম আবূ বাকার ইবনুল ‘আরাবী আল-মালিকী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৫৪৩ হি.] বলেন;
الهجرة وهي تنقسم إلى ستة أقسام :
الأول : الخروج من دار الحرب إلى دار الإسلام ، وكانت فرضا في أيام النبي صلى الله عليه وسلم مع غيرها من أنواعها ، وهذه الهجرة باقية مفروضة إلى يوم القيامة ، والتي انقطعت بالفتح هي القصد إلى النبي صلى الله عليه وسلم حيث كان .
الثاني : الخروج من أرض البدعة ، قال ابن القاسم : سمعت مالكا يقول : لا يحل لأحد أن يقيم ببلد يسب فيها السلف .
وهذا صحيح ، فإن المنكر إذا لم يقدر على تغييره نزل عنه ، قال الله تعالى : ( وإذا رأيت الذين يخوضون في آياتنا فأعرض عنهم حتى يخوضوا في حديث غيره وإما ينسينك الشيطان فلا تقعد بعد الذكرى مع القوم الظالمين ) الأنعام/68 .
وقد كنت قلت لشيخنا الإمام الزاهد أبي بكر الفهري : ارحل عن أرض مصر إلى بلادك فيقول : لا أحب أن أدخل بلادا غلب عليها كثرة الجهل وقلة العقل ، فأقول له : فارتحل إلى مكة أقم في جوار الله وجوار رسوله ، فقد علمت أن الخروج عن هذه الأرض فرض لما فيها من البدعة والحرام ، فيقول : وعلى يدي فيها هُدَى كثير وإرشاد للخلق وتوحيد وصد عن العقائد السيئة ودعاء إلى الله عز وجل .
الثالث : الخروج عن أرض غلب عليها الحرام ؛ فإن طلب الحلال فرض على كل مسلم .
الرابع : الفرار من الإذاية في البدن ، وذلك فضل من الله عز وجل أرخص فيه ، فإذا خشي المرء على نفسه في موضع فقد أذن الله سبحانه له في الخروج عنه والفرار بنفسه ليخلصها من ذلك المحذور ، وأول من حفظناه فيه الخليل إبراهيم عليه السلام لما خاف من قومه قال : ( إني مهاجر إلى ربي ) العنكبوت/26 ، وقال : ( إني ذاهب إلى ربي سيهدين ) الصافات/99 وموسى قال الله سبحانه فيه : ( فخرج منها خائفا يترقب قال رب نجني من القوم الظالمين ) القصص/21 .
الخامس : خوف المرض في البلاد الوخمة والخروج منها إلى الأرض النزهة ، وقد أذن النبي صلى الله عليه وسلم للرعاء حين استوخموا المدينة أن يتنزهوا إلى المسرح فيكونوا فيه حتى يصحوا ، وقد استثني من ذلك الخروج من الطاعون فمنع الله سبحانه منه بالحديث الصحيح عن النبي صلى الله عليه وسلم .
السادس : الفرار خوف الأذية في المال ، فإن حرمة مال المسلم كحرمة دمه ، والأهل مثله أو آكد “
“হিজরত ছয় ভাগে বিভক্ত:
প্রথম ধরণের হিজরত হল: দারুল হারব (অমুসলিম শত্রুদের দেশ) থেকে দারুল ইসলাম (ইসলামী রাষ্ট্র) এ হিজরত করা। এটি হিজরতের একটি বৈধ ও স্থায়ী ধরন, যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগেও ছিল অন্যান্য ধরণের হিজরতের পাশাপাশি। এই হিজরত কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে এবং তা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মুসলিমদের জন্য আবশ্যক (ফরজ) থাকবে। আর যে হিজরত ফাতহে মক্কার পর বন্ধ হয়ে গেছে, তা হল সেই হিজরত যার মাধ্যমে মুসলিমরা সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যেতেন, যেখানে তিনি অবস্থান করতেন।
.
দ্বিতীয় প্রকার হিজরত হল: বিদআতি ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়া। ইবনুল কাসিম (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: আমি ইমাম মালিক (রহিমাহুল্লাহ) কে বলতে শুনেছি কোনো ব্যক্তির জন্য এমন স্থানে বা দেশে অবস্থান করা বৈধ নয়, যেখানে সালাফদের (অতীতের নেককার মনিষী) গালি দেওয়া হয়। এবং এটি সঠিক, কেননা যদি কেউ কোনো মন্দ (অপরাধ, গুনাহ) কাজ প্রতিরোধ করতে না পারে, তাহলে তার থেকে দূরে সরে যাওয়া কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর যখন তুমি দেখো যে,তারা আমাদের আয়াতসমূহ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপে লিপ্ত, তখন তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, যতক্ষণ না তারা অন্য প্রসঙ্গে প্রবেশ করে। আর যদি শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পর তুমি যেন ওই জালিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসো না।”[সূরা আল-আনআম, আয়াত: ৬৮] আমি একবার আমাদের শায়েখ ইমাম আবু বকর আল-ফাহরীকে বলেছিলাম: আপনি মিসর ত্যাগ করে আপনার দেশে হিজরত করুন।”তিনি বলতেন: “আমি এমন দেশে যেতে পছন্দ করি না যেখানে অজ্ঞতা বেশি এবং বুদ্ধিমত্তা কম।” আমি বলতাম: “তাহলে মক্কায় হিযরত করুন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতিবেশী হয়ে বসবাস করুন। আপনি তো জানেনই এই ভূমি (মিসর) ত্যাগ করা ফরয হয়ে গেছে, কেননা এখানে বিদআত ও হারাম ব্যাপক। তিনি বলতেন: “এই দেশে আমার মাধ্যমে অনেক মানুষ হিদায়াত পেয়েছে,আমি মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছি, তাওহীদ শিক্ষা দিয়েছি, তাদেরকে ভ্রান্ত আক্বীদা থেকে ফিরিয়ে আনছি, তাদেরকে তাওহিদের পথে আহ্বান জানিয়েছি।
.
তৃতীয় প্রকার হিজরত হল: এমন একটি দেশ ত্যাগ করা, যেখানে নিষিদ্ধ তথা হারাম জিনিসগুলি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, কারণ যা হালাল তা অন্বেষণ করা প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ।
.
চতুর্থ প্রকার হিজরত হল: জীবন রক্ষার্থে (শারীরিক ক্ষতি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে) হিজরত করা। এটি আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশেষ অনুগ্রহ,যা তিনি সহজ করে দিয়েছেন। সুতরাং, যদি কেউ কোনো স্থানে নিজের ওপর ক্ষতির আশঙ্কা করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে সেই স্থান ত্যাগ করে নিজের জীবন রক্ষা করার জন্য সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।যাতে সে নিজেকে সেই নিষিদ্ধ ও বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে পারে। এই রকম হিজরতের প্রথম উদাহরণ আমরা পেয়েছি নবী ইব্রাহিম (আলাইহিস্ সালাম)-এর মাধ্যমে। যখন তিনি তাঁর কওমের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন: “নিশ্চয়ই আমি আমার প্রতিপালকের দিকে হিজরত করছি।[সূরা আল-আনকাবুত: ২৬] তিনি আরও বলেছেন: “আমি আমার প্রভুর দিকে যাচ্ছি; তিনি অবশ্যই আমাকে পথ দেখাবেন।[সূরা আস-সাফফাত: ৯৯] আর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর ব্যাপারে আল্লাহ বলেন: অতঃপর সে (মূসা) শহর ত্যাগ করল ভীত ও সতর্ক অবস্থায়। সে বলল, হে আমার রব! তুমি আমাকে যালিম কওম থেকে উদ্ধার কর।”[সূরা আল-কাসাস: ২১]
.
পঞ্চম প্রকার হিজরত হল: রোগব্যাধির আশঙ্কায় ভুগতে থাকা অস্বাস্থ্যকর বা দূষিত জায়গা থেকে স্বাস্থ্যকর ও মনোরম স্থানে চলে যাওয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু উটচারক রাখালকে মদীনার পরিবেশে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেখান থেকে তাজা বাতাস ও বিশুদ্ধ আবহাওয়ার জন্য শহরের বাইরে ‘মুসরাহ নামক স্থানে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন, যাতে তারা সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে এ বিষয়ে একটি ব্যতিক্রম হলো প্লেগ বা মহামারির সময় স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়া নিষিদ্ধ, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ (সহীহ) হাদীসে এই নিষেধাজ্ঞা এসেছে যে, “যেখানে প্লেগ দেখা দিয়েছে, সেখানে প্রবেশ করো না, আর যেখানে প্লেগ আছে, সেখান থেকে বের হয়ো না।”
.
ষষ্ঠ প্রকার হিজরত হল: মালের বা সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বা ধ্বংসের আশঙ্কা থেকে পলায়ন, অর্থাৎ সম্পদ রক্ষার্থে স্থান ত্যাগ করা। কারণ একজন মুসলিমের সম্পদের মর্যাদা তার রক্তের মর্যাদার মতোই পবিত্র; বরং তার পরিবার পরিজনের সম্মান তার চেয়েও বেশি মর্যাদাপূর্ণ।”(ইবনুল আরাবি, আহকামুল কুরআন; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৬১২ ইমাম-কুরতুবি, তাফসিরুল কুরতুবি; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩৩০)
▬▬▬▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রশ্ন ২: শরিয়তের ওপর পূর্ণভাবে আমল করা (যেমন দাড়ি রাখা, টাখনুর ওপর কাপড়, কুরআন সুন্নাহর সঠিক বক্তব্য যেখানে বাধাগ্রস্ত হয়, সেখান থেকে কি হিজরত ওয়াজিব?
উত্তর: আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, ‘আল্লাহর পথে হিজরত’ বলতে সাধারণত বোঝানো হয় একটি এমন (অঞ্চল) ভূমি ত্যাগ করা, যেখানে কুফর, শিরক, আকীদাগত বিদ‘আত, হারাম কাজ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও শরীয়তবিরোধী আইন-শাসন প্রচলিত; যেখানে ইসলামের চর্চা বাধাগ্রস্ত হয় এবং দ্বীনের উপর চলা নিরাপদ নয় এবং যেখানে মৃত্যুর ভয় বিদ্যমান এমন অঞ্চল থেকে হিজরত করে এমন নিরাপদ স্থানে গমন করা, যেখানে ইসলামী পরিবেশ বিদ্যমান, শরীয়াহর বিধান পালনে স্বাধীনতা রয়েছে এবং দ্বীন পালন নিরাপদ। এই হিজরতের মূল উদ্দেশ্য হলো নিজের ঈমান-আক্বীদা ও দ্বীনের হেফাজত করা, যেন তা দুর্বল না হয় বা ধ্বংস না হয়। এক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই যে, সেই দেশটি সরাসরি কুফর রাষ্ট্র হোক বা এমন কোনো তথাকথিত মুসলিম দেশ হোক, যা কার্যত সেকুলার, যেখানে সমাজে অনাচার, অশ্লীলতা ও পাপাচার ছড়িয়ে পড়েছে এবং দ্বীন পালনে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। শাইখুল ইসলাম নাসিরুল হাদীস ফাক্বীহুল মিল্লাত ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফি‘ঈ আল-মাক্কী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৫০ হি: মৃত: ২০৪ হি.] বলেছেন:دلت سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم على أن فرض الهجرة على من أطاقها إنما هو على من فتن عن دينه بالبلد الذي يسلم بها.“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ প্রমাণ করে যে, হিজরত কেবল তাদের জন্য ফরজ, যারা এমন দেশে বাস করে, যেখানে তাদের দ্বীনের ওপর ফিতনা বা নির্যাতন চালানো হয়। এই হুকুমে কোনো পার্থক্য নেই যে সেটি কোনো কুফরি রাষ্ট্র হোক বা এমন কোনো তথাকথিত মুসলিম রাষ্ট্র হোক, যেখানে পাপাচার, অশ্লীলতা ও অপবিত্রতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।”(আল-উম্ম; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৭৭)
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন: المساكن بحسب سكانها، فهجرة الإنسان من مكان الكفر والمعاصي إلى مكان الإيمان والطاعة ، كتوبته وانتقاله من الكفر والمعصية إلى الإيمان والطاعة ، وهذا أمر باق إلى يوم القيامة ، والله تعالى قال: (والذين آمنوا وهاجروا وجاهدوا معكم فأولئك منكم) “বসবাসের স্থানকে তার অধিবাসীদের ধর্মীয় অবস্থার ভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিত। সুতরাং,একজন মানুষের জন্য কুফর ও পাপাচারের স্থান থেকে ঈমান ও আনুগত্যের স্থানে হিজরত করা একটি স্থায়ী বিধান, যা কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।আল্লাহ তাআলা বলেন: আর যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং তোমাদের সঙ্গে জিহাদ করেছে তারাই তোমাদের অন্তর্ভুক্ত।”(সূরা আল-আনফাল: ৭৫; ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ২৮৪)
.
ইবনু হাজর আল-হাইতামী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:”الهجرة: شرعًا: مفارقة دار الكفر إلى دار الإسلام خوف الفتنة، ووجوبها باقٍ”শরিয়তের দৃষ্টিতে হিজরত হলো: ফিতনার ভয়ে কুফরের দেশ ত্যাগ করে মুসলিম দেশে চলে আসা। আর হিজরতের এই বিধান এখনো (কিয়ামত পর্যন্ত) বহাল রয়েছে।”(আল-ফাতহুল মু’বীন বি শারহিল আরবাঈন পৃ. ১৩১) মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ গ্রন্থে এ এসেছে:والهجرة في الاصطلاح: الانتقال من دار الكفر إلى دار الإسلام. فإن كانت قربة لله، فهي الهجرة الشرعية” ان “পারিভাষিক অর্থে হিজরত হচ্ছে: কুফরের দেশ থেকে মুসলিম দেশে স্থানান্তর। আর যদি এই স্থানান্তর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে একে বলা হয়, শরঈ হিজরত (শরিয়তের দৃষ্টিতে হিজরত)। (মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, খণ্ড: ৪২; পৃষ্ঠা: ১৭৭)
.
এই হিজরতের অন্তর্ভুক্ত সেই হিজরতও, যা পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর যে কেউ আল্লাহর পথে হিজরত করে, সে পৃথিবীতে অনেক আশ্রয় ও প্রাচুর্য পাবে। আর যে ব্যক্তি তার বাড়ি থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে হিজরতের জন্য বের হয়, তারপর মৃত্যু এসে তাকে আচ্ছন্ন করে তাহলে তার প্রতিদান অবশ্যই আল্লাহর কাছে স্থির হয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০০) উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম তাবারী বলেন: قوله: “ومن يهاجر في سبيل الله”، يقول: من يخرج من أرض الشرك وأهلها إلى دار الإسلام وأهلها، فارًّا بدينه من أرض الكفر إلى دار الإسلام.অর্থাৎ: ‘আর যারা আল্লাহর পথে হিজরত করে’ এর অর্থ হলো যে ব্যক্তি শিরকের ভূমি ও তার অধিবাসীদের ত্যাগ করে, নিজের দ্বীন রক্ষার উদ্দেশ্যে কুফরের দেশ থেকে ইসলামীক দেশে এবং সেখানকার মুমিনদের দিকে হিজরত করে। ‘আল্লাহর পথে’ বলতে বোঝানো হয়েছে আল্লাহর দ্বীনের পথে, অর্থাৎ সেই পথ, যা আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্ট মানবজাতির জন্য নির্ধারণ করেছেন।”(তাফসীরে তাবারী; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৩৯১) ইমাম শওকানী (রহ.) বলেন:وقوله: (في سبيل الله) فيه دليل: على أن الهجرة لا بد أن تكون بقصد صحيح، ونية خالصة غير مشوبة بشيء من أمور الدنيا، ومنه الحديث الصحيح: «فمن كانت هجرته إلى الله ورسوله فهجرته إلى الله ورسوله، ومن كانت هجرته إلى دنيا يصيبها أو امرأة يتزوجها فهجرته إلى ما هاجر إليه” ا
“আল্লাহর পথে থাকা এই বাক্যাংশে প্রমাণ রয়েছে যে, হিজরতের জন্য অবশ্যই সঠিক উদ্দেশ্য থাকতে হবে এবং নিয়ত হতে হবে খাঁটি, যাতে দুনিয়ার কোনো বিষয় এতে মিশ্রিত না থাকে। এর সঙ্গে সেই সহীহ হাদীসটি রয়েছে: ‘যার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য হবে; আর যার হিজরত হয় দুনিয়া লাভের জন্য বা কোনো নারীকে বিয়ে করার জন্য, তার হিজরতও সেই উদ্দেশ্যের জন্যই গণ্য হবে।” (ফাতহুল কাদীর, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫৮৩)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] {وَمَنْ يُهَاجِرْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يَجِدْ فِي الْأَرْضِ مُرَاغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةً} আর যারা আল্লাহর পথে হিজরত করবে, তারা পৃথিবীতে অনেক আশ্রয়স্থল ও প্রাচুর্য পাবে।”
(সূরা আন-নিসা: আয়াত ১০০) এই আয়াতের প্রেক্ষিতে বলেন;الهجرة، ترك البلاد التي لا يقيم الإنسان فيها دينه، إلى بلاد أخرى يقيم فيها دينه. وعبر عنها بعضهم بقوله: الانتقال من بلد الشرك إلى بلد الإسلام”হিজরত অর্থ হলো এমন দেশ ত্যাগ করা, যেখানে মানুষ তার দ্বীন কায়েম করতে পারে না, এবং অন্য এমন দেশে চলে যাওয়া, যেখানে সে তার দ্বীন কায়েম করতে সক্ষম হয়। কেউ কেউ একে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন: শিরকের দেশ থেকে ইসলামের দেশে স্থানান্তর করা। (তাফসীর ইবনু উসাইমীন, সূরা আন-নিসা, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১২৩)
.
অপর আয়াতে আল্লাহ আরো বলেন:اِنَّ الَّذِیۡنَ تَوَفّٰهُمُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ ظَالِمِیۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ قَالُوۡا فِیۡمَ کُنۡتُمۡ ؕ قَالُوۡا کُنَّا مُسۡتَضۡعَفِیۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ قَالُوۡۤا اَلَمۡ تَکُنۡ اَرۡضُ اللّٰهِ وَاسِعَۃً فَتُهَاجِرُوۡا فِیۡهَا ؕ فَاُولٰٓئِکَ مَاۡوٰىهُمۡ جَهَنَّمُ ؕ وَ سَآءَتۡ مَصِیۡرًا”তাদের প্রাণগ্রহণের সময় ফিরিশতাগণ বলে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম: তারা বলে, ‘আল্লাহর যমীন কি এমন প্রশস্ত ছিল না যেখানে তোমরা হিজরত করতে(১)? এদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম, আর তা কত মন্দ আবাস!”(সূরা নিসা: ৯৭) এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা এমন মানুষদের কথা বলছেন যাদের ফেরেশতারা মৃত্যুর সময় তাদের আত্মা গ্রহণ করার সময় জিজ্ঞেস করেন তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা জবাব দেয় “আমরা তো পৃথিবীতে অসহায় ছিলাম।” কিন্তু ফেরেশতারা তখন বলেন “আল্লাহর যমীন কি এতটাই সংকীর্ণ ছিল যে, সেখানে তোমরা হিজরত করে অন্যত্র চলে যেতে পারতে না?” এই আয়াতের মূল শিক্ষা হলো: যারা ইসলামের উপর খোলাখুলি আমল করতে পারে না, কিন্তু সেই অবস্থায় থেকেও তারা হিজরত করে ইসলামি পরিবেশ বা নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করে না, তারা আসলে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। “অসহায়” বললেই দায়মুক্তি হয় না, যদি হিজরত করার সুযোগ ও সামর্থ্য থাকে। তাদের জন্য হুঁশিয়ারি: যদি তারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হিজরত না করে কুফরি পরিবেশে পড়ে থাকে, তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম।হাদীসে এসেছে, আবূ সা‘ঈদ আল খুদ্রী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের আগেকার লোকেদের মধ্যে এক লোক ছিল। সে নিরানব্বই লোককে হত্যা করেছে। তারপর জিজ্ঞেস করল, এ দুনিয়াতে সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান লোক কে? তাকে এক ‘আলিম দেখিয়ে দেয়া হয়। সে তার নিকট এসে বলল যে, সে নিরানব্বই লোককে হত্যা করেছে। এমতাবস্থায় তার জন্য কি তাওবাহ্ আছে? ‘আলিম বলল, না। তখন সে ‘আলিমকেও হত্যা করে ফেলল। সুতরাং সে ‘আলিমকে হত্যা করে একশ’ সম্পূর্ণ করল। অতঃপর সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, এ দুনিয়াতে সবচেয়ে জ্ঞানী কে? তখন তাকে জনৈক ‘আলিম লোকের সন্ধান দেয়া হলো। সে ‘আলিমকে বলল যে, সে একশ’ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, তার জন্য কি তাওবাহ্ আছে? ‘আলিম লোক বললেন, হ্যাঁ। এমন কে আছে যে ব্যক্তি তার মাঝে ও তার তাওবার মাঝে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে? তুমি অমুক দেশে যাও। সেখানে কিছু লোক আল্লাহর ‘ইবাদাতে নিমগ্ন আছে। তুমিও তাদের সাথে আল্লাহর ‘ইবাদাতে লিপ্ত হও। নিজের ভূমিতে আর কক্ষনো প্রত্যাবর্তন করো না। কেননা এ দেশটি ভয়ঙ্কর খারাপ। তারপর সে চলতে লাগল। এমনকি যখন সে মাঝপথে পৌঁছে তখন তার মৃত্যু আসলো। এবার রহ্মাতের ফেরেশ্তা ও ‘আযাবের ফেরেশ্তার মধ্যে তার ব্যাপারে বাক-বিতন্ডা দেখা গেল। রহ্মাতের ফেরেশ্তারা বললেন, সে আন্তরিকভাবে আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাওবার উদ্দেশে এসেছে। আর ‘আযাবের ফেরেশ্তারা বললেন, সে তো কক্ষনো কোন সৎ কাজ করেনি। এমতাবস্থায় মানুষের আকৃতিতে এক ফেরেশ্তা আসলেন। তাঁরা তাঁকে তাঁদের মাঝে মধ্যস্থতা বানালেন। তিনি উভয়কে বললেন, তোমরা উভয় স্থান পরিমাপ কর (নিজ ভূখণ্ড ও যাত্রাকৃত ভূখণ্ড)। এ দু’টি ভূখণ্ডের মধ্যে যা সন্নিকটবর্তী হবে সে অনুযায়ী তার ফায়সালা হবে। তারপর উভয়ে পরিমাপ করে দেখলেন যে, সে ঐ ভূখণ্ডেরই বেশি নিকটবর্তী যেখানে পৌঁছার জন্যে সংকল্প করেছে। অতঃপর রহ্মাতের ফেরেশ্তা তার রূহ কবয করে নিলেন। কাতাদাহ্ (রহঃ) বলেন, হাসান (রহঃ) বলেছেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করা হয়েছে যে, যখন তার মৃত্যু এলো, তখন সে বুকের উপর ভর দিয়ে কিছু এগিয়ে গেল। (সহীহ মুসলিম হা/৬৯০১; ই.ফা. ৬৭৫২)
.
উক্ত হাদীসের আলোকে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, আবুল ফাদল আহমাদ বিন আলি ইবনু হাজার আল-আসকালানি,(রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম:৭৭৩ হি: মৃত:৮৫২ হি:] বলেন:فِيهِ : فَضْلُ التَّحَوُّلِ مِنَ الْأَرْضِ الَّتِي يُصِيبُ الْإِنْسَانُ فِيهَا الْمَعْصِيَةَ ، لِمَا يَغْلِبُ بِحُكْمِ الْعَادَةِ عَلَى مِثْلِ ذَلِكَ ، إِمَّا لِتَذَكُّرِهِ لِأَفْعَالِهِ الصَّادِرَةِ قَبْلَ ذَلِكَ وَالْفِتْنَةِ بِهَا ، وَإِمَّا لِوُجُودِ مَنْ كَانَ يُعِينُهُ عَلَى ذَلِكَ وَيَحُضُّهُ عَلَيْهِ ؛ وَلِهَذَا قَالَ لَهُ الْأَخِيرُ ( وَلَا تَرْجِعْ إِلَى أَرْضِكَ فَإِنَّهَا أَرْضُ سُوءٍ ) ؛ فَفِيهِ إِشَارَةٌ إِلَى أَنَّ التَّائِبَ يَنْبَغِي لَهُ مُفَارَقَةُ الْأَحْوَالِ الَّتِي اعْتَادَهَا فِي زَمَنِ الْمَعْصِيَةِ وَالتَّحَوُّلُ مِنْهَا كلهَا ” انتهى من “এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়, এমন একটি স্থান থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়ায় একটি সদকাহ বা সওয়াব রয়েছে, যেখানে একজন ব্যক্তি পাপের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। কারণ, সেখানে থাকলে তার অনুতাপের অনুভূতি বিঘ্নিত হয়; কারণ সেখানে সে তার পূর্ববর্তী ভুল কাজগুলোর কথা বারংবার স্মরণ করে এবং আবার সেগুলো করতে প্রলুব্ধ হতে পারে। অথবা সেইসব সঙ্গী-সাথীর উপস্থিতি, যারা তাকে সেই গোনাহে সহায়তা করত বা উৎসাহ দিত। এজন্য একজন জ্ঞানী ব্যক্তি তাকে বলেছিল, তুমি তোমার সেই জায়গায় ফিরে যেও না, কারণ সেটি একটি খারাপ জায়গা।এর মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে: তাওবাকারী ব্যক্তির জন্য উচিত,তার পূর্বের পাপের সময় যে পরিস্থিতির সাথে সে অভ্যস্ত ছিল তা ত্যাগ করা এবং সেই পুরাতন পরিবেশ ও অভ্যাসগুলো থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া”। (ইবনু হাজার; ফাতহুল বারী, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৫১৭)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে, জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন; সন্মানিত শাইখ, এই চিঠিটি সুদান থেকে পাঠিয়েছেন এক ভাই, যিনি নিজেকে “মীম, আলিফ, হা” দ্বারা পরিচিত করেছেন। তিনি লিখেছেন: “আমি এমন এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে ইসলামী শরিয়াহ্ সম্পূর্ণরূপে কার্যকর নয়। আমার পক্ষে এই সমাজকে শরিয়াহ্ অনুযায়ী পরিচালিত করতে বাধ্য করাও সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে কি আমার উপর কোনো গুনাহ বর্তাবে?” উত্তরে শাইখ বলেন:
إذا أمكن من يعيش في بلاد لا تطبق الشريعة.. إذا أمكنه أن يهاجر إلى بلاد تطبق الشريعة، وجب عليه الهجرة إذا استطاع ذلك، فإن لم يستطع فلا حرج عليه في الإقامة، ويتقي الله ما استطاع ويرشد إلى الخير وينصح العباد، ويدعو إلى تحكيم الشريعة حسب طاقته، وهو مأجور في هذه الحالة، وإذا كان هناك قدرة على إلزام بحق ومنع باطل لكونه رئيساً أو شيخ قبيلة أو أمير قرية في هذا يستطيع في هذه الأشياء، إذا علم الله منه الصدق أعانه، فهو يفعل ما يستطيع من تحكيم الشريعة حسب طاقته، كونه شيخ قبيلة يحكم الشريعة فيهم إذا كان يعلم، عنده معلومات، كونه أمير قرية يستطيع يحكم فيهم الشريعة فيما يتنازعون فيه عنده وما أشبه ذلك، فالمقصود أنه يجتهد ويتقي الله ما استطاع، ولا يكلف الله نفساً إلا وسعها، ويدعو الله لولاة الأمور بالهداية، أن الله يهديهم ويوفقهم أو يأتي بغيرهم ممن يحكم الشريعة هكذا، أما إن قدر أنه يهاجر وينتقل إلى بلاد تحكم الشريعة فهذا واجب عليه، إلا إذا كان يعني عالماً عنده معلومات وبصيرة وهدى، ويرى أن إقامته في هذه البلد فيها دعوة إلى الله وفيها توجيه الناس إلى الخير وفيها إرشادهم إلى توحيد الله وإنقاذهم وإخراجهم من الظلمات إلى النور، هذا له أجره في ذلك من أجل الدعوة، من أجل التوجيه إلى الخير، من أجل إنقاذ الناس مما هم فيه من الباطل، فهو على خير عظيم، ولا تلزمه الهجرة في هذه الحال؛ لأنه يظهر دينه ولأن عنده معلومات في دينه لا يخشى على نفسه من شبهاتهم فلا بأس. نعم.
“যদি কোন মুসলিম এমন দেশে বসবাস করে যেখানে শরিয়াহ আইন কার্যকর নয়, এবং যদি তার পক্ষে এমন কোন দেশে হিজরত করা সম্ভব হয় যেখানে শরিয়াহ আইন বাস্তবায়িত হয়,তাহলে তার জন্য হিজরত করা ওয়াজিব (অবশ্যক)। কিন্তু যদি তার পক্ষে হিজরত করা সম্ভব না হয়, তাহলে সে ঐ দেশেই অবস্থান করতে পারে, কিন্তু তার দায়িত্ব হবে আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় করা, নেক কাজে উৎসাহ দেওয়া, মানুষকে উপদেশ দেওয়া এবং নিজের সামর্থ্যানুযায়ী শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার দাওয়াত দেওয়া। এ অবস্থায় সে সওয়াবপ্রাপ্ত হবে। যদি তার এমন প্রভাব বা ক্ষমতা থাকে যেমন গ্রামের চেয়ারম্যান, গোত্র প্রধান, বা কোনো অঞ্চলের শাসক,তাহলে তার ওপর আবশ্যক হচ্ছে, সে শরিয়াহ্ মোতাবেক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে, সৎকাজের আদেশ করে এবং মন্দকে প্রতিহত করে, যতটুকু তার ক্ষমতা আছে। যদি সে আন্তরিক হয়, তাহলে আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন। সে নিজের আওতাধীন জনগণের মাঝে শরিয়াহ্র বিধান বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। যেমন তাদের পারস্পরিক বিরোধ মীমাংসা করা, সঠিকভাবে ফয়সালা করা ইত্যাদি।
সারকথা হলো: তার উচিত হবে আল্লাহকে ভয় করা এবং নিজের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করা। কারণ, আল্লাহ কারও ওপর তার সাধ্যের বাইরে কোনো দায়িত্ব দেন না। সেই সঙ্গে, তার উচিত শাসকদের হেদায়াতের জন্য দোয়া করা, যাতে আল্লাহ তাদের সৎপথে পরিচালিত করেন অথবা তাদের পরিবর্তে এমন কাউকে আনেন, যারা শরিয়াহ মোতাবেক শাসন করবে। তবে, যদি কেউ হিজরত করতে সক্ষম হয়,তবে যদি সে একজন আলিম হয়, যার কাছে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও হেদায়াত রয়েছে, এবং সে বুঝে যে এই দেশে অবস্থান করে সে আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দিতে পারে, তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে, তাদের অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসতে পারে। তাহলে এমন অবস্থায় তার জন্য এখানে থাকা উত্তম এবং সে এই দাওয়াত ও হিদায়াতের কারণে মহান সওয়াবপ্রাপ্ত হবে। এমন অবস্থায় হিজরত করা তার জন্য আবশ্যক নয়। কারণ সে দ্বীন প্রকাশ করতে পারছে, তার কাছে সঠিক জ্ঞান আছে এবং সে বাতিলের প্রভাব থেকে নিরাপদ।তাই এরকম অবস্থায় তার জন্য সেখানে অবস্থান করা বৈধ এবং উত্তম ইনশাআল্লাহ।”(বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-৪৮১২)
.
“অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, যে ব্যক্তি এমন কোনো দেশ বা স্থানে বসবাস করছে, যেখানে প্রকাশ্যে গোনাহ ও অপরাধ সংঘটিত হয় এবং যেখানে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘিত হয়, তার জন্য শরিয়তের নির্দেশ হলো সে যদি হিজরত করতে সক্ষম হয় তাহলে সে যেন সেই স্থান পরিত্যাগ করে এমন কোনো নিরাপদ শহর, অঞ্চল কিংবা দেশে চলে যায়, যেখানে সে অন্যায় থেকে নিরাপদ থাকতে পারে এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে। কেননা, এর মাধ্যমে সে পাপাচারীদের সংস্পর্শ এবং তাদের সাহচর্য থেকে বাঁচতে পারে, পাশাপাশি পাপের প্রতি সন্তুষ্টি বা সহানুভূতির অনুভূতি থেকেও নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
▬▬▬▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রশ্ন ৩: হিজরতের ক্ষেত্রে সকল মানুষের জন্য কি একই হুকুম প্রযোজ্য? একজন মুসলিমের জন্য অমুসলিম দেশের দিকে হিজরত করা এবং সে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা কি শরিয়তসম্মত?
উত্তর: ইমামদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, হিজরতের ক্ষেত্রে সকল মানুষের হুকুম একরকম নয়। হিজরতের হুকুম ব্যক্তি, অবস্থা ও সময় ভেদে পরিবর্তিত হয়। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে পরিস্থিতি ও ব্যক্তির অবস্থার উপর নির্ভর করে, হিজরত কখনো ওয়াজিব (অবশ্য করণীয়), কখনো মুস্তাহাব (উত্তম), আবার কখনো হারাম (নিষিদ্ধ) হতে পারে যদি কেউ এমন পরিবেশে বসবাস করে, যেখানে সে নিজের দ্বীন বা ধর্ম পালন করতে অক্ষম, অথচ তার কাছে হিজরতের সামর্থ্য রয়েছে তাহলে তার জন্য হিজরত করা আবশ্যক (ওয়াজিব)। অন্যদিকে, যদি কেউ এমন স্থানে থাকে, যেখানে সে দ্বীন পালনে স্বাধীন এবং নিরাপদ, তাহলে তার জন্য হিজরত করা আবশ্যক নয়; বরং তা মুস্তাহাব বা উত্তম হতে পারে, বিশেষ করে যদি সে ইসলামি পরিবেশে জীবনযাপন করতে চায়। আর যে ব্যক্তি দ্বীন পালনেও অপারগ এবং হিজরত করাও যার সাধ্যে নেই। যেমন: নারী, শিশু, বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তি তাদের প্রতি আল্লাহর করুণা রয়েছে এবং শরিয়তের বিধানে তাদের জন্য ক্ষমা রয়েছে।তাই মানুষদের অবস্থা পর্যালোচনা করে আলেমগন হিজরতের বিধানের ক্ষেত্রে মানুষকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন যেমন:
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] হিজরতের বিধান অনুযায়ী মানুষের তিনটি শ্রেণী উল্লেখ করে বলেন:
ن تجب عليه ، وهو من يقدر عليها ، ولا يمكنه إظهار دينه ، ولا تمكنه إقامة واجبات دينه مع المقام بين الكفار ، فهذا تجب عليه الهجرة ; لقول الله تعالى : ( إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيراً ) . وهذا وعيد شديد يدل على الوجوب . ولأن القيام بواجب دينه واجب على من قدر عليه ، والهجرة من ضرورة الواجب وتتمته ، وما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب .
الثاني: من لا هجرة عليه . وهو من يعجز عنها ، إما لمرض ، أو إكراه على الإقامة ، أو ضعف ; من النساء والولدان وشبههم ، فهذا لا هجرة عليه ; لقول الله تعالى : ( إِلَّا الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ لا يَسْتَطِيعُونَ حِيلَةً وَلا يَهْتَدُونَ سَبِيلاً ) . ولا توصف باستحباب ; لأنها غير مقدور عليها .
والثالث : من تستحب له ، ولا تجب عليه . وهو من يقدر عليها ، لكنه يتمكن من إظهار دينه ، وإقامته في دار الكفر ، فتستحب له ، ليتمكن من جهادهم ، وتكثير المسلمين ، ومعونتهم ، ويتخلص من تكثير الكفار ، ومخالطتهم ، ورؤية المنكر بينهم . ولا تجب عليه ; لإمكان إقامة واجب دينه بدون الهجرة . وقد كان العباس عم النبي صلى الله عليه وسلم مقيما بمكة مع إسلامه “
প্রথম শ্রেণি: যাদের ওপর হিজরত ওয়াজিব (আবশ্যক) এরা হল সেইসব লোক, যারা হিজরত করতে সক্ষম, কিন্তু কাফেরদের মধ্যে অবস্থান করে নিজেদের দ্বীন প্রকাশ করতে পারে না,এবং দ্বীনের ফরজ ওয়াজিব ইবাদতসমূহ যথাযথভাবে আদায় করতে পারে না। এই অবস্থায় তাদের জন্য হিজরত করা ওয়াজিব (আবশ্যক) আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয়ই যেসব লোক নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে, ফেরেশতারা যখন তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়, তখন জিজ্ঞাসা করে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, আমরা তো দুর্বল-অসহায় ছিলাম এই জমিনে।ফেরেশতারা বলে,আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে তোমরা হিজরত করতে? সুতরাং তাদের আবাস হবে জাহান্নাম,আর সেটি কতই না নিকৃষ্ট গন্তব্য।'(সূরা আন-নিসা: ৯৭) এই আয়াতে তীব্র ভীতির মাধ্যমে হিজরতের আবশ্যকতা প্রমাণ করা হয়েছে। কারণ দ্বীনের ফরজ ওয়াজিব কার্য সম্পাদন করা প্রত্যেক সক্ষম মুসলিমের জন্য আবশ্যক।আর যখন তা হিজরত ছাড়া পালন করা অসম্ভব হয়, তখন হিজরত করাও ওয়াজিব হয়ে যায়।
.
দ্বিতীয় শ্রেণি: যাদের ওপর হিজরত ওয়াজিব (আবশ্যক) নয়; বরং যারা হিজরত করতে অক্ষম। যেমন: অসুস্থ ব্যক্তি,জবরদস্তির শিকার হয়ে বন্দী থাকা মানুষ, দুর্বল নারী ও শিশু ও যারা তাদের মতো দুর্বল। এ শ্রেণীর লোকদের ওপর হিজরত ওয়াজিব নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন:”তাদের ব্যতিক্রম, যারা পুরুষ, নারী ও শিশুদের মধ্যে দুর্বল, যারা কোন উপায় বের করতে সক্ষম নয় এবং সঠিক পথও খুঁজে পায় না।”(সূরা আন-নিসা: ৯৮) এদের ক্ষেত্রে হিজরত করা মুস্তাহাব বলা যাবে না, কারণ এটি তাদের সাধ্যের বাইরে।
.
তৃতীয় শ্রেণি: যাদের জন্য হিজরত মুস্তাহাব (সওয়াবের কাজ), ওয়াজিব নয়। তারা হিজরত করার সামর্থ্য রাখে, তবে কাফেরদের রাষ্ট্রে থেকেও নিজেদের দ্বীন রক্ষা করতে ও দ্বীনের বিধি-বিধান যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম। তাদের জন্য হিজরত মুস্তাহাব যাতে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নিতে পারে, মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে, মুসলিমদের সাহায্য করতে পারে এবং কাফেরদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের সান্নিধ্যে থাকার ক্ষতি থেকে রেহাই পেতে পারে। তবে এটা তাদের জন্য আবশ্যক (ওয়াজিব) নয়, কারণ তারা হিজরত না করেও তাদের দ্বীনের ফরজ দায়িত্বগুলো পালন করতে সক্ষম। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চাচা আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণের পরেও মক্কায় অবস্থান করতেন।”(ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনি; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ২৩৬)
.
পূর্ববর্তী আলোচনায় বলা হয়েছে, যদি কোনো মুসলিম তার দ্বীন তথা ইসলামী জীবনাচার প্রকাশ করে চলতে না পারে, তাহলে তার জন্য হিজরত করা আবশ্যক যদি তার পক্ষে তা সম্ভব হয়। কিন্তু যদি কেউ শারীরিক অক্ষমতা, অসুস্থতা অথবা এমন কোনো নিরাপদ জায়গার অনুপস্থিতি যেখানে সে হিজরত করতে পারে, তাহলে সে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত। তার কর্তব্য হলো, সে যতটুকু পারে, আল্লাহকে ভয় করুক এবং তার সাধ্যানুযায়ী দ্বীনের আমলগুলো সম্পাদনে যত্নবান হোক। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আল্লাহ কাউকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না।” (সূরা আল-বাকারা: ২৮৬) তিনি আরো বলেছেন: “আমি কাউকে তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব দিই না।”(সূরা আল-আন’আম: ১৫২) যদি এমন কোনো দেশ না থাকে যেখানে দ্বীনের বিধি-বিধান সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা যায় এবং হিজরতের সুযোগও না থাকে, তাহলে যে জায়গা তুলনামূলকভাবে দ্বীনের অনুসরণ ও নিরাপত্তার জন্য উত্তম সেই জায়গা বেছে নিতে হবে। এটাই আল্লাহর নির্দেশ মানা এবং তার আদেশ অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব তা পালন করার নাম। যদি কোনো ইসলামিক রাষ্ট্র না থাকে যেখানে হিজরত করা সম্ভব, কিন্তু ইউরোপ বা আমেরিকার মতো দেশে কেউ দ্বীন পালন করতে পারে, নিজের জীবন, পরিবার ও সম্পদ রক্ষা করতে পারে এবং স্বদেশের তুলনায় নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারে তাহলে সেখানে বসবাসে দোষ নেই। তবে এই বসবাস শুধু ‘আবাসনের’ পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। ‘নাগরিকত্ব গ্রহণ’ বৈধ নয়, কারণ এর মাধ্যমে অনেক গুরুতর হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয় সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
.
এই প্রসঙ্গে সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল, যার মূল বক্তব্য ছিল: অনেক মুসলমান এই সমস্ত (ইউরোপ-আমেরিকার) দেশে এসে বসবাসের নিয়ত করে এবং আমেরিকান নাগরিকত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু এগুলো তো কুফর, শিরক ও নৈতিক পতনের দেশ। তারা কিভাবে এসব দেশের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে, তাদের ইসলামি দেশীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করে এইসব দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে? ইসলামের দৃষ্টিতে এর হুকুম কী? যদিও তারা একে ইসলাম প্রচারের অজুহাতে বৈধ মনে করে।
স্থায়ী কমিটির আলেমগন উত্তরে বলেন:
لا يجوز لمسلم أن يتجنس بجنسية بلاد حكومتها كافرة ، لأن ذلك وسيلة إلى موالاتهم والموافقة على ما هم عليه من الباطل.
أما الإقامة بدون أخذ الجنسية فالأصل فيها المنع لقوله تعالى: (إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيرا. إلا المستضعفين…) النساء/97، 98.ولقول النبي صلى الله عليه وسلم : ( أنا برئ من كل مسلم يقيم بين المشركين ) ولأحاديث أخرى في ذلك، ولإجماع المسلمين على وجوب الهجرة من بلاد الشرك إلى بلاد الإسلام مع الاستطاعة. لكن من أقام من أهل العلم والبصيرة في الدين بين المشركين لإبلاغهم دين الإسلام ودعوتهم إليه، فلا حرج عليه إذا لم يخش الفتنة في دينه، وكان يرجو التأثير فيهم وهدايتهم
“কোনো মুসলিমের জন্য এমন কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা বৈধ নয়, যার শাসনব্যবস্থা কুফর (অবিশ্বাস) ভিত্তিক; কারণ এটি কুফর রাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতি ও তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসে সম্মতি জানানোর নামান্তর। আর যেখানে নাগরিকত্ব না নিয়ে কেবল বসবাসের বিষয়টি আসে, সেটিও মূলত নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “নিশ্চয়ই যেসব লোক নিজেদের উপর জুলুম করেছে, ফেরেশতারা যখন তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়, তখন জিজ্ঞেস করে। তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, আমরা তো দুর্বল ছিলাম এই দেশে। ফেরেশতারা বলে, আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে তোমরা হিজরত করতে? এদের আবাসস্থল হবে জাহান্নাম, আর তা কতই না নিকৃষ্ট গন্তব্য। তবে তারা ব্যতিক্রম, যারা সত্যিই দুর্বল।(সূরা আন-নিসা: ৯৭-৯৮) আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “আমি সেই মুসলিমের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি না, যে মুশরিকদের মাঝে বসবাস করে। এ বিষয়ে অন্যান্য হাদীসও আছে। এবং সকল মুসলিমের ইজমা তথা ঐকমত্য হলো, কারো পক্ষে যদি সম্ভব হয়, তবে তার ওপর কুফর দেশ থেকে ইসলামী দেশে হিজরত করা ওয়াজিব।তবে কোনো ব্যক্তি যদি দ্বীনের গভীর জ্ঞান রাখে এবং ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে মুশরিকদের দেশে অবস্থান করে, আর সেখানে সে নিজের দ্বীনের ব্যাপারে ফিতনার আশঙ্কা না করে এবং আশা করে যে সে তাদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারবে ও তাদের হেদায়াতের কারণ হতে পারবে। তাহলে তার জন্য সেখানে থাকা দোষণীয় নয়।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৬৯; উত্তরদাতাগণ: শাইখ আবদুল আজিজ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনে বাজ, শাইখ আবদুর রজ্জাক আফিফী, শাইখ আব্দুল্লাহ ইবন কুআউদ রাহিমাহুল্লাহ)
.
স্থায়ী কমিটির আলিমগণ বলেন: “একজন ব্যক্তি এক কুফরি রাষ্ট্র থেকে অন্য একটি কুফরি ভূখণ্ডে হিজরত করতে পারে, যদি সেখানে মন্দ কম হয় এবং মুসলিমদের জন্য হুমকির মাত্রা কম হয় যেমন কিছু মুসলিম, নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশে, মক্কা থেকে হিজরত করে আবিসিনিয়ায় গিয়েছিলেন।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ৫০)
.
উল্লেখ্য, কিছু সংখ্যক আলেম বিশেষ প্রয়োজন ও নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে (যেমন: অমুসলিম দেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ) তা বৈধ বলে অভিমত দিয়েছেন। যেমন, কোনো ব্যক্তি যদি নিজ দেশে নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রাণ রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে অমুসলিম দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং অন্য কোনো বিকল্প না থাকে, তাহলে সেই প্রেক্ষাপটে নাগরিকত্ব গ্রহণকে তাঁরা বৈধ মনে করেছেন।”
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ) এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে জিবরীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪৩০ হি./২০০৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: একজন মুসলিমের জন্য কাফের (অমুসলিম) দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের হুকুম কী?”
জবাবে শাইখ বলেন:
من اضطر إلى طلب جنسية دولة كافرة كمطارد من بلده ولم يجد مأوى فيجوز له ذلك بشرط أن يظهر دينه ويكون متمكنا من أداء الشعائر الدينية ، وأما الحصول على الجنسية من أجل مصلحة دنيوية محضة فلا أرى جوازه والله أعلم.
“যে ব্যক্তি নিজ দেশে নিপীড়নের শিকার হয়ে আত্মরক্ষার তাগিদে কোনো কুফরি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিতে বাধ্য হয় এবং তার জন্য অন্য কোনো আশ্রয়স্থল পাওয়া সম্ভব না হয় তাহলে তার জন্য তা বৈধ। তবে শর্ত হলো, সে যেন তার দ্বীন প্রকাশ্যে পালন করতে পারে এবং ইবাদতসহ ধর্মীয় কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পাদনের সক্ষমতা রাখে। কিন্তু কেউ যদি শুধুমাত্র দুনিয়াবি লাভের উদ্দেশ্যে (অর্থ, সুযোগ-সুবিধা বা আরাম-আয়েশের আশায়) নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, তাহলে আমি তার বৈধতা দেখি না। আল্লাহই সর্বজ্ঞ”।(ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৬২৪৭; ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-১৩০৭৯৮)
▬▬▬▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রশ্ন ৪: ইমাম আলবানী (রাহি.) কি সমগ্র ফিলিস্তিনবাসীদেরকে তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র হিজরত করার পক্ষে ফাতওয়া দিয়েছিলেন?
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’আলার জন্য। দুরুদ বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর। অতঃপর সমস্ত প্রশংসা সেই পরম করুণাময়ের জন্য, যিনি ফিলিস্তিন ভূমিকে সমগ্র মানবজাতির জন্য এক বরকতময়, পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ স্থানে পরিণত করেছেন। এই ভূমিকে তিনি নির্বাচিত করেছেন সেই সাহায্যপ্রাপ্ত দলের আশ্রয়স্থল হিসেবে একটি দল, যারা ত্যাগ ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও সত্য ও ন্যায়ের পথ ধরে রাখবে কিয়ামত পর্যন্ত। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন বনি ইসরাঈল (ইহুদি-খ্রিস্টানরা) এই পবিত্র ভূমিতে দুবার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, সীমালঙ্ঘন ও অহংকারে লিপ্ত হবে। অতঃপর আল্লাহ তাঁর একদল প্রভাবশালী, সাহসী ও ঈমানদার বান্দাকে পাঠাবেন যারা প্রবেশ করবে তাদের ঘরে, লাঞ্ছনার চিহ্ন এঁকে দেবে তাদের মুখে, এবং তারা যা নির্মাণ করেছিল, তা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে। আল্লাহর শাস্তি কিয়ামত পর্যন্ত তাদের জন্য অব্যাহত থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত তিনি তাদের বিরুদ্ধে এমন সব শক্তি পাঠাতে থাকবেন, যারা তাদেরকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করবে। এটাই তাদের কৃতকর্মের ফল, কারণ তারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছে, সাবতের বিধান লঙ্ঘন করেছে, অসংখ্য নবীদের হত্যা করেছে এবং অহংকারভরে বলেছে, “আমরা আল্লাহর সন্তান ও প্রিয়জন (নাউজুবিল্লাহ)। এ কারণে তারা পড়েছে অপমান, দারিদ্র্য ও নিপীড়নের জালে। তাদের বিরুদ্ধে নবী দাউদ (আ.) ও ঈসা ইবনে মারইয়াম (আ.) এর মাধ্যমে অভিশাপ উচ্চারিত হয়েছে, আর তারা আহরণ করেছে আল্লাহর ক্রোধের ওপর আরও একটি ক্রোধ।এই বাস্তবতা সামনে রেখে যখন ফিলিস্তিন থেকে হিজরতের শরঈ বিধান আলোচনা করা হয়, তখন আমাদের জানা আবশ্যক হিজরতের মূলনীতি, এর শরঈ কারণসমূহ, প্রজ্ঞা (হিকমত) এবং ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ এর স্পষ্ট ধারণা। কেননা হিজরত শুধু স্থানান্তরের নাম নয়, বরং তা ঈমান, আত্মত্যাগ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে যাত্রার নাম।
.
প্রিয় পাঠক! বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিন থেকে সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য হিজরতের বিধান কি হবে? সে বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত মন্তব্য করার যোগ্যতা আমাদের নেই। বরং এ বিষয়ে গভীর গবেষণা ও ইজতিহাদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত প্রদানের ভার বর্তমান যুগের যোগ্য মুজতাহিদ বিদ্বানদের উপরই ন্যস্ত। তারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ফাতওয়া প্রদান করবেন। আমাদের উদ্দেশ্য এখানে কোনো ফাতওয়া প্রদান নয়, বরং একটি বিষয় পরিষ্কার করা ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দিন আলবানী (রাহি.) কি ফিলিস্তিনের সকল অধিবাসীকে তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র হিজরত করার ব্যাপারে সাধারণ ও সর্বজনীন ফাতওয়া প্রদান করেছিলেন কি না এই বিষয়ে বাস্তব অবস্থানটি স্পষ্ট করা। চলুন দেখি ইমাম আলবানী (রাহি.) ফিলিস্তিনিদের হিজরতের ব্যাপারে কি বলেছিলেন।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহি.) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে অডিয়ো কলে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:
السائل : خروج الفلسطينيين من فلسطين .
الشيخ : لا ما أفتينا بوجوب الخروج ، أفتينا بوجوب الهجرة على كل مسلم لا يتمكن من المحافظة على نفسه أو على دينه أو على عرضه أو على أخلاقه .
السائل : نعم .
الشيخ : وما تقرأه في الجرائد كله بهت وافتراء .
السائل : هذا ما أحببنا أن نتأكد منه .
الشيخ : أنا أجبتك .
السائل : نعم ؟
الشيخ : أنا أجبتك ، مع إلفات النظر بأن الأسئلة عندنا بعد العشاء من كل ليلة .
السائل : نعم .
الشيخ : لكن لاهتمامك بالموضوع أجبتك بهذا الذي سمعته .
السائل : جزاك الله خيرًا .
الشيخ : ” وهذا هو الحقُّ ما به خفاء *** فدَعْني عن بُنيات الطريقِ ” .
السائل : الله يبارك فيك ويجزيك الخير ، صحيح أن حوالي ثمانين من المشايخ في الأردن اجتمعوا وردوا على هذه الفتوى ؟
الشيخ : إي خمس وعشرون .
السائل : خمس وعشرون .
الشيخ : إي نعم .
السائل : خيرا إن شاء الله بارك الله بكم وأعانكم على قول الحق .
الشيخ : اللهم آمين .
السائل : وثبتكم عليه .
الشيخ : هذا بدعواتكم الصالحة إن شاء الله .
السائل : الله يحفظكم ويبارك فيكم .
الشيخ : الله يسلمك .
السائل : طيب لا تنسونا من الدعاء يا شيخنا .
الشيخ : أرجو لك كل خير .
অনুবাদ:
প্রশ্নকারী: ফিলিস্তিন থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রস্থান করা কি আবশ্যক?
শায়েখ: না, ফিলিস্তিনিদের আবশ্যকভাবে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যেতে হবে আমি এমন কোনো ফাতওয়া প্রদান করিনি । বরং, আমি ফাতওয়া দিয়েছি যে, যদি কোনো মুসলমান নিজের জীবন, ধর্ম, সম্মান বা নৈতিকতা রক্ষা করতে না পারে, তাহলে তার জন্য হিজরত করা আবশ্যক।
প্রশ্নকারী: জ্বী।
শায়েখ: আর পত্রিকায় যাহাকিছু পড়ছেন, সেগুলো সবই অপবাদ ও মিথ্যা।
প্রশ্নকারী: আমরা সেটাই নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম।
শায়েখ: আমি আপনাকে উত্তর দিয়েছি।
প্রশ্নকারী: জ্বী?
শায়েখ: আমি আপনাকে উত্তর দিয়েছি এবং আমি এশার নামাজের পর প্রতিদিন প্রশ্ন নিই, এটা বলে দিচ্ছি।
প্রশ্নকারী: জ্বী।
শায়েখ: তবে আপনি যেহেতু এই বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন, তাই এখনই আপনাকে উত্তর দিলাম।
প্রশ্নকারী: আল্লাহ আপনাকে প্রতিদান দিন।
শায়েখ: “এটাই সত্য, এতে কোনো সন্দেহ নেই তাই আমাকে গলিপথে নিয়ে যাবেন না।”
প্রশ্নকারী: আল্লাহ আপনাকে বরকত দিন এবং ভালো প্রতিদান দিন। এটা কি সত্যি যে জর্ডানে প্রায় আশি জন আলেম এই ফতোয়ার উত্তর দিয়েছেন?
শায়েখ: না, পঁচিশ জন।
প্রশ্নকারী: পঁচিশ জন?
শায়েখ: হ্যাঁ, ঠিক।
প্রশ্নকারী: আল্লাহ চাইলে ভালোই হবে। আল্লাহ আপনাকে বরকত দিন এবং সত্য বলায় সহায়তা করুন।
শায়েখ: ইয়া আল্লাহ আমীন!
প্রশ্নকারী: আপনাকে এতে অবিচল রাখুন।
শায়েখ: সেটা আপনার নেক দোয়ার মাধ্যমে, ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্নকারী: আল্লাহ আপনাকে হেফাজত করুন ও বরকত দিন।
শায়েখ: আল্লাহ আপনাকেও নিরাপদ রাখুন।
প্রশ্নকারী: ঠিক আছে, আমাদের কথা দোয়ায় ভুলবেন না, শায়েখ।
শায়েখ: আমি আপনাদের জন্য কল্যাণ কামনা করি।”
(সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, অডিয়ো ক্লিপ নং-২৫২)
.
সুতরাং শাইখের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি সাধারণভাবে সব ফিলিস্তিনবাসীর জন্য ফিলিস্তিন ত্যাগের ফাতওয়া প্রদান করেননি।” বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে সিরিয়ার প্রখ্যাত আলেম শাইখ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনি (রাহিমাহুল্লাহ) তার শিক্ষণমূলক গ্রন্থ কিতাবু দুরুসিতে ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) সম্পর্কে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন [শাইখ আল-আলবানি, সত্যের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ও যে কষ্ট তিনি সহ্য করেছেন] অতঃপর তিনি বলেন:
وكان هذا العزم واضحاً حتى في تصميمه على آرائه الشكلية التي خالف فيها الناس، فعندما كان يقتنع بمسألة فقهية فلا يتركها أبداً إلا إذا ظهر له دليل آخر يرجعه عنها، حتى ولو أوذي بسببها، وهذا فيه دلالة على صلابة الشيخ رحمه الله في الحق، وحسبك أنه مع نباهته ومع شدة تأثيره في الناس عاش غريباً إلى أن مات، فالشيخ الألباني قبل أربع سنوات كاد أن يطرد من الأردن بسبب فتوى له حرفتها بعض الجماعات الإسلامية ممن يسيطرون على مجلس الأمة الأردني، وزعموا أن الشيخ الألباني يوجب على الفلسطينيين الهجرة من فلسطين وتركها لليهود.وحتى أن بعض إخواني سمع هذه الفتوى في إذاعة إسرائيل، فالمذيع في إذاعة إسرائيل ذكر الشيخ الألباني وترجم له ترجمة لطيفة وظريفة وقال: إنه أكبر محدث في العالم الإسلامي، وقد أفتى بوجوب هجرة الفلسطينيين من فلسطين.
مع أن الشيخ الألباني ما أفتى بذلك، وإنما الفتوى خرجت على مقتضى السؤال الذي وجه إليه، وأنت تعلم أن العالم أسير السؤال، والجواب إنما يخرج على مقتضى السؤال.السؤال الذي سمعته بأذني من السائل أنه قال للشيخ: إننا نعاني من الاضطهاد في الأرض المحتلة، ونخاف على أنفسنا، حتى لا يستطيع الواحد منا أن يقيم الصلاة في المسجد خوفاً على أهله؟ فقال له الشيخ: إذا لم تستطع أن تقيم الصلاة فيجب عليك أن تهاجر، فإن هذا النوع من الهجرة أوجبه جميع علماء المسلمين، وهذا النوع لم ينقطع: الهجرة من بلاد الكفر إلى بلاد الإسلام، ومن بلاد المعصية إلى بلاد الطاعة، ومن بلاد البدعة إلى بلاد السنة، فهذه الهجرة الواجبة ينبغي على المسلم أن يسعى إليها ولا تسقط عنه إلا بعجزه عن الهجرة.فالجواب واضح، قال: إذا عجزتم عن عبادة الله فاخرجوا من دياركم وارجعوا إليها فاتحين.وكاد الشيخ رحمه الله أن يطرد بسبب هذه الفتوى، لولا تدخل بعض كبار تلاميذه، مثل الشيخ: أبي مالك محمد بن إبراهيم الشقرة، وهو مدير المسجد الأقصى في الأردن، وخطيب مسجد صلاح الدين ومن أفضل تلاميذ الشيخ ومن أشدهم وفاءً له، وكان هذا الشيخ له حظوة عند الملك حسين، ودخل إلى الملك حسين أكثر من مرة، بل ما دخل الشيخ الألباني الأردن إلا بضمان الشيخ أبي مالك؛ لأنهم رفضوا أيضاً استقباله في الأردن، وظل الشيخ ثلاثة أشهر على الحدود لا يدري إلى أي بلد يدخل؛ لأن كل بلد ترفض دخوله.
ولما عقد مؤتمر السنة والسيرة النبوية عام (١٤٠٠هـ) هنا في مصر دعي إليه كل الناس إلا الشيخ الألباني، مع أن أغلب هؤلاء المؤتمرين الذين حضررا المؤتمر ليس لهم أي جهد يشكر في خدمة هذه الأمة فيما يتعلق بسنة النبي صلى الله عليه وسلم، فكيف لا يدعى مثل هذا الشيخ العظيم؟ وظل هذا التجاهل الرسمي للشيخ الألباني حتى العام الماضي، فأعطوه جائزة الملك عن خدمة الحديث، وهو الذي شرف الجائزة، والجائزة لم تشرفه يوماً من الأيام، ولقد ظل الشيخ يخدم السنة أكثر من ستين عاماً وهو إمام للسنة وإمام للعقيدة وإمام في الفقه وفي تعظيم النبي، وظل رد الفعل الرسمي هذا ضعيفاً جداً، ولكن الله عز وجل جعل له من المحبة في قلوب المسلمين ما ظهر مقتضاه حين مات، فيوم موته كانت فجيعة، وكثير من الناس لم يصدق أن الشيخ الألباني رحمة الله عليه مات، ولقد وصلت كتبه إلى آخر مكان في الدنيا، وجعل الله تبارك وتعالى لها القبول في الأرض، ورزقه الله عز وجل حسن التصنيف، بحيث أنه لو عرض مسألة ما، فإنك تقتنع بها ولو كان الشيخ مخطئاً فيها، وإنك إذا قرأت كلامه وقع في قلبك أنه الحق، وهذا لم يبدع فيه إلا قليل من أهل العلم ممن رزق حسن العبارة في التصنيف.فالشيخ رحمه الله ظل غريباً، ولم يتحرك بعز الدولة -أي دولة- إلى أن مات، وكان رأيه في حرب الخليج رأياً واضحاً، وقد أوذي بسببه أيضاً، ولم يتراجع فيه لأنه يعتقد أنه الحق في المسألة.والشيخ الألباني رحمه الله كان إذا اعتقد مسألة أنها حق لا يفارقها أبداً ولو أدى ذلك إلى حرمانه من سكنى آمنة، أو إلى طرد من البلد، وكان ذلك أيضاً سبباً في محنته لما سجن في سوريا فإنه كان متزعماً للتدريس، وجمع الله عز وجل حوله الأفئدة، وكان رجلاً نابهاً، قال لي: كان عندي سيارة قديمة وكنت أطوف سوريا كلها بهذه السيارة، ومرة اختلف إخواني السلفيون في حلب -وكان هو يسكن في دمشق- فقالوا: إن لم تتدارك إخوانك تفرقوا.وذهب إلى هناك وسهر الليل كله، وظل هناك أكثر من أسبوع حتى فصل النزاع بين إخوانه ورجع.فكان قد أوقف حياته كلها لهذه الدعوة المباركة، ولما سجنوه استثمر وقته في السجن وأخرج لنا كتاباً وهو (مختصر صحيح الإمام مسلم رحمه الله) درس الكتاب دراسة دقيقة، وجرد الكتاب من أسانيده، وجمع وضم الروايات بعضها إلى بعض، وأخرج مختصر صحيح مسلم بقلمه، ولا أظن أن هذا الكتاب قد طبع حتى الآن.والذي طبع هو مختصر صحيح مسلم بتحقيق الشيخ الألباني، أما (مختصر صحيح مسلم) للشيخ الألباني نفسه فلم يطبع
“ইমাম আলবানী (রাহি.)-এর দৃঢ় মনোভাব এমন ছিল যে, যখন তিনি কোনো ফিকহি বিষয়ে নিশ্চিত হতেন, তখন অন্য কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেও তিনি নিজ অবস্থান ত্যাগ করতেন না যতক্ষণ না নতুন প্রমাণ তাঁর মত বদলাতে বাধ্য করত। এমনকি এ কারণে যদি তিনি কষ্টও পেতেন, তবু সত্য থেকে সরে যেতেন না। এটি তাঁর সত্যনিষ্ঠা ও অটলতার প্রমাণ আল্লাহ তাঁর উপর দয়া করুন। তাঁর জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব থাকা সত্ত্বেও তিনি সারাজীবন ‘অজানা এক মানুষ’ হিসেবেই বেঁচে ছিলেন এবং তেমনি করেই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর চার বছর আগে, একটি বিকৃত ফাতওয়ার কারণে, শাইখ আলবানিকে জর্ডান থেকে প্রায় বহিষ্কার করা হয়েছিল, যা কিছু ইসলামপন্থী দল জর্ডানের পার্লামেন্টে অপব্যাখ্যা করে উপস্থাপন করেছিল। তারা মিথ্যা দাবি করেছিল যে শাইখ আলবানি একটি ফাতওয়া দিয়েছেন যাতে ফিলিস্তিনিদের বলা হয়েছে নিজেদের দেশ ত্যাগ করে ইহুদিদের হাতে তুলে দিতে। আমার কিছু ভাই ইসরায়েলি রেডিওতে এই ফাতওয়া প্রচারিত হতে শুনেছেন। সেই সম্প্রচারে বলা হয়েছিল: “তিনি ইসলামী জগতের সবচেয়ে বড় হাদীসবিদ এবং ফিলিস্তিনিদের ফিলিস্তিন ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।” কিন্তু বাস্তবে শাইখ আলবানী (রাহি.) কখনোই এমন কোনো ফাতওয়া দেননি। ফাতওয়াটি ছিল ভুল ব্যাখ্যায় বিকৃত। ইসলামী ফাতওয়ার একটি মূলনীতি হলো: আলেমকে করা প্রশ্ন এবং প্রেক্ষাপট অনুযায়ী উত্তর দিতে হয়। প্রশ্নটি ছিল: “আমরা অধিকৃত ভূমিতে নির্যাতনের শিকার। এমনকি মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লেও পরিবারের জন্য ভয় থাকে। তখন ”শাইখ উত্তর দেন: “যদি ইবাদত করতে না পারেন, তবে আপনাদের হিজরত করা ফরজ। সকল ইসলামী স্কলারগণ এ বিষয়ে একমত। হিজরত অব্যাহত আছে কুফরের দেশ থেকে ইসলামীক দেশে, গোনাহের স্থান থেকে আনুগত্যের স্থানে, বিদআতের স্থান থেকে সুন্নাহর দেশে হিজরত ফরজ।”
.
তাঁর কথা স্পষ্ট ছিল: “যদি আল্লাহর ইবাদত করতে না পারেন তাহলে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যান এবং বিজয়ী হয়ে ফিরে আসুন।” এই ফাতওয়ার কারণে তাঁকে জর্ডান থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছিল, কিন্তু তাঁর এক শীর্ষ ছাত্র শাইখ আবু মালিক মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম আল-শুকরাহ’র হস্তক্ষেপে তা ঠেকানো যায়। তিনিই রাজা হুসেইনের সাথে সম্পর্ক ব্যবহার করে শাইখ আলবানিকে জর্ডানে ঢুকতে সাহায্য করেন।১৪০০ হিজরিতে যখন মিসরে ‘সুন্নাহ ও সীরাহ’ সম্মেলন হয়, তখন সকলকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও শাইখ আলবানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অথচ যাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তাদের অনেকেরই সুন্নাহর সেবায় কোনো অবদান ছিল না। এই অবহেলা চলতেই থাকে, যতক্ষণ না শেষ পর্যন্ত গত বছর তাঁকে হাদীস সেবায় রাজকীয় পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এই পুরস্কার তাঁর মর্যাদা বাড়ায়নি; বরং তিনিই পুরস্কারকে সম্মানিত করেছেন। তিনি ষাট বছরেরও বেশি সময় সুন্নাহর সেবা করেছেন। তিনি ছিলেন আকীদা, ফিকহ এবং সুন্নাহর একজন নিঃস্বার্থ ইমাম। তাঁর বইগুলো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাঁকে দিয়েছিলেন গ্রহণযোগ্যতা ও যুক্তিপূর্ণ লেখার অসাধারণ ক্ষমতা। তিনি যখন কোনো বিষয়ে আলোচনা করতেন, তুমি তাতে বিশ্বাস করতে বাধ্য হতে এমনকি যদি তিনি ভুলও হতেন। তাঁর লেখা পড়ে মনে হতো যেন সত্য হৃদয়ে গেঁথে গেছে। এই বিরল গুণ কেবল অল্প কিছু আলেমকেই দেওয়া হয়। শাইখ রহ. সারা জীবন একা ছিলেন এবং কোনো রাষ্ট্রীয় শক্তির ওপর নির্ভর করেননি। উপসাগরীয় যুদ্ধ নিয়ে তাঁর অবস্থানও স্পষ্ট ছিল, আর সে জন্য তাঁকে ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছিল। তবুও তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরেননি, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এটাই সত্য। “শাইখ আলবানি (রহি.) যখন কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করতেন যে তা সত্য, তখন তিনি তা কখনোই ত্যাগ করতেন না, যদিও এর পরিণামে নিরাপদ আবাস হারাতে হতো বা কোনো দেশ থেকে বহিষ্কৃত হতে হতো। এটাই ছিল তার পরীক্ষার একটি কারণ, যখন তাকে সিরিয়ায় কারাবন্দী করা হয়, কারণ তিনি ছিলেন শিক্ষার ক্ষেত্রে একজন অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ তা’আলা মানুষের হৃদয়গুলো তার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন, এবং তিনি ছিলেন এক বুদ্ধিমান মানুষ।তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন: ‘আমার একটা পুরনো গাড়ি ছিল, আর আমি পুরো সিরিয়া জুড়ে ভ্রমণ করতাম সেটাতে করে। একবার, যখন আমি দামেস্কে বাস করছিলাম, তখন আলেপ্পোর আমার সালাফি ভাইদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। তখন তারা বলল: “আপনি যদি এগিয়ে না আসেন, আপনার ভাইদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হবে।” তখন তিনি সেখানে যান এবং পুরো রাত জেগে থাকেন। তিনি সেখানে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় কাটান যতক্ষণ না তিনি তাদের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে ফেলেন, তারপর তিনি ফিরে আসেন। তিনি তার সারাজীবন এই বরকতময় দাওয়াতের (ইসলাম প্রচারের) জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। যখন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়, তিনি সে সময়টিকে কাজে লাগান এবং একটি বই রচনা করেন: মুখতাসার সহীহ ইমাম মুসলিম (রাহি.)। তিনি বইটি মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করেন, সনদসমূহ বাদ দেন, হাদিসগুলো একত্র করেন এবং নিজ হাতে সহীহ মুসলিম এর সংক্ষিপ্তসার রচনা করেন। আমি বিশ্বাস করি না যে এই বইটি এখন পর্যন্ত মুদ্রিত হয়েছে। যেটি মুদ্রিত হয়েছে তা হলো মুখতাসার সহীহ মুসলিম, যা শাইখ আলবানির যাচাইসহ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু যেটি সম্পূর্ণভাবে শাইখ আলবানীর রচনাতে রয়েছে, সেটি এখনো প্রকাশিত হয়নি।”(দেখুন আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনি (রাহি.)-এর শিক্ষণমূলক গ্রন্থ কিতাবু দুরুসি; খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ৩৮)
.
এমনকি ইমাম আলবানীর ফাতওয়াটির বিকৃত ব্যাখ্যা করার কারণে তৎকালীন সময়ে শাইখের ফাতওয়ার বিরোধিতা করে জর্দানের ফাতওয়া বোর্ড পাল্টা ফাতওয়া জারি করে, স্বীকৃতি নং (৩৬): ফিলিস্তিন ভূমি থেকে হিজরত করার বিধান। তারিখ: ৪/১/১৪১৪ হিজরি, ২৪/৬/১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ। অতঃপর তারা বলেন:
الحمد لله، والصلاة والسلام على رسوله الأمين سيدنا محمد وآله وبعد،، بتاريخ 4 محرم 1414هـ الموافق 24 حزيران 1993م اجتمع مجلس الإفتاء برئاسة سماحة قاضي القضاة رئيس مجلس الإفتاء سماحة الدكتور نوح علي سلمان القضاة وعضوية كل من سماحة الدكتور علي الفقير، وعطوفة الدكتور أحمد هليل أمين عام وزارة الأوقاف، وفضيلة الشيخ محمود الشويات مفتي القوات المسلحة الأردنية وفضيلة الدكتور محمود السرطاوي عميد كلية الشريعة في الجامعة الأردنية، وفضيلة الدكتور محمد نعيم ياسين الأستاذ في كلية الشريعة الجامعة الأردنية، وفضيلة الشيخ راتب الظاهر عضو محكمة الاستئناف، وفضيلة الشيخ سعيد حجاوي المفتي العام بالوكالة، وفضيلة الشيخ إبراهيم خشان مدير دائرة الإفتاء العام.
ونظر المجلس في مقالة صدرت عن أحد المشتغلين بالعلوم الإسلامية المقيمين في عمان والتي تفيد بوجوب هجرة أهل فلسطين منها بحجة أنهم مقهورون من قبل العدو الكافر وتأسياً بما فعله الرسول عليه الصلاة والسلام والصحابة الكرام عندما هاجروا من مكة إلى المدنية.
وقد اتفق أعضاء المجلس على أن هذا القول هفوة لا يجوز إتباعها ولا العمل بها، وسببها عدم الإحاطة بالوضع القائم في فلسطين وعدم التروي للتأكد من مشابهة وضع المسلمين في فلسطين لوضع المسلمين في مكة المكرمة قبل الهجرة إلى المدينة.
والمجلس يؤكد على أنه لا يجوز لأهل فلسطين أن يهاجروا ولا يجوز لهم إخلاء الأرض المقدسة لليهود، كما يؤكد المجلس على أن بقائهم في أرضهم جهاد في سبيل الله ولهم عليه أجر المرابطين، وإن مناهضتهم للعدو جهاد في سبيل الله لهم به أجر المجاهدين، وإن الذين يقتلون في تلك المصادمات هم شهداء أحياء عند ربهم يرزقون، وإن كل دعم لصمود أهل فلسطين هو تأييد للمجاهدين وبذلك في سبيل الله، ويلفت المجلس الانتباه إلى الفروق المتعددة بين وضع المسلمين في فلسطين ووضع المسلمين في مكة المكرمة قبل الهجرة ومن ذلك ما يلي:-
1-إن فلسطين أرض إسلامية يحاول اليهود انتزاعها والغلبة عليها وتغيير هويتها، ولذا يجب على المسلمين كافة الوقوف في وجههم بكل ما أوتوا من قوة، وتقع المسؤولية أولاً على أهل فلسطين ثم على الأدنى فالأدنى في البلاد الإسلامية المجاورة، بينما كانت مكة المكرمة دياراً للمشركين والمسلمون يحاولون الغلبة عليها، فلما لم يقدروا على ذلك هاجروا إلى الحبشة ثم إلى المدينة المنورة.
2-إن الهجرة إلى الحبشة لم تكن واجبة، بل لمن شاء أن يستريح من عذاب الكافرين ولما قامت دولة الإسلام في المدينة المنورة أصبحت الهجرة إلى المدينة واجبة على كل مسلم مستطيع سواء أكان في مكة أم في غيرها، فالغرض من الهجرة إلى المدينة لم يكن طلب النجاة فقط، بل لدعم الدولة الإسلامية بالطاقة البشرية والمالية وغيرهما، ولذا نسخ هذا الأمر عندما بسط الإسلام نفوذه على مكة وغيرها في الجزيرة العربية، والمسلمون اليوم في فلسطين لا يجدون بلداً كالمدينة المنورة من كل الوجوه.
3-إن الهجرة إلى المدينة المنورة كانت بأمر ولي أمر المسلمين وهو الرسول × وكان يراعي بذلك مصلحة الجماعة الإسلامية واليوم يجمع ولاة أمر المسلمين من القادة والعلماء العارفين بواقع الحال على أن المصلحة تقتضي ثبات المسلمين في فلسطين لإبقاء الهوية الإسلامية فيها وانتظاراً لفرجٍ آتٍ بإذن الله.
4-إن اليهود لا يمنعون المسلمين من إقامة شعائر دينهم ولا يحولون بينهم وبين أداء العبادات والتزام الأحكام الشرعية في خاصة أمرهم لكنهم يمنعون المجاهدين من الجهاد وقد كان كفار مكة يمنعون ضعفاء المسلمين من كل مظهر يمت إلى الإسلام بصلة حتى من العبادات.
5-إنّ تفريغ فلسطين من أهلها المسلمين هو ما يريده قادة اليهود وحكامهم؛ لأنه يخدم مصالحهم ويسمح لهم بتنفيذ مخططاتهم وواجب على كل مسلم أن يحبط كيد الكافرين وإن يقف في وجه مخططاتهم.
6-إن مجلس الفتوى يؤكد على أن ما صدر عن ذلك العالِـم هفوةٌ لا يُتابع عليها ولو عرف أبعادها وما يترتب عليها لتنزه عن القول بها كما يؤكد المجلس على المسلمين أن لا يتسرعوا بالأخذ بكل ما يقال في الأمور الدينية أياً كان قائله، فإن الحلال بيّن والحرام بيّن البر ما اطمأنت إليه النفس واطمأن إليه القلب والإثم ما حاك في النفس وتردد في الصدر.
7-كما أن المجلس يؤيد جهاد أهلنا في فلسطين وإخواننا في البوسنة والهرسك وفي كل بلد إسلامي ويبارك مواقفهم المشرفة ويدعوا جميع المسلمين إلى تأييدهم ودعمهم بكل ما أوتوا من قوة وإمكانيات، والله من وراء القصد.
رئيس مجلس الإفتاء,قاضي القضاة / د. نوح علي سلمان
المفتـي العام بالوكالـة/ الشيخ سعيد حجاوي
مفتي القوات المسلحة الأردنية/ الشيخ محمود الشويات
د. علي الفقــير,أمين عـام وزارة الأوقـــاف/ د. أحمد هليــل
د. محمود السرطاوي,الشيخ راتب الظاهر
د. محمد نعيم ياسين,الشيخ إبراهيم خشان
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, তাঁর রাসূল, আমাদের আমাদের নেতা মুহাম্মদ (ﷺ) এবং তাঁর পরিবারের প্রতি শান্তি ও বরকত বর্ষিত হোক।অতঃপর: ১৯৯৩ সালের ২৪ জুন, ১৪১৪ হিজরির ৪ মুহাররম তারিখে, ফতোয়া পরিষদ তাঁর সম্মানিত ড. নোয়া আলী সালমান আল-কুদাহ, প্রধান বিচারপতি ও ফতোয়া পরিষদের সভাপতি, এর নেতৃত্বে একত্রিত হয়, এর সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তাঁর সম্মানিত ড. আলী আল-ফুকির, সম্মানিত ড. আহমদ হালায়েল, আওকাফ মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি জেনারেল, সম্মানিত শায়খ মাহমুদ আল-শুয়িয়াত, জর্ডান সেনাবাহিনীর গ্র্যান্ড মুফতি, সম্মানিত ড. মাহমুদ আল-সারতাওয়ি, জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয়ের শারিয়া বিভাগের ডিন, সম্মানিত ড. মুহাম্মদ নাঈম ইয়াসিন, জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয়ের শারিয়া বিভাগের অধ্যাপক, সম্মানিত শায়খ রতেব আল-জাহের, আপিল কোর্টের সদস্য, সম্মানিত শেখ সাঈদ হিজাওয়ি, ভারপ্রাপ্ত গ্র্যান্ড মুফতি, এবং সম্মানিত শায়খ ইব্রাহীম খশন, সাধারণ ফতোয়া বিভাগ এর পরিচালক।
পরিষদ একটি প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করে, যা আম্মানে বসবাসরত একজন ইসলামি বিজ্ঞানী লিখেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল যে, প্যালেস্টাইনবাসীদের জন্য প্যালেস্টাইন ত্যাগ করা আবশ্যক, কারণ তারা কাফের শত্রু দ্বারা নির্যাতিত এবং এতে তারা হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীদের মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করার উদাহরণ তুলে ধরেন। ফতোয়া পরিষদের সদস্যরা একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে, এই বিবৃতি একটি ভুল, যা অনুসরণ বা কার্যকর করা উচিত নয়। এর কারণ হল প্যালেস্টাইনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অপর্যাপ্ত বোঝাবুঝি এবং এ বিষয়ে সাবধানে চিন্তা না করা, যে প্যালেস্টাইনে মুসলমানদের পরিস্থিতি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার আগে মক্কায় মুসলমানদের পরিস্থিতির সাথে তুলনীয় কি না। ফিলিস্তিনী জনগণের জন্য কাউন্সিল যে বক্তব্য প্রদান করেছে তা হলো: কাউন্সিল তাৎপর্যপূর্ণভাবে উল্লেখ করেছে যে, ফিলিস্তিনী জনগণকে দেশ ছাড়তে হবে না, তাদের জন্য পবিত্র ভূমি ইহুদিদের জন্য খালি করতে হবে না। কাউন্সিল আরও উল্লেখ করে যে, তাদের দেশের মধ্যে অবস্থান করা আল্লাহর পথে একটি জিহাদ, তারা তাদের ভূমির সুরক্ষায় যারা অবস্থান করছে তাদের পুরস্কার পাবে। শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধও আল্লাহর পথে একটি জিহাদ, তারা আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী সকলের পুরস্কার পাবে। যারা এই সংঘর্ষে নিহত হয়, তারা শহীদ, তারা তাদের প্রভুর কাছে জীবিত এবং সাধ্যমত জীবিকা লাভ করছে। ফিলিস্তিনী জনগণের দৃঢ়তায় কোনো সাহায্য প্রদান করা, এটি মুজাহিদীনদের সাহায্য করা, সুতরাং আল্লাহর পথে সাহায্য করা। কাউন্সিল ফিলিস্তিনী মুসলমানদের পরিস্থিতি ও মক্কায় হিজরতের পূর্বের মুসলমানদের পরিস্থিতির মধ্যে যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা হলো:
.
(১).ফিলিস্তিন একটি ইসলামিক ভূমি, যা ইহুদিরা দখল করার চেষ্টা করছে, আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং এর পরিচিতি পরিবর্তন করতে চায়। সুতরাং, সকল মুসলমানের জন্য এটি কর্তব্য যে, তারা তাদের পূর্ণ শক্তি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। প্রধান দায়িত্ব ফিলিস্তিনী জনগণের, পরবর্তীতে নিকটবর্তী মুসলিম দেশের। এর বিপরীতে, মক্কা ছিল মুশরিকদের ভূমি, এবং মুসলমানরা এর উপর বিজয় লাভ করতে চেয়েছিল। যখন তারা এটি করতে সক্ষম হয়নি, তখন তারা আবিসিনিয়ায় এবং পরে মদিনায় হিজরত করেছিল।
.
(২).আবিসিনিয়ায় হিজরত করা আবশ্যক ছিল না; এটি ছিল তাদের জন্য যারা অবিশ্বাসীদের নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে চেয়েছিল। তবে, যখন মদিনায় ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল, তখন মক্কা বা অন্য কোনো স্থানে বসবাসরত প্রতিটি মুসলমানের জন্য মদিনায় হিজরত করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ল। মদিনায় হিজরত করার উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র মুক্তি পাওয়া নয়, বরং ইসলামিক রাষ্ট্রকে মানবিক, আর্থিক এবং অন্যান্য সম্পদ দিয়ে সমর্থন করা। এই বাধ্যবাধকতা তখন তুলে নেওয়া হয়, যখন ইসলাম মক্কা এবং আরব উপদ্বীপের অন্যান্য অংশে তার প্রভাব বিস্তার করেছিল। আজ, ফিলিস্তিনে মুসলমানদের এমন কোনো দেশ পাওয়া যাচ্ছে না, যা মদিনার মতো হতে পারে। মুসলিম শাসক, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশেই মদিনায় হিজরত করা হয়েছিল, যিনি মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আজকের দিনে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও আলেমগণ, যারা বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সুপরিচিত, এ বিষয়ে একমত যে ফিলিস্তিনে মুসলমানদের অবিচল থাকা ইসলামি পরিচয় সংরক্ষণের জন্য এবং আল্লাহর ইচ্ছায় আগত সাহায্যের প্রতীক্ষায় সবচেয়ে উত্তম পথ।
.
(৪). ইহুদিরা মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেয় না, বরং ব্যক্তিগত জীবনে শরিয়াহ অনুযায়ী চলতে বা ইবাদত করতে বাধা দেয় না। কিন্তু তারা মুজাহিদদের জিহাদে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয়। যেমন মক্কার কাফিররা দুর্বল মুসলমানদের ইসলামি কর্মকাণ্ড এমনকি ইবাদতের ক্ষেত্রেও বাধা দিত।
.
(৫).ইহুদি নেতৃবৃন্দ ও শাসকদের লক্ষ্য হলো ফিলিস্তিনকে মুসলিমদের থেকে খালি করা, যাতে তারা তাদের স্বার্থে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে। এ ধরনের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা এবং তাদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব।
.
(৬).ফতোয়া কাউন্সিল ঘোষণা করেছে যে ঐ আলেমের বক্তব্য একটি ভুল ছিল, যা অনুসরণযোগ্য নয়। তিনি যদি নিজের বক্তব্যের পরিণতি ও প্রভাব উপলব্ধি করতে পারতেন, তবে এমন কিছু বলতেন না। কাউন্সিল মুসলিমদেরকে উপদেশ দিয়েছে যেন তারা ধর্মীয় বিষয়ে যেকোনো বক্তব্য গ্রহণে তাড়াহুড়ো না করে, বক্তা যেই হোন না কেন। হালাল স্পষ্ট, হারাম স্পষ্ট; ন্যায় হচ্ছে যা আত্মাকে প্রশান্তি দেয় এবং পাপ হচ্ছে যা অন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি করে ও সন্দেহ জাগায়।
.
(৭).কাউন্সিল ফিলিস্তিনে আমাদের জনগণের জিহাদ, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় আমাদের ভাইদের এবং অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তারা এসব সম্মানজনক অবস্থানকে ধন্যবাদ জানিয়েছে এবং সকল মুসলমানকে আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা শক্তি ও সম্পদের মাধ্যমে তাদের সহায়তা করে। আল্লাহই সর্বোচ্চ পথ প্রদর্শক। ফতোয়া কাউন্সিলের প্রধান, প্রধান বিচারপতি ড. নূহ আলী সালমান কার্যরত গ্র্যান্ড মুফতি শাইখ সাঈদ হিজজাওয়ি জর্ডান সশস্ত্র বাহিনীর মুফতি শাইখ মাহমুদ আল-শুয়াইয়াত ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ের মহাসচিব ড. আলী আল-ফাকির ও ড. আহমাদ হ্লায়েল, ড. মাহমুদ আল-সারতাউই, শাইখ রাতিব আল-জাহির, ড. মোহাম্মদ নাইম ইয়াসিন, শাইখ ইব্রাহিম খাশান। (ফাতওয়ার লিংক: https://www.aliftaa.jo/decision/37/(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
.
আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করেন, তাঁর কালিমাকে উচ্চে তোলেন এবং আমাদের, আপনাদের ও সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে তাঁর হেফাজতে রাখেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: শাইখ নাসরুল্লাহ আল মাদানী (হাফি)।
অনার্স, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়,সৌদি আরব।
এবং ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি)।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।
No comments:
Post a Comment