Sunday, May 25, 2025

ইসলামে আল ওয়ালা ওয়াল বারা অর্থাৎ কারো সাথে বন্ধুত্ব রাখা এবং শত্রুতা পোষণ করার মূলনীতি

 প্রশ্ন: ইসলামে الولاء والبراء আল ওয়ালা ওয়াল বারা অর্থাৎ কারো সাথে বন্ধুত্ব রাখা এবং শত্রুতা পোষণ করার মূলনীতি কি?

▬▬▬▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’আলার জন্য। দুরুদ বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর। অতঃপর আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা” ইসলামী আকীদার এক মৌলিক স্তম্ভ, যা ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’ নামে সুপরিচিত। এটি তাওহীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, যা শুধু মুখের কথায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা বিশ্বাস, হৃদয়ের অনুভূতি ও জীবনচর্যার প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীরভাবে প্রকাশিত হয়। এই মহান নীতিমালার আলোকে একজন মুসলিম শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালোবাসে, আনুগত্য করে, বন্ধুত্ব গড়ে তোলে এবং সাহায্যের হাত বাড়ায়। অপরদিকে,আল্লাহর শত্রুতা পোষণকারীদের প্রতি বিরাগ, বিরোধিতা ও বৈরিতার মনোভাব পোষণ করে। এই চেতনা ঈমানের পরিপূর্ণতা ও বিশুদ্ধতার চাবিকাঠি, যা প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে গেঁথে থাকা অপরিহার্য।আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’ হচ্ছে ঈমানের বিশুদ্ধতা ও পরিপূর্ণতার এক অপরিহার্য চাবিকাঠি, যা প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা আবশ্যক।এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে কিছু দেয়, আল্লাহরই জন্য কিছু দেওয়া থেকে বিরত থাকে এবং আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে, আল্লাহরই জন্য কারও প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, সে তার ঈমান পরিপূর্ণ করে ফেলল।”(সুনানে তিরমিযী হা/২৪৪৫, মুসনাদে আহমাদ হা/১৫০৬৪) সুতরাং ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’ সম্পর্কে স্পষ্ট ও সঠিক জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অপরিহার্য, যাতে তার ঈমান দৃঢ় হয় এবং তা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হয়।”
.
❏.আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা অর্থাৎ আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা/ঘৃণা পোষণ করার অর্থ:
.
‘আল্লাহর জন্য ভালোবাসা’ বলতে বোঝায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাউকে ভালোবাসা, এমন একটি ভালোবাসা যা দুনিয়াবি স্বার্থ, রূপ, সম্পদ কিংবা পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নয়; বরং তার ঈমান, তাকওয়া, দ্বীনদারিতা ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার কারণে তাকে ভালোবাসা। এই ভালোবাসার চারটি প্রধান নিদর্শন রয়েছে: (১).তার কল্যাণ কামনা করা এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালনার আন্তরিক চেষ্টা করা। (২).তার নেক কাজগুলোতে পাশে থাকা এবং তাকে সহযোগিতা করা। (৩).তার অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোয়া করা ও কল্যাণ কামনা করা। (৪).সে কোনো কষ্টে পড়লে তার পাশে দাঁড়ানো এবং সামর্থ্য অনুযায়ী তার প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসা ইত্যাদি। এ ধরনের ভালোবাসা পরস্পরের হৃদয়ে আখিরাতমুখী বন্ধন সৃষ্টি করে এবং ব্যক্তিকে আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয় করে তোলে।
.
অপরদিকে “আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাগ বা ঘৃণা করা” বলতে বোঝানো হয় কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি আমাদের বিরূপতা বা ঘৃণা কেবল এই কারণে যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরোধিতা করে, শিরক ও কুফরিতে লিপ্ত, বিদআত ও গোমরাহিতে নিমজ্জিত, পাপাচারে ডুবে আছে এবং কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ ঘৃণা ব্যক্তিগত শত্রুতা বা হিংসার ওপর ভিত্তি করে নয়; বরং তা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, ঈমানের প্রতি আনুগত্য এবং হক ও বাতিলের স্পষ্ট পার্থক্যের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রকাশ।
.
❏.একজন মুসলিম মানুষের সাথে কীভাবে বৈরিতা ও মিত্রতা পোষণ করবে,এ বিষয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা কুরআন সুন্নাহ’য় এসেছে। আল ওয়ালা ওয়াল বারা তথা বৈরিতা ও মিত্রতার ক্ষেত্রে মানুষ তিনভাগে বিভক্ত। যথা:
.
প্রথম ভাগ: যাঁদের প্রতি হৃদয়ে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পোষণ করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যাঁদের প্রতি বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ বা হিংসার স্থান নেই তাঁরা হলেন খাঁটি মু’মিন সম্প্রদায়। এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয় নবীগণ, সত্যবাদী সিদ্দীকগণ, আল্লাহর রাহে আত্মোৎসর্গকারী শহীদগণ এবং পরহেযগার, নেককার বান্দারা যাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে অবিচল। মহান আল্লাহ বলেছেন, “যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে: ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের প্রতিপালক, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু’।”(সূরাহ হাশর: ১০)
.
২য় ভাগ: যাদের প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করতে হবে, যাদের প্রতি কোনো ভালোবাসা ও মিত্রতা পোষণ করা যাবে না। তারা হলো স্পষ্টভাবে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী খাঁটি কাফির সম্প্রদায়। যেমন: কাফির, মুশরিক, আক্বীদাগত মুনাফিক্ব, মুরতাদ, নাস্তিক ও অন্যান্য বিধর্মী সম্প্রদায়। শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে, তাদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সতর্কতা ও সীমাবদ্ধতা অবলম্বন করা জরুরি, যাতে ঈমান ও নৈতিক স্থিতি অটুট থাকে।” মহান আল্লাহ বলেছেন,“তুমি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী কোনো জাতিকে এরূপ পাবে না যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে এমন ব্যক্তিদের সাথে বন্ধুত্ব করে, যদিও তারা তাদের পিতা, বা পুত্র, কিংবা ভাই, বা জাতি-গোষ্ঠী হয়। এরাই তারা, যাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতসমূহে, যেগুলোর তলদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহ’র প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এরাই আল্লাহ’র দল। জেনে রেখো, নিশ্চয় আল্লাহ’র দলই সফলকাম।” (সূরাহ মুজাদালাহ: ২২)
.
৩য় ভাগ: যাদেরকে একদিক থেকে ভালোবাসতে হবে, আবার একদিক থেকে ঘৃণা করতে হবে, যাদের ব্যাপারে অন্তরে ভালোবাসা-ঘৃণা দুটিই একত্রিত হবে। তারা হল পাপাচারী মু’মিন ব্যক্তিবর্গ। তাদেরকে ভালোবাসতে হবে, তাদের ঈমানের কারণে। আর তাদেরকে ঘৃণা করতে হবে, শির্ক-কুফরের চেয়ে নিম্নপর্যায়ের পাপাচারিতায় লিপ্ত হওয়ার কারণে। অধিকন্তু তাদের প্রতি ভালোবাসার দাবি হচ্ছে তাদেরকে নসিহত করা এবং মন্দকর্মে তাদের বিরোধিতা করা। বিধি মোতাবেক তাদের মন্দকর্মের বিরোধিতা করা ওয়াজিব। এ বিষয়ে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন,إذا اجتمَعَ في الرَّجُلِ الواحِدِ خَيرٌ وشَرٌّ وفُجورٌ، وطاعةٌ ومَعصيةٌ، وسُنَّةٌ وبِدعةٌ- استحَقَّ مِن الموالاةِ والثَّوابِ بقَدْرِ ما فيه مِنَ الخَيرِ، واستحَقَّ مِن المعاداةِ والعِقابِ بحَسَبِ ما فيه مِنَ الشَّرِّ، فيَجتَمِعُ في الشَّخصِ الواحِدِ مُوجِباتُ الإكرامِ والإهانةِ، فيَجتَمِعُ له من هذا وهذا، كاللِّصِّ الفقيرِ تُقطَعُ يَدُه لسَرِقَتِه، ويُعْطى مِن بَيتِ المالِ ما يَكْفيه لحاجتِه، هذا هو الأصلُ الذي اتَّفَق عليه أهلُ السُّنَّةِ والجَماعةِ، وخالَفَهم الخوارِجُ والمُعتَزِلةُ، ومن وافَقَهم عليه.”যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য ও সুন্নাত-বিদ‘আত একত্রিত হয়, তবে সে ততটুকু ভালবাসা প্রাপ্তির যোগ্য হবে,যতটুকু ভাল তার মধ্যে রয়েছে। পক্ষান্তরে সে ততটুকু ঘৃণা ও শাস্তি প্রাপ্তির যোগ্য হবে,যতটুকু মন্দ তার মধ্যে রয়েছে। অতএব একই ব্যক্তির মধ্যে সম্মান ও অপমান উভয়ের কারণ সমবেত হ’তে পারে। যেমন চুরি করার অপরাধে গরীব চোরের হাত কাটতে হবে, তবে তার চাহিদা মিটানোর জন্য বায়তুল মাল থেকে তাকে অর্থ দিতে হবে। এটি এমন একটি মূলনীতি, যে বিষয়ে আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত একমত পোষণ করলেও খারেজী-মু‘তাযিলী ও এদের পক্ষাবলম্বনকারীদের বিরোধিতা রয়েছে।”(ইবনু তাইমিয়া মাজমূঊল ফাতওয়া; খণ্ড: ২৮; পৃষ্ঠা: ২০৯; মদীনা, সঊদী আরব; বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স; ১৪১৬ হিঃ ১৯৯৫; এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইমাম সালিহ আল-ফাওযান, আল-ইরশাদ ইলা সাহীহিল ই‘তিক্বাদ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২৮৯-২৯০; আর-রিআসাতুল ‘আম্মাহ লি ইদারাতিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১২; ২য় প্রকাশ)।
.
“আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা অর্থাৎ কারো সাথে বন্ধুত্ব রাখা ও শত্রুতা পোষণ করা তাওহীদের অন্যতম একটি মূলনীতি; যার শব্দ ও মর্ম দলিল দ্বারা সাব্যস্ত। এ বিষয়ে অসংখ্য দলিল-প্রমাণ মহান আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহতে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা [প্রকৃতপক্ষে] একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে, সে অবশ্যই তাদেরই একজন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে হেদায়াতের পথ প্রদর্শন করেন না।” সুতরাং যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে আপনি তাদেরকে খুব তাড়াতাড়ি ওদের সাথে মিলিত হতে দেখবেন এ বলে, আমরা আশংকা করছি যে, কোন বিপদ আমাদের আক্রান্ত করবে। অতঃপর হয়ত আল্লাহ বিজয় বা তার কাছ থেকে এমন কিছু দেবেন যাতে তারা তাদের অন্তরে যা গোপন রেখেছিল সে জন্য লজ্জিত হবে, আর মুমিনগণ বলবে, এরাই কি তারা, যারা আল্লাহর নামে দৃঢ়ভাবে শপথ করেছিল যে, নিশ্চয় তারা তোমাদের সঙ্গেই আছে? তাদের আমলসমূহ নিস্ফল হয়েছে; ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ দ্বীন থেকে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং যারা তাকে ভালবাসবে; তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে; তারা আল্লাহ্‌র পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না; এটা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছে তাকে তিনি তা দান করেন এবং আল্লাহ্‌ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। তোমাদের বন্ধু তো কেবল আল্লাহ, তার রাসূল ও মুমিনগণ যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং তারা বিনীত। আর যে আল্লাহ, তার রাসূল ও মুমিনগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তবে নিশ্চয় আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।”(সূরা মায়েদাহ: ৫১-৫৫) আল্লাহ আরো বলেন: আর [স্মরণ করো, হে মুহাম্মদ], যখন ইব্রাহিম তার পিতা এবং তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা যেগুলোর ইবাদত কর নিশ্চয় আমি তাদের থেকে সম্পর্কমুক্ত। তবে তিনি ব্যতীত যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর নিশ্চয় তিনি শীঘ্রই আমাকে সৎপথে পরিচালিত করবেন।”(সূরা আয-যুখরুফ ৪৩: ২৬-২৭) তিনি আল্লাহ আরো বলেন; “অবশ্যই তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, “তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তা হতে আমরা সম্পৰ্কমুক্ত। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শক্ৰতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যতক্ষণ না তোমরা একমাত্র আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করো।”[আল-মুমতাহিনা ৬০: ৪]। পবিত্র কুরআনে এমন আরও বহু আয়াত রয়েছে, যেখানে মু’মিনদের একে অপরের মিত্র ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে, আর কাফিরদেরকে বন্ধু ও সহচর হিসেবে গ্রহণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে, তাদের ও তাদের উপাস্যদের প্রতি স্পষ্টভাবে অস্বীকার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
.
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
« إِنَّ أَوْثَقَ عُرَى الْإِيمَانِ أَنْ تُحِبَّ فِي اللهِ، وَتُبْغِضَ فِي اللهِ »
“ইমানের সবচেয়ে সুদৃঢ় বন্ধন হল, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা পোষণ করা”।(ইমাম বায়হাকী শুয়াবুল ইমান হা/১৪) অপর হাদীসে আনাস বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন,রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,তিনটি জিনিস যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে ইমানের স্বাদ উপভোগ করতে পারবে। (১).যে ব্যক্তি কোনও মানুষকে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসবে। (২).যার নিকট আল্লাহ ও আল্লাহর রসুল অন্য সব কিছু হতে অধিক প্রিয় হবে। (৩).এবং আল্লাহ তাকে কুফরি থেকে রক্ষা করার পর পুনরায় কুফরিতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া তার নিকট অধিক প্রিয় মনে হবে।”(সহীহ বুখারী,হা/ ২১, ৬০৪১ ও সহীহ মুসলিম, হাদিস: ৪৩, ৬৮) অপর বর্ননায় মুয়াজ ইবন জাবাল (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলাম: “সর্বোত্তম ঈমান কী? তিনি বললেন:أَفْضَلُ الْإِيمَانِ أَنْ تُحِبَّ لِلَّهِ، وَتُبْغِضَ فِي اللهِ، وَتُعْمِلَ لِسَانَكَ فِي ذِكْرِ “সর্বোত্তম ঈমান হলো,“আল্লাহর জন্য ভালোবাসা রাখা, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা, এবং আল্লাহর জিকিরে তোমার জিহ্বাকে ব্যস্ত রাখা।”(মুসনাদে আহমেদ হা/২২১৩২; শাইখ শুআইব আরনাঊত হাদীসটি সনদ সহীহ বলেছেন)আরেক বর্ননায় ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:أوثق عرى الإيمان: الموالاة في الله ، والمعاداة في الله ، والحب في الله ، والبغض في الله عز وجل وصححه الألباني في“ঈমানের সবচেয়ে মজবুত বন্ধন হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মুমিনদেরকে ভালোবাসা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাফেরদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা।”(সহীহ আল-জামি’ আস-সাগীর হা/২৫৩৯; ইমাম আলবানী হাদীসটি সহীহ বলেছেন)
.
যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] বলেছেন:” من أحب في الله، وأبغض في الله، ووالى في الله، وعادى في الله، فإنما تنال ولاية الله بذلك، ولن يجد عبد طعم الإيمان، وإن كثرت صلاته وصومه حتى يكون كذلك، وقد صارت عامة مؤاخاة الناس على أمر الدنيا، وذلك لا يجدي على أهله شيئا ”যে আল্লাহর জন্য ভালবাসে এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, এবং যে আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব নষ্ট করে অথবা তার জন্য শত্রুতা ঘোষণা করে, সে আল্লাহর কাছ থেকে নিরাপত্তা পাবে৷ এটা ছাড়া কেউ প্রকৃত ঈমানের স্বাদ পাবে না, যদিও তার সওম ও সালাত অনেক হয়৷ মানুষ দুনিয়াবী বিষয়ে সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা তাদেরকে কোন উপকারই করতে পারবে না৷”(ইবনে রজব আল হাম্বালী, জামি আল উলূমওয়াল হাকিম,পৃষ্ঠা;৩০) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “ঈমানের ঘোষণা আল্লাহ ছাড়া ইবাদত যোগ্য আর কোন ইলাহ নেই, এর দাবী হচ্ছে তুমি শুধু আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসবে, কাউকে শুধু আল্লাহর জন্য ঘৃণা করবে, নিজেরা বন্ধুত্ব করবে আল্লাহর জন্য, কারও সাথে শত্রুতা ঘোষণা করবে শুধু আল্লাহর জন্য; এর দাবী হচ্ছে তুমি ভালবাসবে যা আল্লাহ ভালবাসেন, তুমি ঘৃণা করবে যা আল্লাহ ঘৃণা করেন”(আল-ইহতিজাল ফিল ক্বদর, পৃষ্ঠা: ৬২)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: “ফযিলাতুশ শাইখ! দয়া করে মৈত্রী ও শত্রুতার বিষয়টা পরিস্কার করবেন কী? কাদের সাথে মৈত্রী করতে হবে? কাফেরদের সাথে মৈত্রী করা কি জায়েয আছে?
তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) উত্তর বলেন:
الولاء والبراء معناه محبة المؤمنين وموالاتهم وبغض الكافرين ومعاداتهم والبراءة منهم ومن دينهم هذا هو الولاء والبراء كما قال الله سبحانه في سورة الممتحنة: قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ الآية. وليس معنى بغضهم وعداوتهم أن تظلمهم أو تتعدى عليهم إذا لم يكونوا محاربين، وإنما معناه أن تبغضهم في قلبك وتعاديهم بقبلك ولا يكونوا أصحابا لك، لكن لا تؤذيهم ولا تضرهم ولا تظلمهم فإذا سلموا ترد عليهم السلام وتنصحهم وتوجههم إلى الخير كما قال الله عز وجل: وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ الآية. وأهل الكتاب هم اليهود والنصارى وهكذا غيرهم من الكفار الذين لهم أمان أو عهد أو ذمة، لكن من ظلم منهم يجازى على ظلمه، وإلا فالمشروع للمؤمن الجدال بالتي هي أحسن مع المسلمين والكفار مع بغضهم في الله للآية الكريمة السابقة…” ا
“আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা তথা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা ও আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঘৃণা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে মুমিনদেরকে ভালোবাসা, তাদের সাথে মিত্রতা রাখা এবং কাফেরদেরকে ঘৃণা করা, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা এবং তাদের থেকে ও তাদের ধর্ম থেকে নিজের সম্পর্কচ্ছেদ করা। এটাই হচ্ছে মৈত্রী ও শত্রুতা। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সূরা মুমতাহিনাহতে বলেছেন:“তোমাদের জন্য ইব্রাহিম (আঃ) ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যখন তারা তাদের কওমকে বলেছিল:”তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করো, তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করি। এবং আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে চিরকালীন শত্রুতা ও বিদ্বেষ শুরু হয়েছে, যতক্ষণ না তোমরা একমাত্র আল্লাহর ওপর ঈমান আনো।”(সূরা আল-মুমতাহিনা: ৪) কাফেরদেরকে ঘৃণা করা ও তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করার অর্থ এ নয় যে, আপনি তাদের উপর যুলুম করবেন কিংবা তাদের উপর সীমালঙ্ঘন করবেন; যদি না তারা হারবী (যুদ্ধরত শ্রেণীর) না হয়। বরং এর মর্ম হচ্ছে আপনি মনে মনে তাদেরকে ঘৃণা করবেন, মনে মনে তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবেন এবং তারা আপনার বন্ধু হবে না। কিন্তু আপনি তাদেরকে কষ্ট দিবেন না, তাদের ক্ষতি করবেন না, তাদের উপর যুলুম করবেন না। যদি তারা সালাম দেয় সালামের উত্তর দিবেন। তাদেরকে উপদেশ দিবেন। ভাল কাজের দিক নির্দেশনা দিবেন।যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “তোমরা কিতাবীদের সঙ্গে তর্ক করো না, কিন্তু উত্তম পন্থায়,তাদের মধ্যে যারা জুলুম করে, তাদের ছাড়া।(সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত: ৪৬) কিতাবধারী হচ্ছে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা। অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য অন্যান্য কাফেরদের ক্ষেত্রেও যাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে কিংবা অঙ্গীকার দেয়া হয়েছে কিংবা জিম্মা দেয়া হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে যারা জুলুম করেছে তাদেরকে তাদের জুলুম অনুপাতে শাস্তি দেয়া যাবে। অন্যথায় মুমিনদের জন্য শরয়ি বিধান হলো পূর্বোক্ত আয়াতে কারীমার ভিত্তিতে মুসলিম ও কাফেরদের সাথে উত্তম পন্থায় বিতর্ক করা…।(বিন বায; মাজমায়ে ফাতওয়া; খন্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৪৬)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা বলতে কী বুঝায়?
জবাবে শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
البراء والولاء لله -سبحانه- أن يتبرأ الإنسان من كل ما تبرأ الله منه كما قال -سبحانه وتعالى-: (قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآءُؤا مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَداً) (الممتحنة: من الآية4) وهذا مع القوم المشركين كما قال -سبحانه-: (وَأَذَانٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ) (التوبة: من الآية3) ؛ فيجب على كل مؤمن أن يتبرأ من كل مشرك وكافر. فهذا في الأشخاص.وكذلك يجب على المسلم أن يتبرأ من كل عمل لا يرضي الله ورسوله ، وإن لم يكن كفراً، كالفسوق والعصيان، كما قال – سبحانه-: (وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْأِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ أُولَئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ) (الحجرات: من الآية7)”
“আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা অর্থাৎ আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা হচ্ছে আল্লাহ্‌তাআলা যা কিছু থেকে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা করেছেন সেগুলো থেকে ব্যক্তি নিজের সম্পর্কচ্ছেদ করা; যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেন:” তোমাদের জন্য ইবরাহিম ও তাঁর সাথীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যখন তারা তাদের কওমকে বলেছিল: আমরা তোমাদের থেকে ও তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করো, তাদের থেকে মুক্ত। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি। এবং আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরস্থায়ী শত্রুতা ও বিদ্বেষ শুরু হয়ে গেছে…(সূরা আল-মুমতাহিনা: আয়াত: ৪) এই বিধান মুশরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।যেমন আল্লাহ আরও বলেন:”আর মহান হজের দিনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি এটা এক ঘোষণা যে, নিশ্চয় মুশরিকদের সম্পর্কে আল্লাহ দায়মুক্ত এবং তার রাসূলও।(সূরা আত-তাওবা: আয়াত: ৩) তাই প্রত্যেক মুমিনের উপর ওয়াজিব হল প্রত্যেক মুশরিক ও কাফের থেকে নিজেকে অবমুক্ত রাখা। এ বিধান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে। অনুরূপভাবে মুসলিমের উপর ওয়াজিব হল এমন প্রত্যেক কর্ম থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করা যে কর্মের প্রতি আল্লাহ্‌ও তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট নন; এমনকি যদি সেটা কুফর না হয়ে পাপাচার ও অবাধ্যতা হয় তবুও। যেমনটি আল্লাহ তায়লা বলেছেন:”কিন্তু আল্লাহ তোমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তা তোমাদের হৃদয়ে শোভামণ্ডিত করেছেন। আর কুফর, গোনাহ এবং অবাধ্যতাকে তিনি তোমাদের কাছে ঘৃণিত করে দিয়েছেন। তারাই তো সৎপথপ্রাপ্ত।:(সূরা হুজুরাত: ৭; ইবনু উসাইমীন, ফাতাওয়ে আরকানুল ইসলাম পৃষ্ঠা: ১৮৩)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] নাওয়াকিযুল ঈমান’ গ্রন্থে বলেন: শাইখ (রহঃ) কাফেরের সাথে মিত্রতার একটি প্রকার উল্লেখ করেছেন। সেটি হচ্ছে যুদ্ধে সহযোগিতা। যদিও মৈত্রী অন্তরের ভালোবাসা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করা, তাদের স্তুতি ও প্রশংসা করা ইত্যাদিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। কেননা আল্লাহ্‌তাআলা কাফেরদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা, ঘৃণা করা ও তাদের সাথে সম্পর্কছিন্ন করা মুসলমানদের উপর ওয়াজিব করেছেন। ইসলামে এ অধ্যায়কে বলা হয়: মৈত্রী ও শত্রুতা।(নাওয়াকিযুল ঈমান’ পৃষ্ঠা: ১৫৮)
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা অর্থাৎ আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা ইমানের একটি মৌলিক অনুষঙ্গ। এর প্রকৃত তাৎপর্য হলো: আল্লাহভীরু, দ্বীনদার, সৎ চরিত্রবান এবং আহলে ইলমদের প্রতি পরিপূর্ণ আন্তরিক ভালোবাসা পোষণ করতে হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে, কাফের, মুশরিক, বিদআতি, মুনাফিক এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রকাশ্য শত্রুদের প্রতি হৃদয়ের গভীর থেকে ঘৃণা করতে হবে এবং তাদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপন করা কোনো অবস্থাতেই বৈধ নয়। এটি ইমানের দাবি। অবশ্য কাফের-মুশরিকদের সাথে দুনিয়াবি স্বার্থে যেমন: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, আত্মীয়ার বন্ধন, কূটনৈতিক বিষয় ইত্যাদি কারণে বাহ্যিক সম্পর্ক রাখায় কোন দোষ নেই, যতক্ষণ না সেই সম্পর্ক হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রীতির রূপ নেয়। এছাড়া কেউ যদি এমন হয় যে তার মধ্যে ইসলামী নীতি ও আদর্শের কিছু চিহ্ন বিদ্যমান, আবার সাথে সাথে কিছু গুনাহ বা শরীয়ত-বিরোধী কাজও রয়েছে, তাহলে তার প্রতি অবস্থান হবে ভারসাম্যপূর্ণ। তার যেসব দিক ইসলামের অনুকূল, সে পরিমাণ ভালোবাসা পোষণ করতে হবে; আর যেসব দিক ইসলামের পরিপন্থী, তা ততটুকুই ঘৃণার যোগ্য। এটাই হলো ন্যায়পরায়ণ ও শরীয়তসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি।
আল্লাহ তাআলাই সর্বজ্ঞ ও সর্বোত্তম বিচারক।
▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

No comments:

Post a Comment

Translate