প্রশ্ন: সালাতের বাইরে কুরআন তেলাওয়াত শোনা হলে, তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা এবং তেলাওয়াত চলাকালে নীরব থাকা কি শরয়ী দৃষ্টিতে আবশ্যক? এছাড়া বাসায় বা বাইরে কাজের ফাঁকে, শুয়ে-বসে রেডিও/মোবাইল থেকে কুরআনের তেলাওয়াত শোনা কি শরিয়তসম্মত? এ অবস্থায় মনোযোগে ঘাটতি হলে শোনার বিধান কী হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’আলার জন্য। দুরুদ বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর। অতঃপর মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মানবজাতির কল্যাণের আলো।মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ তাআলা সর্বশেষ যে আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, তা হলো আল-কুরআন। এই মহাগ্রন্থের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা হলো এটি আল্লাহ তাআলার কালাম, অর্থাৎ স্বয়ং তাঁর বাণী। তাই এর প্রতিটি অক্ষর, শব্দ, আয়াত এবং সূরা, রহমত, বরকত ও হেদায়াতে পরিপূর্ণ।যখন কোনো মুমিন নারী-পুরুষ কুরআন তেলাওয়াত করে,কিংবা তেলাওয়াত মনোযোগ দিয়ে শ্রবন করে তখন তার ঈমান বৃদ্ধি পায়, চোখ অশ্রুসিক্ত হয়, অন্তর কেঁপে ওঠে,গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় এবং মন-প্রাণ বিনয়ী হয়ে পড়ে। সুতরাং, কুরআন তেলাওয়াত কিংবা অন্য কারো তেলাওয়াত শ্রবণ করার সময় মনোযোগ অন্য কোথাও রাখা উচিত নয়। তেলাওয়াত অবশ্যই উদাসীনতা ছাড়া, পূর্ণ মনোযোগ ও শ্রদ্ধার সাথে করা উচিত,শোনা উচিত। তেলাওয়াতের সময় একজন ক্বারী (তেলাওয়াতকারী) ভাববে,সে যেন স্বয়ং আল্লাহর সামনে উপস্থিত রয়েছে এবং আল্লাহর কালাম তেলাওয়াতের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে কথা বলছে। এভাবে তেলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করতে হবে, যাতে মনোসংযোগ ও একাগ্রতা আরও বাড়ে।
.
এখন প্রশ্ন হচ্ছে,সালাতের বাইরে কুরআনের তেলাওয়াত শ্রবণ করার সময় চুপ থাকা ও মনোযোগ দেওয়া ফরজ (ওয়াজিব) না মুস্তাহাব (উপযুক্ত) এ বিষয়ে আহলুল আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।সাধারণত,এ বিষয়ে দু’টি প্রসিদ্ধ অভিমত পাওয়া যায়।
.
(১).প্রথম অভিমত হলো সালাতের বাইরে মনোযোগ সহকারে কুরআনুল কারীম শ্রবণ করা এবং তেলাওয়াত চলাকালে নীরব থাকা ওয়াজিব। এটি হানাফি মাজহাবের অভিমত। তাঁদের কেউ কেউ একে ব্যক্তিগত ফরজ (ফরযে আইন) হিসেবে গণ্য করেছেন, আবার কেউ কেউ একে সমষ্টিগত ফরজ (ফরযে কিফায়া) বলে বিবেচনা করেছেন। তাঁরা দলিল হিসেবে আল্লাহ্ তাআলার এই আয়াতটি পেশ করেছেন যেখানে মহান আল্লাহ বলেছেন:وَ اِذَا قُرِیٴَ الۡقُرۡاٰنُ فَاسۡتَمِعُوۡا لَهٗ وَ اَنۡصِتُوۡا لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ“অতএব, যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো এবং চুপ থাকো, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হয়।”(সূরা আল-আ’রাফ; ৭: ২০৪)
.
আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ গ্রন্থে এ এসেছে:
الاستماع إلى تلاوة القرآن الكريم حين يقرأ خارج الصلاة واجبٌ إن لم يكن هناك عذرٌ مشروعٌ لترك الاستماع .
وقد اختلف الحنفيّة في هذا الوجوب ، هل هو وجوبٌ عينيٌّ ، أو وجوبٌ كفائيٌّ ؟
قال ابن عابدين : الأصل أنّ الاستماع للقرآن فرض كفايةٍ ، لأنّه لإقامة حقّه ، بأن يكون ملتفتاً إليه غير مضيّعٍ ، وذلك يحصل بإنصات البعض ، كما في ردّ السّلام .ونقل الحمويّ عن أستاذه قاضي القضاة يحيى الشّهير بمنقاري زاده : أنّ له رسالةً حقّق فيها أنّ سماع القرآن فرضُ عينٍ .نعم إنّ قوله تعالى في سورة الأعراف ( وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُواْ لَهُ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ) قد نزلت لنسخ جواز الكلام أثناء الصّلاة ، إلاّ أنّ العبرة لعموم اللّفظ لا لخصوص السّبب ، ولفظها يعمّ قراءة القرآن في الصّلاة وفي غيرها “
“নামাযের বাইরে কুরআন তিলাওয়াত করা হলে, যদি তা শোনার ক্ষেত্রে শরয়ী কোনো বৈধ ওজর না থাকে, তাহলে সেই তিলাওয়াত শোনা ওয়াজিব (আবশ্যক)। তবে হানাফি মাজহাবে এ ওয়াজিব হওয়ার বিষয়ে মতভেদ রয়েছে এটি কি ফরযে আইন (প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ব্যক্তিগতভাবে ফরজ) নাকি ফরযে কেফায়া (সম্মিলিতভাবে ফরজ)?” ইবনে আবিদীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: মূলনীতি হলো কুরআন শ্রবণ করা ফরযে কিফায়া, কেননা এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরআনের হক আদায় করা, অর্থাৎ মনোযোগসহ তা শোনা ও অবহেলা না করা। আর এটি তখনই পূরণ হয়ে যায় যখন উপস্থিত ব্যক্তিদের কেউ অন্তত তা মনোযোগসহ শোনে। ঠিক যেমন সালামের জবাব দেওয়া (যদি এক ব্যক্তি জবাব দেয়, তবে অন্যদের পক্ষ থেকেও তা আদায় হয়ে যায়)। আল-হামাওয়ী তাঁর শাইখ, প্রধান বিচারপতি ইয়াহইয়া (যিনি ‘মিনকারীযাদা’ নামে পরিচিত) থেকে বর্ণনা করেছেন: তাঁর একটি পুস্তিকা রয়েছে, যাতে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, কুরআন শোনা ফরযে ‘আইন (ব্যক্তিগত ফরজ)।” “হ্যাঁ, আল্লাহ তায়ালার বাণী: ‘আর যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে তা শোন এবং চুপ থাকো, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হয়’ (সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ২০৪)—এই আয়াত নামাযের সময় কথা বলার বৈধতা রহিত করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছিল। তবে ফিকহের মূলনীতি হলো: শুধু অবতীর্ণ হওয়ার কারণ নয়, বরং শব্দের সাধারণতাই বিবেচ্য। আর এই আয়াতের শব্দাবলী এমন যে, তা নামাযের ভেতরে ও বাইরে—উভয় ক্ষেত্রেই কুরআন তিলাওয়াতের সময় শ্রবণের নির্দেশ দেয়।”(আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৮৬)
.
(২).দ্বিতীয় মতামত অনুযায়ী সালাতের বাইরে মনোযোগ সহকারে কুরআনুল কারীম শ্রবণ করা এবং তেলাওয়াতের সময় চুপ থাকা মুস্তাহাব ও সুপারিশকৃত। এ মতের অনুসারীরা সূরা আল-আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতকে কেবল নামাযের তিলাওয়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে ব্যাখ্যা করেছেন।এটি (জমহুর) অধিকাংশ আলেমদের মত।
.
হাফিয ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
وقال علي بن أبي طلحة عن ابن عباس في الآية قوله : ( وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُواْ لَهُ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ) الأعراف/204 : يعني في الصلاة المفروضة . وكذا روي عن عبد الله بن المغفل . وقال ابن جرير : حدثنا حميد بن مسعدة حدثنا بشر بن المفضل حدثنا الجريري عن طلحة بن عبيد الله بن كريز قال : رأيت عبيد بن عمير وعطاء بن أبي رباح يتحدثان والقاص يقص فقلت : ألا تستمعان إلى الذكر وتستوجبان الموعود ؟ قال : فنظرا إلي ثم أقبلا على حديثهما . قال : فأعدت ، فنظرا إلي وأقبلا على حديثهما . قال : فأعدت الثالثة ، قال : فنظرا إلي فقالا : إنما ذلك في الصلاة ( وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُواْ لَهُ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ) الأعراف/204وكذا رواه غير واحد عن مجاهد وقال عبد الرزاق عن الثوري عن ليث عن مجاهد قال : لا بأس إذا قرأ الرجل في غير الصلاة أن يتكلم .
وكذا قال سعيد بن جبير والضحاك وإبراهيم النخعي وقتادة والشعبي والسدي وعبد الرحمن بن زيد بن أسلم : أن المراد بذلك في الصلاة .وهذا اختيار ابن جرير : أن المراد من ذلك الإنصات في الصلاة وفي الخطبة كما جاء في الأحاديث من الأمر بالإنصات خلف الإمام وحال الخطبة “
“আলী ইবনে আবি তালহা ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে আয়াতটির (সূরা আল-আ‘রাফ: ২০৪) তাফসিরে বর্ণনা করেন:“وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُواْ لَهُ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ”অর্থ: যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর এবং চুপ থাকো, যাতে তোমরা দয়া প্রাপ্ত হও।[সূরা আল-আ‘রাফ: ২০৪] তিনি বলেন: এর অর্থ হলো ফরজ নামাযে (ইমামের) কুরআন তিলাওত শোনার সময় (চুপ থাকা)। একই ব্যাখ্যা আবদুল্লাহ ইবনুল মুগাফফাল থেকেও বর্ণিত হয়েছে। ইবনু জারীর বলেন: আমাদেরকে হামীদ ইবনু মাসআদাহ বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: আমাদেরকে বিশর ইবনুল মুফাদ্দাল বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: আমাদেরকে আল-জারীরী বর্ণনা করেছেন, তিনি তালহা ইবনু উবায়দুল্লাহ ইবনু কুরায়য থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:আমি ‘উবায়দ ইবনু উমাইর এবং ‘আতা ইবনু আবি রাবাহকে দেখেছি তারা একজন কাহিনীকার কাহিনী বলার সময় নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন। আমি বললাম: “তোমরা কি ‘যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করো এবং চুপ থাকো’—এই আয়াত শুনো না? তাহলে কি তোমরা আল্লাহর প্রতিশ্রুত রহমতের যোগ্য হওয়ার চেষ্টা করবে না?” তারা আমার দিকে তাকালেন এবং আবার নিজেদের কথাবার্তায় ফিরে গেলেন। আমি আবার বললাম, তারা আবার তাকালেন, আবার নিজেদের কথায় ফিরে গেলেন।তৃতীয়বার বললে, তারা বললেন: এই নির্দেশ শুধুমাত্র নামাযের মধ্যে প্রযোজ্য। এমনিভাবেই একাধিক ব্যক্তি মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ) থেকেও এই ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন। আবদুর রাজ্জাক, স্বরী থেকে, তিনি লায়স থেকে, তিনি মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন: তিনি বলেন: “নামাযের বাইরে কেউ কুরআন তিলাওয়াত করলে, তখন কথা বললে কোনো সমস্যা নেই।”এমনটিই বলেছেন:সাঈদ ইবনু জুবাইর, যাহহাক, ইব্রাহীম নাখাঈ, কাতাদাহ, আশ-শা‘বী, আস-সুদ্দী এবং আব্দুর রহমান ইবনু যায়েদ ইবনু আসলাম। ইবনু জারীরও এই মতকেই গ্রহণ করেছেন: এই আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো নামাযে অথবা খুতবার সময় কুরআন তিলাওয়াত হলে চুপ থাকা ও মনোযোগ দেওয়া। কেননা, হাদীসসমূহে এমন সময় ইমামের পেছনে এবং খুতবার সময় চুপ থাকার নির্দেশ এসেছে।”(তাফসীরে ইবনে কাসীর; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৭২)
.
উপরোক্ত দুটি মতের মধ্যে দ্বিতীয় মতটি অধিক গ্রহণযোগ্য ও যথার্থ বলে প্রতীয়মান হয়, কারণ কোনো বিষয়কে বাধ্যতামূলক করতে হলে তার জন্য কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ থেকে স্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য দলীল থাকা আবশ্যক। অন্যথায়,যথাযথ প্রমাণ ব্যতিরেকে কাউকে কোনো বিষয়ে বাধ্য করা বা নিষেধ করা হলে,তা মানুষের জন্য জুলুম ও কষ্টদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।তবে হা! এতে কোন সন্দেহ নাই যে,কুরআন তিলাওয়াত চলাকালে শ্রদ্ধার সাথে নিরবতা অবলম্বন করে মনোযোগ সহকারে শোনা একজন মুসলিমের জন্য অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও কাম্য। এটি কুরআনের প্রতি সম্মান ও মহত্ব প্রদর্শনের অংশ হিসেবে বিবেচিত।অন্যদিকে, ঘরে কিংবা ঘরের বাইরে, জাগ্রত অবস্থায় হোক বা নিদ্রারত অবস্থায়, কুরআনের তিলাওয়াত রেডিও বা অন্য কোনো মাধ্যমে চালু রাখা দোষণীয় নয়। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, তিলাওয়াতের পরিবেশে যেন কোনো রকম হট্টগোল, চেঁচামেচি, অনুচিত কথাবার্তা বা কুরআনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এমন কিছু না ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে তিলাওয়াত বন্ধ রাখা অধিক উপযুক্ত ও সম্মানজনক। কারণ, কুরআনের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত।যেমন:জুনদুব ইবনু আব্দুল্লাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إِقْرَؤُوْا الْقُرْآنَ مَا ائْتَلَفَتْ عَلَيْهِ قُلُوْبُكُمْ فَإِذَا اخْتَلَفْتُمْ فَقُوْمُوْا عَنْهُ “তোমরা কুরআন পড়, যতক্ষণ তোমাদের মন তা সাগ্রহে চায়। অতঃপর যখন মনের ভাব অন্যরূপ দেখ, তখন তা ছেড়ে উঠে যাও!”(সহীহ বুখারী, হা/৫০৬০; মিশকাত, হা/২১৯০) অপর বর্ননায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ مِنَ اللَّيْلِ فَاسْتَعْجَمَ الْقُرْآنُ عَلَى لِسَانِهِ فَلَمْ يَدْرِ مَا يَقُوْلُ فَلْيَضْطَجِعْ “যখন তোমাদের কেউ রাতে উঠবে ও (ঘুমের চাপের কারণে) জিহ্বায় কুরআন পড়তে এমন অসুবিধা বোধ করবে যে, সে কি বলছে তা বুঝতে পারবে না, তখন সে যেন শুয়ে পড়ে”।(সহীহ মুসলিম,হা/৭৮৭;আবূ দাঊদ, হা/১৩১১; ইবনু মাজাহ, হা/১৩৭২)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] তাঁর গ্রন্থ মুখতাছারুত তিবইয়ান ফী আদাবী হামলাতিল কুরআন -এ বলেন:ومما يعتنى به ويتأكد الأمر به احترام القرآن من أمور قد يتساهل فيها بعض الغافلين القارئين مجتمعين .فمن ذلك : اجتناب الضحك واللغط والحديث في خلال القراءة إلا كلاما يضطر إليه ، وليمتثل قول الله تعالى : ( وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون ) কুরআনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন—এটি এমন একটি বিষয়, যার প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হওয়া জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, কিছু গাফেল ব্যক্তি সম্মিলিতভাবে কুরআন তেলাওয়াত করেন, অথচ যথাযথ আদব রক্ষা করেন না। যেমন—তেলাওয়াত চলাকালীন হাসাহাসি, অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা কিংবা অমনোযোগিতা—এসব থেকে বিরত থাকা উচিত। কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কথা বলার অনুমতি রয়েছে। আল্লাহ তাআলার এই বাণী অনুসরণ করা উচিত: ‘যখন কুরআন তেলাওয়াত করা হয়, তখন মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করো এবং নীরব থাকো, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হয়।”(সূরা আ’রাফ: ২০৪; ইমাম নববী, মুখতাসারুত তিবইয়ান ফী আদাবী হামলাতিল কুরআন; পৃষ্ঠা: ৯২)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: “বাসায় রেডিও তে বা রেকর্ডারে কুরআনে কারীম বাজিয়ে রাখার হুকুম কী; যখন কেউ তার পরিবারকে দেখার জন্য বা আত্মীয়স্বজনকে দেখার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে?
জবাবে শাইখ বলেন: لا حرج في ذلك، إذا كان ما حوله لغط، إذا كان ما حوله مَن يلغط أو يتكلم بغير حاجة فلا بأس، أما فتح الراديو على القرآن وحوله من يلغط ويتكلم ويخوض فلا، تركه أولى ، يصك؛ لأن هذا فيه نوع امتهان للقرآن، أما إذا فتح ولا عنده أحد، وعنده أحد يستمع أو ساكت أو نائم لا بأس “এতে কোন আপত্তি নাই; যদি তেলাওয়াতের আশেপাশে হৈচৈ না থাকে। যদি তেলাওয়াতের পাশে হৈচৈ করার বা প্রয়োজনবিহীন কথা বলার মত কেউ না থাকে তাহলে কোন অসুবিধা নাই। আর যদি রেডিওতে কুরআন তেলাওয়াত ছেড়ে রাখা হয় অথচ আশপাশে কেউ হৈচৈ করছে, কথা বলছে তাহলে নয়। বরং এমতাবস্থায় বন্ধ রাখাই যুক্তিযুক্ত। যেহেতু এতে কুরআনের অমর্যাদা করা হয়। আর যদি এভাবে ছেড়ে রাখা হয় যে, সেখানে কেউ নাই কিংবা কেউ শুনতেছে, কেউ চুপ করে আছে কিংবা কেউ ঘুমিয়ে আছে তাহলে এতে কোন অসুবিধা নাই।” (বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-১৬১৪৫; ইসলাম সাওয়াল জবাব ফাতওয়া নং ১৭৪৭৪৩)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল:আমি দীর্ঘ সময় রান্নাঘরে থাকি, আমার স্বামীর জন্য খাবার প্রস্তুতের কাজে। সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আমি কুরআন তেলাওয়াত শুনি, কখনো রেডিও থেকে, কখনো টেপ রেকর্ডার থেকে। তাহলে আমার এই কাজ কি সঠিক? নাকি এটি অনুচিত, কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন: আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করো এবং নীরব থাকো, যেন তোমরা দয়া লাভ কর।[সূরা আল-আ’রাফ: ২০৪]
উত্তরে শাইখ বলেন:”لا بأس باستماع القرآن الكريم من المذياع أو من المسجل والإنسان يشتغل ، ولا يتعارض هذا مع قوله : ( فَاسْتَمِعُواْ لَهُ وَأَنصِتُواْ ) ؛ لأن الإنصات مطلوب حسب الإمكان ، والذي يشتغل ينصت للقرآن حسب استطاعته ” ا”রেডিও বা টেপ রেকর্ডার থেকে কুরআন তেলাওয়াত শোনা,যদিও কেউ কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে,তাতে কোনো দোষ নেই। এটি আয়াতে উল্লেখিত (মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর ও চুপ থাকো)-এর বিরোধী নয়। কারণ, নীরবতা ও মনোযোগ দেওয়া সম্ভবপরতার ভিত্তিতে চাওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি কোনো কাজে ব্যস্ত, সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কুরআনের প্রতি মনোযোগ দিবে।”(আল-মনতাকা মিন ফাতাওয়া আল-ফাওজান,খণ্ড ৩, প্রশ্ন নং-৪৩৭)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: “কিছু মানুষ ঘুমানোর পূর্বে, অথবা পড়াশোনা কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকার সময় কুরআন তিলাওয়াত শোনে। এটি কি আদব (শিষ্টাচার)-এর অন্তর্ভুক্ত? এবং এর শরঈ হুকুম কী?”
তিনি উত্তরে বলেন: هذا ليس من الآداب ، ليس من الآداب أن يتلى كتاب الله ولو بواسطة الشريط وأنت متغافل عنه ، لقول الله تبارك وتعالى: ( وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا ) الأعراف/20 ، فلذلك نقول : إن كنت متفرغاً لاستماعه فاستمع ، وإن كنت مشغولاً فلا تفتحه … بعض الناس يقول لي: لا ينام إلا على سماع القرآن، إذا كان كذلك فلا بأس ، إذا كان مضطجعاً ينتظر النوم ما عنده شغل ، فيستمع هذا لا بأس به ، ومن استعان بسماع كلام الله، على ما يريد من الأمور المباحة ، لا بأس ليس هناك مانع
“এটি শিষ্টাচারের পরিপন্থী যে, আল্লাহর কিতাব (কুরআন) তেলাওয়াত করা হয়, এমনকি যদিও তা
টেপ বা রেকর্ডিং-এর মাধ্যমে হোক, এমতাবস্থায় তুমি তার প্রতি (গাফিল) উদাসীন থাকো।কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আর যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো এবং চুপ থাকো’ (সূরা আল আ’রাফ: ২০৪)। সুতরাং আমরা বলি: যদি তুমি এটি শোনার জন্য অবসর হও, তাহলে শুনো; আর যদি ব্যস্ত থাকো, তাহলে তা চালু করো না।…কিছু লোক আমাকে বলে, ‘আমি কুরআন না শুনলে ঘুমাতে পারি না।’ যদি এমন হয় যে, সে শুয়ে আছে এবং ঘুমের জন্য অপেক্ষা করছে, তার কোনো কাজ নেই, এবং সে মনোযোগ দিয়ে (কুরআন) শুনছে,তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। আর কেউ যদি কুরআনের বাণী শুনে এমন কোনো বৈধ উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়, তাহলে তাতেও কোনো সমস্যা নেই,এতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।”(ইবনু উসাইমীন; লিকাউল বাবিল মাফতূহ, পর্ব ১৪৬; পৃষ্ঠা: ১৪)
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে আরো জিজ্ঞেস করা হয়েছিল
প্রশ্ন: একদল লোক গাড়িতে সফর করছিল, তাদের একজন কুরআনের ক্যাসেট চালু করলো। এখন প্রশ্ন হলো,গাড়ীর সবার কি সেই ক্যাসেট শুনা ফরয? আর কেউ যদি কথা বলে, তাহলে কি সে গুনাহগার হবে?
শাইখ (রহিমাহুল্লাহ) এর উত্তরে বলেন:
قال الإمام أحمد رحمه الله في هذه الآية : هذا في الصلاة . وقال : أجمعوا على أن ذلك في الصلاة . وعلى هذا فلو كنت بجوار شخص يقرأ القرآن ويجهر به ، وأنا أسبح وأهلل – ذكر خاص – فإنه لا يلزمني أن أستمع له ، وإنما ذلك في الصلاة فقط .ولكني أقول للأخ الذي شغل المسجل : لا تشغل والناس غافلون ؛ لأن هذا أدنى ما نقول فيه أنه يشبه من قال الله فيهم : ( وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لا تَسْمَعُوا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ ) فصلت/26 ، فإذا رأيت إخوانك لا يريدون الاستماع ، إنما هم مشغولون بالحديث بينهم ، فلا تشغل المسجل ، وإذا كنت تشتاق لهذا فهناك سماعة صغيرة أدخلها في أذنك ، ويجعل الصوت له وحده “
“ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) এই আয়াত সম্পর্কে বলেছেন— {وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا}—”যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন মনোযোগ দিয়ে শুনো এবং চুপ থাকো”(সূরা আরাফ:২০৪)—এই আয়াত সালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট। এবং তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, সমস্ত বিদ্বান একমত যে এটি সালাতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সুতরাং, যদি আমি এমন কারো পাশে থাকি যিনি জোরে কুরআন তেলাওয়াত করছে, আর আমি নিজে তখন তাসবীহ-তাহলীল (ব্যক্তিগত জিকির) করছি, তাহলে আমার উপর সেই কুরআন শোনা আবশ্যক নয়। এই নির্দেশ কেবল সালাতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে আমি সেই ভাইকে যিনি গাড়িতে ক্যাসেট চালু করেছেন একটি পরামর্শ দেব: এমন অবস্থায় ক্যাসেট চালাবেন না, যখন চারপাশের লোকজন গাফেল, অর্থাৎ কুরআন শুনতে আগ্রহী নয়। কারণ, অন্তত আমরা এটুকু বলব এটি এমন এক ধরনের কাজ হয়ে যেতে পারে, যা সেই লোকদের অনুরূপ, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন: “আর কাফিররা বলে, তোমরা এ কুরআনের নির্দেশ শোন না এবং তা (আবৃত্তি) তেলাওয়াতের সময় শোরগোল সৃষ্টি কর, যাতে তোমরা জয়ী হতে পার।”(সূরা ফুসসিলাত: ৪০/২৬) সুতরাং যদি আপনি দেখেন আপনার সঙ্গীরা কুরআন শুনতে আগ্রহী নয়, বরং আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত, তাহলে ক্যাসেট চালাবেন না। যদি আপনি একা শুনতে চান, তাহলে এমন একটি ছোট হেডফোন ব্যবহার করুন, যা আপনি কানে লাগাতে পারেন এবং শুধু আপনি শুনতে পারেন।”(ইবনু উসাইমীন; লিকাউল বাবিল মাফতূহ, পর্ব: ১৯৭; পৃষ্ঠা: ২৬) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি.)।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।
No comments:
Post a Comment