Wednesday, September 3, 2025

আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করা জায়েজ কী

 প্রশ্ন: মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা বলতে কি বুঝায়? আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম (মসজিদের মাইকে, ফেইসবুকে, ইউটিউবে, ফোন মেসেজে) মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করা জায়েজ কী?

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর প্রথমত: আরবি (النعي) নাঈ শব্দের অর্থ হলো মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর সংবাদ প্রদান ও তা প্রচার করা। এ সংবাদ প্রকাশের পদ্ধতি হতে পারে মৌখিকভাবে প্রচার করা, সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে জানানো। আবার এ শব্দ দ্বারা মৃত ব্যক্তির গুণাবলি ও মর্যাদা বর্ণনাকেও বোঝানো হয়।
.
ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর জামে গ্রন্থে বলেছেন: والنعي عندهم أن ينادى في الناس أن فلاناً مات ليشهدو جنازته”তাদের নিকট নাঈ হলো মানুষের মাঝে ঘোষণা করা যে অমুক মারা গেছে, যাতে তারা তার জানাজায় অংশগ্রহণ করে।”(তিরমিযী তাঁর জামে পৃষ্ঠা: ২৩৯)
.
ইবনুল আসীর (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর আন নিহায়াহ-এ বলেছেন: نعى الميت إذا أذاع موته ، وأخبر به ، وإذا ندبه” .
“নাঈ করা মানে হলো মৃত ব্যক্তির মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে দেওয়া, তা জানানো এবং তার জন্য শোক প্রকাশ করা।”(ইবনুল আসীর আন নিহায়াহ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৮৫)। ক্বলিউবী তাঁর হাশিয়াহ গ্রন্থে বলেছেন:
وهو النداء بموت الشخص ، وذكر مآثره ومفاخره ” .
এটি হলো কারও মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করা এবং তার গুণাবলি ও কৃতিত্বসমূহ উল্লেখ করা।” (হাশিয়াহ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৪৫)-
.
দ্বিতীয়ত: মৃত্যু ঘোষণার প্রকারভেদ:
.
শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তাভাবনা করলে ইসলামে শোক সংবাদ তিন প্রকার। যথা: (ক).হারাম, (খ).মাকরুহ ও (গ).মুবাহ। এবং এ তিন ধরনের প্রতিটিরই আলাদা হুকুম রয়েছে। ইবনুল আরাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন: يُؤْخَذُ مِنْ مَجْمُوعِ الأَحَادِيثِ ثَلاثُ حَالاتٍ : الأُولَى إِعْلامُ الأَهْلِ وَالأَصْحَابِ وَأَهْلِ الصَّلاحِ فَهَذَا سُنَّةٌ , الثَّانِيَةُ : دَعْوَةُ الْحَفْلِ لِلْمُفَاخَرَةِ فَهَذِهِ تُكْرَهُ , الثَّالِثَةُ : الإِعْلامُ بِنَوْعٍ آخَرَ كَالنِّيَاحَةِ وَنَحْوِ ذَلِكَ فَهَذَا يُحَرَّمُ “”হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, মৃত্যুর সংবাদ জানানোর ক্ষেত্রে তিন ধরনের কার্যপদ্ধতি রয়েছে: (১).পরিবার, বন্ধু ও ধার্মিক ব্যক্তিদের মৃত্যুর সংবাদ জানানো: এটি সুন্নাত এবং প্রয়োজনীয়। (২).মৃত ব্যক্তির মর্যাদা বা গৌরব প্রদর্শনের জন্য জনসমক্ষে বা সমাবেশে আহ্বান দিয়ে মৃত্যু ঘোষণা করা: এটি মাকরূহ। (৩).অন্যান্য অযথা বা অশ্লীল উপায়ে মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করা, যেমন অতিরিক্ত বিলাপ, চিৎকার বা অপ্রয়োজনীয় কান্না: এটি হারাম।”(ফাতহুল বারী; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১১৭) আমরা তিনটি প্রকার সম্পর্কেই আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
(১).হারাম শোক সংবাদ:
.
এটি সেই প্রচারণা যা জাহেলি যুগের রীতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন সাধারণ সমাবেশস্থলে ঘোষণা করে মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়া, সঙ্গে মৃত ব্যক্তির বংশমর্যাদা ও কৃতিত্ব প্রচার করা, কিংবা ঘোষণার সাথে বিলাপ, হাহাকার, আর্তনাদ ও হাহুতাশ প্রকাশ করা।”(হাশিয়াতুল জামাল ‘আলা শারহিল মানহাজ, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৬৮৭)
.
দলিল হচ্ছে হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন আমার মৃত্যু হলে এই বিষয়ে তোমরা কোন ঘোষণা দিবে না। আমার ভয় হয় যে, এটা মৃত্যুর সংবাদ প্রচার বলে ধরা হবে। আমি মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিষেধ করতে শুনেছি।”(তিরমিজি হা/৮৯৬; ইবনু মাজাহ হা/১৪৭৬; ইমাম তিরমিজি, হাফিয ইবনু হাজার আল-আসকালানি,ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদিসটি হাসান বলেছেন; (দেখুন ইবনে হাজার; ফাতহুল বারী; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১১৭; ইমাম আলবানী; আহকামুল জানায়িজ; পৃষ্ঠা: ৩০-৩১)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] মৃতের আত্মীয়দের উপর যা হারাম তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন:
الإعلان عن موته على رؤوس المنائر ونحوها ؛ لأنه من النعي ، وقد ثبت عن حذيفة بن اليمان أنه : كان إذا مات له الميت قال : لا تؤذنوا به أحداً ، إني أخاف أن يكون نعياً ، إني سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم ينهى عن النعي …والنعي لغة : هو الإخبار بموت الميت ، فهو على هذا يشمل كل إخبار ، ولكن قد جاءت أحاديث صحيحة تدل على جواز نوع من الإخبار ، وقيد العلماء بها مطلق النهي ، وقالوا : إن المراد بالنعي الإعلان الذي يشبه ما كان عليه أهل الجاهلية من الصياح على أبواب البيوت والأسواق … .وقال الحافظ : ” وفائدة هذه الترجمة الإشارة إلى أن النعي ليس ممنوعاً كله ، وإنما نهى عما كان أهل الجاهلية يصنعونه ، فكانوا يرسلون من يعلن بخبر موت الميت على أبواب الدور والأسواق ” .قلت (الألباني) : وإذا كان هذا مسلَّما : فالصياح بذلك على رؤوس المنائر يكون نعياً من باب أولى ، ولذلك جزمنا به ، وقد يقترن به أمور أخرى هي في ذاتها محرمات أخر ، مثل أخذ الأجرة على هذا الصياح ! ومدح الميت بما يعلم أنه ليس كذلك ، كقولهم : ” الصلاة على فخر الأماجد المكرمين ، وبقية السلف الكرام الصالحين ! ” .
“তার মৃত্যুর ঘোষণা মিনারের মাথায় বা অনুরূপ জায়গায় দেওয়া; কেননা এটা নাঈর অন্তর্ভুক্ত। আর হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান থেকে প্রমাণিত যে, তার কোনো আত্মীয় মারা গেলে তিনি বলতেন: “এ বিষয়ে কাউকে সংবাদ দিও না, আমি আশঙ্কা করি এটা নাঈ হয়ে যাবে। আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নাঈ থেকে নিষেধ করতে শুনেছি আর নাঈ ভাষাগতভাবে মৃতের মৃত্যুসংবাদ দেওয়া। এই অর্থে এটি প্রতিটি সংবাদকেই অন্তর্ভুক্ত করে। তবে সহীহ হাদীস এসেছে যা মৃত্যুসংবাদ দেওয়ার একটি ধরনকে বৈধ বলে প্রমাণ করে, আর আলিমরা সেই হাদীস দিয়ে সাধারণ নিষেধকে সীমাবদ্ধ করেছেন। তারা বলেছেন: এখানে নাঈ বলতে উদ্দেশ্য হলো সে ঘোষণা যা জাহেলিয়াত যুগে প্রচলিত ছিল যেমন ঘরের দরজায় এবং বাজারে চিৎকার করে মৃতের মৃত্যুসংবাদ প্রচার করা। হাফিয (ইবনে হাজার) বলেছেন: এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য হলো ইঙ্গিত দেওয়া যে, নাঈ পুরোপুরি নিষিদ্ধ নয়; বরং যে নাঈ জাহেলিয়াত যুগে হতো কেবল সেটিই নিষিদ্ধ। তারা তখন লোক পাঠাতো মৃতের মৃত্যুসংবাদ চিৎকার করে ঘরের দরজায় এবং বাজারে জানাতে। আমি (আলবানী) বলি: যদি এটা স্বীকৃত হয়, তাহলে মিনারের মাথায় চিৎকার করে মৃত্যুসংবাদ দেওয়া তো অবশ্যই নাঈর অন্তর্ভুক্ত হবে। এজন্যই আমরা একে নিষিদ্ধ বলেছি। বরং এর সাথে এমন কিছু বিষয় যুক্ত হতে পারে, যা নিজেই আলাদাভাবে হারাম যেমন এই চিৎকারের জন্য মজুরি গ্রহণ করা! কিংবা মৃতকে এমনভাবে প্রশংসা করা যা তার মধ্যে নেই, যেমন তারা বলে: মর্যাদাবান মহৎ ব্যক্তিদের গৌরব, নেককার পূর্বসূরিদের অবশিষ্ট অংশের জানাজায় নামাজ পড়তে আসুন!”(আহকামুল জানায়িজ; পৃষ্ঠা: ৪৪–৪৬)।
.
এমনকি মৃত ব্যক্তির জন্য যদি উচ্চস্বরে কান্নার সাথে গালে চপোটাঘাত করা, জামাকাপড় ছেড়া ও আল্লাহ্‌র তাকদীরের প্রতি অসন্তুষ্টি যুক্ত হয়; তাহলে সেটিও নাজায়েয। যেহেতু আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:( لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَطَمَ الْخُدُودَ وَشَقَّ الْجُيُوبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ )“যে ব্যক্তি গালে চপোটাঘাত করে, জামাকাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যামানার আর্তনাদ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”(সহিহ বুখারী হা/১২৯৪) তিনি আরও বলেন: “(বিপদের সময়) ডাক চিৎকার করে ক্রন্দনকারী, মাথা মুণ্ডনকারী ও পোশাক আশাক ছিন্নভিন্নকারীর সাথে আমার সম্পর্ক নেই”। তিনি আরও বলেন: “যদি বিলাপকারিনী মৃত্যুর আগে তওবা না করে তাহলে কেয়ামতের দিন তাকে এমন অবস্থায় উঠানো হবে তার গায়ে থাকবে আলকাতরার পোশাক, শরীরের চামড়া যেন গুটি বসন্তের বর্ম।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,” أما الندب والنياحة ولطم الخد وشق الجيب وخمش الوجه ونشر الشعر والدعاء بالويل والثبور , فكلها محرمة باتفاق الأصحاب , وصرح الجمهور بالتحريم…, وقد نقل جماعة الإجماع في ذلك“মর্সিয়া-ক্রন্দন, বিলাপ করা, গালে চড় মারা, জামাকাপড় ছিড়ে ফেলা, চেহারাতে খামচি মারা, চুল ছেড়া ও হায়হুতাশ করে আর্তনাদ করা; এই সবকিছু মাযহাবের আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। জমহুর আলেম স্পষ্টভাবে হারাম বলেছেন…। একদল আলেম হারাম হওয়ার মর্মে ইজমা উদ্ধৃত করেছেন।”(নববী; শারহুল মুহায্‌যাব; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৮১)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:
الواجب على المسلمين في هذه الأمور الصبر والاحتساب , وعدم النياحة , وعدم شق الثوب , ولطم الخد , ونحو ذلك لقول الرسول صلى الله عليه وسلم: ( ليس منا من لطم الخدود وشق الجيوب ودعا بدعوى الجاهلية )، ولقوله عليه الصلاة والسلام في الحديث الصحيح: ( أربع في أمتي من أمر الجاهلية لا يتركونهن : الفخر بالأحساب ، والطعن في الأنساب ، والاستسقاء بالنجوم ، والنياحة ) وقال : ( النائحة إذا لم تتب قبل موتها تقام يوم القيامة وعليها سربال من قطران ودرع من جرب ) رواه مسلم في الصحيح. والنياحة هي رفع الصوت بالبكاء على الميت. وقال صلى الله عليه وسلم: ( أنا بريء من الصالقة والحالقة والشاقة ) والحالقة: هي التي تحلق شعرها عند المصيبة, أو تنتفه. والشاقة: هي التي تشق ثوبها عند المصيبة. والصالقة: هي التي ترفع صوتها عند المصيبة. وكل هذا من الجزع ، فلا يجوز للمرأة ولا للرجل فعل شيء من ذلك…
“মুসলমানদের উপর আবশ্যকীয় এসব ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা ও সওয়াব প্রাপ্তির নিয়ত করা; বিলাপ না করা, জামাকাপড় না ছেড়া, গালে চপোটাঘাত না করা ইত্যাদি। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি গালে চপোটাঘাত করে, জামাকাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যামানার আর্তনাদ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” যেহেতু তিনি সহিহ হাদিসে আরও বলেছেন: “আমার উম্মতের মধ্যে জাহেলী যামানার চারটি বিষয় রয়েছে; যেগুলো তারা ত্যাগ করবে না: আত্মগুণ নিয়ে অহংকার করা, বংশের উপর কালিমালেপন করা, নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা এবং মৃতের জন্য বিলাপ করা।যেহেতু তিনি আরও বলেছেন: “যদি বিলাপকারিনী নারী মৃত্যুর পূর্বে তাওবা না করে তাহলে তাকে এমন অবস্থায় তোলা হবে যে, তার গায়ে থাকবে আলকাতরার জামা এবং অভ্যন্তরীণ জামা হবে (তথা চামড়া হবে) খোসপাঁচড়ার।”[সহিহ মুসলিম] নিয়াহা (বিলাপ) দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে: উচ্চস্বরে মৃতের জন্য ক্রন্দন করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন: “আমি প্রত্যেক উচ্চস্বরে ক্রন্দনকারিনী, মাথা-মুণ্ডণকারিনী ও জামা-ছিন্নকারিনী থেকে মুক্ত”। “মাথা-মুণ্ডণকারিনী” দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- যে নারী মুসিবতের সময় মাথার চুল ফেলে দেয় কিংবা টেনে তুলে ফেলে। “জামা-ছিন্নকারিনী” দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- যে নারী বিপদের সময় গায়ের জামা ছিড়ে ফেলে। আর “উচ্চস্বরে ক্রন্দনকারিনী” দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- যে নারী মুসিবতের সময় কণ্ঠস্বরকে উঁচু করে। এর প্রত্যেকটি অধৈর্যের বহিঃপ্রকাশ। তাই কোন নারী বা পুরুষের জন্য এর কোনটি করা জায়েয নয়…”।(বিন বায; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ,খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৪১৪)
.
(২).মাকরূহ শোক সংবাদ:
.
মৃত্যুসংবাদ প্রদানের ক্ষেত্রে উচ্চস্বরে ঘোষণা করা বা জনসমুক্ষে প্রচার করা যদিও তাতে মৃত ব্যক্তির বংশীয় মর্যাদা বা কৃতিত্বের বর্ণনা না থাকে এই ব্যাপারে চার মাযহাবের অধিকাংশ আলেম (হানাফী, মালিকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী) একমত হয়েছেন যে, এ ধরনের ঘোষণা করা মাকরূহ। এই মতের পক্ষে প্রমাণও হুযাইফা (রাঃ)-এর হাদীস। কারণ উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে মৃত্যুসংবাদ প্রচার করা জাহিলিয়াত যুগের প্রথার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। তারা মৃতের খবর জানানোর জন্য লোক পাঠাতো, যারা বাজারে ও মানুষের দরজায় গিয়ে এ ঘোষণা দিতো।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; আল ইনায়াহ শারহুল হিদায়াহ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৬৭; আল খারশী আলা মুখতাসার খালীল; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৩৯; আল মুহাযযাব; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা:  ১৩২; আশ-শারহুল কাবীর; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ২৮৭; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব; ফাতওয়া নং-২৩১০২৯)।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,
ويكره النعي , وهو أن يبعث مناديا ينادي في الناس : إن فلانا قد مات . ليشهدوا جنازته . . . وقال كثير من أهل العلم : لا بأس أن يعلم بالرجل إخوانه ومعارفه وذوو الفضل , من غير نداء . قال إبراهيم النخعي : لا بأس إذا مات الرجل أن يؤذن صديقه وأصحابه , وإنما كانوا يكرهون أن يطاف في المجالس : أنعي فلانا . كفعل الجاهلية “
“মৃত্যুসংবাদ (নাঈ) মাকরূহ। আর তা হলো কোনো ঘোষণা দাতা পাঠানো, যে মানুষদের মাঝে বলে বেড়াবে অমুক ব্যক্তি মারা গেছে, তার জানাজায় উপস্থিত হও। তবে অনেক আলেম বলেছেন: কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার ভাই-বোন, পরিচিতজন এবং সৎগুণাবলির অধিকারীদের জানানোতে কোনো সমস্যা নেই, যদি ডাক না দেওয়া হয়। ইবরাহীম নাখাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন: কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার বন্ধুকে ও সঙ্গীদের জানানোতে কোনো অসুবিধা নেই। তাঁরা কেবল অপছন্দ করতেন যে মজলিসে ঘুরে ঘুরে বলা হতো: ‘অমুক মারা গেছে’, যেমনটা জাহিলিয়াতের কাজ ছিল।”(ইবনু কুদামাহ আল মুগনী; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪০৬)।
.
(৩).মুবাহ বা বৈধ মৃত্যুসংবাদ:
.
কেবল মানুষকে মৃত্যুর সংবাদ জানানো যাতে মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে বাড়াবাড়ি, কোনো অতিরিক্ত প্রশংসা, বিলাপ বা বাড়তি মন্তব্য না থাকে; বরং শুধুমাত্র মৃত্যুর সংবাদ দেওয়াই উদ্দেশ্য থাকে তাহলে কোনো সমস্যা নেই। কেননা সুন্নাহ্‌র প্রমাণসমূহ নির্দেশ করে যে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কেবলমাত্র মৃত্যুর সংবাদ দেওয়া জায়েজ। অধিকাংশ আলেমগণ যেমন হানাফী, মালিকী, শাফেয়ী, হানাবিলা এবং অন্যরা এ মত পোষণ করেছেন যে, ডাকাডাকি ছাড়া শুধুমাত্র মৃত্যুসংবাদ দেওয়া জায়েয, উদ্দেশ্য হলো মৃতের জানাযার নামাজ আদায় করা। এমনকি আলেমদের একদল এ কাজকে মুস্তাহাব (পসন্দনীয়) বলেছেন। (বিস্তারিত জানতে দেখা যেতে পারে; ফাতহুল কাদীর; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১২৭, হাসিয়াতুদ দাসূকী; খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৪, নিহায়াতুল মুহতাজ; খন্ড; ৩; পৃষ্ঠা: ২০, আল ইকনাআ; খণ্ড: ১; পৃষ্টা: ৩৩১, তুহফাতুল আহওয়াযী; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৬১, আস সাইয়লুল জারার; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৩৯, আল বিনায়াহ শারহুল হিদায়াহ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৬৭, আল খারশী আলা মুখতাসার; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৩৯, ইমাম নববী আল আযকার; পৃষ্ঠা: ২২৬)।
.
এরূপ উদাহরণ পাওয়া যায় বাদশা নাজাশির সময়, মুতা যুদ্ধের শহীদদের বিষয়ে, এবং অন্যান্য ঘটনায়, যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শোকবার্তা প্রদান করেছেন।যেমন;আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, “বাদশা নাজাশী যেদিন ইন্তিকাল করেন সেদিন নবী (ﷺ) তাঁর মৃত্যু-সংবাদ সকলকে জানান এবং মুসাল্লায় বের হয়ে গিয়ে কাতার বানিয়ে চার তকবীর দিয়ে (গায়েবানা) জানাযার নামায পড়েন।”(সহীহ বুখারী হা/১১৬৮, সহীহ মুসলিম হা/১৫৮০)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,فِيهِ : اِسْتِحْبَاب الإِعْلام بِالْمَيِّتِ لا عَلَى صُورَة نَعْي الْجَاهِلِيَّة , بَلْ مُجَرَّد إِعْلَام للصَّلَاة عَلَيْهِ وَتَشْيِيعه وَقَضَاء حَقّه فِي ذَلِكَ , وَاَلَّذِي جَاءَ مِنْ النَّهْي عَنْ النَّعْي لَيْسَ الْمُرَاد بِهِ هَذَا , وَإِنَّمَا الْمُرَاد نَعْي الْجَاهِلِيَّة الْمُشْتَمِل عَلَى ذِكْر الْمَفَاخِر وَغَيْرهَا “এতে প্রমাণ রয়েছে যে, মৃত ব্যক্তির খবর জানানো মুস্তাহাব; তবে তা যেন জাহেলিয়াতের যুগের ন্যায় ‘নাঈ (মৃত ঘোষণার ধুমধামপূর্ণ প্রচার) আকারে না হয়; বরং এটি কেবল মানুষকে খবর দেওয়া তার জানাজায় অংশগ্রহণ, তাকে বহন করা এবং তার হক আদায় করার উদ্দেশ্যে। আর যে ‘নাঈ সম্পর্কে নিষেধ এসেছে, এর দ্বারা এই ধরনের সরল তথ্য প্রদান বোঝানো হয়নি; বরং উদ্দেশ্য হলো জাহেলিয়াতের নাঈ যা গর্ব-অহংকারের বর্ণনা ও সেরকম বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত।” (ইমাম নববী শারহু সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৪৩ এর ব্যাখ্যা অংশ)
.
অপর বর্ননায় এসেছে,একজন কালো বর্ণের পুরুষ অথবা বলেছেন কালো বর্ণের মহিলা মসজিদ ঝাড়ু দিত।সে মারা গেল।নবী (ﷺ) তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সাহাবীগণ বললেন,সে মারা গেছে।তিনি বললেনঃতোমরা আমাকে খবর দিলে না কেন? আমাকে তার কবরটা দেখিয়ে দাও।অতঃপর তিনি তার কবরের নিকট গেলেন এবং তার জানাযার সালাত আদায় করলেন।”(সহিহ বুখারী, হা/৪৫৮) “এই দুটি হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মৃত ব্যক্তির মৃত্যুসংবাদ জানানো বৈধ; বরং তা জানানো উত্তম (মুস্তাহাব), যদি উদ্দেশ্য হয় তার জানাজায় অংশগ্রহণ করা এবং তার জন্য দো‘আ করা। কেননা, এটি আসলে মৃতের প্রতি একটি হক আদায়ের মাধ্যম, যেমন তার জানাজায় শরিক হওয়া এবং দাফন কার্যক্রমে অংশ নেওয়া।”
.
জানাযার নামাজ ব্যতীত অন্য কারণে মৃত্যুর সংবাদ ঘোষণা করা জায়েয হওয়ার প্রমাণ সহীহ বুখারীতে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত,যেখানে তিনি বলেন; মুসলিমদের নিকট খবর এসে পৌঁছার পূর্বেই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে যায়দ, জা‘ফার ও ইবনু রাওয়াহা (রাঃ)-এর (শাহাদাতের) কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, যায়দ (রাঃ) পতাকা হাতে এগিয়ে গেলে তাঁকে শহীদ করা হয়। অতঃপর জা‘ফার (রাঃ) পতাকা হতে এগিয়ে গেলে তাকেও শহীদ করা হয়। অতঃপর ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) পতাকা হাতে নিলে তাকেও শহীদ করা হল। এ সময়ে তাঁর দু’চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল। (তিনি বললেন) শেষে আল্লাহর তলোয়ারদের মধ্য হতে আল্লাহর এক তলোয়ার (খালিদ বিন ওয়ালীদ) পতাকা ধারণ করল। ফলে আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করলেন।”(সহীহ বুখারী হা/৪২৬২) এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ তিনজন সাহাবীর মৃত্যুর সংবাদ দিয়েছেন। অথচ সেই নাঈ জানাজার উদ্দেশ্যে ছিল না; বরং মুসলমানদের তাদের ভাইদের খবর পৌঁছে দেওয়া এবং ঐ যুদ্ধে তাদের সাথে যা ঘটেছিল তা জানানোই এর উদ্দেশ্য ছিল।অতএব, মৃতের সংবাদ জানানো বৈধ যতক্ষণ তা কল্যাণকর উদ্দেশ্যে হয়, যেমন তার জন্য দোয়া করা, তার ব্যাপারে ইসতিগফার করা এবং এর অনুরূপ বিষয়।(আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন: নিহায়াতুল মুহতাজ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২০)।
.
ইবনু আব্দুল বার তাঁর আল-ইস্তিজকার এ বলেছেন: وكان أبو هريرة رضي الله عنه يمر بالمجالس ، فيقول : إن أخاكم قد مات فاشهدوا جنازته
“আবু হুরায়রা (রাঃ) যখন মজলিসগুলোর পাশ দিয়ে যেতেন, তিনি বলতেন: ‘তোমাদের ভাই ইন্তিকাল করেছে, সুতরাং তোমরা তার জানাজায় উপস্থিত হও।”(আল-ইস্তিজকার; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৬)
.
হানাফি মাযহাবের কিতাব ‘বাদায়েউস সানায়ি’ গ্রন্থে গ্রন্থকার ‘কাসানি’ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
” وَلَا بَأْسَ بِإِعْلَامِ النَّاسِ بِمَوْتِهِ مِنْ أَقْرِبَائِهِ وَأَصْدِقَائِهِ وَجِيرَانِهِ لِيُؤَدُّوا حَقَّهُ بِالصَّلَاةِ عَلَيْهِ ، وَالدُّعَاءِ وَالتَّشْيِيعِ ، .. وَلِأَنَّ فِي الْإِعْلَامِ تَحْرِيضًا عَلَى الطَّاعَةِ ، وَحَثًّا عَلَى الِاسْتِعْدَادِ لَهَا ، فَيَكُونُ مِنْ بَابِ الْإِعَانَةِ عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى ، وَالتَّسَبُّبِ إلَى الْخَيْرِ ، وَالدَّلَالَةِ عَلَيْهِ”.
“মৃতব্যক্তির মৃত্যু সংবাদ তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদেরকে জ্ঞাপন করতে কোন আপত্তি নেই; যাতে করে তারা জানাযার নামায পড়া, দোয়া করা ও দাফনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে মৃতব্যক্তির হক আদায় করতে পারে। আর যেহেতু সংবাদ দেয়ার মধ্যে নেক কাজের প্রতি উদ্ভুদ্ধকরণ ও প্রস্তুতি নেয়ার প্রতি উৎসাহিত করণ রয়েছে। তাই এটি নেকী ও তাকওয়ার কাজে সহযোগিতা করার মধ্যে পড়বে এবং ভাল কাজের মাধ্যম হওয়া ও সন্ধান দেয়ার পর্যায়ভুক্ত হবে।”(বাদায়িউস সানায়ি; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২০৭)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,
يجوز دعاء أقارب الميت وأصحابه وجيرانه إذا توفي من أجل أن يصلوا عليه ، ويدعوا له ، ويتبعوا جنازته ، ويساعدوا على دفنه ؛ لأن النبي صلى الله عليه وسلم أخبر أصحابه لما توفي النجاشي رحمه الله بموته ليصلوا عليه “
“কেউ মারা গেলে তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদেরকে আহ্বান করা জায়েয; যাতে করে তারা জানাযার নামায পড়তে পারে, তার জন্য দোয়া করতে পারে, তার লাশের সাথে যেতে পারে এবং দাফনকর্মে সহযোগিতা করতে পারে। কেননা নাজাশি যখন মারা গিয়েছিল তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাথীবর্গকে তার মৃত্যুর সংবাদ জানিয়েছেন যাতে করে তারা তার জানাযার নামায পড়তে পারে।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৪০২)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, আবুল ফাদল আহমাদ বিন আলি ইবনু হাজার আল-আসকালানি,(রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম:৭৭৩ হি: মৃত:৮৫২ হি:] তাঁর ফাতহুল বারী-তে বলেছেন:
” النَّعْي لَيْسَ مَمْنُوعًا كُلّه , وَإِنَّمَا نُهِيَ عَمَّا كَانَ أَهْل الْجَاهِلِيَّة يَصْنَعُونَهُ فَكَانُوا يُرْسِلُونَ مَنْ يُعْلِن بِخَبَرِ مَوْت الْمَيِّت عَلَى أَبْوَاب الدُّور وَالأَسْوَاق .قَالَ سَعِيد بْن مَنْصُور : أَخْبَرَنَا اِبْن عُلَيَّة عَنْ اِبْن عَوْن قَالَ قُلْت لإِبْرَاهِيم : أَكَانُوا يَكْرَهُونَ النَّعْي ؟ قَالَ : نَعَمْ . قَالَ اِبْن عَوْن : كَانُوا إِذَا تُوُفِّيَ الرَّجُل رَكِبَ رَجُل دَابَّة ثُمَّ صَاحَ فِي النَّاس : أَنْعِي فُلانًا . وقَالَ اِبْن سِيرِينَ : لا أَعْلَم بَأْسًا أَنْ يُؤْذِن الرَّجُل صَدِيقه وَحَمِيمه .وَحَاصِله أَنَّ مَحْض الإِعْلام بِذَلِكَ لا يُكْرَه , فَإِنْ زَادَ عَلَى ذَلِكَ فَلا “
“না‘ঈ (মৃত্যুসংবাদ প্রচার) সবদিক থেকে নিষিদ্ধ নয়। বরং যে রূপে জাহেলিয়াতের লোকেরা করত সেটিই নিষিদ্ধ হয়েছে। তারা লোক পাঠাত মৃতের সংবাদ ঘোষণা করার জন্য, বাড়ি-বাড়ি ও বাজারে।সাঈদ ইবন মানসুর বলেছেনঃ আমাদেরকে ইবন উলাইয়া ইবন আউনের সূত্রে জানিয়েছেন, তিনি বলেনঃ আমি ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করলামঃ তারা কি না‘ই (মৃত্যুসংবাদ প্রচার) অপছন্দ করত? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। ইবন আউন বলেনঃ যখন কেউ মারা যেত, তখন একজন লোক পশুর পিঠে চড়ে লোকদের মাঝে উচ্চস্বরে ঘোষণা দিতঃ “অমুকের মৃত্যু সংবাদ জানাচ্ছি।ইবনে সীরীন বলেছেনঃ আমি কোনো অসুবিধা দেখি না যে একজন ব্যক্তি তার বন্ধু বা আত্মীয়কে মৃত্যুসংবাদ জানাবে। সারমর্ম এই যে শুধু মৃত্যুসংবাদ দেওয়া অপছন্দনীয় নয়, তবে যদি এর সাথে বাড়তি কিছু যোগ হয় তবে তা অপছন্দনীয়।”(ফাতহুল বারী ফি শরহে সহীহুল বুখারী খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১১৬)
.
দ্বিতীয়ত: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যেমন ফেইসবুক, টুইটার ও ওয়াটসআপ  ইত্যাদিতে কিংবা ইমেইলে ও মোবাইল মেসেজে কারো মৃত্যু সংবাদ প্রচার করতে কোন আপত্তি নেই; যদি এর উদ্দেশ্য হয় যাতে করে মানুষ জানাযার নামাযে উপস্থিত হতে পারে, মৃতব্যক্তির জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) করতে পারে কিংবা মৃতের পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা জানাতে পারে। কেননা এ অবহিতকরণ এ সমস্ত নেক কাজের মাধ্যম।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:
والصحيح الذي تقتضيه الأحاديث التي ذكرناها وغيرها أن الإعلام بموته لمن لم يعلم ليس بمكروه , بل إن قصد به الإخبار لكثرة المصلين فهو مستحب وإنما يكره ذكر المآثر والمفاخر والتطواف بين الناس بذكره بهذه الأشياء , وهذا نعي الجاهلية المنهي عنه , فقد صحت الأحاديث بالإعلام فلا يجوز إلغاؤها وبهذا الجواب أجاب بعض أئمة الفقه والحديث المحققين “
“আমাদের উদ্ধৃত হাদীসসমূহ এবং অন্যান্য হাদীসের আলোকে সঠিক মত হলো যে ব্যক্তি এখনো কারো মৃত্যুর খবর জানে না, তাকে তা জানানো মোটেও মাকরুহ নয়। বরং যদি উদ্দেশ্য হয় অধিক সংখ্যক মানুষকে জানাজায় অংশগ্রহণে অবগত করা, তাহলে তা মুস্তাহাব। মাকরুহ হলো মৃত ব্যক্তির গুণাবলী ও কৃতিত্ব প্রচার করা, মানুষের মাঝে ঘুরে বেড়িয়ে সেগুলো বর্ণনা করা। এটাই হলো জাহেলিয়াত আমলের নিষিদ্ধ ‘নাঈ’ (মৃত্যু-ঘোষণা)। অথচ সহীহ হাদীসে মৃত্যুসংবাদ প্রদানের কথা প্রমাণিত হয়েছে; সুতরাং এগুলো উপেক্ষা করা জায়েয নয়। এ বিষয়ে ফিকহ ও হাদীসের প্রাজ্ঞ ইমামগণের পক্ষ থেকেও একই উত্তর দেওয়া হয়েছে।”(নববী আল মাজমূ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১৭৪)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে পত্র-পত্রিকায় মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন:لا نعلم فيه شيئًا، من باب الخبر”খবর হিসেবে জানানোর ক্ষেত্রে আমরা কোন আপত্তিকর কিছু জানি না।”(মাসায়িলুল ইমাম ইবনু বায; পৃষ্ঠা: ১০৮)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
” وأما الإعلان عن موت الميت : فإن كان لمصلحة مثل أن يكون الميت واسع المعاملة مع الناس بين أخذ وإعطاء ، وأعلن موته لعل أحداً يكون له حق عليه فيقضى أو نحو ذلك : فلا بأس”
“পক্ষান্তরে, মৃতব্যক্তির মৃত্যুর সংবাদ জ্ঞাপন করা: যদি কোন কল্যাণের কারণে হয়; যেমন মৃতব্যক্তির সাথে মানুষের আদান-প্রদানের ব্যাপক লেনদেন থাকে এবং তার মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা হলে তার কাছে কারো পাওনা থাকলে তার পাওনা তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে কিংবা এ ধরণের কিছু: তাহলে তাতে কোন আপত্তি নেই।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৭; পৃষ্ঠা: ৪৬১)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ) এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে জিবরীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪৩০ হি./২০০৯ খ্রি.] বলেন:
لا بأس بنشر الخبر عن وفاة بعض الأشخاص المشهورين بالخير والصلاح ، ليحصل الترحم عليهم والدعاء لهم من المسلمين ، ولكن لا يجوز مدحهم بما ليس فيهم ، فإنَّ ذلك كذب صريح “
“নেককাজ ও ভালকাজের মাধ্যমে মশহুর হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের মৃত্যু সংবাদ প্রচার করতে কোন আপত্তি নেই; যাতে করে তাদের জন্য রহমত প্রার্থনা করা হয় এবং মুসলমানদের পক্ষ থেকে দোয়া করা হয়। তবে এমন প্রশংসা করা জায়েয নয় যা তাদের মধ্যে নেই। কেননা সেটা হবে স্পষ্ট মিথ্যা।”(ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১০৬)
.
তৃতীয়ত: মসজিদে মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করা:
.
মসজিদ থেকে মৃত্যুর সংবাদ প্রচারের অর্থ যদি হয় মসজিদের মিনার বা লাউড স্পিকারের মাধ্যমে সবাইকে জানানো, তবে এটি নিষিদ্ধ এবং মসজিদের মর্যাদার পরিপন্থী। কারন রাসূল (ﷺ) বলেছেন: مَنْ سَمِعَ رَجُلاً يَنْشُدُ ضَالَّةً فِى الْمَسْجِدِ فَلْيَقُلْ لاَ رَدَّهَا اللهُ عَلَيْكَ فَإِنَّ الْمَسَاجِدَ لَمْ تُبْنَ لِهَذَا.”যে ব্যক্তি অন্য কাউকে মসজিদে হারানো জিনিষ খোঁজ করতে শুনবে, সে যেন বলে, আল্লাহ যেন তোমাকে ফেরত না দেন। কারণ মসজিদ সমূহ এ জন্য তৈরি করা হয়নি।”(সহীহ মুসলিম হা/১২৮৮; মিশকাত হা/৭০৬) কিন্তু যদি কেবল নামাজরত মুসল্লিদের স্বাভাবিকভাবে, উচ্চস্বরে না করে মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়, যাতে সবাই জানাজায় উপস্থিত হতে পারে এবং মৃতের জন্য দু’আ করতে পারে।তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের নাজ্জাশীর মৃত্যুর খবর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যেখানে তিনি সাহাবীদেরকে জানিয়ে দিয়ে তাদের জন্য জানাজার নামাজ আদায়ের সুযোগ নিশ্চিত করেছিলেন। যেমন আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত: (মুতার যুদ্ধের সময়) মুসলিমদের নিকট খবর এসে পৌঁছার পূর্বেই নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে যায়দ, জা’ফার ও ইবনু রাওয়াহা (রাঃ)-এর (শাহাদাতের) কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, যায়দ (রাঃ) পতাকা হাতে এগিয়ে গেলে তাঁকে শহীদ করা হয়। অতঃপর জা’ফার (রাঃ) পতাকা হাতে এগিয়ে গেলে তাকেও শহীদ করা হয়। অতঃপর ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) পতাকা হাতে নিলে তাকেও শহীদ করা হল। এ সময় তাঁর দু’চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল। (তিনি বললেন) শেষে আল্লাহ্‌র তলোয়ারদের মধ্য হতে আল্লাহ্‌র এক তলোয়ার (খালিদ বিন ওয়ালীদ) পতাকা ধারণ করল। ফলে আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করলেন।”(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪২৬২; আ. প্র: ৩৯২৯; ই.ফা: ৩৯৩৩) তাবরানীর শব্দ অনুযায়ী: نعى رسول الله صلى الله عليه وسلم أصحاب مؤتة على المنبر “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুতা যুদ্ধে শহীদ হওয়া সাহাবাদের শোকবার্তা (মসজিদের) মিম্বর থেকে ঘোষণা করেছিলেন।”(আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪১৯৫৯; ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-৩২২৪৯৫)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate