Sunday, December 12, 2021

অন্তর-বিধ্বংসী বিষয়সমূহ : ঝগড়া-বিবাদ

 ভূমিকা

 
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على أشرف المرسلين، نبينا محمد، وعلى آله وأصحابه أجمعين.
ঝগড়া-বিবাদ এমন একটি কঠিন ব্যাধি ও মহা মুসিবত, যা মানুষের অন্তরকে করে কঠিন আর জীবনকে করে ক্ষতি ও হুমকির সম্মুখীন।
ওলামায়ে কেরামগণ এর ক্ষতির দিক বিবেচনার বিষয়টি সম্পর্কে উম্মতদের খুব সতর্ক করেন এবং এ নিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি করেন। এটি এমন একটি দুশ্চরিত্র যাকে সলফে সালেহীনরা খুব ঘৃণা করত এবং এ থেকে অনেক দূরে থাকত। আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. বলেন, একজন কুরআন ওয়ালা বা জ্ঞানীর জন্য যে ঝগড়া করে তার সাথে ঝগড়া করা অনুরূপভাবে কোন মূর্খের সাথে তর্ক করা কোন ক্রমেই উচিত নয়। তার জন্য উচিত হল, ঝগড়া- বিবাদ পরিহার করা। ইব্রাহিমে নখয়ী রহ. বলেন, সালফে সালেহীন ঝগড়া-বিবাদকে অধিক ঘৃণা করত।
তবে এ বিষয়ে প্রথমে আমাদের কয়েকটি বিষয় জানা অপরিহার্য।
এক. ঝগড়া-বিবাদ বলতে আমরা কি বুঝি?
দুই. আলেম ওলামারা কেন ঝগড়া-বিবাদকে অধিক ঘৃণা করেন?
তিন. প্রসংশনীয় বিবাদ আর নিন্দনীয় বিবাদ কোনটি? উভয়টির উদাহরণ কি?
চার. ঝগড়া বিবাদ করা কি মানুষের স্বভাবের সাথে জড়িত নাকি তা তার উপার্জন।
এছাড়াও বিষয়টির সাথে আরো বিভিন্ন প্রশ্ন জড়িত। আশা করি এ কিতাবের মাধ্যমে আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাব। আমরা চেষ্টা করব সম্মানিত পাঠকদের এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে।
আমরা আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তাওফিক কামনা করি তিনি যেন আমাদের ভালো ও কল্যাণকর কাজগুলো করার তাওফিক দেন আর আমাদের ভুলগুলো শুধরিয়ে সঠিক ও কামিয়াবির পথে পরিচালনা করেন। নিশ্চয় তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাশীল ও সক্ষম।
সালেহ আল মুনাজ্জেদ।
ঝগড়া বিবাদ বলতে আমরা কি বুঝি?
এ বিষয়ে আরবীতে দুটি শব্দ ব্যবহার হয়েছে। এক হল, জিদাল আর দ্বিতীয় হল, মিরা।
জিদাল: এর অর্থ হল, ঝগড়া করা ও কথা কাটাকাটি করা। অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করা নিজের কথা সত্য প্রমাণ করা জন্য। এটি হল, প্রতিপক্ষের সাথে ঝগড়া করা।
মুজাদালাহ: এর অর্থ হল, বিতর্ক করা তবে সত্য বা সঠিককে প্রকাশ করার জন্য নয়, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য।
আল্লামা যাজ্জাজ রহ. বলেন, জিদাল অর্থ, উচ্চ পর্যায়ের ঝগড়া ও বিতর্ক।
আল্লামা কুরতবী বলেন, কোন কথাকে শক্তিশালী দলীল দ্বারা প্রতিহত করা।
আর মিরা’ শব্দের অর্থ: কেউ কেউ বলেন, জিদাল। যেমন, আল্লামা তাবারী দুটির অর্থ এক বলেছেন। আবার কেউ কেউ বলেন, মিরা’ অর্থ হল, অপরের কথার মধ্যে অপব্যাখ্যা করা। প্রতিপক্ষকে হেয় করা ছাড়া কোন সৎ উদ্দেশ্য থাকে না।
কেউ কেউ বলেন, মিরা’ হল, বাতিলকে সাব্যস্ত করার জন্য আর জিদাল কখনো বাতিলকে সাব্যস্ত করা ও না করা উভয়ের জন্য হয়ে থাকেন।
জিদাল ও মিরা’ উভয়ের মধ্যে প্রার্থক্য:
অনেকে বলেন, উভয় শব্দের অর্থ এক। তবে মিরা’ হলো নিন্দনীয় বিতর্ক। কারণ, এটি হল, হক প্রকাশ পাওয়ার পরও তা নিয়ে অনর্থক বিতর্ক করা। তবে জিদাল এ রকম নয়।
কুরআন নিয়ে জিদাল করার অর্থ
عن أبي هريرة عن النبي قال «المِرَاءُ فِي القُرْآنِ كُفْرٌ»
অর্থ, আবু হুরাইরা রা, হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কুরআন নিয়ে ঝগড়া কুফরী।[1]
কুরআন নিয়ে বিবাদ করাকে কুফরী বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু কুরআন বিষয়ে বিবাদ করার অর্থ কি?
কুরআন বিষয়ে বিবাদের অর্থ: কুরআন বিষয়ে বিবাদের অর্থ হল, কুরআনের প্রতি সন্দেহ পোষণ করা। আর কুরআনের প্রতি সন্দেহ পোষণ করা নি:সন্দেহে কুফর। যদি কোন ব্যক্তি সন্দেহ করে যে কুরআন কি আল্লাহর বাণী অথবা কেউ বলে যে, ইহা আল্লাহর মাখলুক সে অবশ্যই কাফের। অনুরূপভাবে যদি যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যা নাযিল করেছেন, তার কোন বিধান বা কিছু অংশকে অস্বীকার করার অনুসন্ধানে থাকে, সেও নি:সন্দেহে কাফের। সুতরাং বলা বাহুল্য যে, এখানে মুজাদালা বা মুমারাত অর্থ সন্দেহ সংশয়।
কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বা তাফসীর বিষয়ে বিতর্ক করাকে জিদাল বলা হয় না। যেমন কোন ব্যক্তি বলল, কুরআনের এ আয়াতের অর্থ এটি? নাকি এটি? তারপর একাধিক অর্থ হতে কোন একটিকে প্রাধান্য দিল। এ ধরনের বিতর্ককে জিদাল বলা হবে না, বরং এ হল আল্লাহ তা‘আলার বাণীর মর্মার্থ জানার জন্য পর্যালোচনা করা।
মোট কথা, কুরআন বিষয়ে বিবাদ করাকে কুফর বলে আখ্যায়িত করা তখন হবে, যখন কুরআনকে সন্দেহ, সংশয় ও অস্বীকার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
 «اقْرَؤُواالقُرْآنَ مَا ائْتَلَفَتْ قُلُوبُكُمْ، فَإذَِا اخْتَلَفْتُمْ فَقُومُوا عَنْهُ»
অর্থ, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের মনোযোগ থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর। আর যখন তোমাদের অন্তর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তোমরা কুরআন পড়া ছেড়ে দাও।[2]
এ কথাটির কয়েকটি অর্থ হতে পারে:
·                     যখন তোমরা কুরআনের অর্থ বোঝার মধ্যে মতবিরোধ কর, তখন তোমরা কুরআন নিয়ে আলোচনা ছেড়ে দাও। কারণ, হতে পারে তোমাদের ইখতেলাফ তোমাদেরকে কোন খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে।
·                     অথবা হতে পারে এখানে যে নিষেধ করা হয়েছে, তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের সাথে খাস।
·                     অথবা এর অর্থ হল, আল্লাহ তা‘আলার বাণী যে অর্থ বোঝায় বা তোমাদের যে অর্থের দিক নিয়ে যায়, তার উপর তুমি মনোযোগী হও এবং তাই তুমি গ্রহণ করতে থাক। আর যখন তোমাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিবে বা সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি হবে, যা তোমাকে বিবাদের দিকে ঠেলে দেয়, তখন তুমি তা থেকে বিরত থাক। আয়াতের প্রকাশ্য ও স্পষ্ট অর্থই গ্রহণ কর এবং অস্পষ্টতা যা বিবাদের কারণ হয় তা ছেড়ে দাও। বাতিল পন্থীরা কুরআনের অস্পষ্ট বিষয়গুলো নিয়েই টানাটানি করে এবং ফিতনা সৃষ্টি করার জন্য তাতেই তারা বিবাদ করে।
ওমর রা. বলেন, এমন কতক লোকের আগমন ঘটবে যারা কুরআনের সংশয়যুক্ত আয়াত নিয়ে তোমাদের সাথে বিবাদ করবে। তোমরা সুন্নাতের মাধ্যমে তাদের প্রতিহত কর। কারণ, যারা সুন্নাত বিষয়ে অভিজ্ঞ তারা আল্লাহর কিতাব বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখে।[3] এ ছাড়া সুন্নাত আল্লাহর বাণীর মর্মার্থকে তুলে ধরে এবং কুরআনের ব্যাখ্যা করে।
ঝগড়া-বিবাদ মানুষের স্বভাবের সাথে আঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত
ঝগড়া-বিবাদ করা মানুষের স্বভাবের সাথে জড়িত। প্রাকৃতিক ভাবে একজন মানুষ অধিক ঝগড়াটে স্বভাবের হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدۡ صَرَّفۡنَا فِي هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانِ لِلنَّاسِ مِن كُلِّ مَثَلٖۚ وَكَانَ ٱلۡإِنسَٰنُ أَكۡثَرَ شَيۡءٖ جَدَلٗا﴾ [الكهف:54]
অর্থ, আর আমি এই কুরআনে মানুষের জন্য সকল প্রকার উপমা বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। আর মানুষ সবচেয়ে বেশি তর্ককারী। [সূরা কাহাফ- আয়াত: ৫৪]
অর্থাৎ, সবচেয়ে অধিক ঝগড়া-কারী ও প্রতিবাদী; সে সত্যের পতি নমনীয় হয় না এবং কোন উপদেশ-কারীর উপদেশে সে কর্ণপাত করে না।[4]
আলী ইবনে আবি তালিব রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ও তার মেয়ে ফাতেমা রা. কে তাদের উভয়ের দরজায় পাড়ি দিয়ে উভয়কে জিজ্ঞাসা করে বলেন, তোমরা উভয়ে কি সালাত আদায় করনি? আমরা তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জীবনতো আল্লাহর হাতে, তিনি ইচ্ছা করলে আমাদের জাগাতে পারতেন। আমরা এ কথা বলার সাথে সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন প্রকার কালক্ষেপণ না করে ফিরে যান। আমাকে কোন প্রতি উত্তর করেননি। তারপর আমি শুনতে পারলাম তিনি যাওয়ার সময় তার রানে আঘাত করে বলছে [সূরা কাহাফ- আয়াত: ৪৫] অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দ্রুত উত্তর দেয়া ও ব্যাপারটি নিয়ে কোন প্রকার নিজের দুর্বলতা প্রকাশ না করাতে অবাক হন। এ কারণেই তিনি স্বীয় উরুর উপর আঘাত করেন।
তবে এখানে একটি কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, তা হল মানুষ হিসেবে সবার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করার গুণ প্রাকৃতিক হলেও কোন কোন মানুষ এমন আছে, যার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করার গুণ অন্যদের তুলনায় অধিক বেশি এবং সে ঝগড়া করতে অন্যদের তুলনায় অধিক পারদর্শী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কাফেরদের নিকট রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করার পর কাফেরদের বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَإِنَّمَا يَسَّرۡنَٰهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ ٱلۡمُتَّقِينَ وَتُنذِرَ بِهِۦ قَوۡمٗا لُّدّٗا﴾[مريم:97]
অর্থ, আর আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি এর দ্বারা মুত্তাকীদেরকে সুসংবাদ দিতে পার এবং কলহপ্রিয় কওমকে তদ্বারা সতর্ক করতে পার। [সূরা মারয়াম: আয়াত: ৯৭]
এখানে লুদ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, অনর্থক ও অন্যায়ভাবে ঝগড়া-কারী যে সত্যকে গ্রহণ করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা আহলে বাতিল সম্পর্কে আরো বলেন,
 ﴿وَقَالُوٓاْ ءَأَٰلِهَتُنَا خَيۡرٌ أَمۡ هُوَۚ مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلَۢاۚ بَلۡ هُمۡ قَوۡمٌ خَصِمُون﴾[الزخرف:58]
অর্থ, আর তারা বলে, ‘আমাদের উপাস্যরা শ্রেষ্ঠ নাকি ঈসা’? তারা কেবল কূটতর্কের খাতিরেই তাকে তোমার সামনে পেশ করে। বরং এরাই এক ঝগড়াটে সম্প্রদায়। [সূরা যুখরফ: ৫৮] অর্থাৎ, ঝগড়ায় তারা পারদর্শী।
কোন কোন মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা ঝগড়া-বিবাদ করার জন্য অধিক যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করে থাকেন, তার প্রমাণ হল, কা‘আব ইবনে মালেক রা. এর হাদিস। কা‘আব ইবনে মালেক রা. যখন তাবুকের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা হতে বিরত থাকেন, তখন তিনি তার নিজের বিষয়ে বর্ণনা দিয়ে বলেন,
অর্থ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যত যুদ্ধ করেছে, একমাত্র তাবুকের যুদ্ধ ছাড়া আর কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা হতে আমি বিরত থাকিনি। তারপর যখন আমার নিকট খবর পৌঁছল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাফেলা নিয়ে যাত্রা আরম্ভ করেছেন, তখন সব চিন্তা এসে আমাকে গ্রাস করে ফেলল, তখন আমি মিথ্যার অনুসন্ধান করতে লাগলাম। আগামী দিন আমি কি অপারগতা দেখিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আক্রোশ থেকে রেহাই পাব! আমি আমার পরিবারের বিজ্ঞ, জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোকদের কাছ থেকে মতামত নিতে থাকি।… তারপর যখন আমাকে জানানো হল, যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেরৎ আসছে তখন আমার থেকে যাবতীয় সব ধরনের অনৈতিক ও বাতিল চিন্তা দূর হয়ে গেল। আর আমি প্রতিজ্ঞা করলাম যে, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বাচার জন্য এমন কোন কথা বলবো না যার মধ্যে মিথ্যার অবকাশ থাকে। আমি সব সত্য কথাগুলো আমার অন্তরে গেঁথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে উপস্থিত হই। আমি যখন তাকে সালাম দিলাম, তখন সে একটি মুচকি হাসি দিল; একজন ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত ব্যক্তির মুচকি হাসির মত। তারপর সে আমাকে বলে আস! আমি পায়ে হেটে তার দিকে অগ্রসর হয়ে তার সামনে বসে পড়লাম। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করে বলেন, কোন জিনিষ তোমাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ হতে বিরত রাখল? তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ রাসূল! আল্লাহর শপথ করে বলছি! যদি আমি আপনি ছাড়া দুনিয়াদার কোন লোকের সামনে বসতাম, তাহলে আমি কোন একটি অপারগতা বা কারণ দেখিয়ে তার আক্রোশ ও ক্ষোভ হতে মুক্তি পেতাম। আমাকে এ ধরনের ঝগড়া ও বিবাদ করার যোগ্যতা দেয়া হয়েছে…।[5]
এখানে হাদিসে কা‘আব ইবনে মালেকের أعطيت جدلا কথাটিই হল আমাদের প্রামাণ্য উক্তি। এখানে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, আমাকে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে কথা বলার এমন এক যোগ্যতা, শক্তি ও পাণ্ডিত্য দেয়া হয়েছে, যার দ্বারা আমি আমার প্রতি যে অপবাদ দেয়া হয়েছে, তা হতে অতি সহজেই বের হয়ে আসতে পারতাম। আমি আমাকে আঠা থেকে চুল যেভাবে বের করে আনে, সেভাবে বের করে আনতে পারতাম।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী উম্মে সালমা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন তার স্বীয় ঘরের দরজায় ঝগড়ার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ঘর থেকে বের হলেন। তারপর তিনি তাদের বললেন,
«إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ، وَإِنَّهُ يَأْتِينِي الخَصْمُ، فَلَعَلَّ بَعْضَكُمْ أَنْ يَكُونَ أَبْلَغَ مِنْ بَعْضٍ؛ فَأَحْسَبُ أَنَّهُ صَدَقَ، فَأَقْضِيَ لَهُ بِذَلِكَ، فَمَنْ قَضَيْتُ لَهُ بِحَقِّ مُسْلِمٍ فَإِنَّمَا هِيَ قِطْعَةٌ مِنَ الناَّرِ، فَلْيأَخُذْهَا أَوْ فَلْيتْرُكْهَا»
অর্থ, অবশ্যই আমি একজন মানুষ। আর আমার নিকট অনেক বিচার ফায়সালা এসে থাকে। আমি দেখতে পাই অনেক এমন আছে যারা বিতর্কে তার প্রতিপক্ষের চেয়ে অধিক পারদর্শী। তখন তার কথার পেক্ষাপটে আমার কাছে মনে হয় সে সত্যবাদী। ফলে আমি তার পক্ষে ফায়সালা করে থাকি। তবে আমি যদি কোন মুসলিম ভাইয়ের হককে কারো জন্য ফায়সালা করে দিই, মনে রাখবে, তা হল আগুনের একটি খণ্ড! চাই সে তা গ্রহণ করুক অথবা ছেড়ে যাক।[6]
মানুষের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ করার এ গুণটি কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হবে এমনকি কিয়ামত কায়েম হওয়ার পরেও মানুষের মধ্যে ঝগড়া করার গুণটি অবশিষ্ট থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَوۡمَ تَأۡتِي كُلُّ نَفۡسٖ تُجَٰدِلُ عَن نَّفۡسِهَا وَتُوَفَّىٰ كُلُّ نَفۡسٖ مَّا عَمِلَتۡ وَهُمۡ لَا يُظۡلَمُونَ﴾[النحل:111]
অর্থ, (স্মরণ কর সে দিনের কথা) যেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের পক্ষে যুক্তি-তর্ক নিয়ে উপস্থিত হবে এবং প্রত্যেককে ব্যক্তি সে যা আমল করেছে তা পরি পূর্ণরূপে দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি জুলম করা হবে না। [সূরা নাহাল: ১১১]
অর্থাৎ, দুনিয়াতে সে যা করেছে, সে বিষয়ে সে ঝগড়া-বিবাদ করবে এবং প্রমাণ পেশ করবে। আর আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চেষ্টা করবে।
অর্থ, আনাস বিন মালেক রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম। তখন তিনি হাসি দিলেন। তারপর তিনি আমাদের বললেন, তোমরা কি জান আমি কি কারণে হাসলাম? আনাস রা. বলেন, আমরা বললাম আল্লাহ ও তার রাসূ্লই ভালো জানেন। বান্দা তার রবকে সম্বোধন করে যে কথা বলবে, তার কথা স্মরণ করে আমি হাসছি! সে বলবে, হে আমার রব তুমি আমাকে জুলুম থেকে মুক্তি দেবে না। তখন আল্লাহ বলবে অবশ্যই! তখন বান্দা বলবে আমি আমার পক্ষে মাত্র একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো আল্লাহ বলবে আজকের দিন তোমার জন্য কিরামান কাতেবীনের অসংখ্য সাক্ষীর বিপরীতে একজন সাক্ষীই যথেষ্ট। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তার মুখের মধ্যে তালা দিয়ে দিবে এবং তার অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে বলা হবে, তোমরা কথা বল! তখন প্রতিটি অঙ্গ তার কর্ম সম্পর্কে বলবে। তারপর তাকে তার কথা মাঝে ছেড়ে দেয়া হবে। তখন সে তাদের বলবে তোমাদের জন্য ধ্বংস! আমি তোমাদের জন্যই বিতর্ক ও বিবাদ করছি![7] আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন কাফেরদের ঝগড়ার বিবরণ দিয়ে বলেন,
﴿وَيَوۡمَ نَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا ثُمَّ نَقُولُ لِلَّذِينَ أَشۡرَكُوٓاْ أَيۡنَ شُرَكَآؤُكُمُ ٱلَّذِينَ كُنتُمۡ تَزۡعُمُونَ ٢٢ ثُمَّ لَمۡ تَكُن فِتۡنَتُهُمۡ إِلَّآ أَن قَالُواْ وَٱللَّهِ رَبِّنَا مَا كُنَّا مُشۡرِكِينَ ٢٣ ٱنظُرۡ كَيۡفَ كَذَبُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡۚ وَضَلَّ عَنۡهُم مَّا كَانُواْ يَفۡتَرُونَ ٢٤ ﴾[الأنعام:22-23]
অর্থ, আর যেদিন আমি তাদের সকলকে সমবেত করব তারপর যারা শিরক করেছে তাদেরকে বলব, ‘তোমাদের শরীকরা কোথায়, যাদেরকে তোমরা (শরীক) মনে করতে?’ অতঃপর তাদের পরীক্ষার জবাব শুধু এ হবে যে, তারপর তারা বলবে, ‘আমাদের রব আল্লাহর কসম! আমরা মুশরিক ছিলাম না’। দেখ, তারা কীভাবে মিথ্যা বলেছে নিজদের উপর, তারা যে মিথ্যা রটনা করত, তা তাদের থেকে হারিয়ে গেল। [সূরা আনআম ২২-২৪]
আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নূহ আ. ও তার উম্মতরা আল্লাহর দরবারে আসবে তখন আল্লাহ তা‘আলা নুহকে জিজ্ঞাসা করবে তুমি তাদের দাওয়াত দিয়েছ? বলবে হা হে আমার রব! তারপর উম্মতদের জিজ্ঞাসা করা হবে তোমাদের নিকট কি দাওয়াত দিয়েছে? তার বলবে না হে আমাদের প্রভু! আমাদের নিকট কোন নবী আসেনি। তখন আল্লাহ তা‘আলা নূহ আ. কে বলবে হে নূহ, তোমার পক্ষে কে সাক্ষ্য দেবে? তখন সে বলবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার উম্মতেরা। তারপর আমরা সাক্ষী দেব যে, সে তার উম্মতদের পৌঁছিয়েছে। আর তা হল, আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَٰكُمۡ أُمَّةٗ وَسَطٗا لِّتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ وَيَكُونَ ٱلرَّسُولُ عَلَيۡكُمۡ شَهِيدٗاۗ﴾[البقرة:143]
র্অথ, আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের উপর সাক্ষী হও এবং রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের উপর। [সূরা বাকারাহ ১৪৩]
ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টির কারণসমূহ
আমরা যদি একটু নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, কি কারণে মানুষের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ ও মতবিরোধ তৈরি হয়? তাহলে আমরা এর অনেকগুলো কারণ খুঁজে পাবো। সব কারণ উল্লেখ করা সম্ভব নয়। নিম্নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আলোচনা করা হল:
1.    প্রকাশ্যে উপদেশ দেয়া।
2.    অসময়ে উপদেশ দেয়া।
3.    অনুপযোগী স্থানে উপদেশ দেয়া। যার ফলে অন্যরা তাকে ঘৃণা করে ও লজ্জা দেয়।
4.    আবার কখনো ঝগড়া বিবাদের কারণ হয়, অন্যের নিকট যা আছে তা লাভের জন্য পদক্ষেপ নেয়া বা তার প্রতি লোভ করা।
5.    অন্যের উপর যে কোন উপায়ে প্রাধান্য বিস্তার বা বিজয়ী হওয়ার জন্য অধিক চেষ্টা করা। আর তা চাই অনৈতিক পদ্ধতিতে হোক বা সঠিক পদ্ধতিতে। মোট কথা যে কোনোভাবে তাকে প্রাধান্য বিস্তার করতেই হবে।
6.    আর কখনো সময় পরিবেশ ও পরিপার্শ্বিকতা মানুষের মধ্যে ঝগড়া বিবাদকে উসকিয়ে দেয়। বিশেষ করে যুব সমাজকে পরিবেশ ও সমাজ ব্যবস্থা ঝগড়া-বিবাদের দিকে ঠেলে দেয়। তাই উচিত হল, তাদের এ ব্যাপারে অধিক সতর্ক করা। আবার কখনো কখনো দেখা যায়, দ্বীনদার ও দায়ীদের মধ্যেও ঝগড়া-বিবাদ পরিলক্ষিত হয়, যা তাদের মধ্যে ফিরকা-বন্দি ও দলাদলিকে উসকিয়ে দেয়। আবার কখনো দেখা যায় স্কুল মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যেও ঝগড়া-বিবাদ দেখা দেয়। অনেক সময় তারা ছাত্রদের সাথে বিবাদ ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে, যার প্রভাবে ছাত্রদের মধ্যেও এ ঘৃণিত গুণটি সয়লাব করে এবং তারা ঝগড়াটে স্বভাবের হয়ে যায়। আবার কখনো এমন হয় যে, মাতা-পিতা ঝগড়াটে হলে, তার প্রভাবে ছেলে সন্তানও ঝগড়াটে হয়। এ জন্য অভিভাবকদের উচিত তারা যেন এ ঘৃণিত অভ্যাসটি পরিহার করে এবং তা থেকে বেচে থাকে।
7.    অহংকার, ধোঁকাবাজি ও অহমিকা ইত্যাদি ঝগড়ার কারণ হয়।
8.    আল্লাহর ভয় না থাকাও ঝগড়া-বিবাদের অন্যতম কারণ।
9.   অবসর থাকা। কোন কাজকর্ম না থাকলে মানুষ ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। একজন অবসর সৈনিক তাকে দাঙ্গা হাঙ্গামায় লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। তুমি যদি চিন্তা কর, তাহলে দেখতে পাবে কেবল অবসর লোক, যাদের কোন কাজ নাই তারাই বেশিরভাগ ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকে। আর এটাই ঝগড়া বিবাদের অন্যতম কারণ।
প্রশংসনীয় বিতর্কের শর্তাবলী
আমরা যখন কোন বিষয়ে বিতর্ক করতে যাব, তখন আমাদের বিতর্কে যাওয়ার পূর্বে কি কি শর্তাবলী মেনে চলা উচিত, তা অবশ্যই জানা থাকতে হবে।
প্রশংসনীয় বিতর্কের শর্তাবলী নিম্নরূপ:
এক. বিতর্ক হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য। বিতর্ক দ্বারা বরকত লাভ ও ফায়েদা হাসিলের জন্য এখলাস হল পূর্বশর্ত। কারণ, তর্কের উদ্দেশ্য হল, সত্য উদঘাটন করা এবং হককে জানা। এ কারণে এ বিষয়ে বিতর্কে যাওয়ার পূর্বে আল্লাহর ভয় অন্তরে বিদ্যমান থাকতে হবে এবং সদিচ্ছা ও সুন্দর নিয়ত থাকতে হবে। তাহলেই বিতর্ক দ্বারা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছা যাবে।
দুই. বিতর্ক হতে হবে উত্তম পদ্ধতিতে।
তিন. বিতর্ক করতে হবে ইলমের দ্বারা। অর্থাৎ, যে বিষয়ে বিতর্ক করবে, সে বিষয়ে অবশ্যই তার জ্ঞান থাকতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿هَٰٓأَنتُمۡ هَٰٓؤُلَآءِ حَٰجَجۡتُمۡ فِيمَا لَكُم بِهِۦ عِلۡمٞ فَلِمَ تُحَآجُّونَ فِيمَا لَيۡسَ لَكُم بِهِۦ عِلۡمٞۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ﴾[آل عمران:66]
অর্থ, সাবধান! তোমরা তো সেসব লোক, বিতর্ক করলে এমন বিষয়ে, যার জ্ঞান তোমাদের রয়েছে। তবে কেন তোমরা বিতর্ক করছ সে বিষয়ে যার জ্ঞান তোমাদের নেই? আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। [সূরা আলে-ইমরান: ৬৬]
চার. আল্লাহ তা‘আলার নামের মাধ্যমে বিতর্ক শুরু করবে। সুতরাং, উভয় পক্ষ আল্লাহর নাম ও বিছমিল্লাহ দ্বারা বিতর্ক শুরু করবে। যদি মুখে উচ্চারণ করতে না পারে, তবে তাকে অবশ্যেই অন্তরে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে হবে।
পাঁচ. মজলিশের আদব ও প্রতিপক্ষের সম্মান রক্ষা করতে হবে এবং তার সামনে সুন্দর ও বিনম্র-ভাবে বসবে।
ছয়. প্রবৃত্তির পূজা করা হতে বের হতে হবে। তর্কের মাঝে যদি কোন মানুষ বুঝতে পারে, সে ভুলের উপর আছে এবং তার প্রতিপক্ষ হকের উপর, তখন তার উচিত হল, সে তার ভুল থেকে ফিরে আসবে এবং প্রতি পক্ষের কথা মেনে তার নিকট আত্মসমর্পণ করবে। যে ব্যক্তি সালফে সালেহীনদের জীবনী পাঠ করবে, তার জন্য ভুল থেকে ফিরে আসা অনেকটা সহজ হবে।
মুহাম্মদ ইবনে কা‘ব থেকে বর্ণিত, এক লোক আলী রা. কে একটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি তার মতামত দেন। কিন্তু লোকটি তাকে বলল, বিষয়টি এমন নয় বরং বিষয়টি এ রকম। তখন আলী রা. বলল, তুমি সঠিক বলছ আর আমি ভুল করছি। আল্লাহ বলেন,
﴿وَفَوۡقَ كُلِّ ذِي عِلۡمٍ عَلِيمٞ﴾[يوسف:76]
অর্থ, এবং প্রত্যেক জ্ঞানীর উপর রয়েছে একজন জ্ঞানী। [সূরা ইউসুফ: ৭৬]
তাউস রহ. বর্ণনা করেন, যায়েদ ইবনে ছাবেত রা. ও ইবনে আব্বাস রা. উভয় তাওয়াফে বিদা করার আগে কোন মহিলার মাসিক আরম্ভ হলে তার বিধান কি হবে, এ নিয়ে মতবিরোধ করেন। মহিলাটি কি তাওয়াফে বিদা না করে বিদায় নিবে, নাকি সে তাওয়াফ করবে? ইবনে আব্বাস রা. বলেন, সে বিদায় নিবে, আর যায়েদ ইবনে সাবেত রা. বলেন সে বিদায় নিবে না। তারপর যায়েদ ইবনে সাবেত রা. আয়েশা রা. নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, সে বিদায় নিবে। আয়েশা রা. এর উত্তর শুনে যায়েদ ইবনে সাবেত রা. মুচকি হেসে বের হন এবং আব্বাস রা. কে বলেন, কথা সেটাই যা তুমি বলছ।
ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন, এটাই হল ইনসাফ! যায়েদ রা. হলেন ইবনে আব্বাসের শিক্ষক। তারপরও তিনি তার উপর কোন চাপ সৃষ্টি করেননি। আমরা কেন তাদের অনুকরণ করব না। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।
আমরা জানি ইমাম আবু হানিফা রহ. ছিলেন বিতর্কে অত্যন্ত পারদর্শী ও বুদ্ধিমান বিতর্ককারীদের একজন। যারা সত্য ও হককে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিতর্ক করত তিনি ছিলেম তাদের অন্যতম ও বিখ্যাত। কিন্তু তিনি তার ছেলেকে বিতর্ক করতে নিষেধ করেন। তখন তার ছেলে তাকে বলে আপনাকে আমি বিতর্ক করতে দেখছি, অথচ আপনি আমাদের না করছেন!
উত্তরে তিনি বলেন, আমরা যখন কথা বলতাম, তখন আমাদের প্রতিপক্ষের সম্মানহানি হওয়ার ভয়তে এমন করে বসতাম, যেন আমাদের মাথার উপর পাখি বসে আছে। আর বর্তমানে তোমরা বিতর্ক কর, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও সম্মানহানি করার জন্যই।
ইমাম শাফেয়ী রহ. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, কল্যাণ কামনা করা ছাড়া কখনোই কারো সাথে বিতর্ক করিনি। আর কারো সাথে এ জন্য বিতর্ক করিনি যে সে ভুল করুক।[8] অর্থাৎ, আমরা এ কামনা করে কখনোই বিতর্ক করিনি যে, আমার প্রতিপক্ষ হেরে যাক। কারণ, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সত্যকে উদঘাটন করা সেটা চাই আমার পক্ষ থেকে হোক বা তার পক্ষ থেকে হোক।
বর্ণিত আছে একবার ইমাম শাফেয়ী রহ. একটি বিষয় যার মধ্যে দুইটি মতামত বিদ্যমান, তা নিয়ে কোন এক আহলে ইলমের সাথে বিতর্ক করেন। তারপর ইমাম শাফেয়ী রহ. তার প্রতিপক্ষের মতকে গ্রহণ করেন আর প্রতিপক্ষ ইমাম শাফেয়ীর মতকে গ্রহণ করে। এভাবেই তাদের বিতর্কের সমাপ্তি হয়।
সাত. ধৈর্য ও সহনশীলতা থাকতে হবে। কারণ, ধৈর্য ও সহনশীলতা ছাড়া বিতর্ক তিক্ততা ও খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে।
আট. বিতর্কের সময় ধীরস্থিরিতা থাকতে হবে। শুধু তাড়াহুড়া করলে চলবে না। কারণ, শুধু আমি আমার কথা বলতে থাকলাম আমার প্রতিপক্ষকে কথা বলার সুযোগ দিলাম না তাহলে শুধু কথা বলাই হবে। প্রতিপক্ষের নিকট কি আছে তা শোনা বা জানা হবে না।
নয়. সত্য কথা বলার উপর অটল অবিচল থাকতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَقۡفُ مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٌۚ إِنَّ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡبَصَرَ وَٱلۡفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَٰٓئِكَ كَانَ عَنۡهُ مَسۡ‍ُٔولٗا ٣٦﴾ [الإسراء: ٣٦]
অর্থ, আর যে বিষয় তোমার জানা নাই তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তকরণ- এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে। [সুরা ইসরা: ৩৬]
দশ. প্রতিপক্ষের সাথে বিনম্র আচরণ করতে হবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, আমরা যখন কোন বিষয়ে তর্ক করি আমাদের উদ্দেশ্য হল, ফলাফল বের ও সত্য উদঘাটন করা। আমাদের উদ্দেশ্য সময় নষ্ট করা বা প্রতিপক্ষের উপর বিজয় লাভ করা নয়।
সুতরাং, প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করা, মানুষের সামনে তাকে নির্বাক ও হেয় প্রতিপন্ন করা, তাকে কথা বলার সুযোগ না দেয়া বা তার সাথে এমন কথা বলা, যা তার অন্তরে আঘাত আনে ও ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার শামিল হয় এবং মানুষের সামনে তাকে ঠাট্টা বিদ্রূপ ও হাসির পাত্র বানিয়ে ফেলে, তা কোন ক্রমেই উচিত নয়।
এগার. প্রতিপক্ষ ফিরে আসার জন্য পথকে উম্মূক্ত রাখবে। সে যদি হেরে যায় তাহলে তাকে হেয় করবে না। তার সাথে কোন প্রকার দুর্ব্যবহার করবে না। তার কথা ভালোভাবে শুনবে। কারণ, তার কথা ভালোভাবে শুনা দ্বারা তুমি অর্ধেক ফলাফলে পৌঁছে যাবে।
বার. ইনসাফ করা। যদি তোমার প্রতিপক্ষ কোন সত্য কথা বলে, তা স্বীকার করে নেয়া এবং তার মান-মর্যাদার স্বীকৃতি দেয়া।
আবু মুহাম্মদ ইবনে হাযাম বলেন, একবার আমি আমার এক সাথীর সাথে মুনাযারা করি। তার মুখের মধ্যে তোতলামি থাকাতে আমি তার উপর বিজয় লাভ করি। আমাকে মজলিশে বিজয়ী ঘোষণা করে মজলিশ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আমি যখন মজলিশ শেষ করে ঘরে ফিরি, তখন আমার অন্তরে সন্দেহ হলে আমি কিতাবের শরণাপন্ন হই এবং কিতাবে একটি বিশুদ্ধ প্রমাণ দেখতে পাই যা আমার প্রতিপক্ষের কথাকে বিশুদ্ধ আর আমার কথাকে বাতিল বলে প্রমাণ করে। আমার সাথে একজন সাথী ছিল যে আমাদের তর্কের মজলিসে উপস্থিত ছিল। আমি তাকে কিতাবের বিষয়টি অবহিত করলে সে বলে তুমি এখন কি করতে চাও? আমি বললাম কিতাবটি নিয়ে তার কাছে গিয়ে পেশ করবো এবং তাকে বলব তুমি হক আর আমি বাতিল। আর তার কথা কবুল করে নেব। সে বলল, তুমি তোমাকে হেয় করবে? আমি বললাম হা! আমি যদি এ মুহূর্তে তা করতে পারতাম তাহলে আগামীর জন্য অপেক্ষা করতাম না। তবে আমি এখনই আমার মতকে প্রত্যাখ্যান করে তার মতের দিকে ফিরে আসলাম।
তের. মার্জিত ও সম্মান সূচক বাক্য ব্যবহার করে কথা বলবে। চিৎকার করবে না ও অমার্জিত কথা বলবে না। কোন এক ব্যক্তি মজলিশে চিৎকার করলে পরিচালনাকারী বলেন, হে আব্দুস সামাদ সত্য তো সঠিক কথার মধ্যে কঠিন আওয়াজে নয়। সুতরাং চিৎকার দ্বারা কোন ফায়সালা হয় না।
চৌদ্দ. ঝগড়া পরিহার করা। অনেক লোক আলেমদের ইলম থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের সাথে বিবাদ করার কারণে। ইবনে আব্বাস রা. এর কোন এক ছাত্র বলছিল, আমি যদি ইবনে আব্বাসের সাথে বন্ধুত্ব করতাম, তাহলে তার থেকে আরো অনেক ইলম শিখতে পারতাম।[9] ইবনে জুরাইয রহ. বলেন, আমি যত কিছু আতা থেকে শিখেছি তা তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ দ্বারাই শিখছি।[10]
পনের. বিতর্কের জন্য শর্ত হল, তা আলেমদের সম্মুখে হবে যাহেলদের সম্মুখে নয়।
ষোল. মতামতের পার্থক্য বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারবে না। ইমাম আহমদ রহ. একবার আলী ইবনুল মাদিনীর সাথে বিতর্ক করতে গিয়ে মজলিশে তারা একে অপরের সাথে উচ্চ বাচ্য করেন। কিন্তু আলী ইবনুল মাদীনি যখন মজলিশ থেকে উঠে চলে যেতে লাগল, তখন ইমাম আহমদ উঠে তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে তাকে বিদায় দেন।
সতের. যে সব কথা মানুষের চিন্তা চেতনা ও বিশ্বাসের পরিপন্থী ঐ ধরনের কথা হতে বিরত থাকা উচিত।
আঠার. সব ধরনের হিলা ও ষড়যন্ত্র পরিহার করবে। আর একজন বিচারক নির্ধারণ করবে যে উভয় পক্ষের কথা নোট করবে, যাতে কেউ কোন কথা বলে অস্বীকার করতে না পারে।
উনিশ. কতক লোক আছে তাদের সাথে বিতর্ক সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে। যেমন, মূর্খ যে তার মূর্খতাকে স্বীকার করে না, সীমালঙ্ঘন কারী, আহাম্মক এবং যে মিথ্যা সাক্ষী দেয়।
বিতর্কের প্রকারভেদ
বিতর্ক দুই প্রকার:
এক- প্রশংসনীয় বিতর্ক।
দুই- নিন্দনীয় বা মন্দ বিতর্ক।
বিতর্ক দ্বারা কখনো কথোপকথন, প্রমাণ উত্থাপন ও মতামত প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এ ধরনের বিতর্ক প্রশংসনীয়। আর বিতর্ক মানে যখন তিক্ততা, বাক বিতণ্ডা ও ঝগড়া-বিবাদ হয়, তা হল, নিন্দনীয় বা মন্দ বিতর্ক। আল্লাহ তা‘আলা উত্তম ও প্রশংসনীয় বিতর্কের জন্য আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ﴾ [النحل:125]
অর্থ, তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াত প্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন। [সূরা নাহাল: ১২৫]
সুতরাং, তোমাদের বিতর্ক যেন হয় উত্তম পদ্ধতিতে, নম্র, ভদ্র ও সুন্দর বাক্য বিনিময়ের মাধ্যমে। আর আমাদের বিতর্ক যেন খারাপ ভাষায় না হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تُجَٰدِلُوٓاْ أَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ إِلَّا بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ إِلَّا ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنۡهُمۡۖ وَقُولُوٓاْ ءَامَنَّا بِٱلَّذِيٓ أُنزِلَ إِلَيۡنَا وَأُنزِلَ إِلَيۡكُمۡ وَإِلَٰهُنَا وَإِلَٰهُكُمۡ وَٰحِدٞ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ﴾ [العنكبوت:46]
অর্থ, আর তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্ক করো না। তবে তাদের মধ্যে ওরা ছাড়া, যারা জুলুম করেছে। আর তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে এবং তোমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো একই। আর আমরা তাঁরই সমীপে আত্মসমর্পণকারী’। [সূরা আনকাবুত: ৪৬] আর উত্তম দ্বারা বিতর্ক করার অর্থ:
১. কুরআন দ্বারা বিতর্ক করা।
২. কেউ কেউ বলে, লা ইলাহা… দ্বারা বিতর্ক করা।
৩. আবার কেউ কেউ বলে, তাদের সাথে বিতর্ক করা কোন প্রকার কঠোরতা ও তিক্ততা ছাড়া আর তাদের জন্য তুমি তোমার পার্শ্বকে বিছিয়ে দাও।
আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী-
﴿وَلَا تُجَٰدِلُوٓاْ أَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ إِلَّا بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ إِلَّا ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنۡهُمۡۖ ﴾
এর অর্থ হল, কিন্তু যারা তোমাদের জন্য সত্যকে স্বীকার করতে অস্বীকার করে এ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না। তবে যারা কর দিতে অস্বীকার করে এবং তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকে, তাদের সাথে মৌখিক বিতর্ক নয়। কারণ, তাদের সাথে বিতর্ক হল, তলোয়ার বা যুদ্ধ। তাদের সাথে এ অবস্থায় মৌখিক বিতর্ক করা সম্ভব নয়।
নিন্দনীয় বা মন্দ বিতর্ক:
যে বিতর্ক দ্বারা বাতিলকে বিজয়ী করা হয় এবং সঠিক ও সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়, তাকে নিন্দনীয় বা মন্দ বিতর্ক বলা হয় ।
আল্লামা যাহবী রহ. বলেন, বিতর্ক যদি সত্য উদঘাটন ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে, তাহলে তা হবে প্রশংসনীয়। আর যদি তা সত্যকে প্রতিহত করা অথবা না জেনে করা হয়, তা হবে নিন্দনীয়।[11]
প্রশংসনীয় বিতর্ক:
 যে বিতর্ক খালেস নিয়ত ও কোন কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তা হল, প্রশংসনীয়। আর এ ধরনের বিতর্ক আল্লাহর দ্বীনের জন্য করা একজন মুসলিমের উপর দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, যে ব্যক্তি নাস্তিক মুরতাদ ও বেদাতিদের সাথে এমন বিতর্ক না করে, যে বিতর্ক তাদের মূলোৎপাটন ও জড় কেটে দেয়, তাহলে সে ইসলামের হক আদায় করেনি এবং সে ঈমান ও ইলমের চাহিদা পূরণ করেনি। তার কথা দ্বারা তার অন্তরের তৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করেনি। আর তার কথা তার ঈমান ও ইলমের কোন উপকারে আসেনি।[12]
একটি কথা মনে রাখতে হবে, হকের পক্ষে বিতর্ক করা মহান ইবাদত। যখন নূহ আ. এর কওমের লোকেরা নূহ আ. কে বলল,
﴿قَالُواْ يَٰنُوحُ قَدۡ جَٰدَلۡتَنَا فَأَكۡثَرۡتَ جِدَٰلَنَا فَأۡتِنَا بِمَا تَعِدُنَآ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّٰدِقِينَ ﴾[هود:32]
অর্থ, তারা বলল, ‘হে নূহ, তুমি আমাদের সাথে বাদানুবাদ করছ এবং আমাদের সাথে অতিমাত্রায় বিবাদ করেছ। অতএব যার প্রতিশ্রুতি তুমি আমাদেরকে দিচ্ছ, তা আমাদের কাছে নিয়ে আস, যদি তুমি সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও’। [সূরা হূদ: ৩২]
এখানে একটি কথা প্রমাণিত হয়, নূহ আ. তার কওমের লোকদের সাথে হককে জানানো ও মানানোর জন্য বিতর্ক করেন। এ কারণেই তিনি তাদের কথার জবাব দেন এবং বলেন,
﴿قَالَ إِنَّمَا يَأۡتِيكُم بِهِ ٱللَّهُ إِن شَآءَ وَمَآ أَنتُم بِمُعۡجِزِينَ ٣٣ وَلَا يَنفَعُكُمۡ نُصۡحِيٓ إِنۡ أَرَدتُّ أَنۡ أَنصَحَ لَكُمۡ إِن كَانَ ٱللَّهُ يُرِيدُ أَن يُغۡوِيَكُمۡۚ هُوَ رَبُّكُمۡ وَإِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ﴾ [هود:33-34]
অর্থ, সে বলল, ‘আল্লাহই তো তোমাদের কাছে তা হাজির করবেন, যদি তিনি চান। আর তোমরা তাকে অক্ষম করতে পারবে না’। ‘আর আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিতে চাইলেও আমার উপদেশ তোমাদের কোন উপকারে আসবে না, যদি আল্লাহ তোমাদের বিভ্রান্ত করতে চান। তিনি তোমাদের রব এবং তাঁর কাছেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে’। [সূরা হুদ আয়াত: ৩৩-৩৪]
কুরআন করীম নবীদের বিতর্কের কাহিনীর আয়াত দ্বারা ভরপুর। যেমন, মূসা আ. এর ফিরআউনের সাথে বিতর্ক, নূহ আ. এর তার কওমের লোকদের সাথে, ইব্রাহিম আ. নমরুদের সাথে ও তার পিতার সাথে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কুরাইশদের সাথে এবং সাহাবীদের মুশরিকদের সাথে বিতর্ক করেন। এ সব বিতর্ক হল, হক পন্থীদের সাথে বাতিল পন্থীদের বিতর্ক, যাতে তারা হককে কবুল করে এবং বাতিল থেকে ফিরে আসে। আর এগুলো হল, প্রশংসনীয় বিতর্ক।
অনুরূপভাবে কুরআনে যে মহিলাটির ঘটনা উল্লেখ করা হয়, সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে ফতওয়া চান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قَدۡ سَمِعَ ٱللَّهُ قَوۡلَ ٱلَّتِي تُجَٰدِلُكَ فِي زَوۡجِهَا وَتَشۡتَكِيٓ إِلَى ٱللَّهِ وَٱللَّهُ يَسۡمَعُ تَحَاوُرَكُمَآۚ إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعُۢ بَصِيرٌ ﴾ [المجادلة:01]
আল্লাহ অবশ্যই সে রমনীর কথা শুনেছেন যে তার স্বামীর ব্যাপারে তোমার সাথে বাদানুবাদ করছিল আর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছিল। আল্লাহ তেমাদের কথোপকথন শোনেন। নিশ্চয় সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। [সূরা মুজাদালাহ: ০১]
মহিলাটি তার স্বামীর সাথে তার পরিণতি ও তার সাথে তার করণীয় সম্পর্কে জানতে চান। তার স্বামী তার জন্য হালাল নাকি হারাম? এ হল, প্রশংসনীয় বিতর্ক।
মন্দ বা খারাপ বিতর্ক:
এমন বিতর্ক যা পরিষ্কার বাতিল অথবা বাতিলের দিকে নিয়ে যায়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا نُرۡسِلُ ٱلۡمُرۡسَلِينَ إِلَّا مُبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَۚ وَيُجَٰدِلُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بِٱلۡبَٰطِلِ لِيُدۡحِضُواْ بِهِ ٱلۡحَقَّۖ وَٱتَّخَذُوٓاْ ءَايَٰتِي وَمَآ أُنذِرُواْ هُزُوٗا ﴾[الكهف:56]
অর্থ, আর আমি তো রাসূলদেরকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপেই পাঠিয়েছি এবং যারা কুফরী করেছে তারা বাতিল দ্বারা তর্ক করে, যাতে তার মাধ্যমে সত্যকে মিটিয়ে দিতে পারে। আর তারা আমার আয়াতসমূহকে এবং যা দিয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে, তাকে উপহাস হিসেবে গ্রহণ করে [সূরা কাহাফ: ৫৬]
 অর্থাৎ, যাতে তারা হককে প্রতিহত করতে পারে এবং মিথ্যা সাব্যস্ত করতে পারে। আর নিন্দনীয় বিতর্ক হল, কাফেরদের স্বভাব। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿وَمَا نُرۡسِلُ ٱلۡمُرۡسَلِينَ إِلَّا مُبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَۚ وَيُجَٰدِلُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بِٱلۡبَٰطِلِ لِيُدۡحِضُواْ بِهِ ٱلۡحَقَّۖ وَٱتَّخَذُوٓاْ ءَايَٰتِي وَمَآ أُنذِرُواْ هُزُوٗا ﴾[الكهف:56]
অর্থ, আর আমি তো রাসূলদেরকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপেই পাঠিয়েছি এবং যারা কুফরী করেছে তারা বাতিল দ্বারা তর্ক করে, যাতে তার মাধ্যমে সত্যকে মিটিয়ে দিতে পারে। আর তারা আমার আয়াতসমূহকে এবং যা দিয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে, তাকে উপহাস হিসেবে গ্রহণ করে [সূরা কাহাফ: ৫৬]
এ মহান আয়াত দ্বারা এ কথা স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, কাফেররা সর্বদা হককে প্রতিহত ও দূরীভূত করতে ঈমানাদরদের সাথে বিতর্ক করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿كَذَّبَتۡ قَبۡلَهُمۡ قَوۡمُ نُوحٖ وَٱلۡأَحۡزَابُ مِنۢ بَعۡدِهِمۡۖ وَهَمَّتۡ كُلُّ أُمَّةِۢ بِرَسُولِهِمۡ لِيَأۡخُذُوهُۖ وَجَٰدَلُواْ بِٱلۡبَٰطِلِ لِيُدۡحِضُواْ بِهِ ٱلۡحَقَّ فَأَخَذۡتُهُمۡۖ فَكَيۡفَ كَانَ عِقَابِ﴾[غافر:05]
অর্থ, এদের পূর্বে নূহের কওম এবং তাদের পরে অনেক দলও অস্বীকার করেছিল। প্রত্যেক উম্মতই স্ব স্ব রাসূলকে পাকড়াও করার সংকল্প করেছিল এবং সত্যকে বিদূরিত করার উদ্দেশ্যে তারা অসার বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল। ফলে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম। সুতরাং কেমন ছিল আমার আযাব! [সূরা গাফের: ০৫]
অর্থাৎ তারা ঝগড়া বিবাদ ও বিতর্ক করে যাতে হককে মিটিয়ে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ يُحَآجُّونَ فِي ٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ مَا ٱسۡتُجِيبَ لَهُۥ حُجَّتُهُمۡ دَاحِضَةٌ عِندَ رَبِّهِمۡ وَعَلَيۡهِمۡ غَضَبٞ وَلَهُمۡ عَذَابٞ شَدِيدٌ ﴾[الشورى:16]
আর আল্লাহর আহবানে সাড়া দেয়ার পর আল্লাহ সম্পর্কে যারা বিতর্ক করে, তাদের দলীল-প্রমাণ তাদের রবের নিকট অসার। তাদের উপর (আল্লাহর) গযব এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। [সূরা সুরা: ১৬]
 যারা আল্লাহ তা‘আলার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে, তাদের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে যারা বিতর্ক করে ও ঝগড়া-বিবাদ করে এ আয়াত তাদের জন্য হুমকি ও সতর্কবাণী উচ্চারণ করে। আল্লাহ তা‘আলা যারা মুমিনদের আল্লাহর রাস্তা হতে বিরত রাখতে চায় আল্লাহ তা‘আলা তাদের শাস্তির প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا يُجَٰدِلُ فِيٓ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَلَا يَغۡرُرۡكَ تَقَلُّبُهُمۡ فِي ٱلۡبِلَٰدِ﴾[غافر:04]
অর্থ, কাফিররাই কেবল আল্লাহর আয়াতসমূহ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়। সুতরাং দেশে দেশে তাদের অবাধ বিচরণ যেন তোমাকে ধোঁকায় না ফেলে। [সূরা গাফের: ০৪]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন
আর তাদের কেউ তোমার প্রতি কান পেতে শোনে, কিন্তু আমি তাদের অন্তরের উপর রেখে দিয়েছি আবরণ যেন তারা অনুধাবন না করে, আর তাদের কানে রেখেছি ছিপি। আর যদি তারা প্রতিটি আয়াতও দেখে, তারা তার প্রতি ঈমান আনবে না; এমনকি যখন তারা তোমার কাছে এসে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়, যারা কুফরী করেছে তারা বলে, ‘এটা পূর্ববর্তীদের কল্পকাহিনী ছাড়া কিছুই নয়।’ [সূরা আনআম: ২৫]
অর্থাৎ, তুমি পূর্বেকার লোকদের থেকে গ্রহণ করছ এবং তাদের কিতাবসমূহ ও তাদের মুখ থেকে শুনে শুনে শিখছ। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَقَالُوٓاْ ءَأَٰلِهَتُنَا خَيۡرٌ أَمۡ هُوَۚ مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلَۢاۚ بَلۡ هُمۡ قَوۡمٌ خَصِمُونَ﴾[الزخرف:57]
অর্থ, আর তারা বলে, আমাদের উপাস্যরা শ্রেষ্ঠ নাকি ঈসা? তারা কেবল কুটতর্কের খাতিরেই তাকে তোমার সামনে পেশ করে। বরং এরাই এক ঝগড়াটে সম্প্রদায়। [সুরা যুখরফ: ৫৭]
বাতিলের উপর তারা ঝগড়া করে এবং তারা ছিল অধিক ঝগড়াটে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবনে যুবারি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করে তুমি কি ধারণা কর যে, আল্লাহ তা‘আলা তোমার উপর এ আয়াত-
 ﴿إِنَّكُمۡ وَمَا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ حَصَبُ جَهَنَّمَ أَنتُمۡ لَهَا وَٰرِدُونَ ٩٨ لَوۡ كَانَ هَٰٓؤُلَآءِ ءَالِهَةٗ مَّا وَرَدُوهَاۖ وَكُلّٞ فِيهَا خَٰلِدُونَ ﴾[الأنبياء: ٩٨ [
র্অথ, নিশ্চয় তোমরা এবং আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের পূজা কর, সেগুলো তো জাহান্নামের জ্বালানী। তোমরা সেখানে প্রবেশ করবে। [সুরা আম্বিয়া: ৯৮]
নাযিল করেন, ইবনে যুবারি বলেন, আমরা সূর্য্, চন্দ্র, ফেরেস্তা উযাইর ও ঈসা ইবনে মারয়ামের ইবাদত করি। তাহলে তাদের সবাই কি আমাদের ইলাহগুলোর সাথে জাহান্নামে যাবে? তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন-
﴿وَلَمَّا ضُرِبَ ٱبۡنُ مَرۡيَمَ مَثَلًا إِذَا قَوۡمُكَ مِنۡهُ يَصِدُّونَ ٥٧ وَقَالُوٓاْ ءَأَٰلِهَتُنَا خَيۡرٌ أَمۡ هُوَۚ مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلَۢاۚ بَلۡ هُمۡ قَوۡمٌ خَصِمُونَ ٥٨﴾ [الزخرف: ٥٧]
অর্থ, আর তারা বলে, আমাদের উপাস্যরা শ্রেষ্ঠ নাকি ঈসা? তারা কেবল কুটতর্কের খাতিরেই তাকে তোমার সামনে পেশ করে। বরং এরাই এক ঝগড়াটে সম্প্রদায়। [সূরা যুখরুফ: ৫৭]
তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন,
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ سَبَقَتۡ لَهُم مِّنَّا ٱلۡحُسۡنَىٰٓ أُوْلَٰٓئِكَ عَنۡهَا مُبۡعَدُونَ ﴾[ الأنبياء: ١٠١]
র্অথ, নিশ্চয় আমার পক্ষ থেকে যাদের জন্য পূর্বেই কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে তাদেরকে তা থেকে দূরে রাখা হবে। [সূরা আম্বিয়া: ১০১]
উযাইর আ. ও ঈসা ইবনে মারয়াম জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত থাকবে আর অন্যান্য বাতিল ইলাহগুলো জাহান্নামে যাবে। এমনকি চন্দ্র, সূর্য ও মূর্তিগুলোকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, যাতে তাদের যারা পূজা করত তাদের কষ্ট দেয়া হয় ও তাদের শাস্তির মাত্রা বৃদ্ধি করা হয়। তাদের বলা হবে, এ সব ইলাহগুলোর তোমরা ইবাদত করতে। এখন তারা তোমাদের জাহান্নামের কারণ হল। তাদের কারণে তোমরা জাহান্নামের খড়ি। সুতরাং, তোমরা জাহান্নামের আযাবের স্বাদ গ্রহণ করতে থাক।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে মুশরিকদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীদের একাধিক বিতর্ক হয়েছে। কাফেররা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীদের সাথে অন্যায়ভাবে ঝগড়া-বিবাদ করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَأۡكُلُواْ مِمَّا لَمۡ يُذۡكَرِ ٱسۡمُ ٱللَّهِ عَلَيۡهِ وَإِنَّهُۥ لَفِسۡقٞۗ وَإِنَّ ٱلشَّيَٰطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰٓ أَوۡلِيَآئِهِمۡ لِيُجَٰدِلُوكُمۡۖ وَإِنۡ أَطَعۡتُمُوهُمۡ إِنَّكُمۡ لَمُشۡرِكُونَ ﴾ [الأنعام:121]
অর্থ, আর তোমরা তা থেকে আহার করো না, যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি এবং নিশ্চয় তা সীমালঙ্ঘন এবং শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্ররোচনা দেয়, যাতে তারা তোমাদের সাথে বিবাদ করে। আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তবে নিশ্চয় তোমরা মুশরিক। [সূরা আনআম, আয়াত: ১২১]
 শরিয়তের বিধান যা হক ও সত্য তা প্রতিহত করার জন্য শয়তান কাফেরদের যুক্তি দেয়, ফলে তারা মুসলিমদের বলে, তোমরা তোমাদের নিজ হাতে যা জবেহ কর, তা তোমরা বক্ষণ কর, অথচ যে গুলোকে আল্লাহ তা‘আলা নিজে হত্যা করে তা তোমরা খাও না?! দেখুন! জাহিলদের যুক্তি কতইনা অবান্তর! আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথা প্রত্যাখ্যান করেন এবং মুসলিমদের সম্বোধন করে বলেন,
﴿وَلَا تَأۡكُلُواْ مِمَّا لَمۡ يُذۡكَرِ ٱسۡمُ ٱللَّهِ عَلَيۡهِ وَإِنَّهُۥ لَفِسۡقٞۗ وَإِنَّ ٱلشَّيَٰطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰٓ أَوۡلِيَآئِهِمۡ لِيُجَٰدِلُوكُمۡۖ وَإِنۡ أَطَعۡتُمُوهُمۡ إِنَّكُمۡ لَمُشۡرِكُونَ﴾[الأنعام:121]
আর তোমরা তা থেকে আহার করো না, যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি এবং নিশ্চয় তা সীমালঙ্ঘন এবং শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্ররোচনা দেয়, যাতে তারা তোমাদের সাথে বিবাদ করে। আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তবে নিশ্চয় তোমরা মুশরিক। [সূরা আনআম, আয়াত: ১২১]
সবই আল্লাহ তা‘আলার ফায়সালা হয়ে থাকে। আল্লাহর ফায়সালা ছাড়া কোন কিছুই হয়নি। যাকে মানুষ জবেহ করে তা যেমন আল্লাহর ফায়সালা অনুযায়ী হয়ে থাকে অনুরূপভাবে যে জন্তুটি নিজে নিজে মারা যায় তাও আল্লাহর ফায়সালায় হয়ে থাকে। তবে যে জন্তু আল্লাহর নাম নিয়ে মানুষ জবেহ করে তার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা হালালের ফায়সালা দেন, আর যে জন্তুটি নিজে নিজে মারা যায় তাকে আল্লাহ তা‘আলা হারামের ফায়সালা দেন।
তাদের এ বিতর্ক সম্পর্কে আরো দেখুন হাদিসের মাধ্যমে।
عن عبد الله بن عباس قال: «أتى أناس النبي صلى الله عليه وسلم فقالوا: يا رسول الله، أنأكل ما نقتل، ولا نأكل ما يقتل الله؟
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, কিছু লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরাবারে এসে জিজ্ঞাসা করে বলে হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যা হত্যা করি তা আমরা খাব আল্লাহ তা‘আলা যা হত্যা করে আমরা তা খাব না? তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত

﴿ فَكُلُواْ مِمَّا ذُكِرَ ٱسۡمُ ٱللَّهِ عَلَيۡهِ إِن كُنتُم بِ‍َٔايَٰتِهِۦ مُؤۡمِنِينَ
থেকে নিয়ে
وَإِنۡ أَطَعۡتُمُوهُمۡ إِنَّكُمۡ لَمُشۡرِكُونَ﴾
পর্যন্ত নাযিল করেন।[13]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজে গিয়ে যা দেখেন, তা নিয়ে মুশরিকরা বিতর্ক করলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিতর্কের বর্ণনা দিয়ে বলেন,
﴿مَا كَذَبَ ٱلۡفُؤَادُ مَا رَأَىٰٓ ١١ أَفَتُمَٰرُونَهُۥ عَلَىٰ مَا يَرَىٰ﴾ [النجم : 11-12]
অর্থ, সে যা দেখেছে, অন্তঃকরণ সে সম্পর্কে মিথ্যা বলেনি। সে যা দেখেছে, সে সম্পর্কে তোমরা কি তার সাথে বিতর্ক করবে? [সূরা নাজম ১১-১২]
অর্থাৎ, হে মুশরিকগণ আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সব নিদর্শন দেখিয়েছেন তা তোমরা অস্বীকার করছ! এবং সন্দেহ পোষণ করছ! আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِن جَٰدَلُوكَ فَقُلِ ٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِمَا تَعۡمَلُونَ ٦٨ ٱللَّهُ يَحۡكُمُ بَيۡنَكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ فِيمَا كُنتُمۡ فِيهِ تَخۡتَلِفُونَ﴾ [النجم:68-69]
অর্থ, আর তারা যদি তোমার সাথে বাকবিতণ্ডা করে, তাহলে বল, ‘তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।’ তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছ, আল্লাহ সে বিষয়ে কিয়ামতের দিন ফয়সালা করে দেবেন। [সূরা আল-হজ: ৬৮-৬৯] কাফেররা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে অনর্থক বিতর্ক তখন আল্লাহ তা‘আলা তার উপর এ আয়াত নাযিল করে তাদের প্রতিহত করেন। তিনি বলেন, তোমারা যা কর আল্লাহ তা‘আলা সে সম্পর্কে জানেন। অর্থাৎ তোমরা যে কুফরী ও হৎকারিতা করছ, সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অবগত আছেন। তাই তিনি তাদের তোমাদের থেকে বিরত থাকতে ও তোমাদের সাথে বিতর্ক করতে না করেন। কারণ হঠকারী লোকদের সাথে বিতর্ক করে কোন ফায়েদা নাই।
মুশরিকরা কুরআন বিষয়ে অনর্থক বিতর্ক করে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا يُجَٰدِلُ فِيٓ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَلَا يَغۡرُرۡكَ تَقَلُّبُهُمۡ فِي ٱلۡبِلَٰدِ ﴾[غافر:04]
কাফিররাই কেবল আল্লাহর আয়াতসমূহ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়। সুতরাং দেশে দেশে তাদের অবাধ বিচরণ যেন তোমাকে ধোকায় না ফেলে। [গাফের ০৪]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَا تُجَادلِوُا فِي القُرْآنِ؛ فَإنّ جِدَالا فيِهِ كُفْرٌ»
অর্থ, তোমরা কুরআন বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদ করো না। কারণ, কুরআন বিষয়ে বিবাদ করা কুফরি।
দুর্বল-ঈমান সম্পন্ন লোকদের বিতর্ক:
অনুরূপভাবে দুর্বল ঈমানদারদের পক্ষ হতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর্কের সম্মূখীন হন।
 আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿كَمَآ أَخۡرَجَكَ رَبُّكَ مِنۢ بَيۡتِكَ بِٱلۡحَقِّ وَإِنَّ فَرِيقٗا مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ لَكَٰرِهُونَ ٥ يُجَٰدِلُونَكَ فِي ٱلۡحَقِّ بَعۡدَ مَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى ٱلۡمَوۡتِ وَهُمۡ يَنظُرُونَ﴾ [الأنفال:5-6]
অর্থ, (এটা এমন) যেভাবে তোমার রব তোমাকে নিজ ঘর থেকে বের করেছেন যথাযথভাবে এবং নিশ্চয় মুমিনদের একটি দল তা অপছন্দ করছিল। তারা তোমার সাথে সত্য সম্পর্কে বিতর্ক করছে তা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর। যেন তাদেরকে মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হচ্ছে, আর তারা তা দেখছে। [সূরা আনফাল: ৫-৬] অর্থাৎ, তারা যখন বুঝতে পারল যুদ্ধ ও লড়াই নিশ্চিত। তখন তারা তা অপছন্দ করল এবং বলল, আপনি যুদ্ধের কথা কেন আমাদের আগে জানায়নি? যাতে আমরা যুদ্ধের জন্য তৈরি ও প্রস্তুত হতাম? আমরাতো বের হয়েছি বাণিজ্যিক কাফেলার জন্য আমরা সৈন্য দলের উদ্দেশ্যে বের হই নাই। এ ছিল তাদের বিবাদ।
কাফেররা নবীদের সাথে তাদের উপস্থিতিতেও বিবাদ ও বিতর্ক করত। যেমন- হুদ আ. তার কওমের লোকেরা তার সাথে বিতর্ক করে এবং মূর্তি বিষয়ে তার সাথে ঝগড়া করে। আল্লাহ তা‘আলা হুদ আ. এর জবানে বলেন,
﴿قَالَ قَدۡ وَقَعَ عَلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ رِجۡسٞ وَغَضَبٌۖ أَتُجَٰدِلُونَنِي فِيٓ أَسۡمَآءٖ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّا نَزَّلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٖۚ فَٱنتَظِرُوٓاْ إِنِّي مَعَكُم مِّنَ ٱلۡمُنتَظِرِينَ﴾[الأعراف:71]
সে বলল, নিশ্চয় তোমাদের উপর তোমাদের রবের পক্ষ থেকে আযাব এ ক্রোধ পতিত হয়েছে। তোমরা কি এমন নাম সমূহ সম্পর্কে আমাদের সাথে বিবাদ করছ, যার নাম করণ করছ তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরা যার ব্যাপারে আল্লাহ কোন প্রমাণ নাযিল করেননি? সুতরাং তোমরা অপেক্ষা কর। আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি [সূরা আরাফ: ৭১] অর্থাৎ, কতক মূর্তি নিয়ে তোমরা বিতর্ক করছ, যেগুলোর নাম করন তোমরা ও তোমাদের পূর্ব পুরুষরাই করছে। তারা কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না।?!
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلَّذِينَ يُجَٰدِلُونَ فِيٓ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ بِغَيۡرِ سُلۡطَٰنٍ أَتَىٰهُمۡۖ كَبُرَ مَقۡتًا عِندَ ٱللَّهِ وَعِندَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْۚ كَذَٰلِكَ يَطۡبَعُ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ قَلۡبِ مُتَكَبِّرٖ جَبَّارٖ ﴾[غافر:35]
অর্থ, যারা নিজদের কাছে আগত কোন দলীল-প্রমাণ ছাড়া আল্লাহর নিদর্শনা-বলী সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়। তাদের এ কাজ আল্লাহ ও মুমিনদের দৃষ্টিতে অতিশয় ঘৃণার্হ। এভাবেই আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী স্বৈরাচারীর অন্তরে সীল মেরে দেন। [সূরা গাফের: ৩৫] কে এ কথাটি বলছিল? আল্লাহ তা‘আলা কার কথার বর্ণনা দেন? এ কথাটি বলছিল, ফেরআউনের গোত্রের একজন ঈমানদার যখন সে মুসা আ. কে ছড়াতে উদ্ধত হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿ّإِنَ ٱلَّذِينَ يُجَٰدِلُونَ فِيٓ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ بِغَيۡرِ سُلۡطَٰنٍ أَتَىٰهُمۡ إِن فِي صُدُورِهِمۡ إِلَّا كِبۡرٞ مَّا هُم بِبَٰلِغِيهِۚ فَٱسۡتَعِذۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ﴾ [غافر:56]
অর্থ, নিশ্চয় যারা তাদের নিকট আসা কোন দলীলÑ প্রমাণ ছাড়াই আল্লাহর নিদর্শনাবলী সম্পর্কে বিতর্ক করে, তাদের অন্তরসমূহে আছে কেবল অহংকার, তারা কিছুতেই সেখানে (সাফল্যের মনজিলে) পৌঁছবে না। কাজেই তুমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। [গাফের: ৫৬]
 অহংকার, দম্ভ ও ঝগড়া-বিবাদের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান। দেখুন কীভাবে অহংকার মানুষকে অন্যায়ভাবে ঝগড়া-বিবাদের দিকে ধাবিত করে এবং সত্যকে প্রতিহত ও বাতিলকে প্রতিষ্ঠিত করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ يُجَٰدِلُونَ فِيٓ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ أَنَّىٰ يُصۡرَفُونَ ﴾[غافر:69]
অর্থ, তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করনি যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী সম্পর্কে বাকবিতণ্ডা করে? তাদেরকে কোথায় ফিরানো হচ্ছে? [সূরা গাফের: ৬৯]
নিন্দনীয় বিতর্কের প্রকার:
নিন্দনীয় বিতর্ক ও দুই প্রকার:
এক. জ্ঞানহীন ঝগড়া বিবাদ। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يُجَٰدِلُ فِي ٱللَّهِ بِغَيۡرِ عِلۡمٖ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيۡطَٰنٖ مَّرِيدٖ ﴾[الحج:3]
অর্থ, মানুষের মধ্যে কতক আল্লাহ সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক করে না জেনে এবং সে অনুসরণ করে প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের। [আল- হজ: ৩]
আল্লাহ তা‘আলা আহলে কিতাবদের সম্বোধন করে বলেন,
﴿هَٰٓأَنتُمۡ هَٰٓؤُلَآءِ حَٰجَجۡتُمۡ فِيمَا لَكُم بِهِۦ عِلۡمٞ فَلِمَ تُحَآجُّونَ فِيمَا لَيۡسَ لَكُم بِهِۦ عِلۡمٞۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ﴾[آل عمران:66]
 সাবধান! তোমরা তো সেসব লোক, বিতর্ক করলে এমন বিষয়ে, যার জ্ঞান তোমাদের রয়েছে। তবে কেন তোমরা বিতর্ক করছ সে বিষয়ে যার জ্ঞান তোমাদের নেই? আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। [সূরা আলে-ইমরান: ৬৬]
 আল্লাহ তা‘আয়ালার বিষয়ে বিতর্ক করা জ্ঞানহীন বিতর্কের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَيُسَبِّحُ ٱلرَّعۡدُ بِحَمۡدِهِۦ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ مِنۡ خِيفَتِهِۦ وَيُرۡسِلُ ٱلصَّوَٰعِقَ فَيُصِيبُ بِهَا مَن يَشَآءُ وَهُمۡ يُجَٰدِلُونَ فِي ٱللَّهِ وَهُوَ شَدِيدُ ٱلۡمِحَالِ﴾ [الرعد:13]
 আর বজ্র তার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করে এবং ফেরেশতারাও তার ভয়ে। আর তিনি গর্জনকারী বজ্র পাঠান। অতঃপর যাকে ইচ্ছা তা দ্বারা আঘাত করেন এবং তারা আল্লাহর সম্বন্ধে ঝগড়া করতে থাকে। আর তিনি শক্তিতে প্রবল, শাস্তিতে কঠোর। [সূরা রায়াদ: ১৩]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يُجَٰدِلُ فِي ٱللَّهِ بِغَيۡرِ عِلۡمٖ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيۡطَٰنٖ مَّرِيدٖ ٣ كُتِبَ عَلَيۡهِ أَنَّهُۥ مَن تَوَلَّاهُ فَأَنَّهُۥ يُضِلُّهُۥ وَيَهۡدِيهِ إِلَىٰ عَذَابِ ٱلسَّعِيرِ ﴾[حج:3-4]
অর্থ, মানুষের মধ্যে কতক আল্লাহ সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক করে না জেনে এবং সে অনুসরণ করে প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের। তার সম্পর্কে নির্ধারণ করা হয়েছে যে, যে তার সাথে বন্ধুত্ব করবে সে অবশ্যই তাকে পথভ্রষ্ট করবে এবং তাকে প্রজ্বলিত আগুনের শাস্তির দিকে পরিচালিত করবে। [হজ ৩-৪] তাদের বিতর্ক; তারা আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা করে যে, আল্লাহ তা‘আলা মৃতকে জীবিত করতে পারে না। তাই একজন কাফের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট পুরনো একটি হাড় নিয়ে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বলত, তুমি কি মনে কর যে, তোমার রব এ চূর্ণ -বিচূর্ণ হাড় কে জীবিত করতে পারবে? এভাবেই তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তর্ক করত এবং আখেরাতের জীবনকে অস্বীকার করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يُجَٰدِلُ فِي ٱللَّهِ بِغَيۡرِ عِلۡمٖ وَلَا هُدٗى وَلَا كِتَٰبٖ مُّنِيرٖ ٨ ثَانِيَ عِطۡفِهِۦ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۖ لَهُۥ فِي ٱلدُّنۡيَا خِزۡيٞۖ وَنُذِيقُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ عَذَابَ ٱلۡحَرِيقِ ﴾[الحج:8-9]
অর্থ, আর মানুষের মধ্যে কতক আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে কোন জ্ঞান ছাড়া, কোন হিদায়েত ছাড়া এবং দীপ্তিমান কিতাব ছাড়া। সে বিতর্ক করে ঘাড় বাঁকিয়ে, মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে তার জন্য রয়েছে দুনিয়াতে লাঞ্ছনা এবং কিয়ামতের দিন আমি তাকে দহন যন্ত্রণা আস্বাদন করাব। [আল-হজ্জ: ৮-৯] অর্থাৎ অহংকারী এবং চায় মানুষকে আল্লাহর রাস্তা হতে বিরত রাখতে।
এ ছাড়াও তারা কিয়ামত বিষয়ে বিতর্ক করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَسۡتَعۡجِلُ بِهَا ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِهَاۖ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مُشۡفِقُونَ مِنۡهَا وَيَعۡلَمُونَ أَنَّهَا ٱلۡحَقُّۗ أَلَآ إِنَّ ٱلَّذِينَ يُمَارُونَ فِي ٱلسَّاعَةِ لَفِي ضَلَٰلِۢ بَعِيدٍ﴾ [الشورى: 18]
অর্থ, যারা এতে ঈমান আনে না, তারাই তা ত্বরান্বিত করতে চায়। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা একে ভয় করে এবং তারা জানে যে, এটা অবশ্যই সত্য। জেনে রেখ, নিশ্চয় যারা কিয়ামত সম্পর্কে বাকÑবিতণ্ডা করে তারা সুদূর পথভ্রষ্টটায় নিপতিত। [সূরা সুরা: ১৮] অথচ, কিয়ামতের বিষয়টি ইলমে গাইবের অন্তর্ভুক্ত, যা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।
জ্ঞানহীন তর্কে অন্তর্ভুক্ত হল, কদর সম্পর্কে বিতর্ক করা।
অর্থ, আমর ইবনে শুয়াইব রা. বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন তার সাহাবীরা কদর সম্পর্কে বিতর্ক করছে। এ দেখে রাগে এ ক্ষোভে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারা মলিন হয়ে গেল। তখন তিনি তাদের বললেন, তোমাদের এর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে? অথবা তোমাদের এ জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে? তোমরা কুরআনের এক অংশ দ্বারা অপর অংশকে আঘাত করছ! এ কারণেই তোমাদের পূর্বের উম্মতরা ধ্বংস হয়েছে। তারপর আব্দুল্লাহ ইবনে আমর বলেন, আমি আর কোন মজলিশে অনুপস্থিত থাকতে এত পছন্দ করিনি সেদিন ঐ মজলিশে অনুপস্থিত থাকাকে যতটুকু পছন্দ করি।
 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক ক্ষুব্ধ হন, কারণ ক্বদর হল আল্লাহ তা‘আলার গোপনীয় বিষয় সমূহের একটি। যে ব্যক্তি না জেনে তাতে মশগুল হয়, তার পরিণতি হবে গোমরাহী। হয় সে ক্বদরী হবে অথবা জবরী হবে। এ কারণে তিনি তাতে লিপ্ত হতে নিষেধ করেন।
ক্বদর সম্পর্কে বিতর্ক ঈমানের নড়বড়টা ও সন্দেহ, সংশয়ের দিকে নিয়ে যায়। ক্বদর বিষয়ে ঈমানের মধ্যে ঘটায় ও সন্দেহ সংশয়কে উসকিয়ে দেয়, তাই এ বিষয়ে বিতর্ক করা নিন্দনীয় বিতর্ক। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَا يَزَالُ أَمْرُ هَذِهِ الأمةِ مُوَائِماً أَوْ مُقَارِباً مَا لَمْ يَتَكَلَّمُوا فِي الوِلْدَانِ وِالقَدَرِ»
অর্থ, এ উম্মতের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ততদিন পর্যন্ত ঠিক বা সত্যের কাছাকাছি থাকবে যতদিন পর্যন্ত তারা কদর ও মুশরিকদের সন্তানদের নিয়ে কোন বিতর্ক করবে না।
নিন্দনীয় বিতর্কের দ্বিতীয় প্রকার:
নিন্দনীয় বিতর্কের দ্বিতীয় প্রকার হল, বাতিলকে বিজয়ী করা ও হক স্পষ্ট হওয়ার পরও তা অস্বীকার করার বিতর্ক। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿كَذَّبَتۡ قَبۡلَهُمۡ قَوۡمُ نُوحٖ وَٱلۡأَحۡزَابُ مِنۢ بَعۡدِهِمۡۖ وَهَمَّتۡ كُلُّ أُمَّةِۢ بِرَسُولِهِمۡ لِيَأۡخُذُوهُۖ وَجَٰدَلُواْ بِٱلۡبَٰطِلِ لِيُدۡحِضُواْ بِهِ ٱلۡحَقَّ فَأَخَذۡتُهُمۡۖ فَكَيۡفَ كَانَ عِقَابِ﴾ [غافر: 5]
অর্থ, এদের পূর্বে নূহের কওম এবং তাদের পরে অনেক দলও অস্বীকার করেছিল। প্রত্যেক উম্মতই স্ব স্ব রাসূলকে পাকড়াও করার সংকল্প করেছিল এবং সত্যকে বিদূরিত করার উদ্দেশ্যে তারা অসার বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল। ফলে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম। সুতরাং কেমন ছিল আমার আযাব! [গাফের:৫]
এ বিতর্কের পরিণতি খুবই খারাপ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের এ থেকে রক্ষা করুন। আমীন!
প্রশংসনীয় বিতর্ক: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের এর প্রতি আহ্বান করেন, বরং এটি একটি জিহাদ।
আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«جَاهِدُوا المُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسُكمْ وَأَلْسِنتَكْم»
মৌখিক জিহাদ কীভাবে করবো?
উত্তম কথা দ্বারা বিতর্ক করার মাধ্যমে। আল্লামা ইবনে হাযম বলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা যেমন ওয়াজিব অনুরূপভাবে মুনাযারা করাও ওয়াজিব। আল্লামা সুনআনি বলেন, জীবন দিয়ে জিহাদ হল, কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সশরীরে অংশগ্রহণ করা। মাল দ্বারা জিহাদ হল, জিহাদের খরচ ও অস্র ক্রয়ের জন্য ব্যয় করা। আর মৌখিক জিহাদ হল, তাদের বিরুদ্ধে দলীল পেশ করা ও তাদের আল্লাহর দিকে আহ্বান করা।
 এ ধরনের মুনাযারা কখনো ওয়াজিব হয়, আবার কখনো মোস্তাহাব হয়।
আর নিন্দনীয় বিতর্ক সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। কারণ, তা হল, হককে প্রত্যাখ্যান করা অথবা বাতিলকে বিজয়ী করা।
কখনো কখনো বিতর্ক প্রশংসনীয় হয়, ঠিক একই স্থানে তা আবার নিন্দনীয়ও হয়ে থাকে। যেমন হজ: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلۡحَجُّ أَشۡهُرٞ مَّعۡلُومَٰتٞۚ فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ ٱلۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي ٱلۡحَجِّۗ وَمَا تَفۡعَلُواْ مِنۡ خَيۡرٖ يَعۡلَمۡهُ ٱللَّهُۗ وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيۡرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقۡوَىٰۖ وَٱتَّقُونِ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ﴾ [البقرة:197]
অর্থ, হজের সময় নির্দিষ্ট মাসসমূহ। অতএব এই মাসসমূহে যে নিজের উপর হজ আরোপ করে নিলো, তার জন্য হজে অশি¬ল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। আর তোমরা ভাল কাজের যা কর, আল্লাহ তা জানেন এবং পাথেয় গ্রহণ কর। নিশ্চয় উত্তম পাথেয় তাকওয়া। আর হে বিবেক সম্পন্নগণ, তোমরা আমাকে ভয় কর। [সূরা বাকারাহ: ১৯৭]
হজে যে বিতর্ক করতে নিষেধ করা হয়েছে তা কি?
 যে বিতর্ক পরস্পরের মধ্যে বিরোধ, বিদ্বেষ ও দুশমনি সৃষ্টি করে, না জেনে বিতর্ক করা, যে বিতর্ক লক্ষ্য, প্রতিপক্ষের উপর প্রাধান্য বিস্তার করা, বিতর্কে কে ভালো করতে পারে থাকে, কে তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ও চুপ করে দিতে পারে, তা দেখা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে; আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য না থাকে।
কখনো হজের বিধান নিয়ে না জেনে বিতর্ক করে থাকে, তাও নিন্দনীয়।
কিন্তু হক্ব, সঠিক ও সুন্নাতকে জানার জন্য বিতর্ক করা, উত্তম বিতর্ক। যেমন, হজ্জে তামাত্তু উত্তম না ইফরাদ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারেন ছিলেন নাকি তামাত্তু পালন করেন এ ধরনের বিতর্ক যদ্ধারা সত্য উদঘাটন হয়, তা উত্তম। অনুরুপভাবে সাওমের বিধান বিষয়ে বিতর্ক করা তার বিধান নিয়ে আলোচনা করা।
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الصِّيَامُ جُنَّةٌ، فَلَا يَرْفُثُ وَلَا يَجْهَلُ، وَإِنِ امْرُؤٌ قَاتَلَهُ أَوْ شَاتَمَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي صَائِمٌ – مَرَّتَيْنِ وفي رواية سهيل بن أبي صالح عن أبيه فَلَا يَرْفُثُ وَلَا يُجَادِلُ»
অর্থ, সাওম হল, ডাল স্বরূপ রোজা অবস্থা কেউ যেন অশ্লিল কোন কাজ না করে এবং অজ্ঞতার পরিচয় না দেয়। যদি কোন লোক তোমার সাথে ঝগড়া করে বা তোমাকে গালি দেয়, তখন তাকে বলে, দিবে যে আমি রোজাদার। এ কথা দুইবার বলবে।[14] আর সুহাইল ইবনে আবি সালেহের বর্ণনায় বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে যেন অশ্লিল কোন কাজ না করে এবং ঝগড়া না করে।[15]
এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে মুসলিমদের জন্য উচিত হল, তারা হক্বের পক্ষে হলেও বর্তমানে বিতর্ক পরিহার করবে। কারণ, বিতর্ক ঝগড়া ও বিবাদ মানুষের অন্তকে কঠিন করে দুই মুসলিম ভাইয়ের মাঝে হিংসা বিদ্বেষ ও রেষারেষি বৃদ্ধি করে। বিতর্কে হককে প্রত্যাখ্যান করা ও বাতিলকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَنَا زَعِيمٌ بِبَيْتٍ فِي رَبَضِ الجَنةَِّ لِمَنْ تَرَكَ المِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقّاً»
অর্থ, যে ব্যক্তি বিতর্ককে পরিহার করে যদিও সে হকের পক্ষে হয়, আমি তার জন্য জান্নাতের পার্শ্বের একটি প্রাসাদের দায়িত্বশীল।[16] আয়েশা রা. হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ أَبْغَضَ الرِّجَالِ إلِى الله الأَلَدُّ الخَصِمُ»
অর্থ, আল্লাহ তায়ালার নিকট সর্বাধিক নিকৃষ্ট সে ব্যক্তি যে অধিক ঝগড়া বিবাদ করে।[17]
এখানে যে ঝগড়া বিবাদ ও বিতর্ক পরিহার করার কথা বলা হয়েছে, তা হল, হক পন্থীদের সাথে বিবাদ করা কিন্তু যারা আহলে বাতিল ও বিদআতি তাদের সাথে তর্ক বিতর্ক করাই হল, জরুরি যাতে তারা হেদায়েত প্রাপ্ত হয় অথবা তাদের বাতিলের মূলোৎপাটন হয়।
প্রশংসনীয় বিতর্কের উদাহরণ
বাতিল পন্থীদের সাথে নবী -রাসূল ও সালফে সালেহীনদের বিতর্কের পদ্ধতির উপর কয়েটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হল:
১. ইব্রাহীম আ. নমরুদের সাথে তার বাতিলকে প্রতিহত করতে বিতর্ক করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অর্থ, তুমি কি সে ব্যক্তিকে দেখনি, যে ইবরাহীমের সাথে তার রবের ব্যাপারে বিতর্ক করেছে যে, আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছেন? যখন ইবরাহীম বলল, ‘আমার রব তিনিই’ যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমিই জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহীম বলল, নিশ্চয় আল্লাহ পূর্বদিক থেকে সূর্য আনেন। অতএব তুমি তা পশ্চিম দিক থেকে আন। ফলে কাফির ব্যক্তি হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়েত দেন না। [সূরা বাকারাহ: ২৫৮]
 এ বিতর্ক ছিল তাওহীদের রুবুবিয়্যাহ বিষয়ে তাই কাফেরটি বলে [আমি জীবিত করি ও মৃত্যু দিই] অর্থাৎ এক লোক মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আমি তাকে ক্ষমা করে দিই আবার অপরজন নির্দোষ আমি তাকে হত্যা করি। এ বিতর্ক ছিল অবান্তর। কারণ, তাওহীদের রুবুবিয়্যাতে হায়াত দ্বারা উদ্দেশ্য অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্বে আনা। যদি তুমি তোমার দাবীতে সত্য হও তবে অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্বে নিয়ে আস! কিন্তু ইব্রাহিম আ. যখন দেখতে পেলেন, বিষয়টিতে নমরুদের বিতর্ক করার অবকাশ রয়েছে, তাই তিনি বিষয়টি এমন একদিক ঘুরিয়ে দিলেন, যেখানে নমরুদ বিতর্ক করতে পারবে না। তারপর তিনি বলেন,
﴿فَإِنَّ ٱللَّهَ يَأۡتِي بِٱلشَّمۡسِ مِنَ ٱلۡمَشۡرِقِ فَأۡتِ بِهَا مِنَ ٱلۡمَغۡرِبِ فَبُهِتَ ٱلَّذِي كَفَرَۗ﴾
অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ পূর্বদিক থেকে সূর্য আনেন। অতএব তুমি তা পশ্চিম দিক থেকে আন। ফলে কাফির ব্যক্তি হতভম্ব হয়ে গেল।
২. অনুরূপভাবে দুই বাগানের মালিক ও একজন নেক-কার লোকের বিতর্ক। লোকটি তাকে কিভাবে উত্তর দেন? তার নিকট যে নেয়ামত রয়েছে তা দ্ধারা ধোঁকায় না পড়ে তার পরিবর্তে তার কর্তব্য বিষয়ে কিভাবে তাকে পথ দেখান। তারপর সে আল্লাহর থেকে তার প্রত্যাশা কি তা উল্লেখ করেন,
﴿فَعَسَىٰ رَبِّيٓ أَن يُؤۡتِيَنِ خَيۡرٗا مِّن جَنَّتِكَ وَيُرۡسِلَ عَلَيۡهَا حُسۡبَانٗا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ فَتُصۡبِحَ صَعِيدٗا زَلَقًا ﴾[الكهف:40]
অর্থ, তবে আশা করা যায় যে, ‘আমার রব আমাকে তোমার বাগানের চেয়ে উত্তম (কিছু) দান করবেন এবং তার উপর আসমান থেকে বজ্র পাঠাবেন। ফলে তা অনুর্বর উদ্ভিদশূন্য জমিনে পরিণত হবে’। [সূরা কাহাফ: ৪০] এবং তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, এটি সবই ধ্বংস হবে।
৩. এ ছাড়াও অনেক আহলে ইলম আছেন, যারা নাস্তিক মুরতাদ ও কাফেরদের সাথে বিতর্ক করেন। যেমন, ইমাম আবু হানিফা রহ. দাহরীয়াদের একটি সম্প্রদায়ে সাথে মুনাজারা করেন। তারা বলেন, এ জগতের সৃষ্টি প্রাকৃতিক; জগতের আলাদা কোন স্রষ্টা নাই, সে নিজেই তার স্রষ্টা। প্রতি ছত্রিশ হাজার বছর পর পৃথিবী আপন কক্ষ পথে ফিরে আসে। আদম আ. আবার জন্ম লাভ করে এবং প্রতি জীবন যেগুলো চলে যায় সে গুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে। এভাবে তারা মারা যায় আবার ফিরে আসে।
ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, আচ্ছা বলত, এ ব্যক্তি সম্পর্কে তোমাদের মতামত কি? যে বলে নদীতে মাঝি ছাড়াই নৌকা চলে, কোন লোক ছাড়াই নৌকা নিজে নিজে তার মধ্যে মালামাল উঠায়, আবার নামায়।
তারা বলল, যে এ কথা বলে সে পাগল ছাড়া আর কি হতে পারে?
তিনি বললেন, ছোট্ট একটি নৌকা তার জন্য যদি মাঝি লাগে, পরিচালক লাগে, তাহলে এত বড় জগত তার জন্য কি পরিচালক লাগবে না? তা কীভাবে পরিচালক ছাড়া চলতে পারে?
তার কথা শোনে তারা কেঁদে ফেলল এবং হককে স্বীকার করে নিলো।
আমর ইবনে উবাইদ সে একজন মুতাযেলা যারা বলে কবীরাগুণাহকারী চির জাহান্নামী। সে একদিন বলে, কিয়ামতের দিন আমাকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত করা হলে আল্লাহ বলবে তুমি কেন বললে হত্যাকারী জাহান্নামী? আমি বলব তুমি তা বলছ!
﴿وَمَن يَقۡتُلۡ مُؤۡمِنٗا مُّتَعَمِّدٗا فَجَزَآؤُهُۥ جَهَنَّمُ خَٰلِدٗا فِيهَا وَغَضِبَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ وَلَعَنَهُۥ وَأَعَدَّ لَهُۥ عَذَابًا عَظِيمٗا ﴾[النساء:93]
অর্থ, আর যে ইচ্ছাকৃত কোন মুমিনকে হত্যা করবে, তার প্রতিদান হচ্ছে জাহান্নাম, সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর আল্লাহ তার উপর ক্রুদ্ধ হবেন, তাকে লা‘নত করবেন এবং তার জন্য বিশাল আযাব প্রস্তুত করে রাখবেন। [সূরা নিসা: ৯৩]
তারপর তাকে কুরাইশ ইবনে আনাস বলল, ঘরের মধ্যে তার চেয়ে ছোট আর কেউ নাই; যদি তোমাকে বলে আমি বলছি
﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ وَمَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلَٰلَۢا بَعِيدًا﴾ [النساء:116]
অর্থ, নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরীক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্টটায় পথভ্রষ্ট হল। [নিসা আয়াত: ১১৬]
তুমি কিভাবে জানতে পারলে আমি ক্ষমা করতে চাইবো না? এ কথার পর সে আর কোন উত্তর দিতে পারেনি।
৩ ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. আওন ইবনে আব্দুল্লাহকে খারেজিদের সাথে মুনাযারার জন্য পাঠান। তারা ইমামদের কাফর বলত। সে তাদের বলল, তোমরা ওমর ইবনে খাত্তাবের মতে শাসক চেয়েছিলে, কিন্তু যখন ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ আসল তোমরাই সর্বপ্রথম তার থেকে পলায়ন করলে?!
তারা বলল, সে তার পূর্বসূরিদের বলয় থেকে বের হতে পারেনি! আমরা শর্ত দিয়েছিলাম তার পূর্বের সব ইমাম ও খলিফাদের অভিশাপ করতে হবে। কিন্তু সে তা করেনি।
সে বলল, তোমরা সর্বশেষ করে হামানকে অভিশাপ করছ?
তারা বলল, না আমরা কখনোই হামানকে অভিশাপ করিনি!
সে বলল, ফেরআউনের উজির যে তার নির্দেশে প্রাসাদ নির্মাণ করল তাকে তোমরা ছাড়তে পারলে অথচ তোমরা ওমর ইবনে আব্দুল আজীজকে ছাড়তে পারলে না, যে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং আহলে ক্বিবলার কাউকে চাই সে কোন বিষয়ে ভুল করুক?!
ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ তার কথায় খুব খুশি হন এবং বলেন তাদের নিকট তোমাকে ছাড়া আর কাউকে পাঠাবো না।
তারপর সে তাকে বলে, তুমি হামানের কথা বললে ফিরআউনের কথা বললে না?
সে বলে আমি আশংকা করছিলাম ফিরআউনের কথা বললে সে বলবে আমরা তাকে অভিশাপ করি।
* জাহ্হাক আস-সারী নামে একজন খারেজী আবু হানিফা রহ. এর নিকট এসে বলে তুমি তাওবা কর!
তিনি বললেন, কীসের থেকে তাওবা করব?
সে বলল, তুমি যে বলছ, দুই ব্যক্তির মাঝে বিচারক নির্ধারণ করা বৈধ তা হতে। খারেজীরা কোন হাকীম মানে না তারা বলে, হাকিম একমাত্র আল্লাহ।
আবু হানিফা রহ. বলল, আচ্ছা তুমি কি আমাকে হত্যা করবে নাকি আমার সাথে মুনাযারা করবে?
সে বলল, আমি তোমার সাথে মুনাযারা করব!
বলল, যদি আমরা যে বিষয়ে মুনাযারা করব তাতে যদি আমরা একমত না হতে পারি তাহলে আমার আর তোমার মধ্যে কে ফায়সালা করবে?
সে বলল, যাকে তুমি চাও নির্ধারণ কর।
আবু হানিফা রহ. জাহ্হাক আশ-শারি এক সাথীকে বলল, তুমি বস আমরা যে বিষয়ে বিরোধ করি তাতে তুমি ফায়সালা দিবে।
তারপর সে জাহ্হাককে বলল, তুমি আমার ও তোমার মধ্যে বিচারক হিসেবে তাকে মান?
বলল, হ্যাঁ
আবু হানিফা রহ. বলল, তুমি-তো এখন বিচারক নির্ধারণ করাবে বৈধ বললে। তারপর সে নির্বাক হল এবং চুপ হয়ে গেল। আর কোন উত্তর দিতে পারল না।
ইবনে আসাকের বর্ণনা করেন, একদা রুমের একজন লোককে কাজী আবু বকর আলা-বাকিল্লানীর নিকট পাঠান ইফকের ঘটনা বিষয়ে বিতর্ক করার জন্য। উদ্দেশ্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী আয়েশা রা. কে হেয় করা। সে বলল, আল্লাহ তায়ালা কুরআনের মধ্যে একজন মহিলাকে জেনার অপবাদ থেকে পবিত্র করেন, তার নাম কি?
কাজী উত্তরে বললেন, তার হল, দুইজন মহিলা। তাদের সম্পর্কে লোকেরা অপবাদ দেয় এবং যা বলার বলে। একজন হল আমাদের নবীর স্ত্রী আর অপর জন হল, মারয়াম বিনতে ইমরান। আমাদের নবীর স্ত্রী সন্তান প্রসব করেনি আর মারয়াম আ. একজন সন্তান কাঁধে নিয়ে মানুষের মধ্যে ফিরে আসে। আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যে অপবাদ দেয়, তা থেকে আয়েশা রা. ও মারয়াম আ. উভয়কে পবিত্র করেন। তুমি তাদের দুজনের কার কথা জানতে চাও? এ কথা শোনে লোকটি চুপ হয়ে গেল কোন উত্তর দিতে পারল ন। এর পর তার আর কি বলার আছে?
মোট কথা, বাতিলকে প্রতিহত ও নিরুত্তর করার জন্য এবং বিধর্মী কাফের মুশরিক ও নাসারাদের প্রতিহত করার জন্য বিতর্ক করা মুসলিমদের উপর ওয়াজিব। একজন মুসলিমের সামনে কুফর পেশ করা হবে, আর সে চুপ করে বসে থাকবে, তা কখনোই বৈধ হতে পারে না।
নিন্দনীয় ঝগড়া ও বিতর্কের ক্ষতি
আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের একমাত্র ঐ সব বিষয় থেকে বিরত থাকতে বলেন, যার মধ্যে নগদে বা ভবিষ্যতে কোন না কোন ক্ষতি নিহিত রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের ঝগড়া-বিবাদ থেকে নিষেধ করেছেন। কারণ, ঝগড়া-বিবাদ মানুষের অনেক ক্ষতির কারণ হয় এবং অনিষ্টটা সৃষ্টি করে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি উল্লেখ করা হল:
১. মহা কল্যাণ হতে বঞ্চিত হওয়া।
 আল্লামা আওযায়ী বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি কামনা করেন, তখন তাদের উপর ঝগড়া-বিবাদ চাপিয়ে দেন এবং তাদের কাজের থেকে বিরত রাখেন।
মুয়াবিয়া ইবনে কুরাহ বলেন, তোমরা ঝগড়া-বিবাদ থেকে বেচে থাক! কারণ, তা তোমাদের আমলসমূহকে ধ্বংস করে দেয়।
২. ইলম থেকে বঞ্চিত।
তোমরা জান না যে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বদর রজনীর ইলমকে কেবল মাত্র ঝগড়ার কারণে তুলে নেন।
উবাদাহ ইবনে সামেত রা. হতে বর্ণিত,
فعن عبادة بن الصامت أن رسول الله خرج يخبر بليلة القدر، فتلاحى رجلان من المسلمين فقال: «إنِّي خَرَجْتُ لِأخْبِرَكُمْ بلِيلْةِ القَدْرِ -أي: ليعينها-، وَإِنَّهُ تَلَاحَى فُلَانٌ وَفُلَانٌ فَرُفِعَتْ، وَعَسَى أَنْ يَكُونَ خَيْراً لَكُمْ، الْتَمِسُوهَا فِي السَّبْعِ وَالتِّسْعِ وَالخَمْسِ»
অর্থ, ওবাদাহ ইবনে সামেত রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কদর রজনী সম্পর্কে খবর দিতে আমাদের নিকট বের হন, তারপর দুই মুসলমিনকে দেখেন, তারা দুইজন ঝগড়া করতেছে। আমি তোমাদের নিকট বের হয়েছিলাম তোমাদের কদর রজনী সম্পর্কে সংবাদ দিতে। কিন্তু অমুক অমুক লোক ঝগড়া করতে থাকলে তার ইলম তুলে নেয়া হয়। হতে পারে এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। তোমরা সাতাশ, উনত্রিশ ও পঁচিশ তারিখ রজনীতে কদর রজনীকে তালাশ কর।[18]
ওবাদাহ ইবনে সামেত হতে বর্ণিত, হাদিস দ্বার প্রমাণিত হয়, ঝগড়া বিবাদ করা একটি নিন্দনীয় কাজ; যার কারণে মানুষ শাস্তি ভোগ করতে হয় এবং কল্যাণ হতে বঞ্চিত হয়। দুই লোকের ঝগড়া, বাক বিতণ্ডা ও বিবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিতিতে মসজিদে সংঘটিত হয়। ফলে কদর রাত্রির ইলম থেকে আমরা মাহরুম হই।
ইউনুস হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার নিকট মাইমুন ইবনে মাহরান লিখেন, সাবধান! দ্বীনের বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদ করা হতে বিরত থাকবে। কোন আলেম বা জাহেল কারো সাথে কখনো বিবাদ করবে না।
এক লোক বর্ণনা করে যে, এক ব্যক্তি আলেমদের সাথে বিবাদ করার কারণে ইলেম হাসিল করা হতে বঞ্চিত হয়। শেষ পর্যন্ত সে লজ্জিত হয় এবং বলে, আফসোস যদি আমি তাদের সাথে বিবাদ না করতাম!
৩. উম্মতের ধ্বংস।
فعن أبي هريرةعن النبي صلى الله عليه وسلم قال: «دَعُونِي مَا تَرَكْتكُمْ، إنَمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ سُؤَالهمْ وَاخْتِلَافُهُمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ»
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের পূর্বের উম্মতরা অধিক প্রশ্ন করা ও তাদের নবীদের সাথে বিরোধ করার কারণে ধ্বংস হয়েছে।
ওমর রা. যিয়াদ ইবনে হাদীরকে জিজ্ঞাসা করে বলে, তুমি কি জান কোন জিনিষ ইসলামকে ধ্বংস করে? সে বলল, না। তারপর বলল, ইসলাম ধ্বংস করে আলেমদের পদস্খলন, মুনাফেকদের বিবাদ করা আল্লাহর কিতাব বিষয়ে এবং ভ্রষ্ট ইমামদের ফায়সালা দেয়।
وعن ابن عباس قال : «إنما هلك من كان قبلكم بالمراء والخصومات في الدين»
অর্থ, ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, তোমাদের পূর্বের লোকেরা দ্বীনের ব্যাপারে বিবাদ করার কারণে ধ্বংস হয়েছে।
৪. অন্তরকে কঠিন করে ও শত্রুতা সৃষ্টি করে।
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, ঝগড়া বিবাদ করা মানুষের অন্তরকে কঠিন করে দেয় এবং পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা তৈরি করে।
অনেক মানুষ আছে কেবল মজলিশে বিতর্ক করার কারণে তাদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয়। যার কারণে তারা একে অপরের সাথে কথা বলে না, একজন অপরজনকে দেখতে যায় না। এ কারণে মনীষীরা বিতর্ক করা থেকে সতর্ক করেন। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, তোমার জুলুমের জন্য তুমি ঝগড়াটে হওয়াই যথেষ্ট। আর তোমার গুণার জন্য তুমি বিবাদ কারী হওয়াই যথেষ্ট।
মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হুছাইন বলেন, ঝগড়া দ্বীনকে মিটিয়ে দেয়, মানুষের অন্তরে বিদ্বেষ জন্মায়।
আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান বলেন, বিবাদ প্রাচীন বন্ধুত্বকেও ধ্বংস করে, সুদৃঢ় বন্ধনকে খুলে দেয়, কমপক্ষে তার চড়াও হওয়ার মানসিকতা তৈরি করে যা হল, সম্পর্কচ্ছেদের সবচেয়ে মজবুত উপায়।
ইব্রাহীমে নখয়ী আল্লাহ তায়ালার এ বাণীর তাফসীরে বলেন,
আর ইয়াহূদীরা বলে, ‘আল্লাহর হাত বাঁধা’। তাদের হাতই বেঁধে দেয়া হয়েছে এবং তারা যা বলেছে, তার জন্য তারা লা‘নতগ্রস্ত হয়েছে। বরং তার দু’হাত প্রসারিত। যেভাবে ইচ্ছা তিনি দান করেন এবং তোমার উপর তোমার রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে তা তাদের অনেকের অবাধ্যতা ও কুফরী বাড়িয়েই দিচ্ছে। আর আমি তাদের মধ্যে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত শত্রতা ও ঘৃণা ঢেলে দিয়েছি। যখনই তারা যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত করে, আল্লাহ তা নিভিয়ে দেন। আর তারা জমিনে ফ্যাসাদ করে বেড়ায় এবং আল্লাহ ফাসাদকারীদের ভালবাসেন না। [সূরা মায়দো: ৬৪]
অর্থাৎ, দ্বীনের ব্যাপারে ঝগড়া-বিবাদ করা।
৫. ভালো কাজের তাওফিক থেকে বঞ্চিত।
আল্লাহ তা‘আলা যে মজলিশে বিতর্ক করা হয় এবং তাতে আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য থাকে না, তাদের আল্লাহ তায়ালা ভালো কাজ করার তাওফিক হতে বঞ্চিত করেন।
৬. অন্তর আল্লাহর স্মরণ হতে বিরত থাকে।
যে বিতর্কে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য থাকে না তা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ হতে দূরে সরিয়ে দেয়। এমনকি সালাতেও তার অন্তর আল্লাহর স্মরণ করাকে বাদ দিয়ে বিতর্কের দিকে তার অন্তর সম্পৃক্ত থাকে।
কোনও একজন মনীষী বলেন, দ্বীনকে নষ্ট, মরুয়তকে দুর্বল এবং অন্তরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখার জন্য ঝগড়া বিবাদ থেকে এত বেশি মারাত্মক আমি আর কিছুই দেখিনি।
৭. পদস্খলনের কারণ:
মুসলিম ইবনে ইয়াসের বলেন, তোমরা ঝগড়া-বিবাদ পরিহার কর। কারণ, তা হল আলেমের মূর্খতার মুহূর্ত। শয়তান এ মুহূর্তেই তার পদস্খলন কামনা করে।
৮. সম্মানহানী:
কোন এক আরব বলছিল, যারা মানুষের সাথে বিবাদ করে তাদের সম্মান নষ্ট হয়। যে বেশি ঝগড়া করে সে তা অবশ্যই বুঝতে পারে।
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন,
قَالُوا سَكتَّ وَقَدْ خُوصِمْتَ، قُلْتُ لَهُمْ
إنَِّ الجَوَابَ لبابِ الشَّرِّ مِفْتَاحُ
وَالصَّمْتُ عَنْ جَاهِلٍ أَوْ أَحمَقٍ شَرَفٌ
وَفيِهِ أَيْضاً لصِوْنِ العِرْضِ إصِلَاحُ
أَمَا تَرَى الُأسَد تُخَشى وَْهَي صامِتَةٌ
وَالكلْبُ يخْسَى لَعَمْرِي وَهْوَ نَبَّاحُ
তুমি চুপ থাকলে অথচ তোমার সাথে বিতর্ক করা হচ্ছে! আমি তাদের বললাম উত্তর দেয়া অন্যায়ের দরজার চাবি স্বরুপ। কোন জাহেল বা আহমকের কথার উত্তর দেয়ার চেয়ে চুপ থাকা মর্যদাকর। এছাড়াও তাতে রয়েছে ইজ্জত সংরক্ষনে নিশ্চয়তা। তুমি কি দেখনা বাঘ চুপ থাকে অথচ তাকে সবাই ভয় করে। আর কুকুরকে সবাই ঘৃণা করে অথচ সে সব সময় ঘেউ ঘেউ করতেই থাকে।
 ৮. বিদআতের বিকাশ ও প্রবৃত্তির অনুকরণ।
ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. বলেন, যে ব্যক্তি দ্বীনকে বিতর্কের জন্য লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করে তার নকল করার প্রবণতা বেড়ে যায়। অর্থাৎ এক বিদআত থেকে আরেক বিদআতের দিকে যায়।
হাকাম ইবনে উতাইবা আল কুফীকে জিজ্ঞাসা করা হল, মানুষকে বিদআতে প্রবেশে কিসে বাধ্য করছে? তিনি বললেন, ঝগড়া ও বিবাদ।
সাহাল ইবনে আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করা হল, একজন মানুষ কীভাবে বুঝতে পারবে যে সে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত? তিনি বললেন, যখন সে দশটি গুণ তার নিকট আছে বলে বুঝতে পারবে! সে জামাত ছাড়বে না, এ উম্মতের বিরুদ্ধে তলোয়ার উত্তোলন করবে না, ভাগ্যকে অস্বীকার করবে না, ঈমান বিষয়ে সন্দেহ করবে না, দ্বীনের বিষয়ে বিবাদ করবে না, আহলে কিবলার কোন অপরাধী মারা গেলে তার উপর সালাত আদায় ছাড়বে না। মোজার উপর মাসেহ করা ছাড়বে না, জালেম বা ইনসাফ-গার বাদশাহর পিছনে সালাত আদায় করা ছাড়বে না।
আলেমদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ
এখানে এমন কতক লোক আছে, যারা মাসলা -মাসায়েল বিষয়ে আলেমদের সাথে অনর্থক বিতর্ক করে। তাদের উদ্দেশ্য আলেম ও তালেবে ইলেমদের মজলিশে নিজেদের যোগ্যতা ও ইলম জাহের করা এবং তারা কথা বলা ও বিতর্ক করার যোগ্যতা রাখে প্রকাশ করা। এ ধরনের বিতর্ক ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে অবশ্যই অপরাধ। যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَا تَعَلَّمُوا العِلْمَ لِتُبَاهُوا بِهِ العُلَمَاءَ، وَلَا لِتُمَارُوا بِهِ السُّفَهَاءَ، وَلَا تَخَيَّرُوا بِهِ المَجَالِسَ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَالنَّارَ النَّارَ»
অর্থ, তোমরা আলেমদের সাথে বড়াই করা এবং মূর্খদের সাথে বিতর্ক করার উদ্দেশ্যে ইলম শিক্ষা করো না এবং ইলম দ্বারা মজলিশসমূহকে বিতর্কিত করো না। যে ব্যক্তি ইহা করে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম জাহান্নাম।[19]
অপর এক হাদিসে কা‘ব বিন মালেক রা. হতে বর্ণিত, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
«مَنْ طَلَبَ العِلْمَ لِيُجَارِيَ بهِِ العُلَمَاءَ، أَوْ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ، أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ؛ أَدْخَلَهُ الله النَّارَ»
অর্থ, যে ব্যক্তি আলেমদের সাথে বিতর্ক করা এবং জাহেলদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করা অথবা মানুষকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।[20]
সুতরাং, ঝগড়া করার বা আলেমদের সাথে বিতর্ক করার উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করা হতে বিরত থাকতে হবে।
আবার কিছু লোক আছে তাদের উদ্দেশ্যই হল, আলেম ও তালেবে ইলমদের সাথে বিতর্ক করা। তারা বিভিন্ন মজলিশে গিয়ে বলতে থাকে, আমি অমুক কায়েদা জানি অমুক দলীল জানি ইত্যাদি। এ কারণে তাদের দেখা যায় তাদের মাশায়েখদের প্রশ্ন করলে মাশায়েখরা যখন উত্তর দেয়, তখন বলে, হে শায়খ এ মাসাআলা বিষয়ে অমুক আলেম এ কথা বলছে, অমুক এ কথা বলছে…। সে যখন সব কিছু জানে তাহলে তার প্রশ্ন করার দরকার কি? এতে স্পষ্ট হয় সে তার যোগ্যতা প্রকাশ করার জন্য প্রশ্ন করে থাকে। এ ধরনের লোকেরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে ইলম শিক্ষা করে না। তারা ইলম শিখে তাদের বড়ত্ব, যোগ্যতা ও পাণ্ডিত্য প্রকাশ করার জন্য। এ ছাড়াও তার নাম যাতে আলোচনায় আসে এবং মানুষ বলবে লোকটি হাফেয তার নিকট দলীলের অভাব নাই সে অনেক বড় মুনাযের ইত্যাদি প্রশংসা লাভের জন্যই সে ইলম অর্জন করে।
পরিশিষ্ট:
আমরা যখন চাইবো যে, আমরা অনর্থক বিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদ হতে বিরত থাকবো এবং ঝগড়া-বিবাদের নিজেদের জড়াবো না, তখন আমাদের কর্তব্য হল, আমরা এ দ্বীনকে মজবুত করে ধরবো দ্বীন থেকে বিচ্যুত হবো না। কারণ, যারা দ্বীনকে ছেড়ে দেয়, তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি হল, আল্লাহ তা‘আলা তাদের মধ্যে জাহালত ও ঝগড়া-বিবাদ ও ফিতনা ছড়িয়ে দেয়।
আবু উমামা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا ضلَّ قَوْمٌ بَعْدَ هُدىً كَانُوا عَلَيْهِ إِلَّا أُوتُوا الجَدَلَ ثم تلا النبي هذه الآية ﴿وَقَالُوٓاْ ءَأَٰلِهَتُنَا خَيۡرٌ أَمۡ هُوَۚ مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلَۢاۚ بَلۡ هُمۡ قَوۡمٌ خَصِمُونَ﴾»
অর্থ, মানুষ সঠিক পথের উপর থাকার পর কখনো গোমরাহ হয় নাই কিন্তু যখন তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ দেয়া হল, তখন তারা ধ্বংস হতে আরম্ভ করল। তার এ আয়াত-
﴿وَقَالُوٓاْ ءَأَٰلِهَتُنَا خَيۡرٌ أَمۡ هُوَۚ مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلَۢاۚ بَلۡ هُمۡ قَوۡمٌ خَصِمُونَ﴾[الزخرف:58]
 অর্থ¸আর তারা বলে, ‘আমাদের উপাস্যরা শ্রেষ্ঠ নাকি ঈসা’? তারা কেবল কূটতর্কের খাতিরেই তাকে তোমার সামনে পেশ করে। বরং এরাই এক ঝগড়াটে সম্প্রদায়। [সুরা যুখরুফ: ৫৮] তিলাওয়াত করেন।
আল্লাহ তা‘আলা তাদের থেকে বদলা নিয়েছেন এবং তাদের শাস্তি দিয়েছেন। যেমন, তাদের নিকট যে দ্বীন ও ইলম পেশ করা হয়েছিল তার বিনিময়ে তাদের ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত করা হয়েছে। তাদের অনর্থক বিতর্কে লিপ্ত করে দেয়া হল।
আর মনে রাখতে হবে, এ হল, চিরন্তন নিয়ম, যখন কোন জাতি উপকারী ইলম ও কুরআন ও সুন্নাহের ইলম ছেড়ে দেবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ ও ফিতনা ফাসাদ ছড়িয়ে দিয়ে তাদের থেকে বদলা নিবে।
হে আল্লাহ তুমি আমাদের হককে হক হিসেবে পরিচয় করে দাও আর তার অনুকরণ করার তাওফীক দান কর। আর বাতিলকে বাতিল হিসেবে চেনার তাওফীক দাও এবং বাতিল হতে বেচে থাকার তাওফীক দাও।
وصلى الله وسلم على نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين
-সালেহ আল-মুনাজ্জেদ
তোমার বুঝকে পরীক্ষা কর!
তোমার সামনে দুই প্রকার প্রশ্ন আছে; কিছু আছে তুমি এখনই উত্তর দিতে পারবে, আর কিছু আছে যে গুলোর উত্তর দিতে তোমাকে গভীর চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
প্রথম প্রকার প্রশ্ন:
১. ঝগড়া-বিবাদের সংজ্ঞা দাও।
২. ঝগড়া ও বিতর্কের মধ্যে পার্থক্য কি?
৩. ঝগড়া ও বিতর্কের অনেক কারণ আছে, উল্লেখ যোগ্য কয়েকটি উল্লেখ কর।
৪. প্রশংসনীয় বিতর্কের শর্তসমূহ কি?
৫. বিতর্ক কত প্রকার? প্রত্যেক প্রকার উদাহরণ বর্ণনা কর।
৬. ঝগড়ার কারণে কি কি ক্ষতি বা ফ্যাসাদ হতে পারে।
দ্বিতীয় প্রকার প্রশ্ন:
১. কুরআনে করীম বিষয়ে বিতর্কে অর্থ কি?
২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিম্ন লিখিত বাণীর অর্থ কি?
 اقرؤوا القرآن ما ائتلفت قلوبكم،فإذا اختلفتم فقوموا عنه
৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিম্ন লিখিত বাণীর অর্থ কি?
ما ضل قوم بعد هدى كانوا عليه إلا أُتوا الجدل
৪. আল্লাহ তা‘আলার বাণীতে অর্থ কি?
সূচীপত্র
ভূমিকা
ঝগড়া বিবাদ বলতে আমরা কি বুঝি?
কুরআন নিয়ে জিদাল করার অর্থ:
ঝগড়া-বিবাদ মানুষের স্বভাবের সাথে আঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত:
ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টির কারণসমূহ:
প্রশংসনীয় বিতর্কের শর্তাবলী।
বিতর্কের প্রকারভেদ।
নিন্দনীয় বা মন্দ বিতর্ক:
প্রশংসনীয় বিতর্ক:
নিন্দনীয় বিতর্কের প্রকার:
প্রশংসনীয় বিতর্কের উদাহরণ:
নিন্দনীয় ঝগড়া ও বিতর্কের ক্ষতি:
পরিশিষ্ট:
[1] আবু দাউদ [৪৬০৩] আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
[2] বুখারি: ৫০৬০
[3] দারমী [১১৯]
[4] তাফসীরে কুরতবী [ ২৪১/৮ ]
[5] বুখারি [৪৪১৮] মুসলিম [২৭৬৯]
[6] বুখারি: ৪৪১৮ মুসলিম: ২৭৬৯
[7] মুসলিম: ৬৯৬৯
[8] দেখুন: তারিখে দেমশক ৩৮৪/৫১
[9] দেখুন তারিখে দামেশক [২৯৭/২৯]
[10] দেখুণ: মিফতাহুস সাআদাত [১৬৯/১]
[11] আল কাবায়ের।
[12] মাজমুয়ুল ফাতওয়াহ ১৬৪/২০
[13] তিরমিযি: ৩০৬৯
[14] বুখারি: ১৮৯৪
[15] ওমদাতুল কারী: ২৫৮/১০ ফতহুল বারী: ১০৪/৪
[16] আবু দাউদ: ৪৮০০
[17] বুখারি: ২৪৫৭ মুসলিম: ২৬৬৮
[18] বুখারি: ৪৯
[19] ইবনে মাযা: ২৫৪
[20] তিরমিযি: ২৬৪৫
_________________________________________________________________________________
সংকলন : শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদক : জাকের উল্লাহ্ আবুল খায়ের
সম্পাদনা : ড. মো: আবদুল কাদের
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

No comments:

Post a Comment

Translate