প্রশ্ন: কোনো ব্যক্তি যদি সড়ক দুর্ঘটনা, হামলা বা দুর্যোগে আহত হয় এবং এর ফলে তার সাহায্যের প্রয়োজন হলে আশে পাশের অন্যান্য মুসলিমদের করণীয় কী?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। অতঃপর যে ব্যক্তি তাৎক্ষণিক ধ্বংস বা মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে যেমন দুর্ঘটনা, হামলা বা কোনো বিপর্যয়ে পড়ে প্রাণনাশের ঝুঁকিতে থাকে তাহলে তাকে বাঁচানো সক্ষম ব্যক্তির জন্য আবশ্যিক (ওয়াজিব)। এমনকি ব্যক্তি সালাত রত অবস্থায় থাকলেও সালাত ভঙ্গ করে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করতে হবে যদিও সালাতের সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। উদ্ধার কাজ শেষ করার পর উক্ত সালাত কাজা পড়তে হবে। কেননা ইসলামে মানুষের প্রাণ রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তাআলা বলেন:مَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَآ أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا“আর যে মানুষের প্রাণ বাঁচালো,সে যেন সকল মানুষকে বাঁচালো।”(সূরা মায়িদাহ: ৩২) ইমাম জাসসাস এই আয়াতের তাফসীরে বলেন:وعلى كل أحد أن ينجي غيره إذا خاف عليه التلف مثل أن يرى إنسانا قد قصده غيره بالقتل أو خاف عليه الغرق وهو يمكنه تخليصه”যদি কেউ দেখে অন্য কেউ তাকে হত্যা করতে যাচ্ছে, বা সে ডুবে যাচ্ছে আর সে যদি তাকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়, তাহলে তার দায়িত্ব তাকে উদ্ধার করা।”(ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-১১৪৭৮৩) হাদিসে রাসূল (ﷺ) বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে যে কোন ব্যক্তি তার ভাইয়ের কোন উপকার করতে সমর্থ হলে সে যেন তা করে।”(সহিহ মুসলিম হা/৫৬২২) অপর বর্ননায় রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমার ভাইকে সাহায্য কর। সে জালিম হোক অথবা মজলুম হোক। এক লোক বলল, হে আল্লাহ্র রসূল! মজলুম হলে তাকে সাহায্য করব তা তো বুঝলাম। কিন্তু জালিম হলে তাকে কিভাবে সাহায্য করব? তিনি বললেন: তাকে অত্যাচার থেকে বিরত রাখবে। আর এটাই হল তার সাহায্য।”(সহিহ বুখারী হা/৬৯৫২)
.
তবে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে সহায়তা করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে, তাহলে সে গুনাহগার হিসেবে পরিগণিত হবে। কাশফুল ক্বিনা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে:ولو وجد آدميا معصوما في هلكة ، كغريق : لزمه – مع القدرة – إنقاذه) من الهلكة”যদি কোনো নিরাপরাধ (হত্যা করা নিষিদ্ধ) মানুষকে ধ্বংসের মুখে পাওয়া যায়, যেমন: একজন ডুবন্ত ব্যক্তি, তাহলে তার পক্ষে যদি সক্ষমতা থাকে, তবে তার জন্য তাকে ধ্বংস থেকে বাঁচানো আবশ্যক।”(কাশফুল ক্বিনা খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩১৪)
.
আর শরিয়তে ‘মা‘সুম (যার জান রক্ষা করা অপরিহার্য) বলতে বুঝানো হয় সেই ব্যক্তি যার জীবন শরিয়ত অনুযায়ী সুরক্ষিত। অর্থাৎ, যার ওপর অন্যায়ভাবে আঘাত হানা হারাম। মুসলিমদের পাশাপাশি, অমুসলিমদের মধ্যেও কিছু শ্রেণি যেমন মুসলিম, জিম্মী (ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক), মুআহাদ (চুক্তিভিত্তিক শান্তিপূর্ণ কাফির) এবং মুস্তাআ’মান (যাকে মুসলিম রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিয়েছে)। এই শ্রেণির লোকদের প্রাণ রক্ষা আবশ্যক। তবে যারা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন: কাফির শত্রু, ধর্মত্যাগী (মুরতাদ), শরিয়ত অনুযায়ী রজমযোগ্য বিবাহিত ব্যভিচারী তাদের জীবন রক্ষা করা শরিয়তের দৃষ্টিতে আবশ্যক নয়। “কাশশাফুল ক্বিনাআ’” গ্রন্থে বলা হয়েছে:”(ويجب رد كافر معصوم) بذمة أو هدنة أو أمان (عن بئر ونحوه) كحية تقصده (ك) رد (مسلم) عن ذلك ، بجامع العصمة .(و) يجب (إنقاذ غريق ونحوه) كحريق (فيقطع الصلاة لذلك) ، فرضا كانت أو نفلا .وظاهره: ولو ضاق وقتها، لأنه يمكن تداركها بالقضاء، بخلاف الغريق ونحوه ؛ (فإن أبى قطعها) ، أي الصلاة لإنقاذ الغريق ونحوه : أثم”কাফির যদি মাসুম হয় (যেমন জিম্মি, চুক্তিবদ্ধ বা নিরাপত্তা প্রাপ্ত), তাকে কূপে পড়া বা সাপ দংশনের মতো বিপদ থেকে বাঁচানো ওয়াজিব যেমনটি একজন মুসলমানকে বাঁচানো ওয়াজিব, কারণ উভয়ই মাসুম। এমনকি কেউ যদি সালাতে থাকে, তবুও (যদি সে পারত) তাহলে ডুবে যাওয়া ব্যক্তি বা আগুনে আটকে পড়া কাউকে উদ্ধার করা তার জন্য ওয়াজিব। সালাত ফরজ হোক বা নফল, তাও কাটতে হবে এই উদ্ধারের জন্য। যদি সালাতের সময় সংকীর্ণও হয়, তাও তাকে সালাত ভেঙে উদ্ধার করতে হবে, কারণ সালাত পরে কাজা করা সম্ভব, কিন্তু ডুবে যাওয়া বা আগুনে পড়া ব্যক্তি রক্ষা পাবে না। যদি কেউ তাও না করে, তাহলে সে গুনাহগার হবে। তাই যদি কেউ এমন অবস্থায় থাকে যে সে সালাতে আছে অথবা রোজা রাখছে এবং কাউকে উদ্ধার করতে হলে তাকে সালাত ভাঙতে হবে বা রোজা ভেঙে ফেলতে হবে, তবুও তা করা ফরজ, এবং তা না করলে সে গুনাহগার হবে।”(কাশশাফুল ক্বিনাআ’ খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৮০)
.
আল-মাওসুআতুল ফিক্বহিয়্যাহ” গ্রন্থে বলা হয়েছে:” إغاثة الغريق والعمل على إنجائه من الغرق : واجب على كل مسلم ، متى استطاع ذلك .يقول الفقهاء : يجب قطع الصلاة لإغاثة غريق إذا قدر على ذلك، سواء أكانت الصلاة فرضا أم نفلا ، وسواء استغاث الغريق بالمصلي ، أو لم يعيّن أحدا في استغاثته ، حتى ولو ضاق وقت الصلاة ؛ لأن الصلاة يمكن تداركها بالقضاء ، بخلاف الغريق “ডুবে যাওয়া ব্যক্তি বা এজাতীয় বিপদের শিকার কারো সাহায্য করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর আবশ্যক, যদি সে তা করতে সক্ষম হয়। এমনকি যদি সে সালাতে থাকে, ফরজ হোক বা নফল এবং এমনকি যদি ডুবে যাওয়া ব্যক্তি তার কাছ থেকে সাহায্য চায় বা চায় না তবুও তাকে সালাত ছেড়ে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ সালাত পরে কাজা করা যায়, কিন্তু একজন মানুষ মারা গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা যায় না।এই বিষয়ে ফকীহদের মধ্যে ভিন্নমত আছে যে, কেউ যদি উদ্ধার না করে তাহলে তার ওপর কী বিধান প্রযোজ্য হবে।”(আল-মাওসুআতুল ফিক্বহিয়্যাহ খণ্ড: ৩১; পৃষ্ঠা: ১৮৩)
.
ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
لا شك أن إنقاذ الغريق من أهم الواجبات على كل قادر على إنقاذه ، فإذا أخذ في إنقاذه ، فتعلق به حتى خشي على نفسه أن يغرق مثله : فليس عليه في هذه الحالة وجوب ، لا شرعا ، ولا عقلا، فيخلص نفسه منه ، ويدعه، سواء كان قد أشرف على النجاة أم لا، بل ظاهر قوله تعالى: ( وَلا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ ) [البقرة: 195]، أنه يجب عليه تخليص نفسه.والآية هذه ، وإن كانت واردة على سبب خاص ، كما في سن أبي داود وغيرهما ؛ فالاعتبار بعموم اللفظ ، لا بخصوص السبب ، كما تقرر في الأصول ، وهو الحق”
“এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ডুবন্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা সামর্থবান ব্যক্তির উপর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব (অবশ্যপালনীয়) এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু উদ্ধার করতে গিয়ে যদি আশঙ্কা থাকে যে, ডুবন্ত ব্যক্তি তাকে জাপটে ধরবে এবং সেও তার মতোই ডুবে মরবে তাহলে এই অবস্থায় তার জন্য এটি ওয়াজিব নয় শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকেও নয় বা জ্ঞান-বুদ্ধির বিচারেও নয়। এই অবস্থায় সে তাকে ছেড়ে নিজেকে রক্ষা করবে। চাই তার বাঁচার সম্ভাবনা থাকুক অথবা না থাকুক। বরং মহান আল্লাহর বাণী: “আর তোমরা নিজেরকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না।” (সূরা বাকারা: ১৯৫) এর প্রকাশ্য অর্থ এটাই যে, ডুবন্ত ব্যক্তিকে ছেড়ে নিজেকে রক্ষা করা তার জন্য ওয়াজিব। যদিও আয়াতটি একটি নির্দিষ্ট ঘটনা উপলক্ষে নাজিল হয়েছে যেমনটি আবু দাউদসহ বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত তবুও উসূলুল ফিকহের মূলনীতির আলোকে স্বীকৃত সত্য হলো, কুরআনের আয়াতে ব্যবহৃত সাধারণ ভাষা ও শব্দরূপই বিধান নির্ধারণে মুখ্য; নাজিল হওয়ার বিশেষ কারণ নয়। এটাই বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মত।”(আস সাইলুল জাররা মুন্তাফিক আলা হাদাইকুল আজহার, পৃষ্ঠা নং ৮৯২)
.
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন:إنه يجب على المرء المسلم إذا رأى أخاه المسلم في أمر يُخشَى منه الهلاك، يجب عليه أن يسعى لإنقاذه بكل وسيلة،حتى إنه لو كان صائمًا صيام الفرض في رمضان، وحصل شيء يُخشَى منه الهلاك على أخيه المسلم، واضطر إلى أن يُفطِرَ لإنقاذه، فإنه يفطر لإنقاذه، وعلى هذا فإذا مررت بحادث سيارة، ورأيت الناس في حال يُخشَى عليهم من التَّلَفِ أو من تضاعف الضرر، فإنه يجب عليك إنقاذهم بقدر ما تستطيع، ولو أن تحمِلَ النساء، وإن لم يكن معهن محارم؛ لأن هذه ضرورة”؛”যদি কোনো মুসলমান তার ভাইকে এমন বিপদে দেখে যা তার ধ্বংসের আশঙ্কা তৈরি করে তাহলে তাকে অবশ্যই উদ্ধার করতে হবে যেকোনো উপায়ে। এমনকি যদি সে রমজানের ফরজ রোজায় থাকে এবং তার ভাই বিপদের মধ্যে পড়ে আর তাকে উদ্ধার করতে গেলে রোজা ভেঙে ফেলতে হয়, তাহলেও সে রোজা ভেঙে ফেলবে। যেমন কেউ গাড়ি দুর্ঘটনা দেখতে পেলো এবং মানুষ মারাত্মক বিপদের মধ্যে আছে তখন তোমার ওপর ফরজ হয়ে যায় তাদের উদ্ধার করা, যতটুকু সম্ভব। এমনকি যদি তোমাকে মহিলাদের গাড়িতে তোলাও লাগে, যদিও তাদের সাথে কোনো মাহরাম নেই তবুও সেটা বৈধ, কারণ এটি জরুরি অবস্থা। (ইবনু উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ১৫৯)
.
অতএব উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে কোনো মুসলিম দুর্ঘটনা, হামলা বা দুর্যোগে আহত হলে তাকে সাহায্য করা উপস্থিত মুসলিমদের ওপর ওয়াজিব হয়ে যায় যদি তারা সক্ষম হয়। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অবহেলা করা বড় গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এমনকি জীবন রক্ষা করতে সালাত ভঙ্গ করাও বৈধ। যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সাহায্য, চিকিৎসা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইসলামী দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদের সকলকে মানবিক দায়িত্ব পালনে যত্নবান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬◐✪◑▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।
No comments:
Post a Comment