প্রশ্ন: অর্ধ শাবানের রাতে (কথিত শবে বরাতে) ব্যক্তিগতভাবে বাড়িতে বা মসজিদে কি বিশেষ কোনো ইবাদত-বন্দেগি করা শরিয়তসম্মত?▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর: এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কথা হলো, কথিত শবে বরাতকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোনো ইবাদত-বন্দেগি করা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। চাই তা বাড়িতে হোক বা মসজিদে হোক, একাকী হোক বা দলবদ্ধভাবে হোক। (যদিও কতিপয় আলেম মনে করেন এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তাদের বক্তব্য দলিল দ্বারা সমর্থিত নয়।)
কারণ এ রাতে ইবাদত করার বিশুদ্ধ কোনো দলিল নেই। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোনো প্রমাণ নেই যে, তারা এ রাতে কোনো ধরনের ইবাদত-বন্দেগি করতেন।
সুতরাং এটি দ্বীনের মধ্যে সংযোজিত একটি বিদআত, যার পক্ষে কুরআন, সুন্নাহর দলিল নেই এবং সাহাবি-তাবেঈদেরও ইজমা তথা সম্মিলিত কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় না।
এ রাতে যদি বিশেষ কোনো ইবাদত-বন্দেগি করা ফজিলতপূর্ণ হতো তাহলে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আমল করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিতেন। সাহাবিগণ তা পালন করা থেকে বিরত থাকতেন এমনটি কল্পনাও করা যায় না। তবে কারও যদি আগে থেকেই অন্যান্য রাতে কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, দোয়া, তাসবিহ পাঠ এবং নফল সালাত আদায়ের অভ্যাস থাকে তাহলে সে এ রাতেও তা অব্যাহত রাখতে পারে। কিন্তু যদি আগে না থাকে এবং শুধুমাত্র এই রাতে বিশেষভাবে ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত হয় তাহলে এ বিষয়ে অবশ্যই রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবিদের আমল থাকা প্রয়োজন। অন্যথায় তা বিদআত হিসেবে পরিগণিত হবে।
❑ অর্ধ শাবানের দিনে রোজা রাখা ও রাতে নফল সালাত সম্পর্কে বর্ণিত কতিপয় জাল ও জইফ হাদিস:
সাধারণত মানুষ অর্ধ শাবানের দিনে রোজা রাখা ও রাতে নফল নামাজ পড়ার বিষয়ে কতিপয় বানোয়াট ও দুর্বল হাদিসের ওপর নির্ভর করে।
নিম্নে সে ধরনের কিছু হাদিস মুহাদ্দিসদের পর্যালোচনাসহ পেশ করা হলো:
❖ (ক) আলি ইবনে আবি তালিব (রা.) হতে বর্ণিত:
তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“যখন শাবান মাসের পনেরোতম রাত আসে, তোমরা দিনে রোজা রাখো আর রাতে নফল নামাজ আদায় করো। কারণ, এ রাতে আল্লাহ তাআলা নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন, এমন কেউ আছে কি যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কেউ কি আছে যে আমার কাছে রিজিক চাইবে? আমি তাকে রিজিক দেব। কেউ কি আছে যে আমার কাছে বিপদ থেকে মুক্তি চাইবে? আমি তাকে মুক্তি দেব…” এভাবে আল্লাহ তাআলা ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত ডাকতে থাকেন।
🔸 হাদিসের মান: মুহাদ্দিসদের মতে, এ হাদিসটি মাওযু (জাল/বানোয়াট)। [পর্যালোচনা দেখুন- ১]
❖ (ঘ) আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত: তিনি বলেন,
🔎 টিকা ও পর্যালোচনা:
[১] ইবনে মাজাহ, নামাজ অধ্যায়: নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। ইমাম বুসাইরি “জাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ” গ্রন্থে বলেন: উক্ত হাদিসের বর্ণনাসূত্রে একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন, তার নাম ইবনে আবি সুবরাহ (ابن أبي سبرة) (তার প্রকৃত নাম: আবু বকর ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি সুবরাহ)। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন এবং আহমাদ বিন হাম্বল রহ. বলেন, এ ব্যক্তি হাদিস তৈরি করত (অর্থাৎ জাল হাদিস বর্ণনা করত)। ইবনে হাজার আসকালানি রহ. “তাকরীব” কিতাবে [২/৩৯৭] বলেন, মুহাদ্দিসগণ এই ব্যক্তিকে হাদিস জাল করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। উকাইলি “আল-যুআফা আল-কাবীর” গ্রন্থে [২/২৭১] একই কথা বলেছেন।
[২] ইবনুল জাওজি উক্ত হাদিসটি “আল-মাওয়ুআত” কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি যে বানোয়াট তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব বর্ণনাকারী রয়েছেন, যাদের অধিকাংশেরই পরিচয় অজ্ঞাত। আরও কতিপয় বর্ণনাকারী খুব দুর্বল। সুতরাং হাদিসটি নিশ্চিতভাবে জাল। অথচ আমরা অনেক মানুষকে দেখি, যারা সারা রাত ধরে নামাজ পড়ার পর তাদের ফজর নামাজ ছুটে যায় কিংবা সকালে যখন ওঠে অলসতা সহকারে ওঠে। কিছু মসজিদের ইমাম শবে বরাতের এসব নামাজকে সাধারণ জনগণকে একত্রিত করার এবং এর মাধ্যমে নিজেদের রুটি-রুজি ও উন্নতির মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এরা জনগণকে একত্রিত করে তাদের আলোচনা সভাগুলোতে বিভিন্ন কিচ্ছা-কাহিনি আলোচনা করে থাকে। মূলত এসবই ভ্রান্ত এবং হকের সঙ্গে সম্পর্কহীন।
ইবনুল কাইয়্যিম জাওজিয়াহ “আল-মানারুল মুনিফ” কিতাবে উক্ত হাদিসটি উল্লেখ করে বলেন: জাল হাদিসসমূহের মধ্যে অর্ধ শাবানের রাতের নামাজ পড়া সম্পর্কিত উক্ত হাদিসটি অন্যতম। এরপর তিনি বলেন, “আজব ব্যাপার হলো, কিছু মানুষ যারা হাদিসের কিছু ঘ্রাণ পেয়েছে তারাও এসব উদ্ভট হাদিস দেখে প্রতারিত হয়ে শবে বরাতের নামাজ পড়া শুরু করে দেয়!”
অনুরূপভাবে ইমাম সুয়ুতি রহ. উপরোক্ত হাদিসটি “আল-লাআলি আল-মাসনুয়া” কিতাবে উল্লেখ করে সেটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তদ্রূপ ইমাম শাওকানি রহ. এটিকে “আল-ফাওয়ায়েদুল মাজমুয়া” কিতাবে জাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
[৩] এ হাদিসটিও ইবনুল জাওজি রহ. তার “আল-মাওজুয়াত” কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এ হাদিসটিও জাল। এ হাদিসটির সনদে এমন একদল বর্ণনাকারী রয়েছেন, যাদের সকলের পরিচয় অজ্ঞাত। অনুরূপভাবে ইমাম সুয়ুতি রহ. “আল-লাআলি” কিতাবে এবং ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহ. “আল-মানারুল মুনীফ” কিতাবে উক্ত হাদিসটি উল্লেখ করে এটিকে জাল হাদিস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
[৫] ইমাম সুয়ুতি রহ. কর্তৃক লিখিত “আল-জামিউল কাবির” বা “জামউল জাওয়ামি” গ্রন্থের ১২৮৩০ নং হাদিস। তিনি নিজেই বলেছেন: হাদিসটি মুরসাল। আরও, হাদিসটি দায়লামী আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেন। আল্লামা আলবানি রহ. বলেন: ”হাদিসটি জইফ বা দুর্বল।” দেখুন: “সিলসিলা যইফা মুখতাসারাহ”, হাদিস নং ৪৪০০, মাকতাবা শামেলা।
No comments:
Post a Comment