Saturday, October 13, 2018

অধ্যয়ন ও জ্ঞানসাধনা (১ম পর্ব)

অধ্যয়ন ও জ্ঞানসাধনা (১ম পর্ব)

ইলমের সংজ্ঞা
ওলামায়ে কেরামের পরিভাষায় শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন-
العلم بالكسر وسكون اللام: في عرف العلماء يطلق على معان منها، الإدراك مطلقا
ইলম শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে। এগুলোর একটি অর্থ হচ্ছে অনুধাবন ও উপলব্ধি করা। দার্শনিকগণ এই অর্থের প্রবক্তা।
কেউ কেউ বলেন,
ومنها التصديق مطلقا، يقينياكان أو غيره والعلم بمعنى اليقين في اللغة
‘ইলমের অর্থ সত্যায়ন করা। চাই তা ইয়াকিনী হোক বা অন্য কিছু। আর অভিধান অনুযায়ী ইলম অর্থ ইয়াকিন বা বিশ্বাস।’
এর এক অর্থ হচ্ছে التعقل বা আকলের সাহায্যে অনুধাবন করা। আর এই অর্থের ভিত্তিতেই ইলম শব্দটি কল্পনা, ধারণা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইলমের আরেকটি অর্থ হচ্ছে:
إدراك المسائل عن دليل
তথা দলিলের ভিত্তিতে মাসআলা আয়ত্ব করা।
বস্তুত: ইলম হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার সিফাত বা অনন্য গুণাবলিসমূহের একটি, যা ইলমের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছে।
ইলমের আভিধানিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পূর্বসূরীগণ এর অন্তর্নিহিত একটি সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন। যেই সংজ্ঞায় ইলমের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং প্রকৃত ইলমের আলামত ফুটে ওঠে। যেমন, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন,
ليس العلم بكثرة الرواية، إنما العلم خشية الله
‘বেশি বর্ণনা করা ও অধিক পরিমাণ আক্ষরিক জ্ঞান হাসিল করার নাম ইলম নয়, বরং ইলম হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার ভয়ের নাম।’
ইমাম মালেক (রহ.) বলতেন,
الحكمة والعمل نور يهدي به الله من يشاء وليس بكثرة المسائل ، ولكن عليه علامة ظاهرة وهو التجافي عن دار الغرور والإنابة إلي دار الخلود
‘হেকমত ও আমল হচ্ছে একটি নূর। যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তাকে পথ দেখান। আর বেশি বেশি মাসআলা জানার নাম ইলম নয়। এর একটি আলামত আছে। তা হচ্ছে, ইলমের বদৌলতে প্রতারণার এই জগত থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং চিরস্থায়ী জগতের দিকে ধাবিত হওয়া।’
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলতেন,
وما العلم إلا العمل به والعمل به ترك العاجل للآجل
‘ইলম হচ্ছে আমলের নাম। আর আমল হলো স্থায়ী জগতের স্বার্থে ক্ষণস্থায়ী জগত পরিহার করা।’
মুমিন হতে হলে ইলম জরুরী
অনেকের ধারণা, ইলমের বিষয়টি কেবল ফযীলতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ ইলম হাসিল করা ভালো এবং সওয়াবের কাজ আর না করা দোষণীয় নয় তবে ছাওয়াব ও ফযীলত থেকে বঞ্চিত হওয়ার নামান্তর মাত্র। কিন্তু বিষয়টি কি আদৌ এমন? ফযীলতের মধ্যেই কি ইলম সীমাবদ্ধ? মোটেই তা নয়। বরং একজন মানুষের প্রকৃত মুমিন হওয়া নির্ভর করে ইলম হাসিলের ওপর। কারণ কোনো ব্যক্তি ইলম হাসিল করা ছাড়া প্রকৃতি মুমিনই হতে পারে না। কেননা মুমিন হওয়া নির্ভর করে দুটি বস্তুর ওপর। এক. সে আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না। দুই. শরীয়ত নির্দেশিতপন্থা ছাড়া ইবাদত করবে না। আর এ দুটিই হচ্ছে তাওহীদের মর্মবাণী। যথা:
أشهد أن لا إله إلا الله وأشهد أن محمداً عبده ورسوله
‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল।’
সুতরাং তাওহীদের মর্মবাণীর মধ্যে ইলম অপরিহার্যভাবে জড়িত ও পরিব্যপ্ত। অতএব বোঝা গেল, ইলম ছাড়া তাওহীদের মর্মবাণী যথার্থভাবে উপলব্ধি হয়নি। একারণেই ইমাম বুখারী (রহ.) সহীহ বুখারীতে ইলমকে আমলের আগে প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন এবং একটি অধ্যায় কায়েম করেছেন নিম্নোক্ত শিরোনামে-
بَاب الْعِلْمُ قَبْلَ االْقَوْلِ وَالْعَمَلِ لِقَوْلِ اللَّهِ تَعَالَى: (فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ)
‘এ অধ্যায় কথা ও কাজের আগে ইলম- এ বিষয়ে। যেমন আল্লাহও বলেছেন, ‘তোমরা জানো যে আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই’।
ইলম: বান্দার প্রতি আল্লাহর প্রথম উপহার
আল্লাহ তা‘আলা মানুষ সৃষ্টি করার তাদেরকে বিভিন্ন রকমের নেয়ামত দান করেছেন। মানুষের প্রতি তাঁর করুণা ও দান এত বিস্তৃত ও সীমাহীন যে, কারো পক্ষে সে সব নেয়ামতের হিসাব করা সম্ভব নয়। কিন্তু কোনো কোনো নেয়ামত এত মূল্যবান যে, যা হাজার নেয়ামতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাও ওই সব নেয়ামতের কথা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। বান্দার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অমূল্য নেয়ামতরাজির অন্যতম হচ্ছে ইলম।
ইলম শুধু মহা নেয়ামতই নয়; বরং বান্দার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার প্রথম উপহার, যা তিনি বান্দা তথা মানুষ সৃষ্টি করার পর তাকে দান করেছিলেন। তিনি মানুষ সৃষ্টি করার আগে ফেরেশতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বললে তারা নেতিবাচক পরামর্শ দেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এর জবাবে বলেন,
﴿ وَإِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ خَلِيفَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَجۡعَلُ فِيهَا مَن يُفۡسِدُ فِيهَا وَيَسۡفِكُ ٱلدِّمَآءَ وَنَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَۖ قَالَ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٣٠ ﴾ [البقرة: ٣٠]
‘আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘নিশ্চয় আমি যমীনে একজন খলীফা সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় আমি জানি যা তোমরা জান না।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৩০}
এরপর তিনি আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। তাকে সৃষ্টি করে সর্বপ্রথম ইলম শিক্ষা দেন এবং ইলমকেই ফেরেশতাদের ওপর তার শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হিসেবে সাব্যস্ত করেন। যেমন পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন,
﴿ وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلۡأَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبِ‍ُٔونِي بِأَسۡمَآءِ هَٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٣١ ﴾ [البقرة: ٣١]
‘আর তিনি আদমকে নামসমূহ সব শিক্ষা দিলেন তারপর তা ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতপর বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৩১}
মোটকথা, আল্লাহ তখন মানুষ সৃষ্টিতে দ্বিমতকারী ফেরেশতাদের সামনে কিছু বিষয় পেশ করেন যার জবাব দিতে তারা ব্যর্থ হন এবং তখন আদম (আ.)-কে সেগুলোর জবাব দিতে বলেন। যেসব বিষয়ে ফেরেশতারা নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করেন সেগুলো আদম (আ.) প্রকাশ করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। আল্লাহ তা‘আলা এভাবে ফেরেশতাদের সামনে ইলমের মাহাত্ম্য প্রকাশ করেন এবং ইলম গ্রহণকারী মানুষকে তাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। সুতরাং বুঝা গেল, নিষ্পাপ ফেরেশতাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হলো ইলম- আল্লাহ তা‘আলা যা মানুষকে প্রথম উপহার হিসেবে দান করেছেন।
ইলম আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে শুধু উপহারই নয়; বরং অসামান্য অনুগ্রহও বটে। তিনি কুরআনের বহু স্থানে বান্দার প্রতি তাঁর বিশেষ বিশেষ দান-অনুগ্রহের কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। আর যে দান ও অনুগ্রহ সবিশেষ মূল্যবান সেটি হচ্ছে ইলম। ইরশাদ হয়েছে-
﴿ خَلَقَ ٱلۡإِنسَٰنَ ٣ عَلَّمَهُ ٱلۡبَيَانَ ٤ ﴾ [الرحمن: ٣، ٤]
‘মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে বয়ান শিক্ষা দিয়েছেন।’ {সূরা আর-রহমান, আয়াত: ৩-৪}
ইলম ও আলেমের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহর বাণী
সাধারণ মুমিনের চেয়ে আলেমের মর্যাদা বহু গুণ বেশি: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَرۡفَعِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ دَرَجَٰتٖۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٞ ١١ ﴾ [المجادلة: ١١]
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত।’ {সূরা আল-মুজাদালা, আয়াত: ১১}
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, ‘সাধারণ মুমিনের চেয়ে আলেমের মর্যাদা সাতশত গুণ বেশি। এবং প্রতিটি মর্যাদার মধ্যে দূরত্ব পাঁচশত বছরের সমান।’
আলেমের নাম আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে!
আল্লাহ আলেমদেরকে কী পরিমাণ মর্যাদা দান করেছেন তার বড় প্রমাণ তিনি নিজের নামের সঙ্গে তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ করেছেন-
﴿ شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلۡعِلۡمِ قَآئِمَۢا بِٱلۡقِسۡطِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٨ ﴾ [ال عمران: ١٨]
আলেমগণকে তাঁর নিজের নামের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। কেননা যে যাকে ভালোবাসেন তিনি তাকে নিজের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করেন। একারণেই আল্লাহ তা‘আলা ওলামায়ে কেরামের নাম নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত রেখেছেন এবং এর কারণ হচ্ছে; মানুষের মধ্যে আলেমগণই আল্লাহ তা‘আলার কাছে বেশি সম্মানিত ও প্রিয়। ইমাম কুরতুবী (রহ.) তাফসীরে লেখেন-
وفي هذه الآية دليل على فضل العلم وشرف العلماء وفضلهم ، فإنه لو كان أحد أشرف من العلماء لقرنهم الله باسمه واسم ملائكته كما قرن اسم العلماء
‘আলোচ্য আয়াত ইলম ও ওলামায়ে কেরামের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের দলিল। কেননা ওলামায়ে কেরাম ছাড়া অন্য কেউ আল্লাহ তা‘আলার কাছে অধিক সম্মানিত হলে তিনি নিজের নামের সঙ্গে তাদের নামই উল্লেখ করতেন।’
আলেমদের এই সম্মান ও মর্যাদার কারণ হচ্ছে, একমাত্র তারাই যথাযথভাবে এবং হক অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করেন ও তার বিধান সহীহ তরীকায় পালন করতে সচেষ্ট থাকেন। ইরশাদ হয়েছে-
﴿ إِنَّمَا يَخۡشَى ٱللَّهَ مِنۡ عِبَادِهِ ٱلۡعُلَمَٰٓؤُاْۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ ٢٨ ﴾ [فاطر: ٢٨]
“কেবলমাত্র আলেমগণই আল্লাহকে ভয় করে, নিশ্চয় আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী ক্ষমাশীল।” [সূরা ফাতির: ২৮]
এমনিভাবে নবুওয়াতের সাক্ষীদাতা হিসেবে আলেমরাই যথেষ্ট বলে কুরআনে ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
﴿ وَيَقُولُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لَسۡتَ مُرۡسَلٗاۚ قُلۡ كَفَىٰ بِٱللَّهِ شَهِيدَۢا بَيۡنِي وَبَيۡنَكُمۡ وَمَنۡ عِندَهُۥ عِلۡمُ ٱلۡكِتَٰبِ ٤٣ ﴾ [الرعد: ٤٣]
“আর কাফিররা বলে, আপনি প্রেরিত রাসূল নন, বলুন, আমাদের ও তোমাদের মাঝে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট, আর যার কাছে রয়েছে কিতাবের জ্ঞান”। [সূরা আর-রা‘দ:৪৩]
ইলমের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা এক অবিশ্বাস্য শক্তি সন্নিহিত করেছেন। বিষয়টি অনুধাবন করা যায় সুলায়মান (আ.)-এর দরবারে রাণী বিলকিসের সিংহাসন উপস্থিত করার ঘটনায়। নবী সুলায়মান (আ.) তখন শামে অবস্থান করছিলেন। আর বিলকিসের রাজত্ব ও সিংহাসন ছিল ইয়ামানে অবস্থিত। তিনি সেখান থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিলকিসের সিংহাসন আনার আগ্রহ প্রকাশ করলে ইফরিত জিন্ন মজলিস থেকে ওঠে পুনরায় ফিরে আসার সময়ের মধ্যে তা হাজির করার সামর্থের কথা জানায়। কিন্তু এই প্রস্তাব সুলায়মান (আ.)-এর মনোপুত হলো না। কেননা এরচেয়েও কম সময়ের মধ্যে তিনি সিংহাসন নিজের সামনে উপস্থিত দেখতে চাচ্ছিলেন। তখন দরবারে যে ব্যক্তি আসমানী কিতাবের অধিকারী ছিলেন তিনি বললেন-
﴿ قَالَ ٱلَّذِي عِندَهُۥ عِلۡمٞ مِّنَ ٱلۡكِتَٰبِ أَنَا۠ ءَاتِيكَ بِهِۦ قَبۡلَ أَن يَرۡتَدَّ إِلَيۡكَ طَرۡفُكَۚ ﴾ [النمل: ٤٠]
‘আর যার কাছে কিতাবের ইলম ছিল, সে বলল, আমি এরচেয়েও কম সময়ে- চোখের পলক পড়ার আগেই আপনার সামনে তা উপস্থিত করতে পারি।’ {সূরা আন-নামল, আয়াত: ৪০}
এই বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ইলমের বরকতে এবং ইলমের কল্যাণে। ওই ব্যক্তি ইলমের শক্তিবলে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে সিংহাসন উপস্থিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ীত্ব, আখেরাতের অবশ্যম্ভাবিতা এবং করণীয় সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত বলে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই তাদেরকে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। কারূনের সীমাহীন ধন-সম্পদ দেখে সাধারণ মানুষের চোখ যখন ধাঁধিয়ে গিয়েছিল এবং সবাই এই পাপীর মতো সম্পদের প্রাচুর্য্য কামনা করছিল তখন বিচক্ষণ আলেমগণ নিজেদেরকে এই ঘৃণিত কামনা থেকে বিরত রাখলেনই, সেই সঙ্গে সাধারণ লোকদের এই কামনাকে চরম ধিকৃত বলে প্রকাশ করলেন। ইরশাদ হয়েছে-
﴿ وَقَالَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ وَيۡلَكُمۡ ثَوَابُ ٱللَّهِ خَيۡرٞ لِّمَنۡ ءَامَنَ وَعَمِلَ صَٰلِحٗاۚ وَلَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ٱلصَّٰبِرُونَ ٨٠ ﴾ [القصص: ٨٠]
‘আর যারা জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ‘ধিক তোমাদেরকে! আল্লাহর প্রতিদানই উত্তম যে ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তার জন্য। আর তা শুধু সবরকারীরাই পেতে পারে।’ {সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৮০}
আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিব্যবস্থা, তাঁর কুদরত ও কার্যাবলির হেকমত কারো পক্ষে অনুধাবন করা আদৌ সম্ভব নয়। তিনি যেমন মহান তাঁর যাবতীয় কার্যও মহান এবং সূক্ষ্ম ও হেকমতপূর্ণ। তিনি ছাড়া আর কারো পক্ষে যা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। তবে আলেমগণকে আল্লাহ তা‘আলা তার কর্মকাণ্ডের যৎকিঞ্চিত হেকমত ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে অবহিত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
﴿ وَتِلۡكَ ٱلۡأَمۡثَٰلُ نَضۡرِبُهَا لِلنَّاسِۖ وَمَا يَعۡقِلُهَآ إِلَّا ٱلۡعَٰلِمُونَ ٤٣ ﴾ [العنكبوت: ٤٣]
‘আমি এসব উপমা উপস্থাপন করি। তবে আলেমগণ ছাড়া অন্য কেউ তা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে না।’ {সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৪৩}
জীবন চলার পথে, সামাজিক নানা সমস্যা ও বিপদাপদে সাধারণ মানুষকে আলেমদের শরণাপন্ন হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং ওলামায়ে কেরামকে সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থলের মর্যাদা দান করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
﴿ فَسۡ‍َٔلُوٓاْ أَهۡلَ ٱلذِّكۡرِ إِن كُنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ٤٣ ﴾ [النحل: ٤٣]
‘সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জানো।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৪৩}
একমাত্র ওলামায়ে কেরামই যুগসমস্যার সমাধান এবং ইসলামের প্রকৃত ও যথার্থ দিকনির্দেশনা করতে পারেন বলে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে ঘোষণা করেছেন। মানুষের অজ্ঞাত ও অবোধ্য বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর ইলমের প্রতিনিধি উলামায়ে কিরামের শরণাপন্ন হতে বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
﴿ وَلَوۡ رَدُّوهُ إِلَى ٱلرَّسُولِ وَإِلَىٰٓ أُوْلِي ٱلۡأَمۡرِ مِنۡهُمۡ لَعَلِمَهُ ٱلَّذِينَ يَسۡتَنۢبِطُونَهُۥ مِنۡهُمۡۗ وَلَوۡلَا فَضۡلُ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ وَرَحۡمَتُهُۥ لَٱتَّبَعۡتُمُ ٱلشَّيۡطَٰنَ إِلَّا قَلِيلٗا ٨٣ ﴾ [النساء: ٨٣]
‘আর যদি তারা সেটি রাসূলের কাছে এবং তাদের কর্তৃত্বের অধিকারীদের কাছে পৌঁছে দিত, তাহলে অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা তা উদ্ভাবন করে তারা তা জানত। আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত না হত, তবে অবশ্যই অল্প কয়েকজন ছাড়া তোমরা শয়তানের অনুসরণ করতে।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮৩}
মুফাসসিরগণ লিখেছেন-
وألحق رتبتهم برتبة الأنبياء في كشف حكم الله
‘বস্তুত এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার বিধান নির্গত করার দিক দিয়ে ওলামায়ে কেরামকে নবীগণের মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত করেছেন।’
ইমাম আবূ বকর জাস্‌সাস (রহ.) কুরআনে বর্ণিত তাদের ফযীলতের কথা উল্লেখ করে আহকামুল কুরআনে উল্লেখ করেন-
وأن من استدل على حكمه واستنبط معناه فحمله على المحكم المتفق على معناه فهو ممدوح مأجور ممن قال الله تعالى (لعلمه الذين يستنبطونه منهم)
‘যেসব লোক হুকুম আহকামের ব্যাপারে গবেষণা করে এবং সঠিক অর্থ প্রকাশ করে অতপর তা সঠিক অর্থে প্রয়োগ করে সে প্রশংসিত এবং প্রতিদানযোগ্য। আর আল্লাহ তা‘আলা তাদের ব্যাপারেই এই আয়াতটি ইরশাদ করেছেন।
তিনি ওলামায়ে কেরামকে জাতির দিকনির্দেশক ও পথপ্রদর্শক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আরো বলেন, ‘যেহেতু ওলামায়ে কেরামই আল্লাহ তা‘আলার আদেশ-নিষেধ ভালোভাবে জানেন তাই কওমের লোকদের কর্তব্য হচ্ছে তাদের আদেশ মান্য করা এবং তাদের অনুসরণ করা।’
জ্ঞান-বিজ্ঞানের চিরন্তন উৎস আল-কুরআনের বিশাল জ্ঞানের ভাণ্ডার আলেমদের সিনায় সংরক্ষিত বলে কুরআনে ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
﴿ بَلۡ هُوَ ءَايَٰتُۢ بَيِّنَٰتٞ فِي صُدُورِ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَۚ ﴾ [العنكبوت: ٤٩]
‘বরং এটি হচ্ছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী, যা যাদেরকে ইলমের অধিকারী করা হয়েছে তাদের বক্ষে সংরক্ষিত।’ {সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৪৯}
কুরআনের ইলম আলোকবিচ্ছরণকারী নূর
﴿ وَلَقَدۡ جِئۡنَٰهُم بِكِتَٰبٖ فَصَّلۡنَٰهُ عَلَىٰ عِلۡمٍ هُدٗى وَرَحۡمَةٗ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ٥٢ ﴾ [الاعراف: ٥٢]
‘আর আমি তো তাদের নিকট এমন কিতাব নিয়ে এসেছি, যা আমি জেনেশুনে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। তা হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ এমন জাতির জন্য, যারা ঈমান রাখে।’ {সূরা আল-‘আরাফ, আয়াত: ৫২}
আয়াতের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মুফাসসির মুহাম্মাদ আমিন শানকিতী (রহ.) বলেন,
ولا شك أن هذا القرآن العظيم هو النور الذي أنزله الله إلى أرضه ليستضاء به فيعلم في ضوئه الحق من الباطل والحسن من القبيح والنافع من الضار والرشد من الغي
‘সন্দেহ নেই যে, এই কুরআনই হচ্ছে সেই নূর, যা আল্লাহ তা‘আলা ভূপৃষ্ঠকে আলোকময় করতে অবতীর্ণ করেছেন। যাতে সেই আলোর সাহায্যে হক ও বাতিল এবং ভালো ও মন্দ পার্থক্য করা যায়। ক্ষতি ও উপকারী বস্তু চেনা যায়। ভ্রান্তি থেকে সঠিক পথের দিশা পাওয়া যায়।’
ইলমকে আল্লাহ মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ লেবাস বলে অভিহিত করেছেন। যথা-
﴿ يَٰبَنِيٓ ءَادَمَ قَدۡ أَنزَلۡنَا عَلَيۡكُمۡ لِبَاسٗا يُوَٰرِي سَوۡءَٰتِكُمۡ وَرِيشٗاۖ وَلِبَاسُ ٱلتَّقۡوَىٰ ذَٰلِكَ خَيۡرٞۚ ذَٰلِكَ مِنۡ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ لَعَلَّهُمۡ يَذَّكَّرُونَ ٢٦ ﴾ [الاعراف: ٢٦]
‘হে বনী আদম, আমি তো তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকবে এবং যা সৌন্দর্যস্বরূপ। আর তাকওয়ার পোশাক, তা উত্তম। এগুলো আল্লাহর আয়াতসমূহের অন্তর্ভুক্ত। যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ {সূরা আল-‘আরাফ, আয়াত: ২৬}
কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, আলোচ্য আয়াতে লিবাস দ্বারা ইলম, রী-শা দ্বারা ইয়াকিন এবং লিবাসুত তাকওয়া দ্বারা লজ্জাশীলতা উদ্দেশ্য।
এসব আয়াত ছাড়াও আরো বহু আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইলম ও ইলমের বাহকদের প্রশংসা করেছেন। সেই সঙ্গে মূর্খতা ও ইলমহীনতার নিন্দাও করেছেন কুরআনের বহু জায়গায়।
মূর্খতার নিন্দা
মূর্খতা হচ্ছে আত্মার মৃত্যু এবং জীবন যবেহ ও হায়াত ধ্বংস করার নাম। কুরআনে মূর্খতা থেকে বেঁচে থাকতে এবং এর নিন্দা জ্ঞাপন করে ইরশাদ হয়েছে-
﴿ إِنِّيٓ أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ ٱلۡجَٰهِلِينَ ٤٦ ﴾ [هود: ٤٦]
‘আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, যেন মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত না হও।’ {সূরা হূদ, আয়াত: ৪৬}
শুধু তাই নয়; অন্য আয়াতে মূর্খতাকে মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যেমন-
﴿ أَوَ مَن كَانَ مَيۡتٗا فَأَحۡيَيۡنَٰهُ وَجَعَلۡنَا لَهُۥ نُورٗا يَمۡشِي بِهِۦ فِي ٱلنَّاسِ كَمَن مَّثَلُهُۥ فِي ٱلظُّلُمَٰتِ لَيۡسَ بِخَارِجٖ مِّنۡهَاۚ ﴾ [الانعام: ١٢٢]
‘যে ছিল মৃত, অতঃপর আমি তাকে জীবন দিয়েছি এবং তার জন্য নির্ধারণ করেছি আলো, যার মাধ্যমে সে মানুষের মধ্যে চলে, সে কি তার মত যে ঘোর অন্ধকারে রয়েছে, যেখান থেকে সে বের হতে পারে না?’ {সূরা আল-‘আনআম, আয়াত: ১২২}
পক্ষান্তরে ইলমকে বুদ্ধিমান লোকদের অন্তর্দৃষ্টিতা এবং প্রাণসঞ্জীবিনী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যে ইলম দ্বারা মৃতের জীবন সঞ্চার হয় এবং মানুষের মধ্যে চলাফেরা করতে পারে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইলম রাখে না সে অন্ধকারে চলমান ব্যক্তির মতো, যে কখনই ওই অন্ধকার থেকে নিস্তার পায় না।
বাহ্যিকদৃষ্টিতে মানুষ একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা করেই থাকে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এখানে একটি বিষয়ের প্রতি বান্দাকে আকৃষ্ট করেছেন যে, মানুষের সঙ্গে চলাফেরা এবং সামাজিকতা রক্ষা করার জন্য ইলম চাই। কুরআনী ইলম ছাড়া যত বড় শিক্ষা ও শিক্ষাবিদ থাকুক না কেন, কুরআন-হাদীছ ও ইসলামের পরিভাষায় তা মূর্খতা বৈ কিছু নয়। ইলম ও আখেরাতবিহীন জ্ঞান ও জ্ঞানের অধিকারীদেরকে আল্লাহ তা‘আলা চতুষ্পদ জন্তু কিংবা তার চেয়েও নিকৃষ্ট বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং স্বয়ং মহান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে মূর্খতার উপাধি পাওয়ার পর এদেরকে জ্ঞানী হিসেবে জাহির করা কতটুকু সঠিক?
কুরআনের এক আয়াতে যাদের কুরআনের জ্ঞান নেই তাদেরকে যাদের কুরআনের জ্ঞান আছে তাদের সঙ্গে তুলনা করতে বারণ করা হয়েছে এবং তারা পরস্পরে মর্যাদার দিক দিয়ে কখনই এক নয় বলে অভিহিত করা হয়েছে। যথা-
﴿ ۞أَفَمَن يَعۡلَمُ أَنَّمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ مِن رَّبِّكَ ٱلۡحَقُّ كَمَنۡ هُوَ أَعۡمَىٰٓۚ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ١٩ ﴾ [الرعد: ١٩]
‘যে ব্যক্তি জানে তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা নাযিল হয়েছে, তা সত্য, সে কি তার মত, যে অন্ধ? বুদ্ধিমানরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।’ {সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ১৯}
সুতরাং যারা পার্থিব জীবনের জ্ঞান ও ধন-সম্পদ নিয়ে অহমিকা করে তাদের বাহ্যিক সুখদর্শনে কারো বিভ্রান্ত ও বিচলিত হওয়া উচিত নয়। ওরা তো চতুষ্পদ জন্তুর মতো, যারা চারণভূমিতে পেটে যতদূর জায়গা হয় ততদূর খেয়ে থাকে। আর বাড়িতে যাওয়ার পর জায়গা হয় নোংরা গোয়াল ঘর কিংবা নিকৃষ্ট খোয়াড়ে। কিন্তু একজন মানুষ কি তাই? সে কি গরুর প্রচুর খাওয়া দেখে হিংসা বা ঈর্ষা করতে পারে? না মানায় তা?
অতএব মর্যাদা, গৌরব, অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্বের কিছু থাকলে তা ইলমের মধ্যেই নিহিত এবং যারা ইলম ধারণ করেছে তারা বাহ্যিকদৃষ্টিতে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল, গরীব ও অসহায় মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তারাই সফল, বিত্তবান এবং মর্যাদার অধিকারী।
ইলমের ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষের জাগতিক সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। দুনিয়ার যাবতীয় আসবাব-সম্পদ মৃতের জন্য অর্থহীন ও অকার্যকর প্রমাণিত হয়ে যায়। এমনকি জীবদ্দশার কৃত যাবতীয় ইবাদতের ছাওয়াবও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ইলম এমন এক ইবাদত, যার ধারাবাহিকতা কখনও শেষ হয় না। যেমন:
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মানুষ যখন মারা যায় তখন তিনটি আমল ছাড়া তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়। আমল তিনটি হচ্ছে চলমান সাদাকা, এমন ইলম, যা দ্বারা (অন্যরা) উপকৃত হয় তথা ইলমে নাফে‘ এবং নেক সন্তান, যে মৃতের জন্য দু‘আ করে।’ [মুসলিম: ১৬৩১]
একজন আলেমের প্রচার-প্রসারকৃত ইলম কেয়ামত পর্যন্ত তার আমলনামায় যুক্ত হওয়ার কথা অন্য হাদীছে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ مِمَّا يَلْحَقُ الْمُؤْمِنَ مِنْ عَمَلِهِ وَحَسَنَاتِهِ بَعْدَ مَوْتِهِ عِلْمًا عَلَّمَهُ وَنَشَرَهُ، وَوَلَدًا صَالِحًا تَرَكَهُ، وَمُصْحَفًا وَرَّثَهُ، أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ، أَوْ بَيْتًا لِابْنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ، أَوْ نَهْرًا أَجْرَاهُ، أَوْ صَدَقَةً أَخْرَجَهَا مِنْ مَالِهِ فِي صِحَّتِهِ وَحَيَاتِهِ، يَلْحَقُهُ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهِ»
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মৃত্যুর পর মুমিনের সঙ্গে যেসব আমল যুক্ত হবে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে ইলম, যা সে অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং যার প্রচার-প্রসার করেছে; পুণ্যবান সন্তান যে সে রেখে গিয়েছে; কুরআন যার সে উত্তরাধিকারী বানিয়েছে; মসজিদ যা সে বানিয়েছে; মুসাফিরদের আশ্রয়কেন্দ্র যা সে নির্মাণ করেছে; নদী যা সে খনন করেছে এবং সাদাকা যে সে নিজ জীবদ্দশায় ও সুস্থতাকালে আপন সম্পদ থেকে দান করেছে- এসব তার মৃত্যুর পর তার সঙ্গে যুক্ত হবে।’ [ইবন মাজাহ্‌: ২৪২; সহীহ ইবন খুযাইমা: ২৪৯০, শায়খ আলবানী হাদীছটিকে হাসান বলেছেন]
ইলমের পথকে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান, দামি ও জান্নাতের পথ বলে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: « وَمَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ »
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (দীর্ঘ হাদীছের অংশ) ‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’ [মুসলিম: ২৬৯৯]
কুরআন ও ইলমের মজলিসকে আল্লাহ তা‘আলার রহমত অবতীর্ণ হওয়ার কেন্দ্র বলে সুষ্পষ্ট ঘোষণা এসেছে। এ হাদীছেরই পরের অংশে বর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِى بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ
‘আল্লাহর যে ঘরে মানুষ একত্রিত হয় এবং তাঁর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং পরস্পরে ইলমের দরসে লিপ্ত হয় সেই ঘরে রহমত অবতীর্ণ হয়, ফেরেশতারা সেই ঘরকে বেষ্টন করে নেন এবং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আশেপাশে যারা আছেন (ফেরেশতারা) তাদের কাছে তাদের প্রশংসা করেন। [মুসলিম: ২৬৯৯]
পৃথিবীর এমন কে আছে, যাদের পায়ের নিচে ফেরেশতাদের মতো মহাসম্মানিত ও নিষ্পাপ মাখলুক নিজেদের পাখা বিছিয়ে দেন? হ্যাঁ, মহাসম্মানিত এই বান্দাগণ একমাত্র ইলমের বাহক ওলামায়ে কেরাম এবং তালেবে ইলমের পায়ের নিচে নিজেদের পাখা বিছিয়ে দেন। শুধু কি তাই? দিগন্তবিস্তৃত প্রাণীকুল, আসমানের ফেরেশতা, সমুদ্রের মাছ, গর্তের পিপিলিকা, ভূপৃষ্ঠে চলমান প্রতিটি প্রাণীই আলেম এবং তালেবে ইলমের জন্য মাগফিরাতের দু‘আ করতে থাকে! এই বিরল সম্মান কীসের ফসল? ইলমের ফসল। যেমন:
عَنْ كَثِيرِ بْنِ قَيْسٍ، قَالَ: كُنْتُ جَالِسًا عِنْدَ أَبِي الدَّرْدَاءِ فِي مَسْجِدِ دِمَشْقَ، فَأَتَاهُ رَجُلٌ، فَقَالَ: يَا أَبَا الدَّرْدَاءِ، أَتَيْتُكَ مِنَ الْمَدِينَةِ، مَدِينَةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؛ لِحَدِيثٍ بَلَغَنِي أَنَّكَ تُحَدِّثُ بِهِ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ: فَمَا جَاءَ بِكَ تِجَارَةٌ؟ قَالَ: لَا، قَالَ: وَلَا جَاءَ بِكَ غَيْرُهُ؟ قَالَ: لَا، قَالَ: فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ، وَإِنَّ طَالِبَ الْعِلْمِ يَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ، حَتَّى الْحِيتَانِ فِي الْمَاءِ »
‘কাছীর ইবন কায়স থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, দামেশকের মসজিদে আমি আবূদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে বসা ছিলাম। তাঁর কাছে জনৈক ব্যক্তি আগমন করে বললেন, হে আবূদ্দারদা! আমি মদীনা শহর থেকে আপনার কাছে এসেছি একথা জেনে যে, আপনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শোনা একটি হাদীছ বর্ণনা করে থাকেন। আমি অন্য কোনো প্রয়োজনে আসিনি, কেবল সেই হাদীছটি শ্রবণ করতে এসেছি। আবূদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, তুমি ব্যবসায়ীক বা অন্য কোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আগমন করনি? একমাত্র একারণেই তুমি সফর করে এসেছ? লোকটি বললেন, হ্যাঁ। একমাত্র একারণেই এখানে এসেছি। তখন তিনি বললেন, তবে শুনে রেখো, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের জন্য বের হয় আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন। ফেরেশতারা তার সম্মানে নিজেদের পাখা বিছিয়ে দেয়। আলেমের জন্য আসমান-জমিনের সবাই দু‘আ করতে থাকে। এমনকি সাগর ও খাল-বিলের মাছও তার জন্য দু‘আ করতে থাকে…। [ইবন মাজাহ: ২২৩; সহীহ]
জগদ্বাসীর চন্দ্র ও আসমানবাসীর চন্দ্র
রাতের সৌন্দর্য কোন্ বস্তুতে নিহিত? কাব্য-কবিতায়, উপমা-উৎপ্রেক্ষায় কোন্ বস্তু বেশি ব্যবহৃত হয়? পূর্ণিমার চাঁদ এবং চাঁদের আলো! কবি-গল্পকারদের কবিতা ও গল্প যেন চাঁদের রশ্মি ছাড়া আলোই ছড়ায় না! পূর্ণিমার রাতের স্নিগ্ধ আলোর মোহনীয় দৃশ্য মানসপটে গভীর প্রভাব ফেলে না- এমন লোকের অস্তিত্ব বোধ হয় সারাবিশ্বে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছোটো-বড় সকলের কাছে চাঁদ এবং চাঁদের আলো প্রিয় এবং উপমাযোগ্য। জগদ্বাসীর কাছে যদি চাঁদ এবং চাঁদের কদর এত থাকে, তবে আসমানবাসী এবং স্বয়ং আসমান-জমিনের অধিপতির কাছে চাঁদের আলোর চেয়েও আকর্ষণীয় বস্তু আছে। তা হচ্ছে ইলম এবং ইলমধারী ওলামায়ে কেরাম। হাদীছের পরের অংশে সে কথাই বলা হয়েছে:
وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ
‘আবেদের ওপর আলেমের মর্যাদা তেমন, যেমন নক্ষত্ররাজির ওপর পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা।’ [ইবন মাজাহ: প্রাগুক্ত]
সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদের উত্তরাধিকার
মানুষ পরবর্তীদের জন্য সম্পদ জমা করে যায়, ওয়ারিস হিসেবে রেখে যায়, পরবর্তীরা পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার লাভ করে ধন্য হয়, গৌরববোধ করে। কেউ বংশীয় সূত্রে জমিদারী পায়, কেউ পায় সিংহাসন, কেউ পায় পদ-পদবী এবং কেউবা অঢেল সম্পদ। কিন্তু মহান আল্লাহ তা‘আলার কাছে এগুলোর কী-ইবা মূল্য আছে! বিশ্বের সব মানুষের কাছে এবং স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার দৃষ্টিতে মহা নেয়ামত এবং মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে নবুওয়াত। এই নেয়ামত যোগ্যতা বলে কিংবা হাজারও প্রচেষ্টায় হাসিল করা সম্ভব নয়। তা নেহায়তই আল্লাহ তা‘আলার কৃপা ও দান। তিনি লক্ষ-কোটি মানুষের মধ্যে থেকে মাত্র এক লাখ চব্বিশ হাজার মানুষকে এই মহান নেয়ামতের জন্য নির্বাচিত করেছেন এবং সর্বশেষ নবী রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের মধ্য দিয়ে চির গৌরবের এই নেয়ামত লাভের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার সবিশেষ করুণা এই যে, এই ধারা বন্ধ হয়ে গেলেও এর রহমতের ছায়া সচল রয়েছে। কেয়ামত পর্যন্ত একশ্রেণীর মানুষকে তিনি নবুওয়াতের রহমতের ছায়ায় আশ্রিত করবেন। আশ্রিতরা হবেন ওলামায়ে কেরাম এবং রহমতের ছায়াটি হচ্ছে ইলম। পৃথিবীতে এরচেয়ে শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার এবং শ্রেষ্ঠ ছায়া দ্বিতীয়টি নেই। যেমন একই হাদীছের শেষাংশে বলা হয়েছে,
وَ إِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلَا دِرْهَمًا، إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ
‘আলেমগণ হলেন নবীগণের ওয়ারিছ। আর নবীগণ ধনসম্পদের মীরাছ রেখে যান না, বরং পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ইলমের মীরাছ রেখে যান। সুতরাং যে ব্যক্তি এই মহামূল্যবান মীরাছ গ্রহণ করল সে বিরাট মূল্যবান বস্তু গ্রহণ করল।’ [ইবন মাজাহ: প্রাগুক্ত]
আল্লাহ তা‘আলা মাখলুকের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দান করেছেন প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। আর আলেমদের করেছেন সাধারণ আবেদের তুলনায় রাসূলের মতো মহামান্বিত। যেমন:
عَنْ أَبِي أُمَامَةَ البَاهِلِيِّ، قَالَ: ذُكِرَ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلَانِ أَحَدُهُمَا عَابِدٌ وَالآخَرُ عَالِمٌ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «فَضْلُ العَالِمِ عَلَى العَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ. » ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ اللَّهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالأَرَضِينَ حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتَّى الحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الخَيْرَ»
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দুইজন ব্যক্তির কথা আলোচনা করা হলো। একজন আবেদ আর অপরজন আলেম। জবাবে তিনি বললেন, ওই দুইজনের মধ্যে আলেমের মর্যাদা তেমন সুউচ্চ, যেমন আমার মর্যাদা একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে সুউচ্চ। এরপর তিনি বললেন, স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা আলেমের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতা, আসমান ও জমিনবাসী, এমনকি গর্তের পিপিলিকা এবং সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত আলেমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।’ [তিরমিযী: ২৬৮৫]
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইলমকে নেতৃত্ব ও মর্যাদার মাপকাঠি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِنَّ النَّاسَ لَكُمْ تَبَعٌ، وَإِنَّ رِجَالًا يَأْتُونَكُمْ مِنْ أَقْطَارِ الأَرَضِينَ يَتَفَقَّهُونَ فِي الدِّينِ، فَإِذَا أَتَوْكُمْ فَاسْتَوْصُوا بِهِمْ خَيْرًا»
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুনিয়ার মানুষ তোমাদের অনুসারী। আর তোমাদের কাছে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে লোকেরা আসবে দীন শেখার জন্য। সুতরাং তারা যখন তোমাদের কাছে আসবে তখন তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে।’ [তিরমিযী: ২৬৫০][1]
ইলম জগতের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
মানুষ আজ সারাবিশ্বে জুড়ে খনিজ সম্পদ ও অর্থকড়ির জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত সম্পদ ও মূল্যবান বস্তু আসলে কোনটি? স্থুলদৃষ্টির মানুষের সংজ্ঞায় তা সংজ্ঞায়িত না করে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানে এর সংজ্ঞা দেওয়া যাক। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْكَلِمَةُ الْحَكِيمَةُ ضَالَّةُ الْحَكِيمِ حَيْثُ مَا وَجَدَهَا فَهُوَ أَحَقُّ بِهَا»
‘হেকমত ও ইলমের একটি কথা জ্ঞানীর জন্য হারানো মূল্যবান সম্পদের মতো। সুতরাং যেখানে পায় সেখান থেকেই যেন সে তা সংগ্রহ করে নেয়।’ [বাইহাকী: ৪১২, যঈফ]
নারী-পুরুষ সকলেই ইলম অন্বেষণে আদিষ্ট
ইলমের এই মর্যাদা লাভের জন্য শুধু পুরুষরাই নয় বরং নারীরাও আদিষ্ট। সকলের জন্য এই মর্যাদা এবং সকলের জন্য তা অপরিহার্য। যেমন:
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ »
‘আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ইলম অন্বেষণ করা প্রতিটি মুসলিমের ওপর ফরয।’ [ইবন মাজাহ: ২২৪, সহীহ] হাদীছের ব্যাখ্যাকারীগণ লিখেছেন,
وبلا ريب لفظ (مسلم) يدخل فيه أيضا (المسلمة). أما الحديث الذي فيه زيادة (ومسلمة) فهي زيادة ضعيفة، وعموم اللفظ الأول يغني عن الضعيف
‘নিঃসন্দেহে মুসলিম مسلم (পুরুষ) শব্দটি المسلمة মুসলিমা (নারী) কেও শামিল করে। অর্থাৎ এই বিধান পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীর জন্য সমানহারে প্রযোজ্য। আর কোনো কোনো হাদীছে المسلمة শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে এটি দুর্বল তথা অপ্রয়োজনীয় সংযোজন। কেননা ‘মুসলিম’ শব্দটিই এটার প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে দেয়।’
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুসাফির
আল্লাহ তা‘আলার নিকট জিহাদ অত্যন্ত প্রিয় আমল। জিহাদের রাস্তার ধূলোবালিকে তিনি জাহান্নামের প্রতিবন্ধক বানিয়েছেন এবং এই পথের পথিককে দিয়েছেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পথিকের মর্যাদা। এই রাস্তার মুসাফিরের ধূলোবালি আর জাহান্নামের আগুন একত্রিত হওয়াকে তিনি হারাম করেছেন। ইলম অন্বেষণের রাস্তাকেও তিনি সেই মর্যাদাই দিয়েছেন এবং ইলম অন্বেষী ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত ঘরে না ফেরে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে জিহাদের রাস্তায় থাকারই ছাওয়াব দান করেন। হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ خَرَجَ فِي طَلَبِ الْعِلْمِ فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ حَتَّى يَرْجِعَ»
‘আনাছ ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের জন্য বের হয় সে আল্লাহর রাস্তায় থাকে, যাবত না সে ফিরে আসে।’ [জামে তিরমিযী: ২৬৪৭[2]]
মানুষ অন্যকে কোনো সাফল্য পেতে দেখলে আফসোস করে, ঈর্ষা করে, হিংসা করে এবং নিজে সে সব সাফল্য পেতে চায়, মনেপ্রাণে তা কামনা করে। শরীয়তের দৃষ্টিতে হিংসা ও লোভ-লালসা নিষিদ্ধ এবং তা কঠোর গুনাহের কাজ। কিন্তু ইলম এমন এক মূল্যবান সম্পদ, যা অন্যকে হাসিল করতে দেখলে শুধু আফসোস করা নয়, বরং তা লাভের জন্য রীতিমতো ঈর্ষা করাও জায়েয! সহীহ বুখারী ও মুসলিমে যেমন বর্ণিত হয়েছে:
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-: لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِى اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ أَتَاهُ اللَّهُ مَالاً فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ فِى الْحَقِّ وَرَجُلٌ أَتَاهُ اللَّهُ حِكْمَةً فَهُوَ يَقْضِى بِهَا وَيُعَلِّمُهَا
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দু’টি ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে ঈর্ষা করা বৈধ নয়। এক. ওই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন আর সে তা হকের পথে ব্যয় করে এবং দুই. ওই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ ইলম দিয়েছেন, যা দ্বারা সে বিচারকার্য পরিচালনা করে এবং এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়।’ [বুখারী: ৭১৪১; মুসলিম: ৮৫০]
ইলমের সামগ্রিক চিত্র ও হাকীকত
মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর এক হাদীছে ইলমের একটি সর্বাঙ্গীন চিত্র ও ব্যাখ্যা ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন,
«تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ؛ فَإِنَّ تَعْلِيمَهُ لِلَّهِ خَشْيَةً وَطَلَبَهُ عِبَادَةً، وَمُذَاكَرَتَهُ تَسْبِيحٌ وَالْبَحْثَ عَنْهُ جِهَادٌ، وَتَعْلِيمَهُ لِمَنْ لَا يَعْلَمُهُ صَدَقَةٌ، وَبَذْلَهُ لِأَهْلِهِ قُرْبَةٌ؛ لِأَنَّهُ مَعَالِمُ الْحَلَالِ وَالْحَرَامِ وَمَنَارُ سُبَلِ أَهْلِ الْجَنَّةِ وَهُوَ الْأُنْسُ فِي الْوَحْشَةِ وَالصَّاحِبُ فِي الْغُرْبَةِ وَالْمُحَدِّثُ فِي الْخَلْوَةِ، وَالدَّلِيلُ عَلَى السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ، وَالسِّلَاحُ عَلَى الْأَعْدَاءِ، وَالزَّيْنُ عِنْدَ الْأَخِلَّاءِ، يَرْفَعُ اللَّهُ بِهِ أَقْوَامًا فَيَجْعَلُهُمْ فِي الْخَيْرِ قَادَةً وَأَئِمَّةً يُقْتَصُّ آثَارُهُمْ، وَيُقْتَدَى بِأَفْعَالِهِمْ وَيُنْتَهَى إِلَى رَأْيِهِمْ، تَرْغَبُ الْمَلَائِكَةُ فِي خُلَّتِهِمْ وَبِأَجْنِحَتِهَا تَمْسَحُهُمْ يَسْتَغْفِرُ لَهُمْ كُلُّ رَطْبٍ وَيَابِسٍ، وَحِيتَانُ الْبَحْرِ وَهَوَامُّهُ وَسِبَاعُ الْبَرِّ وَأَنْعَامُهُ؛ لِأَنَّ الْعِلْمَ حَيَاةُ الْقُلُوبِ مِنَ الْجَهْلِ وَمَصَابِيحُ الْأَبْصَارِ مِنَ الظُّلَمِ يَبْلُغُ الْعَبْدُ بِالْعِلْمِ مَنَازِلَ الْأَخْيَارِ وَالَدَّرَجَاتِ الْعُلَا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، وَالتَّفَكُّرُ فِيهِ يَعْدِلُ الصِّيَامَ وَمُدَارَسَتُهُ تَعْدِلُ الْقِيَامَ، بِهِ تُوصَلُ الْأَرْحَامُ، وَبِهِ يُعْرَفُ الْحَلَالُ مِنَ الْحَرَامِ، وَهُوَ إِمَامٌ وَالْعَمَلُ تَابِعُهُ يُلْهَمُهُ السُّعَدَاءُ وَيُحْرَمُهُ الْأَشْقِيَاءُ» ، هَكَذَا حَدَّثَنِيهِ أَبُو عَبْدِ اللَّهِ عُبَيْدُ بْنُ مُحَمَّدٍ رَحِمَهُ اللَّهُ مَرْفُوعًا بِالْإِسْنَادِ الْمَذْكُورِ وَهُوَ حَدِيثٌ حَسَنٌ جِدًّا وَلَكِنْ لَيْسَ لَهُ إِسْنَادٌ قَوِيٌّ
‘তোমরা ইলম শিক্ষা করো, কেননা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য ইলম তলব করা আল্লাহভীতি এবং ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। ইলমের আলোচনা করা তাসবীহ এবং বাহাছ করা জিহাদের মতো। অজ্ঞকে শিক্ষা দেওয়া দান-সদকার মতো। যোগ্য লোকদের মধ্যে তা বিতরণ করা নৈকট্য লাভের মাধ্যম। কেননা ইলম হচ্ছে হালাল-হারামের মাপকাঠি। জান্নাতীদের পথের আলো। ইলম একাকিত্বের সঙ্গী, নিঃসঙ্গতার বন্ধু, নির্জনতায় গল্পের সঙ্গী। সুখ-দুঃখের দলিল। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র, বন্ধু-বান্ধবদের সামনে অলঙ্কার। আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমে একদল লোককে সম্মানিত করেন, ফলে তারা সমাজের নেতৃত্ব লাভ করে। তারা পথপ্রদর্শক হয়, যেই পথ অনুসরণ করে সাধারণ মানুষ পথ চলে। ফেরেশতাদের মজলিসে তাদের আলোচনা করা হয় এবং ফেরেশতাগণ সম্মান প্রদর্শনের জন্য তাদের পায়ের নিচে নিজেদের পাখা বিছিয়ে দেন। জীব-জড় এবং জলভাগ-স্থলভাগ সবশ্রেণীর মাখলুক ইলমওয়ালার জন্য মাগফেরাতের দু‘আ করেন। এমনকি সমুদ্রের মাছ এবং ভূমির কীটপতঙ্গ ও হিংস্র জন্তু-দানব! কেননা ইলম হচ্ছে মূর্খতা থেকে জীবন সঞ্চারণকারী। গভীর অন্ধকারের প্রখর উজ্জ্বল বাতি। ইলম বান্দাকে দুনিয়া-আখেরাতে মর্যাদার উচ্চ আসনে নিয়ে যায়। ইলম বিষয়ে ফিকির করা সাওম পালনের মতো। ইলমের দরস দেওয়া রাত্রি জাগরণ করে সালাত আদায় করার মতো। ইলমের দ্বারা আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। এর দ্বারাই হালাল-হারামের সুস্পষ্ট জ্ঞান হাসিল হয়। ইলম হচ্ছে ইমাম এবং আমল হলো তার মুক্তাদী। ভাগ্যবানরা ইলম লাভে ধন্য হয় আর হতভাগ্যরা এ থেকে বঞ্চিত হয়।’ [ইবন আবদুল বার (রহ.), জামে বয়ানুল ইলম, বর্ণনা নং ২৬৪]
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন ঘটেছিল একজন মুআল্লিম হিসেবে। তিনি ইরশাদ করেন-
« وَإِنَّمَا بُعِثْتُ مُعَلِّمًا»
‘আমি তো একজন শিক্ষক হিসেবে দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছি।’ [ইবন মাজাহ: ২২৯[3]]
ইলম অন্বেষণ অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে ফযীলতপূর্ণ
ইলম হাসিলের কাজে লিপ্ত থাকা নফল ইবাদতে মশগুল থাকার চেয়ে বেশি মর্যাদার। কেননা ইলম মানুষকে আল্লাহর ভয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পন্থা শেখায়। হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ أَوْحَى إِلَيَّ أَنَّهُ مَنْ سَلَكَ مَسْلَكًا فِي طَلَبِ الْعِلْمِ سَهَّلْتُ لَهُ طَرِيقَ الْجَنَّةِ وَمَنْ سَلَبْتُ كَرِيمَتَيْهِ أَثَبْتُهُ عَلَيْهِمَا الْجَنَّةَ. وَفَضْلٌ فِي عِلْمٍ خَيْرٌ مِنْ فَضْلٍ فِي عِبَادَةٍ وَمِلَاكُ الدِّينِ الْوَرَعُ» .
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার নিকট এই মর্মে ওহী প্রেরণ করেন, যে ব্যক্তি ইলম তলবের পথ গ্রহণ করে আমি তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দিই। আর আমি যার উভয় চোখের দৃষ্টি কেড়ে নেই, তাকে উভয়ের বদলা দেব জান্নাতে। ইলম অন্বেষণের ফযীলত ইবাদতে লিপ্ত থাকার ফযীলতের চেয়ে বেশি। আর দীনের মূল হচ্ছে আল্লাহভীতি। [বায়হাকী: ৫৩৬৭, সহীহ]
ইলমের ফযীলত সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের অভিব্যক্তি
আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
العالم أفضل من الصائم القائم المجاهد، وإذا مات العالم ثلم في الإسلام ثلمة لا يسدها إلا خلف منه
‘একজন আলেম রোজাদার, তাহাজ্জুদের জন্য রাত্রি জাগরণকারী এবং আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদের চেয়ে উত্তম। যখন একজন আলেম মারা যান যখন ইসলামের গায়ে একটি ছিদ্র ও দাগ পড়ে। যা অপরজন তার স্থান পূরণ না করার আগ পর্যন্ত ভরাট হয় না।’ তিনি আরো বলেন,
العلم خير من المال، العلم يحرسك وأنت تحرس المال، العلم يُكسِبُ العالم الطاعة في حياته وجميل الأحدوثة بعد موته، وصنيعة المال تزول بزواله، مات خزّان المال وهم أحياء
‘ইলম সম্পদের চেয়ে উত্তম। কেননা ইলম তোমাকে পাহারা দেয় আর তুমি পাহারা দাও সম্পদকে। আলেম ব্যক্তির জীবনে ইলম নিয়ে আসে মানুষের আনুগত্য, আর মৃত্যুর পর তাকে সবাই উত্তমভাবে স্মরণ করে। আর মালের মালিক মারা গেলে মালও তার হাতছাড়া হয়ে যায়। বরং, মালের মালিকরা জীবিত হলেও মৃত থেকে যায়।’
ইলম হাসিল হলে দুনিয়ার সব কিছু হাসিল হয়। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
خُيِّر سليمان بن داود عليهما السلام بين العلم والمال والملك فاختار العلم فأعطي المال والملك معه
‘সুলায়মান ইবন দাঊদ ‘আলাইহিমাসসালামকে ইলম, সম্পদ ও রাজত্ব- এই তিনটি বস্তুর যে কোনো একটি গ্রহণের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। তিনি ইলম এখতিয়ার করেছিলেন। কিন্তু এর বদৌলতে সম্পদ ও রাজত্বও হাসিল হয়েছিল।’
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এবং আহমাদ (রহ.) বলতেন,
تذاكر العلم بعض ليلة أحب إلي من إحيائها
‘রাতের কিছু অংশে ইলমের আলোচনা করা আমার কাছে সারারাত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করার চেয়েও প্রিয়।’
উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
يا أيها الناس عليكم بالعلم فإن لله سبحانه رداء يحبه فمن طلب بابا من العلم رداه الله عز وجل بردائه فإن أذنب ذنبا استعتبه ثلاث مرات لئلا يسلبه رداءه ذلك وإن تطاول به ذلك الذنب حتى يموت
‘হে লোক সকল! তোমরা ইলম গ্রহণ করো। কেননা আল্লাহ তা‘আলার একটি চাদর আছে, যা তিনি পছন্দ করেন। যে ব্যক্তি ইলমের কোনো দরজা অন্বেষণ করে আল্লাহ তা‘আলা তাকে নিজ চাদরে আশ্রয় দেন। যদি সে কোনো গুনাহ করে, তাকে তিনবার এর শাস্তি থেকে সতর্ক করে যেন তার থেকে নিজ চাদর ছিনিয়ে নেওয়া না হয়। যদিও এ গুনাহ আমৃত্যু দীর্ঘায়িত হয়।’
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন,
ذللت طالبا فعززت مطلوبا
‘ইলম অন্বেষণের সময় তুচ্ছ থেকেছি ফলে উস্তাদ হয়ে সম্মানিত হয়েছি।’
আবূদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
لأن أتعلم مسألة أحب إلي من قيام ليلة
‘একটি মাসআলা শিক্ষা করা আমার দৃষ্টিতে ইবাদতের জন্য সারারাত জাগ্রত থাকার চেয়ে শ্রেয়।’
উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
موت ألف عابد قائم الليل صائم النهار أهون من موت عالم بصير بحلال الله وحرامه
‘রাত্রি জাগরণকারী এবং সাওম পালনকারী এক হাজার আবেদের মৃত্যুর চেয়ে আল্লাহ তা‘আলার হালাল-হারামের জ্ঞান রাখা একজন আলেমের মৃত্যু অনেক বেশি ভারি।’
আবূদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আরো বলতেন,
من رأى أن الغدو إلى طلب العلم ليس بجهاد فقد نقص في رأيه وعقله
‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের জন্য বের হওয়াকে জিহাদ বলে মনে করে না তার চিন্তা ও বিবেকের ঘাটতি আছে।’
ইলমের প্রচারকের ফযীলত বর্ণনা করে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
من حدث حديثا فعمل به فله مثل أجر من عمل ذلك العمل
‘যে ব্যক্তি অন্যের কাছে একটি হাদীছ বর্ণনা করল আর সে ব্যক্তি সে অনুযায়ী আমল করল তবে বর্ণনাকারীও সমপরিমাণ ছাওয়াব লাভ করবে।’
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন,
عليكم بالعلم قبل أن يرفع ورفعه موت رواته
‘ইলম উঠে যাওয়ার আগেই তা শিক্ষা কর। আর এর উঠে যাওয়ার অর্থ বর্ণনাকারীর মৃত্যু ঘটা।’
আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কুমাইলকে লক্ষ্য করে বলতেন,
يا كميل، العلم خير من المال، العلم يحرسك وأنت تحرس المال، والعلم حاكم والمال محكوم عليه، والمال تنقصه النفقة والعلم يزكو بالإنفاق
‘হে কুমাইল! ইলম সম্পদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ইলম তোমাকে পাহারা দেয় আর সম্পদকে তোমার পাহারা দিতে হয়। ইলম শাসক, পক্ষান্তরে সম্পদ প্রজা। সম্পদ খরচ করলে কমে যায় কিন্তু ইলম খরচ করলে তা বৃদ্ধি পায়।’
ইলমের দাবী করাও গৌরবের বিষয়
মানুষ সাধারণত ওইসব বস্তুর দাবি করা এবং তা নিজের মধ্যে থাকাকে গৌরবের মনে করে যা অমূল্য ও সর্বজন প্রশংসনীয়। এই হিসেবে ইলম পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তু। একারণেই দুনিয়ার কেউই ‘নিজে জাহেল’ একথা স্বীকার করতে চায় না এবং কেউ তাকে জাহেল বলুক তাও পছন্দ করে না। কেউ তাকে ‘জাননেওয়ালা’ কিংবা ‘ইলমওয়ালা’ বললে খুশি হয়। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
كفى بالعلم شرفاً أن يدعيه من لا يحسنه ويفرح به إذا نسب إليه وكفى بالجهل ذمّاً أن يتبرأ منه من هو فيه
‘ইলমের মর্যাদা বুলন্দ হওয়ার জন্য এটাই বড় আলামত, যে কেউ ইলম রাখে না সেও ইলমের সঙ্গে সম্বোধিত হলে খুশি হয়। আর মূর্খতার নীচতার প্রমাণ এই, যার মধ্যে এই মূর্খতা আছে সেও এ থেকে পানাহ চায় এবং মূর্খতার নামে সম্পৃক্ত হওয়া অপছন্দ করে।’
ইলমের মজলিসই প্রকৃত সম্পদের মজলিস
দুনিয়ার মানুষ চোখে মোটা চশমার ফ্রেম পরায় দেখতে পায় না কোনটা মূল্যবান সম্পদ আর কোনটা মূল্যহীন এবং নগণ্য সম্পদ। একারণেই পার্থিব জগতের সাফল্যকে বড় করে দেখে এবং আখিরাতের অফুরন্ত সম্পদ ও নেয়ামত বেমালুম ভুলে যায়। অথচ অফুরন্ত নিয়ামত ও মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে আখিরাতের সম্পদ। আর আখিরাতের নিয়ামত ও মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে ইলম। একারণেই ইলমের মজলিসকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদের মজলিস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে হাদীছের কিতাবে। যেমন:
جاء أبو هريرة رضي الله عنه إلى أهل السوق و هم يتبايعون و يتشارَون ، فقال: ” أنتم هاهنا و ميراث النبي صلى الله عليه و سلم يُقسَم في المسجد ؟ ” فتركوا بضائعهم و ذهبوا يتراكضون إلى المسجد ، فدخلوا و ما وجدوا إلا حلقةً هنا تعلِّم التفسير ، و أخرى تعلِّم الحديث ، فرجعوا و قالوا: يا أبا هريرة غفر الله لك ، ما رأينا شيئاً ! ، قال: أوَ ذهبتم ؟ قالوا: نعم ، قال: فماذا رأيتم ؟ قالوا: رأينا قوما يعلِّمونَ القرآن و قوماً يعلِّمون التفسير وقوماً يعلِّمون الحديث ! قال: و هل ميراثُ رسول الله صلى الله عليه و سلم إلا هذا؟
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একবার বাজারে গেলেন এবং লোকদেরকে সম্বোধন করে বললেন, তোমরা এখনো এখানে? অথচ মসজিদে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মীরাছ বণ্টন হচ্ছে! তার কথায় লোকেরা বাজার ছেড়ে মসজিদ পানে ছুটে গেলেন। কিন্তু তারা সেখানে গিয়ে দেখলেন কোথাও তাফসীরের মজলিস হচ্ছে, কোথাও হাদীছের দরস হচ্ছে। ফলে তারা মসজিদ থেকে বেরিয়ে পড়লেন এবং আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সঙ্গে দেখা হলে বললেন, আবূ হুরায়রা! আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে ক্ষমা করুন। আমরা তো আপনার কথার সত্যতা দেখতে পেলাম না! আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, তবে তোমরা সেখানে কী দেখেছ? তারা বললেন, আমরা একদল লোককে কুরআনের, আরেকদলকে হাদীছের দরসে লিপ্ত দেখলাম। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, এটাই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মীরাছ।’
পৃথিবীর একটি বস্তুর চাহিদার সমাপ্তি নেই
পৃথিবীর সব বস্তুর চাহিদা ও বাসনা একটা পর্যায়ে গিয়ে শেষ হয়ে যায়। আকর্ষণ ও আগ্রহ কমে যায়। কিন্তু ইলম এমন বস্তু যার আকর্ষণ ও চাহিদা কখনও নিঃশেষ হয় না। কাতাদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
لو كان أحد يكتفي من العلم بشئ لاكتفي موسى عليه السلام ولكنه قال للخضر عليه السلام: (هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا)
‘যদি ইলমের চাহিদা শেষ হতো তবে (সর্বপ্রথম) মূসা (আ.)-এর চাহিদা শেষ হতো। কিন্তু তিনি খিজির (আ.)-কে বললেন, আমি কি আপনার অনুসরণ করতে পারি, যাতে আপনি আমাকে ইলম শিক্ষা দেন?’
ইলমের এই সীমাহীন মর্যাদা, ফযীলত ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণে সাহাবায়ে কেরাম তাদের প্রতিযোগিতার বিষয় বানিয়েছিলেন ইলম। আজ আমরা যেমন পার্থিব বস্তুসামগ্রী হাসিল করতে পরস্পর প্রতিযোগিতা করি তারা সেরূপ করতেন না। কে কত বেশি আমল ও ইলম হাসিল করতে পারেন তারা সেই প্রতিযোগিতাই করতেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ গ্রহণের আদেশ করেছেন। তবে আমাদের কি উচিত নয় তাদের আদর্শ গ্রহণ করে ইলমের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া?
উম্মতের সম্মানিত পূর্বসূরী আলেমগণের দৃষ্টিতে ইলম
ইমাম মালেক (রহ.)-এর বিখ্যাত শাগরেদ ইবন ওয়াহাব (রহ.) বলেন, ‘আমি একদিন ইমাম মালেক (রহ.)-এর মজলিসে বসা ছিলাম। সে সময় মুআযযিন আযান দিলে আমি কিতাবপত্র গুছিয়ে সালাতের দিকে রওয়ানা হওয়ার উদ্যোগ করলাম। তখন ইমাম মালেক (রহ.) বললেন-
على رسلك ! ترفَّق ليس الذي تقوم إليه – يعني من التنفل قبل الفريضة – بأفضل مما تقوم عنه إذا صحَّت النية
‘একটু দাঁড়াও। মনে রেখো, যে উদ্দেশ্যে (ফরযের পূর্বের নফল সালাত) যাচ্ছো, তা যা থেকে যাচ্ছো তা থেকে উত্তম নয়; যদি নিয়ত সহীহ থাকে।’
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলতেন,
طلب العلم أفضل من النافلة
‘ইলম তলব করা নফল সালাতের চেয়ে উত্তম।’
পূর্বসূরীগণ ইলমকে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় বলে আকীদা রাখতেন। শায়খ আব্দুর রহমান ইবন সাদী (রহ.) বলেন,
أن أهل السنة والجماعة يتقربون إلى الله – تعالى – بتوقير العلماء وتعظيم حُرمتهم
‘আহলে সুন্নাত ওয়ালজামাত ওলামায়ে কেরামের সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করতেন।’
হাসান বসরী (রহ.) বলেন,
كانوا يقولون: موت العالم ثلمة في الإسلام لا يسدها شيء ما اختلف الليل والنهار
‘পূর্বসূরীগণ এই বিশ্বাস রাখেন, একজন আলেমের মৃত্যু ইসলামের দেহ ছিদ্র হয়ে যাওয়ার ন্যায়। দিনরাতের পরিবর্তন যা ভরাট করতে পারে না।’
তিনি আরো বলতেন,
لموت قبيلة أيسر من موت عالم
‘একটি গোত্রের সকলের মৃত্যু একজন আলেমের মৃত্যুর চেয়ে অনেক সহজ।’
বিখ্যাত তাবে‘ঈ ইমাম যুহরী (রহ.) বলতেন,
ما عُبدَ الله بشيءٍ أفضلَ من العلم
‘ইলমের চেয়ে উত্তম কোনো ইবাদত নেই।’
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলতেন,
من شرف العلم أن كل من نسب إليه ولو في شيء حقير فرح ومن رفع عنه حزن
‘ইলমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং শ্রেষ্ঠত্ব এখানে যে, যার সঙ্গেই ইলম সম্পৃক্ত হয়-যদিও তা তুচ্ছ বিষয়ের ইলম হোক না কেন- আনন্দিত ও গৌরবান্বিত হয়। আর যার থেকে ইলম উঠিয়ে নেওয়া হয় সে পেরেশান হয়।’
আহনফ (রহ.) বলতেন,
كل عز ولم يؤيد بعلم فإلى ذل مصيره
‘যে ইজ্জত ইলমকেন্দ্রিক নয়, তার শেষ পরিণতি লাঞ্ছনা।’
সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) বলতেন,
لا أعلم بعد النُّبوة أفضل من العلم ، لأن العالم هو وريث النبي الخ
‘নবুওয়াতের মর্যাদার পর ইলমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। কেননা আলেম হচ্ছেন নবীর ওয়ারিছ। আর নবীগণ দিনার-দিরহামের ওয়ারিছ বানান না বরং তারা ইলমের ওয়ারিছ বানান।’
আবূল আছওয়াদ (রহ.) বলেন,
ليس شيء أعز من العلم، الملوك حكام على الناس والعلماء حكام على الملوك
‘ইলমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো বস্তু নেই। বাদশারা তো সাধারণ মানুষের শাসক কিন্তু আলেমগণ বাদশাহদের শাসক।’
ইমাম আওযায়ী (রহ.) বলেন,
الناس عندنا أهل العلم ومن سواهم فلا شيء
‘আমাদের দৃষ্টিতে মানুষ বলতে আলেমই বুঝায়। তারা ছাড়া অন্যরা কিছু নয়।’
সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) বলতেন,
لو أن فقيها على رأس جبل لكان هو الجماعة
‘যদি একজন আলেম পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করেন তবে তিনিই বিশাল এক জামাতের মর্যাদা লাভ করবেন।’
আবদুল্লাহ ইবন মুবারক (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল-
من الناس؟ فقال: العلماء قيل: فمن الملوك؟ قال: الزهاد. قيل: فمن السفلة؟ قال: الذين يأكلون الدنيا بالدين
‘মানুষ কারা? তিনি জবাবে বললেন, ওলামায়ে কেরাম। এরপর জিজ্ঞেস করা হলো, বাদশাহ কারা? তিনি বললেন, দুনিয়াবিমুখ লোকেরা। এরপর জিজ্ঞেস করা হলো, আর নিকৃষ্ট লোক কারা? তিনি বললেন, যারা দীনের বদলায় দুনিয়া কামায় তারাই হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক।’
ইলমশূন্য মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর মতো
হাসান বসরী (রহ.) বলতেন,
لولا العلماء لصار الناس مثل البهائم الخ
‘যদি ওলামায়ে কেরাম না থাকতেন তবে মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর কাতারে নেমে যেত।’ অর্থাৎ মানুষ কেবল ইলমের কারণেই চতুষ্পদ জন্তুর কাতার থেকে মানুষের কাতারে উন্নীত হতে সক্ষম হয়।’
বস্তুত অন্য যাবতীয় মাখলুক থেকে মানুষের আলাদা হওয়ার অবশ্যই কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর সেই বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে ইলম। মানুষ তো এ কারণেই মানুষ হয়েছে। সে তার ব্যক্তিগত শক্তি-সামর্থের কারণে জন্তু-জানোয়ারের চেয়ে আলাদা ও মর্যাদাশীল নয়। যদি শারীরিক সামর্থ এবং কষ্ট সহিষ্ণুতার কারণে কেউ শ্রেষ্ঠ হতো উট সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতো। কেননা উট প্রাণীকুলের মধ্যে সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু প্রাণী। শারীরিক কাঠামো ও বপুতার কারণেও মানুষ শ্রেষ্ঠ নয়। যদি তাই হতো তবে স্থলভাগের হাতি এবং পানির তিমি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হতো। বাহাদুরি ও বীরত্বের কারণেও কেউ শ্রেষ্ঠ নয়। যদি হতো তবে হিংস্র বাঘ সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতো। খাওয়ার সামর্থের কারণেও কেউ শ্রেষ্ঠ নয়। যদি তাই হতো তবে গরু-মহিষ সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতো। কেননা তাদের চেয়ে বড় পেট ও পেটুক কোনো প্রাণী নেই। সুতরাং অন্যান্য মাখলুকের ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের একটি মাপকাঠি আছে। আর নিঃসন্দেহে সেটা হচ্ছে ইলম।
ইলমের বদৌলতে ইতর প্রাণীও সম্মানিত
ইলমের কারণে মানুষ তো বটেই, আল্লাহ তা‘আলা ইতর প্রাণীকেও সম্মানিত করেছেন। শিকারের জ্ঞান রাখা কুকুরকে তিনি অন্যান্য কুকুরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
﴿ يَسۡ‍َٔلُونَكَ مَاذَآ أُحِلَّ لَهُمۡۖ قُلۡ أُحِلَّ لَكُمُ ٱلطَّيِّبَٰتُ وَمَا عَلَّمۡتُم مِّنَ ٱلۡجَوَارِحِ مُكَلِّبِينَ تُعَلِّمُونَهُنَّ مِمَّا عَلَّمَكُمُ ٱللَّهُۖ فَكُلُواْ مِمَّآ أَمۡسَكۡنَ عَلَيۡكُمۡ وَٱذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَيۡهِۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ سَرِيعُ ٱلۡحِسَابِ ٤ ﴾ [المائ‍دة: ٤]
‘তারা তোমাকে প্রশ্ন করে, তাদের জন্য কী বৈধ করা হয়েছে? বল, ‘তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে সব ভাল বস্তু এবং শিকারী পশু-পাখী, যাদেরকে তোমরা শিকার প্রশিক্ষণ দিয়েছ; সেগুলোকে তোমরা শেখাও, যা আল্লাহ তোমাদেরকে শিখিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তা থেকে খাও, যা তোমাদের জন্য ধরে এনেছে এবং তাতে তোমরা আল্লাহর নাম স্মরণ কর আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ হিসাব গ্রহণে দ্রুত।’ {সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪}
এই আয়াত একথার প্রমাণ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটা কুকুর অন্য কুকুর থেকে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। সুতরাং ইতর প্রাণী কুকুর যদি ইলমের কারণে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত হয় তবে মানুষ যদি এই ইলম অর্জন করে তবে সে অন্য মানুষের তুলনায় কতদূর এগিয়ে যেতে পারে?
ইলম মানসিক প্রশান্তির কারণ
পূর্বসূরীগণ বলেন,
إن السرور والانشراح ياتي مع العلم ، لأن العلم عثور على الغامض، وحصول على الضالة واكتشاف للمستور والنفس مولعة بمعرفة الجديد والاطلاع على المستطرف.أما الجهل فهو ملل وحزن ، لأنه حياة لا جديد فيها ولا طريف ، و لا مستعذب ، أمس كاليوم ، واليوم كالغد. فإن كنت تريد السعادة فاطلب العلم وحصل الفوائد، لتذهب عنك الغموم والهموم والأحزان.
‘আনন্দ ও মনের প্রফুল্লতা অর্জিত হয় ইলমের মাধ্যমে। কেননা ইলম অস্পষ্টতার পর্দা উন্মোচন করে, হৃতগৌরব উদ্ধার করে, অজ্ঞাত বস্তু জ্ঞান উদ্ভাসিত করে এবং সাফল্যের নতুন নতুন দ্বার উন্মুক্ত করে। আর মানুষের আত্মা এসব বস্তু দ্বারা প্রশান্তি লাভ করে। পক্ষান্তরে মূর্খতা হচ্ছে লাঞ্ছনার নাম। মূর্খ এমন জীব যার প্রাণ নেই। চিত্তাকর্ষক ও আনন্দদায়ক কিছু নেই। তার জীবনের গতকাল এবং আজ সমান। আর আগামীকাল ব্যর্থতার গ্লানিতে কর্দমাক্ত। সুতরাং হে বন্ধু! তুমি যদি সৌভাগ্যের পরশ পেতে চাও তবে ইলম অন্বেষণ কর। তবেই দুশ্চিন্তা দূর হবে, পেরেশানমুক্ত হবে।
আলেমদের হাশর হবে নবীগণের সঙ্গে
ইলমের অন্যতম ফযীলত হচ্ছে, আলেমদের হাশর হবে নবী-রাসূলগণের সঙ্গে। কেয়ামতের দিন এরচেয়ে বড় গৌরবের বিষয় আর কী হতে পারে যে, সাধারণ মানুষ হয়েও শুধু ইলমের বরকতে একজন মানুষ আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় মহা সম্মানী নবী-রাসূলগণের সঙ্গে উঠতে সক্ষম হবেন? পৃথিবীর যাবতীয় পদ-পদবীর জন্য হাশরের মাঠে আক্ষেপ হবে, সেদিনের গৌরবের পদবী হবে কেবল নবী ও রাসূলগণের পদবী। সেই নবী-রাসূলগণের সঙ্গে হাশর হওয়া কত যে গৌরব ও মর্যাদার, আমাদের জন্য তা ভাষায় প্রকাশ করাও সম্ভব না, হৃদয় দিয়ে এর গভীরে পৌঁছাও সহজ না। অবশ্য আমাদের পূর্বসূরীগণ এর মর্যাদা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জনৈক বুযুর্গকে বিচারকের পদ গ্রহণ করার অনুরোধ করলে তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন,
إنما تعلمت العلم لأحشر به مع الأنبياء لا مع الملوك فإن العلماء يحشرون مع الأنبياء والقضاة يحشرون مع الملوك
‘আমি ইলম শিক্ষা করেছি নবীগণের সঙ্গে হাশর হওয়ার জন্য, বাদশাদের সঙ্গে হাশর হওয়ার জন্য নয়। কেননা আলেমদের হাশর হবে নবীগণের সঙ্গে আর বিচারকদের হাশর হবে বাদশাদের সঙ্গে।’
পুণ্যবান পূর্বসূরীর মুখে বিদ্যাহীনতার নিন্দা
ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন,
الجهل داء قاتل وشفاؤه أمران علم من القرآن أو من سنة يجعله ليس من الأحياء، فالعالمون أحياء وغيرُهم أموات
‘মূর্খতা হচ্ছে জীবননাশক ব্যাধি। এটা কখন রোগীকে মেরে ফেলে রোগী তা নিজেও টের পায় না। আর এর আরোগ্য রয়েছে দুটি বস্তুতে। কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান। অথবা বলা যায়, মূর্খতা মানুষকে মৃতের কাতারে নিয়ে যায়। অতএব কেবল ইলমওয়ালারা জীবিত, অন্যরা মৃত।’
মূর্খতা ও অজ্ঞতা কলবের মৃত্যু ঘটায়
ফাতহ আল-মুসিলী (রহ.) বলেন,
أليس المريض إذا منع الطعام والشراب والدواء يموت؟ قالوا: بلى، قال: كذلك القلب إذا منع عنه الحكمة والعلم يموت.
‘রোগীকে যদি খাবার-পানীয় ও ঔষধ থেকে বঞ্চিত করা হয় তবে কি তার মুত্যৃ ঘটবে না? লোকেরা জবাবে বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, এমনিভাবে অন্তরকে যদি ইলম ও হিকমত থেকে বঞ্চিত রাখা হয় তবে কলবের মৃত্যু ঘটে।’
বাস্তবেও তাই। কেননা অন্তরের খাদ্য হচ্ছে ইলম ও হিকমত এবং এর দ্বারাই অন্তর যিন্দা থাকে। যেভাবে খাবারের দ্বারা মানুষের দেহ টিকে থাকে। তাই যে ইলম থেকে বঞ্চিত হয় তার অন্তর রোগাক্রান্ত হয় এবং অন্তরের মৃত্যু আবশ্যক হয়ে যায়। কিন্তু দুনিয়ার তীব্র ভালোবাসার কারণে তার অনুভূতি শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় বলে সে তা অনুভব করতে পারে না।
হাসান বসরী (রহ.) বলেন,
يوزن مداد العلماء بدم الشهداء فيرجح مداد العلماء بدم الشهداء، فوالذي نفسي بيده ليودن رجال قتلوا في سبيل الله شهداء أن يبعثهم الله علماء لما يرون من كرامتهم، فإن أحدا لم يولد عالما وإنما العلم بالتعلم
‘ওলামায়ে কেরামের (ইলম শিক্ষার) কালিকে শহীদের রক্তের সঙ্গে ওজন করা হবে এবং ওলামায়ে কেরামের কালিই ওজনে ভারি হবে। ওই সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, যেসব লোক আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় শহীদ হয়েছেন তারা কেয়ামত দিবসে আলেমদের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব দেখে আলেম হিসেবেই উত্থিত হওয়া কামনা করবেন। আর কোনো ব্যক্তি আলেম হয়ে জন্ম নেয় না, বরং তাকে ইলম শিক্ষা করে আলেম হতে হয়।’
আল্লাহর বাণী,
﴿ وَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا حَسَنَةٗ وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِ حَسَنَةٗ وَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ٢٠١ ﴾ [البقرة: ٢٠١]
‘আর তাদের মধ্যে এমনও আছে, যারা বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন। আর আখিরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০১} এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাসান বসরী (রহ.) বলেন,
إن الحسنة في الدنيا هي العلم والعبادة وفي الآخرة هي الجنة
‘দুনিয়ার হাসানা (কল্যাণ) হচ্ছে ইলম ও ইবাদত। আর আখেরাতের হাসানা (কল্যাণ) হচ্ছে জান্নাত।’
জনৈক হাকিমকে জিজ্ঞেস করা হলো-
أي الأشياء تقتني قال الأشياء التي إذا غرقت سفينتك سبحت معك
‘কোন বস্তু উপার্জন ও চয়ন করচ? জবাবে তিনি বললেন, ওই সব বস্তু, তোমার জাহাজ ডুবে গেলে যা তোমাকে নিয়ে সাঁতার কেটে ভাসাবে।’ অর্থাৎ ইলম।
এখানে জাহাজ ডুবে যাওয়ার দ্বারা মৃত্যুর কারণে দেহ নিঃশেষ হওয়া উদ্দেশ্য।
অন্য এক হাকিম বলেন,
من اتخذ الحكمة لجاما اتخذه الناس إماما ومن عرف بالحكمة لاحظته العيون بالوقار
‘যে ব্যক্তি হেকমত ও ইলমের লাগাম পরিধান করে, লোকেরা তাকে ইমাম ও বরণীয় ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করে। আর যে ব্যক্তি ইলম ও হিকমত দ্বারা পরিচিত হয় তার দিকে সম্ভ্রমের দৃষ্টি প্রদান করা হয়।’
ইলম সম্মানিত করে
সালেম ইবন আবূ শুজা‘ বলেন, ‘আমার মুনিব তিনশত দিরহাম দিয়ে ক্রয় করে আমাকে আজাদ করে দেন। আজাদ হওয়ার পর বললাম, আমি কোন পেশায় জড়িত হতে পারি? অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত ইলমের অন্বেষণে লেগে পড়লাম। এই অবস্থায় এক বছরও গত হলো না, এরই মধ্যে শহরের প্রশাসক আমার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এলেন কিন্তু আমি তাকে অনুমতি দিলাম না।’
ইলমের প্রয়োজনীয়তা সার্বক্ষণিক
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রহ.) বলেন,
الناس أحوج إلى العلم منهم إلى الطعام والشراب لأن الطعام والشراب يحتاج إليه في اليوم مرة أو مرتين، والعلم يحتاج إليه في كل وقت
‘মানুষ খানাপিনার চেয়ে ইলমের প্রতি বেশি মুখাপেক্ষী। কেননা দিনে মাত্র দুই-তিনবার খানাপিনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ইলমের প্রয়োজন প্রতি মুহূর্ত এবং সারা জীবন।’
ইলম সম্পদ ও সম্মান আনে
যুবায়ের ইবন আবূ বকর (রহ.) বলেন,
كتب إلي أبي بالعراق عليك بالعلم فإنك إن افتقرت كان لك مالا وإن استغنيت كان لك جمالا
আমার পিতা আমাকে ইরাকে লিখে পাঠালেন, ‘হে বৎস! তুমি অবশ্যই ইলম অন্বেষণ করো। কেননা তুমি যদি দরিদ্র হও তবে ইলমের বরকতে সম্পদ লাভ করবে। আর যদি ধনী হও তবে এটা তোমার সৌন্দর্যের কারণ হবে।’
ইলম ছাড়া সম্মান তালাশ করা বোকামী
আবদুল্লাহ ইবন মুবারক (রহ.) বলেন,
عجبت لمن لم يطلب العلم كيف تدعوه نفسه إلى مكرمة؟
‘আমি ওই ব্যক্তিকে দেখে খুব বিস্ময় বোধ করি, যে ইলম অন্বেষণ করে নি অথচ সম্মান তালাশ করে!’
আতা (রহ.) বলেন,
مجلس علم يكفر سبعين مجلسا من مجالس اللهو
‘একটি ইলমের মজলিস সত্তরটি অহেতুক মজলিসের পাপ মোচন করে দেয়।’
ইলমের মীরাছ স্বর্ণ-রূপার মিরাছের চেয়ে শ্রেষ্ঠ
উবায়দুল্লাহ ইবন কাছীর (রহ.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করে বলেন,
ميراث العلم خير من ميراث الذهب والفضة والنفس الصالحة خير من اللؤلؤ ولا يستطاع العلم براحة الجسم
‘ইলম স্বর্ণ-রূপার মিরাছের চেয়ে শ্রেয়। নেককার মানুষ মনি-মুক্তার চেয়ে উত্তম। আর ইলম শারীরিক আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে হাসিল হয় না।’ অর্থাৎ দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করতে হলে এর পিছনে শ্রম দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
ইলমের ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে হাকিম-বিজ্ঞগণের বক্তব্য ও মন্তব্য
ইলম হাসিলে লুকমানের উপদেশ:
লুকমান (রহ.) হিকমত ও প্রজ্ঞার জন্য বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তিনি পুত্রকে বিভিন্ন সময় শিক্ষণীয় উপদেশ দিতেন। ইতিহাসের পাতায় তা স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত আছে। ইলমের গুরুত্ব প্রদান করে তিনি পুত্রকে ওসিয়ত করেছিলেন-
يا بني جالس العلماء وزاحمهم بركبتيك فإن الله سبحانه يحيي القلوب بنور الحكمة كما يحيي الأرض بوابل السماء
‘হে বৎস! তুমি ওলামায়ে কেরামের মজলিসে বসো এবং তোমার দু’হাঁটু বসিয়ে তাদের কাছে ভীড় জমাও। কেননা আল্লাহ তা‘আলা ইলম ও হিকমতের বদৌলতে অন্তরকে জীবন্ত করেন, যেভাবে আসমানের পানি (বৃষ্টি) দ্বারা জমিনকে জীবিত করেন।’
আলেমের মৃত্যুতে জীব-জন্তুর কান্না
জনৈক হাকিম বলেন,
إذا مات العالم بكاه الحوت في الماء والطير في الهواء ويفقد وجهه ولا ينسى ذكره
আলেমের মৃত্যু হলে পানির মাছ এবং শূন্যে চলমান পাখি কান্না করে। তার চেহারা খুঁজে ফেরে আর তার স্মরণ জারি রাখে।
ইলম ছাড়া করুণা লাভ করা যায় না
জনৈক হাকিম বলেন,
إني لا أرحم رجالا كرحمتي لأحد رجلين: رجل يطلب العلم ولا يفهم، ورجل يفهم العلم ولا يطلبه
‘আমি দুইজন ব্যক্তিকে যেভাবে করুণা করি অন্য কাউকে তা করি না। সে দুইজন হলেন, এক. ওই ব্যক্তি, যিনি ইলম তলব করেন যদিও এর মর্মার্থ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। দুই. ওই ব্যক্তি, যিনি ইলমের মর্মার্থ অনুধাবন করেন কিন্তু (বেশি মাত্রায়) ইলম তলব করেন না।’
আলেম আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনকারী
এক আলেম বলেন,
العالم يدخل فيما بين الله وبين خلقه فلينظر كيف يدخل
‘আলেম আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর মাখলুকের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনকারী। সুতরাং মানুষ যেন ভাবে যে, সে কীভাবে তাঁদের মধ্যে প্রবেশ করবে।’
যে শহরে ইলম অন্বেষণকারী নেই তা বাসযোগ্য নয়
বর্ণিত আছে-
روى أن سفيان الثوري رحمه الله قدم عسقلان فمكث لا يسأله إنسان فقال اكروا لي لأخرج من هذا البلد هذا بلد يموت فيه العلم
‘একবার সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) আসকালান শহরে গমন করেন এবং সেখানে বেশকিছুদিন অবস্থান করেন। কিন্তু অবস্থানকালে একজন লোকও তাঁর কাছে ইলম শিক্ষা করতে আসল না এবং তাঁকে ইলমের কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করল না। তিনি লোকজনকে বললেন, এই শহর থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য দ্রুত আমার জন্য বাহনের ব্যবস্থা করো। কেননা এই শহরে ইলম মৃত। আর যে শহরে ইলম মৃত সেই শহর বাসযোগ্য নয়।’
আতা (রহ.) বলেন,
دخلت على سعيد وهو يبكي فقلت ما يبكيك قال ليس أحد يسألني عن شيء
‘আমি সাঈদ ইবন মুসাইয়িব (রহ.)-এর মজলিসে গেলাম। ওই সময় তিনি ক্রন্দন করছিলেন। ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, এখানে ইলমের বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করার করা মতো একজন লোকও নেই!’
ইলমহীন ব্যক্তি ইসলাম ধ্বংসকারী
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘ইমাম শাফেয়ী (রহ.) কোনো ব্যক্তিকে দেখলে প্রথমে তাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেন। যদি তিনি আলেম ও আমলদার হতেন তবে ছেড়ে দিতেন। অন্যথায় তাকে তিক্ত ভাষায় ভর্ৎসনা করতেন এবং বলতেন,
لا جزاك الله خيراً لا عن نفسك و لا عن الإسلام ضيَّعتَ نفسك و ضيَّعتَ الإسلام
‘আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় না দিন- না তোমার নিজের থেকে না ইসলাম থেকে। তুমি নিজেকেও ধ্বংস করেছ, ইসলামকেও ধ্বংস করেছ!’
জনৈক বুযুর্গ বলেন,
العلماء سرج الأزمنة كل واحد مصباح زمانه يستضيء به أهل عصره
‘আলেমগণ যুগের প্রদীপ, প্রত্যেকের নিজের সময়ের বাতিস্বরূপ; লোকেরা তাদের থেকে আলো সংগ্রহকারী।’
আলেমগণ এই উম্মতের সবচেয়ে কল্যাণকামী মানুষ
ইয়াহইয়া ইবন মু‘আয (রহ.) বলেন,
العلماء أرحم بأمة محمد صلى الله عليه وسلم من آبائهم وأمهاتهم قيل وكيف ذلك قال لأن آباءهم وأمهاتهم يحفظونهم من نار الدنيا وهم يحفظونهم من نار الآخرة
‘ওলামায়ে কেরাম উম্মাতে মুহাম্মাদীর সবচেয়ে কল্যাণকামী ব্যক্তি। এমনকি ব্যক্তির পিতামাতার চেয়েও বেশি করুণাকামী তারা। জিজ্ঞেস করা হলো; এটা কীভাবে? জবাবে তিনি বললেন, কেননা ব্যক্তির পিতামাতা তাকে দুনিয়ার আগুন থেকে বাঁচায় মাত্র, কিন্তু আলেমগণ বাঁচান আখেরাতের আগুন থেকে।’
ইলমের মূল্য
ইকরামা (রহ.) বলতেন,
إن لهذا العلم ثمنا قيل وما هو قال أن تضعه فيمن يحسن حمله ولا يضيعه
‘এই ইলমের একটি মূল্য আছে। জিজ্ঞেস করা হলো, কী সেই মূল্য? তিনি বললেন, এর মূল্য হচ্ছে সে ব্যক্তিকে ইলম দেওয়া যে এর সঙ্গে সদাচার করে এবং একে বরবাদ করে না।’
বাতিলশক্তি খতম করতে ইলমী শক্তির প্রভাব
আল্লামা ইবন তাইমিয়া (রহ.) বলেন, বাতিল ও অপশক্তি বাহ্যিকভাবে প্রবল হলেও সহীহ ও ইলমে নাফের মোকাবেলায় তা নিতান্তই নগণ্য। আল্লাহ তা‘আলা ইলমের মধ্যে এমন এক শক্তি নিহিত রেখেছেন যার দ্বারা বাতিল শক্তিকে পরাভূত করা খুব সহজ। এমনকি বাহ্যিকদৃষ্টিতে বাতিলের শক্তি-সামর্থ্য ও সংখ্যা বেশি অনুমিত হলেও। যেমন, মূসা (আ.)-এর ঘটনায় দেখা যায়, ফিরাউনের ভাড়া করা জাদুকর সংখ্যায় ছিল অনেক। কিন্তু নবুওয়াতী ও ইলমী শক্তির কাছে তারা খুবই দুর্বল বলে প্রমাণিত হয়। এই সংখ্যা ইলমী শক্তিকে নিঃশেষ করতে চাইলে নিজেই নিঃশেষ হয়ে যায়! বাতিলশক্তি তাদের শক্তি প্রদর্শন করে অসংখ্য সাপ-বিচ্ছুর মহড়া দেখায়। কিন্তু মূসা (আ.)-এর ইলমী ও নবুওয়াতী শক্তির এক ঝলকে তা ধ্বংস ও মিসমার হয়ে যায়। এভাবেই রচিত হয়েছে ইতিহাস। যখনই কোনো বাতিলশক্তি ইলম ও আলেমদের পথচলায় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করেছে তখনই তারা ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। আজ তারা ইতিহাসের নিকৃষ্ট উপমা! ইলম ও আলেমদের চলার পথ কেউ কখনও বন্ধ করতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। এটাই আল্লাহ তা‘আলার ফয়সালা।
ইলমের সঙ্গে সময় কাটানো সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে সময় কাটানোর মতো
আবদুল্লাহ ইবন মুবারক (রহ.)-এর মজলিসে একবার কিছু লোক আগমন করলেন। এর কিছুক্ষণ পর লোকগুলো মজলিস থেকে বের হয়ে গেলেন। তাদের চেহারার অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো ইবন মুবারক (রহ.) তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হননি। তাদের কেউ একজন বললেন, মনে হয় আপনার কাছে এমন কোনো লোক আছে যাদের প্রতি আপনার হৃদয়ের সুসম্পর্ক রয়েছে। তিনি একথা বলে ইঙ্গিত করেছেন পরিবার- পরিজনের দিকে। একথা শুনে আবদুল্লাহ ইবন মুবারক (রহ.) বললেন, বরং তাদের চেয়েও প্রিয় কেউ আছেন। আমি তো সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈগণের সঙ্গে সময় কাটাই! অর্থাৎ আমি ইলমের সঙ্গে সময় কাটাই এবং ইলমের সঙ্গে সময় কাটানোটা আমার কাছে পরিবার-পরিজনের চেয়ে শ্রেয়।
পাচকের ঘরে বিচারক
ইলম মানুষকে নানাভাবে সম্মানিত করে। একটি ঘটনা বলি। হাশেম ইবন বাশির ইবন আবূ হাযেম সালামী ওয়াসেতী (রহ.)-এর পিতা ছিলেন হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের পাচক। অবশ্য পরে এই পেশা ছেড়ে দিয়ে ফলের ব্যবসা শুরু করেন। বাশির পুত্র হাশেমকে ইলম অন্বেষণে বাধা দিতেন এবং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু পুত্র হাশেম ইলম অন্বেষণ থেকে বিরত হতে অস্বীকৃতি জানান। এভাবে চলতে থাকে দিন। একবার হঠাৎ হাশেম (রহ.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। সংবাদ পেয়ে ওয়াসেতের বিচারক আবূ শায়বা তাকে দেখতে আসেন। তার সঙ্গে আসেন গণ্যমান্য আরো অনেকেই। হাশেমের পিতা বাশির ঘটনা দেখে খুব খুশি হন এবং বলেন, হে বৎস! আমি বুঝতে পারছি ইলমের কারণেই তুমি এই মর্যাদায় উপনীত হয়েছো যে, স্বয়ং বিচারক তোমার সাক্ষাতে এসেছেন! আজ থেকে আমি তোমাকে ইলম অন্বেষণে বাধা দেব না।
হাশেম (রহ.) অত্যন্ত উঁচুমাপের বুযুর্গ ছিলেন। মালেক, শুবা, ছাওরী, আহমাদ ইবন হাম্বল (রহ.) প্রমুখ বিখ্যাত হাদীছ বিশারদের কাছে ইলমে হাদীছ অর্জন করেছেন। তিনিও ছিলেন ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর মতো ইবাদতগুজার।
ইলম সম্পদের জননী
এ দেশের মানুষ হীনমন্যতায় ভোগে। ইলম শিক্ষা করলে ‘খাবে কী’ সেই দুঃচিন্তায় ঘুম হয় না অনেকের। অনেকে এধরনের অপপ্রচারও করে বেড়ায়। আর দুনিয়াপূজারীর দৃষ্টিতে একজন আলেমের জীবন চলারই কথা নয়! তাদের দৃষ্টি সার্টিফিকেট আর চাকরিতে। তাই তারা বংশের কেউ আলেম হোক তা কল্পনাও করতে পারে না। অথচ বিষয়টি বাস্তবে আদৌ এমন? প্রথমত ইলম শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, সমাজের সব মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা। এই দুটি বস্তু হাসিল হলে ইলম শিক্ষা করার উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেল। আর রিযিক? সেটা তো আল্লাহ তা‘আলা দেবেন এবং তাঁর কুদরতী পদ্ধতি অনুযায়ী যাকে যেভাবে যে পরিমাণ দেয়ার তাকে সেভাবে সে পরিমাণই দান করবেন। তথাপি সমালোচনা এবং অপপ্রচারের জবাবে বলা যায়, ইলম শিক্ষায় রিযিকের অভাব হয় না বরং ইলমের বরকতে আল্লাহ তা‘আলা রিযিকের মধ্যে প্রশস্তি দান করেন। এজন্য ইলমকে উম্মুল মাল বা সম্পদের জননী বলা হয়। বিখ্যাত মুহাক্কিক আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) ইলম ও মালের মধ্যে তুলনা করে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। এতে তিনি ইলমকে বহুদিক দিয়ে মালের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং ইলমকে মালের জননী আখ্যায়িত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘ইলম নবীগণের মীরাছ। পক্ষান্তরে সম্পদ ধনী এবং রাজা-বাদশাহদের মীরাছ। সুতরাং কোনটা শ্রেষ্ঠ? ধন-সম্পদকে মালিকের হেফাজত করতে হয়। পক্ষান্তরে ইলম মালিককে হেফাজত করে। মাল খরচ করলে কমে যায়। পক্ষান্তরে ইলম খরচ করলে তা দিন দিন বাড়ে। ইলম মালিককে সর্বদা সঙ্গ দেয়। এমনকি কবরের জগতেও। পক্ষান্তরে মাল ও ধন-সম্পদ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মালিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইলম ধন-সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব করে। সুতরাং ইলম শাসক আর মাল শাসিত।
মাল ও ধন-সম্পদ ভালো-মন্দ, মুসলিম-কাফের এবং নেককার-পাপী সবাই হাসিল করতে পারে। কিন্তু ইলমের ধন একমাত্র নেককার মুমিন ব্যক্তিই হাসিল করতে পারে। আলেমের কাছে রাজা-বাদশাহ সকলেই মুহতাজ তথা মুখাপেক্ষী। পক্ষান্তরে ধনীর কাছে কেবল অভাবী ব্যক্তি মুহতাজ। ধন-সম্পদের অধিকারী যখন তখন নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আলেমের সেই শঙ্কা নেই।
সম্পদ কখনও কখনও মালিকের ধ্বংসের কারণ হতে পারে। ইতিহাসের এধরনের বহু দৃষ্টান্ত আছে। যেমন, কারুন, নমরুদ, শাদ্দাদ ইত্যাদি। পক্ষান্তরে ইলম আলেমের জন্য জীবনস্বরূপ, এমনকি তা মৃত্যুর পরেও।’
মালের সৌভাগ্য ক্ষণস্থায়ী পক্ষান্তরে ইলমের সৌভাগ্য চিরস্থায়ী
আলেমের কদর ও সম্মান তার ব্যক্তিসত্তায় নিহিত। পক্ষান্তরে ধনীর সম্মান তার মালের মধ্যে নিহিত। ধনী ব্যক্তি তার সম্পদের মাধ্যমে মানুষকে দুনিয়ার দিকে আহ্বান করে। পক্ষান্তরে আলেম ইলমের মাধ্যমে মানুষকে আহ্বান করে আখেরাতের দিকে।
ইলম মানুষের জীবনকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়জগতে কীভাবে উন্নতি বয়ে আনে তার একটি দৃষ্টান্ত পেশ করা যেতে পারে। ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ) উম্মতের মুহসিনগণের (কল্যাণকারী) একজন, যাদের অবদানের ভারে উম্মতের গর্দান সর্বদা নুয়ে থাকে। বিশেষ করে ফিকহে হানাফীর অনুসারীদের জন্য তার অবদান অনস্বীকার্য।
তিনি শুধু একজন ফকীহ হিসেবেই ইমাম আবূ হানীফা (রহ)-এর ইলম ও ফিকহ উম্মতের কাছে পৌঁছে দেন নি, বরং একজন প্রধান বিচারপতি হিসেবে ফিকহকে দর্শন থেকে বের করে এনে এর আমলী রূপও দান করেছেন।
আলী ইবন জা‘দ (রহ.) বর্ণনা করেন, ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.) বাল্যকালেই পিতা ইবরাহীম ইবন হাবীবের স্নেহ হারিয়েছিলেন। ফলে অভাবে অপরাগ হয়ে মা তাকে ধোপার কাছে ন্যস্ত করেছিলেন। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.)-এর ঝোঁক ছিল প্রচণ্ড। তাই তিনি ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর দরসে শরীক হতেন। মা এই তথ্য জেনে তাকে দরসে যেতে বাধা দিলেন এবং সে কারণে তিনি কয়েকদিন আবূ হানীফা (রহ.)-এর দরসে অনুপস্থিত থাকলেন।
মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছাত্রের প্রতি উস্তাদদের আলাদা দৃষ্টি থাকে এবং সেটাই স্বাভাবিক। তাই কয়েকদিন অনুপস্থিত থাকার পর ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ) দরসে উপস্থিত হলে ইমাম আবূ হানীফা (রহ) এর কারণ জিজ্ঞেস করেন। ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.) আদ্যোপান্ত ঘটনা বলেন। ঘটনা শুনে ইমাম আবূ হানীফা (রহ) দরস থেকে তাকে কাছে ডেকে নিলেন এবং একশ দিরহামের একটি থলি হাতে তুলে দিলেন। দেওয়ার সময় বললেন, আপাতত এই দিয়ে প্রয়োজন পূরণ করো। ফুরিয়ে গেলে আমাকে জানাতে ভুল করো না।
ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ) বলেন, এরপর থেকে আমাকে কখনও বলতে হয়নি যে, আমার টাকা ফুরিয়ে গেছে। বরং টাকা ফুরিয়ে গেলে তিনি নিজ থেকেই আমাকে আবার টাকা দিতেন। যেন পয়সা শেষ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি তিনি নিজ থেকেই আঁচ করতে পারতেন!
মা এটা জেনে ভাবলেন, এভাবে আর কতদিন চলবে? বরং একটা স্থায়ী সমাধান এবং জীবিকার ব্যবস্থা হওয়া দরকার। একারণে একদিন তিনি ইমাম আবূ হানীফা (রহ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, জনাব! এ তো ইয়াতিম বাচ্চা। আমি চাচ্ছি, সে কাজ শিখে জীবিকার স্থায়ী একটা ব্যবস্থা করে নিক, আপনি তাকে আপনার দরবারে উপস্থিত হতে বারণ করে দিন। মায়ের কথা শুনে ইমাম আবূ হানীফা (রহ) বললেন-
هو ذا يتعلم أكل الفالوذج بدهن الفستق
‘সে তো ইলম শিক্ষা করে পেস্তার ঘিতে ফালুদা খাওয়া শিখছে!’
মা এটাকে নিছক কৌতুক মনে করলেন এবং তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
أنت شيخ قد خرفت وذهب عقلك
‘আপনি বৃদ্ধ মানুষ। তাই আপনার আকল নষ্ট ও অকার্যকর হয়ে গেছে!’
কিন্তু কথাটির মর্ম ঠিকই বুঝেছিলেন ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.)। তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এই ইলমের বদৌলতে বিচারকের পদ দান করেছেন। তিনি তৎকালীন বিখ্যাত খলীফা হারুনুর রশীদের দস্তরখানে খুব বেশি আমন্ত্রিত হতেন। তিনি বলেন,
فلما كان في بعض الأيام قدم إلى هارون فالوذجة فقال لي يا يعقوب كل منها فليس في كل يوم يعمل لنا مثلها فقلت وما هذه يا أمير المؤمنين فقال هذه فالوذجة بدهن الفستق
‘একবার আমি হারুনুর রশীদের দস্তরখানে বসা ছিলাম। এসময় তিনি আমার সামনে একটি পেয়ালায় পেস্তার ঘিতে বানানো ফালুদা পেশ করেন এবং বলেন, এটি একেবারেই খাঁটি বস্তু। হে ইয়াকুব! ভক্ষণ করুন। এগুলো সবসময় বানানো হয় না। বরং আমার জন্য মাঝে-মধ্যে প্রস্তুত করা হয়। আমি আশ্চর্য হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, আমীরুল মুমিনীন! এগুলো কী? তিনি জবাবে বললেন, পেস্তার ঘিয়ে ভাজা ফালুদা।
আমি তার কথায় হেসে উঠলাম। তিনি হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে আমি পুরো ঘটনা ব্যক্ত করলাম। ঘটনা শুনে তিনিও অবাক হলেন এবং বললেন-
لعمري: إنه العلم ليرفع وينفع ديناً ودنيا وترحم على أبي حنيفة وقال: كان ينظر بعين عقله ما لا يراه بعين رأسه
‘আমার জীবনের শপথ! নিশ্চয় এই ইলম দুনিয়া ও আখেরাতে মর্যাদা বুলন্দ করে।’ এরপর তিনি ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর প্রতি রহমতের দু‘আ করে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা ইমাম আবূ হানীফাকে রহম করুন। তিনি সবকিছু অন্তর্চক্ষু দিয়ে অবলোকন করতেন, যা বাহ্যিক চোখ দিয়ে দেখা যায় না।’ [ওয়াফায়াতুল আইয়ান ওয়া আবনাউয যামান: ৮/২২১]
পূর্ববতী যুগের রাজা-বাদশাদের দৃষ্টিতে ইলমের গুরুত্ব
বর্তমান যুগের রাজা-বাদশা ও ক্ষমতাশালীরা নিজেদের সন্তানদের পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থায় পারদর্শী করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন এবং কুরআন-হাদীছের জ্ঞান থেকে তাদের একেবারেই বঞ্চিত করেন। কিন্তু অতীতের কীর্তিমান শাসকগণের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা তাদের সন্তানদের কুরআন-হাদীছের ইলম শিখিয়ে ধন্য হতেন এবং সন্তানদের জীবন ধন্য হয়েছে বলে মনে করতেন। বেশিদিন আগের কথা নয়। মোঘল সম্রাট আলমগীরের কথাই ধরুন। ভারত শাসন করেছেন যারা তাদের কয়জন তার মতো কৃতিত্ব ও ইতিহাসে স্মরণীয় হতে পেরেছেন?
‘বাদশা আলমগীর, কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলবী দিল্লির’ হৃদয়কাড়া কবিতার এই অংশই প্রমাণ করে বিখ্যাত মোঘল সম্রাট পুত্রের জন্য কী ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি নিজেও অত্যন্ত ইলম-অনুরাগী ছিলেন। বিশ্বখ্যাত ফাতাওয়ার গ্রন্থ ‘ফাতাওয়ায়ে আলমগির’ তারই তত্ত্বাবধানে সংকলিত ও প্রকাশিত হয়েছিল।
আগের যুগের সকল খলীফা ও আমীর-উমারা এরূপই ইলমের প্রতি সীমাহীন অনুরাগী ছিলেন। যেমন বিখ্যাত শাসক আবদুল মালেক ইবন মারওয়ান তার পুত্রকে উপদেশ প্রদান করে বলেছিলেন-
يا بنيّ تعلموا العلم فإن كنتم سادة فقتم وإن كنتم وسطاً سدتم وإن كنتم سوقة عشتم
‘হে বৎস! ইলম শিক্ষা করো। কেননা যদি নেতা হও তবে সবার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবে। যদি মধ্যম ধরনের লোক হও তবে নেতার আসন লাভ করতে পারবে। আর যদি সাধারণ প্রজা হও তবে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করতে পারবে।’
এরপর তিনি কবিতা আবৃত্তি করে বলেন,
ومن لم يذق مر التعلم ساعة تجرع ذل الجهل طول حياته
ومن فاته التعليم وقت شبابه فكبر عليه أربعا لوفاته
وذات الفتى والله بالعلم والتقى إذا لم يكونا لا اعتبار لذاته
‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের কিঞ্চিত তিক্ততা বরদাশত করে না, সে দিনের পর দিন মূর্খতার লাঞ্ছনা গিলতে বাধ্য হয়।
যৌবনে যার ইলম শিক্ষা করার সুযোগ হয়নি তার ওপর (জানাযার) চার তাকবীর পাঠ করো। কেননা সে তো মৃত!
আল্লাহ তা‘আলার শপথ! যুবকের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব তার ইলম ও তাকওয়ার কারণে। যদি এই দুটি বস্তু না থাকে তবে তার কোনো মূল্যই নেই।’
ইলমের কারণে বিধর্মীও সম্মানযোগ্য
ইলম এমন এক দৌলত, যার বদৌলতে একজন বিধর্মীও সম্মান লাভের যোগ্য হতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, বদর যুদ্ধে ৭০জন কাফের যুদ্ধবন্দী হিসেবে গ্রেফতার হয়ে মদীনায় নীত হয়। মক্কাবাসী সে সময় আরবী পঠন ও লিখন বিদ্যায় পারদর্শী ছিল। পক্ষান্তরে মদীনাবাসী ছিল এর বিপরীত। তারা ছিল নিরক্ষর। যুদ্ধবন্দীদের কিছু ছিল মূর্খ, লেখাপড়া না জানা। তাদেরকে অর্থের বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হয়। আর যারা ছিল শিক্ষিত তাদের প্রত্যেকের যিম্মায় মদীনার দশজন করে শিশু ন্যস্ত করা হয় এবং এদের শিক্ষা প্রদানকে তাদের মুক্তিপণ সাব্যস্ত করা হয়। এভাবে তারা বিধর্মী হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একমাত্র ইলমের কারণে তাদেরকে সম্মান করেন এবং অন্যদের তুলনায় ভিন্ন মর্যাদা প্রদান করেন। এর দ্বারা বুঝা যায়, ইলম এমন এক সম্পদ, যার বদৌলতে একজন বিধর্মীও সম্মানের পাত্র হতে পারে। সুতরাং কোনো মুসলিম যদি এই ইলমের অধিকারী হয় তবে তার সম্মান কত বেশি হতে পারে?
কাব্য-কবিতা ও শের-আশ্আরে ইলমের মর্যাদা ও প্রশস্তি
জনৈক কবি বলেন,
يموت قوَم فيحيى العلم ذكرهم والجهل يلحق أمواتاً بأموات
‘মানুষ মারা যায়, কিন্তু ইলম তার স্মরণকে জীবিত রাখে। আর মূর্খরা মরে গিয়ে কেবল মৃত হিসেবে মৃতদের সঙ্গে মিলিত হয়।’
زوال بزوالها ، ومحبة العالم دين يدان به
يكسبه الطاعة في حياته ، وجميل الأحدوثة بعد موته .
– مات خزان المال وهم أحياء ، والعلماء باقون ما بقي الدهر ،
أعيانهم مفقودة ، وآثارهم في القلوب موجودة!
‘সম্পদের সৃষ্টি সম্পদের সঙ্গে নিঃশেষ হয়ে যায় কিন্তু আলেমের মহব্বত হচ্ছে দীন, যদ্বারা মানুষের দীন পালিত হয়।
এর দ্বারা জীবদ্দশায় আনুগত্য হাসিল হয় এবং মৃত্যুর পর তা উত্তম কথা হয়ে থাকে।
মালের রক্ষকরা মারা যায়, কিন্তু আলেমরা যুগ যুগ ধরে অমর থাকেন।
তাদের সম্পদ হারিয়ে যায় কিন্তু আলেমদের প্রভাব ও স্মরণ মানুষের হৃদয়ে গ্রোথিত ও অম্লান হয়ে থাকে।’
আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আলেমের কীর্তির অমরত্বের কথা তুলে ধরেছেন এভাবে-
ما الفضل إلا لأهل العلم إنهم
على الهدي لمن استهدى أدلاء
فاظفر بعلم ولا تبغي به بدلا
فالناس موتى وأهل العلم أحياء
‘সম্মান কেবল আলেমদেরই জন্য, তারা হেদায়াতের পথে চলমান এবং হেদায়াত প্রত্যাশীর পথপ্রদর্শক। সুতরাং তুমি ইলম দ্বারাই সৌভাগ্য হাসিল করতে সচেষ্ট হও এবং এর মোকাবেলায় অন্য কোনো বস্তু গ্রহণ করো না। কেননা, অন্যান্য মানুষ মৃত আর আলেমগণ অমর, তাদের কীর্তি জীবিত।’
আরেক বুযুর্গ বলেন,
علم الإنسان ولده المخلد
‘মানুষের ইলম হলো তার চিরস্থায়ী সন্তান।’
আবূল ফাতহ মুহাম্মাদ আল-বুস্তী (রহ.) বলেন,
يقولون ذكر المرء يبقى بنسله  و ليس له ذكر إذا لم يكن نسل
فقلت لهم نسلي بدائع حكمتي  فمن سره نسل فإنا بذا نسلو
‘মানুষ বলে, বংশ দ্বারা মানুষ স্মরণীয় হয়, এর দ্বারা তার নাম বাকি থাকে। তাই যদি বংশ না থাকে তবে কেউ তাকে স্মরণ করে না। আমি তাদেরকে বলব, আমার বংশ হচ্ছে আমার ইলম ও হেকমতের দুষ্প্রাপ্যতা। সুতরাং কেউ যদি স্মরণকারী বংশ চায় তবে সে যেন এই পথই বেছে নেয়।’
আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিচের কবিতাটিও সম্যক পরিচিত ও বিখ্যাত। যথা-
العلم نور وخير الناس تطلبه
يا طالب العلم لا تبغي به بدلا
والجاهلون لأهل العلم أعداء
الناس موتى وأهل العلم أحياء
‘ইলম হচ্ছে নূর এবং কেবলমাত্র ভালো মানুষেরাই তা অন্বেষণ করে, হে তালেবে ইলম! ইলমের মোকাবেলায় তুমি অন্য কোনো বস্তু গ্রহণ করো না। আর জাহেলরা হচ্ছে আলেমদের দুশমন, সাধারণ মানুষ তো মৃত; কেবল জীবিত মানুষ হচ্ছেন আলেমগণ।’
তিনি ছন্দাকারে আরো বলেন,
ما الفخرُ إلا لأهلِ العِلْم إنَّهم على الهدى لمن استهدى أدلاَّءُ
وقَدْرُ كلِّ امرىءٍ ما كان يُحْسِنُه  والجَاهِلُون لأهْل العلم أعَداءُ
ففُزْ بعلمٍ تَعِشْ حياً به أبداً  النَّاسَ موتى وأهلُ العِلْمِ أحْياءُ
‘ফখর ও গৌরব তো একমাত্র আহলে ইলমেরই। কেননা তারা হেদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং যারা হেদায়াতপ্রত্যাশী তাদের পথপ্রদর্শক। প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদা ঠিক ততটুকু, (নিজের ভেতর সে) যতটুকু ইলম স্থান দিয়েছে ও তাকে সুন্দর করেছে। আর জাহেলরা হচ্ছে আলেমদের শত্রু। তুমি ইলমের দ্বারাই সাফল্য লাভের চেষ্টা করো, তবে জীবন্তসত্তা হিসেবে জীবনযাপন করবে। সাধারণ মানুষ তো মৃত; আহলে ইলম কেবল জীবিত।’
আরেক কবি বলেন,
الناس من جهة التمثال أكفاء  أبـــوهمُ آدم والأم حواء
فإن يكن لهم في أصلهم نسب  يفاخرون به فالطين والماء
ما الفضل إلا لأهل العلم إنهمُ  على الهدى لم استهدى أذلاء
‘গঠনপ্রকৃতির দিক দিয়ে সব মানুষই সমান, তাদের আদি পিতা আদম এবং আদি মাতা হাওয়া। যদি তাদের মূলে বংশীয় গৌরব থাকে, তবে সেই গৌরবের অধিকারী হচ্ছে মাটি এবং পানি। বরং মর্যাদা কেবল আহলে ইলমের জন্যই, তারাই সুপথপ্রাপ্ত অপদস্তরাই সুপথ প্রার্থনা করে না।’
আরেক কবির ভাষায়-
العلم يرفع بيتاً لا عماد له ## والجهال يهدم بيت العز والشرف
العلم يسمو بقوم ذروة الشرف ## وصاحب العلم محفوظ من التلف
ياطالب العلم مهلاً لا تدنسه ## بالموبقات فما للعلم من خلف
‘ইলম স্তম্ভহীন ঘরকেও সমুন্নত করে, আর জাহেলরা ইজ্জত ও সম্ভ্রমের ঘর ভূলুণ্ঠিত করে। ইলম জাতির মর্যাদার চূড়া সমুন্নত করে, ইলমের অধিকারী ব্যক্তি ধ্বংস ও পতন থেকে নিরাপদ থাকে, হে ইলম প্রত্যাশী! কখনই তুমি ইলমকে কলঙ্কিত করো না ধ্বংসাত্মক বস্তু দ্বারা, কেননা ইলমের কোনো বিকল্প নেই।’
অন্য কবি বলেন,
العلم أنفس شيء أنت داخره
من يدرس العلم لم تدرس مفاخره
‘ইলম হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু যা তুমি সঞ্চয় কর! যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করে তার মর্যাদা কখনও পদদলিত ও কলঙ্কিত হয় না।’
বিখ্যাত মুফাসসির ও অভিধানবিদ আল্লামা যমখশারী বলেন,
سَهَرِي لِتَنْقِيحِ العُلُومِ أَلَذُّ لي ## مِنْ وَصْلِ غَانِية ٍ وَطيبِ عِنَاقِ
وتمايلي طرباً لحلِّ عويصة ٍ في الدَّرْسِ ## أَشْهَى مِنْ مُدَامَة ِ سَاقِ
وصريرُ أقلامي على أوراقها ## أحلى منَ الدَّكاءِ والعشاقِ
وَأَلَذُّ مِنْ نَقْرِ الفتاة لِدُفِّهَا ## نقري لألقي الرَّملَ عن أوراقي
‘ইলমের গবেষণায় রাত্রি জাগরণ আমার কাছে গায়িকা এবং মূল্যবান উষ্ট্রির চেয়ে আকর্ষণীয়; দরসের জটিল কোনো মাসআলা সমাধান করার বাসনা আমার কাছে সাকির শরাবের চেয়ে অধিক কাম্য ও সুস্বাদু। কাগজের পাতায় কলমের খসখসে আওয়াজ আমার কাছে প্রেমাস্পদের চেয়ে বেশি আনন্দের। আমার কাগজের ধূলোবালি দূর করার আঘাত গায়িকার দফে আঘাত করার চেয়ে বেশি শ্রুতিমধুর।’
আরেকজন কবি আলেমের অমরত্বের কাব্য গেয়েছেন নিচের কবিতায়-
أخو العلم حيٌ خالدٌ بعدَ موتِهِ ## و أوصالهُ تحتَ التُّرابِ رَمِيمُ
وذو الجهلِ مَيْتٌ وهو ماشٍ عَلَى الثَّرى ## يُظَنُّ مِنَ الأَحيَاءِ وهو عَديمُ
‘ইলমের বাহক মৃত্যুর পরও জীবিত, অমর। যদিও তার হাড়গোড় মাটির নিচে ছিন্নভিন্ন। পক্ষান্তরে জাহেলরা মৃত, যদিও সে ভূপৃষ্ঠে চলমান এবং খালি চোখে মনে হয় তারা জীবিত। কিন্তু বাস্তবে সে অস্তিত্বহীন।’
কোন্ ইলম শিক্ষা করা ফরয?
ইলম শিক্ষার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করেন না। কিন্তু আভিধানের আশ্রয় নিয়ে কেউ কেউ অপব্যাখ্যা করেন। ইলম মানে জানা, ইলম মানে জ্ঞান- অভিধানের এই অর্থ গ্রহণ করে কৌশলে অনেকেই জাগতিক জ্ঞান ও সেই সাধনাকেও দীনের অংশ হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। একারণে বই-পুস্তকে, স্কুল-কলেজের দেয়ালে লেখা থাকে- ‘প্রত্যেক নর-নারীর ওপর জ্ঞান শিক্ষা করা ফরয।’ কিন্তু আসলেই কি তাই? জাগতিক শিক্ষার জন্য কুরআন-হাদীছে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে? বর্ণিত ফযীলতের কথা বলা হয়েছে? আদৌ তা নয়। বরং কুরআন-হাদীছ এবং দীনী বিষয়ের যে জ্ঞান সেটাকেই ইলম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং সেগুলোরই ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। বিখ্যাত হাদীছ বিশারদ আল্লামা মুনাবী (রহ.) বলেন,
قد تباينت الأقوال وتناقضت الآراء في هذا العلم المفروض على نحو عشرين قولاً وأجود ما قيل قول القاضي أن العلم المفروض هو ما لا مندوحة عن تعلمه كمعرفة الخالق جل وعلا ونبوة محمد { وكيفية الصلاة ونحوها فإن تعلمها فرض عين والظاهر أن المراد به كل ما يحتاجه المسلم من أمور العقيدة وشرائع الإسلام من حلال وحرام مما جاء عن النبيﷺ
‘এই ফরয ইলমের ব্যাপারে পরস্পর বিরোধী প্রায় বিশটি মত-অভিমত রয়েছে। তবে সবচেয়ে উত্তম মত হচ্ছে কাজী ইয়াদ্ব (রহ.)-এর অভিমত। তা হচ্ছে; ফরয ইলম হচ্ছে যা শিক্ষা করার বিকল্প নেই। যেমন, আল্লাহ তা‘আলার মারেফাত হাসিল করা, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান হাসিল করা, সালাত ও অন্যান্য বিধান সম্পর্কে অবহিত হওয়া। এসব ইলম হাসিল করা ফরযে আইন। মোটকথা হচ্ছে, জরুরী আকীদা, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত শরীয়তের প্রতিটি বিধান যথাযথভাবে জানার জন্য মুসলিম যে ইলমের মুখাপেক্ষী সেটাই ফরয ইলম হিসেবে বিবেচিত।
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
«طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ »
‘ইলম শিক্ষা করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরয।’ [ইবন মাজাহ: ২২৪]
এর ব্যাখ্যায় ওলামায়ে কেরাম লিখেন-
فأشرف العلوم ثمرة العلم بالله سبحانه وتعالى وملائكته ورسله وما يعين عليه فإن ثمرته السعادة الأبدية
‘সর্বশ্রেষ্ঠ ইলম হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে জ্ঞান হাসিল হওয়ার ইলম, তাঁর ফেরেশতা, রাসূল এবং এগুলোর সহায়ক ইলম। কারণ এর ফল হলো অনন্ত সৌভাগ্য।’
হাসান ইবন রবী‘ (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
سألت ابن المبارك عن قول النبي صلى الله عليه وسلم: طلب العلم فريضة على كل مسلم قال: ليس هو الذي يطلبونه ولكن فريضة على من وقع في شيء من أمر دينه
‘ইলম শিক্ষা করা ফরয’ দ্বারা সেই ইলম উদ্দেশ্য নয়, মানুষ যা (জাগতিক স্বার্থে) হাসিল করে। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে দীনের প্রয়োজনের ইলম।’
ইলমের পথে চলে কোনো কারণে কাঙ্ক্ষিত ইলম হাসিল করতে না পারলেও ছাওয়াব
ইলমের রাস্তা এমন এক বরকতময় রাস্তা যে, এখানে ব্যর্থতা বলতে কোনো কিছু নেই। এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি ইলম হাসিল করতে এসে কোনো কারণে ব্যর্থও হয়, তথাপি তার জন্য ছাওয়াব রয়েছে। স্কুল-কলেজে তো পাশ করতে না পারলে কয়েক বছরের শ্রম একেবারেই বৃথা যায়। পরীক্ষার আগের সমস্ত লেখাপড়াকে ব্যর্থ ও মূল্যহীন আখ্যায়িত করা হয় পরীক্ষায় পাশ করতে না পারলে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার খাজানা এবং দানের ভাণ্ডার এত বিস্তৃত যে, তিনি দ্বীনী ইলম শিখতে আসা কাউকে বঞ্চিত করেন না। বরং একনিষ্ঠতার সঙ্গে কেউ ইলম শিখতে এসে যদি কোনো কারণে ব্যর্থ হয় আল্লাহ তা‘আলা তাকেও তার নিয়তের বদৌলতে ছাওয়াব দান করেন।
ইলমের ধারাবিন্যাস
পূর্বসূরীগণ ইলমের চমৎকার একটি ধারাবিন্যাস উল্লেখ করেছেন। যথা-
وقيل أول العلم الصمت ثم الاستماع ثم الحفظ ثم العمل ثم نشره
‘ইলমের প্রথম অংশ নীরবতা, তারপর কান পেতে শ্রবণ করা, এরপর হিফজ করা, অতপর আমল করা এবং তারপর ইলমের প্রচার-প্রসার ঘটানো।’
ইলম অর্জন করার পদ্ধতি
ইলম হাসিল করার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু হিকমত ও কৌশল আছে। ইলম হাসিল এবং নিজের মধ্যকার অজ্ঞতা দূর করার সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ উপায় হচ্ছে সংকোচ দূর করা। যেমন, পূর্বসূরীরা বলে থাকেন-
وقيل علِّم علمك من يجهل وتعلم ممن يعلم ما تجهل فإنك إذا فعلت ذلك علمت ما جهلت وحفظت ما علمت
‘প্রথমে যে ব্যক্তি জানেন না তাকে আপনার ইলম দান করুন। আর আপনি যা জানেন না, তা যিনি জানেন তার কাছ থেকে শিক্ষা করুন। যদি এরূপ করেন তবে আপনি যে বিষয়ে অজ্ঞ সে আপনার ইলম হাসিল হবে এবং যা জানেন না তাও আয়ত্বে থাকবে।’
ইলম শিখতে এসে যারা ফিরে গেছে তারা চরম ব্যর্থ হয়েছে
অনেকে ইলম হাসিল করতে আসে না। আর কেউ কেউ এসেও নানা কারণে ঝরে পড়ে। সাবধান! অমন দুর্ভাগা যেন আমরা কেউ না হই। যারা ইলম শিখতে আসে না কিংবা এসেও কোনো কারণে ফিরে যায়, পৃথিবীতে তাদের চেয়ে হতভাগা কোনো লোক নেই। কথাটির সত্যতা পাওয়া যায় একটি হাদীছে। তাতে এসেছে,
بينما نحن مع رسول الله صلى الله عليه و سلم إذ مر ثلاثة نفر فجاء أحدهم فوجد فرجة في الحلقة فجلس وجلس الآخر من ورائهم وانطلق الثالث فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم ألا أخبركم بخبر هؤلاء النفر قالوا بلى يا رسول الله قال أما الذي جاء فجلس فأوى فآواه الله والذي جلس من ورائكم فاستحى فاستحى الله منه وأما الذي انطلق رجل أعرض فأعرض الله عنه
একবার তিনজন লোক রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসেন। সে সময় তিনি সাহাবায়ে কেরামকে ইলম শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনজনের একজন মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজের প্রয়োজনে চলে যায়, দ্বিতীয়জন মজলিসের মাঝখানে জায়গা পেয়ে সেখানে বসে পড়েন এবং ইলমের মজলিসে বসার কারণে ফেরেশতাদের দু‘আ, আল্লাহ তা‘আলার রহমত এবং সমস্ত প্রাণীর দু‘আ লাভের সৌভাগ্য হাসিল করেন। আর তৃতীয় ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলাকে লজ্জা করেন অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে ভীড় ঠেলে বসতে সংকোচবোধ করেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলাও তার প্রতি রহমতের ব্যাপারে লজ্জাবোধ করেন অর্থাৎ তাকে রহমত থেকে বঞ্চিত করেন[4]।
এর দ্বারা বোঝা গেল, ইলমের মজলিসে ভীড় ঠেলে হলেও বসা নিন্দনীয় নয়, বরং প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে লজ্জা বা সংকোচবোধ করা আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ।
হাদীছ থেকে আমরা জানতে পারি, ইলমের মজলিসে বসা শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাপ্রাপ্তির মাধ্যম। পক্ষান্তরে ইলমের মজলিস ত্যাগ করা পরম বঞ্চনা ও ব্যর্থতার লক্ষণ।
তাছাড়া ইলম ও যিকিরের মজলিস পরিত্যাগকারীদের ব্যাপারে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
﴿ وَمَن يَعۡشُ عَن ذِكۡرِ ٱلرَّحۡمَٰنِ نُقَيِّضۡ لَهُۥ شَيۡطَٰنٗا فَهُوَ لَهُۥ قَرِينٞ ٣٦ ﴾ [الزخرف: ٣٦]
‘যারা দয়াময়ের যিকির ও স্মরণ থেকে দূরে সরে যায় আমি তাদের জন্য একজন শয়তানকে নির্দিষ্ট করি। ফলে সে তার সঙ্গী হয়ে যায়।’ {সূরা যুখরুফ, আয়াত: ৩৬}
ইলম হাসিলের সহায়ক
ইলমের অনেক ফযীলত। সীমাহীন এর গুরুত্ব। পূর্বোক্ত বর্ণনা ও আলোচনায় তা স্পষ্ট হলো। কিন্তু কীভাবে তা হাসিল হবে? ইলম কী খুব সহজেই হাসিল হয়? কোনো কষ্ট-ক্লেশ বরদাশত করা ছাড়া? না, ইলম হাসিলের জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা করতে হয়। সময় ব্যয় করতে হয়। শ্রম দিতে হয় এবং অনেক গুণের অধিকারী হতে হয় কিংবা নিজের মধ্যে গুণ সৃষ্টি করতে হয়। বুযুর্গানে কেরাম ইলম হাসিলের জন্য ছয়টি গুণ আবশ্যক বলেছেন। যথা-
এক. মেধা। মেধা এমন এক বস্তু, যা প্রতিটি মানুষের মধ্যে কমবেশি বিদ্যমান। আল্লাহ তা‘আলা একেবারে মেধাশূন্য কোনো মানুষ সৃষ্টি করেননি। কম হোক বেশি হোক প্রত্যেকের মধ্যেই মেধা আছেই। এটাই আল্লাহ তা‘আলার ইনসাফ। একেবারে মেধাশূন্য করে তিনি কোনো বান্দার প্রতি বে-ইনসাফ করেন নি। সুতরাং যারা মেধাশূন্যতার দোহাই দেয় তারা ভুল করে এবং ভুল বিশ্বাসের সঙ্গে বাস করে।
দুই. ইলম অন্বেষণের প্রতি তীব্র বাসনা থাকা। সুতরাং ইলম শিক্ষার্থী এবং শিক্ষার্থীনির কর্তব্য হচ্ছে ইলম অন্বেষণের প্রতি তীব্র বাসনা ও আগ্রহ রাখা। ইলমের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য উদগ্রীব থাকা। ইলম শিক্ষার জন্য ছোটো-বড় সকলের শরণাপন্ন হওয়া। ইলমের সূক্ষ্মতা ও গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছার ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা এবং সর্বোচ্চ মেধা খরচ করা।
তিন. ইলম হাসিলের জন্য সবর, ত্যাগ ও মুজাহাদা করা। একজন তালেবে ইলমের জন্য এই গুণ খুবই জরুরী। এই গুণ অর্জন করা ছাড়া কেউ তালেবে ইলম হওয়ারই যোগ্যতা রাখে না। ইলম তো সবর ও চেষ্টার অপেক্ষায় থাকে। তাই এই গুণ দুটি ছাড়া ইলম হাসিলে সাফল্য লাভ করার কল্পনা করা বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
তালেবে ইলমের জন্য চাই অপরিসীম সবর ও ধৈর্য। মনে রাখতে হবে, ইলমের পথ সংক্ষিপ্ত নয়। বরং দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েই কেবল ইলম সাধনায় সফলতা পাওয়া যায়। ইলমের পথপরিক্রমা তো সেই দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত! এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে কিঞ্চিত কষ্ট বরদাশত করতে হবে না! নফসকে দমন করতে হবে না!
ইলম অন্বেষণে নফসকে দমন ও কষ্ট স্বীকারে প্রস্তুত করার জন্য দুইভাবে সবর ও ধৈর্য্যরে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। প্রথমত. এ কথার শিক্ষা যে, ইলম হচ্ছে ইবাদত। আর প্রতিটি ইবাদত পালনেই কষ্ট স্বীকার করতে হয়। দ্বিতীয়ত. ইলম শিক্ষার পথপরিক্রমায় অহর্নিশ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে থাকা।
কী রকম ধৈর্য? শুধু পাঠকক্ষে উপস্থিত হওয়ার কষ্ট স্বীকারের ধৈর্য? না। শুধু উস্তাদগণের সান্নিধ্যে থাকার ধৈর্য? না। দরসের পড়া শ্রবণ ও তা ধরে রাখার ধৈর্য? না। শুধু এসব বিষয়ের ধৈর্যই যথেষ্ট নয়। বরং ইলম থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এধরনের যাবতীয় বস্তু থেকে দূরে থাকাই হচ্ছে ইলম হাসিলে ধৈর্যধারণ করা। যুবক ও তরুণদের জন্য এই বিষয়টি বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। কেননা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তারা পথ হারিয়ে ফেলে। যুগের নানা রকম আহ্বান তাদেরকে ভ্রান্ত পথে চালিত করে। তাই তাদেরকে ইলমের পথে টিকে থাকার জন্য অপরিসীম ধৈর্যধারণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইলম শিক্ষা করতে এসে কিছুটা কষ্টের সম্মুখীন না হলে, ত্যাগ স্বীকার করতে না পারলে পরবর্তী জীবনে সফলতা পাওয়া যায় না।
ইবন আতাউল্লাহ (রহ.) বলেন,
من كانت بداياته محرقة قوية كانت نهاياته مشرقة.
‘যার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় কষ্টের তার শেষ জীবন হয় উজ্জ্বল।’
বস্তুত ইলমের গভীরতা ও সূক্ষ্ম ইলম হাসিল করতে হলে কষ্ট স্বীকার করতেই হবে। মনে রাখা চাই, ইলম সাধারণ ওয়াজ-নছিহত নয় যে, যেখান সেখান থেকে, যেভাবে সেভাবে সংগ্রহ করা যায়। বরং খাঁটি ইলম সংগ্রহ করতে হলে অবশ্যই কষ্ট স্বীকার করতে হবে এবং কষ্ট স্বীকারে ধৈর্যও ধারণ করতে হবে। ইবন মুবারক (রহ.)-এর কথায় এই বিষয়টিই ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন-
إذا رأيت موعظة، أو إذا مررت بجدار فرأيت مكتوبا عليه موعظة، فقف عندها لتتعظ؛ ولكن الفقه في الدين إنما يكون بالمشافهة والسماع
‘যদি কোথাও ওয়াজ শুনতে পাও অথবা পথ চলতে দেয়ালের গায়েও উপদেশ বাক্য লেখা দেখতে পাও তবে সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যাও এবং নছিহত গ্রহণ করো। কিন্তু মনে রেখো, দীনের ফিকহ হাসিল করা এরকম সহজ নয়। বরং তা সরাসরি ও উস্তাদের কাছে শ্রবণ করে হাসিল করতে হয়।’
এই বাণীতে এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, একজন মানুষ সাধারণ ওয়াজ-নছিহত, আদেশ-উপদেশ সুযোগ অনুযায়ী যে কোনো স্থান থেকেই হাসিল করতে পারে। কিন্তু ইলম হাসিলের বিষয়টি আদৌ এমন নয়। বরং এর জন্য ত্যাগ স্বীকার ও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় এবং কষ্টসহিষ্ণু হতে হয়। নফসের সঙ্গে তুমুল লড়াই করতে হয়। আরো মনে রাখা উচিত, কেউ যদি ইলম হাসিলের জন্য নিজেকে দীর্ঘদিন আবদ্ধ না রাখে, ধৈর্য হারিয়ে ফেলে তবে তাকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হতে হবে। ইলমের ভাণ্ডার থেকে মাহরুম হবে। উদাহরণস্বরূপ মূসা (আ.)-এর ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি খিযির (আ.)-এর সঙ্গে বেশিদিন অবস্থান করার ধৈর্যধারণ করতে পারেন নি বলে তিনি বেশি উপকৃত হতে পারেননি এবং এ কারণে আমরাও অনেক ইলম থেকে বঞ্চিত হয়েছি। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
يَرْحَمُ اللهُ مُوسَى لَوَدِدْنَا أَنَّهُ صَبَرَ حَتَّى يَقُصَّ عَلَيْنَا مِنْ أَخْبَارِهِمَا
‘আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আ.)-এর ওপর রহম করুন। আক্ষেপ, তিনি যদি আরেকটু ধৈর্যধারণ করতেন তবে আমরা তাদের আরো অনেক কিছু জানতে পারতাম।’ [বুখারী: ১২২; মুসলিম: ১৭০]
বর্ণিত আছে-
لو صبرتَ لأتيتُ بك على ألفي عجيبة، كلها مما رأيت
‘খিজির (আ.) বললেন, আপনি যদি ধৈর্যধারণ করতেন তবে আমি আপনার সামনে আমার দেখা দুই হাজার বিস্ময়কর ও হেকমতপূর্ণ ঘটনা পেশ করতাম।’ [তাফসীর আল-বাহরুল মাদীদ: ১১/২৭৭]
সুতরাং সবর করতে হবে এবং দীর্ঘসময় নিয়ে ইলম অন্বেষণে ব্যস্ত থাকতে হবে। এমনকি ঘরে-বাইরে, সমাজে-রাষ্ট্রে সর্বদা ইলমেরই চর্চা করতে হবে। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, আমি আমার পরিবারের লোকদের সঙ্গে থাকার সময়ও আমার সামনে মাসআলা হাজির হয় এবং আমি ইলমী বিষয়ে মশগুল থাকি।
আমাদের পূর্বসূরীগণের অনেকেই ইলম হাসিলে এত বিমগ্ন থাকতেন যে, এ কারণে কেউ হয়ত বিবাহই করেননি, আবার কেউ অনেক বিলম্বে বিয়ে করেছেন।
আল্লামা আবদুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ (রহ.) ‘আল-উলামাউল উয্যাব’ নামে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে ইসলামী ইতিহাসের বহু বিখ্যাত মনীষীর জীবনী আলোচনা করা হয়েছে, যারা শুধু দীনী ইলম হাসিল এবং তা মানুষের মধ্যে বিস্তারের জন্যই বিবাহের পার্থিব সুখানন্দ থেকে নিজেদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিরত রেখেছেন।
এছাড়াও অনেক মাশায়েখ শুধু ইলম হাসিলের স্বার্থে বিয়েশাদী বিলম্ব করতেন। যেমন, বিখ্যাত মনীষী আল্লামা ইবন রজব হাম্বলী রহ. (৭৯৫ হি.)। তিনি ইলম হাসিলে এত বিমগ্ন ছিলেন যে, অনেক বয়স হওয়ার পর তাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। আর বিয়ের দিনেও মুতালা‘আ বা অধ্যয়ণ এবং জ্ঞানসাধনায় এত মগ্ন ছিলেন যে, স্ত্রী সেজেগুজে, সুগন্ধি মাখিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ানোর পরও তিনি টের পেলেন না। তিনি স্ত্রীর দিকে দৃষ্টিপাতের ঘটনা বর্ণনা করে বলতেন, অনেকক্ষণ পর আমি তার দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে নজর দিয়েছিলাম। এরপর তিনি স্ত্রীর কিছু বিবরণ দেয়ার পর বলেন, অতপর আমি কিতাবের দিকে মনোনিবেশ করলাম এবং অসমাপ্ত পড়া শেষ করলাম। কিন্তু স্ত্রী এতে দারুণ ক্রুদ্ধ হলো এবং সেখান থেকে চলে গেল।
বস্তুত তারা নিজেরাও জানেন, যে ব্যক্তি যে হকের অধিকারী তাকে সেই হক প্রদান করা জরুরী। কিন্তু কখনও কখনও এই বাস্তবতার ওপর মানুষের স্বভাব প্রবল হয়ে ওঠে এবং যে যেভাবে জীবন গড়ে তুলেছে তার মধ্যে সেই বস্তু প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করে। যেহেতু ইবন রজব হাম্বলী (রহ.) সারা জীবন গ্রন্থ অধ্যয়ণ ও জ্ঞানসাধনায় মগ্ন থেকেছেন, একারণে বাসর রজনীতেও নববধূর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করার কথা ভুলে গেছেন এবং সারা জীবনের সঙ্গী কিতাবপত্রের সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন! অনেকে তো কিতাবাদির সঙ্গে এত সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন যে, রাতে শোয়ার সময় শিয়রে বইপত্র ও অধ্যয়নের সামগ্রী নিয়ে শুতেন!
চার. পানাহারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকা। আলহামদুলিল্লাহ, বর্তমান সময়ে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে যে সম্পদ দান করেছেন তাতে সকলের জন্য এই শর্ত সহজ এবং ইলম শিক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত খরচাদির অনকূল ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
পাঁচ. যোগ্য ও স্নেহপ্রবণ উস্তাদের সান্নিধ্য গ্রহণ। সার্বক্ষণিক উস্তাদের সান্নিধ্যে থেকে ইলম হাসিল করতে হবে। মনে রাখতে হবে, উস্তাদ ছাড়া শুধু বই-পুস্তক ঘেঁটে আলেম হওয়া যায় না।
ছয়. ইলম অন্বেষণের জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করা, দ্রুততা অবলম্বন না করা। একজন খাঁটি আলেম হতে হলে অবশ্যই তাকে সময় দিতে হয়। সাধনা করতে হয়। ইলম তো মেশিনে প্রাপ্ত কোনো বস্তু নয় যে, সকালে ঢুকে বিকেলে আলেম হয়ে বের হওয়া যাবে! ইবন শিহাব যুহরী (রহ.) বলতেন,
ومن أراد العلم جملة ذهب عنه جملة
‘যে ব্যক্তি একসঙ্গে সব ইলম পেতে চায় তার সব কিছু একসঙ্গে হারিয়ে যায়।’
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এক কবিতায় এই ছয়টি বস্তুকে একত্রিত করেছেন। যথা-
أخي لن تنال العلم إلا بستة  سأنبيك عنـــــها ببيان
ذكاء وحرص وافتقار وغربة  وتلقين أستاذ وطول زمان
‘ভাই! ছয়টি বস্তু ছাড়া তুমি ইলম হাসিল করতে পারবে না। আমি তোমাকে সেই ছয়টি বস্তু বর্ণনা করে শোনাবো। মেধা, বাসনা, আগ্রহ, সফর, উস্তাদের সাহচার্য এবং দীর্ঘ সময় ব্যয়।’
জনৈক ফার্সি কবির ভাষাতেও এই ছয়টি গুণের কথা প্রকাশিত হয়েছে। যথা-
علم را هر گز نيابى تا نه داري شش خصال
حرص قطع فهم كامل جمع خاطر كل حال
خدمت استاذ بايد هم سبق خواني مدام
لفظ را تحقيق كنى تا شوي مرد كمال
‘তুমি ছয়টি গুণ ছাড়া কিছুতেই ইলম পাবে না। তীব্র আকাঙ্ক্ষা, পূর্ণ বোধ, সর্বাবস্থায় মনসংযোগ, শিক্ষকগুরুর সেবা, সর্বোপরি সারাক্ষণ অধ্যয়নে অভিনিবেশ আর শব্দের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বুঝে পাঠ- এসব বৈশিষ্ট্য আমলে নাও যাতে তুমি একজন পরিণত মানুষ হতে পার।’
ইলমের অন্তরায়
ইলম অমূল্য সম্পদ, সীমাহীন এর গুরুত্ব। আর দুনিয়ার নিয়মই এমন, যে বস্তু যত মূল্যবান তা ততই গুরুত্বের দাবি রাখে এবং মানুষ তা হাত ছাড়া না হওয়ার নানা রকম উপায় অবলম্বন করে। সে হিসেবে ইলম অর্জনে সহায়ক অনেক পন্থাও যেমন অবলম্বন করতে হয় তেমনিভাবে ইলম অর্জনে প্রতিবন্ধক অনেক পন্থাও পরিহার করতে হয়। আসলে যুগ ও সময়ের হাওয়ায় প্রতিবন্ধকতার নতুন নতুন উপসর্গ যোগ হয়। তাই যুগ ও সময়ের বিচার ও মূল্যায়ন করে ইলমের অন্তরায় যাবতীয় বিষয়াদি থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে। নিম্নে ইলমের প্রতিবন্ধক কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো। আশা করি আমরা সকলে এসব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
প্রথম অন্তরায়: ইলমের মর্ম সম্পর্কে অবহিত না হওয়া
ইলমের প্রতিবন্ধকতার একটি হচ্ছে, ইলমের মর্ম সম্পর্কে অবহিত না হওয়া। অর্থাৎ ইলম যে অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ তার মর্ম অনুধাবন করতে ব্যর্থ হওয়া। অনেকে ইলম হাসিল করতে আসে বটে কিন্তু এর মূল্য অনুধাবন করতে পারে না। সে মনে করে ইলম নিতান্তই মামুলি বস্তু এবং এর উপকারিতা সামান্য। বরং কেউ কেউ তো চরম হীনমন্যতায় ভোগে একথা ভেবে যে, ধর্মহীন জাগতিক শিক্ষায় ধন-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির সুযোগ বেশি। কিন্তু এখানে তো এর কিছুই নেই! এসব ভেবে নিজেকে একেবারে মূল্যহীন এবং ইলমকে স্বল্পদামী জ্ঞান করে। যার চূড়ান্ত পরিণাম হচ্ছে ইলম থেকে বঞ্চিত হওয়া।
দ্বিতীয় অন্তরায়: নিয়তে ত্রুটি
আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোনো নিয়তে ইলম অন্বেষণ করা। এটা তো বলাইবাহুল্য যে নিয়ত ঠিক না হলে কোনো নেক কাজই মূল্যবান হয় না। উমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
«إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَلِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى »
‘নিশ্চয় আমলের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেকের জন্য তাই থাকবে যা সে নিয়ত করবে।’ [বুখারী: ১]
আমলের বিশুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
لو أن أهل العلم صانوا العلم ووضعوه عند أهله لسادوا به أهل زمانهم . ولكنهم بذلوه لأهل الدنيا لينالوا به من دنياهم ، فهانوا عليهم سمعت نبيكم صلى الله عليه وسلم يقول: من جعل الهموم هما واحدا ، هم آخرته ، كفاه الله هم الدنيا ، ومن تشعبت به الهموم في أحوال الدنيا ، لم يبال الله في أي أوديتها هلك
‘আহলে ইলম যদি ইলম হেফাজত করতেন এবং যথাস্থানে তা রাখতেন তবে তারা যুগের নেতৃত্ব লাভ করতে পারতেন। কিন্তু ইলমকে পার্থিব স্বার্থে ব্যবহৃত করার ফলে ক্ষমতাসীনরা তাদেরকে লাঞ্ছিত করেছে। আমি তোমাদের নবীর মুখে শুনেছি। যে ব্যক্তি আখেরাতকে একমাত্র ফিকিরের বস্তু বানাবে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি দুনিয়ায় পেছনে ছোটে সে যে উপত্যকায় ধ্বংস হোক তাতে আল্লাহ তা‘আলা কোনোরূপ ভ্রূক্ষেপ করবেন না।’
সুতরাং তালেবে ইলমের একমাত্র নিয়ত হতে হবে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। অন্যথায় তা বিপদের কারণ হবে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللَّهِ، لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلَّا لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا، لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ»
‘কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শিক্ষা করা হয় যে ব্যক্তি এমন ইলম শিক্ষা করবে দুনিয়ার কোনো স্বার্থ অর্জনের নিমিত্তে, সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের গন্ধও পাবে না।’ [আবূ দাঊদ: ৩৬৬৪, সহীহ]
আতা রহ. বলেন,
جعل الله العلم الذى علمه من هذا وصفه حجة عليه ومثل من تعلم العلم لاكتساب الدنيا والرفعة فيها كمن رفع العذرة بملعقة من الياقوت، فما أشرف الوسيلة وما أخس المتوسل إليه
‘আল্লাহ যে ইলম শিখিয়েছেন একে, তিনি তা বান্দার বিপক্ষে দলিল বানিয়েছেন। যে ব্যক্তি দুনিয়া উপার্জন ও তাতে মর্যাদা লাভের জন্য ইলম হাসিল করে সে ওই ব্যক্তির মতো যে ইয়াকুত পাথরের চামচ দিয়ে ময়লা ওঠায়। আহ্! মাধ্যম কত মর্যাদার আর তা দ্বারা ওঠানো বস্তু কত নগণ্য!
সুহনুন বলেন, ইবনুল কাসেম আমাদেরকে বারবার বলতেন,
اتقوا الله فإن قليل هذا الأمر يعني العلم مع تقوى الله كثير ، وكثيره مع غير التقوى قليل
‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। কেননা আল্লাহভীতির সঙ্গে এই জিনিস তথা ইলম সামান্যও অনেক। পক্ষান্তরে আল্লাহভীতি ছাড়া অনেক ইলমও সামান্য।’
হাম্মাদ ইবন সালামা বলেন,
العلم موقوف على العمل والعمل موقوف على الإخلاص ، والإخلاص يورث الفهم عن اله عز وجل
‘ইলম নির্ভর করে আমলের ওপর। আর আমল নির্ভর করে ইখলাসের ওপর। ইখলাস এমন বস্তু, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বান্দার মধ্যে সমঝ সৃষ্টি করে।’
তৃতীয় অন্তরায়: ইলম ও উস্তাদের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন করা
ইলম থেকে বঞ্চিত এবং তা থেকে উপকৃত হতে ব্যর্থ হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, ইলম ও উস্তাদের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন করা। অতীত ও বর্তমানে এধরনের বহু ঘটনার উদাহরণ পাওয়া যায়। ইলম ও উস্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু দরসের সময়ের সঙ্গে নয়; বরং আজীবন তা বজায় রাখতে হয়। আর শিক্ষা সমাপনের পর কিংবা পড়াশোনার সময়েও এক দরস থেকে আরেক দরসের মাঝখানে যে বিশাল সময় থাকে তা অহেতুক, অপ্রয়োজনীয় কিংবা গালগল্পের মধ্যে কাটিয়ে দিলে আস্তে আস্তে ইলমের মহব্বত ও আকর্ষণ কমে যায়। এভাবে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে জাগতিক কাজে। এভাবে ইলমের প্রতি অমনোযোগীতা ও বিকর্ষণ সৃষ্টি হয়। যা তাকে শেষ পর্যন্ত পথহারা করে ছাড়ে। অনেক মেধাবী ছাত্রের শুধু একারণে ইলম থেকে বঞ্চিত হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আজ আমাদের অবস্থা এতই শোচনীয় যে, রাস্তাঘাটে সাধারণ লোকদের সঙ্গে বসে গল্পগুজব করা, অপ্রয়োজনে রাস্তার পাশে বসে চা খাওয়ার নামে প্রচুর সময় ব্যয় করার মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আমাদের পূর্বসূরী পুণ্যবানদের অবস্থা কি তাই ছিল? ইতিহাসে এমন বহু ঘটনা পাওয়া যায়, যাতে এ কথার উল্লেখ রয়েছে যে, তারা শুধু ইলমের জন্য দুনিয়ার হাজার রকমের স্বাদ-আহ্লাদ ও সুখকর বস্তু পরিহার করে চলেছেন। তারা ইলমের মধ্যে এত স্বাদ খুঁজে পেয়েছিলেন যে যাবতীয় পার্থিব সুখকে তারা দু’পায়ে মাড়াতেন আকুণ্ঠচিত্তে। জনৈক কবি এক আলেমের শানে এরূপ একটি ঘটনার কাব্যিক বিন্যাস করেছেন। একবার এক সুন্দরী ও চরিত্রবান দাসী আসল এক আলেমের কাছে। কিন্তু তিনি তার দিকে ভ্রূক্ষেপও করলেন না। বরং বললেন-
فقلت ذريني واتركيني ## ولي في طلاب العلم والفضل والتقى
فإنّني شغلت بتحصيل العلوم وكشفها ## غنى عن غناء الغانيات وعرفها
‘আমাকে ছাড়ো। আমার তো ইলম অন্বেষণ ও ইলমচর্চার কাজ রয়েছে। আমি ইলম অর্জন ও এর রহস্য উদঘাটনেই ব্যস্ত থাকতে বেশি পছন্দ করি। আর এটাই আমার জন্য গায়িকার গান এবং দাসীর সঙ্গস্বাদ পূর্ণ করে দেয়।’
মোটকথা, ইলমের স্বাদ ও পিপাসা স্বভাবজাত অভ্যাসে পরিণত না করা পর্যন্ত অন্যদিকে মনোনিবেশ করা যাবে না। এভাবে অভ্যাস গড়ে উঠলে একদিন এমন আসবে, যেদিন দুনিয়ার হাজারও পার্থিব উপকরণ সামনে আসা সত্ত্বেও সেদিকে মন যাবে না।
নিঃসন্দেহে এটি একটি কঠিন কাজ। কিন্তু রোগ তো সারাতে হবে! মানুষ রোগমুক্তির জন্য কত সুখ সম্ভারই না ত্যাগ করে! সুস্বাদু খাবার, প্রভাতের মৃদমন্দ স্নিগ্ধ ও কোমল হাওয়ায় সুখকর ঘুম ত্যাগ করে ব্যায়াম করে, আরো কত কি! তবে নিজের দুনিয়া ও আখিরাতের মহা রোগ মূর্খতার জন্য কেন তুমি কিছু কষ্ট স্বীকার করতে পারবে না? আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘মূর্খতা এমন এক রোগ, যা রোগীকে কখন খুন করে ফেলে তা রোগী নিজেও টের পায় না।’ তিনি আরো বলেন,
والجهل داء قاتل وشفاؤه علم من القرآن أو من سنة
أمران في الترتيب متفقان وطبيب ذاك العــــالم الرباني
‘মূর্খতা হচ্ছে খুনী রোগ। আর এর শেফা হচ্ছে সর্বসম্মতভাবে দুটি বিষয়, কুরআন ও সুন্নাহর ইলম। আর ডাক্তার হচ্ছেন আলেমে রব্বানী।’
চতুর্থ অন্তরায়: আমল তরক করা
ইলমের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে আমল। সুতরাং আমলহীন ইলম অর্থহীন এবং বিপদের কারণ। হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
عَنْ أَبِي بَرْزَةَ الأَسْلَمِيِّ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تَزُولُ قَدَمَا عَبْدٍ يَوْمَ القِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ، وَعَنْ عِلْمِهِ فِيمَ فَعَلَ، وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ، وَعَنْ جِسْمِهِ فِيمَ أَبْلَاهُ» هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ
‘আবূ বারযা আসলামী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন বান্দা একচুল কদম সরতে পারবে না যাবৎ না তাকে (চারটি প্রশ্নের উত্তর) জিজ্ঞেস করা হয়: তার হায়াত সম্পর্কে, কীসে তা বিলিয়ে দিয়েছ; তার ইলম সম্পর্কে, কোথায় সে আমল করেছে; তার সম্পদ সম্পর্কে, কোত্থেকে সে উপার্জন করেছে এবং কোথায় সে ব্যয় করেছে এং তার দেহ সম্পর্কে, কোন কাজে তা পুরনো করেছে।’ [তিরমিযী: ২৪১৭, সহীহ]
ফুযাইল ইবন ইয়াদ্ব বলেন,
لا يزال العالم جاهلا بما علم حتى يعمل به ، فإذا عمل به كان عالما
‘ইলম অনুযায়ী আমল না করলে ওই ব্যক্তি জাহেল। যখন আমল করবে কেবল তখনই সে আলেম বলে গণ্য হবে।’
ইমাম শা‘বী (রহ.) বলেন,
كنا نستعين علي حفظ الحديث بالعمل به ، وكنا نستعين على طلبه بالصوم
‘আমরা হাদীছ মুখস্থ করার ক্ষেত্রে তদনুযায়ী আমলের মাধ্যমে সহযোগিতা নিতাম আর তা অর্জনে সহযোগিতা নিতাম সাওম পালনের।’
সাহাবায়ে কেরাম দশটি আয়াত শিখলে আগে সেগুলোর ওপর আমল করে পরে অন্য আয়াত শিখতেন।
ইবনুল জাওযী (রহ.) বলেন,
والمسكين كل المسكين من ضاع عمره في علم لم يعمل به ، ففاته لذات الدنيا وخيرات الآخرة
‘নিঃস্ব ও সম্পূর্ণ মিসকিন ওই ব্যক্তি, যে সারা জীবন এমন ইলমের জন্য ব্যয় করল যার ওপর আমল করা হলো না। ফলে সে দুনিয়ার স্বাদ থেকেও বঞ্চিত হলো আখেরাতের কল্যাণ থেকেও বঞ্চিত হলো।’
পঞ্চম অন্তরায়: শুধু কিতাবের ওপর ভরসা করা
কোনো কোনো তালেবে ইলম ধারণা, উস্তাদ ছাড়া শুধু কিতাব থেকেই ইলম হাসিল করা যায়। এ ধরনের ধারণা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর। উস্তাদের সাহচর্য, সান্নিধ্য ‌ও দিকনির্দেশনা ছাড়া ইলম হাসিলের কল্পনাই করা যায় না। পূর্বসূরী পূর্বসূরীগণ বিভিন্ন ভাষায় এ ধরনের ধারণার নিন্দা করেছেন। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন,
من تفقه من بطون الكتب ضيع الأحكام
‘যে ব্যক্তি কিতাবের পেট থেকে জ্ঞানে প্রাজ্ঞতা অর্জন করে সে বিধানাবলিকে ধ্বংস করে ছাড়ে।’
ফকিহ সুলায়মান মূসা বলেন,
كان يقال: لا تأخذوا القرآن من المصحفين ، ولا العلم من الصحفيين
‘বলা হতো, লিপিকার থেকে কুরআন এবং কিতাবের পাতা থেকে তোমরা ইলম গ্রহণ করো না।’
সাঈদ ইবন আবদুল আযীয তানূখীও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন,
لا تحملوا العلم عن صحفي ، ولا تأخذوا القرآن من مصحفي
‘তোমরা লিপিকার থেকে (কুরআনের) বিদ্যা তালাশ করো না আর কিতাবের পাতা থেকে কুরআন গ্রহণ করো না।’
জ্ঞানীগণ বলেন,
من كان شيخه كتابه ، كان خطؤه أكثر من صوابه
‘যার শিক্ষক হলো শুধু কিতাব, তা সঠিকের চেয়ে বেঠিকই বেশি।’
ষষ্ঠ অন্তরায়: শুধু নবীনদের ইলমে ভরসা করা
প্রতিবন্ধকতার আরেকটি বিষয় হচ্ছে অভিজ্ঞতাহীন নবীনদের থেকে ফিকহ-ফাতাওয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ ইলম হাসিল করা। বস্তুত অভিজ্ঞতা এবং বয়সের একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে, যা নবীনদের মধ্যে অনুপস্থিত। এর প্রভাব পড়ে তার ইলম ও কথাবার্তাতেও। তাই পূর্বসূরীগণ নবীনদের কাছ থেকে ফিকহ-ফাতাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ইলম হাসিল করার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
لَا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا أَخَذُوا الْعِلْمَ عَنْ أَكَابِرِهِمْ وَعَنْ أُمَنَائِهِمْ وَعُلَمَائِهِمْ , فَإِذَا أَخَذُوهُ مِنْ أَصَاغِرِهِمْ وَشِرَارِهِمْ هَلَكُوا
‘যতদিন মানুষ ইলম অর্জন করবে নিজেদের প্রবীণ, বিশ্বস্ত ও আলেমদের কাছ থেকে, তারা কল্যাণের মধ্যেই থাকবে। আর যখন ইলম গ্রহণ করবে নবীন ও অশিষ্টদের কাছ থেকে, তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।’ [বাইহাকী, মাদখাল: ২৭৫]
হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَبِي أُمَيَّةَ الْجُمَحِيِّ , قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُلْتَمَسَ الْعِلْمُ عِنْدَ الْأَصَاغِرِ» .
‘আবূ উমাইয়া জুমাহি থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের আলামত নিদর্শনের অন্যতম হলো নবীনদের কাছ থেকে ইলম তালাশ করা।’ [জামে ছগীর: ২২০৩; সহীহ]
অবশ্য নবীনের সংজ্ঞা নিয়ে মতভেদ আছে। ইবন কুতায়বা বলেন, এর দ্বারা বয়সে নবীন উদ্দেশ্য। কেননা শায়খের বয়সের বালখিল্যতা, ত্বরাপ্রবণতা, বোকামি, লালসা, শয়তানী পদস্খলন ইত্যাদি স্বভাব দূরীভূত হওয়ার ফলে তার মধ্যে গভীরতা ও গাম্ভীর্য সৃষ্টি হয়। যা ইলমের গাম্ভীর্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরী। উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
وإذا جاء الفقه من الكبير تابعه الصغير فاهتديا
‘ফিকহ যখন প্রবীণ থেকে আসে আর নবীন তার অনুগমন করে তখন উভয়ে পথপ্রাপ্ত হয়।’
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
إنكم لن تزالوا بخير ما دام العلم في كباركم ، فإن كان العلم في صغاركم سفه الصغير الكبير
‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত ইলম থাকবে প্রবীণদের মধ্যে। আর ইলম যদি নবীন থেকে প্রবীণের দিকে আসে তখন নবীন প্রবীণকে বোকা বানিয়ে দেয়।’
অবশ্য এই বক্তব্য সর্বাংশে প্রযোজ্য নয়। বরং কোনো নবীন যদি সত্যিকার অর্থেই যোগ্যতা, বিশ্বস্ততা এবং ইলমী মাকাম প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় তবে তার কাছ থেকে ইলম হাসিল করাতে দোষ নেই। সাহাবী-তাবেঈদের মধ্যে অনেক নবীন প্রবীণের চেয়েও ইলমী অবস্থানে বেশি এগিয়ে ছিলেন। ফলে তাদের কাছ থেকে আগ্রহ ও প্রতিযোগিতার সঙ্গে ইলম হাসিল করা হতো। অতএব, নবীনদের কাছ থেকে ইলম হাসিল করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার অর্থ হচ্ছে প্রত্যেককে যথাযথ স্থানে আসন দেয়া। সুতরাং নবীন ও প্রবীণদেরকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করা খুবই প্রয়োজনীয়।
সপ্তম অন্তরায়: ইলম অন্বেষণে ত্বরাপ্রবণতা
প্রতিবন্ধকতার আরেকটি হলো ত্বরাপ্রবণতা বা ত্বরিতমনস্কতা। অর্থাৎ নূন্যতম ও স্বল্প সময়ের মধ্যে বড় আলেম হতে চাওয়া। অল্প সময় ব্যয় করে মুফতি বা মুহাদ্দিস হতে চাওয়া। অথচ এটি ইলম হাসিলের সরলপথ নয়, বরং বক্রপথ। কারণ, ইলম একদিনে হাসিল হওয়ার বস্তু নয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এবং এভাবে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিতে হয় ইলম হাসিলের জন্য। কেননা মানুষ যখনই সংক্ষিপ্ত পন্থা অবলম্বন করে এবং তাতে সাফল্য লাভে ব্যর্থ হয় তখনই পথচ্যুত হয়, ইলম হাসিলের পথ ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় নামে। সুতরাং বলা যায়, ইলম অন্বেষণের বড় অন্তরায় হচ্ছে ধীর-সুস্থতা অবলম্বন না করা। অল্প সময়ে সবকিছু শিখে ফেলার প্রবণতা। দুই-চার বছর খরচ করে মাওলানা মুফতি হয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা করা। কেননা ইলমের রীতি হচ্ছে পর্যাপ্ত সময় ও শ্রম ব্যয় করে এবং ধীরতা অবলম্বন করে তা অর্জন করতে হয়। কুরআনেও বারবার নবীকে এই সুন্নত বা রীতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত-
﴿ وَقُرۡءَانٗا فَرَقۡنَٰهُ لِتَقۡرَأَهُۥ عَلَى ٱلنَّاسِ عَلَىٰ مُكۡثٖ وَنَزَّلۡنَٰهُ تَنزِيلٗا ١٠٦ ﴾ [الاسراء: ١٠٦]
‘আর কুরআন আমি নাযিল করেছি কিছু কিছু করে, যেন তুমি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পার ধীরে ধীরে এবং আমি তা নাযিল করেছি পর্যায়ক্রমে।’ {সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ১০৬}
আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন-
﴿ وَقَالَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لَوۡلَا نُزِّلَ عَلَيۡهِ ٱلۡقُرۡءَانُ جُمۡلَةٗ وَٰحِدَةٗۚ كَذَٰلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهِۦ فُؤَادَكَۖ وَرَتَّلۡنَٰهُ تَرۡتِيلٗا ٣٢ ﴾ [الفرقان: ٣١]
‘আর কাফিররা বলে, ‘তার উপর পুরো কুরআন একসাথে কেন নাযিল করা হল না? এটা এজন্য যে, আমি এর মাধ্যমে তোমার হৃদয়কে সুদৃঢ় করব। আর আমি তা আবৃত্তি করেছি ধীরে ধীরে।’ {সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৩১}
এসব আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধীরতা অবলম্বন এবং সময়ক্ষেপণ করে কুরআন হাসিল করার আদেশ করেছেন।
অষ্টম প্রতিবন্ধকতা: অহংকার, আত্মম্ভরিতা ও আত্মতুষ্টি
ইলমের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে পাপ। আর সবচেয়ে পাপ হচ্ছে অহংকার, দাম্ভিকতা। সুতরাং ইলম অন্বেষণ করতে চাইলে অন্যান্য যাবতীয় পাপের সঙ্গে সঙ্গে এই মারাত্মক পাপগুলোও পরিহার করতে হবে। কুরআনে এই পাপের নিন্দা করে ইরশাদ হয়েছে-
﴿ وَلَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمۡشِ فِي ٱلۡأَرۡضِ مَرَحًاۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَالٖ فَخُورٖ ١٨ ﴾ [لقمان: ١٨]
‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।’ {সূরা লুকমান, আয়াত: ১৮}
ইলম অন্বেষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে আখেরাতের চূড়ান্ত সফলতা। আর সফলতার পথে বড় বাধা অহংকার ও দাম্ভিকতা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ تِلۡكَ ٱلدَّارُ ٱلۡأٓخِرَةُ نَجۡعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوّٗا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فَسَادٗاۚ وَٱلۡعَٰقِبَةُ لِلۡمُتَّقِينَ ٨٣ ﴾ [القصص: ٨٣]
‘এই হচ্ছে আখিরাতের নিবাস, যা আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা যমীনে ঔদ্ধত্য দেখাতে চায় না এবং ফাসাদও চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য।’ {সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৮৩}
আলী ইবন ছাবেত (রহ.) বলেন,
العلم آفته: الإعجاب والغضب ++ والمال آفته: التبذير والنهب
ইলমের আপদ হলো আত্মতুষ্টি ও ক্রোধ। আর সম্পদের আপদ অপচয় ও ছিনতাই।
আইউব সিখতিয়ানী (রহ.) বলেন,
ينبغي للعالم أن يضع التراب على رأسه تواضعاً لله
‘তালেবে ইলমের কর্তব্য হচ্ছে বিনয় প্রকাশ করে মাথায় মাটি তুলে রাখা।’
জনৈক হাকিমকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মানুষের কোন্ নিয়ামতের ওপর ঈর্ষা করা যেতে পারে? ‘জবাবে তিনি বললেন, বিনয়ের জন্য। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, তবে কোন বিপদের জন্য তার জন্য করুণা করা যেতে পারে? জবাবে তিনি বললেন, আত্মম্ভরিতা ও অহংকারের জন্য।’
নবম অন্তরায়: দ্রুত ফলাফল কামনা করা
কোনো কোনো ছাত্র অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত ফলাফল পেতে চায়। এটাও ইলম হাসিলে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তারা মনে করে, ইলম খাদ্যের মতো, যা কয়েক গ্রাসে সাবাড় করা যায়! তাই সামান্য কয়েকটি মাস-বছর ব্যয় করেই আলেম, মুহাক্কিক, মুফাসসির হয়ে যেতে চায়। খলীফা মামুন এ ধরনের মানসিকতার কঠোর নিন্দা করে বলেন,
علم الحديث ثلاثة أيام ثم يقول: أنا من أهل الحديث
‘তিনদিন হাদীছের দরসে বসেই অনেকে বলে, আমি একজন মুহাদ্দিস!’
ইমাম শা‘বী (রহ.)-কে বলা হলো, আপনি এই ইলম কোথা থেকে কীভাবে সংগ্রহ করেছেন? জবাবে তিনি বললেন-
لنفي الاعتماد ، والسير في البلاد ، وصبر كصبر الجماد ، وبكور كبكور الغراب
‘সামান্য ইলমে ভরসা না করা, বিভিন্ন দেশে সফর, পাথরের মতো অবিচলতা এবং কাকের মত প্রাতে বের হওয়া দ্বারা।’
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন,
لا يبلغ في هذا الشأن رجل حتى يضر به الفقر ويؤثره على كل شيء
‘কোনো ব্যক্তি এই মর্যাদা পর্যন্ত উন্নীত হতে পারবে না, যাবত না সে এর কারণে দারিদ্রের শিকার হয় এবং সবকিছুর ওপর ইলমকে প্রাধান্য দেয়।’
ইমাম ইয়াকুব ইবন সুফিয়ান বলেন,
أقمت في الرحلة ثلاثين سنة
‘আমি (ইলমের) সফরে ত্রিশ বছর কাটিয়েছি।’
ইবন হাদ্দাদ মালেকী (রহ.) বলেন,
ما للعلم وملائمة المضاجع
‘নরম বিছানায় শুয়ে ইলম হাসিল করা যায় না।’
সুতরাং তালেবে ইলমের কর্তব্য হচ্ছে ইমামগণের এই মন্তব্য ও তাদের মুজাহাদ-মেহনতের কথা স্মরণ করে সে অনুযায়ী আমল করা এবং ইলম হাসিলের জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করা।
জনৈক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি ইলম হাসিল করেছেন কীভাবে? তিনি বললেন-
طلبته فوجدته بعيد المراد ، لا يصاد بالسهام ، ولا يرى في المنام ولا يورث عن الآباء والأعمام .فتوسلت إليه بافتراش المدار ، واستناد الحجر، وإدمان السهر وكثرة النظر ، وإعمال الفكر ومتابعة السفر ، وركوب الخطر: فوجدته شيئا لا يصلح إلا للغرس ولا يغرس إلا في النفس ، ولا يسقي إلا بالدرس
আমি ইলম তলব করতে গিয়ে দেখলাম, এটি খুবই দূরবর্তী একটি বস্তু, যা তীর নিক্ষেপ করে নাগাল পাওয়া যায় না। স্বপ্নেও পাওয়া যায় না। বাপ-দাদা তথা পিতৃপুরুষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রেও হাসিল হয় না। সুতরাং তা হাসিল করার জন্য আমি দোয়াতের বিছানা বিছালাম, পাথরের গায়ে হেলাম দিলাম, দীর্ঘ নিশিজাগরণের অভ্যেস করলাম, গভীর দৃষ্টিপাত প্রদান করতে লাগলাম, ফিকির প্রলম্বিত করলাম, অব্যাহত সফর জারি রাখলাম, বিপদজনক বাহনে আরোহণ করতে লাগলাম। এসব করে দেখলাম, ইলম এমন এক বস্তু, যা রোপণ করা ছাড়া হাসিল হয় না। আবার রোপণ করতে হয়ে দিলের একেবারে গহীনে এবং রোপণ করার পর সিঞ্চন করতে হয় দরসের বারি।
দশম অন্তরায়: হীনমন্যতা
ইলম হাসিলের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে হীনমন্যতা। অনেকে ইলম শিখতে এসে হীনমন্যতায় ভোগে। কেউ ভাবে, ইলম শিখে কী হবে? অর্থাৎ পার্থিব জীবনের বড় ধরনের সফলতা না পাওয়ার আশঙ্কায় হীনমন্যতায় ভোগা। আবার কেউ কেউ হীনমন্যতায় ভোগার কারণে সামান্য ইলমে তুষ্ট হয়।
এটা ইলম হাসিলের জন্য যে কত বড় অন্তরায় তা পূর্বসূরীগণ ঠিকই বুঝেছিলেন। যেমন, এক কবি বলেন,
فكن رجلا رجله في الثرى ++ وهامة همته في الثريا
‘সুতরাং তুমি হয় ওই ব্যক্তির মতো, যার পা ছুরাইয়া তারকার ওপর এবং হিম্মত ছুরাইয়া তারকা ছাড়িয়ে।’
একাদশ অন্তরায়: অবাস্তব আশা-আকাঙ্ক্ষা
ইলমের পথে আরেকটি বড় অন্তরায় হচ্ছে কাজ না করে বড় বড় স্বপ্ন দেখা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ডুবে থাকা। যেমন, প্রয়োজনের সময় কাজ না করে সামনে কবর, পরে করা যাবে, ভবিষ্যতে করতে পারব- এ ধরনের ধারণা ও আশা রাখা। এগুলো হচ্ছে বোকা ও ব্যর্থ মানুষের ভাবনা। এভাবে আশা-আকাঙ্ক্ষা করা হবে বটে কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে এই শ্রেণীর মানুষের পরিণতির কথা উল্লেখ করে বলেন,
﴿ وَأَنذِرِ ٱلنَّاسَ يَوۡمَ يَأۡتِيهِمُ ٱلۡعَذَابُ فَيَقُولُ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ رَبَّنَآ أَخِّرۡنَآ إِلَىٰٓ أَجَلٖ قَرِيبٖ نُّجِبۡ دَعۡوَتَكَ وَنَتَّبِعِ ٱلرُّسُلَۗ أَوَ لَمۡ تَكُونُوٓاْ أَقۡسَمۡتُم مِّن قَبۡلُ مَا لَكُم مِّن زَوَالٖ ٤٤ ﴾ [ابراهيم: ٤٤]
‘আর তুমি মানুষদেরকে সতর্ক কর, যেদিন তাদের উপর আযাব নেমে আসবে। অতঃপর তখন যারা যুলম করেছে তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব, তুমি আমাদেরকে কিছু সময়ের জন্য অবকাশ দাও, আমরা তোমার ডাকে সাড়া দেব এবং রাসূলদের অনুসরণ করব’। ইতঃপূর্বে তোমরা কি কসম করনি যে, তোমাদের কোন পতন নেই?’ {সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪৪}
সুতরাং তালেবে ইলমের একান্ত কর্তব্য হচ্ছে এ ধরনের ভাবনা থেকে দূরে থাকা এবং তৎপরতার সঙ্গে যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দেয়া। সর্বদা এই আয়াত স্মরণে রাখা-
﴿ وَلِكُلّٖ وِجۡهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَاۖ فَٱسۡتَبِقُواْ ٱلۡخَيۡرَٰتِۚ أَيۡنَ مَا تَكُونُواْ يَأۡتِ بِكُمُ ٱللَّهُ جَمِيعًاۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٤٨ ﴾ [البقرة: ١٤٨]
‘আর প্রত্যেকের রয়েছে একটি দিক, যেদিকে সে চেহারা ফিরায়। সুতরাং তোমরা কল্যাণকর্মে প্রতিযোগিতা কর। তোমরা যেখানেই থাক না কেন, আল্লাহ তোমাদের সবাইকে নিয়ে আসবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৬}
উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন,
وإذا أمسيت فلا تنتظر الصباح ، وإذا أصبحت فلا تنتظر المساء وخذ من صحتك لمرضك ، ومن حياتك لموتك
‘সন্ধ্যায় তুমি সকালের অপেক্ষা করো না এবং সকাল হলে সন্ধার অপেক্ষায় থেকো না। আর সুস্থতায় অসুস্থতার জন্য কিছু পুঁজি করো এবং জীবদ্দশায় মরণের জন্য সঞ্চয় করো।’
আশা-আশাঙ্ক্ষার কাঙালদেরকে ভর্ৎসনা করে ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন,
عن مفسدات القلب: ركوبه بحر التمني ، وهو بحر لا ساحل له وهو البحر الذي يركبه مفاليس العالم
‘অন্তরবিনাশী বিষয়গুলো মধ্যে অন্যতম হলো, অন্তরকে প্রত্যাশার সাগরে চড়ে দেওয়া। এটা এমন সাগর যার তীর নেই। আর এমন সাগর জগতের নিঃস্বরাই আরোহন করে।’
জনৈক হাকিমকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল-
من أسوء الناس حالا ؟ قال من بعدت همته واتسعت أمنيته ، وقصرت آلته وقلت مقدرته
‘কোন ব্যক্তির অবস্থা সবচেয়ে বেশি শোচনীয়? জবাবে তিনি বললেন, যার হিম্মত কম, মাধ্যম নগণ্য এবং সক্ষমতাও সামান্য। অথচ আশা-আকাঙ্ক্ষা অগাধ।’
কেউ কেউ বলেন,
تجنبوا الأماني فإنها تذهب ببهجة ما خولتهم وتستصغرون بها نعمة الله عليكم فليتجنب هذا المرض وليحذر تمكنه منه فإنه كالسرطان الفتاك ، قل من يبرأ منه
‘আশা ও প্রত্যাশা থেকে বিরত থাকো, কারণ তা তোমাদের যা দেওয়া হয়েছে তার সৌন্দর্য হরণ করে, এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের যত নেয়ামত দিয়েছেন তাকে স্বল্প জ্ঞান করবে। অতএব এ রোগ থেকে বেঁচে থাকো। এটি তোমাকে পেয়ে বসা থেকে সতর্ক থাকো। কেননা তা ধ্বংসাত্মক ক্যান্সারের মতো, কম মানুষই এ থেকে আরোগ্য লাভ করতে পারে।’
হক্কানী উলামায়ে কেরামের পরিচিতি
এক. রব্বানী বা হক্কানী ওলামায়ে কেরামের প্রথম পরিচিতির ভিত্তি হচ্ছে ইলম। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
﴿ مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُؤۡتِيَهُ ٱللَّهُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحُكۡمَ وَٱلنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُواْ عِبَادٗا لِّي مِن دُونِ ٱللَّهِ وَلَٰكِن كُونُواْ رَبَّٰنِيِّ‍ۧنَ بِمَا كُنتُمۡ تُعَلِّمُونَ ٱلۡكِتَٰبَ وَبِمَا كُنتُمۡ تَدۡرُسُونَ ٧٩ ﴾ [ال عمران: ٧٩]
‘কোন মানুষের জন্য সংগত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমাত ও নবুওয়াত দান করার পর সে মানুষকে বলবে, ‘তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমার বান্দা হয়ে যাও’। বরং সে বলবে, ‘তোমরা রব্বানী হও। যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষা দিতে এবং তা অধ্যয়ন করতে।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭৯}
আলোচ্য আয়াতে কিতাব পাঠ করার ইলম দ্বারা আলেমদের প্রধান শর্ত ইলমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে-
وَبِمَا كُنتُمۡ تَدۡرُسُونَ
(যেহেতু তোমরা কিতাব অধ্যয়ন করতে।) এ আয়াত দ্বারা তাদের দরস প্রদান, ফিকহ-ফাতাওয়া নিয়ে গবেষণা করা, শায়খ-মুফতি হওয়ার প্রতি ইশারা করা হয়েছে।
দুই. হক্কানী ওলামায়ে কেরামের দ্বিতীয় পরিচয় হচ্ছে, ইত্তেবার গুণ অর্জন করা। অর্থাৎ কুরআন-হাদীছ ও সাহাবায়ে কেরাম, সালফে সালেহীন এবং আয়িম্মায়ে মুজতাহিদিনের পথে চলা। কুরআন-হাদীছে ইলমের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ইরশাদ হয়েছে-
﴿ مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُؤۡتِيَهُ ٱللَّهُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحُكۡمَ وَٱلنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُواْ عِبَادٗا لِّي مِن دُونِ ٱللَّهِ وَلَٰكِن كُونُواْ رَبَّٰنِيِّ‍ۧنَ بِمَا كُنتُمۡ تُعَلِّمُونَ ٱلۡكِتَٰبَ وَبِمَا كُنتُمۡ تَدۡرُسُونَ ٧٩ ﴾ [ال عمران: ٧٩]
‘কোন মানুষের জন্য সংগত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমাত ও নবুওয়াত দান করার পর সে মানুষকে বলবে, ‘তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমার বান্দা হয়ে যাও’। বরং সে বলবে, ‘তোমরা রব্বানী হও। যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষা দিতে এবং তা অধ্যয়ন করতে।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭৯}
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাঁর রাসূল এবং পূর্ববতী নবীগণের ওপর যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তার শিক্ষা গ্রহণ এবং তার অনুসরণ করা।
আল্লামা ইবন রজব হাম্বলী (রহ.) বলেন,
العلم النافع من هذه العلوم كلها ضبطُ نصوصِ الكتاب و السنة و فهمُ معانيها و التقيُّدُ في ذلكِ بالمأثور
‘ইলমে নাফে হচ্ছে কিতাবের স্পষ্ট বর্ণনা আয়ত্ব করা, সুন্নাহ আয়ত্ব করা এবং এগুলোর অর্থ অনুধাবন এবং সাহাবায়ে কেরামের বর্ণনার আলোকে সেগুলো আয়ত্ব করা।’
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন,
العلم هو المعرفة الحاصلة بالدليل
‘ইলম হচ্ছে দলিলের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান।’
তিন. হক্কানী আলেমের তৃতীয় গুণ হচ্ছে ইখলাস ও বিশুদ্ধ নিয়ত। নিয়তের বিশুদ্ধতা ছাড়া কোনো ইবাদতই আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। একারণে ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ইখলাস ও নিয়তের পরিশুদ্ধি। উমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
«إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَلِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى »
‘নিশ্চয় আমলের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেকের জন্য তাই থাকবে যা সে নিয়ত করবে।’ [বুখারী: ১]
নিয়ত সহীহ থাকলে ইলমও যে নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে সেটা ইমাম মালেক (রহ.)-এর অভিমত দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে। তিনি তার শাগরেদ ইবন ওয়াহাবকে বলেছিলেন-
على رسلك ! ترفَّق ! ليس الذي تقوم إليه – يعني من التنفل قبل الفريضة – بأفضل مما تقوم عنه إذا صحَّت النية
‘দাঁড়াও, কোমলতা অবলম্বন করো। তুমি যেখানে যাচ্ছ অর্থাৎ ইলম অর্জন ছেড়ে নফল সালাত আদায়ের দিকে, সেটা তার থেকে শ্রেষ্টতর নয় যাতে তুমি নিরত আছো, যদি তোমার নিয়ত ঠিক হয়।’
চার. চতুর্থ গুণ হচ্ছে ইলমের সঙ্গে মানানসই ব্যবহার ও আদব-কায়দা রক্ষা করা। আর এটা অর্জিত হয় ভাবগাম্ভীর্য, পরিশীলিত আচরণ ও স্বভাব দ্বারা। এবং এক্ষেত্রে আদর্শ হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ও উস্তাদ হয়েও যে আদর্শ ও অন্যদের প্রতি পরিশীলিত আচরণ করেছেন, তা এক কথায় সকলের জন্য পালনীয় ও অনুসরণীয়।
পাঁচ. হক্কানী আলেমের পঞ্চম গুণ হচ্ছে আদর্শ শিক্ষা ও দীন বিস্তারের স্বার্থে মানুষের সঙ্গে মেশা ও সম্পর্ক রাখা। আপনি কীভাবে তাদেরকে দীন শিক্ষা দেবেন, অথচ আপনি অবস্থান করছেন দুর্ভেদ্য প্রাসাদে! কীভাবে মানুষকে তালিম দেবেন, আপনি যদি থাকেন আপনার নির্দিষ্ট মাদরাসা-মসজিদে আবদ্ধ? আপনি কীভাবে তাদেরকে কুরআন-হাদীছের জ্ঞান শিক্ষা দেবেন, যদি আপনার ঘরের দরজার সামনে প্রতিবন্ধকতার তালা ঝুলানো থাকে? আপনি তাদেরকে কীভাবে ধর্মীয় জ্ঞান ও নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেবেন যদি আপনি তাদের থেকে থাকেন আলাদা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে?
তাই সাধারণ লোকদের মধ্যে কুরআন-হাদীছের শিক্ষা বিস্তার করতে হলে তাদের সঙ্গে মিশতে হবে, তাদেরকে সময় দিতে হবে। হাদীছে এ কথারই সমর্থন রয়েছে। বর্ণিত হয়েছে-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْمُؤْمِنُ الَّذِي يُخَالِطُ النَّاسَ، وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ، أَعْظَمُ أَجْرًا مِنَ الْمُؤْمِنِ الَّذِي لَا يُخَالِطُ النَّاسَ، وَلَا يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ»
‘আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে মুমিন সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশে এবং তাদের দেওয়া কষ্ট হজম করে সে ওই মুমিন থেকে উত্তম, যে মানুষের সঙ্গে মেশে না এবং তাদের দেওয়া কষ্টও সে হজম করে না।’ [তিরমিযী: ২৫০৭; ইবন মাজাহ: ৪০৩২; সহীহ]
আজ আমাদের মধ্যে এই গুণের বড় অভাব। ওলামায়ে কেরামের অনেকেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে চান না এবং তাদের সঙ্গে মেলামেশা ও চলাফেরা করাকে দোষের কারণ বলে মনে করেন। একথা ঠিক যে, সাধারণ মানুষের দীনী অবস্থা অত্যন্ত নাযুক ও শোচনীয় হওয়ার কারণে তাদের সঙ্গে ব্যাপক মেলামেশা ও সম্পর্ক রাখা নিজের দীনী গায়রতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু এটাও ভাবতে হবে যে, আলেমগণ যদি তাদেরকে এভাবে ছেড়ে রাখেন তবে শয়তান নামের বাঘ তাদেরকে মরুভূমিতে একাকি পেয়ে ছিঁড়েফেঁড়ে খেয়ে ফেলবে। টিভি, সিনেমা, গান-বাজনার সয়লাবে তাদের অবশিষ্ট ঈমানটুকুও ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই ঈমান ও আমল বাঁচানোর স্বার্থে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশা, সম্পর্ক রাখা এবং তাদের দীনী পরিবেশ চাঙ্গা রাখা অপরিহার্য। অন্তত আলোচ্য হাদীছের বাণী আমাদের জন্য সান্ত্বনা যে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশা দোষের নয় বরং দীনীস্বার্থে হলে তা প্রশংসনীয়।
ছয়. ষষ্ঠ গুণ হচ্ছে ইলমের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা। জাগতিক হীনস্বার্থে ইলমকে ব্যবহার করা থেকে নিজেকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যাকে কুরআন, হিকমত এবং ইলম দান করেছেন তিনি কেন দুনিয়ার লালসা করে এর অবমূল্যায়ন করবেন?
আলেমের শান হলো বাতিলের সঙ্গে আপস না করা। যেমন, ইয্য ইবন আবদুস সালাম (রহ.)-কে বলা হলো, আপনি সুলতানের মাথায় চুম্বন করুন, তিনি আপনাকে মার্জনা করবেন। তখন তিনি হাসলেন এবং বললেন-
مساكين ! أنت في وادٍ و أنا في واد ! أنا ما أرضى أن يقبلَ السلطانُ رأسي فكيف أقبِّل رأسَه ؟ !
‘মিসকিনের দল! তুমি এক উপত্যকায় আর আমি আরেক উপত্যকায়। আমি তো এটাই পছন্দ করি না যে, সুলতান আমার মাথা চুম্বন করুক, সেখানে আমি তার মাথা চুম্বন করব সেটা কী করে সম্ভব?’
আহ্! ইসলামের এই বীরসন্তানরা আজ কোথায়? এঁদের একেকজনের অস্তিত্ব গোটা মানবতার জন্য ছিল মুক্তির কারণ। কিন্তু এঁদের স্থান দখল করেছি আমরা নামধারী কতক অথর্ব মানুষ। যারা নিজেদের গায়রত হারিয়ে সামান্য অর্থকড়ির আশায় বিকিয়ে দিয়েছি নিজেদের স্বকীয়তা ও ধর্মীয় আভিজাত্য। পরিণামে লাঞ্ছিত হচ্ছি অহর্নিশ।
সাইয়েদ কুতুব (রহ.)-কে অন্যায়ভাবে শুধু ইসলামী আন্দোলন ও জিহাদ করার অপরাধে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। মৃত্যুর সময় বলা হলো, নিজের ওজর পেশ করে শুধু একটি বাক্য লিখে দিন। ফাঁসির দণ্ড থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। জবাবে তিনি বললেন-
إن السبَّابة التي تشهد ألا إله إلا الله ، لا يمكن أن تكتب كلمةَ اعتذارٍ واحدةٍ تقرُّ بها حكمَ طاغية !
‘যে শাহাদত আঙ্গুল দিয়ে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষ্য দেওয়া হয় সেই শাহাদত আঙ্গুল দিয়ে এমন কোনো কথা লেখা সম্ভব নয়, যা বাতিল শাসকদের হুকুম বা আইনকে সমর্থন করে।’
সাত. সপ্তম গুণ হচ্ছে হেকমত। অর্থাৎ আলেমকে হেকমত ও প্রজ্ঞার গুণ অর্জন করা চাই। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু وَلَكِن كُونُواْ رَبَّانِيِّينَ আয়াতের তাফসীর করেছেন হাকিম এবং ফকিহ হওয়ার দ্বারা। অর্থাৎ তিনি এই আয়াতের তাফসীরে বলেছেন- أي حكماء فقهاء রব্বানী হওয়ার অর্থ হলো তারা হবেন ফকীহ এবং হাকিম।’
আট. অষ্টম গুণ হচ্ছে নিজের সত্তাকে বিলিয়ে দেয়া। অর্থাৎ বিনয়ী হওয়া এবং নিজের সত্তাকে ইলমের জন্য উৎসর্গ করে দেয়া। সুতরাং ইলমের জন্য নিজের সুবিধা ত্যাগ করা এবং কোনো কথা বা কাজে অন্যকে কষ্ট না দেয়া, হক বিষয় অনুধাবন করার পর তা মেনে নিতে সংকোচ না রাখা। মানুষের দোষের পেছনে না পড়া। ইবন দাকীকুল ঈদ (রহ.) জনৈক ব্যক্তিকে ইলম অন্বেষণ করতে দেখে বললেন-
أنت رجلٌ فاضلٌ و السعيد من تموت سيآتُه بموته فلا تهجوَنَّ أحداً
‘আপনি সম্মানিত ব্যক্তি। সৌভাগ্যবান ব্যক্তি সেই, যার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার গুনাহরও মৃত্যু ঘটে। সুতরাং আপনি কাউকে বদনামী করে হেয়প্রতিপন্ন করবেন না।’
ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব আসলে বিনয়ে, অহংকারে নয়। জনৈক শায়ের বলেন,
تَواضَعْ تَكُن كالنَّجمِ لاحَ لناظِرٍ  عَلَى طَبَقَاتِ الماءِ و هو رَفِيعُ
و لا تَكُ كالدُّخَانِ يعلُو مكانَه  على طَبَقَاتِ الجَوِّ و هو وَضِيعُ
‘বিনয়ী হও, দর্শকের দৃষ্টিতে নক্ষত্রের মর্যাদা লাভ করবে। নক্ষত্র পানির স্তরে যদিও নিচে মনে হয় কিন্তু আসলে তা সমুন্নত। কিন্তু অহংকারী হয়ো না। সেটা ধোঁয়ার মতো শূন্যে উচ্চ অনুমিত হলেও বাস্তবে তা মূল্যহীন, পতিত।’
সাত. সপ্তম গুণ হচ্ছে আমল। আলেমে রব্বানীর যাবতীয় গুণাবলীর ভিত্তি হচ্ছে আমল। আর আমলই হচ্ছে ইলমের ফলাফল। এ কারণেই সালফে সালেহীন আমল এবং ইলম উভয়ের সমষ্টিকে ফিকহ বলে নামকরণ করেছেন। আইউব সুখতিয়ানী (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল-
أيهما أكثرُ العلمُ اليومَ أم في الماضي ؟ فقال الكلامُ اليومَ أكثر ،لكنَّ العلمَ فيما تقدَّم أكثر
‘অতীতকাল এবং বর্তমানকাল, কোনকালে ইলম বেশি চর্চিত? তিনি বললেন, বর্তমান বেশি চর্চিত হচ্ছে ‘কথা’। আর অতীতকালে বেশি চর্চিত হতো ইলম।’
কথাটি কি আমাদের সময় আরো বেশিমাত্রায় প্রযোজ্য নয়? আমাদের সময়ে কথাই হচ্ছে বেশি। কিন্তু কলব পর্যন্ত পৌঁছে যে ইলম এবং ইলমের ফলাফল যা, তথা আমল ও সততা, তা আজ ক্রমেই বিরল হয়ে পড়ছে।
মারূফ কারখী (রহ.) বুযুর্গ, মুত্তাকী, দুনিয়াবিমুখ ও বিশ্বখ্যাত একজন আবেদ ছিলেন। তাঁর তাকওয়া-পরহেজগারী এবং ইবাদত-বন্দেগি ছিল প্রবাদতুল্য। অনেক কিতাবে তার বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। একবার আহমাদ ইবন হাম্বল (রহ.)-এর মজলিসে উপস্থিতদের একজন বললেন-
معروف قصيرُ العلم
‘মারূফ (কারখীর {রহ.}) তো ইলম কম!’
লোকটির কথায় ইমাম আহমাদ (রহ.) নাখোশ হলেন এবং বললেন-
أَمْسِكْ عافاكَ الله ، و هل يُرادُ من العلمِ إلاَّ ما وَصَل إليه معروف ؟!
‘থামো! আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে মাফ করুন। আরে ইলম দ্বারা তো সেটাই উদ্দেশ্য, যেখানে মারূফ কারখী (রহ.) পৌঁছেছেন।’
অর্থাৎ আমরা তো ইলম দ্বারা এর পরিণাম বা ফলাফল বুঝি তথা আমল। আর এই বিষয়টি মারূফ কারখীর (রহ.) মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। তাই তিনি ইলমে দুর্বল একথা বলার সুযোগ নেই।
আরেকবারের ঘটনা। একবার আহমাদ ইবন হাম্বল (রহ.)-এর পুত্র আবদুল্লাহ পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন-
يا أبَتِ هل كان معروف معه شيءٌ من العلم ؟
‘সম্মানীত পিতা! মারূফ কারখী (রহ.) কি ইলমের কারণে প্রসিদ্ধ?!
জবাবে আহমাদ ইবন হাম্বল (রহ.) বললেন-
يا بني ! معه رأسُ العلمِ خشيةُ الله تعالى
‘বৎস! তাঁর মধ্যে তো ইলমের সর্বোচ্চ চূড়াই বিদ্যমান। আর তা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার ভয়।’
বস্তুত পুণ্যবান পূর্বসূরীদের এসব কথা হাদীছে নববীরই প্রতিধ্বনি। ইরশাদ হয়েছে-
عَنْ أَبِي مُوسَى، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِنَّ مَثَلَ مَا بَعَثَنِيَ اللهُ بِهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنَ الْهُدَى، وَالْعِلْمِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَصَابَ أَرْضًا، فَكَانَتْ مِنْهَا طَائِفَةٌ طَيِّبَةٌ، قَبِلَتِ الْمَاءَ فَأَنْبَتَتِ الْكَلَأَ وَالْعُشْبَ الْكَثِيرَ، وَكَانَ مِنْهَا أَجَادِبُ أَمْسَكَتِ الْمَاءَ، فَنَفَعَ اللهُ بِهَا النَّاسَ، فَشَرِبُوا مِنْهَا وَسَقَوْا وَرَعَوْا، وَأَصَابَ طَائِفَةً مِنْهَا أُخْرَى، إِنَّمَا هِيَ قِيعَانٌ لَا تُمْسِكُ مَاءً، وَلَا تُنْبِتُ كَلَأً، فَذَلِكَ مَثَلُ مَنْ فَقُهَ فِي دِينِ اللهِ، وَنَفَعَهُ بِمَا بَعَثَنِيَ اللهُ بِهِ، فَعَلِمَ وَعَلَّمَ، وَمَثَلُ مَنْ لَمْ يَرْفَعْ بِذَلِكَ رَأْسًا، وَلَمْ يَقْبَلْ هُدَى اللهِ الَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ»
‘আবূ মূসা আশআ’রী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান বিজ্ঞান ও হেদায়েত দিয়ে পাঠিয়েছেন তার উদাহরণ হচ্ছে এমন মুষলধারার বৃষ্টির মতো যা ভূমিতে এসে পড়েছে, ফলে এর কিছু অংশ এমন উর্বর পরিষ্কার ভূমিতে পড়েছে যে ভূমি পানি চুষে নিতে সক্ষম, ফলে তা পানি গ্রহণ করেছে, এবং তা দ্বারা ফসল ও তৃণলতার উৎপত্তি হয়েছে। আবার তার কিছু অংশ পড়েছে গর্তওয়ালা ভূমিতে (যা পানি আটকে রাখতে সক্ষম) সুতরাং তা পানি সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে, ফলে আল্লাহ এর দ্বারা মানুষের উপকার করেছেন তারা তা পান করেছে, ভূমি সিক্ত করিয়েছে এবং ফসলাদি উৎপন্ন করতে পেরেছে। আবার তার কিছু অংশ পড়েছে এমন অনুর্বর সমতল ভূমিতে যাতে পানি আটকে থাকে না, ফলে তাতে পানি আটকা পড়েনি, ফসলও হয়নি। ঠিক এটাই হলো ওই ব্যক্তির দৃষ্টান্ত যে আল্লাহর দ্বীনকে বুঝতে পেরেছে এবং আমাকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন তা থেকে উপকৃত হতে পেরেছে, ফলে সে নিজে জেনেছে এবং অপরকে জানিয়েছে। (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ভূমি)। এবং ঐ ব্যক্তির উদাহরণ যে এই হিদায়েত এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের দিকে মাথা উঁচু করে তাকায়নি, ফলে আল্লাহ যে হিদায়েত নিয়ে আমাকে প্রেরণ করেছেন তা গ্রহণ করেনি। (তৃতীয় শ্রেণর ভূমি) ।’ [সহীহ বুখারী: ৭৯, সহীহ মুসলিম: ২২৮২]
সুতরাং আমলকারী ও ইলম বিস্তারকারী আলেম ওই কার্যকর মাটির মতো, যাতে বৃষ্টির পানি পতিত হয় এবং তাতে মাটি সিক্ত, কোমল ও তরুতাজা হয় এবং সবুজ-শ্যামল ফলমূল ও ফসল উৎপন্ন করে। অতএব ইলমের ফলাফল হচ্ছে আমল, ইবাদাত, দাওয়াত এবং সবর।
হাদীছের ভাষ্যানুযায়ী দ্বিতীয় প্রকার মাটির সঙ্গে তুলনীয় হচ্ছেন ওইসব ব্যক্তি, যাদের কাছে কুরআন-হাদীছের বর্ণনা আছে বটে কিন্তু সে অনুযায়ী আমল নেই। ফলে তারা ওই মাটির মতো যে মাটি পানি ধরে রাখে কিন্তু নিজে এর দ্বারা উপকৃত হয় না। বরং অন্যরা উপকৃত হয়। ঠিক তদ্রূপ এসব লোক ইলম দ্বারা নিজেরা উপকৃত হয় না বরং তাদের দ্বারা অন্য লোকেরা উপকৃত হয়।
আর তৃতীয় প্রকার মাটির সঙ্গে তুলনীয় হচ্ছে ওইসব লোক, যাদের নিজেদের মধ্যে ইলম নেই। ফলে নিজেরাও এর দ্বারা উপকৃত হয় না এবং অন্যরাও উপকৃত হতে পারে না। ফলে তারা ওই সব পাথুরে মাটির মতো, যা পানি ধরে না রাখার কারণে নিজেও উপকৃত হতে পারে না এবং অন্যদেরকেও উপকৃত করতে পারে না।
ইলমহীন তালেবে ইলমের অবস্থা বর্ণনা করে কবি বলেন,
زَوَامِلَ للأسفارِ لا عِلْمَ عندَهُم بجيّدِهَا إلا كعِلْمِ الأباعِرِ
لَعَمْرُكَ ما يدري البعيرُ إذا غَدَا  بأسفارِهِ أو رَاحَ ما في الغَرَائِرِ !
‘কিছু কিতাবাদীর সঙ্গী, যাদের কাছে উত্তম কোনো ইলম নেই, তবে উটের বিষ্টার মতো।
তোমার জীবনের শপথ! কিতাবের বোঝা নিয়ে উট চলাচলের সময় সে জানে না তার থলে বা পিঠে কী আছে।’
আল্লাহ আমলহীন ইলমধারীকে বোঝাবহনকারী গর্দভের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
﴿ مَثَلُ ٱلَّذِينَ حُمِّلُواْ ٱلتَّوۡرَىٰةَ ثُمَّ لَمۡ يَحۡمِلُوهَا كَمَثَلِ ٱلۡحِمَارِ يَحۡمِلُ أَسۡفَارَۢاۚ بِئۡسَ مَثَلُ ٱلۡقَوۡمِ ٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ بِ‍َٔايَٰتِ ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٥ ﴾ [الجمعة: ٥]
‘যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছিল তারপর তারা তা বহন করেনি, তারা গাধার মত! যে বহু কিতাবের বোঝা বহন করে। সে সম্প্রদায়ের উপমা কতইনা নিকৃষ্ট, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে। আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।’ {সূরা আল-জুমুআ‘, আয়াত: ৫}
যাহোক, ইলম হচ্ছে পথনির্দেশক আর আমল হচ্ছে ফলাফল। এবং উভয়ের সমষ্টিই হচ্ছে ফিকহ। বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে-
«مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ »
‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তিনি তাকে দীনী বিষয়ে প্রাজ্ঞতা দান করেন।’ [বুখারী: ৩১১৬; মুসলিম: ১০৩৭]
মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
وأنت في صلاتك تقول: اهدِنَا الصِّرَاطَ المُستَقِيمَ ، و ما الصراط المستقيم إلا العلم و العمل بالهدى و دين الحق .
‘তুমি সালাতে বলো হে আল্লাহ! আমাকে সোজা পথ দেখান। সোজা পথ তো ইলম এবং হেদায়াত ও দীনে হকের ওপর আমল করা ছাড়া আর কিছু নয়।’
দশ. আলেমের দশম গুণ হচ্ছে তালিম বা শিক্ষাপ্রদান। বস্তুত নবী-রাসূলগণের প্রধান কর্তব্যই ছিল তালিমে দীন। আর দীনী ইলম শিক্ষাপ্রদানকারীর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সীমাহীন করুণা রয়েছে। তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা খাস রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাদের জন্য কল্যাণের দু‘আ করেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীনী শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্ব প্রদান করে ইরশাদ করেন-
بلغوا عني وَ لَو آيةً
‘তুমি একটি আয়াত জানলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’ [সহীহুল জামে: ২৮৩৭]
দীনের প্রচার-প্রসারের কাজে ব্যাপৃত লোকদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ হতে তাদের জীবন সুখী-সমৃদ্ধ হওয়ার ঘোষণা এসেছে হাদীছে। ইরশাদ হয়েছে-
«نَضَّرَ اللَّهُ امَرَءًا سَمِعَ مِنَّا حَدِيثًا فَبَلَّغَهُ كَمَا سَمِعَهُ »
‘আল্লাহ তা‘আলা ওই ব্যক্তির জীবন সুখী-সমৃদ্ধ করুন, যে আমার হাদীছ শ্রবণ করে অতপর তা মুখস্থ করে এবং অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়।’ [সহীহ ইবন হিব্বান: ৬৯, হাসান]
হক্কানী তালেবে ইলমের পরিচয়
তালেবে ইলমের মধ্যে নিম্নোক্ত গুণগুলো থাকা চাই। যথা-
এক. আত্মিক পরিশুদ্ধি। অর্থাৎ যাবতীয় নিকৃষ্ট স্বভাব ও চারিত্রিক নিম্নমুখিতা থেকে নিজেকে পবিত্র রাখা। কেননা ইলম হচ্ছে কলবের ইবাদত। সালাত যেমন বাহ্যিক পবিত্রতা ছাড়া আদায় হয় না, তেমনি অন্তরের ইবাদত ও পরিচর্যা আত্মিক পবিত্রতা ছাড়া অর্জিত হয় না।
ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রবাদতুল্য। পড়ার উদ্দেশ্য ছাড়াই কোনো কাগজে শুধু দৃষ্টি পড়লেই তা মুখস্থ হয়ে যেত। একদিন তিনি একটি বিষয় হিফজ করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন, তার স্মৃতিশক্তি আজ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তাকে সঙ্গ দিচ্ছে না। তিনি বিচলিত হলেন এবং এর কারণ উদ্ঘাটন করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কারণ উদ্ঘাটন করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত দ্বারস্থ হলেন উস্তাদ ওয়াকী‘ ইবনুল জাররাহ (রহ.)-এর। উস্তাদ বললেন, নিঃসন্দেহে কোনো গুনাহের কাজ সংঘটিত হয়েছে। তিনি আরো বললেন, ‘ইলম হচ্ছে একটি মস্ত বড় নূর। আর আল্লাহ তা‘আলা এই নূর তাঁর নেক বান্দা ছাড়া অন্য কাউকে দান করেন না। আর কোনো নেক বান্দাও যখন গুনাহ করে তখন তার থেকে এই নূর উঠিয়ে নেওয়া হয়।’
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) শের ও কবিতাশাস্ত্রেও অত্যন্ত দক্ষ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। উস্তাদের কথাগুলোকে তিনি কাব্যের ফ্রেমে বেঁধে ফেললেন এভাবে-
شكوت إلى وكيع سوء حفظي ##فأرشدني إلى ترك المعاصي
وأخبرني بأن العلم نور ##ونور الله لا يعطى لعـــــاصي
‘আমি উস্তাদ ওয়াকী (রহ.)-এর কাছে স্মরণশক্তির দুর্বলতার অভিযোগ করলাম। তিনি আমাকে পাপ ছেড়ে দেয়ার আদেশ করলেন এবং বললেন, ইলম হচ্ছে নূর। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নূর কোনো পাপীকে দান করেন না।’
দ্বিতীয়: গুণ হচ্ছে, ইলমকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা।
তৃতীয়: ইলম অন্বেষণ করতে গিয়ে দাম্ভিকতা ও অহংকার পরিহার করা এবং উস্তাযের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে কার্পণ্য না করা। ইমাম বায়হাকী (রহ.) এ সংক্রান্ত একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যথা-
‘যায়দ ইবন ছাবেত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একবার জানাযার সালাত আদায় করলেন। (সালাত শেষে) সওয়ার হওয়ার জন্য খচ্চর পেশ করা হলো। এটা দেখে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এগিয়ে এলেন এবং রেকাবি ধরলেন। যায়দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, হে রাসূলের চাচার পুত্র! আপনি রেকাবি ছেড়ে দিন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমরা আলেম ও উস্তাদদের সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করতেই আদিষ্ট হয়েছি।’
চার. উস্তাদের সঙ্গে পূর্ণ আদব বজায় রেখে চলা। সুতরাং উস্তাদকে দুর্বোধ্য কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করে তাকে বিরক্ত না করা। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন, ‘আলেমের হক হচ্ছে, তাকে বেশি বেশি জিজ্ঞেস না করা। তাকে কষ্টে নিপতিত না করা। ক্লান্তিবোধ করলে প্রশ্নবাণে জর্জরিত না করা। আর তোমার আবশ্যক দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার ওয়াস্তে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।’
পাঁচ. উপকারী কোনো ইলম ও শাস্ত্র পরিহার না করা। বরং সুযোগ-সুবিধা মতো উপকারী সব শাস্ত্রই আয়ত্ত করা।
ছয়. তলবে ইলমের একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। সুতরাং এর দ্বারা ধন-সম্পদ, মাল-দৌলত, সুনাম-সুখ্যাতি অর্জনের নিয়ত না করা। যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইলম শিখবে আল্লাহ তা‘আলা তার মর্যাদা বুলন্দ করবেন।
সাত. তলবে ইলমের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে অন্যকে সংশোধনের আগে নিজে সংশোধন হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে ইরশাদ করেন-
﴿ ۞أَتَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبِرِّ وَتَنسَوۡنَ أَنفُسَكُمۡ وَأَنتُمۡ تَتۡلُونَ ٱلۡكِتَٰبَۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ٤٤ ﴾ [البقرة: ٤٤]
‘তোমরা কি মানুষকে ভাল কাজের আদেশ দিচ্ছ আর নিজদেরকে ভুলে যাচ্ছ? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত কর। তোমরা কি বুঝ না?’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪৪}
জনৈক কবি ও সাধক বলেন,
يا أيها الرجل المعلم غيره هلا لنفسك كان ذا التــــــــعليم
تصف الدواء لذي السقامة والضنى كيما يصح به وأنت سقيم
لا تنه عن خلق وتأتي مثله عار عليك إذا فعلت عظيـــــم
ابدأ بنفسك فانهها عن غيها فإذا انتهت عنه فأنت حكيــم
‘হে অন্যকে শিক্ষাদানকারী ব্যক্তি! কেন তুমি অন্যকে বিস্তার করা শিক্ষা তোমার নিজের ভেতর কার্যকর করছ না?
নিরাময়কারী ওষুধ বাতলে দিচ্ছ তুমি, অথচ তুমি নিজেই রোগাক্রান্ত!
মানুষকে সেই কাজে বাধা দিও না, তুমি নিজে যে কাজ করো। কেননা, এটা মানুষের দৃষ্টিতে খুবই নিন্দনীয়।
প্রথমে নিজের নফসকে দিয়ে শুরু করো এবং নফসকে ভ্রষ্টতা থেকে হেফাজত করো। যদি তুমি তা করতে পারো তবে তুমিই হাকিম, তুমিই বিজ্ঞ ব্যক্তি।’
২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
সংকলন: আবু বকর সিরাজী
সম্পাদনা: আলী হাসান তৈয়ব
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

No comments:

Post a Comment

Translate