Tuesday, January 10, 2023

ইমাম নাসাই রহঃ এর জীবনী

 ইমাম নাসাঈ (রহঃ)

কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ভূমিকা : ইমাম নাসাঈ (রহঃ)
ইলমে হাদীছের আকাশে এক
উজ্জ্বল নক্ষত্র।
তিনি সুনানে নাসাঈ সহ অনেক
মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করে মুসলিম
বিশ্বে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
সততা, বিশ্বস্ততা,
আমানতদারিতা, ন্যায়পরায়ণতা ও
আল্লাহভীরুতায় তিনি ছিলেন
অনন্য। হাদীছ চর্চায়
তিনি নিজেকে উৎসর্গ
করেছিলেন।
নাম ও পরিচিতি : ইমাম নাসাঈ-
এর প্রকৃত নাম আহমাদ, পিতার নাম
শো‘আইব।[1] উপাধি ﺍَﻟْﺎِﻣَﺎﻡُ ﺍﻟْﺤَﺎﻓِﻆُ (আল-
ইমামুল হাফেয)[2], ﺍَﻟْﺤَﺎﻓِﻆُ ﺍﻟْﺤُﺠَّﺔُ (আল-
হাফেযুল হুজ্জাহ),[3] উপনাম আবু
আব্দুর রহমান[4], নিসবতী নাম আল-
খোরাসানী[5], আন-নাসাঈ[6]।
‘নাসা’-এর দিকে সম্বন্ধিত
করে তাঁকে নাসাঈ বলা হ’ত।
‘নাসা’ খোরাসানের
একটি প্রসিদ্ধ শহর। আরবের
লোকেরা কখনো কখনো এটাকে ‘নাসাবী’
‏( ﺍﻟﻨَّﺴَﻮِﻱ‏) বলে থাকে। কিয়াস
হিসাবে উচ্চারণ এভাবেই
হওয়া উচিত। তবে নাসাঈ
উচ্চারণটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।[7]
তাঁর পুরো বংশপরিক্রমা হ’ল- আবু
আব্দুর রহমান আহমাদ ইবনু শো‘আইব
ইবনে আলী ইবনে সিনান
ইবনে বাহার আল-
খোরাসানী আন-নাসাঈ।[8]
কোন কোন ঐতিহাসিক ইমাম
নাসাঈ (রহঃ)-এর বংশপরিক্রমায়
আহমাদ ইবনু শো‘আইব ইবনে আলী-এর
পরিবর্তে আহমাদ ইবনু
আলী ইবনে শো‘আইব উল্লেখ
করেছেন।[9] এ দু’টো বর্ণনার
মধ্যে সমন্বয় সাধন এভাবে করা যায়
যে, দাদার প্রসিদ্ধি ও
পরিচিতির কারণে পুত্রের সম্পর্ক
কখনো কখনো দাদার প্রতি আরোপ
করা হ’ত।[10]
জন্ম : ইমাম নাসাঈ (রহঃ) ২১৫
হিজরী মুতাবিক ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে
[11] মতান্তরে ২১৪
হিজরীতে খোরাসানের ‘নাসা’
নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।[12] এ
স্থানের দিকে সম্বন্ধিত
করে তাঁকে আন-নাসাঈ বলা হয়। এ
নামেই তিনি সমধিক
প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।[13]
আল্লামা ইবনুল আছীর ও
জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহঃ) বলেন,
তিনি ২২৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ
করেন।[14] কিন্তু ইবনু মানযূর, আল-
মিযযী ও
আল্লামা যাহাবী (রহঃ) বলেন, ﺍﻧﻪ
ﻭﻟﺪ ﻋﺎﻡ ২১৫ﻫـ ﻭﻫﻮ ﺍﻟﺮﺍﺟﺢ، ‘তিনি ২১৫
হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছেন।
এটিই প্রাধান্যযোগ্য অভিমত’।[15]
শিক্ষা জীবন : ইমাম নাসাঈ
(রহঃ)-এর সময়ে খোরাসান ও তার
পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহ জ্ঞান-
বিজ্ঞান ও ইলমে হাদীছের
কেন্দ্রভূমি হিসাবে পরিচিত
ছিল। সেখানে অনেক
খ্যাতনামা বিদ্বানের সমাবেশ
ঘটেছিল। ইমাম নাসাঈ (রহঃ)
স্বীয় জন্মভূমিতেই প্রখ্যাত
আলেমগণের তত্ত্ববধানে পড়া-
লেখা শুরু করেন।[16] পনের বছর বয়স
পর্যন্ত তিনি স্বদেশেই কুরআন
মাজীদ হিফয ও প্রাথমিক
শিক্ষা অর্জন করেন।[17]
দেশ ভ্রমণ : ইমাম নাসাঈ (রহঃ)
নিজ এলাকায় প্রাথমিক
শিক্ষা সমাপনের পর বিভিন্ন
দেশে ভ্রমণ
করে ইলমে হাদীছে ব্যুৎপত্তি অর্জন
করেন। তিনি ২৩০ হিজরী মুতাবিক
৮৪৪
খ্রিষ্টাব্দে উচ্চশিক্ষা অর্জনের
জন্য মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ
করে তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন
দেশ ও জনপদের খ্যাতিমান
মনীষীদের দরজায় কড়া নাড়েন।
[18]
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) নিজেই
বলেছেন, ﺭﺣﻠﺘﻲ ﺍﻷﻭﻟﻰ ﺇﻟﻰ ﻗﺘﻴﺒﺔ ﻛﺎﻧﺖ ﻓﻲ
ﺳﻨﺔ ﺛﻼﺛﻴﻦ ﻭﻣﺎﺋﺘﻴﻦ ﺃﻗﻤﺖ ﻋﻨﺪﻩ ﺳﻨﺔ ﻭﺷﻬﺮﻳﻦ
‘আমি ২৩০ হিজরীতে সর্বপ্রথম
কুতায়বা ইবনু সাঈদের নিকট গমন
করি এবং তাঁর সান্নিধ্যে এক বছর
দু’মাস অবস্থান করি’।[19] এ সময় তাঁর
বয়স ছিল মাত্র পনের বছর।[20]
শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ
দেহলভী (রহঃ) বলেন,
‘তিনি অনেক বড় বড় শায়খের
সাথে সাক্ষাৎ করেন।
তিনি খুরাসান, হিজায, ইরাক,
জাযীরা, শাম, মিশর
প্রভৃতি শহরে পরিভ্রমণ করেন’।[21]
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ)
বলেন, ﺭَﺣَﻞَ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟْﺂﻓَﺎﻕِ، ﻭَﺍﺷْﺘَﻐَﻞَ ﺑِﺴَﻤَﺎﻉِ ﺍﻟْﺤَﺪِﻳْﺚِ
ﻭَﺍﻟِﺎﺟْﺘِﻤَﺎﻉِ ﺑِﺎﻟْﺄَﺋِﻤَّﺔِ ﺍﻟْﺤُﺬَّﺍﻕِ، ﻭَﻣَﺸَﺎﻳِﺨُﻪُ ﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﺭَﻭَﻯ
ﻋَﻨْﻬُﻢْ ﻣُﺸَﺎﻓَﻬَﺔً. ‘তিনি পৃথিবীর
বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেন
এবং অভিজ্ঞ ইমামগণের নিকট
থেকে হাদীছ শ্রবণে মনোনিবেশ
করেন। আর যাদের নিকট
থেকে তিনি মুখে মুখে হাদীছ
বর্ণনা করেছেন, তাঁদের নিকট
থেকেও হাদীছ শ্রবণ করেন।[22]
আল্লামা ইউসুফ আল-
মিযযী ‘তাহযীবুল কালাম’
গ্রন্থে লিখেছেন, ﻃﺎﻑ ﺍﻟﺒﻼﺩ ﻭﺳﻤﻊ
ﺑﺨﺮﺍﺳﺎﻥ ﻭﺍﻟﻌﺮﺍﻕ ﻭﺍﻟﺤﺠﺎﺯ ﻭﻣﺼﺮ ﻭﺍﻟﺸﺎﻡ ﻭﺍﻟﺠﺰﻳﺮﺓ
ﻣﻦ ﺟﻤﺎﻋﺔ ‘তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ
করেছেন এবং খোরাসান, ইরাক,
হিজায, মিসর ও জাযীরার একদল
মুহাদ্দিছের নিকট থেকে হাদীছ
শ্রবণ করেছেন’।[23]
ইমাম যাহাবী (রহঃ) বলেন,
‘জ্ঞান অন্বেষণের জন্য
তিনি খোরাসান, হিজায, মিসর,
ইরাক, জাযীরা,
সিরিয়া এবং সীমান্ত এলাকায়
ভ্রমণ করেন। অতঃপর
মিসরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু
করেন’।[24]
শিক্ষকমন্ডলী : ইমাম নাসাঈ (রহঃ)
স্বদেশে হুমাইদ ইবনে মাখলাদ
(মৃঃ ২৪৪ হিঃ), আম্মার ইবনুল
হাসান (মৃঃ ২৪২ হিঃ) প্রমুখ
খ্যাতিমান শায়খের নিকট
শৈশবকালে শিক্ষার্জন করেন।[25]
ড. তাকীউদ্দীন নদভী স্বীয়
‘আ‘লামুল মুহাদ্দিছীন’
গ্রন্থে লিখেছেন, ‘তিনি অসংখ্য
মনীষী থেকে হাদীছ শ্রবণ
করেছেন। তিনি সর্বপ্রথম
বিদেশে পরিভ্রমণ
করে কুতাইবা ইবনু সাঈদ (মৃঃ ২৪০
হিঃ)-এর নিকট
থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন। তাঁর
উল্লেখযোগ্য শিক্ষকের
মধ্যে রয়েছেন ইসহাক ইবনু
রাহওয়াইহ (ইমাম বুখারী (রহঃ)-
এরও উস্তায), মুহাম্মাদ ইবনু নযর,
আলী ইবনু হাজার, ইউনুস ইবনু আব্দুল
আলা, মুহাম্মাদ বিন বাশার, ইমাম
আবূ দাঊদ সিজিস্তানী প্রমুখ। ইবনু
হাজার আসক্বালানী (রহঃ) ইমাম
বুখারী (রহঃ)-কেও ইমাম নাসাঈ
(রহঃ)-এর শিক্ষক হিসাবে গণ্য
করেছেন। অনুরূপভাবে আবু যুর‘আ ও
আবু হাতিম আর-রাযী থেকেও
তার হাদীছ বর্ণনা প্রমাণিত
হয়েছে।[26] তাঁর উল্লেখযোগ্য
শিক্ষকমন্ডলীর
মধ্যে আরো রয়েছেন, বিশর
ইবনে হেলাল, আল-হাসান ইবনুস
সাববাহ আল-বাযযার, আম্মার
ইবনে খালেদ আল-ওয়াসিতী,
ইমরান ইবনে মূসা আল-কাযযায
প্রমুখ।[27]
সুনানে কুবরাতে ইমাম নাসাঈ
(রহঃ) ৪০৩ জন শিক্ষকের নিকট
থেকে এবং সুনানে ছুগরা তথা সুনানে নাসাঈতে ৩৩৫
জন শায়খের নিকট থেকে হাদীছ
বর্ণনা করেছেন। তবে ইবনু
আসাকিরের বর্ণনা মতে তাঁর
শিক্ষকের সংখ্যা ৪৪৪ জন।[28]
ছাত্রবৃন্দ : দেশ-
বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) হাদীছের দরস
প্রদান শুরু করেন। অনেক
শিক্ষার্থী তাঁর নিকট
থেকে ইলমে হাদীছ শিক্ষা লাভ
করেছে।
আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ)
বলেন,
‘মিসরে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস
শুরু করেন এবং সেখানে তাঁর
রচনাবলী প্রসার লাভ করে। বহু
জ্ঞান পিপাসু তাঁর নিকট
থেকে জ্ঞান আহরণ করেছেন।
অতঃপর
তিনি দামেশকে চলে যান’।[29]
তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
কয়েকজন হ’লেন- ‘আমালুল ইয়াওম
ওয়াল লায়লাহ’ গ্রন্থের
খ্যাতিমান লেখক ইবনুস সুন্নী,
আহমাদ ইবনুল হাসান আর-রাযী,
আবুল হাসান আহমাদ আর-রামলী,
আবু জা‘ফর আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ
আন-নাহবী, আবু সাঈদ আহমাদ
ইবনে মুহাম্মাদ ইবনুল আরাবী, আবু
জা‘ফর আহমাদ আত-তাহাবী প্রমুখ।
[30]
সুনানু নাসাঈ সংকলন : ইমাম
নাসাঈ (রহঃ) প্রথমে ‘আস-সুনানুল
কুবরা’ নামে একটি বৃহৎ হাদীছগ্রন্থ
সংকলন করেন। যাতে ছহীহ ও যঈফ
হাদীছের সংমিশ্রণ ছিল। এ
সম্পর্কে আল্লামা আবু যাহূ বলেন,
‘ইমাম নাসাঈ (রহঃ) বিশুদ্ধ ও
ত্রুটিযুক্ত হাদীছ সম্বলিত ‘আস-
সুনানুল কুবরা’ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
অতঃপর একে সংক্ষেপ করে ‘আস-
সুনানুছ ছুগরা’ সংকলন করেন। এর নাম
দেন ‘আল-মুজতাবা’। ইমাম নাসাঈ
(রহঃ)-এর নিকটে এ গ্রন্থের সব
হাদীছই ছহীহ’।[31]
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) বলেন, ﻟﻤﺎ ﻋﺰﻣﺖ
ﻋﻠﻰ ﺟﻤﻊ ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻟﺴﻨﻦ ﺍﺳﺘﺨﺮﺕ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻓﻲ
ﺍﻟﺮﻭﺍﻳﺔ ﻋﻦ ﺷﻴﻮﺥ ﻛﺎﻥ ﻓﻲ ﺍﻟﻘﻠﺐ ﻣﻨﻬﻢ ﺑﻌﺾ
ﺍﻟﺸﻲﺀ ﻓﻮﻗﻌﺖ ﺍﻟﺨﻴﺮﺓ ﻋﻠﻰ ﺗﺮﻛﻬﻢ ﻓﻨﺰﻟﺖ ﻓﻲ
ﺟﻤﻠﺔ ﻣﻦ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﻛﻨﺖ ﺃﻋﻠﻮ ﻓﻴﻪ ﻋﻨﻬﻢ – ‘যখন
আমি সুনানে নাসাঈ সংকলন
করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হ’লাম, তখন কিছু
শায়খ থেকে হাদীছ বর্ণনা করার
ব্যাপারে আমার
অন্তরে খটকা সৃষ্টি হ’লে আমি আল্লাহর
দরবারে ইস্তেখারা করলাম।
অতঃপর তাদের হাদীছ
পরিত্যাগের বিষয়ে কল্যাণকর
ইঙ্গিত পেলাম।
ফলে আমি তাতে এমন কিছু হাদীছ
সন্নিবেশিত করিনি,
যেগুলো তাদের নিকট
থেকে আমার নিকট উচ্চতর
সনদে পৌঁছেছিল’।[32]
সাইয়িদ জামালুদ্দীন বলেন, ‘ইমাম
নাসাঈ (রহঃ) প্রথমে ‘আস-সুনানুল
কাবীর’ নামক একটি গ্রন্থ সংকলন
করেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
হাদীছের বিভিন্ন সূত্র সংবলিত
এমন গ্রন্থ আর কেউ রচনা করতে সক্ষম
হয়নি’।[33]
ইবনুল আছীর বলেন, ফিলিস্তীনের
রামাল্লার আমীর ইমাম নাসাঈ
(রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন,
আপনার সংকলিত ‘আস-সুনানুল
কুবরা’-তে সন্নিবেশিত সকল
হাদীছই কি ছহীহ?
উত্তরে তিনি বললেন, না।
এতে ছহীহ ও যঈফ মিশ্রিত আছে।
তখন আমীর তাঁকে বললেন, এ গ্রন্থ
থেকে শুধু ছহীহ হাদীছগুলো চয়ন
করে আমাদের জন্য একটি বিশুদ্ধ
হাদীছগ্রন্থ সংকলন করুন। এ
প্রেক্ষিতে তিনি আস-সুনানুল
কুবরার যে সকল হাদীছের
সনদে ত্রুটি আছে বলে অভিযোগ
ছিল, সেগুলো বাদ দিয়ে ‘সুনানুল
মুজতাবা’ সংকলন করেন’।[34]
ড. তাকীউদ্দীন
নাদভী লিখেছেন, উপরোক্ত
কাহিনী আল্লামা ইবনুল আছীর
স্বীয় ‘জামিউল উছূল’
গ্রন্থে এবং মোল্লা আলী ক্বারী মিশকাতের
ভাষ্যগ্রন্থ ‘মিরক্বাত’-এ উল্লেখ
করেছেন। কিন্তু
আল্লামা যাহাবী বলেছেন,
উপরোক্ত বর্ণনা সঠিক নয়;
বরং সুনানে কুবরাকে সংক্ষেপ
করে ‘মুজতাবা’ সংকলন করেছেন
ইমাম নাসাঈর সুযোগ্য ছাত্র ইবনুস
সুন্নী।[35]
আল্লামা ইবনু আসাকির
বর্ণনা করেছেন, এ গ্রন্থটির নাম
ﺍَﻟْﻤُﺠْﺘَﻨَﻰঅথবা ﺍَﻟْﻤُﺠْﺘَﺒَﻰউভয়টিই সমার্থক
শব্দ। তবে শেষোক্ত ﺍَﻟْﻤُﺠْﺘَﺒَﻰশব্দটিই
অধিক প্রসিদ্ধ। যখন কোন মুহাদ্দিছ
হাদীছ বর্ণনা শেষে বলবেন, ﺍِﻥَّ
ﺍﻟﻨَّﺴَﺎﺋِﻰَّ ﺭَﻭَﻯ ﺣَﺪِﻳْﺜًﺎ ‘ইমাম নাসাঈ (রহঃ)
হাদীছটি স্বীয়
কিতাবে বর্ণনা করেছেন, তখন
এটা দ্বারা ‘সুনানুল মুজতাবা’কেই
বুঝাবে, সুনানুল কুবরাকে নয়।[36]
উল্লেখ্য, এটিই ‘সুনানে নাসাঈ’
নামে পরিচিত। ‘মুজতাবা’ শব্দের
অর্থ হ’ল বাছাইকৃত চয়নকৃত,
নির্বাচিত এবং ‘মুজতানা’ শব্দের
অর্থ হ’ল সংগৃহীত বা আহরিত ফল।[37]
সুনানে নাসাঈর হাদীছ ও অধ্যায়
সংখ্যা : ইবনুল আছীরের মতে,
সুনানে নাসাঈতে সংকলিত
হাদীছ সংখ্যা ৪৪৮২টি।[38] শায়খ
নাছিরুদ্দীন আলবানীর
গণনা অনুযায়ী নাসাঈর মোট
হাদীছ সংখ্যা ৫৭৫৮।[39]
এতে মোট একান্নটি কিতাব
(অধ্যায়) রয়েছে।[40]
সুনান গ্রন্থসমূহের মধ্যে আলোচ্য
বিষয় এবং হাদীছের দিক
দিয়ে সুনানে নাসাঈ বিশদ ও
ব্যাপক।[41] ইমাম নাসাঈ (রহঃ) এ
গ্রন্থ সংকলনে ইমাম বুখারী (রহঃ)
ও ইমাম মুসলিম (রহঃ)-এর
রীতি অনুসরণ করেছেন
এবং তাঁদের উভয়ের প্রবর্তিত
মানহাজ বা নীতির মধ্যে সমন্বয়
সাধন করেছেন।[42]
সুনানে নাসাঈর সত্যায়ন ও
মূল্যায়ন : ইমাম নাসাঈ (রহঃ) তাঁর
সংকলিত ‘সুনানুল কুবরা’-
কে পরিমার্জন ও সংক্ষেপ
করে ‘সুনানুছ ছুগরা’
তথা ‘সুনানে নাসাঈ’ সংকলন
করে দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, ﻙﺗﺎﺏ
ﺍﻟﺴﻨﻦ ﻛﻠﻪ ﺻﺤﻴﺢ ﻭﺑﻌﻀﻪ ﻣﻌﻠﻮﻝ ﻭﺍﻟﻤﻨﺘﺨﺐ
ﺍﻟﻤﺴﻤﻰ ﺑﺎﻟﻤﺠﺘﺒﻰ ﺻﺤﻴﺢ ﻛﻠﻪ – ‘সুনানুল
কুবরা’-এর সব হাদীছ ছহীহ।
তবে কিছু কিছু হাদীছের সনদ
ত্রুটিযুক্ত। আর ‘মুজতাবা’
তথা ‘সুনানে নাসাঈ’তে নির্বাচিত
সব হাদীছই ছহীহ’।[43]
ইমাম আবু আব্দুল্লাহ ইবনে রুশাইদ
(মৃঃ ৭২১ হিঃ) বলেন, ‘সুনান
পর্যায়ে হাদীছের যত গ্রন্থ প্রণয়ন
করা হয়েছে, তন্মধ্যে এ
গ্রন্থটি অভিনব রীতিতে প্রণয়ন
করা হয়েছে। আর এর সজ্জায়নও
চমৎকার। এতে বুখারী ও মুসলিম
উভয়ের রচনারীতির মধ্যে সমন্বয়
করা হয়েছে।
সাথে সাথে হাদীছের ‘ত্রুটি’ও
এতে বর্ণনা করা হয়েছে।[44]
আবু যাহূ ‘আল-হাদীছ ওয়াল
মুহাদ্দিছূন’ গ্রন্থে লিখেছেন,
‘মোদ্দাকথা, ‘মুজতাবা’
তথা ‘সুনানে নাসাঈ’তে অনুসৃত
ইমাম নাসাঈ (রহঃ)-এর শর্ত
ছহীহাইনের পর সবচেয়ে বেশী সুদৃঢ়
শর্ত। যা তাঁকে মুহাদ্দিছগণের
দৃষ্টিতে মহান করেছে।[45]
তিনি আরো বলেন,
‘মুজতাবা তথা সুনানে নাসাঈতে যঈফ
এবং সমালোচিত রাবী বর্ণিত
হাদীছ খুবই কম রয়েছে। এ গ্রন্থের
মর্যাদা ছহীহাইনের
পরে এবং এটি সুনানে আবূ দাঊদ ও
সুনানে তিরমিযীর চেয়ে অগ্রগণ্য।
[46]
হাফেয আবুল হাসান
মু‘আফেরী বলেন, ‘মুহাদ্দিছগণের
বর্ণিত হাদীছ সমূহের প্রতি যখন
তুমি লক্ষ্য করবে, তখন এ
কথা বুঝতে পারবে যে, ইমাম
নাসাঈ (রহঃ)-এর সংকলিত হাদীছ
অপরের সংকলিত হাদীছের
তুলনায় বিশুদ্ধতার অধিক
নিকটবর্তী’।[47]
তাজুদ্দীন সুবকী স্বীয়
পিতা তাকীউদ্দীন সুবকী ও
উস্তায হাফিয
যাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন, ﻭﺍﻥ
ﺳﻨﻨﻪ ﺃﻗﻞ ﺍﻟﺴﻨﻦ ﺑﻌﺪ ﺍﻟﺼﺤﻴﺤﻴﻦ ﺣﺪﻳﺜﺎ ﺿﻌﻴﻔﺎ –
‘ছহীহাইনের পর অন্যান্য সুনান গ্রন্থ
সমূহের
চেয়ে সুনানে নাসাঈতে কম
সংখ্যক যঈফ হাদীছ রয়েছে’।[48]
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ ইবনু মাত্বার
আয-যাহরানী বলেন,
‘মোদ্দাকথা হ’ল, ছহীহাইন
তথা বুখারী-মুসলিমের পর অন্যান্য
সুনান গ্রন্থের তুলনায় ‘সুনান
নাসাঈ’-তে যঈফ হাদীছ ও
সমালোচিত রাবী কমই আছে। এর
নিকটবর্তী হ’ল সুনানে আবূ দাঊদ ও
তিরমিযী। অন্যদিকে সুনান ইবনু
মাজাহ তার বিপরীত’।[49]
[চলবে]
* প্রধান মুহাদ্দিছ,
বেলটিয়া কামিল মাদরাসা,
জামালপুর।
[1]. হাজী খলীফা, কাশফুয যুনূন
(বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল
আরাবী, তাবি), ১/১০০৬ পৃঃ।
[2]. তারীখুত তাশরীইল ইসলামী,
পৃঃ ৯৫।
[3]. জালালুদ্দীন সুয়ূতী,
মুকাদ্দামাতু যাহারুর
রিবা আলাল মুজতাবা (বৈরূত :
দারু ইহইয়াইত তুরাছিল আরাবী,
তাবি), ২ পৃঃ।
[4]. কাশফুয যুনূন, ১/১০৬ পৃঃ;
মিফতাহুল উলূম ওয়াল ফুনূন, পৃঃ ৬৫।
[5]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-
যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফায
(বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ,
তাবি), ২/৬৯৮ পৃঃ; ইবনুল ইমাদ
হাম্বলী, শাযারাতুয যাহাব
ফী আখবারে মান
যাহাবা (বৈরূত : দারুল ফিকার,
তাবি), ২/২৩৯ পৃঃ।
[6]. হাফেয ইবনু কাছীর, আল-
বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ (বৈরূত :
দারু ইহইয়াইত তুরাছিল আরাবী,
১৯৯৩ খ্রিঃ/১৪১৩হিঃ), ১১/১৪০
পৃঃ; হাফেয ইবনু হাজার
আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব
(বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল
আরাবী, ১৯৯৩ খ্রিঃ/১৪১৩হিঃ),
১/২৭ পৃঃ।
[7]. শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ
দেহলভী, বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন,
বঙ্গানুবাদ: ড. আ.ফ.ম. আবু বকর
সিদ্দীক (ঢাকা : ইসলামিক
ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ,
২০০৪খ্রিঃ/১৪২৫হিঃ), পৃঃ ২৪৪।
[8]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-
যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন
নুবালা (বৈরূত : মুআস্সাসাতুর
রিসালাহ, ১৯৯৬
খ্রিঃ/১৪১৭হিঃ), ১৪/১২৫ পৃঃ।
[9]. তারীখুত তাশরীইল ইসলামী,
পৃঃ ৯৫।
[10]. ইসলামী বিশ্বকোষ, ১৪/৩৯ পৃঃ।
[11]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ,
১১/১৪১ পৃঃ; তাহযীবুত তাহযীব,
১/২৮ পৃঃ।
[12]. নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান
কন্নৌজী, আল-হিত্তাহ
ফী যিকরিছ ছিহাহ সিত্তাহ
(বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ,
১৯৮৫ খ্রিঃ), ২৫৩ পৃঃ।
[13]. মুহাম্মাদ আবু যাহূ, আল-হাদীছ
ওয়াল মুহাদ্দিছূন (আল-মাকতাবাতুত
তাওফীকিয়াহ, তাবি), ৩৫৭ পৃঃ।
[14]. ড. আব্দুল্লাহ মুছতফা মুরতাযা,
রুবাঈয়্যতুল ইমাম আন-নাসাঈ ফিস
সুনানিল কুবরা, অপ্রকাশিত এম.এ
থিসিস, গাযা : জামে‘আতুল
আযহার, ২০১২ ইং/১৪৩৩ হিঃ,
পৃঃ ১৩।
[15]. ঐ।
[16]. ড. তাকীউদ্দীন নাদভী,
আ‘লামুল মুহাদ্দিছীন, (বৈরূত :
দারুল বাশায়ির আল-ইসলামিয়্যাহ,
২০০৭ ইং/১৪২৮ হিঃ), পৃঃ ২৫০-২৫১।
[17]. রুবাঈয়্যাতুল ইমাম আন-নাসাঈ
ফিস সুনানিল কুবরা, পৃঃ ১৪।
[18]. হায়াতুল মুছান্নিফীন, পৃঃ ৬২।
[19]. প্রাগুক্ত, ১৪ পৃঃ।
[20]. বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন, ২৪৪ পৃঃ।
[21]. আ‘লামুল মুহাদ্দিছীন, ২৫১ পৃঃ।
[22]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ,
১১/১৪০ পৃঃ।
[23]. তাহযীবুল কামাল, ১/৩২৯ পৃঃ।
[24]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা,
১৪/১২৭ পৃঃ।
[25]. রুবাঈয়্যাতুল ইমাম আন-নাসাঈ
ফিস সুনানিল কুবরা, পৃঃ ১৪।
[26]. আ‘লামুল মুহাদ্দিছীন, পৃঃ ২৫২।
[27]. প্রাগুক্ত, ১৪/১২৫-২৭ পৃঃ।
[28]. রুবাঈয়্যাতুল ইমাম আন-নাসাঈ
ফিস সুনানিল কুবরা, পৃঃ ২৩।
[29]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫২।
[30]. তাহযীবুল কামাল ফী আসমাইর
রিজাল, ১৪/৩২৯-৩৩৩ পৃঃ।
[31]. আল-হাদীছ ওয়াল মুহাদ্দিছূন,
পৃঃ ৪০৯।
[32]. ড. আবু জামীল আল-হাসান আল-
আলামী, উম্মাহাতু কুতুবিল হাদীছ
ওয়া মানাহিজুত তাছনীফ ইনদাল
মুহাদ্দিছীন (২০০৫ইং/১৪২৬ হিঃ),
পৃঃ ১২৪; ড. মুহাম্মাদ ইবনু মাত্বার
আয-যাহরানী, তাদভীনুস
সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ
(মদীনা মুনাওয়ারাহ : দারুল
খুযায়রী, ১৯৯৮ খ্রিঃ),
পৃঃ ১৫৯-১৬০।
[33]. মুকাদ্দামাতু তুহফাতিল
আহওয়াযী, ১/১০৫ পৃঃ।
[34]. আল-হিত্তাহ ফী যিকরিছ
ছিহাহ আস-সিত্তাহ, পৃঃ ২১৯।
[35]. আ‘লামুল মুহাদ্দিছীন, পৃঃ ২৫৯।
[36]. মুকাদ্দামাতু তুহফাতিল
আহওয়াযী, ১/১০৫ পৃঃ।
[37]. বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন, পৃঃ ২৪৫।
[38]. মিফতাহুল উলূম ওয়াল ফুনূন,
পৃঃ ৬৮।
[39]. শায়খ নাছিরুদ্দীন
আলবানী কৃত তাহকীক সুনান
নাসাঈ দ্রঃ।
[40]. মিফতাহুল উলূম ওয়াল ফুনূন,
পৃঃ ৩২।
[41]. ইসলামী বিশ্বকোষ, ১৪/৩৯ পৃঃ।
[42]. মাওলানা আব্দুর রহীম, হাদীস
সংকলনের ইতিহাস, পৃঃ ৩৮৮।
[43]. আল-হাদীছ ওয়াল মুহাদ্দিছূন,
পৃঃ ৪০৯।
[44]. আ‘লামুল-মুহাদ্দিছীন, পৃঃ ২৬০।
[45]. আল-হাদীছ ওয়াল মুহাদ্দিছূন,
পৃঃ ৪১০।
[46]. ঐ।
[47]. মুকাদ্দামাতু যাহরির
রুবা আলাল মুজতাবা, পৃঃ ৪।
[48]. আল-হাদীছ ওয়াল মুহাদ্দিছূন,
পৃঃ ৩৫৮।
[49]. তাদভীনুস সুন্নাহ, পৃঃ ১৬০-১৬১।

No comments:

Post a Comment

Translate