আল্লাহর উপর ভরসা
অনুবাদকঃ শাইখ মুহা: আবদুল্লাহ আল কাফী
আল্লাহ্ তাআলার উপর ভরসা ইসলামে একটি বিরাট বিষয়। এর গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম।
আল্লাহর প্রতি ভরসা ছাড়া কোন বান্দাই কোন মূহুর্ত অতিবাহিত করতে পারে না। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। কেননা এর মাধ্যমে আল্লাহর তাওহীদের সাথে সম্পর্ক গাড় ও গভীর হয়।
আল্লাহ্ বলেন:وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ“আর ভরসা কর সেই জীবিত সত্বার (আল্লাহর) উপর, যিনি কখনো মৃত্যু বরণ করবেন না।” [সূরা ফুরক্বান-৫৮]
এই আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে তাঁর উপর ভরসা করার আদেশ করেছেন। তিনি ছাড়া অন্য কারো নিকট নিজেকে পেশ করবেন না। কেননা তিনি চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি পরাক্রমশালী, কোন কিছুই তাঁকে পরাজিত করতে পারে না। যে ব্যক্তিই তাঁর উপর নির্ভর করবে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট হবেন- তাকে সাহায্য ও সমর্থন করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো উপর ভরসা করবে, সে তো এমন কিছুর উপর ভরসা করল যে মৃত্যু বরণ করবে, বিলীন ও ক্ষয় হয়ে যাবে। দুর্বলতা ও অপারগতা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রয়েছে। এ কারণে তার প্রতি ভরসা কারীর আবেদন বিনষ্ট হয়ে যায়, সে হয়ে যায় দিশেহারা।
এ থেকেই বুঝা যায় আল্লাহর উপর ভরসা করার ফযীলত ও মর্যাদা কি?! তাঁর সাথে হৃদয়ের সম্পর্ককে গভীর করার গুরুত্ব কতটুকু?!
‘তাওয়াক্কুল আল্লাহ বা আল্লাহর উপর ভরসা করার অর্থ:
হাদীছ গ্রন্থ সমূহেও তাওয়াক্কুলের গুরুত্ব ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। ওমার বিন খাত্তাব (রা:) হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা যদি সঠিকভাবে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে তবে তিনি তোমাদেরকে রিযিক দান করতেন- যেমন পাখিকে রিযিক দান করে থাকেন- তারা খালি পেটে সকালে বের হয় এবং পেট ভর্তি হয়ে রাতে ফিরে আসে।” (আহমাদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনু মাজাহ্)
জাবের বিন আবদুল্লাহ্ (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন, “কোন প্রাণী তার নির্দিষ্ট রিযিক পরিপূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত সে মৃত্যু বরণ করবে না। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং রিযিক অনুসন্ধানের জন্য সুন্দর (বৈধ) পন্থা অবলম্বন কর। যা তোমাদের জন্য হালাল করেছেন তা গ্রহণ কর,আর যা হারাম করেছেন তা পরিত্যাগ কর।” (ইবনু মাজাহ্, হাকেম ও ইবনু হিব্বান)
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর উপর ভরসার সাথে আবশ্যক হল, জীবিকার উপায়-উপকরণ অনুসন্ধান করা ও কাজ করা- ভরসা করে বসে না থাকা।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,وَاتَّقُوا اللَّهَ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلْالْمُؤْمِنُونَ “তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আর মু’মিনগণ যেন আল্লাহর উপরই ভরসা করে।” [সূরা মায়েদা-১১]
এখানে ভরসা করার সাথে সাথে আল্লাহকে ভয় করার কথা বলা হয়েছে। আর তা নির্দেশিত যাবতীয় বিষয়ের উপকরণকে শামিল করছে। সুতরাং নির্দেশিত উপকরণ অবলম্বন না করে বা কাজ না করে শুধু ভরসা করে বসে থাকা বিরাট ধরণের অপারগতা- যদিও এতে তাওয়াক্কুল পাওয়া যায়। সুতরাং কোন বান্দার জন্য উচিত নয় যে,ভরসাকে অপারগতায় রূপান্তরিত করবে অথবা অপারগতাকে ভরসায় রূপান্তরিত করবে। বরং যে সমস্ত উপকরণ সে অবলম্বন করবে তার মধ্যে ভরসাও শামিল থাকবে।
এ অর্থে একটি হাদীছও বর্ণিত হয়েছে। আনাস (রা:) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন: জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল,হে আল্লাহর রাসূল! উটটিকে বাঁধার পর আল্লাহর উপর ভরসা করব? নাকি আল্লাহর উপর ভরসা করে (না বেঁধেই) ছেড়ে দিব? তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “আগে তা বেঁধে দাও,তারপর আল্লাহর উপর ভরসা কর।” (তিরমিযী)
উল্লেখ্য যে, ভরসার ক্ষেত্রে মানুষের দুর্বলতা একমাত্র তাক্বদীরের প্রতি ঈমানের দুর্বলতা থেকেই সৃষ্টি হয়। কেননা মানুষ যখন তার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে, আর তিনি যা ফায়সালা করেন তাতে সন্তুষ্ট হয়ে যায় ও তা পসন্দ করে, তাহলে সে প্রকৃত ভাবে তাওয়াক্কুল বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু সে যদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো উপর ভরসা করে এবং তার সাথেই স্বীয় হৃদয়কে সংশ্লিষ্ট করে, তবে নি:সন্দেহে সে লাঞ্ছিত হবে, স্বীয় মহান রব থেকে উদাসীন।
ইবনু মাসঊদ (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “কোন ব্যক্তি যদি অভাবী হয়, অত:পর তার অভাবের কথা মানুষের কাছে পেশ করে, তবে তার অভাব দুর করা হবে না। আর যে ব্যক্তি তা আল্লাহর কাছে পেশ করে, অনতিবিলম্বে আল্লাহ্ তাকে অভাব মুক্ত করে দিবেন।” (আবু দাউদ )
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া (র:) বলেন: কোন মাখলুকের কাছে যে ব্যক্তি আশা করবে এবং তার উপর ভরসা করবে, তার উক্ত ধারণা নি:সন্দেহে বাতিল হবে এবং সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর সে হবে মুশরিক।
শায়খ সুলায়মান বিন আবদুল্লাহ্ বিন আবদুল ওয়াহাব (র:) বলেন: তাওয়াক্কুল দুপ্রকার:
১) এমন বিষয়ে তাওয়াক্কুল করা- যে ব্যাপারে আল্লাহ্ ছাড়া কারো কোন ক্ষমতা নেই। যেমন, কোন কোন মানুষ মৃত ব্যক্তি এবং তাগুতের উপর ভরসা করে এই আশায় যে, তারা তাদেরকে সাহায্য করবে, তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করবে, তাদের জন্য শাফাআত করবে… এগুলো সবই বড় শিরক যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দিবে।
২) বাহ্যিক উপায়-উপকরণ ও বস্তুর উপর ভরসা করা। যেমন কোন আমীর বা বাদশার উপর ভরসা করা এমন বিষয়ে যা বাস্তবায়নের ক্ষমতা আল্লাহ্ তাকে দিয়েছেন। যেমন চাকরীর ব্যবস্থা করা বা নির্দিষ্ট কোন বিপদ দূর করা। এটা ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
বৈধ ভরসা হলঃ
একজন মানুষ অপরজনকে তার পক্ষ থেকে কোন কাজ আদায় করার দায়িত্ব দেয়া। দায়িত্বপ্রাপ্ত
তাওয়াক্কুলের বাস্তবায়ন এবং বৈধ উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার সাথে সাথে হৃদয়কে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য এ উদাহরণটি উল্লেখযোগ্য: রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতের সময় মদিনার দিকে যাওয়ার জন্য মক্কা থেকে উল্টা দিকে গমন করেন। আর তা ছিল রাতের আঁধারে। অত:পর তাঁরা ‘ছওর’নামক গুহায় আত্মগোপন করেন। আবু বকর (রা:) নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর হিজরতের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, আমরা যখন ‘গারে ছওরে’ ছিলাম তখন আমি উপর দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম মুশরেকদের পা আমাদের মাথার ঠিক উপরেই। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের কেউ যদি নিজের পায়ের দিকে তাকায় তাহলেই আমাদেরকে দেখতে পাবে। তখন তিনি আমাকে বললেন, “আমাদের দুজন সম্পর্কে তোমার ধারণা কি হে আবু বকর! আল্লাহ্ আমাদের তৃতীয় জন। অর্থাৎ আমাদের সাহায্যকারী।” (বুখারী ও মুসলিম)
আল্লাহ্ বলেন,وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ“যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।” (সূরা ত্বালাক-৩)
আল্লাহ্ আমাদেরকে তাঁর প্রতি সঠিকভাবে ভরসা করার তাওফীক দান করুন। আমীন॥
No comments:
Post a Comment