Saturday, July 19, 2025

বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটে মহিলাদের ভয়েস বা অডিও ক্লিপ প্রচার এবং পুরুষদের জন্য তা শ্রবণ করা সংক্রান্ত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া

 ❑ ফতোয়া-১: প্রশ্ন: মহিলাদের অডিও ক্লিপ বা বক্তব্য ইন্টারনেটে প্রচার করার হুকুম কী?

উত্তর: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। দরূদ ও সালাম রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি। অতঃপর
মূলত নারীর কণ্ঠস্বর পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয় (অর্থাৎ তা নিজে নিজে হারাম নয়) যতক্ষণ না সেই কণ্ঠে কোমলতা, চটুলতা, হাসাহাসি বা পুরুষদের মন দুর্বল করে দেওয়ার মতো নম্রতা বা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়।
✪ আল-মাওসু‘আতুল ফিকহিয়্যাহ (কুয়েতি ফিকাহ বিশ্বকোষ) (৪/৯০) গ্রন্থে এসেছে:
“إنْ كَانَ صَوْتَ امْرَأَةٍ ، فَإِنْ كَانَ السَّامِعُ يَتَلَذَّذُ بِهِ ، أَوْ خَافَ عَلَى نَفْسِهِ فِتْنَةً، حَرُمَ عَلَيْهِ اسْتِمَاعُهُ ، وَإِلاَّ فَلاَ يَحْرُمُ ، وَيُحْمَل اسْتِمَاعُ الصَّحَابَةِ رِضْوَانُ اللَّهِ عَلَيْهِمْ أَصْوَاتَ النِّسَاءِ حِينَ مُحَادَثَتِهِنَّ عَلَى هَذَا ، وَلَيْسَ لِلْمَرْأَةِ تَرْخِيمُ الصَّوْتِ وَتَنْغِيمُهُ وَتَلْيِينُهُ ، لِمَا فِيهِ مِنْ إثَارَةِ الْفِتْنَةِ ، وَذَلِكَ لِقَوْلِهِ تَعَالَى : (فَلاَ تَخْضَعْنَ بِالْقَوْل فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ)
“যদি কোনও নারীর কণ্ঠস্বর হয় আর শোনার সময় শ্রোতা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লালসা অনুভব করে অথবা নিজের মনে ফিতনার আশঙ্কা করে। তবে তা শোনা হারাম। তবে যদি এমন কিছু না হয় তাহলে হারাম নয়। সাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) নারীদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁদের কণ্ঠস্বর শুনতেন এটিই তার প্রমাণ। তবে নারীর জন্য কণ্ঠে কোমলতা, মিষ্টি স্বরে অথবা গানে সুর তোলার মতো করে কথা বলার অনুমতি নেই। কারণ এতে ফিতনার আশঙ্কা থাকে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
فَلاَ تَخْضَعْنَ بِالْقَوْل فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ
“তোমরা কথা বলার সময় নম্র স্বরে কথা বলো না, যাতে যার অন্তরে ব্যাধি আছে সে কুমতলব করে না বসে।” [সূরা আহযাব: ৩২]
✪ সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটির আলেমগণ বলেছেন:
صوت المرأة نفسه ليس بعورة، لا يحرم سماعه، إلا إذا كان فيه تكسر في الحديث، وخضوع في القول ، فيحرم منها ذلك لغير زوجها ، ويحرم على الرجال سوى زوجها استماعه ؛ لقوله تعالى : ( يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا ) الأحزاب/ 32 .
“নারীর কণ্ঠস্বর নিজে নিজে পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তা শোনাও হারাম নয়। তবে যদি তাতে চটুলতা, কোমলতা অথবা আকর্ষণীয় ভঙ্গি থাকে তাহলে তা হারাম—স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষদের জন্য। কারণ আল্লাহ বলেন:
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا
“হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা সাধারণ নারীদের মতো নও, যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। অতএব তোমরা কোমলভাবে কথা বলো না, যাতে যার অন্তরে ব্যাধি আছে সে কুমতলব করে না বসে। আর তোমরা স্বাভাবিকভাবে কথা বলো।” [সূরা আহযাব, আয়াত: ৩২]
এই ফতোয়ায় স্বাক্ষরদানকারী আলেমগণ হলেন:
– শায়খ আব্দুল আজিজ ইবনে বায
– শায়খ আব্দুর রাযযাক আফিফি
– শায়খ আব্দুল্লাহ গুদাইয়ান
– শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে কুউদ
[ফতোয়ায়ে লাজনাহ দায়েমাহ ১৭/২০২]
সারসংক্ষেপ: আপনি ইন্টারনেটে যে অডিও ক্লিপটি প্রচার করতে চান তা যদি উপকারী কোনও বিষয়বস্তু নিয়ে হয় এবং এতে কণ্ঠে চটুলতা, কোমলতা, আকর্ষণ বা গান-মেজাজ না থাকে আর কণ্ঠ ছাড়া অন্য কিছু প্রকাশ না হয় তাহলে এতে কোনও দোষ নেই ইনশাআল্লাহ।
আর যদি ক্লিপটি শুধুমাত্র নারীদের জন্য নির্ধারিত হয় বা তাদের উদ্দেশ্য করেই প্রকাশ করা হয় তাহলে তা আরও উত্তম। আল্লাহু আলাম। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। [উৎস: islamqa]
❑ ফতোয়া-২: গণমাধ্যমে নারীর কণ্ঠস্বর শোনা এর শরয়ী বিধান কী?
আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ.-এর এর নিকট প্রশ্ন করা হয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমে (যেমন: রেডিও, টেলিভিশন) অনেক প্রোগ্রাম নারীরা পরিচালনা করেন। এমনকি ইসলামি অনুষ্ঠানেও তারা উপস্থাপনা করে থাকেন। এ অবস্থায় মুসলিমদের জন্য তাদের কণ্ঠ শুনা কি বৈধ? উত্তরে তিনি বলেন, “নারীর কণ্ঠস্বর নিজেই সতর (পর্দা) নয়। বরং সতর হচ্ছে, তার কণ্ঠের কোমলতা, আকর্ষণীয়তা এবং ভঙ্গিমাপূর্ণভাবে কথা বলা। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ
“হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা সাধারণ নারীদের মতো নও, যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো। তবে কোমলভাবে কথা বলো না, যাতে যার অন্তরে রোগ আছে সে লালসা না পোষণ করে।” [সূরা আহজাব: ৩২]
প্রথমত: নারীদের রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদিতে ব্যবহার করা (অর্থাৎ তাদেরকে এসব মাধ্যমে উপস্থাপক বা বক্তা বানানো) উচিত নয়।
তবে যদি এমনটা হয়ে থাকে, তাহলে একজন ব্যক্তি যদি অনুভব করে যে, তিনি ওই কণ্ঠস্বর শুনে আসক্ত হচ্ছেন, মন তাতে ঝুঁকছে, কিংবা কণ্ঠ শুনে উপভোগ করছেন তাহলে তার উচিত তা থেকে দূরে থাকা এবং না শোনা। অন্যদিকে, যদি কোনও উপকারী কথা থাকে যেমন: উপদেশ, সতর্কবাণী, বা প্রয়োজনীয় তথ্য আর শ্রোতা নিজে কোনও ধরনের আসক্তি বা শারীরিক চাহিদা অনুভব না করেন বরং নিছক উপকারের জন্য শোনেন তাহলে আশা করা যায়, এতে তার ধর্মীয় ক্ষতির কোনও আশঙ্কা নেই এবং এতে কোনও দোষ নেই। [উৎস: binbaz]
❑ ফতোয়া-৩: নারীর কণ্ঠে আবৃত্তি করা কবিতার ভিডিও ইন্টারনেটে প্রকাশ করার হুকুম কী?
প্রশ্ন: একটি ভিডিও ইন্টারনেটে আপলোড করার হুকুম কী, যাতে কোনও নারীর কণ্ঠে আবৃত্তি করা কবিতা রয়েছে? আল্লাহ আপনাদের উত্তম প্রতিদান দিন।
উত্তর: আলহামদু লিল্লাহ, ওয়া সাল্লাতু ওয়া সালামু ‘আলা রসূলিল্লাহ, ওয়া ‘আলা আলিহি ও সাহবিহি, আম্মা বাদ:
নারীর কণ্ঠস্বর শরিয়তের বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী নিজে সতর (পর্দা) নয়। তাই যদি উক্ত ভিডিও এবং তাতে আবৃত্তি করা কবিতা শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনও নিষিদ্ধ বিষয়বস্তু থেকে মুক্ত থাকে এবং আবৃত্তি কারী নারী পর্দা মেনে চলে এবং তার কণ্ঠে “খুযু বিল কাওল” (ভঙ্গিমাপূর্ণ কোমলতা ও আকর্ষণীয়তা) না থাকে তাহলে এমন ভিডিও ইন্টারনেটে প্রকাশ করার কোনও বাধা নেই। “মাতালিব উলি নুহা” গ্রন্থে কবিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে:
ويباح مِنْه مَا لَا سُخْفَ فِيهِ غَيْرُ مُنَشِّطٍ عَلَى شَرٍّ، وَمُثَبِّطٍ عَنْ خَيْرٍ، إذْ الشِّعْرُ كَالْكَلَامِ حَسَنُهُ حَسَنٌ وَقَبِيحُهُ قَبِيحٌ
“যে কবিতায় অশ্লীলতা নেই, যা মন্দ কাজে উৎসাহ দেয় না বা ভালো কাজ থেকে বিরত রাখে না, তা বৈধ। কারণ, কবিতা কথাবার্তার মতোই ভালোটা ভালো আর মন্দটা মন্দ।”
অতএব এমন বৈধ কবিতা নারীর কণ্ঠে শোনাও বৈধ যদি তাতে কণ্ঠের কোমলতা না থাকে, কেউ তা শুনে কণ্ঠস্বর দ্বারা আসক্ত না হয় এবং তার দিকে তাকিয়ে উপভোগ না করে। আল মায়াবী ( المايابي) তাঁর نوازل العلوي শিরোনামের কবিতায় বলেন:
وكل ما له أبيح النظرُ فمع قصد لذة ينحظرُ
“যে সব কিছু দেখা বৈধ তা যদি ভোগের উদ্দেশ্যে দেখা হয় তবে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়।” আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার। সৌদি আরব।

শাইখ রবী বিন হাদী আল মাদখালী রাহিমাহুল্লাহর অসীয়ত

আহলুস সুন্নাহর ইমাম আল্লামা শাইখ রবী বিন হাদী আল মাদখালী রহিমাহুল্লাহ তাঁর অসীয়তে বলেন—
“বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম।”
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর কাছে সাহায্য কামনা করি এবং তাঁর কাছেই ক্ষমা চাই। আমরা নিজেদের অন্তরের মন্দ ও আমাদের অসৎ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন, কেউ তাকে সঠিক পথে আনতে পারে না।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই; তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُون
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করো এবং অবশ্যই মুসলিম হওয়া ব্যতীত মৃত্যুবরণ করো না ।” [সূরা আলে ইমরান: ১০২]
يَآأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسࣲ وَٰحِدَةࣲ وَخَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَبَثَّ مِنۡهُمَا رِجَالࣰا كَثِيرࣰا وَنِسَآءࣰۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ ٱلَّذِي تَسَآءَلُونَ بِهِۦ وَٱلۡأَرۡحَامَۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَيۡكُمۡ رَقِيبࣰا
হে মানুষ! তোমাদের প্রভুকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি (আদম) থেকে সৃষ্টি করেছেন; তার থেকে তার সঙ্গিনীকেও সৃষ্টি করেছেন আর ঐ দুজন থেকেই অনেক নর-নারী (সৃষ্টি করে পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন। আল্লাহকে ভয় করো, যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে (যার যার পাওনা) চেয়ে থাক। রক্ত-সম্পর্কের ব্যাপারেও সাবধান থেকো। অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।[সূরা আন-নিসা: ১]
.يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدا
يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَد
فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো, তিনি তোমাদের কাজগুলোকে শুদ্ধ করে দেবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করে।” [সূরা আল-আহযাব: ৭০–৭১]
অতঃপর —নিশ্চয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ কথা হলো আল্লাহর কিতাব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পথ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথ। আর নিকৃষ্টতম বিষয়সমূহ হল বিদআত, প্রত্যেক বিদআত বিভ্রান্তি, আর প্রত্যেক বিভ্রান্তিই জাহান্নামে নিয়ে যায়।
এরপর বলি, এই অসীয়ত এক দুর্বল বান্দার পক্ষ হতে সাধারণ মুসলমানদের জন্য— যে কিনা দুনিয়া থেকে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে এবং আখিরাতের পথে যাত্রার জন্য তৈরি। তার উপদেশ হলো—”মুসলমানরা যেনো আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় করে, একত্রে আল্লাহর রজ্জু আঁকড়ে ধরে, বিভক্ত যেনো না হয়, তারা যেনো দ্বীনের মধ্যে দলাদলি না করে। কারণ আল্লাহভীতি, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার মধ্যেই রয়েছে তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত সাফল্য ও নেতৃত্ব। পক্ষান্তরে, বিভক্তি ও মতবিরোধ তাদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনার দিকে নিয়ে যায়। এই উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি কেবল আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহর ভিত্তিতেই হতে পারে, অন্যথায় সম্ভব না।তাই মুসলিমদের উচিত এই ঐক্যের এই মহান মাধ্যমকে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করা, যা তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য এনে দিবে। আর বিভেদ ও মতপার্থক্য থেকে দূরে থাকা উচিত, যা উভয়জাহানে বিপর্যয় ও লাঞ্ছনার কারণ।
আর আমি (বিশেষভাবে) উপদেশ দিচ্ছি সালাফী ভাইদেরকে– যারা কুরআন ও সুন্নাহর উপর দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছে এবং মানুষের মাঝে তা প্রচার করছে—তারা যেন দ্বীনের বিভিন্ন দিক যেমন আকীদা, ইবাদত, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে দ্বিগুণ আন্তরিকতা ও শ্রম দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে সংশোধনী প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় এবং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাদের অন্যান্য জীবনধারাকে আলোকিত করে। তারা যেন মুসলমানদেরকে বুঝিয়ে দেয়—তাদের উদ্দেশ্য কল্যাণ ছাড়া কিছু নয়, তারা এই উম্মাহর জন্য সমস্ত অকল্যাণ দূর করতে চায়—যার মূল কারণ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দূরে সরে যাওয়া। আমি উপদেশ দিচ্ছি সমস্ত আলেম ও তালিবে ইলমদের, তারা যেন নিজেদের উম্মাহর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে, এবং উম্মাহকে কুরআন-সুন্নাহ এবং সালাফে সালিহীনের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে। আকীদা, ইবাদত, রাজনীতি, সমাজনীতি, চরিত্র—সব কিছুতেই যেন সেই পূর্বসূরিদের অনুসরণ করা হয় এবং তারা যেন মতের ভেদাভেদ ও প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকে, যা আজ উম্মাহর মাঝে ভীষণ বিপর্যয় এনেছে। এখনই সেই সময়—যখন তাদের উচিত এই মহৎ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া এবং মুসলমানদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনাকর পরিস্থিতি থেক্ব উদ্ধার করা। আর এই শেষ উম্মতের সংশোন কেবল সে পথেই হবে, যে পথে পূর্ববর্তী বা উম্মতের প্রথম ব্যক্তিরা সংশোধন করে গেছেন।
এই উম্মত শ্রেষ্ঠত্ব পেয়েছে শুধু এজন্য যে তারা মানবজাতির কল্যাণে বের হয়েছে—সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান—এই ছিল তাদের বৈশিষ্ট্য। প্রথম প্রজন্মের সাহাবিগণ ও তাঁদের অনুসরণকারীরা এই মর্যাদা অর্জন করেছিলেন, যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ আমার যুগ, এরপর তাদের পরবর্তী, তারপর তাদের পরে যারা আসবে তারা । এরপর এমন এক সম্প্রদায় আসবে—যারা সাক্ষ্য দেবে অথচ তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না , যারা প্রতিজ্ঞা করবে কিন্তু তা পূরণ করবে না, এবং তাদের মধ্যে স্থূলতা বৃদ্ধি পাবে।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) তিনি আরও বলেন: “একজন একজন করে নেককাররা চলে যাবে, অবশেষে এমন এক দল বাকি থাকবে যারা গম বা খেজুর ছাঁকার পর যে আবর্জনা পড়ে থাকে, তার মতো হবে। আল্লাহ তাদের কোনো গুরুত্ব দিবেন না।” (সহীহ বুখারী) তাই আলেমদের উপর দায়িত্ব— তাঁরা যেন আল্লাহ, তাঁর কিতাব, রাসূল, সাধারণ ও বিশেষ মুসলমানদের জন্য কল্যাণ কামনা করেন—যাতে আল্লাহ তাআলা এই উম্মাহর গাফেল ও দূর্বল অংশকে মুক্তি দিতে পারেন। কেননা এই দুরাবস্থার মূল কারণ হলো—বেশিরভাগ মানুষ কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত! যদি তারা আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সাথে এই আহ্বান প্রচার করে, তাহলে এই উম্মাতের জন্য বিপুল কল্যাণ সাধিত হবে। আমরা আল্লাহ তাবারাকা ও তায়ালার নিকট কামনা করি, তিনি যেন এটি বাস্তবায়ন করেন এবং মুসলিমদের থেকে সমস্ত অপমান ও হীনতার কারণসমূহ দূর করে দেন— সেই সব কারণ— যা দলাদলি, হিংসা, পরস্পর বিদ্বেষ ও শত্রুতার জন্ম দেয়; যেগুলোর প্রভাব ও ফলাফল স্পষ্টভাবে সেই সব হৃদয়বান ব্যক্তি অনুভব করে থাকেন , যিনি উম্মতের জন্য কল্যাণ কামনা করেন।
_______
শ্রুতিলিপি করেছেন: তাঁর ছাত্র।
খালিদ বিন যুহাইর আয-যাফিরি।
এবং আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেনো এটা সবজায়গায় পত্রিকা ও অন্যান্য মাধ্যমে প্রচার করার জন্য।
উক্তি করেছেন: শায়খ রাবী’ ইবন হাদী আল-মাদখালী।

বৃহস্পতিবার, ২৫ই যুলহিজ্জাহ ১৪২০ হিজরী রাতে। 

দ্বীনি ইলম শিক্ষা দান কারী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কতিপয় জরুরি উপদেশ

 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার জন্য, যিনি বিশ্ব জাহানের একমাত্র প্রতিপালক। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশেষ নবী ও সর্বোত্তম রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), তাঁর পরিবারবর্গ এবং সাহাবায়ে কেরামের উপর।

▪️ দ্বীনি ইলম শিক্ষা দান কারী শিক্ষকদের জন্য কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ:
নিঃসন্দেহে শিক্ষকগণ ব্যক্তি গঠনের পাশাপাশি একটি জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে। তাই তাদের মর্যাদা যেমন অপরিসীম তেমনি তাদের উপরে দায়-দায়িত্বও অনেক বেশি। নিম্নে এক্ষেত্রে তাদের জন্য কতিপয় জরুরি উপদেশ প্রদান করা হলো:
১. শিক্ষার্থীদের অন্তরে দ্বীনের সঠিক বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য। তাই এমন বিষয়ে তাদের অনুশীলন করানোর চেষ্টা করতে হবে যা ইহকাল ও পরকালে কল্যাণকর। আর এর প্রতিদান আশা করবেন কেবল আল্লাহর কাছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
“মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তিনটি আমল ব্যতীত সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। আমল তিনটি হচ্ছে:
১. সাদাকায়ে জারিয়া,
২. উপকারী বিদ্যা এবং
৩. সৎ সন্তান, যে তার জন্য দুআ করে।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ১৬৩১]
২. শিক্ষক তার প্রতিটি পদক্ষেপে প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অনুসরণ ও অনুকরণ করবেন। অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার নিকট আল্লাহর নবী হবেন, সর্বোত্তম আদর্শ। কেননা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
مَثَلُ الْعَالِمِ الَّذِي يُعَلِّمُ النَّاسَ الْخَيْرَ وَيَنْسَى نَفْسَهُ، كَمَثَلِ السِّرَاجِ، يُضِيءُ لِلنَّاسِ وَيَحْرِقُ نَفْسَهُ
“যে ব্যক্তি মানুষকে কল্যাণের শিক্ষা দান করে এবং নিজের কথা ভুলে যায় তার উদাহরণ হচ্ছে, প্রদীপের মতো। প্রদীপ নিজেকে জ্বালিয়ে মানুষকে আলো প্রদান করে।” [তাবরানী (আল-মু’জামুল কাবীর), হাদিস নং: ৭২৪৪]
৩. শিক্ষক তার স্কন্ধে অর্পিত আমানতের গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি খাঁটি ইমানের অধিকারী একটি সুন্দর জাতি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করবেন। এ কাজে তিনি আল্লাহর কাছে প্রতিদানের আশা করবেন। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ
“যে ব্যক্তি কল্যাণের দিক নির্দেশনা প্রদান করবে, সে তার বাস্তবায়নকারীর ন্যায় প্রতিদান লাভ করবে।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ১৮৯৩]
৪. উস্তাদ পোশাক-পরিচ্ছদ এবং চলাফেরায় উত্তম পন্থা অবলম্বন করবেন এবং ধীরস্থিরতা অবলম্বন করবেন। পাঠ্য বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব ও সম্মানের সহিত লক্ষ্য রাখবেন এবং শ্রেণিকক্ষে প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হবেন।
৫. তিনি পাঠ্য বিষয়ের একটি সীমা নির্ধারণ করবেন। আর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো ছাত্রদের মেধানুযায়ী উত্তম নিয়মে সাজিয়ে নেবেন।
এ ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং উন্নত প্রশিক্ষণ পদ্ধতি থেকে সহযোগিতা নিতে পারেন।
৬. ছাত্রদের নিকট উদ্যমশীলতা ও আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে সওয়াল-জওয়াব (প্রশ্নোত্তর) উপস্থাপন করতে হবে।
৭. উস্তাদ ছাত্রদেরকে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শিক্ষানুযায়ী পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াত পাকা-পোক্তভাবে শেখাতে মনোযোগী হবেন।
৭. শিক্ষক হচ্ছেন, মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম। আবু উমামা বাহেলি থেকে বর্ণিত।
ذُكِرَ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلَانِ أَحَدُهُمَا عَابِدٌ وَالْآخَرُ عَالِمٌ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرَضِينَ حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ
“রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর ঠিক তেমন, যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের সাধারণ এক ব্যক্তির উপর।’ নিশ্চয় আল্লাহ, ফেরেশতামণ্ডলী এবং আসমান ও জমিনের অধিবাসীরা—এমনকি পিঁপড়া তার গর্তে—এমনকি পানির মাছ—মানুষকে কল্যাণের শিক্ষাদানকারীর জন্য দু’আ করে।” {সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং: ৩৬৪৩; সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং: ২৬৮২; ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২২৩]
৮. তিনি ঐকান্তিকভাবে যত্ন নেবেন—ছাত্রদের শিক্ষাকে তাদের বাস্তব জীবন এবং সমাজের চলমান অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট করতে। আর এক্ষেত্রে তিনি চলমান বিভিন্ন ঘটনা থেকে উদাহরণও উপস্থাপন করবেন। যাতে করে তাদের বোধগম্য হয় যে, ইসলামের বিধি বিধানগুলো বাস্তব, যথার্থ, জীবন্ত, সজীব এবং তা সর্বকাল এবং সর্বস্থানের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।
৯. প্রথমে আল্লাহর উপর অতঃপর নিজের উপর আস্থা স্থাপনের ক্ষেত্রে ছাত্রদের অনুভূতি ও চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে।
১০. অনুরূপভাবে অবসর সময়কে কীভাবে দ্বীন-দুনিয়ার উপকারী কাজে ব্যবহার করা যায় তার সর্বোত্তম সুন্দর এবং সর্বাধুনিক পদ্ধতি শেখাতে হবে। আল্লাহই সকল তাওফিক দাতা।
▪️দ্বীনি ইলম অন্বেষণকারী শিক্ষার্থীদের জন্য কতিপয় উপদেশ:
১. জ্ঞান অর্জনের পথে মজবুতভাবে লেগে থাকো। কারণ এই পথ অত্যন্ত মর্যাদার।
আবু দারদা রা. বলেন, আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:
مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ فِيهِ عِلْمًا سَلَكَ اللَّهُ بِهِ طَرِيقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالْحِيتَانُ فِي جَوْفِ الْمَاءِ وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلَا دِرْهَمًا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ
“যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে রাস্তায় চলবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তাকে সহজ করে দেবেন। শিক্ষার্থীর (দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা) কর্মের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ফেরেশতারা তাদের ডানাগুলো বিছিয়ে দেয়। আর আলেমের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে—এমনকি পানির মাছও। ইবাদত গুজার একজন ব্যক্তির উপর জ্ঞানী (আলেম) ব্যক্তির মর্যাদা ঠিক সে রকম, যেমন নক্ষত্ররাজিদের উপর একটি চাঁদের মর্যাদা। আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দিনার বা দিরহাম (টাকা-পয়সা ও অর্থ-সম্পদ) উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যাননি। তারা উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখে গিয়েছেন, শুধু মাত্র ইলম বা ওহির জ্ঞান। যে ব্যক্তি তা অর্জন করবে, সে পরিপূর্ণ লাভবান হবে।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ২৭২২]
২. জ্ঞান অর্জনের পর তা গোপন না রেখে অন্যদের সাথে ভাগ করে নাও। মানুষের কাছে প্রচার করো।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَالْهَرَمِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ اللَّهُمَّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لَا يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لَا تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لَا يُسْتَجَابُ لَهَا
“হে আল্লাহ! আপনার কাছে আশ্রয় চাই অপারগতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, অতিবার্ধক্য এবং কবরের আজাব হতে।
হে আল্লাহ! আমার অন্তরে তাকওয়া দান কর। তাকে পবিত্র কর। তুমিই তার সর্বোত্তম পবিত্রতাকারী। তুমিই তার বন্ধু ও কর্তৃত্বকারী।
হে আল্লাহ! তোমার কাছে আশ্রয় কামনা করি এমন জ্ঞান থেকে যা উপকারে আসে না, এমন হৃদয় থেকে যা ভীত হয় না, এমন প্রাণ থেকে যা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন দুআ থেকে যা কবুল করা হয় না।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ২৭২২] মহান আরশের অধিপতি সুমহান আল্লাহর সুউচ্চ দরবারে প্রার্থনা করি, তিনি সবাইকে তাঁর আনুগত্য করা তথা তাঁর আদেশগুলো বাস্তবায়ন এবং নিষেধগুলো থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আল কাফী (রহ.)।
সম্পাদনা ও পরিমার্জনা: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
(জুবাইল দাওয়াহ এসোসিয়েশনের সিলেবাস গ্রন্থের ভূমিকা থেকে নেওয়া)।

যেসব গৃহবধূ তাদের পরিবারের জন্য অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম করে থাকেন ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের মর্যাদা ও প্রতিদান

 প্রশ্ন: আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষের কাজ একদমই অগোছালো। প্রতিদিনই এসব বাড়তি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে যাই। প্রশ্ন হলো, এই যে আমি চুপচাপ পরিশ্রম করে যাই এটা কি এক প্রকার ধৈর্য বিবেচিত হবে? এতে কি আমি সওয়াব পাবো?

উত্তর: আমাদের সমাজের অধিকাংশ গৃহবধূকে তাদের স্বামী সংসারে প্রচুর কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরা বঞ্চিত হলেও অকাতরে তাদের আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে স্বামী সন্তান এবং পরিবারকে ভালো রাখার জন্য হাসিমুখে সব কষ্ট মেনে নেয়। কিন্তু তারা অনেকে জানেই না, ইসলামে এ জন্য তাদের কী মর্যাদা রয়েছে এবং এ মর্যাদা লাভের শর্ত কী? তাই নিম্নে এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিকোণ উপস্থাপন করা হলো:
▪️১. সদকার সওয়াব:
মানুষের সেবা করা বা উপকার করা নিঃসন্দেহে ‘ভালো কাজ’। আর প্রতিটি ভালো কাজেই সদকার সওয়াব রয়েছে ইনশাআল্লাহ।
✪ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
كلُّ معروفٍ صدقةٌ وإن من المعروفِ أن تَلْقَى أخاك بوجهٍ طَلْقٍ وأن تُفْرِغَ من دَلْوِكَ في إناءِ أَخِيك
“প্রত্যেক ভালো কাজই সদকা (দান)। আর ভালো কাজের মধ্যেই এটাও পড়ে যে, তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করবে এবং তোমার বালতির (অতিরিক্ত) পানি তোমার ভাইয়ের পাত্রে ঢেলে দেবে।” [সহিহ বুখারি, হা/ ৬০২১]
✪ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
لا تحْقِرَنَّ من المعرُوفِ شيْئًا ، ولوْ أنْ تلْقَى أخاكَ بوجْهٍ طلْقٍ
“সৎকর্মকে কখনোই তুচ্ছ মনে করো না, যদিও তা তোমার ভাইকে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাই হয়।” [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬২৬]
এখানে হাদিসগুলোর মূল বক্তব্য হলো, শুধু অর্থ সাহায্য করাই সদকা নয় বরং প্রতিটি ভালো কাজ, যেমন—কারো সাথে হাসিমুখে কথা বলা, অন্যের প্রয়োজনে সামান্য হলেও সাহায্য-সহযোগিতা করা সদকার অন্তর্ভুক্ত। সে হিসেবে একজন গৃহবধূ তার স্বামী, সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যত উপকার করবে প্রতিটি কাজের বিনিময়ে সে সদকার সওয়াব পাবে ইনশাআল্লাহ।
❑ শর্তাবলী:
এই সওয়াব লাভের শর্ত হল, তারা অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করবে এবং আল্লাহর নিকট এর প্রতিদানের নিয়ত করবে। আর উপকার করে কখনো কাউকে খোটা দেবে না। কেননা খোটা দিলে উক্ত সৎ কর্মের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُم بِالْمَنِّ وَالْأَذَىٰ
“হে ইমানদারগণ! তোমরা তোমাদের সদকাসমূহ বরবাদ করে দিও না উপকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া (খোটা দেওয়া) ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে।” [সূরা বাকারা: ২৬৪] পাশাপাশি, যথাসময়ে সালাত আদায়, নন মাহরামদের সামনে পর্দা রক্ষা ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক বিধানগুলো ঠিক রাখা আবশ্যক। কেউ যদি এই সকল অপরিহার্য বিধান লঙ্ঘন করে পরিবারের সেবায় লিপ্ত থাকে তাহলে তার এই সওয়াব পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। বরং ফরজ বিধান লঙ্ঘণ করার অপরাধে সে পাপীষ্ঠ বলে গণ্য হবে।
▪️২. ইসলামের দৃষ্টিতে উপকার কারী মানুষই সেরা:
হাদিসে ওই ব্যক্তিকে “উত্তম বা সেরা মানুষ” বলা হয়েছে যে, অধিক পরিমাণে মানুষের উপকার করে।
✪ সাহাবি জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“خيرُ الناسِ أنفعُهم للناسِ”
“সর্বোত্তম মানুষ সে-ই, যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকার কারী।” [শাইখ আলবানি এটিকে হাসান বলেছেন। সহিহুল জামে, হা/ ৩২৮৯] আরও বহু হাদিসে মানুষের উপকারের ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে।
▪️ ৩. মানুষের ভালোবাসা অর্জনের পাশাপাশি আল্লাহর বিশেষ প্রতিদান:
মানুষের সেবা করা বা তাদের উপকার করা তাদের ভালোবাসা অর্জনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কেননা সাধারণভাবে মানুষ তাকে ভালোবাসে যে তার উপকার করে। যদিও আমাদের সমাজে উপকারের উপকার স্বীকার করা বা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায়ের মনোভাব নিতান্তই কম। কিন্তু অকৃতজ্ঞ মানুষ উপকার কারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলেও মহান আল্লাহ অবশ্যই তাকে আখিরাতে প্রতিদান দান করবেন ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ
“উপকারের প্রতিদান কি উপকার ছাড়া আর কিছু হতে পারে?” [সূরা রহমান: ৬০]
▪️ ৪. উত্তম চরিত্র:
আমরা আরও জানি, বিপদ-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সাথে সুন্দর ভাষায় ও হাসিমুখে কথা বলা, মানুষের সাথে ভালো আচরণ করা এবং তাদেরকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদেরকে খুশি রাখা ইত্যাদি সামাজিকভাবে যেমন প্রশংসনীয় বিষয় তেমনি ইসলামের দৃষ্টিতেও উত্তম চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। তার হাদিসে উত্তম চরিত্রের বিশাল ফজিলতের কথা উল্লেখিত হয়েছে। যেমন:
আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَيَّ، وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ القِيَامَةِ، أَحَاسِنَكُمْ أَخْلَاقًا
“তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন আমার কাছে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হবে সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র হবে উত্তম।” [তিরমিজি, হাদিস: ২০১৮ | সহিহ]
▪️ ৫. এটি নিঃসন্দেহে মহৎ হৃদয়ের অধিকারী, ধৈর্যশীল এবং পরোপকারী মানুষের চরিত্র। ইসলামে এগুলো প্রতিটি অত্যন্ত ফজিলত পূর্ণ বিষয়। তাই আমাদের সমাজের গৃহবধূরা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আন্তরিকভাবে তাদের স্বামী، সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যথাসাধ্য সেবা-শুশ্রূষা করে তাহলে তারা এর দ্বারা দুনিয়া অবারিত কল্যাণ এবং আখিরাতে পর্যাপ্ত সওয়াব অর্জন করতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ।আল্লাহু তৌফিক দানকারী।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

মৃতদের স্মরণে অগ্নি প্রজ্বলন বা মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বালানো জঘন্য হারাম এবং নিরেট অজ্ঞতা পূর্ণ কুসংস্কার

মৃতদের স্মরণে অগ্নি প্রজ্বলন বা মোমবাতি/প্রদীপ জ্বালানো জঘন্য হারাম এবং নিরেট অজ্ঞতা পূর্ণ কুসংস্কার: এর ৭ কারণ।
মানুষ অন্ধকারে আলো জ্বালাবে-এটা স্বাভাবিক। একসময় বিদ্যুৎ ছিল না। তখন মানুষ অন্ধকারে চেরাগ/কুপি, হারিকেন বা মোমবাতি জ্বালাত। প্রয়োজনে এখনো জ্বালাবে। তাতে কোনও সমস্যা নাই। তবে বর্তমানে আধুনিক যুগে বৈদ্যুতিক বাতির আলোর ঝলকানিতে বিশ্ব আলোকিত। কিন্তু এই উজ্জ্বল আলোর নিচে দাঁড়িয়ে কেউ যখন মৃত/শহিদদের স্মরণে বা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে কিংবা তাদের আত্মার শান্তির প্রত্যাশায় ঘটা করে মোমবাতি জ্বালাবে, মোমবাতির সামনে নীরবতা পালন করবে অথবা মোমবাতির সামনে মৃতদের ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তখন সুস্থ বিবেকের সামনে তার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। তৎসঙ্গে একজন মুসলিম হিসেবে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ তা কতটুকু সঠিক বা কতটুকু ইসলাম সমর্থিত তা বিচার-বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। নিম্নে ইসলাম ও যুক্তির নিরিখে মৃতদের স্মরণে অগ্নি প্রজ্বলন বা মোমবাতি/প্রদীপ জ্বালানো বিষয়টি ৭টি পয়েন্টে উপস্থাপন করা হলো:
❂ ১. ইসলামের দৃষ্টিতে মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে অগ্নি প্রজ্বলন বা মোমবাতি/প্রদীপ জ্বালানো বিদআত (ইসলামে নব সংযোজন বা ধর্মের নামে অধর্ম): প্রকৃতপক্ষে মানুষ মারা গেলে তার প্রতি জীবিতদের কী করণীয় সে ব্যাপারে ইসলামে বিস্তর দিকনির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু ইসলামে মৃতদের উদ্দেশ্য অগ্নি প্রজ্বলন, মোমবাতি/প্রদীপ জ্বালানো এবং তার সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন সম্পর্কে কোনও নির্দেশনা নেই। এবং ইসলামের সোনালী যুগ তথা সাহাবি ও তাবেয়ীদের যুগে মুসলিমদের মধ্যে এ ধরণের কাজের কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
অতএব ইসলামের দৃষ্টিতে তা জঘন্য বিদআত-তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর বিদআত মানেই ভ্রষ্টতা। আর প্রতিটি ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম।
❖ আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করল যে ব্যাপারে আমার নির্দেশনা নেই তা আল্লাহর কাছে পরিত্যাজ্য।” [বুখারী ও মুসলিম]
❖ অন্য বর্ণনায় এসেছে:
مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।” [বুখারী ও মুসলিম]
❖ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এক খুতবায় বলেছেন,
إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِي النَّارِ. رواه مسلم والنسائى واللفظ للنسائى.
‘‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআত হল ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম। [সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ১৫৩৫ ও সুনান আন-নাসায়ী, হাদিস নং ১৫৬০, হাদিসের শব্দ চয়ন নাসায়ী থেকে।]
❂ ২. অন্ধ অনুসরণ: মৃতদের স্মরণে মোমবাতি বা প্রদীপ প্রজ্বলন করা খৃ*ষ্টা*ন, অগ্নি*পূজক ইত্যাদি অমুসলিমদের সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ। কেননা খ্রি**স্টান ধর্মাবলম্বীরা তাদের কবরস্থানে মোমবাতি জ্বালিয়ে মৃতদের উদ্দেশ্যে বিশেষ প্রার্থনা করে থাকে। “অগ্নি উপাসকরা তাদের সকল পূজার সময় বা পূজার প্রারম্ভে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে কাজ শুরু করে এবং অগ্নিকে সর্বাধিক পবিত্র বলেই মেনে থাকে।” [অশোক চক্রবর্তী-মহাভারতের জানা অজানা FB page] আর ইসলামে অমুসলিমদের ‘সাদৃশ্য অবলম্বন’ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।
❖ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
“যে ব্যক্তি অন্য সম্প্রদায়ের (বিধর্মীদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও রীতি-নীতির ক্ষেত্রে) সাদৃশ্য অবলম্বন করে সে তাদেরই দলভুক্ত।“ [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪০৩১, সহীহুল জামে-আলবানী, হা/২৮৩১]
❖ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,
لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ دَخَلُوا فِي جُحْرِ ضَبٍّ لاَتَّبَعْتُمُوهُمْ ‏”‏ ‏.‏ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ آلْيَهُودَ وَالنَّصَارَى قَالَ ‏”‏ فَمَنْ
“তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের নীতি-পদ্ধতি পুরাপুরি ভাবে অনুসরণ করবে, বিঘতে বিঘতে ও হাতে হাতে, এমনকি তারা যদি দব (গুই সাপ সদৃশ মরুভূমিতে থাকা এক প্রকার হালাল প্রাণী)-এর গর্তে প্রবেশ করে থাকে তাহলেও তোমরা তাদের অনুসরণ করবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসুল, পূর্ববর্তী উম্মত বলতে কি ইহুদি ও খ্রিষ্টানরাই উদ্দেশ্য? তিনি বললেন, তাহলে আর কারা?” [সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪৯/ ইলম (জ্ঞান), পরিচ্ছেদ: ৩. ইহুদি ও খৃষ্টানদের রীতি-নীতি অনুসরণ] অথচ আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ বানরের মত অনুকরণপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা ভালো-মন্দ বাছ-বিচার ছাড়াই বিধর্মীদের অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হতে এতটুকু দ্বিধা করে না!
সত্য বলতে, বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিম ইসলামের মহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে অমুসলিমদের অন্ধ অনুসরণের ফলেই মুসলিম জাতি অধঃপতনের অতল তলে নিপতিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মুসলিমদেরকে এই অন্ধ অনুকরণের মোহ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
❂ ৩. অগ্নিপূজক/শিরক: মৃতদের উদ্দেশ্যে অগ্নি প্রজ্বলন, স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্য শিখা অনির্বাণ স্তম্ভ, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে ভাষণ প্রদান করেছিলেন সে স্থানে নির্মিত শিখা চিরন্তন স্তম্ভ ইত্যাদি অগ্নিপূজার শামিল। আগুনকে অনির্বাণ (যা কখনো নিভে না) বা চিরন্তন বিশ্বাস করা যেমন একদিক থেকে শিরক তেমনি তার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা ও সেখানে নীরবতা পালন করা এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক স্যালুটের মাধ্যমে সম্মান জানানো ইত্যাদি কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে শিরক। এরূপ কাজ যারা করে তাদেরকে বলা হয় মাজুস বা অগ্নিপূজক। তওবা না করে মৃত্যুবরণ করলে তারা স্থায়ীভাবে জাহান্নামী হবে। কেননা আল্লাহ শিরক কারীকে ক্ষমা করবেন না।
❖ আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ তার সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করেন না। কিন্তু এর নিম্ন পর্যায়ের পাপরাশী ক্ষমা করেন যাকে ইচ্ছা। যে আল্লাহর সাথে শিরক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়।” [সূরা নিসা: ৪৮]
❖ তিনি আরও বলেন,
وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ
“এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে শিরক করল সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অতঃপর (মৃতভোজী) পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।” [সূরা হাজ্জ: ৩১]
❂ ৪. অনর্থক কাজ: এই মোমবাতি প্রজ্বলনে মৃতদের বিন্দুমাত্র উপকার হয় না। সুতরাং নিতান্ত অনর্থক ও অহেতুক কাজ।
❖ আল্লাহ তাআলা সফল মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ
“যারা অনর্থক কার্যক্রম থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে।” [সূরা মুমিনুন: ৩]
❖ আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا
“এবং যারা ভ্রান্ত কর্মে যোগদান করে না এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয়, তখন সেখান থেকে সসম্মানে প্রস্থান করে।” [সূরা ফুরকান: ৭২]
❖ আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مِنْ حُسْنِ إسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ
“অনর্থক বিষয় ত্যাগ করাই একজন ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য।” [তিরমিযী: ২৩১৮, ইবনে মাজাহ: ৩৯৭৬-হাদিসটি হাসান। মৃত মানুষের উদ্দেশ্য বাতি জ্বালানো মূর্খতা সুলভ অহেতুক মিথ্যা আবেগ ছাড়া কিছু নয়।
❂ ৫. অর্থ অপচয়: মৃতদের উদ্দেশ্যে অগ্নি প্রজ্বলন করা, মোমবাতি/প্রদীপ জ্বালানো অর্থ অপচয়ের শামিল। আমাদের সমাজে বিভিন্ন উপলক্ষে নিহতদের স্মরণে বা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনার্থে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মোমবাতি প্রজ্বলন করা হয়। যেমন: খবরে প্রকাশ, নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে ‘একুশের আলো’ সংগঠনের উদ্যোগে ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রজ্বলন করা হয় এক লাখ মোমবাতি! [২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭] এই অনর্থক কাজে তা অর্থ অপচয় ও আল্লাহ নিয়ামতের অপব্যবহার ছাড়া কিছু নয়। কারণ এতে না জীবিত মানুষের কোনও উপকার হয়, না মৃতদের উপকার হয়। আর ইসলামের দৃষ্টিতে অনর্থক কাজে অর্থ অপচয় করা নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ।
❖ আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
“তোমরা খাও এবং পান করো তবে অপচয় করো না। তিনি অপচয় কারীদের ভালোবাসেন না।” [সূরা আরাফ: ৩১]
❖ তিনি আরও বলেন,
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ
“নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” [সূরা বনী ইসরাইল: ২৭]
আমাদের ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় যে, মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন মানুষের অর্থ-সম্পদ তথা তার যাবতীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব নিবেন।
অথচ এই অর্থ যদি সেই নিহতের পরিবারের জন্য খরচ করা হতো তাহলে তারা কতই না উপকৃত হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, দরিদ্রের ঘরে বাতি জ্বলে না কিন্তু বৈদ্যুতিক লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে মূর্খরা প্রদীপ জ্বালায়!
❂ ৬. কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস: মৃতদের উদ্দেশ্যে মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বালালে তাদের আত্মা শান্তি পাবে-এমনটা মনে করা নিতান্তই ভ্রান্ত অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কার। অন্ধ বিশ্বাস থেকেই তারা জন্মদিনে মোমবাতি নিভিয়ে দেয়। আর বিশ্বাস করে, মোমবাতি নিভানোর পর হালকা একটা ধোঁয়া উপরের দিকে উড়ে যায়। সেই ধোঁয়ার সাথে জন্মদিনের করা সব ইচ্ছেগুলো ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যায়। ফলে তিনি সে সব প্রার্থনা পূর্ণ করবেন। অথবা এ বিশ্বাস করা হয় যে, ধোঁয়ার অদৃশ্য হওয়ার সাথে সাথে, জীবনের সমস্ত নেতিবাচক বিষয়গুলো অদৃশ্য হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বালানো বা নিভানোর সাথে মানুষের জীবনের কল্যাণ-অকল্যাণ বা আত্মার সুখ-শান্তির বা কারও প্রতি শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধার ন্যূনতম কোনও সম্পর্ক নেই। থাকতে পারে না। সুতরাং মোমবাতি জ্বালালে মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তি পাবে-এহেন ভ্রান্ত কথা কোনও সুস্থ বিবেক গ্রহণ করতে পারে না। তথাকথিত মুক্তমনা ও বিজ্ঞান মনস্করা এমন অবৈজ্ঞানিক ও অন্ধবিশ্বাসকে কীভাবে গ্রহণ করে তা সত্যি বিস্ময়কর। অথচ তারাই কথায় কথায় ইসলামের বিধিবিধানকে নানাভাবে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদি বলে কটূক্তি করে থাকে। এসব শিক্ষিত মূর্খদেরকে আল্লাহ দ্বীনের প্রকৃত জ্ঞান দান করুন। আমিন।
❂ ৭. মনোবাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে মোমবাতি জ্বালানো হারাম/শিরক: মনোবাসনা পূরণের জন্য মাজারে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে মোমবাতি জ্বালানো হারাম। কখনো তা এটা শিরক পর্যায়ের অপরাধ। কেননা সব মনোবাসনা পূরণ করার ক্ষমতা রাখেন কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। মৃত ব্যক্তি কখনো কিছু দিতে পারেন না। মৃতের কাছে কিছু চাওয়া মানে আল্লাহর সাথে বড় শিরক। আর শিরক হলো, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ও ক্ষমাহীন অপরাধ। মহান আল্লাহ আমাদের দ্বীনের প্রকৃত জ্ঞান দান করুন। ভ্রষ্টতা, মূর্খতা, অন্ধ অনুকরণ এবং মিথ্যা আবেগ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব। 

Translate