Saturday, July 19, 2025

মুহাররম মাসে প্রচলিত কিছু কুসংস্কার ও বিদআত যা পরিত্যাগ করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অপরিহার্য

 সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ্‌র জন্য। আমাদের নবী, সর্বশেষ নবী, রাসূলদের সর্দার মুহাম্মদ ﷺ এর প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবায়ে কেরাম সকলের প্রতি আল্লাহ্‌র রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা বিশ্লেষণ করেছি যে, আশুরা উপলক্ষে আমাদের একমাত্র করণীয় ও শরঈ নির্দেশিত আমল হল—নবী মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর প্রতি আল্লাহর করুণা ও সাহায্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ সিয়াম পালন করা। এটি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ, এবং তা হল মুহাররম মাসের ৯ ও ১০ তারিখে সিয়াম পালন করা। যদি শারঈ কোন কারনে ৯ তারিখে রোযা রাখা সম্ভব না হয়, তবে ১০ ও ১১ তারিখে সিয়াম রাখা যায়। একান্তই সম্ভব না হলে কমপক্ষে ১০ তারিখে এককভাবে সিয়াম রাখা যাবে। এ ছাড়া দলিল বিহীন আশুরাকে কেন্দ্র করে এমন কোনো আমল, আচার কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানের অনুমোদন শরীয়তে নেই। কেউ করলে এসব নিজে থেকে উদ্ভাবিত আমল দ্বীনের মধ্যে নতুন সংযোজন হিসেবে গণ্য হবে এবং তা স্পষ্ট বিদআত হিসেবে বিবেচিত হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, মুহাররম মাসকে কেন্দ্র করে—বিশেষত আশুরার দিন—মুসলিম বিশ্বের বহু অঞ্চলে কিছু কুসংস্কার, বিদআত, শিরকী কর্মকাণ্ড ও গোমরাহির চর্চা লক্ষ্য করা যায়, যা মূলত শী‘আ সম্প্রদায়ের উদ্ভাবিত অপসংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত। এগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য, হারাম ও স্পষ্ট ভ্রষ্টতা। আমাদের উচিত এসব থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা এবং সহিহ সুন্নাহ অনুসরণের মাধ্যমে প্রকৃত দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা।

.
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল :আশুরা দিবস উদযাপন কিংবা আশুরার মাতম করার বিধান কি?
উত্তরে তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ. لَمْ يَرِدْ فِي شَيْءٍ مِنْ ذَلِكَ حَدِيثٌ صَحِيحٌ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَلا عَنْ أَصْحَابِهِ، وَلا اسْتَحَبَّ ذَلِكَ أَحَدٌ مِنْ أَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ لا الأَئِمَّةِ الأَرْبَعَةِ، وَلا غَيْرِهِمْ. وَلا رَوَى أَهْلُ الْكُتُبِ الْمُعْتَمَدَةِ فِي ذَلِكَ شَيْئًا، لا عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَلا الصَّحَابَةِ، وَلا التَّابِعِينَ، لا صَحِيحًا وَلا ضَعِيفًا، لا فِي كُتُبِ الصَّحِيحِ، وَلا فِي السُّنَنِ، وَلا الْمَسَانِيدِ، وَلا يُعْرَفُ شَيْءٌ مِنْ هَذِهِ الأَحَادِيثِ عَلَى عَهْدِ الْقُرُونِ الْفَاضِلَةِ.وَلَكِنْ رَوَى بَعْضُ الْمُتَأَخِّرِينَ فِي ذَلِكَ أَحَادِيثَ مِثْلَ مَا رَوَوْا أَنَّ مَنْ اكْتَحَلَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ لَمْ يَرْمَدْ مِنْ ذَلِكَ الْعَامِ، وَمَنْ اغْتَسَلَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ لَمْ يَمْرَضْ ذَلِكَ الْعَامِ، وَأَمْثَالِ ذَلِكَ.وَرَوَوْا فَضَائِلَ فِي صَلاةِ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، وَرَوَوْا أَنَّ فِي يَوْمِ عَاشُورَاءَ تَوْبَةَ آدَمَ، وَاسْتِوَاءَ السَّفِينَةِ عَلَى الْجُودِيِّ، وَرَدَّ يُوسُفَ عَلَى يَعْقُوبَ، وَإِنْجَاءَ إبْرَاهِيمَ مِنْ النَّارِ، وَفِدَاءَ الذَّبِيحِ بِالْكَبْشِ وَنَحْوَ ذَلِكَ “সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কিংবা তাঁর সাহাবীবর্গ থেকে কোন সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়নি। মুসলিম ইমামদের কেউ, কিংবা চার ইমামের কেউ কিংবা অন্য কোন আলেম এসব কাজকে মুস্তাহাব বলেননি। বর্ণনা নির্ভর গ্রন্থগুলোতে এ ব্যাপারে কিছু নেই; না আছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে; না তাঁর সাহাবীবর্গ থেকে, না তাবেয়ীগণ থেকে; না আছে সহিহ কোন রেওয়ায়েত; না আছে দুর্বল কোন বর্ণনা। না আছে সহিহ কোন হাদিস গ্রন্থে; না আছে সুনান শ্রেণীর গ্রন্থগুলোতে; না আছে মুসনাদ শ্রেণীর গ্রন্থগুলোতে; উত্তম প্রজন্মগুলো থেকে এ সংক্রান্ত কোন হাদিস জানা যায় না। তবে, পরবর্তীতে কিছু ব্যক্তি এ বিষয়ে কিছু হাদিস বর্ণনা করেছেন। যেমন- যে ব্যক্তি আশুরার দিন সুরমা লাগাবে সে ব্যক্তি ঐ বছর চক্ষুপ্রদাহে আক্রান্ত হবে না। যে ব্যক্তি আশুরার দিন গোসল করবে সে ব্যক্তি ঐ বছর আর অসুস্থ হবে না। এ ধরনের আরও অনেক হাদিস। আশুরার দিন নামায পড়ার অনেক ফজিলতও তারা বর্ণনা করেছেন। তারা বর্ণনা করেছেন যে, এই দিন আদম (আঃ) তওবা করেছেন; এই দিন নূহ (আঃ) এর কিস্তি জুদি পর্বতে নঙ্গর করেছে; এদিন ইউসুফ (আঃ) ইয়াকুব (আঃ) এর কাছে ফিরে এসেছেন; এই দিন ইব্রাহিম (আঃ) কে আগুন থেকে মুক্ত করা হয়েছে; এই দিন ইসমাইল (আঃ) এর বদলে বকরী জবাই করা হয়েছে ইত্যাদি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে একটি বানোয়াট হাদিস তারা বর্ণনা করেন: যে ব্যক্তি এ আশুরার দিন তাঁর (নবীর) পরিবারের কারো সচ্ছলতা এনে দিবে আল্লাহ সারা বছর তাকে সচ্ছল রাখবেন।(ইবনে তাইমিয়ার কথা থেকে সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত; বিস্তারিত জানতে দেখুন; আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা, খণ্ড-৫)
.
আশুরাকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে যে সকল অপসংস্কৃতি চালু আছে তার কিছু নমুনা দেওয়া হল:
.
প্রথমত: (১).কিছু সমাজে এ মাসকে শোক, মাতম, দুশ্চিন্তা ও দুঃখের মাস বলা হয়। (২).নারীরা সৌন্দর্যচর্চা থেকে বিরত থাকে। (৩).এ মাসে জন্মগ্রহণকারী সন্তানকে দুর্ভাগা মনে করা হয়। (৪). এ মাসের প্রথম দিন থেকে বাড়ি পরিস্কার করা হয় এবং বানেয়াট নতুন নতুন ইবাদত করা হয়। (৫). কারবালার কারণে আশুরার মর্যাদা মনে করা হয়। (৬). শাহাদতে হুসাইনের শোক পালনের উদ্দেশ্যে সিয়াম পালন করা।(৭).চোখে সুরমা লাগানো। (৮).১০ই মুহাররমে বিশেষ ফযীলতের আশায় বিশেষ পদ্ধতিতে সালাত আদায় করা। (৯).হুসাইনের নামে ভুয়া কবর বানিয়ে তা‘যিয়া বা শোক মিছিল বের করা। (১০).ওই কবরে হুসাইনের রূহ আসে বলে বিশ্বাস করা,সালাম করা,সেখানে মাথা নত করা,সিজদা করা এবং তাঁর কাছে কিছু চাওয়া। (১১).মিথ্যা শোক প্রদর্শন করে বুক চাপড়ানো,বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা। (১২).হায় হোসেন! হায় হোসেন! বলে মাতম করা। (১৩).রক্তের নামে লাল রঙ ছিটানো। (১৪).লাঠি, তীর, বল্লম নিয়ে যুদ্ধের মহড়া দেয়া। (১৫).হুসাইনের নামে কেক বানিয়ে বরকতের কেক বলে চালানো। (১৬).হুসাইনের নামে মোরগ ছেড়ে দিয়ে বরকতের মোরগ বলে চালানো। (১৭).কালো ব্যাজ ধারণ করা। (১৮) এ মাসে বিবাহ-শাদী করা অন্যায় মনে করা। (১৯) এ দিনে পানি পান ও শিশুদের দুধ পান অন্যায় মনে করা। (২০).উগ্র শী‘আরা ‘ইমাম বাড়া’তে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর নামে বকরি বেঁধে লাঠিপেটা করে আনন্দ করা। (২১).আয়েশা (রাঃ) সহ আরো বড় বড় সাহাবীদের গালি দেয়া। (২২).অনেক সেমিনারে আশুরাকে মাককনে কারবালা মনে করা ও হুসাইনকে ‘মা‘ছূম’ এবং ইয়াযীদকে ‘মাল‘ঊন’ প্রমাণ করা, যা সত্য থেকে বহু দূরে। (২৩).বুকে ব্লেড মেরে রক্ত বের করা। (২৪).এ দিনে কবর জিয়ারত করা ইত্যাদি। উল্লেখ্য, ভুয়া কবর জিয়ারত করা শিরক, শোক করা, শোক মিছিল করা ইসলামে হারাম এবং সাহাবীদের গালি দেওয়া কাবীরা গুনাহ।
..
দ্বিতীয়ত: আশুরা সম্পর্কিত কতিপয় বিভ্রান্তি: ১০ই মুহাররমের ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। যেমন বলা হয়ে থাকে:
.
(১). এ দিনে আসমান-যমীন সৃষ্টির কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। (২).এ দিনে আল্লাহ রব হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। (৩). এ দিনে আরশ, কুরসী এবং লাওহে মাহফুয সৃষ্টি হয়। (৪).এ দিনে আদম (আঃ) কে সৃষ্টি ও পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয় এবং এ দিনে হাওয়ার সাথে মিলন হয়। (৫).নূহ (আঃ)-এর সময় প্লাবন হয় এবং নূহ (আঃ) এ দিনে মুক্তি পান। (৬).এ দিনে আল্লাহ তা’য়ালা ঈসা (আঃ) কে ঊর্দ্ধাকাশে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। (৭).এ দিনে আইয়ূব (আঃ) দুরারোগ্য ব্যাধি হতে মুক্ত ও সুস্থতা লাভ করেছিলেন। (৮).এ দিনে মূসা (আঃ) তাওরাত লাভের জন্য তূর পাহাড়ে যান। (৯).এ দিনে ইবরাহীম (আঃ) নমরুদের আগুন থেকে মুক্তি লাভ করেন। (১০).এ দিনে ইয়াকুব (আঃ) দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান ও ইউসুফ (আঃ)-এর সাথে মিলিত হন। (১১).এ দিনে সুলাইমান (আঃ) রাজত্ব ফিরে পান। (১২).এ দিনে ইদরীস (আঃ) কে আকাশে তুলে নেয়া হয়। (১৩) এ দিনে ইউনুস (আঃ) মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করেন। (১৪).এ দিনে আসিয়া মূসাকে লালনের ভার গ্রহণ করেন। (১৫).এ দিনে দাঊদ (আঃ)-এর তওবা কবুল হয়েছিল। (১৬).এ দিনে কাবাঘর নির্মাণ হয়েছিল। (১৭).এ দিনে জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি হয়েছিল। (১৮) এ দিনে দাঊদ (আঃ) জালূতকে হত্যা করেন। (১৯).এ দিনে ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। ইত্যাদি আরও কত কিছু প্রচলিত রয়েছে যা কুরআন ও সহীহ হাদীস ভিত্তিক তথ্য নয়।(বিস্তারিত জানতে আশুরায়ে মহারম সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মিনহাজুস সুন্নাহ বইটি পড়ুন)
.
তৃতীয়ত: আশুরা সম্পর্কে কিছু জাল হাদীস:
.
(১). আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, [দীর্ঘ জাল হাদীস] নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলদের প্রতি বছরে একটি সিয়াম ফরয করেছিলেন সেটি হ’ল আশুরার দিন। ইহা মুহাররমের দশ তারিখ।এ দিনে তোমরা সিয়াম রাখ এবং পরিবারের জন্য খানাপিনায় পর্যাপ্ততা ঘটাও; কারণ যে এ দিনে নিজের পরিবার-পরিজনের প্রতি খাদ্যে প্রশস্ত করবে আল্লাহ তা‘আলা তার সারা বছরে প্রাচুর্যতা দান করবেন। এটি এমন দিন যে দিনে আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-এর তওবা কবুল করে তাকে শফিউল্লাহ বানিয়েছেন,এ দিনে ইদ্রিস (আঃ) কে উঁচু স্থানে উঠিয়েছেন, নূহ (আঃ) কে কিশতী হতে বের করেন, ইবরাহীম (আঃ) কে নমরুদের আগুন থেকে নিস্কৃতি দেন, মূসা (আঃ) এর প্রতি এ দিনে তাওরাত নাজিল করেন, ইউসুফ (আঃ) কে জেলখানা হতে বের করেন, এ দিনে ইয়াকুব (আঃ)-এর চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে দেন, এ দিনে আইয়ূব (আঃ)-এর বিপদ দূর করেন, ইউনুস (আঃ) কে মাছের পেট থেকে বের করেন, এ দিনে বনী ইসরাঈলদের জন্য সাগরকে দ্বিখন্ডিত করেন, এ দিনে দাঊদ (আঃ) কে মাফ করেন এবং সুলাইমান (আঃ) কে বাদশাহী দান করেন, এ দিনেই রাসূল (ﷺ)-এর আগের-পরের সমস্ত পাপ ক্ষমা করেন। ইহাই প্রথম দিন যে দিনে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন,এ আশুরার দিনে আসমান থেকে সর্বপ্রথম বৃষ্টি নাজিল হয়,আশুরার দিনে সর্বপ্রথম রহমত নাজিল হয়। অতএব,যে আশুরার দিন সিয়াম রাখবে সে যেন সারা বছর সিয়াম রাখল। আর ইহা হ’ল সমস্ত নবীদের সিয়াম।যে আশুরার রাত্রি ইবাদতের মাধ্যমে জাগবে সে যেন সাত আসমানবাসীর ন্যায় ইবাদত করল। আর যে এ রাতে চার রাকাত সালাত আদায় করবে,যার প্রতি রাকাতে সূরা ফাতেহা একবার ও সূরা ইখলাস একান্নবার তার পঞ্চাশ বছরের পাপসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। যে আশুরার দিনে কাউকে পানি পান করাবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে রোজ ক্বিয়ামতের দিন এমন পানি পান করাবেন যার পরে তার কখনো পিপাসা লাগবে না এবং সে যেন এক চোখের পলকও আল্লাহর নাফরমানি করেনি বলে বিবেচিত হবে। যে এ দিনে দান-খায়রাত করবে সে যেন কখনো কোন ভিক্ষুককে ফেরত দেয়নি। আর যে এ দিনে গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করবে সে মৃত্যু ছাড়া এ বছরে আর কোন রোগে আক্রান্ত হবে না। যে এ দিনে ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলাবে সে যেন বনী আদমের সমস্ত ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলাবে। আর যে আশুরার দিনে কোন রোগী পরিদর্শন করল,সে যেন সকল বনী আদমের রোগীদের পরিদর্শন করল। এ দিনেই আল্লাহ তা‘আলা আরশ,লাওহে মাহফূয ও কলম সৃষ্টি করেছেন। এ দিনেই আল্লাহ তা‘আলা জিবরীল (আঃ) কে সৃষ্টি করেছেন,ঈসা (আঃ) কে আসমানে উঠিয়েছেন এবং এ দিনেই ক্বিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে’।(বিস্তারিত দেখুন; ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ২২০-৩০০)।
(২). নূহ (আঃ) এর কিশতী ছয় মাস চলার পর আশুরার দিন জূদী পাহাড়ে পৌঁছে। সেদিন নূহ (আঃ) ও তাঁর সাথে যারা ছিল এবং জীবজন্তু আল্লাহর শুকরিয়ার জন্য সিয়াম রাখে”(সিলসিলা যঈফাহ)।
(৩).আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণিত, مَنِ اكتحلَ يومَ عاشوراءَ بالإثمدِ لمْ ترمدْ عيناهُ أبدًا “যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে ইছমিদ নামক পাথরের সুরমা ব্যবহার করবে, সে কখনও ঝাপসা দেখবে না’।(বায়হাক্বী,শু‘আবুল ঈমান হা/৩৭৯৭; হাদীসটি জাল।ইমাম ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) তালখীছু কিতাবিল মাওযূ‘আত খণ্ড:২ পৃষ্ঠা:২০৩;মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী রাহিমাহুল্লাহ হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন। আসরারুল মারফু‘আত হা/৩২০)।
(৪).যে আরাফাতের দিন সিয়াম রাখবে তার জন্য দুই বছরের গুনাহ মাফের কাফফারা হবে। আর যে মুহাররম মাসের একদিন সিয়াম রাখবে তার জন্য প্রতি দিনের ত্রিশ দিনে সওয়াব মিলবে”(ইমাম ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) তালখীছু কিতাবিল মাওযূ‘আত, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১০৯, তানজিহুশ শারী‘আহ, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৫০ ও সিয়ামু ইয়াওমে আশূরা পৃষ্ঠা: ১৬৮-১৭১)।
(৫). কল্যাণকর কাজ হ’ল: ঈদুল আযহা, ঈদুল ফিতর, শবেবরাত ও আশুরার রাত্রি জাগা।(মীযানুল ই‘তিদাল-ইবনে হাজার: খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৯৪, ৪৬৪)
.
চতুর্থত: আশুরা সম্পর্কিত জয়ীফ ও মিথ্যা হাদিসের বর্ণনা:
(১).আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বলেছেন,যে ব্যক্তি আশুরার দিন নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য উদার হস্তে খরচ করবে আল্লাহ তা‘আলা সারা বছর উদারহস্তে তাকে দান করবেন। সুফিয়ান সাওরী বলেন,আমরা এর পরীক্ষা করেছি এবং কথার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি’।(বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩৭৯৫; মিশকাত হা/১৯২৬; হাদীসটি যঈফ বিস্তারিত দেখুন য‘ঈফ আল জামি‘ আস্ সগীর হা/৫৮৭৩)।
(২).যে ব্যক্তি আশুরার দিন গোসল করবে সে এই বছর রোগাক্রান্ত হবে না। আর যে ব্যক্তি আশুরার দিন চোখে সুরমা লাগাবে তার এই বছর চোখের কোন রোগ হবে না। (ইমাম বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটিকে জাল বলেছেন।(বিন বায;মাজমূ‘উল ফাতাওয়া;খণ্ড;২৬;পৃষ্ঠা; ২৪৯,শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”আমাদের কোন আলেম আশুরার দিন গোসল করাকে পছন্দ করতেন না এবং চোখেও সুরমা লাগাতেন না।…আর রাসূল (ﷺ) ও এরূপ করেননি। এরূপ করেননি আবু বকর, ওমর, উসমান ও আলী (রাঃ)।(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫১৩-৫১৪)।
(৩).আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত-আশুরা হল তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের ঈদের দিন। সুতরাং তোমরা এই দিন সিয়াম পালন কর’।(সুয়ূতী, জামেউস সগীর হা/৫৩৪৭; বায্যার হা/৯৮১৩; দায়লামী, আল-ফেরদৌস হা/৮৯৮৯;ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন:সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৮৫১; যঈফুল জামে‘ হা/৩৬৭০। হায়সামী হাদীসটি কে যঈফ বলেছেন মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৮৮)।
(৪).আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত,‘যে আশুরার দিন সিয়াম পালন করবে আল্লাহ তার জন্য সত্তর বছরের সিয়াম ও ক্বিয়ামের নেকী লিখে দিবেন। যে আশুরার দিন সিয়াম পালন করবে তার জন্য দশ হাযার ফেরেশতার সমান সওয়াব দেওয়া হবে। আর যে আশুরার দিন সিয়াম পালন করবে তাকে হজ্জ ও ওমরার সওয়াব দেওয়া হবে”।(ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) এটাকে জাল বলেছেন; ইমাম ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) তালখীছু কিতাবিল মাওযূ‘আত খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৫৭০; ইমাম বায়হাক্বী এটাকে মুনকার বলেছেন; ফাযায়েলুল আওক্বাত পৃষ্ঠা: ১০৫; ইমাম যাহাবী এটাকে মিথ্যা হাদীস বলেছেন; মীযানুল ই‘তিদাল: ১/৪৫১)।
(৫).আশুরার দিন সিয়াম রাখ এবং এক দিন আগে ও এক দিন পরে সিয়াম রেখে ইহুদীদের বিপরীত কর”।(হাদিসটি জয়ীফ; দেখুন যঈফুল জামে হা/৩৫০৬)।
(৬).আশুরার দিন সিয়াম রাখ;কারণ এ দিনে সমস্ত নবী ছিয়াম রেখেছেন”।(সনদ জয়ীফ; যঈফুল জামে‘হা/৩৫০৭)।
(৭).আশূরা হলো নবম দিন”।(সনদ জয়ীফ যঈফুল জামে’-আলবানী হা/৩৫৭১)।
(৮).আশূরার দিনে যে পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খানাপিনার ব্যবস্থা করবে তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা সারা বছরে স্বচ্ছলতা দান করবেন।”সনদ জয়ীফ যঈফুল জামে হা/৫৮৭৩)।
(৯).তোমাদের কেউ এ দিনে সিয়াম রেখেছ? তাঁরা (সাহাবাগণ) বললেন: না, তিনি বললেন: তোমাদের দিনের বাকি সময় সিয়াম পূর্ণ কর এবং কাযা করবে। অর্থাৎ আশুরার দিন এভাবে বর্ণনা মুনকার।”(সিলসিলা যঈফাহ হা/৫২০১)।
(১০).নবী (ﷺ) এ দিনের গুরুত্ব দিতেন এবং তাঁর ও ফাতেমার দুগ্ধপোষ্যদের ডেকে তাদের মুখে তাঁর থুথু মোবারক দিয়ে দিতেন। আর তাদের মাতাদেরকে রাত্রি পর্যন্ত তাদের দুধ না পান করানোর জন্য নির্দেশ করতেন’ হাদীসটি যঈফ।(ইবনু খুযায়মা হা/২০৮৯)।
(১১).যদি তুমি রমাযানের পর কোন পুরো মাস সিয়াম রাখতে চাও, তাহ’লে মুহাররম মাসের রাখ; কারণ ইহা আল্লাহর মাস, যাতে আল্লাহ তা‘আলা এক জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।(সনদ যঈফ; সুনানে তিরমিযী হা/১২০)
.
পঞ্চমত: মুহার্রাম মাসের কিছু বানোয়াট সালাত:
.
(১).মুহাররম মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে এবং আশুরার দিবসে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের কোনো প্রকার নির্দেশনা বা উৎসাহ কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ক সকল কথাই বানোয়াট। আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো পুস্তকে মুহাররম মাসের ১ম তারিখে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করে বিশেষ দোয়া পাঠের বিশেষ ফযীলতের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।(মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃষ্ঠা: ১১-১২) অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল,নেক কানুন,পৃষ্ঠা;২৯৮)
(২).আশুরার দিনে বা রাতে বিশেষ বানোয়াট সালাত: আশুরার সিয়ামের উৎসাহ দেয়া হলেও, হাদীসে আশুরার দিনে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের বিধান দেওয়া হয় নি। তবে জালিয়াতগণ অনেক কথা বানিয়েছে। যেমন যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে …অথবা আশুরার রাত্রিতে এত রাকআত সালাত অমুক অমুক সূরা এতবার পাঠ করে আদায় করবে … সে এত পুরস্কার লাভ করবে। সরলপ্রাণ মুসলিমদের মন জয় করার জন্য জালিয়াতগণ এ সকল কথা বানিয়েছে, যা অনেক সময় সরলপ্রাণ আলিম ও বুযুর্গকেও ধোঁকা দিয়েছে।(ইবনুল জাওযী, মাওদূ‘আত; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪৫-৪৬; সুয়ূতী লাআলী ২/৫৪; ইবন আর্রাক, তানযীহ ২/৮৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৭৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯০, ১১০-১১১) এছাড়াও ওয়ায-মাহফিলে, জুম‘আর খুৎবায় বিভিন্ন আলোচকের মুখে আশুরাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনা শোনা যায়। যার সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক, কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা—ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাত মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে গভীর ব্যথা ও বেদনার স্মারক হয়ে আছে। এ শোকগাথা প্রতিটি মুমিন হৃদয়কে আলোড়িত করে। তবে আমাদের উচিত, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত আবেগ ও বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকা এবং সহিহ আকীদা ও সুন্নাহর আলোকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করা।আশুরা উপলক্ষে আমাদের করণীয় হল: নবী মূসা (আঃ)-এর মুক্তির ঘটনার স্মরণে ৯ ও ১০ মুহাররম তারিখে রোজা রাখা, যেমনটি রাসূল (ﷺ) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। একইসাথে এ দিনকে কেন্দ্র করে সমাজে প্রচলিত শিরক, বিদ‘আত, ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মনগড়া রসম-রেওয়াজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকা জরুরি। এ ছাড়া আমাদের উচিত নিজেদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা ও নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রেও খাঁটি ইসলামী নীতিমালার অনুসরণ নিশ্চিত করা। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমাদের কথা, কলম ও সংগঠনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।আল্লাহ আমাদেরকে সহিহ বুঝ দান করুন এবং আমল করার তাওফীক দিন—আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

No comments:

Post a Comment

Translate