Saturday, July 19, 2025

শিয়াদের উৎপত্তি কখন এবং কিভাবে হয়েছিল

 পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি। অতঃপর আরবি (الشيعة) শী‘আ শব্দের অর্থ অনুসারী, গোষ্ঠী, সাহায্যকারী ইত্যাদি। কুরআনেও এই শব্দটি অনুগামী অর্থে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন: وَ اِنَّ مِنۡ شِیۡعَتِهٖ لَاِبۡرٰهِیۡمَ”আর ইবরাহীম তো তার অনুগামীদের অন্তর্ভুক্ত।”(সূরা আস-সাফফাত, ৩৭: ৮৩) এখানে “শিয়া” মানে ‘নূহ (আঃ)-এর অনুগামী’ দল বা মতের অনুসারী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ইবনু মানযুর (রাহিমাহুল্লাহ) শিয়াদের পরিচয় দিয়ে গিয়ে বলেন: “যারা কোনো মত বা আদর্শে একত্রিত হয়, তারা একে অপরের শিয়া বা অনুসারী গোষ্ঠী।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্বেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন যে, তাঁর উম্মতের মধ্যে বহু ভ্রান্ত দল জন্ম নেবে। এই বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর একটি হলো ‘শীআ’ যারা স্বয়ং নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিবারকে কেন্দ্র করেও গোমরাহিতে লিপ্ত হয়েছে এবং তাদের বিষয়ে বাড়াবাড়ি ও বিকৃতি সৃষ্টি করেছে। প্রখ্যাত সাহাবী উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর মৃত্যুর পর ইহু-দীদের ষড়যন্ত্রের ফসল হিসাবে আলী এবং মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর মাঝে সংঘটিত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে শী‘আ সম্প্রদায়ের জন্ম হয়। মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কায় আপোস করার জন্য যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানায়। ফলে মীমাংসার জন্য আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষে আবু মূসা আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আর মু‘আবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষে আমর ইবনুল আস (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে শালিস নিযুক্ত করা হয়। এতে একশ্রেণীর লোক আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষ ত্যাগ করে। তারা ইতিহাসে ‘খারেজী’ বলে পরিচিত। আরেক শ্রেণী এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে। কিন্তু তারা নিষ্ক্রিয় থাকে। তাদেরকেই ‘শী‘আ বলা হয়।(বিস্তারিত জানতে দেখুন আত-তারীখুল ইসলামী, পৃষ্ঠা: ২৭৪-২৭৭) পরবর্তীতে শী‘আ ফিতনার বিকাশ হয়েছে ইসলাম ও মুসলিমের শত্রু ইহুদী আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা ও তার অনুসারী যুরারা, আবূ বাসীর, আব্দুল্লাহ ইবনু ই‘য়াফুর, আবূ মিখনাফ লূত ইবনু ইয়াহইয়া প্রমুখ মিথ্যাবাদীদের দ্বারা।

.
আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ছিলেন এক ইহু-দি যার ইসলাম গ্রহণ ছিল মুনাফেকি ও ষড়যন্ত্রের ঢাল। সে চরমপন্থী মুনাফিক হয়েও মুসলিম হওয়ার ভান করেছিলেন। সে মূলত ইয়েমেনের বাসিন্দা ছিলেন এবং হিজাজ, তারপর বাসরা ও কুফায় তাঁর ফিতনা (বিশৃঙ্খলা) ছড়াতে ভ্রমণ করেছিলেন। সে ‘উসমান ইবনে ‘আফফান (আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হোন)-এর খিলাফতের সময় দামেস্কে গিয়েছিলেন এবং সেখানকার লোকেরা তাকে বহিষ্কার করে, এরপর সে মিশরে যায় এবং প্রকাশ্যে তাঁর বিদ‘আত (নতুনত্ব) প্রচার করতে শুরু করে। প্রাচীন ও আধুনিক উভয় যুগের আলিমগণ তাঁর ষড়যন্ত্র, মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি-প্রচেষ্টা এবং তাঁর অনুসারীদের কার্যক্রম বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।ইবনু সাবাʾ ছিল তথাকথিত “সাবাই্যায়া” নামে কুখ্যাত একটি ভ্রান্ত ফির্কার নেতা। এই ফিরকার লোকেরা আলি (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-কে ঈশ্বরস্বরূপ মনে করত।(নাঊযু বিল্লাহ) ইবনু সাবাʾই সর্বপ্রথম খিলাফতে আলি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর জন্য আল্লাহ-প্রদত্ত “নস” (সরাসরি নিযুক্তির দাবী), তাঁর ‘ঈসমাহ্ (পাপ-অপরাধ থেকে পূর্ণ পবিত্রতা) এবং কিয়ামতের পূর্বে তাঁর প্রত্যাবর্তন (রাজ‘আত)-এর আকীদা ছড়িয়ে দেয়। তিনিই প্রথম সাহাবায় কিরাম ও পূর্ববর্তী খলিফাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সমালোচনা শুরু করেন। তাঁর এই বিকৃত মতবাদই পরে রাফেযি চিন্তাধারার ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “وأول من ابتدع القول بالعصمة لعلي وبالنص عليه في الخلافة : هو رأس هؤلاء المنافقين عبد الله بن سبأ ، الذي كان يهوديا فأظهر الإسلام وأراد إفساد دين الإسلام كما أفسد بولص دين النصارى “যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম আলি (রাঃ)-এর জন্য নস (সরাসরি নির্দিষ্টকরণ) ও ঈসমাহ’ (নিষ্পাপতা)-এর ভিত্তি স্থাপন করে, সে ছিল এই মুনাফিকদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা’। সে একজন ইহু-দি ছিল, অতঃপর ইসলাম গ্রহণের ভান করে এবং ইসলাম ধর্মকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালায় যেমন খ্রিস্টানদের ধর্ম বিকৃত করেছিল ‘পল’ (Paul)।”(ইবনু তাইমিয়া; মাজমু‘উল ফাতাওয়া: খণ্ড; ৪: পৃষ্ঠা: ৫১৮) এ বিষয়ে সুন্নি ও শিয়া উভয় লেখকের সাম্প্রদায়িকতা, ইতিহাস ও জীবনী নিয়ে লেখা বইগুলিতে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন;আবু আল-হাসান আল-আশ‘আরীর মাকালাত আল-ইসলামিয়ীন; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩২); আশ-শাহরাস্তানির আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৭৪); তারিখ আত-তাবারি; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৪০; শিয়া আল-কুম্মীর আল-মাকালাত ওয়াল-ফিরাক; পৃষ্ঠা: ২০; আত-নওবাখতির ফিরাক আশ-শিয়া পৃষ্ঠা: ২২)।
.
শিয়াদের উৎপত্তি সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:
ففي خلافة أبي بكر وعمر وعثمان لم يكن أحد يسمى من الشيعة، ولا تضاف الشيعة إلى أحد، لا عثمان ولا علي ولا غيرهما، فلما قتل عثمان تفرق المسلمون، فمال قوم إلى عثمان، ومال قوم إلى علي، واقتتلت الطائفتان، وقتل حينئذ شيعة عثمان شيعة علي…وكانت الشيعة أصحاب علي يقدمون عليه أبا بكر وعمر، وإنما كان النزاع في تقدمه على عثمان.ولم يكن حينئذ يسمى أحد لا إماميا ولا رافضيا، وإنما سموا رافضة، وصاروا رافضة، لما خرج زيد بن علي بن الحسين بالكوفة في خلافة هشام، فسألته الشيعة عن أبي بكر وعمر، فترحم عليهما، فرفضه قوم، فقال: رفضتموني رفضتموني فسموا رافضة، وتولاه قوم فسموا زيدية لانتسابهم إليه. ومن حينئذ انقسمت الشيعة إلى رافضة إمامية وزيدية، وكلما زادوا في البدعة زادوا في الشر…”
“আবু বকর, উমর ও উসমান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর খেলাফতের সময়ে কাউকে ‘শিয়া’ বলা হতো না। ‘শিয়া’ শব্দটি কারও সাথেই (না উসমান, না আলি, আর না অন্য কাউকে) সম্পৃক্ত করে বলা হতো না। কিন্তু যখন উসমান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) শহীদ হন, তখন মুসলিমরা বিভক্ত হয়ে পড়ে একদল উসমানের প্রতি ঝুঁকে পড়ে, আরেকদল আলির প্রতি ঝুঁকে পড়ে। অতঃপর উভয় দল একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করে। সে সময় উসমানপন্থী শিয়ারা আলীপন্থী শিয়াদের হত্যা করে। আলি (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর অনুসারী শিয়ারা তাঁকে আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর উপর অগ্রাধিকার দিত না; বরং তাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল কেবল উসমান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর অগ্রাধিকারের ব্যাপারে। সে সময় কাউকে ইমামিয়া’ বা ‘রাফেযী’ বলে ডাকা হতো না। ‘রাফেযী’ নামটি প্রথম চালু হয় তখন, যখন যায়েদ ইবনু আলী ইবনুল হুসাইন (রাহিমাহুল্লাহ) খলিফা হিশামের আমলে কুফায় বিদ্রোহ করেন। সে সময় শিয়ারা তাঁকে আবু বকর ও উমরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। তিনি তাঁদের জন্য দো‘আ করেন (তাদের প্রতি দয়া প্রার্থনা করেন)। তখন একদল তাকে প্রত্যাখ্যান করে। তিনি বললেন, “তোমরা তো আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে! তোমরাই তো ‘রাফেযী’ (বর্জনকারী)।আর যাঁরা তাঁকে সমর্থন করলেন, তাঁদের বলা হলো ‘যায়েদিয়া’ কারণ তাঁরা “যায়েদিয়া”(যায়দের অনুসারী ছিলেন)। তখন থেকেই শিয়ারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় রাফেযী ইমামিয়া ও যায়েদিয়া। এবং তারা যতই বিদআতের প্রতি অগ্রসর হলো, ততই তারা অকল্যাণ ও বিপথগামিতিতে অগ্রসর হতে থাকল…(ইবনু তাইমিয়্যাহ মিনহাজুস সুন্নাহ খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৯৪-৯৫)
.
ইমাম ইবনু হাজম আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃত:৪৫৬ হি.) বলেন:
ومات رسول الله صلى الله عليه وسلم والمسلمون كذلك ليس بينهم اختلاف في شيء أصلا، بل كلهم أمة واحدة، ودين واحد، ومقالة واحدة، ثم ولي أبو بكر رضي الله عنه سنتين وستة أشهر، فغزا فارس والروم وفتح اليمامة… ثم مات رضي الله عنه والمسلمون كما كانوا لا اختلاف بينهم في شيء أصلا، أمة واحدة، ومقالة واحدة…ثم مات أبو بكر وولي عمر رضي الله عنهما، ففتحت بلاد الفرس طولا وعرضا، وفتحت الشام كلها، والجزيرة، ومصر كلها… ثم ولي عثمان رضي الله عنه، فزادت الفتوح، واتسع الأمر… وبقي كذلك اثني عشر عاما حتى مات، وبموته حصل الاختلاف، وابتداء أمر الروافض ”
“রাসূলুল্লাহ ﷺ ইন্তিকাল করেন, মুসলিমরা তখন একই জাতি, একই দ্বীন এবং একই আক্বীদার ওপর ঐক্যবদ্ধ ছিলেন; কোনো মতভেদ ছিল না। এরপর আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) খেলাফত গ্রহণ করেন এবং দুই বছর ছয় মাস শাসন করেন। তিনি পারস্য ও রোমের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন, ইয়ামামা বিজয় করেন…এরপর তিনি ইন্তিকাল করেন, আর মুসলিমরা তখনও পূর্বের মতোই মতভেদহীন এক ও অখণ্ড ছিলেন এরপর আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ইন্তিকাল করলে উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) খেলাফত গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনামলে পারস্যের বিস্তৃত অঞ্চলসমূহ বিজিত হয়, সমগ্র শাম, জাযীরাহ এবং মিসর জয় করা হয়…এরপর উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) খেলাফত গ্রহণ করেন, আর বিজয় আরও বিস্তৃত হয়, ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে…তিনি বারো বছর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন অবশেষে তিনি শাহাদত বরণ করেন। আর তাঁর শাহাদতের পরেই মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং রাফেযী সম্প্রদায়ের (শিয়া চরমপন্থার) আবির্ভাব ঘটে।”(ইবন হাযম; আল-ফাসল ফি মিলাল ওয়া আহওয়া’ঈ ওয়ান নিহাল, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২১৩-২১৬)
.
সুতরাং ইতিহাস, দলিল ও গবেষণার আলোকে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ‘আব্দুল্লাহ ইবন সাবা’ ছিল এক ইহু-দি ষড়যন্ত্রকারী, যার মাধ্যমে রাফেযী মতবাদের বীজ রোপিত হয়। সে ইসলামের ভিতর থেকে ভাঙনের সূচনা করে। এই বিষয়ে প্রাচীন সুন্নি-শিয়া উভয় মতের গ্রন্থেই তার অস্তিত্ব, কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রের প্রমাণ বিদ্যমান।যারা তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, তারা মূলত প্রমাণিত সত্যকে অস্বীকার করার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছেন, যা তাদের মতাদর্শিক পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ। অথচ ইতিহাস স্বয়ং সাক্ষ্য দেয় যে, আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা শুধু একটি ব্যক্তি নয়, বরং এক গভীর ষড়যন্ত্রের সূচনা যার প্রভাব আজও বিদ্যমান। শী‘আরা বহু দলে বিভক্ত। আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী।
▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

No comments:

Post a Comment

Translate