Thursday, July 25, 2024

মুসলিম সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ব্যাপারে কঠিন হুশিয়ারি এবং এ সংক্রান্ত কুরআনের আয়াত ও হাদিস

মুসলিম সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ, হানাহানি, হত্যাকাণ্ড, রক্তপাত, পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ব্যাপারে কঠিন হুশিয়ারি (এ সংক্রান্ত ২০টি কুরআনের আয়াত ও হাদিস)।

ভূমিকা: ইসলাম, মানবতা ও নৈতিকতার কোনও স্তরেই নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ও অহেতুক রক্তপাত সমর্থনযোগ্য নয়। মানবসমাজে কোনও রকম অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, উগ্রতা, বর্বরতা, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড কোনও বিবেকবান ও ধর্মপ্রাণ মানুষের কাম্য নয়। প্রাক-ইসলামি যুগে আরব সমাজে যখন ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির প্রচলন ছিল তখন পেশিশক্তির জোরে খুনখারাবি, হত্যাকাণ্ড, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, ঘুষ-দুর্নীতি সবকিছুই অবাধে চলত। ইসলামের আবির্ভাবে সব রকম হত্যা, রক্তপাত, অরাজকতা, সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে শরিয়ত সম্মত ইসলামি জি-হাদ হলে ভিন্ন কথা। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন বিধিবিধান রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক মতপার্থক্য, ধর্মীয় বিষয়ে দ্বিমত, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয়ে শত্রুতা, টাকাপয়সা লেনদেনকে কেন্দ্র করে ঝগড়াঝাঁটি, অর্থের বিনিময়ে মানুষ খুন বা সামান্য বিষয়ে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে রক্ত প্রবাহিত করা বা হত্যা করা নিঃসন্দেহে ইসলামি ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী যেমন মারাত্মক অপরাধ (কেসাস তথা হত্যার বিনিময়ে হত্যা, অঙ্গহানির বিনিময়ে অঙ্গহানি) তেমনি আখিরাতে খুনির পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।

নিম্নে ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা, রক্তপাত, মুসলিমদের পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ ও মারামারি-কাটাকাটিতে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে কতিপয় কুরআনের আয়াত ও হাদিস তুলে ধরা হল। যেন আমরা সতর্ক হই। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।

◈ ১. নিরপরাধ ইমানদারকে হত্যাকারীর ব্যাপারে আল্লাহর কঠিন হুমকি:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

«وَمَنْ يَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيْهَا وَغَضِبَ اللهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيْمًا»

“আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায়-জেনেবুঝে কোন ইমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করবে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে এবং আল্লাহ তাআলা তার প্রতি ক্রুদ্ধ হবেন ও তাকে অভিসম্পাত দিবেন। আর তিনি তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি।” [সূরা নিসা: ৯৩]

“সেখানে সে চিরকাল থাকবে” এ কথার অর্থ: এটাই তার উপযুক্ত পাওনা যদি আল্লাহ শাস্তি দেন। তবে তার মধ্যে যদি শিরক না থাকে তাহলে হয়ত আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন অথবা জাহান্নামে শাস্তি দেওয়ার পর সেখান থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অথবা এর অর্থ হলো, কেউ যদি এই হত্যাকে জায়েজ মনে করে তাহলে তার জন্য শাস্তি হলো, চিরস্থায়ী জাহান্নাম। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহর হারাম কৃত বিধানকে হালাল মনে করবে সে মুসলিম থাকে না; কাফের হয়ে যায়। আর কাফেরের শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম।

◈ ২. নিরপরাধ একজন মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করার শামিল:
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

مَن قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا

“যে ব্যক্তি প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ (মানুষ হত্যার শাস্তির বিনিময়ে কিসাস হিসেবে হত্যা) অথবা জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার অপরাধ ছাড়া কোনও মানুষকে হত্যা করল সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল এবং যে কারও জীবন রক্ষা করল সে যেন সব মানুষের জীবন রক্ষা করল।” [সূরা মায়িদা: ৩২]

◈ ৩. দু দল দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সন্ধি করার নির্দেশ। কোনও একপক্ষ সন্ধি প্রত্যাখ্যান করে অপর পক্ষের উপর বাড়াবাড়ি করলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ۖ فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ ۚ فَإِن فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا ۖ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ ‎

“যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দিবে এবং ইনসাফ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসফ কারীদেরকে পছন্দ করেন।” [সূরা হুজুরাত: ৯]

◈ ৪. আল্লাহর নিকট সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হওয়া নিরপরাধ এমন মুসলিমকে হত্যা করার চেয়ে সহজ:

আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لَزَوَالُ الدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللهِ مِنْ قَتْلِ رَجُلٍ مُسْلِمٍ

“আল্লাহ তাআলার নিকট একজন মুসলিমকে হত্যা করার চেয়ে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া অধিকতর সহজ।” [সুনানে নাসায়ী, অধ্যায়: ৩৮/ হত্যাকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে, পরিচ্ছেদ: ২. রক্তের মর্যাদা]

◈ ৫. একজন ইমানদার খুন হওয়া সারা পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার চেয়ে গুরুতর:

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَقَتْلُ مُؤْمِنٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ زَوَالِ الدُّنْيَا

“ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, কোন মুসলিমকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা আল্লাহর কাছে পৃথিবী ধ্বংস হওয়া অপেক্ষাও গুরুতর।” [সুনানে নাসায়ী, অধ্যায়: ৩৮/ হত্যাকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে, পরিচ্ছেদ: ২. রক্তের মর্যাদা]

◈ ৬. সারা পৃথিবীর মানুষ যদি একজন ইমানদার ব্যক্তিকে খুন করে তাহলে আল্লাহ তাদের সকলকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন:

আবু সাইদ ও আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তারা বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لَوْ أَنَّ أَهْلَ السَّمَاءِ وَأَهْلَ الْأَرْضِ اشْتَرَكُوْا فِيْ دَمِ مُؤْمِنٍ لَأَكَبَّهُمُ اللهُ فِيْ النَّارِ

“যদি আসমান-জমিনের সবাই মিলে একজন ইমানদার ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করে তবে আল্লাহ তাদের সকলকে মুখের ভরে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” [সুনানে তিরমিজি, অধ্যায়: ১৪/ দিয়ত বা রক্তপণ, পরিচ্ছেদ: ৮. খুনের বিচার-সহিহ]

◈ ৭. দু জন মানুষ পরস্পরকে হত্যার জন্য উদগ্রীব থাকলে হত্যাকারী ও নিহত উভয়ই জাহান্নামি:

আবু বাকরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إِذَا الْتَقَى الْـمُسْلِمَانِ بِسَيْفَيْهِمَا فَالْقَاتِلُ وَالْـمَقْتُوْلُ فِيْ النَّارِ، قِيْلَ: يَا رَسُوْلَ الله! هَذَا الْقَاتِلُ، فَمَا بَالُ الْـمَقْتُوْلِ؟ قَالَ: إِنَّهُ كَانَ حَرِيْصًا عَلَى قَتْلِ صَاحِبِهِ.

“যখন দু জন মুসলিম তরবারি (অস্ত্র) নিয়ে মুখোমুখি লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হয় তখন ঘাতক এবং নিহত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামি। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলা হল: হে আল্লাহর রসুল, হত্যাকারীর ব্যাপারটি তো বুঝলাম। তবে নিহত ব্যক্তির দোষ কী যার কারণে সে জাহান্নামে যাবে? রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কারণ সেও তো অপরপক্ষকে হত্যা করার জন্য উদগ্রীব ছিল” [বুখারী, হা/৩১, ৬৮৭৫, ৭০৮৩ ও মুসলিম, হা/২৮৮৮]

◈ ৮. কিয়ামের কোর্টে সর্বপ্রথম বিচার কার্য পরিচালিত হবে মানুষ খুনের ব্যাপারে:

আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

أَوَّلُ مَا يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيْ الدِّمَاءِ

“কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম বিচার-ফয়সালা করা হবে রক্তের।” [বুখারী ৬৫৩৩, ৬৮৬৪; মুসলিম, হা/ ১৬৭৮]

◈ ৯. মুসলিমদের রক্ত,অর্থ- সম্পদ ও মান-মর্যাদা অত্যন্ত মর্যাদার পাত্র:
তিনি আরও বলেন,

« كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ : دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ »

“প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির রক্ত (জীবন), ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান অপর সব মুসলিমের জন্য হারাম (বা সম্মানযোগ্য)।” [মুসলিম, হাদিস নং ৬৭০৬]

◈ ১০. মানুষ খুন দ্বীনের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনকে সংকীর্ণ করে তোলার নামান্তর:

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন,

لَنْ يَزَالَ الْمُؤْمِنُ فِي فُسْحَةٍ مِنْ دِينِهِ مَا لَمْ يُصِبْ دَمًا حَرَامًا

“একজন প্রকৃত মুমিন তার দ্বীনের ব্যাপারে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, যে পর্যন্ত সে অন্যায়ভাবে হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত না হয়।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৮৭/ রক্তপণ, পরিচ্ছেদ: ৮৭/১. আল্লাহর বাণী: “কেউ ইচ্ছা পূর্বক কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার শাস্তি হল জাহান্নাম।” (সূরা নিসা: ৯৩)]

এ হাদিসের অর্থ হলো, একজন মুসলিম জীবনে নানা ভুলত্রুটি ও পাপাচার করে। তারপরও সে দ্বীনের বিষয়ে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকে অর্থাৎ তার সামনে মুক্তির আশা বিদ্যমান থাকে। সে তখনো কল্যোণের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু যখন সে মানুষ হত্যা করার মত অপরাধ করে ফেলে তখন সে নিজেকে ভয়াবহ সংকীর্ণতায় ফেলে দেয়। অর্থাৎ সে অন্যায়ভাবে রক্তপাতের মাধ্যমে দুনিয়ায় দণ্ডনীয় অপরাধী, আল্লাহর ক্রোধ ও লানতের শিকার হয় এবং মানুষের হক বিনষ্ট করার কারণে আখিরাতে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ হেফাজত করুন। আমিন।।

◈ ১১. কোনও ইমানদারকে হত্যা করা ক্ষমাহীন অপরাধ:

আবুদ দারদা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি,

كُلُّ ذَنْبٍ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَغْفِرَهُ، إِلَّا مَنْ مَاتَ مُشْرِكًا، أَوْ مُؤْمِنٌ قَتَلَ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا

“আশা করা যায়, আল্লাহ সব গুনাহই ক্ষমা করবেন কিন্তু মুশরিক অবস্থায় কেউ মারা গেলে অথবা কোনও ইমানদার ব্যক্তি অপর কোনও ইমানদারকে ইচ্ছাকৃত ভাবে হত্যা করলে (তাকে ক্ষমা করবেন না)।” [সুনান আবু দাউদ (তাহকিককৃত), অধ্যায়: ৩০/ ফিতনা-ফ্যাসাদ, পরিচ্ছেদ: ৬. ইমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ]

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞ আলেমগণ বলেছেন, জুমহুর বা সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মতে, “কোনও ইমানদার ব্যক্তি অপর কোনও ইমানদারকে ইচ্ছাকৃত ভাবে হত্যা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না” বলার মাধ্যমে অন্যায়ভাবে হত্যা করার ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য আয়াত ও হাদিসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, শিরক ছাড়া অন্যান্য গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন যাকে ইচ্ছা। [দেখুন: সূরা নিসা এর ৪৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা]। যেহেতু হত্যাকাণ্ড বড় গুনাহ হলেও তা শিরক নয়। সুতরাং সে যদি তওবা করে তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন বলে আশা করা যায়। এখানে বনি ইসরাইলের এক খুনি কর্তৃক খৃষ্টান পাদ্রিকে হত্যার মাধ্যমে ১০০ খুন পূর্ণ করার পর তওবা করা সংক্রান্ত হাদিসটিও প্রযোজ্য।

◈ ১২. ইমানদারকে হত্যা করে আনন্দ লাভ করলে তার ফরজ ও নফল ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হবে না:

তিনি আরও বলেন,

مَنْ قَتَلَ مُؤْمِنًا فَاعْتَبَطَ بِقَتْلِهِ، لَمْ يَقْبَلِ اللَّهُ مِنْهُ صَرْفًا، وَلَا عَدْلًا

“যে ব্যক্তি কোনও ইমানদারকে হত্যা করে এতে উল্লসিত হল, আল্লাহ তার কোনও ফরজ বা নফল কোনও ইবাদত কবুল করবেন না।” [সুনান আবু দাউদ (তাহকিককৃত), অধ্যায়: ৩০/ ফিতনা-ফ্যাসাদ, পরিচ্ছেদ: ৬. ইমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ]

◈ ১৩. মানুষ হত্যা দ্বীনের পথে গতিময় জীবনকে স্তদ্ধ করে দেয়:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,

لَا يَزَالُ الْمُؤْمِنُ مُعْنِقًا صَالِحًا، مَا لَمْ يُصِبْ دَمًا حَرَامًا، فَإِذَا أَصَابَ دَمًا حَرَامًا بَلَّحَ

“একজন ইমানদার ব্যক্তি সততার সাথে দ্বীনের পথে দ্রুত বেগে চলতে থাকে যতক্ষণ না সে অন্যায়ভাবে কারো রক্ত ঝরায়। যখন সে অন্যায়ভাবে রক্ত ঝরাবে তখন দুর্বল ও ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে তার চলার গতি স্তব্ধ হয়ে যাবে।” [সুনান আবু দাউদ (তাহকিককৃত), অধ্যায়: ৩০/ ফিতনা-ফ্যাসাদ, পরিচ্ছেদ: ৬. ইমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ]

◈ ১৪. মানুষ হত্যা অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক অপরাধ:

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ قِيلَ يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ وَالسِّحْرُ وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِى حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ وَأَكْلُ الرِّبَا وَالتَّوَلِّى يَوْمَ الزَّحْفِ وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْغَافِلاَتِ الْمُؤْمِنَاتِ

“তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কার্যাবলী হতে দূরে থাক। বলা হল: হে আল্লাহর রসূল, সেগুলো কী কী? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শিরক করা, জাদু করা, ন্যায় সঙ্গত অধিকার ছাড়া আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা করা হারাম করেছেন তা হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিম শিশুর অর্থ লোপাট করা, যুদ্ধের দিন (জিহাদের ময়দান) থেকে পলায়ন করা এবং সতী-সাধ্বী ও সুচরিত্রা ইমানদার নারীর চরিত্রে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া।” [বুখারী, হা/২৭৬৬, ৬৮৫৭ ও মুসলিম, হা/২৭২]

◈ ১৫. মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণকারী মুসলিমদের দলভুক্ত নয়:

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

مَنْ حَمَلَ عَلَيْنَا السِّلاَحَ فَلَيْسَ مِنَّا

“যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” [সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী), অধ্যায়: ১। ইমান, পরিচ্ছেদ: ৪২. নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উক্তি: “যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”]

◈ ১৬. মুসলিম ব্যক্তির প্রতি অস্ত্র উঁচিয়ে ইশারা করা লানত যোগ্য অপরাধ:

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“‏ مَنْ أَشَارَ عَلَى أَخِيهِ بِحَدِيدَةٍ لَعَنَتْهُ الْمَلاَئِكَةُ ‏”

“যে ব্যক্তি তার ভাইকে লোহা (অস্ত্র) দ্বারা ইঙ্গিত করে ফেরেশতাগণ তার উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করেন।” [সুনানে তিরমিজি (তাহকীককৃত), অধ্যায়: ৩১/ ফিতনা-ফ্যাসাদ, পরিচ্ছেদ: ৪. কোন ব্যক্তির অস্ত্র দ্বারা মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ইশারা করা-সহিহ]

◈ ১৭. ইসলামি আইনে কাউকে ভয় দেখানোও নিষিদ্ধ:

ইসলামে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা তো বহু দূরের কথা, একজন নিরাপদে থাকা মানুষকে ভয় দেখানোও হারাম যদিও তা মজার ছলে হয়। যেমন: হাদিসে এসেছে,

আব্দুর রহমান ইবনে আবু লায়লা রহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার কাছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন সাহাবি বর্ণনা করেছেন যে,

أنَّهم كانوا يسيرون مع النَّبيِّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم فنام رجلٌ منهم فانطلق بعضُهم إلى حبلٍ معه فأخذه ففزِع فقال رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم لا يحِلُّ لمسلمٍ أن يُروِّعَ مسلمًا

“তারা এক সফরে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। তাদের থেকে এক ব্যক্তি ঘুমিয়ে গেলে, অপর একব্যক্তি রশি নিয়ে তার কাছে যায়, যা ধরার কারণে সে (সাপ মনে করে) ভয় পায়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কোন মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমকে ভয় দেখানো বৈধ নয়।” [সুনানে আবু দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৩৬/ আদব বা শিষ্টাচার, পরিচ্ছেদ: ৯০. ঠাট্টার ছলে কোন জিনিস নেওয়া সম্পর্কে-সহিহ]

◈ ১৮. তিনটি অপরাধ ছাড়া মানুষ হত্যা বৈধ নয়:

উসমান বিন আফফান রা. হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لاَ يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ إِلاَّ بِإِحْدَى ثَلاَثٍ زِنًا بَعْدَ إِحْصَانٍ أَوِ ارْتِدَادٍ بَعْدَ إِسْلاَمٍ أَوْ قَتْلِ نَفْسٍ بِغَيْرِ حَقٍّ فَقُتِلَ بِهِ

“এই তিন কারণে একটি ছাড়া মুসলিম ব্যক্তির খুন হালাল নয়: বিবাহিত করার পর পরনারীর সাথে জিনায় লিপ্ত হওয়া, ইসলাম গ্রহণের পর মুরতাদ হওয়া (ইসলাম ত্যাগ করা) এবং অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করার পর (কেসাস বা ইসলামি ফৌজদারি দণ্ড মোতাবেক) তাকেও হত্যা করা।” [বুখারি ও মুসলিম। সুনান আত তিরমিজি (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৩৬/ ফিতনা, পরিচ্ছেদ: তিনটি কারণের কোন একটি ছাড়া মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করা বৈধ নয়।]

◈ ১৯. ইসলামি ফৌজদারি আইনে অন্যায়ভাবে হত্যাকারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

ا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى ۖ الْحُرُّ بِالْحُرِّ وَالْعَبْدُ بِالْعَبْدِ وَالْأُنثَىٰ بِالْأُنثَىٰ ۚ فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ ۗ ذَٰلِكَ تَخْفِيفٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَرَحْمَةٌ ۗ فَمَنِ اعْتَدَىٰ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“হে ইমানদারগণ, তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কেসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তির বদলায়, দাস দাসের বদলায় এবং নারী নারীর বদলায়। অতঃপর তার ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কাউকে কিছুটা মাফ করে দেয়া হয়, তবে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং ভালভাবে তাকে তা প্রদান করতে হবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে সহজ এবং বিশেষ অনুগ্রহ। এরপরও যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করে, তার জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আজাব।” সূরা বাকারা: ১৭৮]

◈ ২০. ইসলামি ফৌজদারি আইনে অন্যায়ভাবে অঙ্গহানির শাস্তি অঙ্গহানি:

وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنفَ بِالْأَنفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ ۚ فَمَن تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَّهُ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ‎

“আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চোখের বিনিময়ে চোখ, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং জখম সমূহের বিনিময়ে সমান জখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গুনাহ থেকে পবিত্র হয়ে যায়। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করে না তারাই জালেম।” [সূরা মায়িদা: ৪৫]

আল্লাহ আমাদেরকে মুসলিম সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ, হানাহানি-রক্তপাত ও সব ধরণের বিশঙ্খলা সৃষ্টি হতে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার। সৌদি আরব। 

আশুরা উপলক্ষে মাতম, তাজিয়া মিছিল এবং শরীরে আঘাত করা ইত্যাদির বিধান

 প্রশ্ন: শিয়া সম্প্রদায় যে প্রতি বছর ১০ মুহররমে মাতম করে, তাজিয়া মিছিল করে, নিজেদের শরীরে আঘাত করে-এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। এ কাজগুলো কি শরিয়ত সম্মত?

উত্তর: ৬১ হিজরির মুহররম মাসের দশ তারিখে হুসাইন বিন আলী রা. রাজনৈতিক কারণে ফিতনায় পতিত হয়ে ইরাকের কারবালার প্রান্তরে তৎকালীন মুসলিম জাহানের শাসনকর্তা ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া এর সেনাবাহিনীর হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তার প্রতি সমবেদনার বর্হি:প্রকাশ হিসেবে শিয়া সম্প্রদায় প্রতি বছর ১০ম মুহররমে নিজেদের শরীরকে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে, মাথা মুণ্ডন করে, রাস্তায় রাস্তায় ‘হায় হুসাইন..হায় হুসাইন’ বলে কান্নাকাটি ও মাতম করে, কালো ব্যাচ ধারণ করে, তাজিয়া মিছিল বের করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো সব, বিদআত, জাহেলিয়াত পূর্ণ ও হারাম কাজ। নিম্নোক্ত আলোচনা থেকে তা প্রমাণিত হবে ইনশাআল্লাহ।

♻ মৃত্যুশোকে কান্নাকাটি করা, মাতম করা, শরীরে আঘাত করা ইত্যাদির বিধান কি?

মানুষ মারা গেলে নীরবে চোখের পানি ফেলা অথবা নিচু আওয়াজে ক্রন্দন করা বৈধ। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছেলে ইবরাহীম যখন মারা যায় তিনি তাকে কোলে নিয়ে ছিলেন। আর তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

تَدْمَعُ الْعَيْنُ وَيَحْزَنُ الْقَلْبُ وَلاَ نَقُولُ إِلاَّ مَا يَرْضَى رَبُّنَا وَاللَّهِ يَا إِبْرَاهِيمُ إِنَّا بِكَ لَمَحْزُونُونَ

“চক্ষু অশ্রু সজল হয়,অন্তর ব্যথিত হয়। তবে আমরা কেবল সে কথাই বলব যা আমাদের প্রভুকে সন্তুষ্ট করে। আল্লাহর কসম,হে ইবরাহীম,তোমার বিচ্ছেদে আমরা ব্যথিত।” [সহীহ বুখারি: অনুচ্ছেদ: সে আমাদের লোক নয় যে, গালে চপেটাঘাত করে। হাদিস নং ১২৯৭, মাকতাবা শামেলা]

তবে চিৎকার করে কান্নাকাটি করা, মাটিতে গড়াগড়ি করা, শরীরে আঘাত করা, চুল ছেড়া, কাপড় ছেড়া ইত্যাদি হারাম।

এ সম্পর্কে নিন্মোক্ত হাদিস সমূহ দেখুন:

▪ সহীহ বুখারিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,

لَيْسَ مِنّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ، وَشَقَّ الْجُيُوبَ، وَدَعا بِدَعْوى الْجاهِلِيَّةِ

“যে ব্যক্তি গালে চপেটাঘাত করে, পকেট ছিঁড়ে এবং জাহেলিয়াতের মত আহবান করে আমাদের দলভুক্ত নয়।” [মাজমু ফাতাওয়া শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ২৫/৩০২, ৩০৭]

▪ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

أَنا بَرِيءٌ مِمَّنْ بَرئَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَرِئَ مِنَ الصَّالِقَةِ وَالْحالِقَةِ وَالشَّاقَّةِ

“যে মহিলা (বিপদ-মুসিবতে) চিৎকার করে, মাথা মুণ্ডন করে, কাপড় ছিঁড়ে তার থেকে আমি সম্পর্ক মুক্ত।” [সহীহ মুসলিম]

▪ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,

النَّائِحَةُ إذا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِها، تُقامُ يَومَ القِيامَةِ وعليها سِرْبالٌ مِن قَطِرانٍ، ودِرْعٌ مِن جَرَبٍ

“বিলাপকারীনী মহিলা যদি তওবা করার আগে মৃত্যু বরণ করে তবে সে কিয়ামতের দিন আলকাতরা মাখানো পায়জামা আর ঘা বিশিষ্ট বর্ম পরিহিত অবস্থায় উঠবে।” [সহীহ মুসলিম, জানাইয অধ্যায়]

▪ সহীহ বুখারিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,

ما مِن عبدٍ تُصيبُه مُصيبةٌ، فيقولُ: إنَّا لله وإنَّا إليه راجعونَ، اللهُمَّ أْجُرْني في مُصِيبتِي، وأَخْلِفْ لي خيرًا منها، إلَّا أَجَرَه اللهُ في مُصِيبته، وأَخْلَفَ له خيرًا منها

“যে আল্লাহর বান্দা বিপদে আপতিত হলে বলে: ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন, “আল্লা-হুম্মা আজিরনী ফী মুসীবাতী ওয়াখলুফ লী খাইরান মিনহা।”

অর্থ: “নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য নিবেদিত এবং তার কাছেই ফিরে যাব। হে আল্লাহ, বিপদে আমাকে প্রতিদান দাও এবং এর থেকে উত্তম বিকল্প দান কর।” তাকে আল্লাহ তার বিপদে উত্তম প্রতিদান দিবেন এবং তার চেয়ে ভালো বিকল্প ব্যবস্থা করবেন।” [সহীহ মুসলিম, কিতাবুল জানাইয]

▪ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

أَرْبَعٌ في أُمَّتي مِن أمْرِ الجاهِلِيَّةِ، لا يَتْرُكُونَهُنَّ: الفَخْرُ في الأحْسابِ، والطَّعْنُ في الأنْسابِ، والاسْتِسْقاءُ بالنُّجُومِ، والنِّياحَةُ

“আমার উম্মতের মধ্যে চারটি জিনিস জাহেলিয়াতের কাজ যেগুলো তারা ছাড়বে না। বংশ আভিজাত্য নিয়ে গর্ব করা, অন্যের বংশকে দোষারোপ করা, তারকার সাহায্যে বৃষ্টি প্রার্থনা করা এবং মানুষের মৃত্যুতে বিলাপ করা। [সহীহ মুসলিম, বিতাবুল জানাইয]
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শিয়া সম্প্রদায়ের অনিষ্ট থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার। সৌদি আরব।

আল্লাহ, রাসূল, কুরআন বা ইসলামের কোন বিধানকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ ও গালমন্দ করার বিধান ও শাস্তি এবং এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের করণীয়

 প্রশ্ন: কেউ যদি আমার আল্লাহ অথবা নবী অথবা কুরআনকে গালমন্দ করে ইসলামের দৃষ্টিতে তার বিধান কি এবং একজন সাধারণ মুসলিম হিসেবে তার প্রতি আমার কী করণীয়?

উত্তর: এ কথায় কোন সন্দেহ নাই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে গালাগালি করা, কুরআন, হাদিস, সালাত, হজ্জ, পর্দা ইত্যাদি ইসলামের বিধিবিধানকে উপহাস ও ঠাট্টা-মশকরা করা ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোন মুসলিম নামধারী অজ্ঞ ব্যক্তি যদি এমনটি করে তাহলে সে ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত কাফির-মুরতাদ বলে গণ্য হবে।

ইসলামের বিধিবিধান নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করার ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ أَبِاللَّـهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ – لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ ۚ
“আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহর সাথে, তার আয়াত (নিদর্শন ও বিধিবিধান) এর সাথে এবং তাঁর রসূলের সাথে হাসি-ঠাট্টা করছিলে? ওজর পেশ করো না, নিশ্চিতভাবে তোমরা যে কাফের হয়ে গেছো ঈমান আনার পর।” [সূরা তওবা: ৬৫-৬৬]

তিনি আরও বলেন,

وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

“আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি তার দীন (ইসলাম) থেকে ফিরে যায় আর সে অবিশ্বাসী অবস্থায় মারা যায়, তাহলে দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। এই লোকেরাই হল জাহান্নামের অধিবাসী। তারা চিরকাল সেখানে থাকবে।” (সূরা বাকারা: ২১৭)

❑ ইসলামি ফৌজদারি দণ্ডবিধি মোতাবেক ইসলাম ত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড যদি সে তওবা না করে:

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لا يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ إِلاَّ بإِحْدَى ثَلاثٍ: الثَّيِّبُ الزَّانِي، وَالنَّفْسُ بِالنَّفْسِ، وَالتَّاركُ لِدِينه المُفَارِقُ للجمَاعَةِ

“তিন কারণের কোনও একটি ব্যতীত কোন মুসলিমের রক্ত প্রবাহিত করা হালাল নয়:
ক. বিবাহিত জিনাকারী।
খ. হত্যার বিনিময়ে হত্যা।
গ. যে ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করে (মুসলিমদের) জামাআত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।” (সহীহ বুখারি, হাদিস ৬৮৭৮, জামে তিরমিযী, হাদিস ১৪০২, মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদিস ১৮৭০৪, বায়হাকী ৮:১৯৪ ইত্যাদি)
এছাড়াও এ মর্মে একাধিক হাদিস রয়েছে।

তাছাড়া মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে ইসলামি স্কলারদের মাঝে কোন দ্বিমত নাই আল হামদুলিল্লাহ।
ইবনে আব্দুল বার (মৃত্যু: ৪৬৩ হিজরি) লিখেছেন,
إن من ارتد عن دينه حل دمه، وضربت عنقه، والأمة مجتمعة على ذلك
“যে তার দীন (ইসলাম) ত্যাগ করে তাকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যাবে এবং তার শিরশ্ছেদ করা হবে। এ বিষয়ে পুরো উম্মতের মতৈক্য রয়েছে।” [আত তামহীদ ৫/৩০৬]

❑ এ ক্ষেত্রে একজন সাধারণ মুসলিমের জন্য করণীয় হল:

◆ ১) প্রথমত: তাকে নসিহত করা এবং সুন্দরভাবে বুঝানো যে, এসব কথাবার্তা ভ্রষ্টতা ও কুফরি। কেউ এসব কথা বললে মুরতাদ বা ইসলাম চ্যুত হিসেবে গণ্য হয়। ইসলামি আইনে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এতে তার অন্তরে পরিবর্তন আসতে পারে এবং ভুল পথ থেকে তওবা করে ইসলামের পথে ফিরে আসতে পারে যদি তার ভাগ্য ভালো হয়।

◆ ২) ইসলাম, আল্লাহ, রসূল, কুরআন ইত্যাদি সম্পর্কে তার সংশয় বা প্রশ্ন থাকলে উত্তর দেয়ার এবং তার সংশয় দূর করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। নিজে না পারলে আলেমদের সহায়তা নিতে হবে। পাশাপাশি তার হেদায়েতের জন্য আল্লাহর নিকট দুআও করতে হবে।
◆ ২) ক্ষমতা থাকলে তার অন্যায় কথাবার্তার প্রতিবাদ করতে হবে এবং বিভ্রান্তির যথোপযুক্ত জবাব দিতে হবে।
◆ ৩) সে যেখানে এ সব খারাপ কথা বলবে সেখানে বসে বসে তার কথা শুনবে না। বরং তার প্রতিবাদ করার পরও সে তার কথা অব্যাহত রাখলে স্থান ত্যাগ করতে হবে।
(দেখুন: সূরা আনআম: ৮৬)
◆ ৪) তারপর আদালতে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে। যদি ইসলামি আদালত হয় তাহলে তাকে প্রথমত: সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে অপরাধ প্রমাণিত হলে তওবা করার মাধ্যমে সংশোধন করার চেষ্টা চালাবে। কিন্তু সে তওবা করতে অস্বীকৃতি জানালে শরিয়ার নির্দেশনা মোতাবেক তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে।

আর ইসলামি আদালত না হলে দেশীয় আইনে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ বা ‘কোন ধর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা’র আইনে তার বিরুদ্ধে সাজা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

❑ মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগী) বা আল্লাহর-রাসূল, কুরআন ইত্যাদিকে গালমন্দকারীকে হত্যা করার দায়িত্ব কার?

ইসলামের সব ধরণের হুদুদ কায়েম বা ফৌজদারি দণ্ডবিধি (যথা: মৃত্যুদণ্ড, বেত্রাঘাত, জেল, জরিমানা বা অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ) বাস্তবায়ন করার একমাত্র অধিকারী সরকার বা তার স্থলাভিষিক্ত; সাধারণ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়।
ইবনে রুশদ (Averroes) কুরতুবি [জন্ম: ১১২৬, মৃত্যু: ১১৯৮ খৃ] বলেন:
وأما من يقيم هذا الحد – أي : جلد شارب الخمر – فاتفقوا على أن الإمام يقيمه وكذلك الأمر في سائر الحدود
“আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, এই হদ (তথা মদ পানকারীর উপর চাবুক মারার বিধান) বাস্তবায়ন করবে ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান)। সকল হুদুদ (দণ্ড প্রয়োগ) এর ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।” (বিদায়াতুল মুজতাহিদ ২/২৩৩)
তবে কেবল মনিব কর্তৃক দাস-দাসীর উপর দণ্ড প্রয়োগের বিষয়টি ভিন্ন। কারণ তা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
—————–
◯ প্রশ্ন:
“বিড়াল কুকুর মেরো না।
নাস্তিক পেলে ছেড়ো না।”
“রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধে কথা বললে জিহ্বা কেটে নেব।”
এ জাতীয় কথাবার্তা বলা কি ইসলাম সমর্থন করে?
উত্তর:
সাধারণ মানুষের এমন কথা-বার্তা বলা শরিয়ত সম্মত নয়। কেননা এটি আইন নিজের হাত তুলে নেয়ার প্রতি উস্কানি মূলক বক্তব্য।
মনে রাখতে হবে, ইসলাম বিনা বিচারে হত্যা, মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ বা কোন ধরণের শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার দেয় না। কারণ এতে হিংসার বশবর্তী হয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে দেয়ার এবং অন্যায় রক্তপাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পর্যাপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হতে পারে।

তা ছাড়া আইনকে নিজের হাতে তুলে নেয়া দেশের প্রচলিত আইনেও একটি অপরাধ।

ইসলামের নামে এমনটি করা হলে, ইসলাম বিদ্বেষীরা ইসলামকে একটি বিশৃঙ্খল ধর্ম হিসেবে বদনাম করার সুযোগ হাতে পাবে অথচ ইসলাম সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও সুসভ্য জীবনাদর্শের নাম।
ইসলামের বিধান হল, এ জাতীয় মামলায় ইসলাম ত্যাগী মুরতাদ বা আল্লাহ, রাসূল, কুরআন বা ইসলামের কোন বিধিবিধানকে গালাগালি বা কুটুক্তি কারীকে শরঈ আদালতের মাধ্যমে প্রথমত: তওবার সুযোগ দেয়াা হবে। তাতে সে পরিবর্তন না হলে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আইনগতভাবে সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) প্রদান করা হবে।

শরঈ আদালত না থাকলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী জেল-জরিমানা যতটুকু হয় ততটুকু হবে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মুসলিমদেরকে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করত: ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। কেননা হদ বা দণ্ডবিধি প্রয়োগের একমাত্র অধিকারী হল, মুসলিম শাসক বা তার স্থলাভিষিক্ত; কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি নয়। শাসক যদি তার উপর অর্পিত ফরজ দায়িত্ব পালন না করে তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে আল্লাহর বিচারের কাঠ গড়ায় দাণ্ডয়মান হতে হবে। কিন্তু কোন দল বা গোষ্ঠী কর্তৃক বা সাধারণ কোন মানুষ ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশ্যে বা গোপনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হত্যা বা আক্রমণ করতে পারবে না। ইসলাম তার অনুমতি দেয় না বরং এটি হবে আরেকটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
▬▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল। দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

হাদিসের আলোকে নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত শাসকের ৪ বৈশিষ্ট্য

 নিম্নে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশুদ্ধ হাদিসের আলোকে এমন চারটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো‌ যেগুলো একজন শাসকের মধ্যে বিদ্যমান থাকলে সে একদিকে যেমন দেশের সাধারণ মানুষের নিকট নিকৃষ্ট শাসক ও ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয় অন্যদিকে সে আল্লাহর নিকটও লাঞ্ছিত-অপদস্ত এবং অভিশাপ যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। এমনকি জাহান্নামেরও হকদার হয়ে যায়।সেগুলো হলো:

❂ ১. যে শাসককে জনগণ ঘৃণা করে ও তার প্রতি অভিশাপ দেয় এবং সেও তাই করে:

প্রখ্যাত সাহাবি আওফ ইবনে মালিক আশজাঈ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে,

خِيَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُحِبُّونَهُمْ وَيُحِبُّونَكُمْ وَتُصَلُّونَ عَلَيْهِمْ وَيُصَلُّونَ عَلَيْكُمْ وَشِرَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ وَتَلْعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ نُنَابِذُهُمْ عِنْدَ ذَلِكَ قَالَ ‏”‏ لاَ مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلاَةَ لاَ مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلاَةَ أَلاَ مَنْ وَلِيَ عَلَيْهِ وَالٍ فَرَآهُ يَأْتِي شَيْئًا مِنْ مَعْصِيَةِ اللَّهِ فَلْيَكْرَهْ مَا يَأْتِي مِنْ مَعْصِيَةِ اللَّهِ وَلاَ يَنْزِعَنَّ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ ‏”‏

“তোমাদের সর্বোত্তম শাসক হচ্ছে তারা, যারা তোমাদেরকে ভালোবাসে ও তোমরাও তাদেরকে ভালোবাসো এবং তোমরা তাদের জন্য দুআ কর ও তারাও তোমাদের জন্য দুআ করে।

আর তোমাদের নিকৃষ্ট শাসক হচ্ছে তারা, যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর, তোমাদেরকেও তারা ঘৃণা করে এবং তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দাও ও তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়।

সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রসুল, এ সময় আমরা কি তাদেরকে প্রতিহত করবো না?
তিনি বললেন, না, যে যাবত তারা তোমাদের মধ্যে সালাত কায়েম রাখবে। তবে যার উপর কোন শাসক নিয়োগ করা হবে আর সে তাকে আল্লাহর কোন নাফরমানি করতে দেখবে তখন ঐ শাসক যতক্ষণ আল্লাহর নাফরমানিতে থাকবে ততক্ষণ তাকে ঘৃণা করতে থাকবে কিন্তু আনুগত্যের হাত গুটিয়ে নেবে না।”

এ হাদিসের একজন বর্ণনাকারী ইবনে জাবের রাহ. বলেন, বর্ণনাকারী জুরাইক যখন এ হাদিস আমার কাছে বর্ণনা করছিলেন তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আবু মিকদাম, আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, সত্যিই কি আপনি মুসলিম ইবনে কারাজাকে বর্ণনা করতে শুনেছেন যে, আওফ ইবনে মালিক রা. রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে হুবহু এ রকম বলতে শুনেছেন?

বর্ণনাকারী বলেন, তখন তিনি তার দু হাঁটুর উপর ভর করে কিবলা মুখী হয়ে বসে পড়লেন এবং বললেন, সেই আল্লাহর কসম করে বলছি, যিনি ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই আমি অবশ্যই মুসলিম ইবনে কারাজাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমি আওফ রা. কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি।” [সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী), অধ্যায়: ৩৪। প্রশাসন ও নেতৃত্ব, পরিচ্ছেদ: ১৭. উত্তম শাসক ও নিকৃষ্ট শাসক। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নাম্বার: ৪৬৫২, ইসলামিক সেন্টার হাদিস নাম্বার: ৪৬৫৪]

❂ ২. যে শাসককে জনগণ অপছন্দ করে:

আবু উমামা রা. হতে বর্ণনা আছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

ثَلاَثَةٌ لاَ تُجَاوِزُ صَلاَتُهُمْ آذَانَهُمُ الْعَبْدُ الآبِقُ حَتَّى يَرْجِعَ وَامْرَأَةٌ بَاتَتْ وَزَوْجُهَا عَلَيْهَا سَاخِطٌ وَإِمَامُ قَوْمٍ وَهُمْ لَهُ كَارِهُونَ

“তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের কানের নিচে অতিক্রম করে না (অর্থাৎ আল্লাহর নিকট কবুল হয় না)। তারা হলো:
ক. যে দাস তার মালিক থেকে পালিয়ে যায় যে পর্যন্ত সে তার নিকট ফিরে না আসে।
খ. যে মহিলা এমন অবস্থায় রাত অতিবাহিত করে যে তার স্বামী তার উপর রাগান্বিত ছিল।
গ. এবং যে ইমামকে তার কওমের লোকেরা অপছন্দ করে।”

[সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), অধ্যায়: ২/ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত নামাজ বিষয়ক হাদিস, পরিচ্ছেদ: ১৫৪. লোকজনের অসন্তোষ সত্ত্বেও তাদের ইমামতি করা]

আলেমগণ এর ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে ইমাম দ্বারা উদ্দেশ্য অত্যাচারী-অনাচারী ও পাপিষ্ঠ শাসক। অর্থাৎ এরাই সর্ব প্রথম উক্ত হাদিসের অন্তর্ভুক্ত হবে। তারপর অন্তর্ভুক্ত হবে নামাজের ইমামগণ। [islamweb]

❂ ৩. যে শাসক জনগণের সাথে নির্দয় আচরণ করে:

উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

اللَّهُمَّ مَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِي شَيْئًا فَشَقَّ عَلَيْهِمْ فَاشْقُقْ عَلَيْهِ وَمَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِي شَيْئًا فَرَفَقَ بِهِمْ فَارْفُقْ بِهِ ‏”

“হে আল্লাহ, যে আমার উম্মতের বিষয়ে দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করে এবং তাদের প্রতি কঠিন আচরণ করে তুমি তার প্রতি কঠিন আচরণ করো আর যে আমার উম্মতের বিষয়ে দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করে এবং তাদের প্রতি নম্র ও সদয় আচরণ করে তুমি তার প্রতি নম্র ও সদয় আচরণ করো।” [সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) , ৩৪/ রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রশাসন, পরিচ্ছেদ: ৫. ন্যায়পরায়ণ শাসকের ফজিলত ও জালেম শাসকের শাস্তি। শাসিতদের প্রতি নম্রতা অবলম্বন ও কঠোরতা বর্জন]

❂ ৪. যে শাসক জনগণের সাথে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করে:

মাকেল ইবনে ইয়াসার রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এ কথা বলতে শুনেছি যে,

‏ مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللَّهُ رَعِيَّةً يَمُوتُ يَوْمَ يَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ إِلاَّ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ ‏

“আল্লাহ তাআলা যে বান্দাকে জনগণের দায়িত্ব (নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব) দিয়েছেন কিন্তু যদি তাদের সাথে প্রতারণা ও খেয়ানত করে এবং এ অবস্থায় যদি তার মৃত্যু হয় তবে আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন।” সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ১/ কিতাবুল ঈমান, পরিচ্ছেদ: ৬২. জনগণের সঙ্গে খিয়ানত কারী শাসক জাহান্নামের যোগ্য]
আল্লাহ তাআলা আমাদের শাসকদেরকে হেদায়েত করুন অথবা তাদের থেকে জাতিকে মুক্তি দান করুন। আমিন।▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

আশুরার শোক উদযাপন বিদআত কেন

 মুহররম মাসের দশ তারিখ আশুরার দিন হিসেবে পরিচিত। ৬১ হিজরির ১০ মুহররম তারিখে আল্লাহ রব্বুল আলামিন হুসাইন রা. কে শাহাদাতের মর্যাদায় ভূষিত করেছিলেন। এই শাহাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা অনেক উন্নীত করেছেন। কারণ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসান ও হুসাইন রা.-এর ব্যাপারে এ শুভ সংবাদ প্রদান করে গেছেন যে, তারা হবেন জান্নাতের যুবকদের নেতা।

আর এ কথা চির সত্য, যে যত বড় মর্যাদা লাভ করে তাকে তত বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হল,

أيُّ النَّاسِ أشدُّ بلاءً؟ قال: الأنبياءُ ثمَّ الأمثلُ فالأمثَلُ، فيُبتلى الرَّجلُ على حسْبِ دينِه، فإن كانَ في دينهِ صلبًا اشتدَّ بلاؤُهُ، وإن كانَ في دينِهِ رقَّةٌ ابتليَ على حسْبِ دينِه، فما يبرحُ البلاءُ بالعبدِ حتَّى يترُكَهُ يمشي على الأرضِ ما عليْهِ خطيئةٌ

“মানব জাতির মধ্যে কে সব চেয়ে বেশি পরীক্ষা ও বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন? তিনি বললেন, নবিগণ, তারপর আল্লাহর নেককার বান্দাগণ।তারপর অন্যদের মধ্যে যারা যে পরিমাণ ঈমান ও পরহেজগারিতার অধিকারী তারা সে পরিমাণ পরীক্ষা সম্মুখীন হয়েছেন। মানুষ তার দ্বীনদারি অনুযায়ী পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। কেউ যদি মজবুত দ্বীনের অধিকারী হয় তবে সে বেশি পরিমাণ পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। আর কারো দ্বীনদারিতে কমতি থাকলে তার বিপদাপদ কম আসে এবং পরীক্ষাও কম হয়। মুমিন বান্দা যতদিন পৃথিবীতে চলা ফেরা করে ততদিন তার উপর বিপদাপদ পতিত হতে থাকে এবং এভাবে তার আর কোন গুনাহ বাকী থাকে না।” [মুসনাদ আহমদ ও তিরমিযি-সনদ হাসান]

আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাদের এই মর্যাদা পূর্বেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল। তারা তাদের পূর্বপুরুষদের মতই বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছেন। ইসলামের মর্যাদা নিয়েই তারা দুনিয়াতে আগমন করেছেন এবং ইসলাম প্রদত্ত মর্যাদা সহকারে তারা প্রতিপালিত হয়েছেন। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সংস্পর্শ, স্নেহ-মমতা, আদর ও ভালবাসা পেয়ে তাদের জীবন সৌভাগ্য মণ্ডিত হয়েছে। যার কারণে মুসলিমগণ তাদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইহজগৎ ত্যাগ করেন তখন তাঁরা ভালোমন্দ বুঝার বয়সে উপনীত হননি।

আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এমন নিয়ামত দিয়েছেন যার মাধ্যমে তারা তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে গিয়ে মিলিত হতে পারে। কারণ তাদের চেয়ে যিনি বেশি মর্যাদার অধিকারী তথা তাদের পিতা আলি রা. ও শহিদ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছেন।

হুসাইন রা.-এর নিহত হওয়ার ঘটনায় জনমানুষের মাঝে ফেতনা-ফ্যাসাদের বিস্তার ঘটে। যেভাবে উসমান রা.-এর নিহত হওয়ার ঘটনা বিরাট বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। যার কারণে আজ পর্যন্ত মুসলিম জাতি বিভক্ত।

❖ হুসাইন রা.-এর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড:

খারেজি সম্প্রদায়ের আব্দুর রহমান বিন মুলজিম আলি রা. কে হত্যা করার পর সাহাবিদের একাংশ হাসান রা. এর হাতে বয়াত নিলেন। তার ব্যাপারে আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

إنَّ ابْنِي هذا سَيِّدٌ، ولَعَلَّ اللَّهَ أنْ يُصْلِحَ به بيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ المُسْلِمِينَ

“আমার এই ছেলে (নাতি) একজন নেতা। সম্ভবত: সে মুসলিমদের দুটি বড় বড় (বিবদমান) দলের মধ্যে সমাধান করবেন।” [সহিহ বুখারি-আবু বকরা বিন নুফাই রা. থেকে বর্ণিত]।

তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। এর মাধ্যমে মুয়াবিয়া এবং হাসান রা.-এর সমর্থক দু দলের মধ্যে সমাধান হল। অতঃপর তিনি ইহজগৎ ত্যাগ করলেন। এরপর বেশ কিছু মানুষ হুসাইন রা.-এর নিকট চিঠির পর চিঠি লেখা শুরু করল। তারা বলল, যদি হুসাইন রা. ক্ষমতা গ্রহণ করেন তবে তাঁকে তারা সাহায্য-সহযোগিতা করবে। অথচ তারা এ কাজের যোগ্য ছিল না।

অতঃপর হুসাইন রা. যখন তাদের নিকট তার চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকিল ইবনে আবু তালিবকে পাঠালেন তখন তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তার দুশমনকে তাকে প্রতিহত করতে এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহায্য করল।

এদিকে বিচক্ষণ সাহাবিগণ এবং হুসাইন রা. হিতাকাঙ্ক্ষীগণ-যেমন: ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর রা. প্রমুখ তারা সবাই হুসাইন রা. কে ঐ সকল লোকদের ডাকে না যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন। তারা বললেন, হুসাইন রা.-এর সেখানে যাওয়াতে কোন লাভ নেই। এতে কোন কল্যাণ বয়ে আসবে না। পরে ঘটনা যা ঘটার তাই ঘটল। আল্লাহর ইচ্ছাই বাস্তবায়িত হল।

হুসাইন রা. বিজ্ঞ সাহাবিগণের পরামর্শ উপেক্ষা করে যখন বের হলেন তখন দেখলেন, অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেছে। তিনি তাদের নিকট আবেদন করলেন, তাকে ছেড়ে দেওয়া হোক। তিনি যেন তিনি মদিনায় ফিরে যেতে পারেন অথবা কোন সীমান্ত প্রহরায় অংশ গ্রহণ করতে পারেন। অথবা তাকে যেন ইয়াজিদের সাথে সাক্ষাত করতে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা তার কোন প্রস্তাব গ্রহণ করল না। বরং তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে যুদ্ধ করতে বাধ্য করল। তিনি এবং তার সঙ্গীগণ যুদ্ধ করে পরিশেষে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করলেন।

এই শাহাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তাকে মর্যাদার সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করলেন এবং তাঁর অন্যান্য পূত-পবিত্র পরিবারবর্গের সাথে মিলিত করলেন এবং তাঁর উপর যারা এহেন নিষ্ঠুর আচরণ করল তাদেরকে লাঞ্ছিত করলেন।

ইতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড জনমানুষের মধ্যে অত্যন্ত খারাপ প্রভাব ফেলল। মানুষ দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এ নিয়ে অনেক মানুষ মুনাফেকি, মূর্খতা এবং গোমরাহির মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। একদল মানুষ এই আশুরার দিন কে মাতম, আহাজারি, কান্নাকাটি এবং শোক দিবস হিসেবে গ্রহণ করল। তারা সেদিন জাহেলি জামানার বিভিন্ন আচরণ প্রদর্শনী শুরু করল। তারা সে দিন, শোক র‍্যালি, কালো পতাকা মিছিল, নিজের শরীরে চাবুক-তলোয়ার ইত্যাদি ধারাল অস্ত্র দ্বারা দিয়ে জখম, নিজেদের গালে আঘাত, শরীরের কাপড় ছেড়া, জামার পকেট ছেড়া, চুল ছেড়া ইত্যাদি বিভিন্ন জাহেলি প্রথা অনুযায়ী শোক দিবস পালন করে থাকে। যা আজ পর্যন্ত পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবছর আশুরার দিন তারা ইসলামি শরিয়তের সম্পূর্ণ বিপরীত এহেন কার্যকলাপ করে থাকে। তারা মনে করে, এ সব কাজ করার মাধ্যমে তারা হুসাইন রা. এবং তার আহলে বাইত তথা পরিবারবর্গের প্রতি ভালবাসা এবং সমবেদনা প্রকাশ করে!!

❖ শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,

“হুসাইন রা.-এর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে শয়তান মানুষের মধ্যে দুটি বিদআত আবিষ্কার করল। একটি হল, আশুরার দিন শোক ও কান্নাকাটি করার বিদআত। যে দিন শরীরে আঘাত করা, চিৎকার করে কান্নাকাটি করা, পিপাসার্ত থাকা, মর্সিয়া পালন ইত্যাদি কার্যক্রম করা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয় বরং এ দিন পূর্বপুরুষদেরকে গালাগালি করা হয়, তাদের উপর অভিশাপ দেওয়া হয় এবং এমন সব লোকদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয় যারা প্রকৃতপক্ষে অপরাধী নয় এবং হুসাইন রা. এর মৃত্যু সংক্রান্ত এমন সব কাহিনী বয়ান করা হয় যেগুলো অধিকাংশই মিথ্যা এবং বানোয়াট।

যারা এসবের সূচনা করেছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল ফেতনা-ফ্যাসাদের দরজা উন্মুক্ত করা এবং মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করা। এসব কাজ তো মুসলিমদের ঐকমত্যে ওয়াজিব নয় মোস্তাতাহাবও নয় বরং এতে শুধু অতীতে ঘটে যাওয়া বিপদাপদকে কেন্দ্র করে ধৈর্য হীনতা এবং কান্নাকাটি নতুন করে উজ্জীবিত করা হয়। অথচ তা আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রসুল কর্তৃক শক্তভাবে নিষিদ্ধ জিনিস।”

ধৈর্য হীনতা প্রকাশ করা বা চিৎকার-কান্নাকাটি করা ইসলামি শরিয়তের পরিপন্থী। বিপদে-মসিবতে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের নির্দেশ হল, ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া, ‘ইন্নাল্লিাহি ওয়া ইন্নালিল্লাইহি রাজিঊন’ পাঠ করার পাশাপাশি আত্ম সমালোচনা করা। যেমন:

▪ আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَبَشِّرِالصَّابِرِينَ – الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّـهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ ولَـٰئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ ۖ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ

“আর ধৈর্য ধারণকারীদেরকে শুভ সংবাদ দাও। যারা বিপদ এলে বলে, ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ (আমরা আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন এবং তাঁর নিকটই প্রত্যাবর্তনকারী)। এদের উপরই আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া ও করুণা বর্ষিত হয় এবং এরাই সুপথে প্রতিষ্ঠিত।” [সূরা বাকারা: ১৫৫]

▪ সহিহ বুখারিতে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,

لَيْسَ مِنّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ، وَشَقَّ الْجُيُوبَ، وَدَعا بِدَعْوى الْجاهِلِيَّةِ

“যে ব্যক্তি গালে চপেটাঘাত করে, জামার পকেট ছিঁড়ে এবং জাহেলিয়াতের মত আহবান করে তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।” [মজমু ফাতাওয়া শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ২৫/৩০২, ৩০৭]

▪ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

أَنا بَرِيءٌ مِمَّنْ بَرئَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَرِئَ مِنَ الصَّالِقَةِ وَالْحالِقَةِ وَالشَّاقَّةِ

“যে মহিলা (বিপদে-মসিবতে) চিৎকার করে, মাথার চুল মুণ্ডন করে, কাপড় ছেঁড়ে তার থেকে আমি সম্পর্ক মুক্ত।” [সহিহ মুসলিম]

▪ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,

النَّائِحَةُ إذا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِها، تُقامُ يَومَ القِيامَةِ وعليها سِرْبالٌ مِن قَطِرانٍ، ودِرْعٌ مِن جَرَبٍ

“বিলাপকারিণী মহিলা যদি তওবা করার আগে মৃত্যু বরণ করে তবে সে কিয়ামতের দিন আলকাতরা মাখানো পায়জামা আর ঘা বিশিষ্ট বর্ম পরিহিত অবস্থায় উঠবে।” [সহিহ মুসলিম, জানাজা অধ্যায়]

▪ সহিহ বুখারিতে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,

ما مِن عبدٍ تُصيبُه مُصيبةٌ، فيقولُ: إنَّا لله وإنَّا إليه راجعونَ، اللهُمَّ أْجُرْني في مُصِيبتِي، وأَخْلِفْ لي خيرًا منها، إلَّا أَجَرَه اللهُ في مُصِيبته، وأَخْلَفَ له خيرًا منها

“যে আল্লাহর বান্দা বিপদে অপতিত হলে বলে: ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইল্লাইহি রাজিঊন, “আল্লাহুম্মা আজিরনী ফী মুসীবাতী ওয়াখলুফ লাহু খাইরান মিনহা” (নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য নিবেদিত এবং তার কাছেই ফিরে যাব। হে আল্লাহ, বিপদে আমাকে প্রতিদান দাও এবং এর থেকে উত্তম বিকল্প দান কর)।” আল্লাহ তাকে তার বিপদে উত্তম প্রতিদান দিবেন এবং তার চেয়ে ভালো বিকল্প ব্যবস্থা করবেন।” [সহিহ মুসলিম, জানাজা অধ্যায়]

▪ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

أَرْبَعٌ في أُمَّتي مِن أمْرِ الجاهِلِيَّةِ، لا يَتْرُكُونَهُنَّ: الفَخْرُ في الأحْسابِ، والطَّعْنُ في الأنْسابِ، والاسْتِسْقاءُ بالنُّجُومِ، والنِّياحَةُ

“আমার উম্মতের মধ্যে চারটি জিনিস জাহেলিয়াত বা মূর্খতা সুলভ কাজ যেগুলো তারা ছাড়বে না। বংশ আভিজাত্য নিয়ে গর্ব করা, অন্যের বংশকে দোষারোপ করা, তারকার সাহায্যে বৃষ্টি প্রার্থনা করা এবং মানুষের মৃত্যুতে বিলাপ করা।” [সহিহ মুসলিম, জানাযা অধ্যায়]
সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি হুসাইন রা.-এর নিহত হওয়ার ঘটনায় অন্য মুমিন-মুসলিমদের প্রতি জুলুম-অত্যাচার করে, তাদেরকে গালাগালি করে বা তাদের উপর অভিশাপ দেয় এবং দ্বীনের দুশমন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কাজে সাহায্য করা সহ নানা অন্যায় কাজে জড়িত হয় তাদের পরিণতি কী হতে পারে?!

শয়তান গোমরাহ লোকদের জন্যে আশুরার দিনকে শোক ও মাতম প্রকাশের দিন হিসেবে সুসজ্জিত ভাবে তুলে ধরেছে। যার কারণে এ সব লোক আশুরা আসলে কান্নাকাটি, দুঃখের কাওয়ালি গাওয়া, বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী বর্ণনা ইত্যাদি কার্যক্রম শুরু করে দেয়। এতে কি কিছু লাভ হয়? হ্যাঁ, এতে যা হয় তা হল, মানুষের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ এবং গোঁড়ামির বিষ বাষ্প ছড়ানো, মুসলিমদের মাঝে ফেতনা-ফ্যাসাদ উজ্জীবিত করা এবং অতীত কালের মানুষদের গালাগালি করা। এভাবে দ্বীনের মধ্যে অসংখ্য ফেতনা ছড়ানো হয় এবং মিথ্যার পরিচর্যা করা হয়।

ইসলামের ইতিহাসে এত ফেতনা-ফ্যাসাদ, দ্বীনের নামে মিথ্যাচার এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদেরকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে এ শিয়া সম্প্রদায়টির চেয়ে অগ্রগণ্য আর কোন মানুষ দেখা য়ায়নি। (সমাপ্ত)
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উৎস: শাইখ আব্দুল আজিজ বিন আহমদ আত তুওয়াইজিরি রাহ. কর্তৃক রচিত ‘আল বিদা আল হাওলিয়া’ (মাস্টার্স এর থিসিস)
অনুবাদ: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি। দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate