ইসলামী হুদুদ তথা দণ্ড প্রয়োগের একমাত্র দায়িত্বশীল হল রাষ্ট্র, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও আদালত। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি, কমিটি, জামাত বা সংগঠন এই ক্ষমতা রাখে না। কেননা এতে ‘হদ’ কায়েমের নামে ব্যক্তিগত রেষারেষি, পারিবারিক কলহ, জায়গাজমি নিয়ে ধন্ধ, রাজনৈতিক ও দলীয় প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ইত্যাদি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া দলিল-প্রমাণ সহকারে যথাযথ তদন্ত ছাড়াই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করার সম্ভাবনা আছে। তাই আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। এতে সমাজে বিবাদ, বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাত আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
Friday, September 27, 2024
কোনো অপরাধী বা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেওয়া এবং ইসলাম বিদ্বেষী ও ধর্মদ্রোহী বা নাস্তিকদেরকে গোপনে হত্যা করার বিধান
মানুষের মধ্যে সর্ব প্রথম সৃষ্টি আদম আলাইহিস সালাম নাকি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
মানুষের মধ্যে সর্ব প্রথম সৃষ্টি আদম আ. না কি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম? সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্ব প্রথম সৃষ্টি কি নুরে মুহাম্মদি?
প্রশ্ন: আল্লাহ তাআলা সর্ব প্রথম আদম আ. কে সৃষ্টি করেছেন না কি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে? শুনেছি যে, আল্লাহ তাআলা সর্ব প্রথম নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নুর সৃষ্টি করেছেন। সে নুর থেকে তিনি এই বিশ্বচরাচরের সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। এ কথার বাস্তবতা কতটুকু?
উত্তর: মানব জাতির মধ্যে আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম আদম আ. কে সৃষ্টি করেছেন। এরপর পৃথিবীতে যত মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে ও ঘটবে তারা সকলে আদম ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া আ. এর মাধ্যমেই হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ۚ
“হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী।” [সূরা নিসা: ১]
মানব জাতির এ ধারা পরম্পরায় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৫৭০/৬৭১ খৃষ্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশে পিতা আব্দুল্লাহ ও মা আমিনার মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে আগমন করেছেন।
❑ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নুর আল্লাহ প্রথম সৃষ্টি হওয়ার হাদিস জাল ও ভিত্তিহীন:
আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নুর সৃষ্টি করেছেন আর তার নুর থেকে তামাম জাহান সৃষ্টি করেছেন, আদম আ. কে সৃষ্টি করার পর তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা নুর দেখতে পেলেন আর সে নুর হল, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইত্যাদি। এ ধরণের যত কথা আমাদের সমাজে লোকমুখে প্রচলিত সবই ভিত্তিহীন ও ভ্রান্ত কথা। এ সব কথায় বিশ্বাস করা বৈধ নয়।
◈ যারা বলে যে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নুর থেকে বিশ্ব ভুবন সৃষ্টি হয়েছে তাদের প্রতি প্রশ্ন:
তাঁদের এই কথার ফলাফল অনুযায়ী পৃথিবীর সবকিছু নুরে মুহাম্মদি দ্বারা তৈরি। তাহলে আল্লাহর শত্রু ফেরাউন, নমরূদ, হামান, আবু জাহেল, আবু লাহাব, জেনাকারি এবং জেনাকারিনী, মদ্যপান কারী এবং মদ, জুয়াড়ি এবং জুয়া, মূর্তি এবং মন্দির, জাহান্নাম এবং জাহান্নামি, শুকর, কুকুর, ইঁদুর, বিড়াল ইত্যাদি সবই কি নুরে মুহাম্মদি হতে তৈরি?! নাউযু বিল্লাহ! এটাই কি আপনাদের দৃষ্টিতে নবীর মর্যাদা এবং নবীর মহব্বত?! বরং এই বর্ণনা অনুযায়ী তো এর থেকেও জঘন্য আকিদা প্রমাণ হয়। তা হল, এ সবও আল্লাহর নুর! কারণ নুরে মুহাম্মদি হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর নুর যা দ্বারা এসব কিছু তৈরি হয়েছে। এটা কোন ধরণের আকিদা?!
◈ যারা বলে যে, আল্লাহ তাআলা সর্ব প্রথম আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নুর সৃষ্টি করেছেন তাদের এ কথা নিম্নোক্ত সহিহ হাদিস পরিপন্থী:
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
” إن أول شيء خلقه الله تعالى القلم وأمره أن يكتب كل شيء يكون
‘‘আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে জিনিস সৃষ্টি করেন, তা হল কলম। তার পর কলমকে লিখতে আদেশ করেন যা কিছু (ভবিষ্যতে) হবে।”
হাদিসটিকে ইবনে আসেম আস্ সুন্নাহ গ্রন্থে (১০৮), আল আওয়ায়েল্ গ্রন্থে (৩), আবু ইয়ালা তার মুসনাদ গ্রন্থে (১/ ১২৬), বায়হাকি সুনান আল কুবরাতে (৯/৩) এবং আল্ আসমা ওয়াস সিফাত গ্রন্থে (২৭১)এ বর্ণনা করেন। [দেখুন সিলসিলা সহীহাহ, প্রথম খণ্ড হা/১৩৩]
শাইখ আলবানি, এ হাদিসের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন,
“এ হাদিসে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, লোকজন যে বিষয়টি নিজেদের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা করে থাকে এমনকি যেটা অনেক মানুষের অন্তরে শক্ত বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে যে, নুরে মুহাম্মদি (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নুর) হল, আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্টি। কিন্তু তা সঠিক নয়।” [ajurry]
এ হাদিস প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা সর্ব প্রথম সৃষ্টি হল, কলম। কারো মতে আরশ আর কারো মতে পানি। এ ব্যাপারে উক্ত তিনটি মত পাওয়া যায়। যা হোক, আল্লাহর নবীর নুরকে প্রথম সৃষ্টি বলা হলে তা উক্ত হাদিসের বিপরীতে চলে যায়। আল্লাহু আলাম।
আমি জ্ঞানের শহর আর আলি তার দরজা একটি প্রসিদ্ধ জাল বা বানোয়াট হাদিস
উপরোক্ত হাদিসটি আমাদের সমাজের বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে শোনা যায়। বিভিন্ন ইসলামি বই-পুস্তকে পাওয়া যায় এবং অনেক সময় সাধারণ মানুষও উল্লেখ করে থাকে। অথচ এটি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। কতিপয় মুহাদ্দিসের মতে তা জইফ বা দুর্বল। কিন্তু অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মতে তা হাদিসেরে নামে মিথ্যাচার, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট হাদিস। ইমাম বুখারী, আবু হাতিম, ইয়াহিয়া বিন সায়ীদ, জাহাবী প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ হাদিসটিকে ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘জাল’ বলে উল্লেখ করেছেন।
❑ নিম্নে মূল হাদিস, তার উৎস এবং মান সম্পর্কে জগদ্বিখ্যাত হাদিস বিশারদগণের মতামত তুলে ধরা হলো:
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
أَنَا مَدِينَةُ الْعِلْمِ وَعَلِيٌّ بَابُهَا ، فَمَنْ أَرَادَ الْعِلْمَ فَلْيَأْتِهِ مِنْ بَابِهِ
“আমি হলাম, ইলম বা জ্ঞানের শহর আর আলি তার দরজা। যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের ইচ্ছে করে সে যেন তার দরজা দিয়ে প্রবেশ করে।” অর্থাৎ আলি রা. এর সূত্রে ইলম অর্জন করে।”
[উৎস: আল মুজামুল কাবীর, হা/১১০৬১, মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৪৬৩৭, ইবনে হিব্বান তার মাজরুহিন কিতাবে, ১/১৩০, ইবনে আদি তার তারিখ কিতাবে ৩/৬৫৫, উকাইলি তার যুয়াফা কিতাবে, ৩/১৪৯, কানযুল উম্মাল, হা/৩২৮৯০, সুনানে তিরমিজি/৩৭২৩ ইত্যাদি।]
❑ হাদিসটি মান:
অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মতে তা হাদিসেরে নামে মিথ্যাচার ও বানোয়াট হাদিস। ইমাম বুখারী, আবু হাতিম, ইয়াহিয়া বিন সায়ীদ, জাহাবি প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হাদিসটিকে ভিত্তিহীন ও জাল বলে উল্লেখ করেছেন।
উৎস: ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/২৬১-২৬৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৩২৮-৩৩৬; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, ৭১-৭২ পৃষ্ঠা নং ২৫১, সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃষ্ঠা নং ১১৪-১১৬, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃষ্ঠা নং ৬৯ ইত্যাদি।
❂ উক্ত হাদিসটির ব্যাপারে বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের মতামত নিম্নরূপ:
❑ এর প্রায় সমার্থবোধক আরেকটি হাদিস পাওয়া যায়। তা হলো, আলি রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«أَنَا دَارُ الْحِكْمَةِ وَعَلِيٌّ بَابُهَا»
“আমি হেকমত বা প্রজ্ঞার ঘর আর আর আলি তার দরজা।”
[উৎস: মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), অধ্যায়: ৩০: মান-মর্যাদা, পরিচ্ছেদ: দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ: আলি ইবনে আবি তালিব রা.-এর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য। ইমাম তিরমিজি হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং তিনি বলেছেন, اسنادہ ضعیف “এর সনদটি জইফ (দুর্বল)।” তবে কিছু মুহাদ্দিস এটিকে মুনকার (মারাত্মক পর্যায়ের দুর্বল) বলেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মুহাদ্দিস এটিকে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে আখ্যায়িত করেছেন।
❂ উক্ত হাদিসটির ব্যাপারে বিজ্ঞ মুহাদ্দিনদের মতামত নিম্নরূপ:
সম্ভবত: আলি রা.-এর মর্যাদা ও মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে শিয়ারা এই হাদিসটি তৈরি করেছে। এ উদ্দেশ্যে উক্ত হাদিস ছাড়াও তারা আরও বহু হাদিস তৈরি করেছে।
প্রকৃতপক্ষে আলি রা. অত্যন্ত মর্যাদাবান সাহাবি। তার মান-সম্মান প্রমাণের জন্য বহু বিশুদ্ধ হাদিস বিদ্যমান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সেগুলোই যথেষ্ট। সুতরাং এ জন্য কোনও জাল ও ভিত্তিহীন হাদিসের আদৌ প্রয়োজন নেই।
আল্লাহ তাআলা জাল হাদিস রচনাকারীদেকে তাদের উপযুক্ত পাওনা বুঝিয়ে দিন। আমিন।
সুতরাং এই অপ্রমাণিত জাল ও বানোয়াট হাদিস সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার উদ্দেশ্য ছাড়া তা বর্ণনা করা ও প্রচার করা হারাম ও কবিরা গুনাহ। কারণ জেনে-বুঝে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যা/জাল হাদিস বর্ণনা করার পরিণতি জাহান্নাম। আল্লাহু আলাম।