প্রশ্ন: পর্নোগ্রাফি কী? পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রির উদ্দেশ্য কী? অশ্লীল ও নগ্ন ভিডিও দেখার কুফল ও পরিণাম কী কী? পর্নোগ্রাফির আগ্রাসন ও পর্নো ওয়েবসাইট থেকে মুক্তির উপায়গুলো কি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর ‘পর্নোগ্রাফি’ শব্দটি ইংরেজি Pornography থেকে উদ্ভূত, যা এসেছে গ্রিক শব্দ Pornographia থেকে। এর আক্ষরিক অর্থ হলো— অশ্লীল বা যৌন উত্তেজনামূলক বিষয় উপস্থাপন করা।পর্নোগ্রাফি বলতে মূলত এমন কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও, চলচ্চিত্র বা অভিনয়কে বোঝায়, যার উদ্দেশ্য কেবল যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টি করা, কিন্তু যার কোনো শৈল্পিক, নৈতিক বা শিক্ষামূল্য নেই। অন্যভাবে বলা যায়, পর্নোগ্রাফি হলো— এমন সব অশ্লীল দৃশ্য, সংলাপ, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন উপস্থাপনা, যা মানুষের মনে কৃত্রিমভাবে যৌন আকর্ষণ বা কামোদ্দীপনা জাগায়।আর এ ধরনের অশ্লীল বিষয়বস্তু বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে—যেমন: বই, সাময়িকী, পোস্টার, আলোকচিত্র, অঙ্কন, পেইন্টিং, চলচ্চিত্র, ভিডিও, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ কিংবা ইন্টারনেট। সংক্ষেপে বলা যায়—“যে কোনো প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে যৌন বিষয়বস্তু উপস্থাপন করে মানুষের মনে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি বা কামনা উদ্রেক করার উদ্দেশ্যে তৈরি সামগ্রীই পর্নোগ্রাফি।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; Bangla Academy English-Bengali Dictionary, Reprint, January, 2004, Page: 593; বাংলাদেশের আইন কানুন প্রতিবেদন, ৬ জুন, ২০১৫)
.

পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি?
.
বিশ্বে ইন্টারনেটের সূচনা হয় ১৯৬৯ সালে। বাংলাদেশে এটি চালু হয় ১৯৯৩ সালে এবং ১৯৯৬ সালে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। শুরুতে জ্ঞান ও তথ্যের আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটের ব্যবহার ক্রমে জনপ্রিয়তা পেলেও, বাস্তবতা হলো—আজ এর অন্যতম প্রধান প্রসারতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অশ্লীলতা ও পর্নোগ্রাফির বিস্তার। পর্নোগ্রাফি তৈরিতে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে আমেরিকা, আর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জার্মানি। পরিসংখ্যান বলছে,বর্তমানে ইন্টারনেটে প্রায় ৪.৬ মিলিয়ন পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট এবং ৪৫০ মিলিয়ন পর্নো ওয়েবপেজ সক্রিয় রয়েছে—এবং এই সংখ্যা প্রতিদিনই উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।বাংলাদেশও এই ভয়াবহ প্রবণতা থেকে মুক্ত নয়। স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট পর্নো ভিডিও ছড়িয়ে পড়াকে করে তুলেছে আরও সহজ ও দ্রুততর। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ৩২ সেকেন্ডে একটি নতুন পর্নো ভিডিও ইন্টারনেটে আপলোড হচ্ছে। এই অশ্লীল উপকরণগুলো অনায়াসে পৌঁছে যাচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কর্পোরেট অফিসের কর্মকর্তাদের হাতেও। এই অশ্লীলতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের শিল্প—যা আজ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে—এর মূল উদ্দেশ্যই হলো: সকল শ্রেণির মানুষ অর্থাৎ নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীর সামনে তাদের নোংরামি, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা, যেনা-ব্যভিচারের দৃশ্যকে নানা নাম ও আকর্ষণীয় আবরণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা; ফলে মানুষকে ধীরে ধীরে নৈতিকতা ও লজ্জাশীলতা থেকে বিচ্যুত করে দেওয়া। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে মানুষকে নৈতিকতার পথ থেকে সরিয়ে, উদাসীন ও যৌন বিকৃত মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলে।আজ লক্ষ কোটি যুবক-যুবতী এই প্রভাবের শিকার হচ্ছে। তারা বিনষ্ট হচ্ছে শারীরিক, মানসিক ও নৈতিকভাবে, এবং তাদের চরিত্রে ছড়িয়ে পড়ছে কলুষিত আচরণ। ইসলামের শত্রুরা এই নীরব যুদ্ধের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও জাতিকে অস্থিতিশীল করতে সচেষ্ট। এ পথ ধরে অনেকেই অবচেতনভাবে পাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত তাদের ধ্বংস ও নরকপ্রাপ্তির দিকে নিয়ে যায়। অশ্লীলতা ও পর্ণোগ্রাফি কেবল ব্যক্তিকে নয়, পুরো জাতিকে হুমকির মুখে ফেলে। কারণ প্রত্যেক জাতির যুবসমাজ হলো ভবিষ্যতের আলো, জাতির মেরুদণ্ড। যদি তারা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে জাতির ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। ২০০৬ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৩৭২ জন মানুষ সার্চ ইঞ্জিনে পর্নো কনটেন্ট খুঁজছিল। এখন সেই সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে বিশ্বব্যাপী এক ভয়াবহ সামাজিক মহামারিতে রূপ নিয়েছে।
.

পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীল ভিডিও দেখার কুফল গুলো কি কি:
.
পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীল ভিডিও দেখার ফলে আমাদের আমলনামা কলুষিত হয়, দীন ও চরিত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং অন্তর শয়তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।পর্ণ ও অশ্লীলতায় ডুবে থাকা ব্যক্তির অন্তর রোগাক্রান্ত হয়। সে অন্তরে ভয়-ভীতি, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা ও নি:সঙ্গতা অনুভব করে।অন্তর থেকে লজ্জা শরম বিদায় নেয়, ঈমানের স্বাদ উঠে যায় এবং আল্লাহ ভীতি লোপ পায়।তারপর সে ধীরে ধীরে নানা পাপাচারে লিপ্ত হয়, জিনা-ব্যভিচার ও নোংরামির পথ খুঁজতে থাকে, নিজের উপর জুলুম করতে থাকে, হস্তমৈথুন করে, তার শরীর ও চেহারায় পাপাচারের চিহ্ন ফুটে উঠে এবং শরীরে নানা রোগব্যাধি বাসা বাঁধে। বিবাহিত হলে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য শুরু হতে পারে এবং প্রেম-পরকীয়া জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ তখন হালাল স্ত্রীও তার কাছে অ পছন্দনীয় হয়ে যেতে পারে।একপর্যায়ে ইবাদত-বন্দেগিতে অনীহা সৃষ্টি হয়। এমনকি সম্ভাবনা আছে, একসময় সে আল্লাহর রাস্তা থেকে সরে যাবে।(আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন)।
.

পর্ণ ও অশ্লীল-নগ্ন ভিডিও দেখার পরিণাম কি:
.
আমাদের জানা জরুরি যে,আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল প্রকার অশ্লীলতাকে হারাম করেছেন।আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ“আপনি বলে দিনঃ আমার পালনকর্তা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছে এবং হারাম করেছেন পাপাচার, অন্যায়-অত্যাচার, আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার দলিল অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জানো না।” [সূরা আরাফ: ৩৩) ইসলামে পরপুরুষ বা পরনারীর দিকে কামনা-বাসনা সহকারে তাকানো হারাম। অনুরূপভাবে পরপুরুষ-পরনারীর লজ্জা স্থানের দিকে তাকানো হারাম। চাই তা সরাসরি হোক, বা ছবি বা ভিডিও এর মাধ্যমে হোক।তাছাড়া যা কিছু ফেতনা সৃষ্টি করতে পারে বা কামভাবের উদ্রেক ঘটাতে পারে অথবা হারাম বিষয়ে নিমজ্জিত করতে পারে, তার সবকিছুর দিকে দৃষ্টি দিতে মহান আল্লাহ আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেনقُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ. وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ “মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। আর মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে”।(সূরা আন-নূর, ২৪/৩০-৩১)।
.
উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন,الْبَصَرُ هُوَ الْبَابُ الْأَكْبَرُ إِلَى الْقَلْبِ، وَأَعْمَرُ طُرُقِ الْحَوَاسِّ إِلَيْهِ، وَبِحَسَبِ ذَلِكَ كَثُرَ السُّقُوطُ مِنْ جِهَتِهِ. وَوَجَبَ التَّحْذِيرُ مِنْهُ، وَغَضُّهُ وَاجِبٌ عَنْ جَمِيعِ الْمُحَرَّمَاتِ، وَكُلِّ مَا يُخْشَى الْفِتْنَةُ مِنْ أَجْلِه.”চোখ হচ্ছে হৃদয়ে প্রবেশের সবচেয়ে বড় দরজা এবং ইন্দ্রিয়সমূহে ঢোকার সবচেয়ে উর্বর পথ। এই চোখের কারণেই পদস্খলন ঘটে। ফলে সে ব্যাপারে সতর্ক করা জরুরী। চোখের কারণে যত হারাম কাজ হতে পারে এবং যত ধরনের ফেতনায় নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তার সবগুলো থেকে চোখতে অবনমিত রাখা অপরিহার্য”।(ইমাম কুরতুবী,আল-জামে‘ লিআহকামিল কুরআন তাফসীর কুরতুবী- (কায়রো: দারুল কুতুবিল মিছরিয়্যাহ, ২য় মুদ্রণ: ১৩৮৪ হি./১৯৬৪ খৃ.), খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা/২২৩)
.
ইমাম আব্দুর রহমান নাছের আস সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,أَرْشِدِ الْمُؤْمِنِيْنَ، وَقُلْ لَهُمْ: الَّذِيْنَ مَعَهُمْ إِيْمَانٌ، يَمْنَعُهُمْ مِنْ وُقُوْعِ مَا يُخِلُّ بِالْإِيْمَانِ: {يَغُضُّوْا مِنْ أَبْصَارِهِمْ} عَنِ النَّظَرِ إِلَى العَوْرَاتِ وَإِلَى النِّسَاءِ الأَجْنَبِيَّاتِ، وَإِلَى المُرْدَانِ الَّذِيْنَ يُخَافُ بِالنَّظَرِ إِلَيْهِمُ الْفِتْنَةُ، وَإِلَى زِيْنَةِ الدُّنْيَا الَّتِيْ تَفْتِنُ، وَتُوْقِعُ فِي الْمَحْذُوْرِ.‘আপনি মুমিনদেরকে নির্দেশনা দিন এবং তাদেরকে বলুন, যাদের সাথে ঈমান আছে, সেই ঈমানের বিচ্যুতি ঘটাতে পারে এমন বিষয় থেকে তাদেরকে তাদের ঈমানই বাধা প্রদান করবে: তারা তাদের দৃষ্টি অবনত রাখবে গোপন বিষয়সমূহ থেকে, বেগানা নারীদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া থেকে এবং এমন কিশোর-যুবকের দিকে দৃষ্টি দেওয়া থেকে, যাদের দিকে তাকালে ফেতনার আশঙ্কা রয়েছে। অনুরূপভাবে তারা দুনিয়াবী এমন সৌন্দর্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়া থেকে তাদের চোখকে অবনমিত রাখবে, যেসব সৌন্দর্য ফেতনায় ফেলতে পারে এবং নিষিদ্ধ বিষয়ে নিপতিত করতে পারে”।(আব্দুর রহমান নাছের আস-সা‘দী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান (মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ১ম মুদ্রণ: ১৪২০ হি./২০০০ খৃ.),পৃষ্ঠা: ৫৬৬)
.
এছাড়াও পর্ণ ও অশ্লীল ভিডিও দেখার ফলে চোখের গুনাহ হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا“নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।” (সূরা ইসরা: ৩৬) কিয়ামতের দিন আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। যেমন: আল্লাহ বলেন,الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَىٰ أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُم بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ “আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।”(সূরা ইয়াসিন: ৬৫) শুধু তাই নয়, আমরা প্রকাশ্যে বা গোপনে যা কিছু করি সব কিছু আল্লাহ পর্যবেক্ষণ করছেন এবং ফেরেশতামন্ডলী রেকর্ড রাখছেন। কিয়ামতের দিন আমাদের সব গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাবে-যদি আমরা তওবা না করি। সেজন্যই তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন,لَا يَنْظُرُ الرَّجُلُ إِلَى عَوْرَةِ الرَّجُلِ، وَلَا الْمَرْأَةُ إِلَى عَوْرَةِ الْمَرْأَةِ، وَلَا يُفْضِي الرَّجُلُ إِلَى الرَّجُلِ فِي ثَوْبٍ وَاحِدٍ، وَلَا تُفْضِي الْمَرْأَةُ إِلَى الْمَرْأَةِ فِي الثَّوْبِ الْوَاحِدِ ‘কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষের এবং কোনো নারী যেন অপর নারীর ‘আওরাত’ না দেখে। আর কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষের সাথে এক কাপড়ের নিচে না থাকে। অনুরূপ কোনো নারীও যেন অপর নারীর সাথে এক কাপড়ের নিচে না থাকে”(সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৮) তিনি আরো বলেন,لاَ تُبَاشِرُ المَرْأَةُ المَرْأَةَ، فَتَنْعَتَهَا لِزَوْجِهَا كَأَنَّهُ يَنْظُرُ إِلَيْهَا ‘কোনো নারী অন্য নারীর সাথে শরীর মিলিয়ে শুবে না। কেননা সে তার স্বামীর নিকট অপর নারীর শরীরের বর্ণনা দিবে এবং মনে হবে সে যেন তাকে চাক্ষুস দেখছে”।(সহীহ বুখারী, হা/৫২৪০)
.
হাদীসটির ব্যাখায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,فَفِيهِ تَحْرِيمٌ نَظَرُ الرَّجُلِ إِلَى عَوْرَةِ الرَّجُلِ وَالْمَرْأَةُ إِلَى عَوْرَةِ الْمَرْأَةِ وَهَذَا لَا خِلَافَ فِيهِ وَكَذَلِكَ نَظَرُ الرَّجُلِ إِلَى عَوْرَةِ الْمَرْأَةِ وَالْمَرْأَةُ إِلَى عَوْرَةِ الرَّجُلِ حَرَامٌ بِالْإِجْمَاعِ وَنَبَّهَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِنَظَرِ الرَّجُلِ إِلَى عَوْرَةِ الرَّجُلِ عَلَى نَظَرِهِ إِلَى عَوْرَةِ الْمَرْأَةِ وَذَلِكَ بِالتَّحْرِيمِ أَوْلَى ‘এ “হাদীসে একজন পুরুষের অন্য পুরুষের গোপনাঙ্গের দিকে এবং একজন মহিলার অন্য মহিলার গোপনাঙ্গের দিকে তাকানো হারাম হওয়ার প্রমাণ আছে। আর এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। একইভাবে, কোনো পুরুষের জন্য কোনো মহিলার গোপনাঙ্গের দিকে এবং কোনো মহিলার জন্য কোনো পুরুষের গোপনাঙ্গের দিকে তাকানো ইজমার ভিত্তিতে হারাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন পুরুষকে অন্য পুরুষের গোপনাঙ্গের দিকে তাকানোর ব্যাপারে সতর্ক করার মাধ্যমে একজন পুরুষের জন্য একজন মহিলার গোপনাঙ্গের দিকে তাকানোর ব্যাপারে সাবধান করেছেন। বরং এটা আরো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হারাম”।(ইমাম নববী; আল-মিনহাজ শারহস সহীহি মুসলিম খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩০)
.
শুধু তাই নয়,নির্জনে সংঘটিত গুনাহের জন্যও পরকালে ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে।এ সম্পর্কে একটি সতর্কতামূলক হাদীস এসেছে ইমাম ইবনু মাজাহ এর বর্ণনায়। প্রখ্যাত সাহাবী সাওবান (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন: “আমি আমার উম্মতের এমন কিছু মানুষের কথা জানি, যারা কিয়ামতের দিন তিহামা পাহাড়সম শুভ্র নেকী নিয়ে হাজির হবে
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সে নেকগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধুলিকণাতে পরিণত করে দিবেন”। সাওবান (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় আমাদের জানিয়ে দিন, আমাদের জন্য পরিষ্কার করে বলুন— যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই।”তখন নবী ﷺ বললেন,“তারা তোমাদেরই ভাই, তোমাদেরই জাতি-গোষ্ঠীভুক্ত। তোমরা যেমন রাতে নামাজ আদায় কর, তারাও তেমনই ইবাদত করে। কিন্তু পার্থক্য এই যে— তারা নির্জনে অবস্থান করে আল্লাহ্র নিষিদ্ধ বিষয়গুলোতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।”(ইবনু মাজাহ: হা/৪২৪৫; ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদিসটি সহিহ বলেছেন)
.
হাফেয ইবনুল জাওযি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:”الحذر الحذر من الذنوب، خصوصًا ذنوب الخلوات ، فإن المبارزة لله تعالى تُسقط العبد من عينه. وأصلح ما بينك وبينه في السر، وقد أصلح لك أحوال العلانية “গুনাহ থেকে সাবধান! গুনাহ থেকে সাবধান! বিশেষতঃ নির্জনের গুনাহ থেকে। কেননা আল্লাহ্র সাথে দ্বন্দ করা বান্দাকে আল্লাহ্র চোখে মূল্যহীন করে দেয়। তোমার ও আল্লাহর মাঝের নিভৃতের অবস্থাকে সংশোধন কর; তবে তিনি তোমার বাহ্যিক অবস্থাগুলো সংশোধন করে দিবেন।”(ইবনুল জাওযি;সাইদুল খাত্বের পৃষ্ঠা-২০৭) তবে উপরোক্ত হাদিসটির উদ্দেশ্য এ নয়: যে ব্যক্তি নির্জনে গুনাতে লিপ্ত হয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তি। কেননা সগিরা গুনাহ থেকে কেউই মুক্ত নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামম বলেছেন:”প্রত্যেক বনী আদম ভুলকারী সর্বোত্তম ভুলকারী হচ্ছে তওবাকারীগণ।”(সুনানে তিরমিযি হা/২৪৯৯), আলবানী ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন] বরং এ হাদিসের উদ্দেশ্য হচ্ছে: মুনাফিকগণ কিংবা লৌকিকতাতে আক্রান্ত ব্যক্তিগণ। যারা মানুষের সামনে নিজেদের দ্বীনদারি ও তাকওয়া প্রকাশ করে। আর যখন মানুষের চোখের আড়াল হয় তখন তারা তাদের আসল রূপে প্রকাশিত হয়। তারা আল্লাহ্ তাআলার মর্যাদাকে ভ্রুক্ষেপ করে না।
.
ইবনে হাজার আল-হাইছামী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:(الْكَبِيرَةُ السَّادِسَةُ وَالْخَمْسُونَ بَعْدَ الثَّلَاثِمِائَةِ: إظْهَارُ زِيِّ الصَّالِحِينَ فِي الْمَلَأِ وَانْتِهَاكُ الْمَحَارِمِ وَلَوْ صَغَائِرَ فِي الْخَلْوَةِ) أَخْرَجَ ابْنُ مَاجَهْ بِسَنَدٍ رُوَاتُهُ ثِقَاتٌ عَنْ ثَوْبَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: لَأَعْلَمَنَّ أَقْوَامًا مِنْ أُمَّتِي يَأْتُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِأَعْمَالٍ أَمْثَالِ جِبَالِ تِهَامَةَ بَيْضَاءَ فَيَجْعَلُهَا اللَّهُ هَبَاءً مَنْثُورًا…. الحديث ثم قال في آخر البحث:تَنْبِيهٌ: عَدُّ هَذَا هُوَ ظَاهِرُ الْحَدِيثِ الْأَوَّلِ وَلَيْسَ بِبَعِيدٍ وَإِنْ لَمْ أَرَ مَنْ ذَكَرَهُ؛ لِأَنَّ مَنْ كَانَ دَأْبُهُ إظْهَارَ الْحَسَنِ وَإِسْرَارَ الْقَبِيحِ يَعْظُمُ ضَرَرُهُ وَإِغْوَاؤُهُ لِلْمُسْلِمِينَ؛ لِانْحِلَالِ رِبْقَةِ التَّقْوَى وَالْخَوْفِ مِنْ عُنُقِهِ.
“৩৫৬ তম কবিরা গুনাহ: মানুষের সামনে নেককারদের ভাব প্রকাশ করা, আর নিভৃতে গুনাহতে লিপ্ত হওয়া; এমনকি সেটা ছগিরা গুনাহ হলেও। ইবনে মাজাহ এক সনদে সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, যে সনদের রাবীগণ ছিকাত (নির্ভরযোগ্য)। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন:”আমি আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু মানুষের কথা জানি যারা কিয়ামতের দিন তিহামা পাহাড়সম শুভ্র নেকী নিয়ে হাজির হবে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সে নেকগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধুলিকণাতে পরিণত করে দিবেন।…”এরপর এ আলোচনার শেষে তিনি বলেন: সতর্কতা: এ বিষয়টিকে কবিরা গুনাহর মধ্যে গণ্য করাটা প্রথম হাদিসটির বাহ্যিক মর্ম এবং তা অবান্তর কিছু নয়; যদিও আমি কাউকে কবিরা গুনাহর মধ্যে এটাকে উল্লেখ করতে দেখিনি। কেননা যে ব্যক্তির অভ্যাস হল সুন্দর ভাব ফুটিয়ে তোলা; আর মন্দ ভাবকে লুকিয়ে রাখা মুসলমানদের উপর তার অনিষ্ট ও ধোঁকা জঘন্য— তাকওয়ার রজ্জু ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে এবং তার পক্ষ থেকে ভয় থাকার কারণে।”(আল-জাওয়াযের আন ইকতিরাফিল কাবায়ির (৩৫৬) আমরা আল্লাহ্ তাআলার কাছে ক্ষমা ও নিরাপত্তার প্রার্থনা করছি।

পর্নোগ্রাফির আগ্রাসন ও পর্নো ওয়েবসাইট থেকে মুক্তির উপায়গুলো কি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
পর্নোগ্রাফির আসক্তি একটি ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি—যার চিকিৎসা অপরিহার্য। এই আসক্তির সর্বাধিক কার্যকর চিকিৎসা হলো এর মূল উৎস থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, স্বেচ্ছায় কিংবা প্রয়োজনে কঠোরভাবে। পাশাপাশি নিজের সময়কে দুনিয়া ও আখিরাতের উপকারী কাজে ব্যয় করা, যেন শয়তানের জন্য কোনো অবসর না থাকে।এছাড়া প্রয়োজনে একজন যোগ্য মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে; যাতে তিনি প্রয়োজনীয় ঔষধ,চিকিৎসা এবং পরামর্শের মাধ্যমে মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারেন।এছাড়াও পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ব্যক্তি কিভাবে এই ভয়াবহ পাপ থেকে মুক্তি পেতে পারেন এ সম্পর্ক নিম্নে আমরা কিছু উপদেশ ও পদক্ষেপ উল্লেখ করব:
(১) এই হারাম আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে নারী-পুরুষ উভয়কেই আত্মসংযম, ধৈর্য ও অবিচল পরিশ্রমের পথ অবলম্বন করতে হবে। এর জন্য করণীয় হলো—ইলেকট্রনিক ডিভাইস (যেমন মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদি) ব্যবহারে সতর্ক থাকা; কেননা এগুলোই প্রায়শই গুনাহের দরজা খুলে দেয়। রাসূল (ﷺ) বলেন,”নিশ্চয়ই চোখের যিনা হচ্ছে দেখা।”(সহীহ মুসলিম হা/৬৬৪৭)
.
(২) মন ও চিন্তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণকর কাজে যেমন—শিক্ষা, ইবাদত, দাওয়াহ, কিংবা কোনো সৃষ্টিশীল কাজে ব্যস্ত রাখা।সর্বক্ষণ আল্লাহভীতি হৃদয়ে জাগ্রত রাখা—গোপনে ও প্রকাশ্যে যেন সর্বদা স্মরণ থাকে, “আল্লাহ আমাকে দেখছেন।যখন কেউ আন্তরিকভাবে নিজের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করতে চায়, তখন আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তার জন্য মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। কবি বলেন:إذا ما خلوت الدهر يوماً فلا تقل خلوت ولكن قل علي رقيب ولا تحسبن الله يغفل ســاعـة ولا أن ما تخفي عليه يغيـب”যদি তুমি কোনো দিন একাকী হও তাহলে বলো না আমি একা; বরং বলো: আমার একজন পর্যবেক্ষক আছেন। কখনো মনে করো না যে আল্লাহ এক মুহূর্ত গাফেল হন, মনে করো না যে, তুমি তার থেকে যা গোপন করছ তা তিনি জানেন না।” অন্য একজন কবি বলেন:وإذا خلوت بريبة في ظلمة والنفس داعية إلى الطغيان فاستحي من نظر الإله وقل لها إن الذي خلق الظلام يراني”যদি তুমি অন্ধকারে নির্জনে কোনো সন্দেহজনক কাজ করতে চাও এবং মন তোমাকে সীমালঙ্ঘনের দিকে আহ্বান করতে থাকে, তখন আল্লাহর দৃষ্টিপাতকে লজ্জা করো এবং মনকে বলো: যিনি এই অন্ধকারের স্রষ্টা তিনি আমাকে দেখছেন।”(গৃহীত ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯৩৫১৯)।
.
(৩) এই অভ্যাস থেকে বাঁচার প্রেরণা যেন হয় আল্লাহ্র নির্দেশ পালন ও তাঁর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা।কেননা আল্লাহ বলেন:قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِهِمۡ وَ یَحۡفَظُوۡا فُرُوۡجَهُمۡ ؕ ذٰلِكَ اَزۡكٰی لَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ”মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে; এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।”(সূরা নূর:৩০) আয়াতটি ইঙ্গিত দেয় যে, ব্যভিচারের পথ থেকে বিরত থাকা এবং দৃষ্টিসীমা সংরক্ষণ করা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি মূলত চোখ ও দৃষ্টির দুষ্ট ব্যবহার থেকে উদ্ভূত।হাফেয ইবনে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,النظرة سهم سم إلى القلب ‘দৃষ্টি হচ্ছে এমন একটি তীর, যা মানুষের হৃদয়ে বিষের উদ্রেক করে”।(তাফসীর ইবনে কাসীর;খণ্ড;৩;পৃষ্ঠা;৩৭৬) আর হাদিসে এসেছে,আবু উমামা (রাঃ) বলেন,আমি রাসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,اكفلوا لي بست اكفل لكم بالجنة… غضوا ابصارهم “তোমরা ছয়টি বিষয়ে আমাকে নিশ্চয়তা দাও। তাহ’লে আমি তোমাদের জান্নাতের যিম্মাদার হব। (তার মধ্যে একটি হ’ল) তোমরা তোমাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী কর”।(মুসনাদে আহমাদ হা/২২৭৫৭)
.
(৪) স্থায়ী সমাধান তথা বিয়ের মাধ্যমে এ অভ্যাসকে প্রতিরোধ করা। কারণ এটাই ছিল যুবকদের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপদেশ।রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:,يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ-“হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে, তাদের বিবাহ করা কর্তব্য। কেননা বিবাহয় দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন ছিয়াম পালন করে। কেননা ছিয়াম হচ্ছে যৌবনকে দমন করার মাধ্যম”। (সহীহ বুখারী/৫০৬৫;সহীহ মুসলিম/১৪০০)
.
(৫) নানা রকম কু-চিন্তা ও খারাপ ভাবনা থেকে দূরে থাকা। দুনিয়া বা আখেরাতের কল্যাণকর চিন্তায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা। কারণ কু-চিন্তাকে বাড়তে দিলে সেটা এক পর্যায়ে কর্মের দিকে নিয়ে যায়। চূড়ান্ত পর্যায়ে তা নিয়ন্ত্রয়ের বাইরে গিয়ে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তখন তা থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
.
(৬) দৃষ্টিকে নত রাখা। কারণ কোন ব্যক্তি বা অশ্লীল ছবির দিকে দৃষ্টিপাত করা, সেটা জীবিত মানুষের হোক কিংবা আঁকা হোক, বাঁধহীন দৃষ্টি ব্যক্তিকে হারামের দিকে নিয়ে যায়। এ কারণে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন: “মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে”[সূরা নূর, আয়াত: ৩০] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তুমি দৃষ্টির পর দৃষ্টি দিবে না”[সুনানে তিরমিযি (২৭৭৭), আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন] তাই প্রথম দৃষ্টি, যে দৃষ্টি হঠাৎ করে পড়ে যায় সেটাতে গুনাহ না থাকলেও দ্বিতীয় দৃষ্টি হারাম। এছাড়া যে সব স্থানে যৌন উত্তেজনা জাগিয়ে তোলার উপকরণ বিদ্যমান থাকে সেসব স্থান থেকে দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়।একজন আরবী কবি বলেছেন,كل الحوادث مبداها من النظر+ ومعظم النار من مستصقر الشرر كم نظرة فتك في قلب صاحبها + فتك السهام بلا قوس ولا وتر والمرء ما دام ذا عين يقلبها + في اعين الغيد موقوف على الخطر يسر مقلته ما ضر مهجته + لا مرحبا بسرور عاد بالضرر،অর্থাৎ সমস্ত (যৌন) দুর্ঘটনার সূত্রপাত দৃষ্টি থেকেই হয়। অধিকাংশ অগ্নিকান্ড ঘটে ছোট অঙ্গার থেকেই। কত দৃষ্টি তার কর্তার হৃদয়কে ধ্বংস করেছে, ধনুক ও তারহীন তীরের মত। চোখওয়ালা মানুষ যতক্ষণ কামিনীদের চোখে চোখ রেখে বারবার দৃষ্টিপাত করে, ততক্ষণ সে বিপদের উপর দন্ডায়মান থাকে। যে জিনিস তার আত্মার জন্য ক্ষতিকর, তাই দিয়ে সে নিজের চক্ষুকে তুষ্ট করে। অথচ সেই খুশিকে কোন স্বাগতম নয়, যার পরিণাম হ’লো ক্ষতি।”(শাইখ আব্দুল হামীদ ফাইযী আল মাদানী; বই পাপ তার শাস্তি ও মুক্তির উপায়,পৃষ্ঠা; ৪০)
.
(৭) এ ধরণের কু-অভ্যাসের ফলে যেসব শারীরিক ক্ষতি ঘটে থাকে সেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। যেমন- দৃষ্টিশক্তি ও স্নায়ুর দুর্বলতা, প্রজনন অঙ্গের দুর্বলতা, মেরুদণ্ডের ব্যথা ইত্যাদি যেসব ক্ষতির কথা চিকিৎসকরা উল্লেখ করে থাকেন। অনুরূপভাবে বিভিন্ন মানসিক ক্ষতি; যেমন- উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মানসিক পীড়া অনুভব করা। এর চেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে-এগুলো দেখার পরে অনেকেই হস্তমৈথুন করে নামায নষ্ট করা। যেহেতু বারবার গোসল করা লাগে, যা করা কঠিন। বিশেষতঃ শীতের রাত্রিতে। অনুরূপভাবে রোযা নষ্ট করা।
.
(৮) কঠিন ইচ্ছা ও শক্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা। শয়তানের কাছে হার না মানা। একাকী না থাকা; যেমন একাকী রাত কাটানো। হাদিসে এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন পুরুষকে একাকী রাত কাটাতে নিষেধ করেছেন।[মুসনাদে আহমাদ, হাদিসটি ‘সহিহুল জামে’ তে রয়েছে]
.
(৯) ঘুমানোর সময় ইসলামী আদবগুলো মেনে চলা। যেমন- ঘুমানোর দোয়াগুলো পড়া, ডান পার্শ্বে কাত হয়ে শোয়া, পেটের উপর ভর দিয়ে না-ঘুমানো; যেহেতু এ সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিষেধ আছে।
.
(১০) ধৈর্য ও সংযমের গুণে নিজেকে ভূষিত করা। কারণ হারাম কাজ থেকে ধৈর্য রাখা আমাদের উপর ফরয; যদিও আমাদের মাঝে সেগুলো করার চাহিদা থাকে। আমাদের জানা উচিত, যদি আমরা নিজেকে সংযমী রাখার চেষ্টা করি তাহলে পরিশেষে সেটা ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য আখলাকে পরিণত হবে। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি সংযম অবলম্বন করে আল্লাহ্ তাকে সংযমী বানিয়ে দিবেন, যে ব্যক্তি অমুখাপেক্ষী থাকার চেষ্টা করবেন আল্লাহ্ তাকে অমুখাপেক্ষী বানিয়ে দিবেন, যে ব্যক্তি ধৈর্য রাখার চেষ্টা করবেন আল্লাহ্ তাকে ধৈর্যশীল বানিয়ে দিবেন। কোন মানুষকে ধৈর্যের চেয়ে প্রশস্ত ও কল্যাণকর আর কোন দান দেয়া হয়নি।”(সহিহ বুখারী হা/১৪৬৯)
.
(১১) কেউ যদি এই গুনাহটি করে ফেলে তাহলে তার উচিত অনতিবিলম্বে তওবা করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, নেকীর কাজ করা এবং ক্ষমাপ্রাপ্তির ব্যাপারে হতাশ না হওয়া। কেননা এ পাপটি একটি কবিরা গুনাহ।
.
(১২) সর্বশেষ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণ করে সাহায্য প্রার্থনা করা,দোয়ার মাধ্যমে তাঁর কাছে মিনতি করা, তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা এই কু-অভ্যাস থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উপায়। কেননা আল্লাহ্ তাআলা দোয়াকারীর ডাকে সাড়া দেন।আল্লাহ বলেন: “আর তোমাদের রব বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব”[সূরা গাফির, আয়াত: ৬০] রাসূল (ﷺ) বলেন:وَمَنْ يَتَصَبَّرْ يُصَبِّرْهُ اللهُ وَمَا أُعْطِيَ أَحَدٌ عَطَاءً خَيْرًا وَأَوْسَعَ مِنْ الصَّبْرِ”যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাকে সবর দান করেন। সবরের চেয়ে উত্তম ও ব্যাপক কোন নি‘আমত কাউকে দেয়া হয়নি।”(সহীহ বুখারী হা/১৪৬৯)
.
অতএব, আমাদের মুসলিম যুবসমাজের জন্য অত্যন্ত জরুরি হলো—পর্নোগ্রাফির ভয়াবহ ক্ষতি অনুধাবন করা এবং তা থেকে আত্মরক্ষার কার্যকর পথ গ্রহণ করা। সচেতনতা, ধৈর্য ও আত্মসংযমের মাধ্যমে আমরা এ মারাত্মক আসক্তি ও তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। পরিশেষে, আমরা আল্লাহ্ তাআলার কাছে ক্ষমা, হিদায়াত ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করি। নিশ্চয়ই আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।