Wednesday, September 10, 2025

ইসলামের দৃষ্টিতে মৃতের লাশ কে অপমান করা বা কবর থেকে তুলে তা পুড়িয়ে ফেলার বিধান

 ইসলামের দৃষ্টিতে মৃতের লাশ কে অপমান করা বা কবর থেকে তুলে তা পুড়িয়ে ফেলার বিধান: (প্রসঙ্গ: নুরাল পাগলার লাশ পুড়ানোর ঘটনা)।

ইসলামের দৃষ্টিতে মৃত ব্যক্তির সম্মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ━তা সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম, মুরতাদ (ইসলামচ্যুত) হোক বা ফাসেক (পাপীষ্ঠ) হোক। মৃত ব্যক্তির লাশ কবর থেকে তুলে অসম্মান করা কিংবা পুড়িয়ে ফেলা অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ। এমনকি কোনও অমুসলিমের লাশ বা তার কবরকেও অপমান-অপদস্থ করা ইসলামে জায়েজ নয়।
◆ সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি, আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বাজ (রহ.)-কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়:
প্রশ্ন: কাফেরদের কবর কি অপমান করা বা অসম্মান করা বৈধ? উত্তরে তিনি বলেন,
لا، تُزار بس، بدون إهانة؛ لذِكْر الآخرة، إذا زارها من أجل ذِكْر الآخرة فقط
“না, কাফেরদের কবর অসম্মান করা জায়েজ নয়। যদি কেউ কবর জিয়ারত করতে চায় তবে তা শুধুমাত্র পরকালের কথা স্মরণ করার উদ্দেশ্যে করা যেতে পারে━কোনও অসম্মান বা অবমাননা ছাড়া।”
❑ শত্রুর মৃত দেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলার ব্যাপারে শাইখ বিন বায রাহ.-এর আরও কিছু প্রশ্নোত্তর:
প্রশ্ন: কা**ফের শত্রুকে আগুনে পুড়িয়ে মারা━এটার বিধান কী?
উত্তর: না, তাদেরকে আগুনে পোড়ানো যাবে না-যদি না তারা নিজেরা আগে (মুসলিম যোদ্ধাদেরকে) পুড়িয়ে থাকে।
প্রশ্ন: অর্থাৎ এটা কি প্রতিশোধের অংশ হিসেবে?
উত্তর: হ্যাঁ।
প্রশ্ন: একইভাবে, অঙ্গহানি করা?
উত্তর: এটাও প্রতিশোধ হিসেবে করা যায়। তবে অঙ্গহানি না করাই উত্তম; কারণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ولا تُمَثِّلوا “তোমরা অঙ্গহানি করো না।”
প্রশ্ন: যদি তারা নিজেরা অঙ্গহানি করে থাকে তখনও কি?
উত্তর: তখনও অঙ্গহানি না করাই উত্তম, যদিও তারা তা করে থাকে।
প্রশ্ন: আলী ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু কি তাঁর অনুসারী শিয়াদেরকে আগুনে পুড়িয়েছিলেন?
উত্তর: সাহাবিগণ রাদিয়াল্লাহু আনহুম এ কাজের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি তাদের ওপর প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়েছিলেন। কারণ তারা বলেছিল: ‘আপনিই আল্লাহ’! (আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন)।
তাই তাদের ওপর প্রচণ্ড রাগের কারণে তিনি তাদের পুড়িয়ে মেরেছিলেন। তবে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু যেমনটি বলেছিলেন: “যদি তিনি তাদের তলোয়ার দিয়ে হত্যা করতেন তবে তা উত্তম হতো।” আর এটাই করা উচিত। কারণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথার ওপর কারো কথাকে প্রাধান্য দেওয়া যায় না-না আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর কথা, না অন্য কারো। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা সবার কথার ওপর প্রাধান্য পাবে। [উৎস: বিন বায রাহ.- এর অফিসিয়াল ওয়ােব সাইট binbaz]
◆ ইসলামের যুদ্ধনীতিতেও এই মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা যায়। জিহাদের ময়দানে নিহত কাফেরদের ‘মুসলা’ বা অঙ্গহানি করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
غزوا بسم الله، وفي سبيل الله، وقاتلوا من كفر بالله، اغزوا ولا تغلوا، ولا تغدروا، ولا تمثلوا، ولا تقتلوا وليدا، ولا أصحاب الصوامع
“তোমরা আল্লাহর নামে, আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করো। যারা আল্লাহর সাথে কুফরি করে, তাদের সাথে যুদ্ধ করো। যুদ্ধ করো, তবে তোমরা সম্পদ আত্মসাৎ করবে না, বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, অঙ্গচ্ছেদ করবে না, শিশুদেরকে হত্যা করবে না এবং উপাসনালয়ের সাধু-সন্ন্যাসীদের হত্যা করবে না।” [সহিহ মুসলিম]
◆ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবিগণ অসংখ্য যুদ্ধে বিজয় লাভ করেছেন। কিন্তু এমন একটিও ঘটনা পাওয়া যায় না যে, তাঁরা কোনও পরাজিত শক্তির মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা তো দূরের কথা বরং সেগুলোর সাথে কোনও বর্বর আচরণ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে ইসলাম মানুষকে মানবিকতা, নৈতিকতা, সভ্যতা ও শৃঙ্খলা শিক্ষা দেয়। উশৃঙ্খলতা, বর্বরতা এবং অমানবিক কার্যক্রম ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুতরাং সম্প্রতি রাজবাড়ির কথিত ইমাম মাহদির দাবিদার এবং শরিয়ত বিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রবর্তক নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি শরিয়ত বহির্ভূত এবং সভ্যতা পরিপন্থী কাজ। এটি ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ, অন্ধ এবং আবেগপ্রবণ জ্ঞানকাণ্ডহীন কিছু মানুষের কাজ। আমরা এই ধরনের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। পাশাপাশি, নুরাল পাগলা কর্তৃক প্রবর্তিত শরিয়ত বিরোধী কাজগুলো বন্ধ করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

মিলাদ বা মাওলিদ অনুষ্ঠানের বিধান এবং যে তা পালন করে তার পেছনে সালাতের বিধান

 প্রশ্ন: মিলাদুন্নবী পালনের বিধান কী? এবং যারা এই কাজ করে, বিশেষ করে যখন সে কোনো মসজিদের ইমাম এবং খতিব হয় তাদের ব্যাপারে শরিয়তের বিধান কী? তার পেছনে সালাত পড়া জায়েজ হবে কি? আমি যখন কাউকে বলি যে, এটি একটি নিকৃষ্ট বিদআত তখন সে খুব বিরক্ত হয় এবং সহিহ মুসলিমের একটি হাদিস দিয়ে যুক্তি দেখায়, যেখানে বলা হয়েছে যে, সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার ফজিলত আছে। আর এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, সোমবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এসব মানুষের ব্যাপারে আমরা কী করব? বিশেষ করে যখন তারা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত? ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ আপনাকে আমাদের এবং সকল মুসলিমকে এর পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দিন।

উত্তর: সাধারণভাবে ​জন্মোৎসব পালন করা একটি নব আবিষ্কৃত বিদআত। মিলাদুন্নবী বা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া রাহমাতুল্লাহ-এর জন্মোৎসবও এই বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। এটি মুসলিমদের মধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে অথচ তা নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবিগণ, যেমন: খোলাফায়ে রাশেদিন প্রমূখ তা পালন করেননি। এমনকি প্রথম শ্রেষ্ঠ তিন প্রজন্মের মুসলিমরাও এটি পালন করেননি। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সহিহ হাদিসে বলেছেন:
من عمل عملًا ليس عليه أمرنا فهو رد
​“যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করবে, যার ব্যাপারে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।”
​তিনি আরও বলেছেন:
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه؛ فهو رد
​“যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু তৈরি করবে যা এর অংশ নয় তা প্রত্যাখ্যাত।”
​সুতরাং মুসলিমদের উপর অপরিহার্য হল, এই ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকা এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত অনুসরণ করা এবং তার নির্দেশনা মেনে চলা। মিলাদুন্নবী পালনের কোনো ভিত্তি নেই। বরং এটি একটি বিদআত যা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। একজন মুসলিমের জন্য জরুরি হল, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করা, তার শরিয়ত ও সুন্নাতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তার পথে চলা। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
​قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ
​“বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।” [সূরা আলে ইমরান: ৩১] ​এবং তিনি আরও বলেছেন:
​وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
​“রসুল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ করো এবং যা থেকে নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো।” [সূরা হাশর: ৭]
​অতএব তার প্রতি ভালোবাসা, তাকে অনুসরণ করা, তার নির্দেশনা গ্রহণ করা এবং যা থেকে তিনি নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। এটিই একজন মুসলিমের দায়িত্ব। মিলাদ বা অন্য কোনো বিদআত দ্বীনের মধ্যে জায়েজ নয়। বরং তা পরিহার করা আবশ্যক। মিলাদ উদযাপন, কবরের উপর স্থাপনা নির্মাণ, কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা এবং কবরের নিকটে সালাত আদায় করা—এগুলো সব নব আবিষ্কৃত বিদআত। একইভাবে, রজব মাসের ২৭ তারিখে ইসরা ও মিরাজের অনুষ্ঠান পালন করাও বিদআত।কারণ শরিয়তে এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই।
🟢 মিলাদ পালনকারী ​ইমামের পেছনে সালাত: ​যে ইমাম লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করেন তাকে এই ধরনের কাজ (মিলাদ) থেকে বিরত থাকার জন্য নসিহত করা উচিত। তবে তার পেছনে সালাত সহিহ হবে যদি তার মধ্যে শুধুমাত্র মিলাদের বিদআত থাকে। কারণ এটি একটি বিদআত; কুফর নয়। ​তবে যদি সেই মিলাদ অনুষ্ঠানে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডাকা হয় এবং তার কাছে সাহায্য চাওয়া হয় তবে এটি বড় কুফর। যদি তারা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডাকে, তার কাছে সাহায্য চায় এবং তার উদ্দেশ্য মানত করে তবে তা বড় কুফর। ​অন্যদিকে শুধু মিলাদ পালন, খাবার বিতরণ, মানুষ একত্রিত হওয়া এবং শিরকমুক্ত কসিদা (কবিতা) পাঠ করা—এটি বিদআত। তবে যদি কসিদার মধ্যে শিরক থাকে, যেমন বুসারির লেখা বুরদা কবিতার এই অংশ:
​يَا أَكْرَمَ الْخَلْقِ مَا لِي مَنْ أَلُوذُ بِهِ سِوَاكَ عِنْدَ حُدُوثِ الْحَادِثِ الْعَمَمِ
​إِنْ لَمْ تَكُنْ فِي مَعَادِي آخِذًا بِيَدِي فَضْلًا وَإِلَّا فَقُلْ يَا زَلَّةَ الْقَدَمِ
​فَإِنَّ مِنْ جُودِكَ الدُّنْيَا وَضَرَّتَهَا وَمِنْ عُلُومِكَ عِلْمَ اللَّوْحِ وَالْقَلَمِ
​“হে সৃষ্টির সেরা, মহাবিপদের সময় আপনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই, যার কাছে আমি আশ্রয় নিতে পারি।”
​“যদি আপনি কিয়ামতের দিন অনুগ্রহ করে আমার হাত না ধরেন, তাহলে আমার পতন অবশ্যম্ভাবী।”
​“আপনার দানশীলতা থেকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই এসেছে এবং আপনার জ্ঞানের অংশ হলো লাওহ ও কলমের জ্ঞান।”
​যে ব্যক্তি এসব বিশ্বাস করে, সে কাফের হয়ে যাবে। আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই। ​সুতরাং মুসলিমদের উপর অপরিহার্য হল, শিরক এবং সকল প্রকার বিদআত থেকে দূরে থাকা, এবং একে অপরকে এই কাজগুলো ত্যাগ করার জন্য নসিহত করা। দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা, শেখা এবং সুন্নাতের অনুসারী আলেমদের কাছে এই বিদআত সম্পর্কে প্রশ্ন করা উচিত। আমরা সকলের জন্য হেদায়েত, সাফল্য এবং অন্তর্দৃষ্টি কামনা করি।
▪️​ উপস্থাপক: মান্যবর শাইখ,
​সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার হাদিস দ্বারা মিলাদের দলিল পেশ করা কতটা সঠিক?
উত্তরে‌ শাইখ বলেন,
আবু কাতাদা থেকে বর্ণিত হাদিস যেখানে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সোমবারের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এবং তিনি বলেছিলেন:
ذلك يوم ولدت فيه، وبعثت فيه
“এটি সেই দিন যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং যেদিন আমাকে নবি হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।”
এটি তাদের জন্য কোনো দলিল হতে পারে না। এই হাদিসটি কেবল সোমবার রোজা রাখার বৈধতা প্রমাণ করে। সোমবার রোজা রাখা যায়। কারণ এই দিনে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছেন এবং এই দিনে তার ওপর ওহি নাজিল হয়েছে।
এছাড়াও এই দিনে এবং বৃহস্পতিবার আল্লাহর কাছে বান্দার আমল পেশ করা হয়। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন এবং বলতেন:
إنهما يومان تعرض فيهما الأعمال على الله؛ فأحب أن يعرض عملي وأنا صائم
“এই দুটি দিনে আল্লাহর কাছে আমল পেশ করা হয়। তাই আমি চাই যে আমার আমল পেশ করার সময় আমি রোজা থাকি।”
​সুতরাং সোমবার রোজা রাখা ভালো। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন রোজা রেখেছেন, তেমনি এটি করা উচিত। তিনি বলেননি যে, এই দিনটিকে উৎসব বা ঈদ হিসেবে পালন করতে হবে। বরং কেবল রোজা রাখার বিধান দিয়েছেন। তাই যে রোজা রেখেছে সে উত্তম কাজ করেছে। কিন্তু যে ব্যক্তি মিলাদের আয়োজন করে, খাবার বিতরণ করে এবং কবিতা পাঠের মাধ্যমে উৎসব পালন করে, এটি বিদআত। এ দুটির মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

ইমাম যদি রুকুর আগে ও পরে হাত তোলার মতো কিছু সুন্নাহ ত্যাগ করেন তাহলে কি মুসল্লিকে ইমামের অনুসরণ করতে হবে

প্রশ্ন: ইমাম যদি রুকুর আগে ও পরে হাত তোলার মতো কিছু সুন্নাহ ত্যাগ করেন তাহলে কি মুসল্লিকে ইমামের অনুসরণ করতে হবে নাকি সুন্নাহর অনুসরণ করা উত্তম?
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর ইমাম শব্দের অর্থ নেতা। তিনি মাননীয় ও অনুসরণীয়।সালাত আদায়ে তিনি নেতৃত্ব দেন। সকল শ্রেণীর মুসল্লী তার নেতৃত্বে সালাতে রুকু সিজদা আদায় করেন, উঠেন ও বসেন। তার তাকবীর ধ্বনি শুনে সকলে তার অনুকরণ ও অনুসরণ করেন, কেউই তা লঙ্ঘন করে না। ইমামের এরূপ অনুসরণই হলো ইক্তিদা। ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সালাতে ইমামের অনুসরণ করা ওয়াজিব।কারন রাসূল (ﷺ) বলেন, إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ “ইমাম নিযুক্ত করা হয়, কেবল তাঁকে অনুসরণ করার জন্য”।(সহীহ বুখারী হা/৩৭৮) এখানে অনুসরণ করার অর্থ হলো,ইমাম কোনো কাজ শেষ করার পরপরই মুক্তাদির সেই কাজটি শুরু করা।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; হাশিয়াতু ইবনে কাসিম খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২৮৫; ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি; আলা জাদিল মুস্তাকনি; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৬৯; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৪৪৫৮)
.
সালাতে ইমাম যদি কোনো সুন্নাহ ত্যাগ করেন তাহলে মুক্তাদির করণীয় হলো যে আমলকে তিনি সুন্নাত মনে করেন, ইমাম তা করুন বা না করুন, তিনিও তা পালন করবেন। তবে যদি সেই আমল করার কারণে ইমামের অনুসরণ ব্যাহত হয় অর্থাৎ তিনি ইমামের থেকে এগিয়ে যান কিংবা পেছনে পড়ে যান তাহলে এ অবস্থায় ইমামের অনুসরণকে অগ্রাধিকার দিয়ে সুন্নাত আমলটি ছেড়ে দেবেন। প্রশ্নে উল্লিখিত বিষয় (রুকুতে যাওয়ার আগে ও পরে হাত তোলা) ইমামের অনুসরণে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না। সুতরাং মুক্তাদির জন্য এ কাজ করা উচিত। কিন্তু যে আমলের কারণে অনুসরণ ব্যাহত হয়, তার উদাহরণ হলো: যদি মুক্তাদি জলসাতুল ইস্তেরাহাহ (বিশ্রামের জন্য অল্পক্ষণ বসা) করতে চান অথচ ইমাম তা না করেন, তবে এ ক্ষেত্রে মুক্তাদির উচিত হবে ইমামের অনুসরণে সেই আমলটি ছেড়ে দেওয়া।(বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৪৪৫৮)
.
​শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,وَإِنْ تَرَكَ الإِمَامُ جلْسَةَ الاسْتِرَاحَةِ أَتَى بِهَا الْمَأْمُومُ , قَالَ أَصْحَابُنَا (يعني الشافعية) : لأَنَّ الْمُخَالَفَةَ فِيهَا يَسِيرَةٌ ا”যদি ইমাম ‘জলসাতুল ইস্তিরাহা’ (বিশ্রামের বসা) ছেড়ে দেন,তবে মুক্তাদি তা আদায় করবে। আমাদের শাফি‘ঈ মাযহাবের আলেমগণ বলেছেন:
কারণ এতে ইমামের সাথে ভিন্নতা খুবই সামান্য।”(ইমাম নববী; আল-মাজমু; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৪০)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন:
الشيء الذي لا يقتضي التَّأخُّر عن الإمام ولا التَّقدُّم عليه فهذا يأخذ المأموم بما يراه ، مثاله : لو كان الإمام لا يرى رفع اليدين عند التَّكبير للرُّكوع والرَّفع منه والقيام من التَّشهد الأوَّل ، والمأموم يرى أن ذلك مستحبٌّ ، فإنه يفعل ذلك ؛ لأنه لا يستلزم تأخراً عن الإمام ولا تقدُّماً عليه ، ولهذا قال الرَّسول صلّى الله عليه وسلّم : (إذا كَبَّر فكبِّروا ، وإذا ركع فاركعوا ، وإذا سجد فاسجدوا) والفاء تدلُّ على التَّرتيب والتَّعقيب ، وكذلك أيضاً : لو كان الإمام يَتورَّكُ في كلِّ تشهُّد يعقبه سَلام حتى في الثُّنائيَّة ، والمأموم لا يرى أنه يَتورَّك إلا في تشهُّد ثانٍ فيما يُشرع فيه تشهُّدان ، فإنه هنا له ألا يتورَّك مع إمامه في الثُّنائيَّة ؛ لأن هذا لا يؤدِّي إلى تخلُّف ولا سبق
“যে সব কাজ ইমামের থেকে পিছিয়ে পড়া বা তার আগে এগিয়ে যাওয়ার কারণ হয় না, সে ক্ষেত্রে মুক্তাদির জন্য তার নিজের মত অনুসরণ করা বৈধ। উদাহরণস্বরূপ: যদি ইমাম রুকুতে যাওয়ার সময়, রুকু থেকে উঠার সময় এবং প্রথম তাশাহুদের পর দাঁড়ানোর সময় তাকবীরের সাথে হাত তোলাকে পছন্দ না করেন, অথচ মুক্তাদি তা মুস্তাহাব মনে করেন, তবে তিনি (মুক্তাদি) তা করতে পারেন। কারণ এতে ইমামের থেকে না পিছিয়ে পড়া হয়, না এগিয়ে যাওয়া হয়। এই কারণেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “যখন তিনি তাকবীর দেন,তখন তোমরাও তাকবীর দাও। যখন তিনি রুকু করেন, তখন তোমরাও রুকু করো। আর যখন তিনি সিজদাহ করেন, তখন তোমরাও সিজদাহ করো।” এখানে “فـ (ফা)” অক্ষরটি নির্দেশ করছে তাৎক্ষণিকতা ও ক্রমান্বয়। একইভাবে যদি কোনো ইমাম প্রত্যেক তাশাহুদের পর তাওয়াররুক (বসার একটি নির্দ্বিষ্ট পদ্ধতি) করেন এমনকি দুই রাকাআত বিশিষ্ট নামাজেও অথচ মুক্তাদির মতে দুই রাকাআত বিশিষ্ট নামাজে তাওয়াররুক করা বৈধ নয়; বরং দুই তাশাহহুদ বিশিষ্ট নামাজের দ্বিতীয় তাশাহুদের ক্ষেত্রেই কেবল তাওয়াররুক করা বৈধ, তাহলে এই ক্ষেত্রে মুক্তাদির জন্য ইমামের সাথে দুই রাকাআত বিশিষ্ট নামাজে তাওয়াররুক না করলে অসুবিধা নেই। কারণ এতে ইমামের সাথে না পিছিয়ে পড়া হয়, না তার আগে এগিয়ে যাওয়া হয়।”(ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি; আলা জাদিল মুস্তাকনি; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩১৯-৩২০)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬

উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি। 

মৃত ব্যক্তির কবর স্থানান্তর করা বা কবর থেকে হাড় উত্তোলন করে অন্য স্থানে দাফন করার শারঈ হুকুম কি

ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর মহান আল্লাহ তাআলা বনী আদমকে সম্মানিত করেছেন এবং তাদেরকে এমন সব বৈশিষ্ট্য ও গুণে ভূষিত করেছেন, যা অন্য কোনো সৃষ্টির মধ্যে নেই। এজন্য মুসলিম নর-নারী জীবিত অবস্থায় যেমন মর্যাদার অধিকারী, মৃত্যুর পরও তাদের সেই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে। তাই একবার কোনো মৃতদেহ দাফন করা হলে তাকে সেই কবরেই রাখা আবশ্যক, যতক্ষণ না পর্যন্ত তার দেহ সম্পূর্ণরূপে মাটির সাথে মিশে বিলীন হয়ে যায় এবং আর কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট না থাকে। এখন প্রশ্ন হলো শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন কোন পরিস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির কবর স্থানান্তর করা বা কবর থেকে হাড় উত্তোলন করে অন্য স্থানে দাফন করা বৈধ গণ্য হবে?
.
জবাবে বলা যায়, শারই দৃষ্টিকোণ থেকে কবর থেকে মৃতদেহ স্থানান্তর বা হাড় উত্তোলন করে অন্য স্থানে দাফন করার দুটি অবস্থা হতে পারে।যার মধ্যে একটি পদ্ধতি সরাসরি নিষিদ্ধ অপরটি শরীয়ত সম্মত ওজরের কারণে বৈধ।
▪️(ক).নিষিদ্ধ অবস্থা: শারঈ দৃষ্টিকোন থেকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিনা কারণে কবর খনন করে লাশ উত্তোলন করা,গোরস্থান এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা কিংবা মৃত ব্যক্তির হাড় বের করে অন্য জায়গায় দাফন করা বৈধ নয়।কারন তাতে লাশের অসম্মান করা হয়।তাছাড়া মুসলিম ব্যক্তিকে তার জীবদ্দশায় যেমন কষ্ট দেওয়া যায় না। তেমনি মৃত্যুর পরেও কষ্ট দেওয়া যাবে না।আম্মাজান আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত,রাসূল (ﷺ) বলেন, كَسْرُ عَظْمِ الْمَيِّتِ كَكَسْرِهِ حَيًّا”মৃত ব্যক্তির হাঁড়ভাঙ্গা যেন তার জীবিত কালের হাঁড় ভাঙ্গার মতোই’ (আবূ দাঊদ হা/৩২০৭; সহীহ আত তারগীব হা/৩৫৬৭; সহীহ আল জামি‘ আস সগীর হা/৪৪৭৮; ইবনু হিব্বান হা/৩১৬৭) উক্ত হাদীসের আলোকে আল্লামা ত্বীবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, জীবিত ব্যক্তিকে যেমন অপমান-অপদস্ত ও লাঞ্ছিত করা যায় না ঠিক তেমনিভাবে মৃত ব্যক্তিকে অনুরূপ অবজ্ঞা ও অবহেলা করা যাবে না। ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “জীবিত ব্যক্তির হাঁড় ভাঙ্গলে যেরূপ গোনাহ হয়, মৃত ব্যক্তির হাঁড় ভাঙ্গলেও তদ্রুপ গোনাহ হয়”(আত তাহমিদ; খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ১৪৪)
.
শাইখুল ইসলাম নাসিরুল হাদীস ফাক্বীহুল মিল্লাত ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফি‘ঈ আল-মাক্কী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৫০ হি: মৃত: ২০৪ হি.] বলেছেন:فيمن حفر فوجد عظام ميت : “وإن أخرجت عظام ميت أحببت أن تعاد فتدفن”কেউ যদি খনন করতে গিয়ে মৃতের হাড় পায় আর যদি মৃতের হাড় বের করা হয়, তবে আমি পছন্দ করি সেগুলো পুনরায় ফেরত দিয়ে দাফন করা হোক।”(আল উম্ম; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩১৬)।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:وَأَمَّا نَبْشُ الْقَبْرِ فَلَا يَجُوزُ لِغَيْرِ سَبَبٍ شَرْعِيٍّ بِاتِّفَاقِ الْأَصْحَابِ “শারঈ কোনো কারণ ছাড়া কবর খনন করা বৈধ নয় এ ব্যাপারে সব সাহাবীরা (শাফেয়ী মাযহাবের আলেমগণ) একমত।”(নববী আল মাজমূ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৭৩)।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,وَإِنْ تَيَقَّنَ أَنَّ الْمَيِّتَ قَدْ بَلِيَ وَصَارَ رَمِيمًا , جَازَ نَبْشُ قَبْرِهِ , وَدَفْنُ غَيْرِهِ فِيهِ ، وَإِنْ شَكَّ فِي ذَلِكَ رَجَعَ إلَى أَهْلِ الْخِبْرَةِ . فَإِنْ حَفَرَ , فَوَجَدَ فِيهَا عِظَامًا دَفَنَهَا , وَحَفَرَ فِي مَكَان آخَرَ . نَصَّ عَلَيْهِ أَحْمَدُ “যদি কেউ নিশ্চিত হয় যে মৃত ব্যক্তি (মৃতদেহ) সম্পূর্ণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, তবে তার কবর খুঁড়ে অন্য কাউকে সেখানে দাফন করা বৈধ। আর যদি এতে সন্দেহ থাকে, তবে সে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নেবে। যদি কবর খুঁড়ে হাড় পাওয়া যায়, তবে তা আবার ঢেকে দেয়া হবে এবং অন্য স্থানে কবর খনন করা হবে। এই বিষয়টি ইমাম আহমদও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।”(ইবনু কুদামাহ; আল-মুগনী; খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৯৪)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন:
فالأصل أنه لا يجوز نبش قبر الميت وإخراجه منه ؛ لأن الميت إذا وضع في قبره فقد تبوأ منزلا وسبق إليه فهو حبْسٌ عليه ، ليس لأحد التعرض له ، ولا التصرف فيه ؛ ولأن النبش قد يؤدي إلى كسر عظم الميت وامتهانه .وإنما يجوز نبش قبر الميت وإخراجه منه إذا دعت الضرورة إلى ذلك ، أو مصلحة إسلامية راجحة يقررها أهل العلم
“মূলনীতি হলো, মৃতের কবর খনন করে তাকে বের করা বৈধ নয়। কারণ মৃত যখন তার কবরস্থানে রাখা হয়, তখন সেটাই তার আস্তানা হয়ে যায় এবং সে সেখানে পৌঁছে গেছে; তাই সেটি তার জন্যই সংরক্ষিত, অন্য কারও সেখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। আর কবর খনন করলে মৃতের অস্থি ভেঙে যাওয়া বা তার অসম্মান হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে কেবল তখনই বৈধ হবে, যখন জরুরি প্রয়োজন দেখা দেয়, অথবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী স্বার্থ থাকে, যেটি আলেমগণ নির্ধারণ করবেন।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ১২২)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য,বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,যদি কোন কবরে কোন মাইয়্যেতকে দাফন করা হয় এবং সেটা যদি স্থায়ীভাবে বেঁধে ফেলে তাহলে সেটা তার জন্যই অগ্রাধিকার। তাতে খুবই জরুরী প্রয়োজন ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে কবরস্থ করা যাবে না। (ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘ খন্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩৬৯)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেসা করা হয়েছিল:“আমাদের এখানে মৃতদেহ রাখার জন্য একটি ঘর রয়েছে, যা মাটির নিচে নির্মিত কক্ষের মতো। সেখানে মৃতদেহ রাখা হয়। এক বছর পর সেই কবর পুনরায় খোলা হয় এবং সেখানে আরেকটি মৃতদেহ রাখা হয়। সেক্ষেত্রে কি এমন হতে পারে যে যদি একজন মৃত ব্যক্তি অপরাধী হয়ে শাস্তি ভোগ করে, তবে একই কবরে থাকা সৎকর্মশীল ব্যক্তি তার কারণে কষ্টভোগ করবে?” তিনি উত্তরে বলেছেন:السنة أن يقبر كل إنسان على حدة مع القدرة ، إذا اتسعت الأرض ، وأمكن قبر كل واحد على حدة فهذا هو السنة ، كما كان النبي صلى الله عليه وسلم في البقيع يقبرون الموتى هكذا ، كل واحد على حده ، أما إذا حصل ضرورة ولم يوجد مكان إلا هكذا فلا حرج ، وكل يؤاخذ بذنبه ، المحسن يجازى بإحسانه ، والمسيء يجازى بإساءته ( وَلاَ تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى ) لكن مهما أمكن فالمشروع أن يدفن كل واحدٍ على حدة ، كل قبر على حدة ، ولا يجمع في محل واحد “
“সুন্নাত হল প্রত্যেক ব্যক্তিকে সম্ভব হলে আলাদাভাবে দাফন করা। যদি জমি প্রশস্ত হয় এবং প্রত্যেককে আলাদাভাবে দাফন করা সম্ভব হয় তাহলে এটিই সুন্নত। যেমনভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার বাকি কবরস্থানে প্রতিটি মাইয়্যেতকে পৃথকভাবে দাফন করেছেন।কিন্তু যদি কোনো প্রয়োজন দেখা দেয় এবং আলাদা জায়গা না পাওয়া যায়,তাহলে একই জায়গায় দাফনে কোনো দোষ নেই।প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ আমলের দায়ভার বহন করবে—সৎকর্মকারী তার সৎকর্মের প্রতিদান পাবে আর দুষ্কর্মকারী তার দুষ্কর্মের শাস্তি ভোগ করবে।কেননা আল্লাহ বলেছেন: “কোনো বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না।” (সূরা আন‘আম: ১৬৪; সূরা ফাতির: ১৮) তবে শরিয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী, যতটুকু সম্ভব প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির জন্য পৃথক কবর খোঁড়া উচিত। প্রত্যেককে স্বতন্ত্রভাবে দাফন করা জরুরি এবং এক কবরের মধ্যে একাধিক মৃতদেহ একত্র করা জায়েজ নয়।”(ইবনু বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-১৪০৯১)
.
▪️(খ).জায়েজ অবস্থা: যদি শরীয়তসম্মত অপরিহার্য কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে মৃত ব্যক্তির কবর স্থানান্তর করা বা কবর থেকে অস্থি উত্তোলন করে অন্য স্থানে পুনরায় দাফন করা বৈধ হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য। মৃতদেহের অবশিষ্টাংশ যেন কোনোভাবেই অসম্মানিত না হয় সেদিকে গভীরভাবে লক্ষ্য রেখে অত্যন্ত যত্ন ও মর্যাদার সাথে তা বহন করতে হবে। এছাড়াও, যদি কবরটি পুরাতন হয়ে মাটির সাথে মিশে বিলীন হয়ে যায়,এবং সেখানে মৃত ব্যক্তির হাড়সহ কোন চিহ্নই যদি অবশিষ্ট না থাকে, তাহলে প্রয়োজন হলে সেখানে নতুন করে মাটি ভরাট করা সেই জমি চাষাবাদসহ নানাবিধ কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করা বৈধ হবে।
.
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) তার সহীহ বুখারীতে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এভাবে যে,”هَلْ يُخْرَجُ الْمَيِّتُ مِنْ الْقَبْرِ وَاللَّحْدِ لِعِلَّةٍ”কোন কারণে মৃতদেহকে কবর বা লাহ্দ হতে বাহির করা যাবে কি?।(সহীহ বুখারী অধ্যায় নং-২৩, অনুচ্ছেদ নং-৭৭)। অতঃপর তিনি হাদিস উল্লেখ করেছেন,জাবির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমার পিতার সাথে (একই কবরে) অন্য এক লোককে দাফন করা হয়েছিল। তাই আমি তার মরদেহকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করার ইচ্ছা করলাম। অতঃপর ছয় মাস পর আমি পিতার মৃতদেহকে তুললাম (এবং অন্যত্র দাফন করলাম)। (যেহেতু তিনি উহুদের দিন শহীদ হয়েছিলেন তাই) তাঁর শরীরের কোন অংশই পরিবর্তন হয়নি। কেবল দাড়ির কিছু চুল মাটির সংস্পর্শে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল’ (সহীহ বুখারী হা/১৩৫১, ১৩৫২)।
.
উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, وفي حديث جابر دلالة على جواز الإخراج لأمر يتعلق بالحي “জাবির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত এই হাদীসটি প্রমাণ করে যে, বিশেষ প্রয়োজনে মরাদেহ বাহির করা জায়েয।(ফাৎহুল বারী; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২১৫)।অনুরূপভাবে মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু) একটি পানির নহর প্রবাহিত করার জন্য ওহোদ যুদ্ধে শহীদ কতিপয় সাহাবীর কবর খনন করে তাঁদের লাশ অন্যত্র দাফনের ব্যবস্থা করেন।”(কিতাবুল জিহাদ; পৃষ্ঠা: ৯৮; মাওয়াহিবুল জালীল; খণ্ড: ৬;
পৃষ্ঠা: ২০; আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফাতওয়া নং-৩০৬৩৫৫)।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] তার আল মিনহাজ-এ বলেছেন:ونبشه بعد دفنه للنقل وغيره: حرام ، إلا لضرورة؛ بأن دفن بلا غسل أو في أرض أو ثوب مغصوبين، أو وقع فيه مال، أو دفن، لغير القبلة”দাফনের পর মৃতকে স্থানান্তরের জন্য বা অন্য কারণে কবর খনন করা হারাম, তবে প্রয়োজন হলে বৈধ হবে; যেমন তাকে গোসল না দিয়েই দাফন করা হয়েছে, বা দাফন করা হয়েছে দখলকৃত জমিতে বা দখলকৃত কাফনে, অথবা তার সাথে কোনো সম্পদ পড়ে গেছে, অথবা কিবলামুখী না করে দাফন করা হয়েছে (তাহলে দাফনের পর মৃতকে স্থানান্তর করা বৈধ)।(নববী আল মিনহাজ; পৃষ্ঠা: ৬২)
.
ইমাম বাহূতী (রাহিমাহুল্লাহ) কাশ্শাফুল ক্বিনাআ-এ বলেছেন:
فلو دفن قبل الغسل ، من أمكن غسله : لزم نبشه) وأن يخرج ويغسل، تداركا لواجب غسله ، (ما لم يخف تفسخه أو تغيره) ، فإن خيف ذلك ترك بحاله وسقط غسله، كالحي يتضرر به …
(ومثله) أي مثل من دفن بلا غسل أمكن : (من دُفن غير متوجه إلى القبلة) ، فينبش ويوجه إليها، تداركا لذلك الواجب …
(أو دفن قبل تكفينه) ، فيخرج ، ويكفن . نص عليه [يعني الإمام أحمد] .(ويجوز نبشه لغرض صحيح ، كتحسين كفنه) لحديث جابر قال أتى النبي عبد الله بن أبي ابن سلول بعد ما دفن، فأخرجه ، فنفث فيه من ريقه وألبسه قميصه رواه الشيخان، (و) كـ (دفنه في بقعة خير من بقعته) التي دفن فيها فيجوز نبشه لذلك.(و) لـ (مجاورة صالح) ، لتعود عليه بركته…
(ويجوز نبشه) أي الميت (إذا دفن لعذر بلا غسل ولا حنوط) ، فيغسل ويحنط ، لأنه غرض صحيح ، (وكإفراده في قبر عمن دفن معه) ؛ أي يجوز نبشه لذلك لقول جابر دفن مع أبي رجل، فلم تطب نفسي حتى أخرجته، فجعلته في قبر على حدة “.
وفي رواية ” كان أبي أول قتيل ، يعني يوم أحد ، فدفن معه آخر في قبره، ثم لم تطب نفسي أن أتركه مع الآخر ، فاستخرجته بعد ستة أشهر ، فإذا هو كيوم وضعته غير أذنه ” رواهما البخاري”
“যদি (মাইয়তকে) গোসল দেওয়ার আগে দাফন করা হয়, অথচ গোসল দেওয়া সম্ভব হয়, তবে তাকে অবশ্যই কবর থেকে বের করা হবে এবং বের করে গোসল করানো হবে, তার গোসলের ফরজ আদায়ের জন্য, (যতক্ষণ না আশঙ্কা হয় যে তার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে বা পরিবর্তিত হবে)। যদি এমন আশঙ্কা থাকে, তবে তাকে সেভাবেই ছেড়ে দেওয়া হবে এবং গোসলের ফরজ তার থেকে রহিত হবে, যেমন জীবিত মানুষের ক্ষতি হলে গোসল রহিত হয়।” (একইভাবে) যেমন গোসল ছাড়া দাফন করা হয়েছে (যদি কিবলামুখী না করে দাফন করা হয়), তবে কবর খনন করা হবে এবং তাকে কিবলামুখী করা হবে, কারণ এটি ফরজ।(অথবা তাকে কাফন ছাড়া দাফন করা হলে), বের করে কাফন পরানো হবে। এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ স্পষ্টভাবে বলেছেন।(বৈধ হবে কবর খনন করা যদি কোনো সঠিক উদ্দেশ্য থাকে, যেমন তার কাফনকে উন্নত করা)। জাবির (রা.) হতে হাদিসে এসেছে: নবী (ﷺ) আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলূল দাফন করার পর তার কবরের কাছে গেলেন, তাকে বের করলেন, তার লালারস দিলেন এবং নিজ জামা পরিয়ে দিলেন। এটি সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে।যেমন (তাকে ভালো স্থানে দাফন করা, তার আগের স্থান থেকে উত্তম হলে) এ কারণেও কবর খনন করা বৈধ।নেককার মানুষের পাশে দাফন করার জন্য, যেন তার বরকত প্রাপ্ত হয়।(বৈধ হবে কবর খনন করা) অর্থাৎ মৃতকে (যদি সে গোসল বা সুগন্ধি ছাড়া কোনো কারণে দাফন করা হয়), তবে তাকে বের করে গোসল ও সুগন্ধি দেওয়া হবে, কারণ এটি একটি সঠিক উদ্দেশ্য। (যদি এক কবরের মধ্যে অন্য কারও সাথে দাফন করা হয়ে থাকে, তবে আলাদা করার জন্যও কবর খনন বৈধ)। যেমন জাবির (রা.) বলেছেন: আমার বাবা একজন শহীদ ছিলেন (উহুদের যুদ্ধে), তার সাথে আরও একজনকে একই কবরের মধ্যে দাফন করা হয়েছিল। কিন্তু আমার মন রাজি হচ্ছিল না তাকে অন্যের সাথে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তাই ছয় মাস পর আমি তাকে বের করলাম, তখনও তিনি ঠিক তেমনই ছিলেন যেদিন তাকে দাফন করেছিলাম, শুধু কান সামান্য পরিবর্তিত ছিল। এটি ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন।”(বাহূতী; কাশ্শাফুল ক্বিনাআ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৮৬)
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:لا ينبش الميت من قبره ، إلا لحاجة ؛ مثل أن يكون المدفن الأول فيه ما يؤذي الميت ، فينقل إلى غيره ، كما نقل بعض الصحابة في مثل ذلك”মৃতকে কবর থেকে খনন করে বের করা বৈধ নয়, তবে প্রয়োজন হলে বৈধ হবে; যেমন প্রথম কবরস্থল মৃতের জন্য কষ্টদায়ক হলে, তখন অন্য স্থানে স্থানান্তর করা হবে। সাহাবাদের কিছু কবর এভাবে স্থানান্তর করা হয়েছিল। (মাজমূউল ফাতাওয়া; খণ্ড: ২৪; পৃষ্ঠা: ৩০৩)।
.
বাজী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:ولا بأس بحفر القبر وإخراج الميت منه ، إذا كان ذلك لوجه مصلحة ، ولم يكن في ذلك إضرار به ، وليس من هذا الباب نبش القبور ، فإن ذلك لوجه الضرر ، أو لغير منفعة “কোনো উপকারী কারণে এবং যদি মৃতের প্রতি কোনো অবমাননা বা ক্ষতি না হয়,তবে কবর খনন করে মৃতকে বের করতে দোষ নেই। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ কবর খননের (নবশুল কুবুর) সাথে তুলনা করা যাবে না, কারণ সেটা সাধারণত ক্ষতির উদ্দেশ্যে বা কোনো উপকার ছাড়া করা হয়।”(আল মুনতাকা শারহুল মুওয়াত্তা; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২২৫)।
.
শাইখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘নিঃসন্দেহে কবর খনন করা নিষিদ্ধ, তবে বিশেষ প্রয়োজনে পুরাতন কবরকে এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা জায়েয’ (কুয়েতী ফিক্বহ বিশ্বকোষ; খণ্ড: ৩২; পৃষ্ঠা: ২৫২; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফাতওয়া নং-৩০৬৩৫৫)। শাইখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) আরো বলেন, ‘কবর স্থানান্তরিত করার সময় অবশ্যই সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অত্যন্ত যত্ন সহকারে অবশিষ্ট অংশগুলো বহন করতে হবে। যাতে মৃতদেহের কোন প্রকারের অসম্মান না হয়।(ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব; ফাতওয়া নং-৩০৬৩৫৫)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।

অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব। 

তাওহীদুল হাকিমিয়া

 প্রশ্ন: তাওহীদুল হাকিমিয়া বলতে কি বুঝায়? এর প্রকৃত অর্থ ও প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর হাকিমিয়াত সমসাময়িক ইসলামী চিন্তাধারায় বহুল আলোচিত ও প্রচলিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটি এত বেশি আলোচিত হয়েছে যে, বর্তমানে অনেক মানুষের চিন্তা ও কর্মক্ষেত্রে এর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। এর ফলে এই ধারণা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট পরিভাষা সমসাময়িক ইসলামী বক্তৃতা ও লেখনীতে বিশেষ স্থান দখল করেছে। এর চারপাশে জন্ম নিয়েছে বহু জ্ঞানভিত্তিক বিতর্ক ও মতপার্থক্য, যা একে পরিণত করেছে দাওয়াহ ও আন্দোলনমূলক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে; পাশাপাশি এটি সমসাময়িক ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তার গঠনে অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকে একে যেন এক প্রকার “জাদুকরি চাবিকাঠি” হিসেবে ব্যবহার করেছেন—আলিম হোক বা সাধারণ মানুষ হোক, কেউ কেউ এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট শরয়ি বিধান প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, আবার কেউ বা নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রচারের হাতিয়ার বানিয়েছেন। এ বিষয়টি শুধু মুসলিম গবেষকদেরই নয়,অমুসলিম গবেষকদেরও আকৃষ্ট করেছে, এবং এর অনুসন্ধানে গৃহীত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ও বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি।
.
▪️ভাষাগত দিক থেকে হাকিমিয়াত:
.
হাকিমিয়াত” শব্দটি একটি ইজতিহাদি বা উদ্ভাবিত শব্দ, যা এসেছে আরবি “হাকাম” শব্দ থেকে। এর অর্থ হলো: শাসক বা হাকিমের পদ, তাঁর দায়িত্ব বা কর্মপদবী। অর্থাৎ শব্দটি নতুন হলেও এটি মূলত “হুকুম” বা কর্তৃত্বের ধারণাকেই প্রকাশ করে। আরবীতেও এটি প্রাচীন প্রচলিত শব্দ নয়। সর্বশ্রেষ্ঠ তিন প্রজন্মের কেউই এই শব্দটি ব্যবহার করেননি,ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিমসহ হাদীস গ্রন্থ সংকলনকারী মুহাদ্দিসগণ,চার মাযহাবের ইমামগণসহ পরবর্তী মুসলিম উম্মাহর হকপন্থী প্রসিদ্ধ কোন আলেম তাওহীদের চতুর্থ অংশ হিসেবে শব্দটি ব্যবহার করেননি। বরং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আলোচনায় প্রথম যিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেন তিনি হলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ সাইয়্যিদ আবুল আ’লা মওদূদী (রাহিমাহুল্লাহ)। তাঁর হাত ধরেই উপমহাদেশে শব্দটি প্রসার লাভ করে এবং পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। মওদূদী ইসলামী সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি আলোচনা করতে গিয়ে “হাকিমিয়াত”-এর ধারণাকে সামনে আনেন। তাঁর দৃষ্টিতে এটি ছিল ইসলামী সাংবিধানিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু এবং রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে তিনি তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা উপস্থাপন করেন, যেখানে হাকিমিয়াত সংক্রান্ত ব্যাখ্যাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে সময় ভারতের শাসনব্যবস্থা ছিল ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের হাতে—যা মওদূদীর মতে ছিল জাহেলি ও কাফের মানবিক কর্তৃত্ব। অন্যদিকে, কংগ্রেসের কল্পিত স্বাধীন ভারতের রূপরেখায় দেখা যাচ্ছিল পশ্চিমা ধাঁচের জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে শাসনক্ষমতা থাকবে হিন্দু নেতৃত্বের হাতে। এই পরিস্থিতিতেই মওদূদী উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেন মানবিক হাকিমিয়াতের কুফর এবং জোর দেন আল্লাহর একক হাকিমিয়াতের উপর। তাঁর রচিত “তাদবীনুদ দাস্তূরুল ইসলামী” গ্রন্থে এই বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। মূলত গ্রন্থটি ছিল সে সময়কার ধর্মনিরপেক্ষদের উত্থাপিত প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জের জবাব। আইনজীবী এ. কে. রোহী তখন ঘোষণা করেছিলেন—“যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে যে কুরআনে সংবিধানগত নীতিমালা বিদ্যমান, তবে আমি তাকে পাঁচ হাজার রুপি পুরস্কার দেব।”মওদূদী তাঁর “আসাসুদ দাস্তূরুল ইসলামী ফিল কুরআন” গ্রন্থ রচনা এবং করাচিতে “তাদবীনুদ দাস্তূরুল ইসলামী” শিরোনামে বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জের জবাব দেন। এর ফলে আইনজীবী রোহী তাঁর চিন্তায় সন্তুষ্ট হন এবং পরে সংবিধান প্রণয়ন পরিষদে ইসলামী সংবিধানসম্মত একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
.
▪️সাইয়্যিদ আবুল আ’লা মওদূদীর নিকট হাকিমিয়াতের অর্থ:
.
মওদূদী (রহিমাহুল্লাহ) হাকিমিয়াতকে ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে যে, এটি সর্বোচ্চ ক্ষমতা ও পরম কর্তৃত্বের প্রতিশব্দ। আজকের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় যেমন সার্বভৌমত্ব (Sovereignty) ব্যবহৃত হয়, তেমনই হাকিমিয়াতও বোঝায় সেই চূড়ান্ত ক্ষমতাকে, যা অন্য সব ক্ষমতার ওপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে। মওদূদীর প্রদত্ত এই সংজ্ঞা পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ।
.
তাওহীদুল-হাকিমিয়্যাতের অর্থ হলো—আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাকে এককভাবে হুকুমদাতা ও শরীয়ত প্রণেতা হিসেবে সাব্যস্ত করা। একমাত্র তিনিই প্রকৃত হাকিম, তিনিই শরীয়তের বিধান প্রণয়নকারী, আর তাঁর হুকুমে কাউকে শরিক করা বৈধ নয়। সমসাময়িক আলিমগণের মধ্যে এ বিষয়ে মতভেদ দেখা যায়। তাঁদের একদল এটিকে তাওহীদের একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে গণ্য করেছেন। অপরদিকে অন্য একদল এটিকে তাওহীদের উলুহিয়্যাহর অন্তর্ভুক্ত করেছেন, আবার কেউ কেউ রুবুবিয়্যাহ এবং উলুহিয়্যাহ উভয়ের সাথেই সম্পর্কিত মনে করেছেন। যারা এটিকে তাওহীদের পৃথক শাখা হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন, তাঁদের দলিল হলো—আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে স্পষ্ট করেছেন যে, যে ব্যক্তি তাঁর পরিবর্তে শরীয়তের বিধান প্রণয়ন করে, সে মূলত আল্লাহর সমকক্ষ বা শরিক দাবি করছে। যেমন আল্লাহ সূরা শূরা আয়াত ২১-এ বলেছেন:اَمۡ لَهُمۡ شُرَكٰٓؤُا شَرَعُوۡا لَهُمۡ مِّنَ الدِّیۡنِ مَا لَمۡ یَاۡذَنۡۢ بِهِ اللّٰهُ ؕ وَ لَوۡ لَا كَلِمَۃُ الۡفَصۡلِ لَقُضِیَ بَیۡنَهُمۡ ؕ وَ اِنَّ الظّٰلِمِیۡنَ لَهُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ “নাকি তাদের এমন কতগুলো শরীক রয়েছে, যারা এদের জন্য দ্বীন থেকে শরীআত প্রবর্তন করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? আর ফয়সালার ঘোষণা না থাকলে এদের মাঝে অবশ্যই সিদ্ধান্ত হয়ে যেত। আর নিশ্চয় যালিমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”(সূরা শূরা: ২১) এবং আল্লাহ আরও বলেন:قُلِ اللّٰهُ اَعۡلَمُ بِمَا لَبِثُوۡا ۚ لَهٗ غَیۡبُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اَبۡصِرۡ بِهٖ وَ اَسۡمِعۡ ؕ مَا لَهُمۡ مِّنۡ دُوۡنِهٖ مِنۡ وَّلِیٍّ ۫ وَّ لَا یُشۡرِكُ فِیۡ حُكۡمِهٖۤ اَحَدًا”আপনি বলুন, তারা কত কাল অবস্থান করেছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন, আসমান ও যমীনের গায়েবের জ্ঞান তাঁরই। তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও শ্ৰোতা! তিনি ছাড়া তাদের অন্য কোন অভিভাবক নেই। তিনি কাউকেও নিজ কর্তৃত্বে শরীক করেন না।”(সূরা কাহফ: ২৬)। অতএব আল্লাহ মহান তাঁর হুকুমে কাউকে শরিক করেননি, আর কাউকে এই অনুমতিও দেননি যে তাকে বাদ দিয়ে তাকে উপাসনা করা হবে। সূরা কাহফের আয়াত ২৬-এর একটি প্রামাণ্য কিরাআতে স্পষ্টভাবে মুসলিমকে সতর্ক করা হয়েছে—সে যেন আল্লাহর হুকুমে কাউকে শরিক না করে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো বিধান মান্য করে তার ইবাদত না করে।হাদিসে এসেছে,আদী বিন হাতেম (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ একদা আমি আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট এলাম, তখন আমার গলায় স্বর্ণের ক্রুশ ছিল। তা দেখে তিনি বললেন, “হে আদী! তোমার দেহ থেকে এই প্রতিমা খুলে ফেলো।” আমি শুনলাম তিনি সূরা তওবার এই আয়াত পাঠ করলেন, যার অর্থ,”আল্লাহর পরিবর্তে তারা তাদের আলেম ও সাধু-দরবেশদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে”।(সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩১) পাঠ করতে শুনলাম। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, তারা তো তাঁদের আলিম ও রুহবানদের ইবাদত করতে না। তিনি বললেন: “হ্যাঁ, কিন্তু তারা তাদের জন্য আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা হালাল করে দিতো, আর তারা তা হালাল মনে করত। তারা তাদের জন্য আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তা হারাম করে দিতো, আর তারা তা হারাম মনে করত।(আদী বললেন, জী হ্যাঁ। তিনি (ﷺ) বললেন,এটাই ছিল তাদের ইবাদত করা।” বায়হাকি সুনানুল কুবরা হা/৩০৩৫০; তিরমিজি হা/৩০৯৫ ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদিসটি সহীহ বলেছেন।) অপর বর্ননায় আবু বখতারী (রহঃ) বর্ণনা করেন: হুযাইফা (রাঃ)-কে এ আয়াত: ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ“আল্লাহর পরিবর্তে তারা তাদের আলেম ও সাধু-দরবেশদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে”।(সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩১) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো তারা কি তাঁদের জন্য নামাজ পড়ত? তিনি বললেন: “না, বরং তারা তাঁদের জন্য যা আল্লাহ হারাম করেছিলেন, তা হালাল করে দিত, আর তারা তা হালাল মনে করত। এবং তারা তাঁদের জন্য যা আল্লাহ হালাল করেছিলেন, তা হারাম করে দিতো, আর তারা তা হারাম মনে করতো। এর ফলে তারা তাদেরকে রব বানিয়ে নিতো। হাদিসটি ইমাম বায়হাকি তাঁর -সুনানুল কুবরা হা/২০৩৫১) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] “মানহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ”-তে বলেছেন:
ولا ريب أن من لم يعتقد وجوب الحكم بما أنزل الله على رسوله فهو كافرٌ، فمن استحل أن يحكم بين الناس بما يراه هو عدلًا من غير اتباعٍ لما أنزل الله فهو كافرٌ؛ فإنه ما من أمةٍ إلا وهي تأمر بالحكم بالعدل، وقد يكون العدل في دِينها ما رآه أكابرهم… فهؤلاء إذا عرَفوا أنه لا يجوز الحكم إلا بما أنزل الله فلم يلتزموا ذلك، بل استحلوا أن يحكموا بخلاف ما أنزل الله – فهم كفارٌ”.
“এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে না যে আল্লাহ তাঁর রসূলের উপর যা নাযিল করেছেন, তার ভিত্তিতেই হুকুম দেওয়া ফরয সে কাফির। সুতরাং, যে ব্যক্তি এই ধারণা পোষণ করে যে, সে মানুষের মাঝে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান বাদ দিয়ে নিজের দৃষ্টিতে ন্যায়সঙ্গত মনে হওয়া নিয়মে ফায়সালা করবে অথচ আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা অনুসরণ করবে না সে কাফির। কারণ এমন কোনো জাতি নেই যারা ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে নির্দেশ দেয় না। তবে তাদের ধর্মে ন্যায়বিচার বলতে অনেক সময় বোঝায়—তাদের নেতৃস্থানীয়দের যা ভালো মনে হয় তাই-ই ন্যায়বিচার। তারা যদি জেনে-বুঝে এ কথা স্বীকার করে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছুর দ্বারা ফায়সালা করা বৈধ নয়, তবুও যদি তা গ্রহণ না করে; বরং উল্টো আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানের বিপরীতে অন্য কিছুর দ্বারা ফয়সালাকে হালাল মনে করে—তাহলে তারা কাফির।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মানহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১৩০)
.
আল্লামা শানকীতী (রাহিমাহুল্লাহ) “আযওয়াউল বায়ান” এ সূরা শূরা (১০) এর আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন:”মহান আল্লাহর বানী:وَ مَا اخۡتَلَفۡتُمۡ فِیۡهِ مِنۡ شَیۡءٍ فَحُكۡمُهٗۤ اِلَی اللّٰهِ ؕ ذٰلِكُمُ اللّٰهُ رَبِّیۡ عَلَیۡهِ تَوَكَّلۡتُ ٭ۖ وَ اِلَیۡهِ اُنِیۡبُ “আর তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ করো না কেন তার ফয়সালা তো আল্লাহরই কাছে। তিনিই আল্লাহ আমার রব; তাঁরই উপর আমি নির্ভর করেছি এবং আমি তাঁরই অভিমুখী হই।”(সূরা শূরা:১০) এই মহিমান্বিত আয়াতের প্রমাণ হলো মানুষের মধ্যে যে সকল বিষয়ের ব্যাপারে মতভেদ হয়,সেসবের চূড়ান্ত হুকুম আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে, অন্য কারো কাছে নয়। এটি বহু আয়াতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সুতরাং, আল্লাহর হুকুমে শিরক করা যেমন, তাঁর ইবাদতে শিরক করাও তেমনি। তিনি তাঁর হুকুম সম্পর্কে বলেছেন:قُلِ اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثُوا لَهُ غَيْبُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ أَبْصِرْ بِهِ وَأَسْمِعْ مَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا”আপনি বলুন, তারা কত কাল অবস্থান করেছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন, আসমান ও যমীনের গায়েবের জ্ঞান তাঁরই। তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও শ্ৰোতা! তিনি ছাড়া তাদের অন্য কোন অভিভাবক নেই। তিনি কাউকেও নিজ কর্তৃত্বে শরীক করেন না।”(সূরা কাহাফ: ২৬)। আর সাত ক্বারীর একজন ইবনে ‘আমির-এর ক্বিরাআতে এসেছে: (وَلَا تُشْرِكْ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا) “তুমি তাঁর হুকুমে কাউকে শরীক করো না।” আর তাঁর ইবাদতে শিরক সম্পর্কে তিনি বলেছেন:وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا”আর (কেউ যেন) তার প্রতিপালকের ‘ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে।” (সূরা কাহাফ: ১১০)। এ দুটি বিষয় সমান। এর মাধ্যমে তুমি জেনে নেবে যে, হালাল সেটাই যা আল্লাহ হালাল করেছেন, হারাম সেটাই যা আল্লাহ হারাম করেছেন, এবং দীনের অর্থ হলো সেটাই যা আল্লাহ শরী‘আত হিসেবে প্রণয়ন করেছেন। সুতরাং, তাঁর শরী‘আতের বাইরে অন্য কোনো প্রণীত আইন বাতিল। আর যে ব্যক্তি মনে করে যে এই আইন আল্লাহর শরী‘আতের সমতুল্য বা তার চেয়ে উত্তম তার এ বিশ্বাস প্রকাশ্য কুফর, এতে কোনো বিরোধ নেই। কুরআনের বহু আয়াত প্রমাণ করেছে যে, আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম নেই। আর অন্যের শরী‘আতকে অনুসরণ করা আল্লাহর প্রতি কুফর।সেসব আয়াতের মধ্যে রয়েছে—আল্লাহর বাণী:اِنِ الۡحُكۡمُ اِلَّا لِلّٰهِ ؕ یَقُصُّ الۡحَقَّ وَ هُوَ خَیۡرُ الۡفٰصِلِیۡنَ”হুকুম কেবল আল্লাহর কাছেই, তিনি সত্য বর্ণনা করেন এবং ফয়সালাকারীদের মধ্যে তিনিই শ্ৰেষ্ঠ।(সূরা আনআম ৫৭) অপর আয়াতে বলেন:وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡكُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الۡكٰفِرُوۡنَ”আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই কাফের।”( সূরা মায়েদা: ৪৪) আরও বলেন:وَ لَا تَدۡعُ مَعَ اللّٰهِ اِلٰـهًا اٰخَرَ ۘ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ۟ كُلُّ شَیۡءٍ هَالِكٌ اِلَّا وَجۡهَهٗ ؕ لَهُ الۡحُكۡمُ وَ اِلَیۡهِ تُرۡجَعُوۡنَ “আর আপনি আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডাকবেন না, তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। আল্লাহর সত্তা ছাড়া সমস্ত কিছুই ধ্বংসশীল।বিধান তারই এবং তারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” (সূরা কসাস: ৮৮) অন্যান্য অনুরূপ আয়াতও প্রচুর রয়েছে,যেমনاِنَّمَا سُلۡطٰنُهٗ عَلَی الَّذِیۡنَ یَتَوَلَّوۡنَهٗ وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ بِهٖ مُشۡرِكُوۡن”তার আধিপত্য তো শুধু তাদেরই উপর যারা তাকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে এবং যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে।”(সূরা নাহল: ১০০) আরও বলেন:وَ لَا تَاۡكُلُوۡا مِمَّا لَمۡ یُذۡكَرِ اسۡمُ اللّٰهِ عَلَیۡهِ وَ اِنَّهٗ لَفِسۡقٌ ؕ وَ اِنَّ الشَّیٰطِیۡنَ لَیُوۡحُوۡنَ اِلٰۤی اَوۡلِیٰٓئِهِمۡ لِیُجَادِلُوۡكُمۡ ۚ وَ اِنۡ اَطَعۡتُمُوۡهُمۡ اِنَّكُمۡ لَمُشۡرِكُوۡنَ”আর আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি তার কিছুই তোমরা খেও না; এবং নিশ্চয় তা গর্হিত। নিশ্চয়ই শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদ করতে প্ররোচনা দেয়; আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তবে তোমরা অবশ্যই মুশরিক।” (সূরা আনআম: ১২১) এবংاَلَمۡ اَعۡهَدۡ اِلَیۡكُمۡ یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ اَنۡ لَّا تَعۡبُدُوا الشَّیۡطٰنَ ۚ اِنَّهٗ لَكُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ”হে বনী আদম! আমি কি তোমাদেরকে নির্দেশ দেইনি যে, তোমরা শয়তানের ইবাদাত করো না,কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?।(সুরা ইয়াসিন: ৬০) এ ধরণের আয়াত অসংখ্য।” (ইমাম শানকীতী; আযওয়াউল বায়ান খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ১৫০)
.
তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেছেন: لما كان التشريع وجميع الأحكام – شرعيةً كانت أو كونية قدرية – من خصائص الربوبية، كما دلت عليه الآيات المذكـورة، كان كل من اتبع تشـريعًا غير تشــريع الله قد اتخذ ذلك المشرِّعَ ربًّا، وأشركه مع الله”যেহেতু শরী‘আত প্রণয়ন ও সমস্ত হুকুম তা শর‘ঈ হোক কিংবা কুদরতি কাওনুন সবই রবুবিয়্যাতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য; যেমনটি উল্লেখিত আয়াতগুলো প্রমাণ করেছে, সুতরাং যে-ই আল্লাহর শরী‘আতের বাইরে অন্য কোনো শরী‘আত অনুসরণ করবে, সে ঐ আইন প্রণেতাকে রব বানালো এবং আল্লাহর সাথে তাকে শরীক করলো।” (আযওয়াউল বায়ান; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ১৬৯) তিনি উক্ত স্পষ্ট আয়াতগুলোর আলোকে সংক্ষিপ্তসার দিয়েছেন এভাবে :إن متَّبِعي أحكام المشرعين غير ما شرعه الله مشركون بالله”“যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য আইন প্রণেতাদের বিধান অনুসরণ করে, তারা আল্লাহর সাথে শিরককারী।”(আযওয়াউল বায়ান; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ১৬৯)
.
ইমাম ইবনু আবিল ‘ইয হানাফি “শারহুত ত্বহাবী”এ উম্মাহর উপর রাসূল (ﷺ)-এর হকসমূহ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন: في معرض ذكر ما يجب على الأمة تجاه نبيها صلى الله عليه وسلم: “فيوحِّده بالتحكيم والتسليم، والانقياد والإذعان، كما وحَّد المرسِل بالعبادة والخضوع، والذل والإنابة والتوكل.فهما توحيدان، لا نجاة للعبد من عذاب الله إلا بهما: توحيد المرسِل، وتوحيد متابعة الرسول؛ فلا يحاكِمُ إلى غيره، ولا يرضى بحُكم غيره”অতএব,উম্মাহর ওপর যা কর্তব্য তা হচ্ছে;তাঁকেই (রাসূল ﷺ-কে) ফায়সালার একমাত্র নির্ধারক হিসেবে মানা, তাঁর আদেশের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা, তাঁর আনুগত্যে অবনত হওয়া এবং বিনম্রভাবে মেনে নেওয়া—যেমন তারা প্রেরক (আল্লাহ)-কে একত্বের সাথে ইবাদত করে, তাঁর সামনে বিনীত হয়, তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করে এবং তাঁর উপরই ভরসা করে। সুতরাং এ দুটি হলো তাওহীদের দুটি শাখা—যার ব্যতীত বান্দার জন্য আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি নেই: (১) প্রেরক আল্লাহর তাওহীদ, এবং (২) রাসূল (ﷺ)-এর অনুসরণের তাওহীদ। তাই বান্দা অন্য কারো কাছে ফয়সালার জন্য যাবে না, এবং অন্য কারো ফায়সালায় সন্তুষ্টও হবে না।”(শারহুত ত্বহাবী; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২২৮)
.
ইমাম ত্বহাবী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বক্তব্য এখানে নবীকে এককভাবে বিচারক হিসেবে মানা প্রসঙ্গে নয়; বরং তিনি হুকুমের একত্ব প্রসঙ্গে আলোকপাত করেছেন। কেননা, আল্লাহকে বিচারক হিসেবে মানা আর রাসূলকে বিচারক হিসেবে মানার মাঝে কোনো ভিন্নতা নেই। কারণ, রাসূল কখনো নিজের মনগড়া কথা বলেন না; তিনি যা বলেন, তা কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ওহীর ভিত্তিতেই বলেন।
.
আর বাস্তবিক অর্থে যাকে কেউ “তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহ” বলে অভিহিত করেছেন,সেটি মূলত তাওহীদুল উলুহিয়্যাহরই একটি অংশ। কারণ তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ মানে আল্লাহকে এককভাবে ইবাদতের যোগ্য মানা। আর ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তাঁর একক হুকুম মানা ও শরীয়াহ মেনে নেওয়া। সুতরাং, যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য করে—হারামকে হালাল কিংবা হালালকে হারাম করার ব্যাপারে, অথবা শরীয়াহবিরোধী আইন-প্রণয়নকে স্বীকৃতি দেয়—সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে উপাস্য বানিয়ে নেয়।আল্লাহ তাআলা বলেন:﴿ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ﴾“তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের আলেম-রাহেবদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে।”(সূরা আত-তাওবা: ৩১) অতএব, যে ব্যক্তি সৃষ্টিকুলের কারো হাতে বিরোধ নিষ্পত্তি বা আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ করে, কিংবা এতে সম্মতি জানায়, কিংবা এর দিকে আহ্বান করে, কিংবা এর সমর্থনে দাঁড়ায়, কিংবা বিনা জবরদস্তিতে এটিকে মেনে নেয়—সে আল্লাহর সঙ্গে বড় শিরক করেছে। আর এই শিরকই তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়— আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই!
.
প্রিয় পাঠক! নতুন আবিষ্কৃত তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহকে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এটি আসলে দুইটি প্রধান অংশে বিভক্ত:
.
প্রথম অংশ: মহাবিশ্ব সংক্রান্ত তাকদীর ও শরীয়াহ প্রণয়ন আল্লাহর একক অধিকার। এটি তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহর অন্তর্ভুক্ত। কারণ, এগুলো একান্তই রবের কাজ। তিনি-ই একমাত্র সৃষ্টির উপর হুকুমদাতা এবং শরীয়াহ প্রণেতা। যেমন আল্লাহ বলেন:”আল্লাহ মানুষের জন্য শরীয়াহ প্রণয়নের অধিকার অন্যদের দেওয়াকে অস্বীকার করে বলেন:أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ “জেনে রাখো, সৃজন ও আদেশ তারই সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ কত বরকতময়।” (সূরা আরাফ:৫৪) তিনি আরও বলেন:وَ لَوۡ لَا کَلِمَۃُ الۡفَصۡلِ لَقُضِیَ بَیۡنَهُمۡ ؕ وَ اِنَّ الظّٰلِمِیۡنَ لَهُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ”নাকি তাদের এমন কতগুলো শরীক রয়েছে, যারা এদের জন্য দ্বীন থেকে শরীআত প্রবর্তন করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?”(সূরা শুরা: ২১) অতএব, সৃষ্টিজগতের তাকদীর নির্ধারণ করা হোক বা দ্বীনের শরীয়াহ বিধান প্রণয়ন—উভয়ই একমাত্র আল্লাহরই একক অধিকার।
.
দ্বিতীয় অংশ: বান্দাদের কর্তব্য হলো আল্লাহর ক্বদর এবং শরীয়াহকে মান্য করা, এবং সমস্ত বিবাদ ও মতবিরোধের বিচার আল্লাহর প্রদত্ত শরীয়াহর মাধ্যমে করা। এ কাজে তারা যখন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর প্রদত্ত সিদ্ধান্ত মেনে নেয় এবং নিজের মনে কোনো দ্বিধা অনুভব করে না, তখন সেটিই প্রকৃত ঈমান।যেমন আল্লাহ বলেন:فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَ یُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا”কিন্তু না, আপনার রবের শপথ তারা মুমিন হবে না যতক্ষন পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।”(সূরা নিসা ৬৫)। সুতরাং বান্দাদের জন্য আল্লাহর শরীয়াহর দিকে ফিরে যাওয়া এবং তা মেনে চলা প্রকৃত অর্থে ইবাদতের একটি রূপ। এটি অন্য কাউকে উৎসর্গ করা যায় না। বরং শুধুমাত্র আল্লাহর শর্তানুযায়ী বিচার-ফয়সালায় ফিরে যাওয়ায় আল্লাহর প্রতি একমাত্র ইবাদত প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাই তাওহীদুল উলুহিয়্যাহর অংশ।
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহ মূলত তাওহীদের একটি দিক, যা প্রধানত তাওহীদুল রুবুবিয়্যাহর আওতায় পড়ে, বিশেষ করে শাসক (হাকিম) সম্পর্কিত বিষয়সমূহে। আল্লাহর ক্ষেত্রে এর অর্থ হলো: তিনিই প্রকৃত শাসক এবং একমাত্র বিধানদাতা। ফলে, যিনি সমস্ত বিষয়ের ওপর শাসন, নিয়ন্ত্রণ ও আদেশ-নিষেধ নির্ধারণ করেন, তিনিই আল্লাহ। এই দিকটি তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহর মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত। আবার বাস্তবিক দিক থেকে, বান্দা যখন আল্লাহর হুকুম মেনে চলে, তখন এটি তাওহীদুল উলুহিয়্যাহর অন্তর্ভুক্তও হয়। সুতরাং, যেহেতু তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহ তাওহীদের দুটি দিকই ধারণ করে, তাই এটিকে আলাদা করে চতুর্থ অংশে বিভক্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই। যদি প্রয়োজন থাকত, তাহলে অবশ্যই আমাদের প্রসিদ্ধ সালাফগণ এটি তাওহীদের চতুর্থ অংশ হিসেবে ব্যবহার করতেন।অতএব,আমাদের প্রসিদ্ধ সালাফগণ তাওহীদকে তিনটি তিনটি বিভক্ত করেছেন যেমন: ১.তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ ২.তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ, ৩.তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত। আর তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহ মূলত তাওহীদের তিনটি অংশের মধ্যেই সন্নিবিষ্ট।যেমনটি আমরা উপরোক্ত আলোচনায় ব্যাখ্যা করেছি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে বোঝার তৌফিক দিন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সালাতের পদ্ধতি কি এবং নারীরা কি এই সালাত আদায় করতে পারবে

❑ প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের সালাত আদায় করা নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই মুস্তাহাব। আবু মাসউদ আল-আনসারি (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্য থেকে দুইটি নিদর্শন। এ দুইটির মাধ্যমে আল্লাহ্‌ বান্দাদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করেন। কোন মানুষের মৃত্যুর কারণে এ দুটোর গ্রহণ ঘটে না। কাজেই যখন গ্রহণ দেখবে, তখন তোমরা এ পরিস্থিতি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সালাত আদায় করবে এবং দোয়া করতে থাকবে।”(সহিহ বুখারী হা/১০৪১;ও সহিহ মুসলিম হা/৯১১) অপর বর্ননায় আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “একবার সূর্যগ্রহণ হল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন; তিনি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা করছিলেন। এরপর তিনি মসজিদে আসেন। এর আগে আমি তাঁকে যেমন করতে দেখেছি, তার চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কিয়াম, রুকু ও সিজদা সহকারে নামায আদায় করলেন। আর তিনি বললেন: এগুলো হল আল্লাহ্‌ কর্তৃক প্রেরিত নিদর্শন; এগুলো কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে ঘটে না। বরং আল্লাহ তাআলা এর দ্বারা তাঁর বান্দাদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করেন। কাজেই যখন তোমরা এর কিছু দেখতে পাবে, তখন ভীত বিহ্বল অবস্থায় আল্লাহর যিকির, দু’আ ও ইস্তিগফারে মগ্ন হবে।”।(সহিহ বুখারী হা/১০৫৯; ও সহিহ মুসলিম হা/৯১২)
.
❑ দ্বিতীয়ত: সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের সালাতের পদ্ধতি:
.
সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময় দুই রাকআত সালাত আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। উক্ত সালাত আদায়ের সময় অন্যান্য সালাতের ন্যায় পবিত্রতা অর্জন করে কিবলামুখী হয়ে অন্তরে নিয়ত করে মুখে উচ্চারণ করে তাকবিরে তাহরিমা (আল্লাহু আকবার) বলবে। সানা পড়বে। এরপর আউযুবিল্লাহ পড়ে সূরা ফাতিহা পড়বে। তারপর দীর্ঘ তেলাওয়াত (অন্য একটি সূরা পাঠ) করবে।এরপর দীর্ঘক্ষণ রুকু করবে। এরপর রুকু থেকে উঠে ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদা, রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ’ বলবে। এরপর সূরা ফাতিহা পড়বে এবং দীর্ঘ তেলাওয়াত করবে; তবে পরিমাণে প্রথম রাকাতের তেলাওয়াতের চেয়ে কম। এরপর দ্বিতীয়বার রুকু করবে এবং দীর্ঘক্ষণ রুকুতে থাকবে; তবে প্রথম রুকুর চেয়ে কম সময়।এরপর রুকু থেকে উঠে ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদা, রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ’ বলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে।এরপর দীর্ঘ দীর্ঘ দুইটি সেজদা করবে এবং দুই সেজদার মাঝখানেও দীর্ঘসময় বসে থাকবে।এরপর দ্বিতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়াবে এবং প্রথম রাকাতের মত দুই রুকুসহ ইত্যাদি করবে। কিন্তু, সবকিছুর দীর্ঘতা প্রথম রাকাতের চেয়ে কম হবে।এরপর তাশাহুদ,দুরদ এবং অন্যান্য দু’আ পড়ে সালাম ফিরাবে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনু কুদামাহ ‘আল-মুগনি; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩২৩; নববী ‘আল-মাজুম’; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৪৮)।
.
উল্লেখ্য যে, কারো যদি দুই রুকুর একটিও ছুটে যায়, তাহলে রাকআত গণ্য করবে না। কারণ, একটি রুকু ছুটে গেলে রাকআত হবে না। ইমামের সালাম ফিরার পর ২টি রুকু বিশিষ্ট ১ রাকআত নামায কাযা পড়তে হবে।(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৫০; মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্; খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৯৮)
.
অতঃপর সালাত শেষ হতে হতে ইতিমধ্যে সূর্য উজ্জ্বল হয়ে গেল। সালাত শেষ করে দাঁড়িয়ে মহানবী (ﷺ) খুতবা দিয়েছিলেন এবং হামদ ও সানা শেষে বললেন যে, সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শন সমূহের মধ্যে দু’টি বিশেষ নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে এই গ্রহণ হয় না। যখন তোমরা ঐ গ্রহণ দেখবে, তখন আল্লাহকে ডাকবে, তাকবীর দিবে, সালাত আদায় করবে ও সাদাক্বা করবে। … আল্লাহর কসম! আমি যা জানি, তা যদি তোমরা জানতে, তাহ’ষলে তোমরা অল্প হাসতে ও অধিক ক্রন্দন করতে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এর মাধ্যমে আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের ভয় দেখিয়ে থাকেন। অতএব যখন তোমরা সূর্য গ্রহণ দেখবে, তখন ভীত হয়ে আল্লাহর যিকর, দো‘আ ও ইস্তেগফারে রত হবে।(সহীহ বুখারী হা/১০৪৭)
.
❑ তৃতীয়ত: নারীরা কি এই সালাত আদায় করতে পারে?
.
নারীদের জন্য সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সালাত আদায় করা মুস্তাহাব (সুন্নাত) হিসেবে প্রমাণিত, এবং এ ব্যাপারে চার মাযহাব—হানাফি, মালিকি, শাফিঈ ও হাম্বলি—এর মধ্যে ঐক্যমত রয়েছে। কেননা রাসূল (ﷺ)-এর বানী:“তোমরা যখন এ দু’টিকে (সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ) দেখবে, তখন দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করো।”(সহিহ বুখারী হা/১০৫৯; সহিহ মুসলিম হা/৯১২)—এ নির্দেশ সাধারণ, যাতে পুরুষ ও নারী উভয়ই অন্তর্ভুক্ত; সে ঘরে হোক কিংবা মসজিদে। তাছাড়া,আম্মিজান ‘আইশাহ রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে জানা যায় যে, তিনি নিজেও জামাতে এই সালাত আদায় করেছেন।যেমন:আসমা বিনতু আবূ বক্‌র (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ আমি একদা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর স্ত্রী ‘আয়িশা (রাঃ)- এর নিকট আসলাম। তখন সূর্যে গ্রহণ লেগেছিল। দেখলাম সব মানুষ দাড়িঁয়ে সালাত আদায় করছে এবং ‘আয়িশা (রাঃ)-ও দাড়িঁয়ে সালাত আদায় করছেন। আমি বললাম, লোকদের কী হয়েছে? তিনি তার হাত আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন “সুবহানাল্লাহ”! আমি বললাম, এটা কি কোন আলামত? তিনি ইঙ্গিত করে বললেনঃ ‘হাঁ’। অতঃপর আমিও সালাতে দাড়িঁয়ে গেলাম। এমনকি আমার জ্ঞান হারিয়ে ফেলার উপক্রম হলো এবং আমি আমার মাথায় পানি দিতে লাগলাম। অতঃপর আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) [মুসল্লীদের দিকে] ফিরে আল্লাহর হাম্‌দ ও সানা বর্ণনা করে বললেনঃ “যেসব জিনিস আমি ইতোপূর্বে দেখিনি সেসব আমার এ স্থানে আমি দেখতে পেয়েছি, এমনকি জান্নাত এবং জাহান্নামও। আর আমার নিকট ওয়াহী পাঠানো হয়েছে যে , কবরে তোমাদের পরীক্ষা করা হবে দাজ্জালের ফিতনার ন্যায় অথবা কাছাকাছি।” বর্ণনাকারী বলেনঃ আসমা (রাঃ) কোন্‌টি বলেছিলেন, আমি জানি না। তোমাদের প্রত্যকের নিকট (ফেরেশতাগণ) উপস্থিত হবে এবং তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, “এ ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কি জান?”- তারপর ‘মু’মিন,’ বা ‘মু’কিন ব্যক্তি বলবে- আসমা ‘মুমিন’ বলেছিলেন না ‘মুকিন’ তা আমি জানি না- ইনি আল্লাহর রসূল মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তিনি আমাদের নিকট মু’জিযা ও হিদায়াত নিয়ে আগমন করেছিলেন। আমরা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছি, তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং তাঁর ইত্তেবা’ করেছি। তারপর তাকে বলা হবে, নিশ্চিন্তে ঘুমাও। আমরা জানলাম যে, তুমি মু’মিন ছিলে। আর ‘মুনাফিক’ বা ‘মুরতাব’ বলবে- আমি জানি না আসমা এর কোন্‌টি বলেছিলেন- লোকজনকে এর সম্পর্কে কিছু একটা বলতে শুনেছি আর আমিও তা-ই বলেছি।”(সহিহ বুখারী হা/১৮৪)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
لا بأس أن تصلي المرأة صلاة الكسوف في بيتها؛ لأن الأمر عام: ( فصلوا وادعوا حتى ينكشف ما بكم )، وإن خرجت إلى المسجد كما فعل نساء الصحابة، وصلت مع الناس: كان في هذا خير
“নারী যদি ঘরে বসে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সালাত আদায় করে, তাতে কোনো অসুবিধা নেই; কারণ এই নির্দেশটি সাধারণ ও সর্বজনীন:”(তোমরা সালাত আদায় করো এবং দো‘আ করো যতক্ষণ না তোমাদের বিপদ দূর হয়)”।আর যদি নারী সাহাবিয়াদের মতো মসজিদে গিয়ে মানুষের সঙ্গে জামাআতে সালাত আদায় করে,তবে এতে আরও বেশি (সওয়াব) এবং কল্যান রয়েছে।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৬; পৃষ্ঠা: ৩১০)
.
❑ চতুর্থত: সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো জেনে রাখা ভালো:
.
(১) সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণের সময় আল্লাহকে বেশি বেশি ভয় করা উচিত, সাথে সাথে দু’আ ও যিকির এবং তওবা ইস্তিগফার করা আবশ্যক, সূর্য গ্রহণ লাগার সাথে সাথে লোকজনকে ডেকে সালাতে নিয়ে যাওয়া উচিত।
.
(২).সূর্যগ্রহণের সালাতের কিরাআত জোরে পড়া হবে নাকি আস্তে পড়া হবে, তা নিয়ে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। তবে জোরে পড়ার পক্ষের হাদিস তুলনামূলক অধিক সহীহ ও স্পষ্ট। আস্তে বা জোরে উভয় অবস্থায় সালাত সহিহ হয়ে যাবে। তবে কিরাআত জোরে পড়া সুন্নাহ (সহীহ বুখারি হা/১০৪০; ১০৬৫; সহীহ মুসলিম হা/ ৯০১; আল মাওসু‘আতুল ফিকহিয়্যাহ; খণ্ড: ২৭; পৃষ্ঠা: ২৫৭)
(৩).সূর্যগ্রহণের সালাতে প্রতি রাকাআতে রুকু কয়টি করে করতে হবে, তা নিয়ে আলিমগণের মাঝে মতভেদ আছে। কারণ এ ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনার হাদীস পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন হাদীসের মাঝে সমন্বয় করে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হল দু’রাক‘আত সালাতে (২+২) ৪টি রুকূ হয় এবং এটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ।(সহীহ বুখারী হা/১০৬৬; সহীহ মুসলিম হা/৯১০)
.
(৪).প্রথম রাকআতে রুকূ থেকে উঠে সামিআল্লাহ হুলিমানহামিদা এবং রাব্বানা লাকাল হামদ্ বলার পর আবারো সূরা ফাতিহা পড়বে এবং আরো একটি দীর্ঘ কিরআত পড়বে,অর্থাৎ ) এ সালাতে দুই রাআতে চারটি রুকূ ও চারটি সিজদা রয়েছে,এই সালাতে প্রথম রাকআতে সূরা আনকাবূত এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা রূম কিংবা সূরা লুকমান পড়া সুন্নাত।
.
(৫).জামাতবদ্ধ হয়ে মাসজিদে এই সালাত পড়া উত্তম। তবে, ব্যক্তিগতভাবেও নিজ নিজ ঘরে এই নামাজ পড়া যাবে। জামাআতে আদায় করলে নারীরাও এই নামাজে অংশ নিতে পারবেন। আবার, বাসায় একাকিও পড়া যাবে। আয়িশা (রা.), আসমা (রা.) ও অন্যান্য নারীগণ নবিজির সাথে সূর্যগ্রহণের নামাজ আদায় করেছিলেন। (সহীহ বুখারি হা/১০৫৩; মুসলিম হা/১৯৮০; ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৬; পৃষ্ঠা: ৩১০)
.
(৬).এই সালাতের জন্য পবিত্রতা অর্জনে অজু করাই যথেষ্ট। তবে গোসল করতে পারলে, সেটিকে উত্তম (মুস্তাহাব) বলেছেন আলিমগণ।
.
(৭).সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সালাতে কিরাআত ও রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা সুন্নাত (তবে বাধ্যতামূলক নয়) প্রথম রাকআতের তুলনা দ্বিতীয় রাকআতের সময় একটু কম লাগাবে।
.
(৮).এ সালাত দু’রাকআত, এই সালাতের জন্য আজান ও ইকামতের প্রয়োজন নেই।
.
(৯).উত্তম হলো সূর্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকে নিয়ে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত সালাতে থাকা। সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ শেষ হওয়ার আগেও সালাত শেষ করা বৈধ। বাকি সময় যিকর, দু‘আ ও ইস্তিগফারে কাটানো উচিত।(সহীহ বুখারী হা/১০৪৪)
.
(১০).পূর্বেই বলা হয়েছে যে, চন্দ্র-সূর্য গ্রহণের সালাত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। কিন্তু এর তুলনায় যে সালাতের গুরুত্ব বেশী সেই সালাতের সময়ে এই সালাতের সময় হলে অধিক গুরুত্বপূর্ণ সালাতই পড়তে হবে। যেমন, জুমুআহ বা ঈদের সময় সূর্যগ্রহণ শুরু হলে, অথবা তারাবীহ্‌র সময় চন্দ্রগ্রহণ শুরু হলে গ্রহণের সালাতের উপর ঐ সকল সালাত প্রাধান্য পাবে।
.
(১১).নিষিদ্ধ সময়ের মধ্যে; যেমন ফজর ও আসরের পর গ্রহণ লাগলেও এই সালাত পড়া যায়। ফরয সালাতের সময় এসে গেলে এই সালাত হালকা করে পড়তে হবে। সালাতের পরও গ্রহণ বাকী থাকলে দ্বিতীয়বার ঐ সালাত পড়া উচিত নয়। যেমন গ্রহণ প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত কেবল পঞ্জিকার হিসাবের উপর নির্ভর করে ঐ সালাত পড়া জায়েজ নয়। অনুরুপ জায়েজ নয় গ্রহণ দৃশ্য না হলে।
.
(১২).ভূমিকম্প, ঝড়, নিরবচ্ছিন্ন বজ্রপাত, আগ্নেয়গিরির অগ্নি উদগিরণ প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও গ্রহণের মত নামায পড়ার কথা আলী, ইবনে আব্বাস ও হুযাইফা সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত আছে।(ইমাম ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৫৫)
(১৩).সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সময় রাসূল ﷺ ক্রীতদাস মুক্ত করতে এবং কবরের আযাব থেকে পানাহ চাইতেও আদেশ করেছেন। (সহীহ বুখারী হা/১০৫০)
.
(১৪).পরিশেষে জেনে রাখা ভাল যে, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময়ে যত বিধিনিষেধের কথা বলা হয়—যেমন: গর্ভবতী মায়েরা এই কাজ সেই কাজ করতে পারবে না, এই সময়ে কেউ খেতে পারবে না, এই সময়ে সন্তান জন্ম নিলে এই হবে সেই হবে, এই সময়ে বৈধ যৌন সঙ্গমও করা যাবে না—এগুলো সবই কুসংস্কার; এসবে বিশ্বাস রাখা যাবে না। এগুলো শরীয়তে আছে মনে করে এ কথা বলা ও মানা হলে তা বিদআত হবে। তবে খালি চোখে গ্রহণ দেখলে চোখ খারাপ হতে পারে, সে কথা সত্য। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়,

জুয়েল মাহমুদ সালাফি 

Translate