Tuesday, August 19, 2025

আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে কেবল সম্মান প্রদর্শনের জন্য সিজদা করা কি শিরক হিসেবে গণ্য হবে

 প্রশ্ন: আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে যেমন কবরের উপর, পীরকে, শিক্ষককে, অথবা কেবল সম্মান প্রদর্শনের জন্য কাউকে সিজদা করা কি শিরক হিসেবে গণ্য হবে?

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর;আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে সিজদা করা শিরক হবে কিনা বিষয়টি ব্যাখ্যা সাপেক্ষে। আমরা বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে আলোচনার মাধ্যমে উদঘাটন করার চেষ্টা করব।
.
শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তাভাবনা করলে রুকু-সিজদা প্রধানত দুই প্রকার:
.
প্রথমত: সিজদায়ে ইবাদত (عبادة السجود):এটি হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সামনে সর্বোচ্চ বিনয়, পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও ইবাদতের নিয়তে করা সিজদা। এই সিজদা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই বৈধ ও শোভনীয়। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে ইবাদতের নিয়তে সিজদা করবে, সে মহা শিরকের (শিরকে আকবরের) মধ্যে পতিত হবে।
.
দ্বিতীয়ত: সিজদায়ে তাহিয়্যা (التحية السجود): এটি করা হয় সম্মান, সম্ভাষণ বা কারো মর্যাদা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। ইসলামের আগের কিছু শরিয়তে এটি বৈধ ছিল। কিন্তু ইসলাম আগমনের পর একে চূড়ান্তভাবে হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে কেবল সম্মানের জন্য সিজদা করে, তবে সে অবশ্যই হারাম কাজ করল, কিন্তু এতে তার ঈমান নষ্ট হবে না এবং সে শিরক বা কুফরে লিপ্ত হবে না।
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:السُّجُودُ عَلَى ضَرْبَيْنِ : سُجُودُ عِبَادَةٍ مَحْضَةٍ ، وَسُجُودُ تَشْرِيفٍ ، فَأَمَّا الْأَوَّلُ فَلَا يَكُونُ إلَّا لِلَّهِ“সিজদা দুই প্রকার: (এক) ইবাদতের সিজদা, এবং (দুই) সম্মানসূচক সিজদা। ইবাদতের সিজদা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই হয়ে থাকে।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৬১) তিনি আরও বলেছেন:وَأَجْمَعَ الْمُسْلِمُونَ عَلَى: أَنَّ السُّجُودَ لِغَيْرِ اللَّهِ مُحَرَّمٌ “. ا “মুসলিমগণ সর্বসম্মত যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য সিজদা করা হারাম।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৫৮) তিনি (রাহিমাহুল্লাহ)
আরও বলেছেন:” فإن نصوص السنة ، وإجماع الأمة : تُحرِّم السجودَ لغير الله في شريعتنا ، تحيةً أو عبادةً ، كنهيه لمعاذ بن جبل أن يسجد لما قدمَ من الشام وسجدَ له سجود تحية”.
“হাদিসের স্পষ্ট দলিল এবং সমগ্র উম্মাহর ইজমা প্রমাণ করে যে, আমাদের শরিয়তে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য সিজদা করা সম্পূর্ণরূপে হারাম; তা ইবাদতের উদ্দেশ্যে হোক কিংবা কেবল সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে হোক। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়েমেন সফর থেকে ফেরার পর মু‘আয ইবনু জাবাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে তাঁর জন্য সিজদা করা থেকে নিষেধ করেছিলেন; অথচ মু‘আয (রাঃ) তা করেছিলেন কেবল অভিবাদনের সিজদা হিসেবে।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ, জামিউল মাসায়েল; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৫)
.
ইমাম কুরতুবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃوَهَذَا السُّجُودُ الْمَنْهِيُّ عَنْهُ : قَدِ اتَّخَذَهُ جُهَّالُ الْمُتَصَوِّفَةِ عَادَةً فِي سَمَاعِهِمْ، وَعِنْدَ دُخُولِهِمْ عَلَى مَشَايِخِهِمْ وَاسْتِغْفَارِهِمْ ، فَيُرَى الْوَاحِدُ مِنْهُمْ إِذَا أَخَذَهُ الْحَالُ ـ بِزَعْمِهِ ـ يَسْجُدُ لِلْأَقْدَامِ ، لِجَهْلِهِ ؛ سَوَاءٌ أَكَانَ لِلْقِبْلَةِ أَمْ غَيْرِهَا ، جَهَالَةً مِنْهُ ، ضَلَّ سَعْيُهُمْ وَخَابَ عَمَلُهُمْ”এই সিজদা, যা আমাদের শরিয়তে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, দুর্ভাগ্যবশত কিছু অজ্ঞ সুফী নিজেদের মধ্যে প্রচলিত করেছে। তারা তাদের ‘সামা‘’ (সঙ্গীতানুষ্ঠান)-এর সময়, অথবা শায়খদের সামনে প্রবেশকালে কিংবা তাদের কাছে ইস্তিগফার প্রার্থনার সময় একে অভ্যাসে পরিণত করেছে। দেখা যায়, তাদের মধ্যে কেউ যখন তথাকথিত ‘হাল’ (আধ্যাত্মিক আবেশ)-এ পড়ে, তখন সে শায়খের পায়ের সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে তা সে কাবার দিকেই হোক বা অন্যদিকে। নিঃসন্দেহে এটি তার জাহিলি অজ্ঞতার ফল। তারা অজ্ঞতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে, যার পরিণতিতে তাদের সাধনা ব্যর্থ হলো এবং তাদের কর্ম ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো।”(তাফসির কুরতুবী; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৯৪)
.
দ্বিতীয়তঃ যারা বলেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা সর্বাবস্থায় শিরক কারণ সিজদা মূলত ইবাদত, আর তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা যায় না” তাদের এই বক্তব্য দুর্বল। এর খণ্ডনে প্রমাণ হলো:
.
(১).ফেরেশতাদের আদমকে সিজদার নির্দেশ:
.
আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদম (আলাইহিস সালাম) কে সিজদা করার জন্য। যদি সিজদা করা সর্বদাই শিরক হতো, তবে আল্লাহ কখনোই তাদেরকে এমন নির্দেশ দিতেন না। ইমাম তাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:“(فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ) অর্থাৎ—এটি ছিল সম্মান ও মর্যাদার সিজদা,ইবাদতের উদ্দেশ্যে নয়।”(তাফসীরে তাবারী,খণ্ড;১৪;পৃষ্ঠা;৬৫) ইবনুল আরাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:اتَّفَقَتْ الْأُمَّةُ عَلَى أَنَّ السُّجُودَ لِآدَمَ ، لَمْ يَكُنْ سُجُودَ عِبَادَةٍ“সমগ্র উম্মতের এ ব্যাপারে ঐক্যমত হয়েছে যে, আদমের প্রতি সিজদা ইবাদতের সিজদা ছিল না।”(আহকামুল কুরআন,খণ্ড;১;পৃষ্ঠা;২৭) ইবনে হাযম আয-যাহিরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:وَلَا خلاف بَين أحد من أهل الْإِسْلَام فِي أَن سجودهم لله تَعَالَى سُجُود عبَادَة ، ولآدم سُجُود تَحِيَّة وإكرام“মুসলিমদের মধ্যে এবিষয়ে কোনো মতভেদ নেই যে,ফেরেশতাগণ আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে সিজদা করেছিলেন ইবাদতের সিজদা হিসেবে, আর আদমের উদ্দেশ্যে করেছিলেন তা ছিল অভিবাদন ও সম্মান প্রদর্শনের সিজদা।”(আল-ফাসলু ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১২৯)
.
(২).ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সন্তানদের ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-কে সিজদা:
.
আল্লাহ তাআলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন যে, ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সন্তানরা ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-এর প্রতি সিজদা করেছিলেন। যদি সিজদা সর্বাবস্থায় শিরক হতো, তবে আল্লাহর মনোনীত নবীগণ কখনোই তা করতেন না। আর এটাও বলা যাবে না যে, এটি ছিল পূর্ববর্তী শরিয়তের কোনো বিশেষ বিধান; কারণ শিরক তো কোনো যুগের শরিয়তেই বৈধ ছিল না। তাওহীদ সর্বদাই অবিচল ও চিরস্থায়ী আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে শুরু করে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ পর্যন্ত সকল নবীর দাওয়াত ও শরিয়তে তাওহীদ-ই ছিল মূল ভিত্তি।
.
ইমাম তাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:قَالَ ابْنُ زَيْدٍ فِي قَوْلِهِ: ( وَخَرُّوا لَهُ سُجَّدًا): ذَلِكَ السُّجُودُ تَشْرِفَة ، كَمَا سَجَدَتِ الْمَلَائِكَةُ لِآدَمَ تَشْرِفَةً ، لَيْسَ بِسُجُودِ عِبَادَةٍ.وَإِنَّمَا عَنَى مَنْ ذَكَرَ بِقَوْلِهِ: إِنَّ السُّجُودَ كَانَ تَحِيَّةً بَيْنَهُمْ ، أَنَّ ذَلِكَ كَانَ مِنْهُمْ عَلَى الْخُلُقِ ، لَا عَلَى وَجْهِ الْعِبَادَةِ مِنْ بَعْضِهِمْ لِبَعْضٍ ، وَمِمَّا يَدُلُّ عَلَى أَنَّ ذَلِكَ لَمْ يَزَلْ مِنْ أَخْلَاقِ النَّاسِ قَدِيمًا ، عَلَى غَيْرِ وَجْهِ الْعِبَادَةِ مِنْ بَعْضِهِمْ لِبَعْضٍ، قَوْلُ أَعْشَى بَنِي ثَعْلَبَةَ:فَلَمَّا أَتَانَا بُعَيْدَ الْكَرَى ** سَجَدْنَا لَهُ وَرَفَعْنَا الْعَمَارَا“ইবনে জায়েদ তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন,এটি ছিল মর্যাদা প্রদর্শনের সিজদা,যেমন ফেরেশতারা আদম (আলাইহিস সালাম)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য সিজদা করেছিল; এটি আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নয়। এবং যে ব্যক্তি বলেছেন, ‘এটি ছিল তাদের মধ্যে অভিবাদনের জন্য,তাদের বক্তব্যের অর্থও এই যে, এটি ছিল ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের নিদর্শন, ইবাদতের উদ্দেশ্যে নয়। এর প্রমাণ হলো, প্রাচীন যুগ থেকে মানুষ এভাবে সিজদার মাধ্যমে পরস্পরকে সম্মান করতো, যা ইবাদতের জন্য নয়। যেমন কবি ‘আশা বানু সা‘লাবাহ’ বলেছেন:“যখন সে আমাদের কাছে নিদ্রার পর এলো, আমরা তাকে সিজদা করলাম এবং উঁচু আসনে বসালাম।”(তাফসীরে তাবারী, খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৩৫৬)
হাফিয ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:وَقَدْ كَانَ هَذَا سَائِغًا فِي شَرَائِعِهِمْ ؛ إِذَا سلَّموا عَلَى الْكَبِيرِ يَسْجُدُونَ لَهُ ، وَلَمْ يَزَلْ هَذَا جَائِزًا مِنْ لَدُنْ آدَمَ إِلَى شَرِيعَةِ عِيسَى عَلَيْهِ السَّلَامُ ، فَحُرِّمَ هَذَا فِي هَذِهِ الْمِلَّةِ ، وجُعل السُّجُودُ مُخْتَصًّا بِجَنَابِ الرَّبِّ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى”তাদের শরিয়তে বৈধ ছিল যে, তারা বড়কে সালাম জানাতে সিজদা করতো। এই রীতি আদম (আ.)-এর যুগ থেকে ঈসা (আ.)-এর শরিয়ত পর্যন্ত চলমান ছিল। পরে আমাদের শরিয়তে তা হারাম করা হয়েছে, এবং সিজদাকে একমাত্র মহান রব্বুল আলামীন-এর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।”(তাফসীরুল কুরআনিল আযীম,খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৪১২) কাসেমী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “নিঃসন্দেহে এটি ইবাদতের সিজদা বা দাসত্বের সিজদা ছিল না; বরং কেবল সম্মান প্রদর্শনের সিজদা ছিল এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা নেই।”(মাহাসিনুত-তাওয়ীল, ৬/২৫০
.
(৩).মুআয (রাঃ) সিরিয়া থেকে ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সিজদা করেছিলেন। যদি এটা শিরক হত, তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতেন, কিন্তু এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল যে তিনি তাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে তাকে সিজদা করা জায়েজ নয়। দলিল হচ্ছে; আব্দুল্লাহ্ ইবনু আবূ আওফা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুআয (রা.) সিরিয়া থেকে ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সিজদা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ হে মু‘আয! এ কী? তিনি বলেন, আমি সিরিয়ায় গিয়ে দেখতে পাই যে, তথাকার লোকেরা তাদের ধর্মীয় নেতা ও শাসকদেরকে সিজদা করে। তাই আমি মনে মনে আশা পোষণ করলাম যে, আমি আপনার সামনে তাই করবো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তোমরা তা করো না। কেননা আমি যদি কোন ব্যক্তিকে আল্লাহ্ ছাড়া অপর কাউকে সিজদা করার নির্দেশ দিতাম, তাহলে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করতে। সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! স্ত্রী তার স্বামীর প্রাপ্য অধিকার আদায় না করা পর্যন্ত তার প্রভুর প্রাপ্য অধিকার আদায় করতে সক্ষম হবে না। স্ত্রী শিবিকার মধ্যে থাকা অবস্থায় স্বামী তার সাথে জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে চাইলে স্ত্রীর তা প্রত্যাখ্যান করা অনুচিত”।(ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৩; সিলসিলা সহীহা হা/১২০৩)
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
وَمَعْلُومٌ أَنَّهُ لَمْ يَقُلْ: لَوْ كُنْت آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَعْبُدَ”.
“এটা সর্বজনবিদিত যে তিনি বলেননি: “যদি আমি কাউকে ইবাদত করার আদেশ দিই।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৬০)
.
ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৪৮) বলেন:
أَلا ترى الصحابة في فرط حبهم للنبي صلى الله عليه وسلم ، قالوا ألا نسجد لك ، فقال: لا ، فلو أذن لهم لسجدوا له سجود إجلال وتوقير ، لا سجود عبادة ، كما قد سجد إخوة يوسف عليه السلام ليوسف .وكذلك القول في سجود المسلم لقبر النبي صلى الله عليه وسلم على سبيل التعظيم والتبجيل : لا يكفر به أصلاً ، بل يكون عاصياً ، فليعرَّفْ أن هذا منهي عنه ، وكذلك الصلاة إلى القبر
“তুমি কি দেখো না যে সাহাবাগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাদের গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছিলেন: ‘আমরা কি আপনাকে সিজদা করব না?’ তিনি বললেন, ‘না।’ যদি তিনি অনুমতি দিতেন, তবে তারা তাঁকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য সিজদা করত, ইবাদতের উদ্দেশ্যে নয় যেমন ইউসুফ আলাইহি সালাম-এর ভাইরা ইউসুফকে সিজদা করেছিল। অনুরূপভাবে, সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের প্রতি সিজদা করার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে: এর মাধ্যমে সে কুফরী করে না; বরং সে পাপ করছে। তাই তাকে বলা উচিত যে, এটি জায়েজ নয়। একই নিয়ম প্রযোজ্য কবরের দিকে মুখ করে নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও।”(মুজাম আল-শুয়ুখুল কাবীর; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৭৩)
.
(৪).কিছু হাদিসে প্রমাণিত হয়েছে যে কিছু প্রাণী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সিজদা করেছিল। যদি কেবল সিজদা করা শিরক হত, তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে এটি ঘটত না।
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
أمَّا الْخُضُوعُ وَالْقُنُوتُ بِالْقُلُوبِ ، وَالِاعْتِرَافُ بِالرُّبُوبِيَّةِ وَالْعُبُودِيَّةِ : فَهَذَا لَا يَكُونُ عَلَى الْإِطْلَاقِ إلَّا لِلَّهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى وَحْدَهُ ، وَهُوَ فِي غَيْرِهِ مُمْتَنِعٌ بَاطِلٌ.وَأَمَّا السُّجُودُ : فَشَرِيعَةٌ مِنْ الشَّرَائِعِ ؛ إذْ أَمَرَنَا اللَّهُ تَعَالَى أَنْ نَسْجُدَ لَهُ ، وَلَوْ أَمَرَنَا أَنْ نَسْجُدَ لِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِهِ غَيْرِهِ : لَسَجَدْنَا لِذَلِكَ الْغَيْرِ ، طَاعَةً لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ ، إذْ أَحَبَّ أَنْ نُعَظِّمَ مَنْ سَجَدْنَا لَهُ،. وَلَوْ لَمْ يَفْرِضْ عَلَيْنَا السُّجُودَ لَمْ يَجِبْ أَلْبَتَّةَ فِعْلُهُ .فَسُجُودُ الْمَلَائِكَةِ لِآدَمَ : عِبَادَةٌ لِلَّهِ ، وَطَاعَةٌ لَهُ وَقُرْبَةٌ يَتَقَرَّبُونَ بِهَا إلَيْهِ ، وَهُوَ لِآدَمَ تَشْرِيفٌ وَتَكْرِيمٌ وَتَعْظِيمٌ.
وَسُجُودُ إخْوَةِ يُوسُفَ لَهُ : تَحِيَّةٌ وَسَلَامٌ ؛ أَلَا تَرَى أَنَّ يُوسُفَ لَوْ سَجَدَ لِأَبَوَيْهِ تَحِيَّةً ، لَمْ يُكْرَهْ لَهُ”
“অন্তরে বিনয় ও ভক্তি, প্রভুত্ব স্বীকার এবং দাসত্বের স্বীকৃতি—এগুলো কখনো একমাত্র আল্লাহর বাইরে অন্য কারও জন্য হতে পারে না। তিনি মহান এবং মহিমাময়। যদি এটি আল্লাহর ব্যতীত অন্য কারো প্রতি প্রকাশিত হয়, তবে তা নিষিদ্ধ এবং অবৈধ। সিজদার বিষয়টি বিশেষত শারঈ আইন এবং হুকুমের সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ আল্লাহ আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন কেবল তাঁর উদ্দেশ্যে সিজদা করতে। যদি তিনি আমাদেরকে তাঁর সৃষ্টির অন্য কাউকে সিজদা করার আদেশ দিতেন, তাহলে আমরা তার আনুগত্যে সেই অন্যকে সিজদা করতাম, কারণ সিজদা হল সম্মান প্রদর্শনের একটি মাধ্যম,এবং যদি তিনি চাইতেন যে আমরা যার প্রতি সিজদা করেছি তাকে সম্মান করি। যদি আল্লাহ সিজদা করার আদেশ না দিতেন, তবে এটি কখনোই বাধ্যতামূলক হতো না। আদম (আ.) কে ফেরেশতাদের দ্বারা সিজদা করা আল্লাহর ইবাদতের অংশ ছিল, তার প্রতি আনুগত্য এবং নৈকট্য লাভের জন্য। এটি আদমের জন্য সম্মান ও শ্রদ্ধার নিদর্শন।ইউসুফ (আ.)-এর ভাইদের তাকে সিজদা করা ছিল কেবল একটি অভিবাদনের রূপ। তুমি কি দেখো না, যদি ইউসুফ তার পিতামাতাকে সালামের মাধ্যমে সিজদা করত, তাহলে তা মাকরুহ (অপছন্দনীয়) হত না।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৬০)
.
(৬)। বিভিন্ন মাযহাবের অধিকাংশ আলেমদের মত অনুযায়ী, সিজদা এবং ইবাদতের উদ্দেশ্যে করা সিজদার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ফখরুদ্দীন আয-জায়লা’ই (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:وَمَا يَفْعَلُونَ مِنْ تَقْبِيلِ الْأَرْضِ بَيْنَ يَدَيْ الْعُلَمَاءِ : فَحَرَامٌ ، وَالْفَاعِلُ وَالرَّاضِي بِهِ : آثِمَانِ ؛ لِأَنَّهُ يُشْبِهُ عِبَادَةَ الْوَثَنِ .وَذَكَرَ الصَّدْرُ الشَّهِيدُ : أَنَّهُ لَا يَكْفُرُ بِهَذَا السُّجُودِ ؛ لِأَنَّهُ يُرِيدُ بِهِ التَّحِيَّةَ “যা তারা করে থাকে অর্থাৎ আলেমদের সামনে গিয়ে মাটিতে চুমু খাওয়া এটি হারাম। যে এটা করে এবং যে এতে সন্তুষ্ট হয়, উভয়েই গুনাহগার; কারণ এর মধ্যে মূর্তিপূজার সাদৃশ্য রয়েছে।আর সাদরুশ শহীদ উল্লেখ করেছেন: এ ধরনের সিজদার মাধ্যমে সে কাফের হবে না; কারণ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয় কেবল সম্ভাষণ (অভিবাদন), ইবাদত নয়।”(যাইলায়ী,‘তাবইনুল হাকায়েক; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ২৫) ইবনে নুজাইম হানাফী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:وَالسُّجُودُ لِلْجَبَابِرَةِ : كُفْرٌ ، إنْ أَرَادَ بِهِ الْعِبَادَةَ ؛ لَا إِنْ أَرَادَ بِهِ التَّحِيَّةَ ، عَلَى قَوْلِ الْأَكْثَرِ“জালিম শাসকদের উদ্দেশ্যে সিজদা করা কুফর,যদি সে এর দ্বারা ইবাদত উদ্দেশ্য করে। কিন্তু যদি এর দ্বারা কেবল অভিবাদন (সম্মান প্রদর্শন) উদ্দেশ্য করে, তবে অধিকাংশ আলিমদের মতে তা কুফর নয়।”(আল-বাহরুর রায়েক খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১৩৪)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:مَا يَفْعَلُهُ كَثِيرٌ مِنْ الْجَهَلَةِ مِنْ السُّجُودِ بَيْنَ يَدَيْ الْمَشَايِخِ .. ذَلِكَ حَرَامٌ قَطْعًا ، بِكُلِّ حَالٍ ، سَوَاءٌ كَانَ إلَى الْقِبْلَةِ أَوْ غَيْرِهَا ، وَسَوَاءٌ قَصَدَ السُّجُودَ لِلَّهِ تَعَالَى ، أَوْ غَفَلَ ، وَفِي بَعْضِ صُوَرِهِ مَا يَقْتَضِي الْكُفْرَ ، أَوْ يُقَارِبُهُ ، عَافَانَا اللَّهُ الْكَرِيمُ “অনেক জাহেল লোক শাইখদের সামনে সিজদা করার মাধ্যমে যেসব কাজ করে থাকে এটি অবশ্যই হারাম, কোন অবস্থাতেই তা জায়েয নয়। কিবলামুখী হয়ে হোক কিংবা অন্যদিকে হয়ে হোক, উদ্দেশ্য যদি আল্লাহ তাআলার জন্য সিজদা করাও হয়, অথবা অসাবধানতাবশত হয় সব ক্ষেত্রেই তা নিষিদ্ধ। বরং এর কিছু কিছু রূপ এমন আছে যা কুফরের দাবি রাখে বা কুফরের কাছাকাছি নিয়ে যায়। আল্লাহ মহান আমাদের হেফাযত করুন।”(ইমাম নববী আল-মাজমু‘ খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৬৯)। শিহাবুদ্দীন আর-রামলি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:مُجَرَّد السُّجُودِ بَيْنَ يَدَيْ الْمَشَايِخِ : لَا يَقْتَضِي تَعْظِيمَ الشَّيْخِ كَتَعْظِيمِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ ، بِحَيْثُ يَكُونُ مَعْبُودًا، وَالْكُفْرُ إنَّمَا يَكُونُ إذَا قَصَدَ ذَلِكَ “শায়খদের সামনে কেবল সিজদা করা মানে এই নয় যে শায়খকে এমনভাবে সম্মান করা যাক যেন আল্লাহকে করা হয় যিনি মহিমান্বিত ও প্রশংসার যোগ্য। যদি উদ্দেশ্য হয় যে শায়খকে সেইরকম উপাসনার মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে, তখনই এটি কুফরী হিসেবে গণ্য হবে।(নিহায়াতুল মুহতাজ ইলা শারহুল মিনহাজ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১২২)
আর-রুহাইবানি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:السُّجُودُ لِلْحُكَّامِ وَالْمَوْتَى بِقَصْدِ الْعِبَادَةِ : كَفْرٌ ، قَوْلًا وَاحِدًا ، بِاتِّفَاقِ الْمُسْلِمِينَ .
وَالتَّحِيَّةُ لِمَخْلُوقٍ بِالسُّجُودِ لَهُ : كَبِيرَةٌ مِنْ الْكَبَائِرِ الْعِظَامِ
ইবাদতের উদ্দেশ্যে শাসক বা মৃতদের সিজদা করা কুফর, এবং এই বিষয়ে মুসলিমরা সর্বসম্মতভাবে একমত।আর কোনো সৃষ্ট জীবকে অভিবাদন (সালাম) জানানোর উদ্দেশ্যে তাকে সিজদা করা এটি গুরুতর বড় বড় কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।”(মাতালিব উলি নুহা; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ২৭৮)
.
আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, আল-মুফাসসির, আল-ফাক্বীহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ‘আলী আশ-শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১২৫০ হি.] বলেছেন:
فلا بد من تقييده بأن يكون سجوده هذا قاصدا لربوبية من سجد له ، فإنه بهذا السجود قد أشرك بالله عز وجل ، وأثبت معه إلهًا آخر .وأما إذا لم يقصد إلا مجرد التعظيم ، كما يقع كثيرا لمن دخل على ملوك الأعاجم : أنه يقبل الأرض تعظيما له ، فليس هذا من الكفر في شيء ، وقد علم كل من كان من الأعلام ، أن التكفير بالإلزام ، من أعظم مزالق الأقدام ؛ فمن أراد المخاطرة بدينه ، فعلى نفسه تَجَنَّى”.
“এটি স্পষ্টভাবে বলা অত্যন্ত জরুরি যে, যদি কোনো সিজদা সেই প্রভুর প্রতি উৎসর্গিত হয় যাঁকে সিজদা করা হচ্ছে, অর্থাৎ তাঁর প্রভুত্ব স্বীকার করে,তাহলে এইভাবে সিজদা করার মাধ্যমে সে আল্লাহর সাথে একজনকে অংশীদার সাব্যস্ত করেছে, এবং নিশ্চিত করেছে যে তাঁর সাথে অন্য একজন উপাস্য আছে।কিন্তু যদি তার উদ্দেশ্য কেবল সম্মান প্রদর্শন করা হয়, যেমনটি প্রায়শই ঘটে থাকে যারা বিদেশী (অ-আরব) রাজাদের কাছে প্রবেশ করে, যেখানে তারা রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মাটি চুম্বন করে, তাহলে এটি মোটেও কুফরী নয়। সমস্ত আলেম একমত যে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কাফের হিসাবে চিহ্নিত করা একটি অত্যন্ত গুরুতর বিষয় এবং এটিকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।”(ইমাম শাওকানী; আস-সাইলুল জাররার; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫৮০)
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:الانحناء عند السلام حرام ، إذا قصد به التحية ، وأَما إن قصد به العبادة فكفر”অভিবাদন জানাতে গিয়ে রুকু করা হারাম, যদি এটি শুধুমাত্র অভিবাদনের উদ্দেশ্যে করা হয়। আর যদি এটি ইবাদতের উদ্দেশ্যে করা হয়, তাহলে তা কুফরী হিসেবে গণ্য হবে।” (ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িল,ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১০৯)
.
শায়খ আব্দুল আজিজ আব্দুল লতিফ বলেছেন:فمن المعلوم أن سجود العبادة ، القائم على الخضوع والذل والتسليم والإجلال لله وحده : هو من التوحيد الذي اتفقت عليه دعوة الرسل، وإن صرف لغيره فهو شرك وتنديد .ولكن لو سجد أحدهم لأب أو عالم ونحوهما ، وقصده التحية والإكرام : فهذه من المحرمات التي دون الشرك ، أما إن قصد الخضوع والقربة والذل له فهذا من الشرك”এটা সর্বজনবিদিত যে,একমাত্র আল্লাহর প্রতি বিনয়, আত্মসমর্পণ ও শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সিজদা করা তাওহীদের (আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতির) অন্তর্ভুক্ত; আর সকল রাসূল এ দিকেই মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। অতএব, যদি এ সিজদা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা হয়, তবে তা হবে শিরক এবং আল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বীদের শরীক করা। কিন্তু কেউ যদি তার পিতা বা আলেম প্রমুখের জন্য সিজদা করে এবং উদ্দেশ্য হয় কেবল সালাম প্রদান ও সম্মান প্রদর্শন, তবে এটি এমন এক নিষিদ্ধ কাজ যা শিরকের চেয়ে নিচু পর্যায়ের। তবে যদি উদ্দেশ্য হয় আত্মসমর্পণ ও বিনয় প্রদর্শন, তবে নিঃসন্দেহে তা শিরক।”(নাওয়াকিদুল ঈমান আল-কাওলিয়্যাহ ওয়াল আমালিয়্যাহ” পৃষ্ঠা: ২৭৮)
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনার পরিসমাপ্তি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহ্‌ তাআলার ব্যতীত কারো উদ্দেশ্যে যেমন কবর, পীর, শিক্ষক বা কেবল সম্মান প্রদর্শনের জন্য সিজদা করা এই উম্মতের জন্য সরাসরি হারাম এবং কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। আর যদি নিয়তে গরমিল থাকে, যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদতের উদ্দেশ্যে সিজদা করা হয় তবে এটি শিরক হবে। সুতরাং কারো উদ্দেশ্যে সিজদা করা শিরক সম্পর্কিত হুকুম লাগানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই যথাযথ দলিল উপস্থাপন এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা প্রয়োজন, যেমনটি আমরা উপরের আলোচনায় করেছি। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

রাসূলে পাক এবং কুরআনে পাক এই শব্দগুলো ব্যবহার না করাই উত্তম ও নিরাপদ

 প্রশ্ন: আর রাসুলুল মুকাদ্দাস বা রাসূলে পাক, এবং আল কুরআনুল মুকাদ্দাস বা কুরআনে পাক। এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের অনুমতি আছে কি?

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর “রাসূলে পাক” এবং “কুরআনে পাক” বাক্যগুলোতে আরবি ও ফারসির শব্দ মিশ্রিত হয়েছে। “রাসূলে পাক” এবং “কুরআনে পাক” আরবি বাক্যগুলো সঠিকভাবে হবে:الرسول المقدَّس —(আর রসুলুল মুকাদ্দাস) বা “পবিত্র রাসূল”القرآن المقدَّس —(আল কুরআনুল মুকাদ্দাস) বা “পবিত্র কুরআন”।
.
আরবী ‘রাসূল’ (رَسُول) শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রেরিত, প্রেরণকৃত, দূত, প্রতিনিধি, বার্তাবাহক (Messenger, Emissary, Envoy, Delegate, Apostle) ইত্যাদি।আরবী ‘আরসালা’ (أرسل) অর্থ প্রেরণ করা। অন্যের পক্ষ থেকে কোনো সংবাদ, তথ্য বা বাণী নিয়ে যিনি আগমন করেন তাকে রাসূল বলা হয়। শারঈ পরিভাষায় রাসূল অর্থ আল্লাহর মনোনিত ও নির্বাচিত ব্যক্তি যাকে আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে তাঁর বাণী ও নির্দেশনা প্রদান করেছেন এবং তা মানুষের কাছে প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন।অপরদিকে ফারসি পাক” শব্দের বাংলা অর্থ “পবিত্র” বা “শুদ্ধ” অতএব, “রাসূলে পাক” অর্থ “পবিত্র প্রেরিত রাসূল” বা “শুদ্ধ দূত”। এখন আর রসুলুল মুকাদ্দাস বা রাসূলে পাক এবং আল কুরআনুল মুকাদ্দাস কুরআনে পাক।শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের অনুমতি আছে কিনা এটি নিয়ে একটু আলোচনা করার চেষ্টা করব।
.
▪️প্রথমত: আরবি ভাষায় “المقدَّس” (মুকাদ্দাস) শব্দের অর্থ বিবেচনায় নিলে, কুরআন মজীদ ও নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ক্ষেত্রে এই শব্দ ব্যবহার করতে কোনো বাধা নেই। المقدَّس” (মুকাদ্দাস) শব্দের গুরুত্বপূর্ণ অর্থের মধ্যে রয়েছে: বরকতময় ও পবিত্র, আর এ দুটো গুণই কুরআন ও নবী (ﷺ)-এর মাঝে রয়েছে।
.
ইবনে মানযুর (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বিখ্যাত গ্রন্থ লিসানুল আরবে বলা হয়েছে :
” و ” المُقَدَّس ” : المُبارَك ، والأَرض المُقَدَّسة : المطهَّرة ، وقال الفرَّاء : الأَرض المقدَّسة : الطاهرة ، وهي دِمَشْق وفِلَسْطين وبعض الأُرْدُنْ ، ويقال : أَرض مقدَّسة أَي : مباركة ، وهو قول قتادة ، وإِليه ذهب ابن الأَعرابي “
“এবং আল মুকাদ্দাস (المقدّس)” অর্থ ‘বরকতময়’ বা ‘পবিত্র’।“আল-আরদ আল-মুকাদ্দাসাহ (الأرض المقدّسة)” অর্থ ‘পবিত্র ভূমি’।ফাররাআ বলেন: পবিত্র ভূমি বলতে বোঝায় দামেশক, ফিলিস্তিন এবং জর্ডানের কিছু অংশ। আবার বলা হয়, পবিত্র ভূমি মানে বরকতময় ভূমি এ কথাই কাতাদাহ বলেছেন, ইবনুল আ’রাবিও এ অভিমতই পোষণ করেছেন।”(লিসানুল আরব; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১৬৮)
.
শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন:
والقرآن هو أحق بالطهر والتقديس من كل كلام ؛ فهو مطهر عن كل عيب ونقص ، مقدس عن الخطأ ، أو أن يشتبه بكلام البشر ؛ لكننا مع ذلك نرى أن وصفه ذلك ، لا يعني أن يطلق عليه أنه ( الكتاب المقدس ) على سبيل الاسم ، أو اللقب الملازم له ، كما هو حال النصارى مع كتابهم ؛ لأننا لم نعرف ذلك عن السلف ، ولم يعد عنهم تلك التسمية ، ويخشى أن يكون فيها ـ أيضا ـ نوع تشبه أو محاكاة لأهل الكتاب مع كتابهم
“অতএব, নিঃসন্দেহ কুরআনুল কারিম অন্য সকল বাণীর চেয়ে সর্বোচ্চ পবিত্র এবং সম্মানযোগ্য; এটি ত্রুটিমুক্ত, দোষ, ঘাটতি এবং যাবতীয় অপূর্ণতা থেকে পবিত্র, এবং মানব রচিত বাক্যের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।তবুও, আমরা মনে করি কুরআনের ক্ষেত্রে “المقدَّس” (পবিত্র) শব্দটি ব্যবহার করা মানে এই নয় যে কুরআনুল কারিমকে الكتاب المقدس (পবিত্র গ্রন্থ) এই নামে ডাকা হবে, যেমন খ্রিস্টানরা তাদের বাইবেলকে বলে থাকে। কারণ,এমন নামকরণ আমরা সাহাবা বা সালাফদের থেকে পাইনি, তারা কখনো কুরআনকে এই নামে ডাকেননি।বরং,এ ধরনের নাম ব্যবহার করলে আহলে কিতাবদের (খ্রিস্টানদের) অনুকরণ বা মিল পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে অনুচিত। (এ বিষয়ে বিস্তারিত দেখতে পারে ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৭৬০৪৬)
.
▪️দ্বিতীয়ত: উপরের আলোচনার আলোকে স্পষ্ট হয় যে, “المقدَّس” পবিত্র শব্দটি শুধু আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট নয়, বরং কিছু সৃষ্টির ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়, যারা এই গুণের যোগ্য। আবু হিলাল আসকারি (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর বই আল ফুরুকুল লুগাওয়িয়্যাহ গ্রন্থে (অন্যদের বরাত দিয়ে) তাসবীহ ও তাকদিস শব্দের পার্থক্য তুলে ধরে বলেন:
والحاصل : أن التقديس لا يختص به سبحانه بل يستعمل في حق الآدميين ، يقال : فلان رجل مقدَّس : إذا أريد تبعيده عن مسقطات العدالة ووصفه بالخير ، ولا يقال : رجل مسبَّح ، بل ربما يستعمل في غير ذوي العقول أيضاً ، فيقال : قدَّس الله روح فلان ، ولا يقال : سبَّحه .ومن ذلك قوله تعالى ( ادْخُلُوا الأَرضَ المُقَدَّسَةَ ) يعني : أرض المقدسة ، يعني : أرض الشام .
সংক্ষেপে: “তাকদিস (পবিত্রতা) শুধু আল্লাহর জন্য সীমাবদ্ধ নয়। এটা মানবজাতির ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়, যেমন বলা হয়: “ফুলান ব্যক্তি একজন ‘মুকাদ্দাস’ (পবিত্র ব্যক্তি)”,যদি তার ন্যায়পরায়ণতা ও সদগুণ বোঝাতে হয়। তবে মুসাববাহ (তাসবীহপ্রাপ্ত ব্যক্তি) বলা হয় না। এমনকি অচেতন জিনিস বা সত্তার ক্ষেত্রেও এই শব্দ ব্যবহৃত হয়,যেমন বলা হয়: قدس الله روح فلان (আল্লাহ অমুকের আত্মাকে পবিত্র করুন), কিন্তু “سبحه الله বলা হয় না। এছাড়াও এর উদাহরণ কুরআনের আয়াতেও এসেছে: অর্থ: তোমরা পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করো”(সূরা আল-মায়িদাহ ৫:২১) অর্থাৎ “আল-আরদুল-মুকাদ্দাসাহ”, যা আশ-শামের (বৃহত্তর সিরিয়ার) ভূমিকে নির্দেশ করছে।”(আল-ফুরুক আল-লুগাওয়িয়্যাহ; পৃষ্ঠা: ১২৫)
.
এছাড়াও “তাফসীরে আস-সাদীতে বলা হয়েছে: (قُلْ نَزَّلَهُ رُوحُ الْقُدُسِ) “বলুন,(হে মুহাম্মদ),পবিত্র আত্মা (রূহুল-কুদুস) এটি অবতীর্ণ করেছেন”।(সূরা নাহল: ১০২) এখানে “রূহুল-কুদুস”অর্থ হলো ফেরেশতা জিব্রাঈল,যিনি হলেন ত্রুটিমুক্ত,পবিত্র বার্তাবাহক এবং সকল বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার ঊর্ধ্বে।”(তাফসীরে আস-সাদী,পৃষ্ঠা;৪৪৯) আর সূরা আল-মায়িদাহ/২১-এ আল্লাহ বলেন:(يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ الَّتِي كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَرْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَاسِرِينَ) হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি লিখে দিয়েছেন তাতে তোমরা প্রবেশ কর,এবং পশ্চাদপসরণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে।”(সূরা মায়েদাহ;২১) আয়াতের তাফসিরে হাফিয ইবনে কাসির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:”فقال تعالى مخبراً عن موسى أنه قال ( يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الأرْضَ الْمُقَدَّسَةَ ) أي : المطهرة“এখানে আল্লাহ বলেন, মূসা (আলাইহিস সালাম) তার জনগণের উদ্দেশে বললেন: ‘হে আমার জনগণ! সেই পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ কর”।এর মানে হলো: পবিত্র (অপরিচ্ছন্নতা মুক্ত) ভূমি।”(তাফসিরে ইবনু কাসীর;খণ্ড;৩;পৃষ্ঠা;৭৫) ইবনে আশুর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:والأرض المقدّسة بمعنى : المطهّرة المباركة ، أي الّتي بارك الله فيها “পবিত্র ভূমি অর্থ হলো পরিশুদ্ধ এবং বরকতময় ভূমি,অর্থাৎ যে ভূমিতে আল্লাহ বরকত দিয়েছেন।”(তাহরীর ওয়াত-তানভীর, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা: ১৬২)
.
▪️তৃতীয়ত: উভয় বর্ণনাই অর্থাৎ ‘মুবারক’ (বরকতময়) এবং ‘মুতাহ্‌হার'(পবিত্র) কুরআন মাজিদ ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়েছে।
(১).মুবারক (বরকতময়) বর্ণনা:
ক.কুরআন মাজিদ সম্পর্কে, এটিকে বরকতময় (মুবারক) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যেখানে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:كِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰهُ اِلَیۡكَ مُبٰرَكٌ “এটা মুবারক কিতাব, এটা আমরা আপনার প্রতি নাযিল করেছি,..।(সূরা সোয়াদ: ২৯)
খ.নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও বরকতময় তাঁর বার্তায়, তাঁর কার্যকলাপে, তাঁর সত্তায় এবং এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর রেখে যাওয়া চিহ্নসমূহে। সাঈদ বিন আলী বিন ওয়াহাফ আল-কাহতানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
والأمور المباركة أنواع منها : 1. القرآن الكريم مبارَك ، أي : كثير البركات والخيرات ؛ لأن فيه خير الدنيا والآخرة ، وطلب البركة من القرآن يكون : بتلاوته حق تلاوته والعمل بما فيه على الوجه الذي يرضي الله عز وجل . 2. الرسول صلّى الله عليه وسلّم مبارك ، جعل الله فيه البركة ، وهذه البركة نوعان : أ. بركة معنوية : وهي ما يحصل من بركات رسالته في الدنيا والآخرة ، لأن الله أرسله رحمة للعالمين وأخرج الناس من الظلمات إلى النور وأحل لهم الطيبات وحرم عليهم الخبائث وختم به الرسل ، ودينه يحمل اليسر والسماحة . ب. بركة حسّيّة ، وهي على نوعين : النوع الأول : بركة في أفعاله صلّى الله عليه وسلّم ، وهي ما أكرمه الله به من المعجزات الباهرة الدالة على صدقه . النوع الثاني : بركة في ذاته وآثاره الحسية ، وهي ما جعل الله له صلّى الله عليه وسلّم من البركة في ذاته ؛ ولهذا تبرك به الصحابة في حياته وبما بقي له من آثار جسده بعد وفاته “
বরকতপূর্ণ জিনিস (মুবারক) বিভিন্ন ধরণের হয়, যার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি অন্তর্ভুক্ত:
(১).কুরআন মাজিদ বরকতময় অর্থাৎ, এটি বহু কল্যাণ ও ফায়দাসমৃদ্ধ; কারণ এতে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিহিত। কুরআন থেকে বরকত লাভের উপায় হলো যথাযথভাবে এর তিলাওয়াত করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এতে যা বলা হয়েছে তার উপর আমল করা প্রয়োজন।
(২).রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরকতময় – আল্লাহ তাঁর মাঝে বরকত রেখেছেন। এই বরকত দুই প্রকার:
ক. আধ্যাত্মিক বরকত (معنوية): তাঁর বার্তার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে যে বরকত এসেছে,তা।কারন আল্লাহ তাঁকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছেন। তিনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসেছেন, তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করেছেন, অপবিত্র বস্তুসমূহ হারাম করেছেন, তাঁকে সব নবীর শেষ নবী বানিয়েছেন,এবং তাঁর ধর্ম হল সহজতা এবং সহনশীলতার ধর্ম।
খ. ইন্দ্রিয়গত বরকত (حسّيّة): এটিও দুই প্রকার:
প্রথম প্রকার: তাঁর কর্মে বরকত আল্লাহ তাঁকে যে বিস্ময়কর মুজিজা দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন,সেগুলো তাঁর সত্যতার প্রমাণ বহন করে।
দ্বিতীয় প্রকার: তাঁর সত্তা ও তাঁর দেহগত চিহ্নে বরকত
অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর দেহ ও সত্তায় বরকত দিয়েছেন।
এজন্য সাহাবিগণ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর সাথে তাবাররুক (বরকত লাভের উদ্দেশ্যে স্পর্শ ইত্যাদি) করতেন এবং মৃত্যুর পরেও তাঁর শরীরের অবশিষ্ট বস্তু দিয়ে তাবাররুক করতেন।”(নূরুসসুন্নাহ ও জুলমাতুল বিদআহ পৃষ্ঠা: ৪৯-৫০)
(২). মুতাহহার (পবিত্র) বর্ণনা:
ক.কুরআন মাজিদকে কুরআনকে (মুতাহহার) পবিত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:”আল্লাহর কাছ থেকে এক রাসূল, যিনি তেলাওয়াত করেন পবিত্র কিতাবসমূহ”(সূরা বাইয়্যিনাহ: ২) তাফসিরে তাবারীতে এসেছে: يقول : يقرأ صحفاً مطهرة من الباطل ” এখানে বলা হয়েছে,তিনি এমন পবিত্র কিতাব পাঠ করেন, যা মিথ্যা থেকে মুক্ত।”(তাফসিরে তাবারী; খণ্ড: ২৪; পৃষ্ঠা: ৫৪০)
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন: ( مُطَهَّرَة ):منقاة من الشرك ومن رذائل الأخلاق ومن كل ما يسوء ؛ لأنها نزيهة مقدسة.”মুতাহহারা অর্থ:তা শিরক,নিন্দনীয় চরিত্র ও সব অপবিত্রতা থেকে পরিশুদ্ধ। কারণ, এটি সম্মানিত ও পবিত্র।”(তাফসির জুয ‘আম্মা; পৃষ্ঠা: ২৮১)
খ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও মুতাহহার আল্লাহ তাআলা তাঁর অন্তরকে পবিত্র করেছেন।
ইমাম আবুল কাসিম সুহাইলী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: والقول عندي في الرسول عليه السلام : أنه متطهِّر ومُطهَّر ، أما متطهِّر : فلأنه بشرٌ آدميٌّ يغتسل من الجنابة ويتوضأ من الحدث ، وأما مطهَّر : فلأنه قد غُسل باطنُه وشُقَّ عن قلبه ومُلئ حكمة وإيماناً فهو مطهَّر ومتطهِّر”আমার মতে,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন ‘মুতাত্তাহির’ (যিনি নিজেকে পবিত্র করেন) এবং ‘মুতাহ্‌হার’ (যাকে আল্লাহ পবিত্র করেছেন)।‘মুতাত্তাহির কারণ,তিনি একজন মানুষ, যিনি জানাবাত অবস্থায় গসল করেন, হাদাস থেকে অজু করেন। ‘মুতাহ্‌হার’ কারণ, তাঁর অন্তর ধুয়ে ফেলা হয়েছে, চিরে ফেলা হয়েছে এবং তা হিকমাহ ও ঈমানে পূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। অতএব তিনি পবিত্র ও নিজেকে পবিত্রকারী উভয়ই।”(আর রওযুল উনুফ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১১৯)
.
শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন:
ومع أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مطهر مبارك ، منزه عن كل ما يعيبه ويشينه وينقص من قدره وشانه ، حاشاه ، صلى الله عليه وسلم ؛ فإننا لا نرى أن يطلق عليه وصف (المقدس) أو يقرن ذلك باسمه ؛ ولا نعلم أحدا من أهل السلف أو أهل العلم والسنة والاتباع قد فعل ذلك معه صلى الله عليه وسلم ، ولا نعلم أيضا أنه أطلق عليه ذلك في شيء من النصوص الشرعية ، ويخشى أن يفتح ذلك باب الغلو ، والإطراء له بما يخالف هديه ، ويوقع في نهيه صلى الله عليه وسلم في قوله ( لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ ) رواه البخاري ( 3261 ) .
“যদিও আল্লাহর রাসূল ﷺ পূত-পবিত্র, বরকতময়, এবং এমন সব দোষত্রুটি ও নিন্দনীয় বিষয় থেকে মুক্ত, যা তাঁর মর্যাদা ও সন্মান ক্ষুণ্ন করে। মহান আল্লাহ তাঁর মর্যাদাকে সর্বদা পবিত্র রাখুন (ﷺ) তবুও আমরা মনে করি না যে তাঁর জন্য “পবিত্র” (المقدس) উপাধি ব্যবহার করা উচিত বা এ শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে সংযুক্ত করা উচিত।কারন আমরা জানি না যে সালাফ কিংবা আহলে সুন্নাহ ও অনুসরণের পথে চলা কোনো আলেম,কখনো তাঁর জন্য এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন; আবার এটাও জানা নেই যে শরিয়তের কোনো নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে তাঁর জন্য এ উপাধি প্রয়োগ করা হয়েছে। বরং আশঙ্কা করা হয়, এভাবে বললে তাঁর সম্পর্কে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জনের এমন একটি দরজা খুলে যেতে পারে, যা তাঁর নিজের নির্দেশনা ও আদর্শের পরিপন্থী।যখন তিনি বলেছিলেন: “তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসা ইবনে মারইয়াম সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করে থাকে। আমি আল্লাহর বান্দা। তাই আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূলই বলো।”(সহীহ বুখারী, হা/৩৪৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৪; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৬৮১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৬২৩৯; জামেউস সগীর, হা/১৩৩১৯; মুসনাদে হুমাইদী, হা/৩০; ইসলাম সুওয়াল জাওয়াব, ফাতাওয়া নং-১৭৫৮২৮)
.
বুখারীর হাদিসটির ব্যাখ্যায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, আবুল ফাদল আহমাদ বিন আলি ইবনু হাজার আল-আসকালানি, (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম:৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] বলেন:وقال ابن التين : معنى قوله ( لاَ تُطْرُونِي ) : لا تمدحوني كمدح النصارى ، حتى غلا بعضهم في عيسى ، فجعله إلهاً مع الله ، وبعضهم ادَّعى أنه هو الله ، وبعضهم ابن الله “ইবনুত তীন বলেন হাদীসে রাসূল (ﷺ)-এর বাণী ‘আমাকে অতিরিক্ত প্রশংসা করো না’ এর অর্থ হলো: তোমরা আমাকে এমনভাবে প্রশংসা করো না যেমন নাসারা (খ্রিস্টানরা) ঈসা (আ.)-এর প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করেছে। তাদের মধ্যে কেউ ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর সাথে শরিক বানিয়েছে, কেউ দাবি করেছে তিনি নিজেই আল্লাহ, আবার কেউ বলেছে তিনি আল্লাহর পুত্র।” (ফাতহুল বারী ফী শারহিল বুখারী,খণ্ড: ১২, পৃষ্ঠা: ১৪৯)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরের আলোচনার ভিত্তিতে আমাদের বক্তব্য হলো “রাসূলুল মুকাদ্দাস” বা “রাসূলে পাক”, এবং “আল-কুরআনুল মুকাদ্দাস” বা “কুরআনে পাক” এই ধরনের শব্দগুচ্ছ কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ্‌তে সরাসরি ব্যবহৃত হয়নি। আমাদের পূর্ববর্তী সালাফে সালিহীন অর্থাৎ সাহাবী, তাবেঈ ও তাবেঈ তাবেঈন এমনকি তাদের পরবর্তী বিশিষ্ট আলেমগণও এ ধরনের অভিব্যক্তি ব্যবহার করেননি।অতএব, যেহেতু এ শব্দগুচ্ছ শরীয়তের প্রমাণিত ভাষার অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই এগুলো ব্যবহার না করাই উত্তম এবং নিরাপদ। বিশেষত, যখন “রাসূলে পাক” বলা হয়, তখন অনেক সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নাম উল্লেখের পর তার ওপর দুরুদ পাঠ করা থেকে বিরত থাকা হয়। অথচ, উম্মতের ওপর তার একটি হক হলো তার নাম শুনলেই দুরুদ পাঠ করা। এছাড়া বাস্তবে দেখা যায়, “রাসূলে পাক” শব্দগুচ্ছটি আমাদের সমাজে মূলত বিদআতপন্থী বা শিয়া-মুখাপেক্ষী কিছু সুন্নি বক্তাদের মধ্যে বেশি প্রচলিত। সুতরাং এ ধরনের শব্দ পরিহার করে আমরা “রাসূল (ﷺ)” বলব যাতে একদিকে সুন্নাহ অনুসরণ করা হয়, অন্যদিকে দুরুদ পাঠের হকও আদায় হয় এবং আমরা নেকি অর্জন করি। ইনশাআল্লাহ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

উপযুক্ত পাত্রের প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও বাবা যদি মেয়ের বিয়েতে বাধা দেন

 প্রশ্ন: উপযুক্ত পাত্রের প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও বাবা যদি মেয়ের বিয়েতে বাধা দেন, তবে কি মেয়ে বিচারকের কাছে অভিযোগ করতে পারবে? একটি দলিল ভিত্তিক পর্যালোচনা।

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি। অতঃপর বর্তমানেও অনেক অভিভাবক (পিতা) কেবল নিজের গোত্রের বা সমমর্যাদার কাউকেই মেয়ের জন্য যোগ্য মনে করেন যার ফলে উপযুক্ত প্রস্তাব এলেও তারা তা ফিরিয়ে দেন, এমনকি বিয়েতে দেরি হয়ে গেলেও। এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুতর অন্যায় এবং আল্লাহ্‌ তাঁদের উপর যে আমানত অর্পণ করেছেন, তার প্রতি স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা। একজন নারীকে উপযুক্ত পাত্রের প্রস্তাব আসার পরেও বিবাহ থেকে বঞ্চিত করা বা অযথা বিলম্ব করানোর কারণে যে বিপদ ও ফিতনার দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়,তার প্রকৃত পরিমাণ একমাত্র আল্লাহই ভালোভাবে জানেন। সমাজের বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করলে এসব পরিণতি স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। হাদিসেও রাসূলুল্লাহ ﷺ এ ধরনের ক্ষতিকর পরিণতির প্রতি সতর্ক করেছেন। প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা যে ব্যক্তির দীনদারী ও নৈতিক চরিত্রে সন্তুষ্ট আছ তোমাদের নিকট সে ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব করলে তবে তার সাথে বিয়ে দাও। তা যদি না কর তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা-ফ্যাসাদ ও চরম বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।”(সুনানে তিরমিজি হা/১০৮৪; সনদ হাসান) সুতরাং যদি কোনো অভিভাবক (ওলি) এমন কোনো উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে (যার দ্বীনদারি ও চরিত্র উত্তম) মেয়েকে বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে তাকে ‘আযল’ (বাধা প্রদানকারী অভিভাবক) বলা হয়, এবং তখন তার কাছ থেকে অভিভাবকত্ব চলে যায় এবং তা পরবর্তী অভিভাবকের (নিকটবর্তী পুরুষ আত্মীয়) কাছে চলে যায়।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,
( ومعنى العضل منع المرأة من التزويج بكفئها إذا طلبت ذلك ، ورغب كل واحد منهما في صاحبه. قال معقل بن يسار : زوجت أختا لي من رجل ، فطلقها ، حتى إذا انقضت عدتها جاء يخطبها ، فقلت له : زوجتك ، وأفرشتك ، وأكرمتك ، فطلقتها ثم جئت تخطبها ! لا والله لا تعود إليك أبدا. وكان رجلا لابأس به، وكانت المرأة تريد أن ترجع إليه ، فأنزل الله تعالى هذه الآية : ( فلا تعضلوهن ) فقلت : الآن أفعل يا رسول الله . قال : فزوجها إياه . رواه البخاري. وسواء طلبت التزويج بمهر مثلها أو دونه ، وبهذا قال الشافعي .فإن رغبت في كفء بعينه ، وأراد تزويجها لغيره من أكفائها ، وامتنع من تزويجها من الذي أرادته ، كان عاضلا لها .فأما إن طلبت التزويج بغير كفئها فله منعها من ذلك ، ولا يكون عاضلا لها )
“আযল (العضل)-এর অর্থ হলো যখন অভিভাবক কোনো নারীকে তার সমমর্যাদা সম্পন্ন (কুফু) পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হতে বাধা দেয়, অথচ সে (নারী) ওই বিয়ে চাইছে এবং উভয় পক্ষই পরস্পরের প্রতি আগ্রহী। যেমন মা‘কিল ইবন ইয়াসার (রাঃ) বলেন: আমি আমার এক বোনকে একজন পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলাম। পরে সে তাকে তালাক দিল। ইদ্দত শেষ হলে সেই ব্যক্তি আবার প্রস্তাব নিয়ে এলো। আমি তাকে বললাম: আমি তো তোমাকে বিয়ে দিয়েছিলাম, তোমাকে গৃহে স্থান দিয়েছিলাম, তোমাকে সম্মান করেছিলাম আর তুমি তাকে তালাক দিয়েছো! তারপর আবার এসে তার হাতে প্রস্তাব দিচ্ছো! না, আল্লাহর কসম, সে আর কখনো তোমার কাছে ফিরবে না। অথচ লোকটি মোটেও খারাপ ছিল না এবং নারীটি চাচ্ছিল তার কাছে ফিরে যেতে। তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াত অবতীর্ণ করলেন—﴿فَلَا تَعْضُلُوهُنَّ﴾“তোমরা তাদেরকে (বিয়েতে) বাধা দিও না”। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, এখন আমি তাকে (আমার বোনকে) তার সঙ্গে বিয়ে দিব। অতঃপর তিনি তাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিলেন।”(সূরা বাকারা: ২৩২; সহীহ বুখারী হা/৪৫২৯) এ ব্যাপারে নারী যদি তার সমমর্যাদার পুরুষকে পছন্দ করে এবং সে মোহর তার সমপর্যায়ের নারীদের মতোই হোক বা কম হোক উভয় অবস্থাতেই এ কথাই ইমাম শাফেয়ী (রাহিমাহুল্লাহ)-ও বলেছেন। আবার যদি নারী কোনো নির্দিষ্ট সমমর্যাদা সম্পন্ন পুরুষকে বিয়ে করতে চায়, অথচ অভিভাবক তাকে তার বদলে অন্য কোনো সমমর্যাদার পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান এবং ওই পছন্দের পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান, তবে সেটিও তার প্রতি ‘আযল গণ্য হবে।তবে, যদি নারী এমন কারো সঙ্গে বিয়ে করতে চায় যে সমমর্যাদাসম্পন্ন নয় (শরীয়তের মানদণ্ডে অযোগ্য), তবে অভিভাবকের পক্ষে তাকে বাধা দেওয়া বৈধ হবে এবং এ ক্ষেত্রে তাকে ‘আযল’ বলা হবে না।”(ইবনু কুদামাহ আল মুগনী; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ৩৮৩)
.
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৮৯ হি.] বলেছেন:
( متى بلغت المرأة سن البلوغ وتقدم لها من ترضاه دينا وخلقا وكفاءة ، ولم يقدح فيه الولي بما يبعده عن أمثالها ويثبت ما يدعيه ، كان على ولي المرأة إجابة طلبه من تزويجه إياها ، فإن امتنع عن ذلك نبه إلى وجوب مراعاة جانب موليته ، فإن أصر على الامتناع بعد ذلك سقطت ولايته وانتقلت إلى من يليه في القربى من العصبة )
“যখন কোনো নারী বালেগ (শরিয়ত অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক) হয়ে যায় এবং তার কাছে এমন একজন পুরুষের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে যার দ্বীনদারিতা, চরিত্র ও (সামাজিক) কুফুওতে সে সন্তুষ্ট এবং অভিভাবক এমন কোনো আপত্তি উত্থাপন করতে পারে না যা সাধারণত তার মতো নারীর জন্য ওই প্রস্তাবকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে এবং যা সে (অভিভাবক) দাবি করে তার প্রমাণও উপস্থাপন করতে পারে না তাহলে অভিভাবকের উপর আবশ্যক (ওয়াজিব) হবে তার এই প্রস্তাব মেনে নিয়ে তাকে বিয়ে দেওয়া। অতঃপর যদি অভিভাবক এতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে তাকে সতর্ক করা হবে যে, তাকে অবশ্যই তার দায়িত্বাধীন নারীর স্বার্থের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। এরপরও যদি সে (ওলি) জেদ ধরে অস্বীকৃতিই জানাতে থাকে, তবে তার অভিভাবকত্ব (ওলিয়্যাহ) বাতিল হয়ে যাবে এবং তা তার পরবর্তী নিকটতম রক্ত সম্পর্কিত পুরুষ আত্মীয়ের (আসাবাহ) কাছে স্থানান্তরিত হবে।”(ফাতাওয়া ইমাম মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম; খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ৯৭)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন;
إذا منع الولي تزويج امرأة بخاطب كفء في دينه وخلقه فإن الولاية تنتقل إلى من بعده من الأقرباء العصبة الأولى فالأولى ، فإن أبوا أن يزوجوا كما هو الغالب ، فإن الولاية تنتقل إلى الحاكم الشرعي ، ويزوج المرأةَ الحاكمُ الشرعي ، ويجب عليه إن وصلت القضية إليه وعلم أن أولياءها قد امتنعوا عن تزويجها أن يزوجها لأن له ولاية عامة ما دامت لم تحصل الولاية الخاصة. وقد ذكر الفقهاء رحمهم الله أن الولي إذا تكرر رده للخاطب الكفء فإنه بذلك يكون فاسقا وتسقط عدالته وولايته بل إنه على المشهور من مذهب الإمام أحمد تسقط حتى إمامته فلا يصح أن يكون إماما في صلاة الجماعة في المسلمين وهذا أمر خطير .وبعض الناس كما أشرنا إليه آنفا يرد الخطاب الذين يتقدمون إلى من ولاه الله عليهن وهم أكفاء . ولكن قد تستحي البنت من التقدم إلى القاضي لطلب التزويج، وهذا أمر واقع ، لكن عليها أن تقارن بين المصالح والمفاسد ، أيهما أشد مفسدة : أن تبقى بلا زوج وأن يتحكم فيها هذا الولي على مزاجه وهواه فإن كبرت وبرد طلبها للنكاح زوجها ، أو أن تتقدم إلى القاضي بطلب التزويج مع أن ذلك حق شرعي لها. لا شك أن البديل الثاني أولى ، وهو أن تتقدم إلى القاضي بطلب التزويج لأنها يحق لها ذلك ؛ ولأن في تقدمها للقاضي وتزويج القاضي إياها مصلحة لغيرها ، فإن غيرها سوف يقدم كما أقدمت ، ولأن في تقدمها إلى القاضي ردع لهؤلاء الظلمة الذين يظلمون من ولاهم الله عليهن لمنعهن من تزويج الأكفاء ، أي أن في ذلك ثلاث مصالح :
مصلحة للمرأة حتى لا تبقى بلا زواج .
مصلحة لغيرها إذ تفتح الباب لنساء ينتظرن من يتقدم ليتبعنه .
منع هؤلاء الأولياء الظلمة الذين يتحكمون في بناتهم أو فيمن ولاهم الله عليهن من نساء ، على مزاجهم وعلى ما يريدون.
وفيه أيضا مصلحة إقامة أمر الرسول صلى الله عليه وسلم حيث قال : ” إذا أتاكم من ترضون دينه وخلقه فأنكحوه إلا تفعلوا تكن فتنة في الأرض وفساد كبير”.
كما أن فيه مصلحة خاصة وهي قضاء وطر المتقدمين إلى النساء الذين هم أكفاء في الدين والخلق)
“যদি কোনো অভিভাবক এমন একজন উপযুক্ত (দ্বীনদার ও চরিত্রবান) পাত্রের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধা দেন, তাহলে অভিভাবকত্ব তার কাছ থেকে তুলে নিয়ে পরবর্তী ঘনিষ্ঠ পুরুষ আত্মীয়ের কাছে হস্তান্তর হবে। আর যদি তারাও বিয়ে না দেয়, যা প্রায়ই দেখা যায়, তাহলে শরিয়তের নির্দেশে বিচারক মেয়ের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করবেন। যখন বিষয়টি বিচারকের নজরে আসে এবং সে নিশ্চিত হয় যে মেয়ের স্বার্থে অভিভাবকরা দায়িত্ব পালন করছে না, তখন বিচারকের উচিত হবে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পথ সুগম করা। কারণ বিচারকের কাছে একটি সর্বজনীন অভিভাবকত্বের অধিকার রয়েছে, যা তখন প্রযোজ্য হয় যখন স্বাভাবিক অভিভাবকরা দায়িত্বে অবহেলা করে।ফকিহগণ উল্লেখ করেছেন যে, কোনো অভিভাবক (ওলি) যদি ধারাবাহিকভাবে উপযুক্ত পাত্রকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে তিনি ফাসেক (অধার্মিক) হয়ে যান এবং তাঁর ন্যায়পরায়ণতা ও অভিভাবকত্বের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি ইমাম আহমদের বিখ্যাত মত অনুযায়ী, এমন অভিভাবকের ইমামতি পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায় এবং মুসলিমদের জামাআতের নামাজে তিনি ইমাম হিসেবে দাঁড়াতে পারেন না। এটি একটি অত্যন্ত গুরুতর বিষয়। তবে বাস্তব জীবনে দেখা যায়, মেয়েরা আদালতে গিয়ে বিয়ের জন্য আবেদন করতে লজ্জাবোধ করে। এটি একটি বাস্তব সমস্যা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের উচিত উপকার ও ক্ষতির মধ্যে তুলনা করা, কোনটি বেশি ক্ষতিকর:স্বামী ছাড়া একাকী থেকে যাওয়া এবং এমন একজন অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণে থাকা, যে নিজের খেয়াল ও ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত দেয়, আর যখন সে মেয়ের বিয়ের চাহিদা কমে যাবে তখন বিয়ে দিবে; না কি আদালতের কাছে গিয়ে বৈধ স্বত্ব অনুযায়ী বিয়ের আবেদন করা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দ্বিতীয় বিকল্পটাই উত্তম। অর্থাৎ, মেয়ের উচিত আদালতের কাছে গিয়ে বিবাহের আবেদন করা, কারণ এটি তার শরয়ী অধিকার। আরও গুরুত্বপূর্ণ, যখন সে আদালতে যাবে এবং বিচারক তাকে বিয়ে দিবে, তখন এতে অন্য নারীদের জন্যও উপকার হবে, কারণ তারা তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসবে। একই সঙ্গে,এই জুলুমকারী অভিভাবকদের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা হবে, যারা তাদের আওতাধীন নারীদের উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হতে বাধা দেয়। অর্থাৎ এতে তিনটি বড় উপকারিতা আছে:
১. মেয়েটির জন্য উপকার, যাতে সে একা না থাকে।
২. অন্য নারীদের জন্য উপকার, কারণ এতে তারা উৎসাহ পাবে।
৩. এই জালিম অভিভাবকদের প্রতিরোধ করা, যারা নারীদের নিজেদের খেয়ালখুশিমতো নিয়ন্ত্রণ করে।
এছাড়াও এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ বাস্তবায়িত হবে। তিনি বলেছিলেন:“যখন তোমাদের কাছে এমন কেউ আসবে যার দ্বীন ও চরিত্রে তোমরা সন্তুষ্ট, তখন তার সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দাও। যদি না কর, তবে পৃথিবীতে ফিতনা ও বড় বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।”এতে ব্যক্তিগত উপকারিতাও রয়েছে, যা হলো যারা দ্বীনদার ও চরিত্রবান এবং নারীদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তাদের বৈধ বিবাহের সুযোগ ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত হওয়া।”(ফাতওয়া ইসলামিয়া; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৪৮)
.
ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন:
وليت أنَّا نصل إلى درجة تجرؤ فيها المرأة على أنه إذا منعها أبوها من الكفء خلقاً وديناً تذهب إلى القاضي ويقول لأبيها زَوِّجْها أو أُزوجها أنا أو يُزوجها وليٌ غيرك ؛ لأن هذا حقٌ للبنت إذا منعها أبوها ( أن تشكوه للقاضي ) وهذا حقٌ شرعي . فليتنا نصل إلى هذه الدرجة ، لكن أكثر الفتيات يمنعهن الحياء من ذلك
হায়! যদি আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারতাম, যেখানে কোনো মেয়ের পিতা যদি দ্বীন ও চরিত্রবান পাত্রের সঙ্গে তার বিয়েতে বাধা দেয়, তাহলে সে সাহস করে বিচারকের কাছে গিয়ে বলত: “আমার বিয়ে দিন, নয়তো আপনি দিন, অথবা আমার অন্য কোনো অভিভাবক বিয়ে দিন।” কেননা এটি মেয়ের অধিকার। যদি তার পিতা তাকে বিয়ে থেকে বিরত রাখে, তাহলে তার উচিত বিচারকের কাছে অভিযোগ করা। এটি একটি শরয়ী অধিকার। হায়! আমরা যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারতাম! কিন্তু অধিকাংশ মেয়েরা লজ্জার কারণে তা করতে পারে না।”(ইবনু উসাইমীন আল-লিক্বাউশ শাহরী, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩২৫৮০)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: এক ভাই চায় তার বোনকে এমন একজন পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিতে, যাকে সে (বোন) পছন্দ করে না। এবং মা তার (ভাইয়ের) মন রক্ষা করার জন্য মেয়েকে ঐ পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন, যদিও মেয়ে রাজি ছিল না। এমতাবস্থায়, এই মায়ের কোনো গুনাহ হয়েছে কি?
উত্তরে শাইখ বলেন:
هذا السؤال فيه تفصيل: إن كانت البنت لم ترض فإنه لا يجوز تزويجها مطلقاً..المقدم: هي تقول: إن البنت لم ترض.
الشيخ: لا يزوجها لا أبوها ولا غيره، ولا أمها ولا أخوها ولا غيرهم، النبي صلى الله عليه وسلم نهى عن تزويج النساء إلا بإذنهن، وقال: لا تزوجوا البكر حتى تستأذن، ولا تزوجوا الأيم حتى تستأمر، قالوا: يا رسول الله! في البكر إنها تستحي، قال: إذنها سكوتها.فالحاصل: أن المرأة لا تزوج إلا بإذنها، فكون أمها أو أخيها يجبرانها على الزواج لا يجوز لهما ذلك، كما أنه لا يجوز لأبيها إجبارها على الصحيح أيضاً، إذا كانت بكراً مكلفة أو بنت تسع على الأقل، إذا كانت بنت تسع فأكثر فإنها لابد أن تستشار، فإن أذنت وإلا لم تزوج، وإذنها يكفي فيه السكوت، لأبيها وغير أبيها، لأبيها ولغير أبيها من باب أولى، فأخوها هذا إن كان لأمها فليس ولياً لها، إن كان أخاً من الأم فليس ولياً لها، وإنما أولياؤها العصبة؛ إخوتها الأشقاء، وإخوتها من الأب، هؤلاء هم أولياؤها، أما إن كان أخاً لها من أبيها أو من أبيها وأمها فهو عصبة، لكن ليس له أن يزوجها إلا بإذنها، تزويجها بغير إذنها يكون فاسداً ليس بصحيح، فلابد من أخذ إذنها في الزواج مطلقاً، لكن إذنها صماتها إذا كانت بكراً، أما الثيب التي قد تزوجت فلابد من تصريحها بالإذن، لابد أن تنطق بالإذن. نعم.
“এই প্রশ্নে কিছু বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। যদি মেয়ে রাজি না হয়ে থাকে, তাহলে তাকে বিয়ে দেওয়া কোনো অবস্থাতেই বৈধ নয়। উপস্থাপক বলেন: তিনি (প্রশ্নকারী) বলছেন, মেয়ে রাজি ছিল না। শাইখ বলেন: তাহলে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া জায়েয নয় না তার বাবা, না অন্য কেউ, না মা, না ভাই কারোরই এক্ষেত্রে অধিকার নেই। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নারীদের তাদের অনুমতি ছাড়া বিয়ে দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন: কোনো কুমারী মেয়েকে তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দিয়ো না, এবং কোনো বিবাহিতা নারীকে (যিনি আগেই একবার বিবাহিত ছিলেন) তার মতামত ছাড়া বিয়ে দিয়ো না। সহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! কুমারী তো লজ্জাবতী, সে কীভাবে অনুমতি দেবে? তিনি বললেন: তার নীরবতাই তার সম্মতি। সারকথা: কোনো নারীকে তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দেওয়া জায়েয নয়। তাই তার মা হোক বা ভাই হোক, জোর করে বিয়ে দেওয়া তাদের জন্য বৈধ নয়। এমনকি সঠিক মত অনুযায়ী, তার বাবার পক্ষেও তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া বৈধ নয় যদি সে প্রাপ্তবয়স্ক (বালেগা) কুমারী হয়, অথবা কমপক্ষে ৯ বছর বয়সী হয়। যদি সে ৯ বছর বা তার বেশি বয়সী হয়, তাহলে তার মতামত অবশ্যই নিতে হবে। যদি সে সম্মতি দেয়, তাহলে বিয়ে দেওয়া যাবে, আর যদি না দেয়, তাহলে বিয়ে দেওয়া যাবে না। তার সম্মতির চিহ্ন হবে যদি সে কুমারী হয় তার নীরবতা। এই অনুমতির বিষয়টি তার পিতার জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি অন্য কারো ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বরং পিতার পর অন্যদের ক্ষেত্রে আরও বেশি খেয়াল রাখতে হবে। এ ভাই যদি শুধুমাত্র মাতৃপক্ষীয় ভাই হয় (একই মা, ভিন্ন বাবা), তাহলে সে মেয়েটির ওলী (অভিভাবক) নয়। মেয়েটির অভিভাবক হতে পারে কেবল তার পিতৃপক্ষীয় আত্মীয়রা যেমন: তার পূর্ণ ভাই (একই বাবা-মা) বা পিতৃভ্রাতা (একই বাবা, ভিন্ন মা)।এরাই তার অভিভাবক। তবে যদি এই ভাই তার পিতৃপক্ষীয় ভাই হয় (বা পূর্ণ ভাই হয়), তাহলে সে আসাবা (পুরুষ অভিভাবকদের শ্রেণি) হিসেবে অভিভাবক হতে পারে। কিন্তু তবুও, মেয়েটির সম্মতি ছাড়া সে তাকে বিয়ে দিতে পারে না। তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দেওয়া হলে সে বিয়ে ফাসিদ (অবৈধ, বাতিলযোগ্য) বলে গণ্য হবে। সুতরাং, বিয়ের জন্য মেয়ের অনুমতি অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।কিন্তু যদি সে কুমারী হয়, তাহলে তার নীরবতাই সম্মতি হিসাবে গণ্য হবে। আর যদি সে সাইব হয় (অর্থাৎ আগে বিয়ে হয়েছে এমন নারী), তাহলে অবশ্যই মুখে স্পষ্টভাবে অনুমতি দিতে হবে সে না বলা পর্যন্ত বিয়ে দেওয়া যাবে না।”(ইমামবিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-৪৪৫২)
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] আরও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:প্রশ্ন: কিছু অভিভাবক (ওলী) তাদের মেয়েদের সেই ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধা দেন যারা তাদের জন্য যোগ্য (কুফু) হয়, তাহলে বিধান কী? এবং মেয়েদের অবস্থান কী?
জবাবে শাইখ বলেছেন;
هذه المسألة مسألة عظيمة ومشكلة كبيرة فإن بعض الرجال والعياذ بالله يخونون الله ويخونون أمانتهم ويجنون على بناتهم ، والواجب على الولي أن يتَّبِع ما يُرضي الله ورسوله وقد قال الله تعالى : ( وأنكحوا الأيامى منكم ) أي زوِّجوا الأيامى منكم ( والصالحين من عبادكم وإمائكم ) أي زوجوا الصالحين من العبيد والإماء الرقيقات .وقد قال النبي صلى الله عليه وعلى آله وسلم : ” إذا أتاكم من ترضون خلقه ودينه فزوجوه إلا تفعلوه تكن فتنة في الأرض وفساد كبير ” .وبعض الناس والعياذ بالله يجعل ابنته سلعة يبيعها على من يهوى ويمنعها عمن لا يهوى ، فيزوجها من لا يُرضى خلقه ودينه لأنه يرى ذلك ويمنعها من يُرضى دينه وخلفه لأنه لا يرى ذلك ! ولكن ليت أنا نصل إلى درجة تجرؤ فيها المرأة على أنه إذا منعها أبوها من الكفء خلقاً وديناً تذهب إلى القاضي ويقول لأبيها زَوِّجْها أو أُزوجها أنا أو يُزوجها وليٌ غيرك ؛ لأن هذا حقٌ للبنت إذا منعها أبوها (أن تشكوه للقاضي ) وهذا حقٌ شرعي . فليتنا نصل إلى هذه الدرجة ، لكن أكثر الفتيات يمنعها الحياء من ذلك .
وتبقى النصيحة للوالد أن يتقي الله عز وجل وأن لا يمنعها من الزواج فَتَفْسُدْ وتُفْسِد ، وليزن ذلك بنفسه : لو منع من النكاح ماذا ستكون نفسه ؟ وبنته التي منعها من النكاح ستكون خصماً له يوم القيامة . ( يوم يفر المرء من أخيه وأمه وأبيه وصاحبته وبنيه لكل امرئ منهم يومئذٍ شان يُغنيه ) فعلى الأولياء من آباء أو إخوان أن يتقوا الله عز وجل ، وألا يمنعوا النساء مما هو حقٌ لهن : من تزويجهن من يُرضى دينه وخلقه . نعم لو أن المرأة اختارت من لا يُرضى دينه وخلقه فله أن يمنعها . لكن تختار رجلاً صالحاً في دينه قيماً في أخلاقه ثم يمنعها لهوىً في نفسه : هذا والله حرام ، وإثم وخيانة ، وأي شيء يترتب على منعه من الفساد فإن إثمه عليه .
“এই মাসয়ালাটি অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ এবং একটি জটিল সমস্যা। কিছু পুরুষ (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহকে অবজ্ঞা করে, তাদের দায়িত্ব পালনে অবিচার করে এবং তাদের কন্যাদের প্রতি অন্যায় আচরণ করে।” এবং অভিভাবক (ওলীর) জন্য ফরজ হলো যে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সন্তুষ্টি অনুসরণ করবে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন:”আর তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন তাদের বিয়ে সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও।”(সূরা নূর: ৩২) অর্থাৎ, তোমাদের কন্যা ও দাসীদের মধ্যে সৎ ও যোগ্যদের বিয়ে করাও।” আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:”যখন তোমাদের কাছে এমন কেউ আসবে যার দ্বীন ও চরিত্রে তোমরা সন্তুষ্ট, তখন তার সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দাও। যদি না কর, তবে পৃথিবীতে ফিতনা ও বড় বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।”(তিরমিজি হা/১০৮৪) কিছু লোক আল্লাহর সাহায্য চেয়ে বলছি মেয়েকে এমনভাবে ব্যবহার করে যেন সে একটি পণ্য, যা তারা ইচ্ছে মত বিক্রি বা বিকল্পে রাখতে পারে। তারা তাদের মেয়েকে এমন কারো সঙ্গে বিয়ে দেয়, যার চরিত্র বা দ্বীনদারিত্ব ঠিকঠাক নয়, কেবল নিজেদের স্বার্থ বা পছন্দ অনুসারে; অথচ যিনি চরিত্র ও ধর্মে যোগ্য, তাঁকে তারা বিরত রাখে, কারণ তাঁকে তারা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে না। তবে আশা করা যায়, আমরা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছাবো যেখানে একজন নারী সাহসী হয়ে বলতে পারবে: “যদি আমার পিতা আমাকে যোগ্য চরিত্র ও ধর্মসম্পন্ন কাউকে বিবাহ করতে বাধা দেন, তবে আমি কোর্টে আবেদন করব এবং বলব: আমার পিতাকে আমাকে বিবাহ দিতে বলুন, না হলে আমি নিজে বিবাহ করব বা অন্য কোনো অভিভাবক আমার জন্য বিবাহের ব্যবস্থা করবেন।”কারণ এটি মেয়ের বৈধ অধিকার যে, যদি পিতা তাকে বিবাহ করতে বাধা দেন, সে কোর্টের কাছে অভিযোগ জানাতে পারবে। কিন্তু অধিকাংশ মেয়েই লজ্জা বা সামাজিক কারণে এটি করতে পারে না।
অভিভাবকের জন্য উপদেশ হলো আল্লাহকে ভয় করুক এবং মেয়েকে বিয়ে করতে বাধা না দিক, যাতে সে বিপথে না যায় এবং অন্যদেরও বিপথে না ঠেলে। সে যেন নিজের অন্তরে চিন্তা করে যদি তাকে বিয়ে থেকে বাধা দেওয়া হতো, তবে তার অবস্থা কী হতো? সে মেয়ে, যার বিয়ে সে আটকে রেখেছে, কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী হবে। যেদিন মানুষ তার ভাই, মা, পিতা, স্ত্রী ও সন্তান থেকে পালাবে সেদিন সে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। অতএব, অভিভাবকদের তা পিতা হোক বা ভাই আল্লাহকে ভয় করা উচিত এবং নারীদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না করা উচিত। তাদের উচিত এমন পাত্রের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, যার দ্বীন ও চরিত্র সন্তোষজনক।তবে, যদি মেয়ে এমন কাউকে পছন্দ করে যার দ্বীন বা চরিত্র ঠিক নয়, তাহলে তাকে বাধা দেওয়া অভিভাবকের অধিকার। কিন্তু, সে যদি দ্বীনদার ও নৈতিক চরিত্রবান কাউকে পছন্দ করে এবং অভিভাবক কেবল নিজের খেয়ালখুশির কারণে তাকে বিয়ে করতে বাধা দেয় তবে তা আল্লাহর কসম! হারাম, গুনাহ ও আমানতের খিয়ানত। আর তার এই নিষেধাজ্ঞা থেকে যদি কোনো ফিতনা বা অন্যায় ঘটে, তবে তার পাপ সম্পূর্ণভাবে তার উপর বর্তাবে। যদি কোনো মেয়েকে এমন কারো সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়, যাকে সে পছন্দ করে না, তাহলে এমন বিয়ে বৈধ নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: কোনো কুমারী মেয়েকে বিয়ে দিও না, যতক্ষণ না তার অনুমতি নেয়া হয়। তিনি আরও বলেন: তার নীরবতাই তার অনুমতি। অতএব, কারো মা, ভাই, এমনকি পিতা কেউই মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিতে পারে না। যদি সে প্রাপ্তবয়স্ক (কমপক্ষে ৯ বছরের) হয়, তাহলে তার অনুমতি না নিয়ে বিয়ে দেওয়া বৈধ নয়। যদি কুমারী হয়, তবে তার নীরবতা অনুমতি হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি বিবাহিত হয়ে থাকে (বিধবা/তালাকপ্রাপ্ত), তবে অবশ্যই তার স্পষ্ট সম্মতি নিতে হবে।”(ইবনু উসাইমীন আল-লিক্বাউশ শাহরী, ইসলাম সাওয়াল জবাব ফাতওয়া নং-১০০১৯৬)। পরিশেষে দু’আ করছি মহান আল্লাহ সর্বস্তরের অভিভাবকদের তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করার তাওফীক দিন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

বিয়ের প্রথম দিন স্বামী স্ত্রী সহবাস করতে পারবে না কারন বিয়ের প্রথম রাত কালরাত এই বক্তব্য কতটুকু সঠিক

 ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। অতঃপর মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করার পাশাপাশি তার জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলোও নির্ধারণ করেছেন এবং সেগুলো পূরণের সঠিক পদ্ধতিও শিখিয়ে দিয়েছেন। মানব জীবনে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো জৈবিক চাহিদাও গুরুত্বপূর্ণ। এসব চাহিদা পূরণের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ইসলাম বিবাহের বিধান দিয়েছে। ইসলামের প্রতিটি কাজে যেমন নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন রয়েছে, সহবাসও তার ব্যতিক্রম নয়। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে কিছু নির্দিষ্ট ব্যতিক্রম ছাড়া দিনের যে কোনো সময় ও রাতের যে কোনো মুহূর্তে এবং শরীয়ত সম্মত যে কোনো স্থানে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করা বৈধ। মহান আল্লাহ বলেন “তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য ক্ষেতস্বরূপ; অতএব তোমরা তোমাদের ক্ষেতে যেভাবে ইচ্ছা গমন কর।”(সূরা আল-বাক্বারাহ, ২:২২৩) এই আয়াতটিতে মহান আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর সহবাসের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম বা সীমাবদ্ধতা আরোপ করেননি। সুতরাং উভয়ের সুবিধা ও ইচ্ছানুযায়ী বিবাহের প্রথম দিন হোক বা পরবর্তী যে কোনো দিন শোয়ে, বসে, কাত হয়ে, যে ভঙ্গিতেই হোক তা জায়েয। শরীয়তে সহবাসের নির্দিষ্ট সংখ্যা বেঁধে দেওয়ার কোনো দলিল নেই, কারণ এটি ব্যক্তির অবস্থা,শারীরিক সক্ষমতা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ভিন্ন হয়ে থাকে। যেহেতু সক্ষমতা ও প্রয়োজন ব্যক্তিভেদে আলাদা,তাই শরীয়তের স্বভাবও এ ধরনের বিষয়ে সংখ্যা নির্ধারণ নয়। তবে জানা উচিত সহবাস অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক মিলন স্ত্রীর একটি অধিকার এবং স্বামীর জন্য তা পূরণ করা একটি কর্তব্য। তবে মনে রাখা জরুরি, যৌনাঙ্গ ছাড়া অন্যান্য স্থানে, যেমন পায়ুপথ বা মুখে, সহবাস করা শরীয়তে জায়েয নয়; বরং এটি বিকৃত প্রবৃত্তির কাজ, যা বিভিন্ন হাদীসে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ,শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন; والوطء واجب على الرجل – أي الزوج بأن يجامع زوجته – إذا لم يكن له عذر ، وبه قال مالك“স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা স্বামীর জন্য ওয়াজিব অর্থাৎ স্বামীর উচিত তার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা যদি না কোনো ওযর (অজুহাত) থাকে। এ বিষয়ে ইমাম মালিকও একই মত প্রকাশ করেছেন।”(ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৩০)

.
হাদীসে এসেছে আবদুল্লাহ ইব্‌নু ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, হে ‘আবদুল্লাহ্‌! আমাকে কি এ খবর প্রদান করা হয়নি যে, তুমি রাতভর ‘ইবাদতে দাঁড়িয়ে থাক এবং দিনভর সিয়াম পালন কর? আমি বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহ্‌র রসূল! তিনি বললেন, তুমি এরূপ করো না, বরং সিয়ামও পালন কর, ইফতারও কর, রাত জেগে ‘ইবাদত কর এবং নিদ্রাও যাও। তোমার শরীরেরও তোমার ওপর হক আছে; তোমার চোখেরও তোমার উপর হক আছে এবং তোমার স্ত্রীরও তোমার ওপর হক আছে।”(সহিহ বুখারী হা/৫১৯৯) স্বামীর উপর স্ত্রীর একটি অধিকার হলো, স্বামী তার সাথে রাত্রিযাপন করবে। হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ,শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন;إذا كانت له امرأة لزمه المبيت عندها ليلة من كل أربع ليال ما لم يكن له عذر “যদি কারও স্ত্রী থাকে, তবে (শারঈ) কোনো ওযর না থাকলে তার জন্য প্রতি চার রাতের অন্তত এক রাত স্ত্রীর সাথে রাত্রিযাপন করা আবশ্যক।”(ইবনু কুদামাহ আল-মুগনি; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ২৮; কাশফুল ক্বিনা; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৪৪)
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:ويجب على الزوج وطء امرأته بقدر كفايتها ما لم ينهك بدنه أو يشغله عن معيشته ، .. فإن تنازعا فينبغي أن يفرضه الحاكم كالنفقة وكوطئه إذا زاد“স্বামীর জন্য স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য যতটা প্রয়োজন তার সাথে সহবাস করা বাধ্যতামূলক, যতক্ষণ না এটি তাকে শারীরিকভাবে ক্লান্ত না করে বা তাকে জীবিকা উপার্জন করা থেকে দূরে রাখে… যদি তারা এই বিষয়ে বিতর্ক করে তবে বিচারকের উচিত সহবাসের পদ্ধতিতে আরও বেশি লিখুন যেভাবে তিনি ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরও বেশি লিখে দেন।”(আল-ইখতিয়ারাত আল-ফিকহিয়্যাহ মিন ফাতাওয়া শাইখ আল-ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, পৃষ্ঠা: ২৪৬)
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)-কে একজন পুরুষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যদি সে তার স্ত্রীর সাথে এক মাস বা দুই মাস সহবাস না করে তাহলে তার কি কোন গুনাহ আছে কি না? স্বামীর কি তা করা উচিত?
তিনি জবাবে বলেন:
يجب على الرجل أن يطأ زوجته بالمعروف ، وهو من أوكد حقها عليه ، أعظم من إطعامها ، والوطء الواجب ، قيل : إنه واجب في كل أربعة أشهر مرة ، وقيل : بقدَر حاجتها وقُدْرته ، كما يطعمها بقدَر حاجتها وقُدْرته ، وهذا أصح القولين “
“স্বামীকে অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত বিষয়ের ভিত্তিতে স্ত্রীর সাথে সহবাস করতে হবে; কেননা এটি তার উপর তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকারগুলির একটি; এটা তাকে খাওয়ানোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্ত্রীর সাথে সহবাস করা ওয়াজিব এ ব্যাপারে, ইমামগনের দুটি মতের মধ্যে এক মত অনুসারে, এটি প্রতি চার মাসে কমপক্ষে একবার ওয়াজিব; অন্য একটি মত অনুসারে, এটি তার প্রয়োজন এবং তার সামর্থ্য অনুযায়ী হওয়া উচিত, যেমন তাকে তার প্রয়োজন এবং তার সামর্থ্য অনুযায়ী খাওয়ানো উচিত।দুই মতের মধ্যে দ্বিতীয়টি মতটি অধিকতর সঠিক।(মাজমু’আল-ফাতাওয়া, খন্ড: ৩২; পৃষ্ঠা: ২৭১)
.
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য,জাহেলি যুগের মতোই আজকের সমাজেও বহু কুসংস্কার বিদ্যমান। এর মধ্যে প্রশ্নে উল্লিখিত বিষয়টিও অন্যতম। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক মানুষ বিশ্বাস করে যে, নির্দিষ্ট কিছু দিন ও সময়ে স্বামী-স্ত্রীর সহবাস করা নিষিদ্ধ—যেমন: বিবাহের প্রথম দিন, ঈদের রাত ও দিন, অথবা সপ্তাহের মঙ্গলবার রাত ইত্যাদি। অথচ এসব বিশ্বাস নিছক কুসংস্কার, যার পক্ষে শরয়ি কোনো প্রমাণ নেই।বরং এসব হল বিদাআতি ও পথভ্রষ্টদের বক্তব্য যা ব্যাপক প্রচারণা ও প্রজন্মান্তরে প্রচলনের ফলে অনেকের নিকট দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে, এবং তারা এসব থেকে বিরত হতে চায় না। অথচ মহান আল্লাহ তাআলা সকলস্থান ও সময়ে স্ত্রী সহবাস করা হালাল করেছেন; কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।ইসলামি শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কয়েকটি নিষিদ্ধ সময় আছে, যাতে স্ত্রী সহবাস বৈধ নয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-
.
(১).রমযানের দিনের বেলায় সহবাস করা: আল্লাহ তাআলা বলেন: “সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীসহবাস হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছেদ এবং তোমরা তাদের জন্য পরিচ্ছেদ। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা নিজেদের সাথে খেয়ানত করছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের তওবা কবূল করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন। অতএব, এখন তোমরা তাদের সাথে মিলিত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখে রেখেছেন তা অনুসন্ধান কর। [সূরা বাকারা,আয়াত: ১৮৭] রমজান মাসে দিনের বেলায় যে ব্যক্তি যৌনমিলন করে তিনি মুকীম (নিজ অঞ্চলে অবস্থানকারী) রোযাদার হলে তার উপর বড় কাফ্‌ফারা (আল কাফ্‌ফারাতুল মুগাল্লাযাহ) ওয়াজিব হয়। আর তা হল একজন দাস মুক্ত করা। যদি তা না পায় তাহলে একাধারে দুইমাস সিয়াম পালন করা। আর যদি তাও না পারে তবে ৬০ জন মিসকীনকে খাওয়ানো।যদি নারী সন্তুষ্টচিত্তে যৌনমিলনে সাড়া দেয় তাহলে একই বিধান নারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর যদি জোরপূর্বক নারীর সাথে সহবাস করা হয় তাহলে তার উপর কোন জরিমানা ওয়াজিব হবে না। আর যদি স্বামী-স্ত্রী উভয়ে মুসাফির হয় তবে সহবাসের কারণে তাদের কোন গুনাহ হবে না, তাদের উপর কোন কাফ্‌ফারাও ওয়াজিব হবে না এবং দিনের বাকি অংশ পানাহার ও যৌনমিলন থেকে বিরত থাকাও ওয়াজিব হবে না। শুধু তাদের উভয়কে ঐদিনের রোযা কাযা করতে হবে। যেহেতু মুসাফির অবস্থায় রোযা পালন করা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।
.
(২).হায়েজ ও নিফাসের সময় সহবাস করা: আল্লাহ তাআলা বলেন:“আর তারা আপনাকে ঋতুস্রাব সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলুন, তা কষ্টদায়ক। সুতরাং তোমরা ঋতুস্রাবকালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে তখন তাদের নিকট আস, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন।[সূরা বাকারা, আয়াত: ২২২] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,”যে ব্যক্তি কোন ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে কিংবা তার পায়ুপথে সঙ্গম করে অথবা গণকের কাছে যায় এবং তার কথা বিশ্বাস করে, সে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করল’ (ইবনু মাজাহ, হা/৬৩৯; তিরমিযী, হা/১৩৫; মিশকাত, হা/৫৫১, হাদীসটি সহীহ)।উল্লেখ্য, ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে সহবাস ব্যতীত অন্যান্য সবকিছু বৈধ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,”তোমরা তাদের সাথে (তাদের হায়েয অবস্থায়) একই ঘরে অবস্থান ও অন্যান্য কাজ করতে পার শুধু সহবাস ছাড়া” (আবূ দাঊদ, হা/২৫৮, ২১৬৫, সনদ ছহীহ)।তাই কেউ যদি এই অবস্থায় সঙ্গম করে, তাহলে তার উপর কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে।তবে স্ত্রী হায়েয থেকে পবিত্র হলে তার সাথে সহবাস করা বৈধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অতঃপর যখন তারা ভালভাবে পবিত্র হবে, তখন আল্লাহর নির্দেশ মতে তোমরা তাদের নিকট গমন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২২২)
.
(৩).মসজিদে সহবাস করা: আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না। এটা আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা এর নিকটবর্তী হয়ো না।[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭]
.
(৪).এগুলো ছাড়াও আরও কিছু অবস্থায় যেমন মুহরিম তথা হজ্জ বা উমরার ইহরাম অবস্থায়ও স্ত্রী সহবাস হারাম। মহান আল্লাহ বলেন,“সুবিদিত মাসে (যথা: শাওয়াল, যিলক্বদ ও যিলহজ্জে) হজ্জ হয়। যে কেউ এই মাস গুলোতে হজ্জ করার সংকল্প করে, সে যেন হজ্জ এর সময় স্ত্রী সহবাস (কোন প্রকার যৌনাচার), পাপ কাজ এবং ঝগড়া বিবাদ না করে।”(সূরা বাকারাহ: ১৯৭)
.
প্রিয় পাঠক, উল্লেখিত কারণগুলি ব্যতীত অন্যান্য যেকোনো পরিস্থিতিতে স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক পরামর্শ ও সম্মতির ভিত্তিতে দিনের যেকোনো সময় বা রাতে একবার কিংবা একাধিকবার স্ত্রীর সাথে সহবাস করা বৈধ। এমনকি যখন স্বামী তার স্ত্রীকে বিছানায় ডাকে, তখন শরীয়তসম্মত কোনো বাধা বা ওজর না থাকলে স্ত্রীর জন্য সেই ডাকে সাড়া দেওয়া ওয়াজিব। দলিল হচ্ছে সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম এ আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত হাদিস, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেন, যদি কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে তার সঙ্গে একই বিছানায় শোয়ার জন্য ডাকে, আর সে আসতে অস্বীকার করে, তাহলে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতাগণ ঐ মহিলার উপর অভিসম্পাত বা লা‘নত বর্ষণ করতে থাকে”।(সহীহ বুখারী হা/৩২৩৭, ৫১৯৩,৫১৯৪;সহীহ মুসলিম হা/১৪৩৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৬৭৭)। সহীহ মুসলিমের এক এসেছে, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কসম সেই সত্তার যাঁর হাতে আমার জীবন। কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে যখন বিছানায় আহবান করে, কিন্তু সে তা অস্বীকার করে, নিঃসন্দেহে যে পর্যন্ত সে তার স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্টি না হয়, ততক্ষন আসমানবাসী তার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে।(সহীহ মুসলিম হা/৩৪৩২; ই.ফা. ৩৪০৫, ই.সে. ৩৪০৪)
.
সুতরাং স্ত্রী যদি কোন বৈধ অজুহাত ছাড়াই স্বামীর আহবান প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে সে অবাধ্য,পাপী হিসেবে হবেন। তার ভরণপোষণ ও পোশাক বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে।এক্ষেত্রে স্বামীর দায়িত্ব তাকে উপদেশ দেয়া, আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করা। তাকে বিছানা থেকে আলাদা করে দেয়া। আর প্রয়োজনে সে তাকে মৃদুভাবে প্রহার করতে পারে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,”আর তোমরা যে নারীদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, বিছানায় তাদেরকে ত্যাগ কর এবং তাদেরকে (মৃদু) প্রহার কর। এরপর যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমুন্নত মহান’ (সূরা আন-নিসা:৩৪)। উক্ত আয়াতে যেসব স্ত্রীলোক স্বামীদের আনুগত্য করে না কিংবা যারা এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। আল্লাহ তা‘আলা সংশোধনের জন্য পুরুষদেরকে যথাক্রমে তিনটি উপায় বলে দিয়েছেন। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন তার স্ত্রীকে চাকর-বাকরদের মত না মারে, পরে সে দিনের শেষে তার সাথে আবার সহবাস করবে”।(সহীহ বুখারী, হা/৫২০৪)।শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,لا يحل لها النشوز عنه، ولا تمنع نفسها منه ، بل إذا امتنعت منه وأصرت على ذلك فله أن يضربها ضربا غير مبرح ، ولا تستحق نفقة ولا قسما “স্ত্রীর জন্য স্বামীর অবাধ্য হওয়া এবং নিজেকে তার থেকে বিরত রাখা জায়েয নয়। বরং স্ত্রী যদি তার থেকে বিরত থাকে এবং তার উপর অটল থাকে, তাহলে তাকে মৃদুভাবে প্রহার করতে পারে এবং সে খোরপোষ বা ভাগের যোগ্য নয়”।(মাজমূঊল ফাতাওয়া খণ্ড: ৩২; পৃষ্ঠা: ২৭৮-২৭৯)।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন:
” يجب عليها أن تطيعه إذا طلبها إلى الفراش وذلك فرض واجب عليها .. .. فمتى امتنعت عن إجابته إلى الفراش كانت عاصية ناشزة … ، كما قال تعالى : (وَاللاَّتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلاً)”
“যখনি স্বামী স্ত্রীকে বিছানায় ডাকবে তখনি ডাকে সাড়া দেয়া স্ত্রীর উপর ফরজ। যদি ডাকে সাড়া না দেয় তাহলে স্ত্রী গুনাহগার ও অবাধ্য হবে। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না।”(ইবনু তাইমিয়া,আল-ফাতাওয়া আল কুবরা, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৪৫-১৪৬) ইসলাম ওয়েব’-এর আলেমগণ বলেন, আলাউদ্দীন আল-মিরদাবী (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইবনু আবেদীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, শারঈ কোন কারণ ছাড়া ধারাবাহিকভাবে সহবাসে রাজি না হলে ক্ষতি করা ব্যতীত জোরপূর্বক সঙ্গম করা জায়েয।(ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৩৮২১৩২)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

শারঈ দৃষ্টিকোন থেকে সালাতের মধ্যে নড়াচড়া করার বিধান কি

 ভূমিকা: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। যিনি তাঁর সুস্পষ্ট গ্রন্থ পবিত্র কুরআনে বলেন, وَ قُوۡمُوۡا لِلّٰہِ قٰنِتِیۡنَ ‘তোমরা বিনীতভাবে আল্লাহর জন্য দণ্ডায়মান হও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩৮)। আল্লাহ তা‘আলা সালাত সম্পর্কে বলেন,لَکَبِیۡرَۃٌ اِلَّا عَلَی الۡخٰشِعِیۡنَ وَ اِنَّہَا “নিশ্চয় বিনয়ীগণ ছাড়া সালাত অন্যদের উপর কঠিন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৪৫)। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মুত্তাক্বীদের ইমাম ও বিনয়ীদের সরদার মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল সাহাবীর উপর। অতঃপর নিশ্চয় সালাত দ্বীন-ইসলামের কার্যগত রুকনসমূহের মাঝে সবচেয়ে বড় রুকন। সালাতে একাগ্রতা ও বিনয়াবনত অর্জন করা মুখ্য উদ্দেশ্য এবং ইসলামী শরী‘আতের প্রকৃত চাহিদা। পক্ষান্তরে আল্লাহর শত্রু ইবলীস বানী আদমকে পথভ্রষ্ট ও বিপদগ্রস্ত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে অঙ্গীকার করেছে যে,ثُمَّ لَاٰتِیَنَّہُمۡ مِّنۡۢ بَیۡنِ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ مِنۡ خَلۡفِہِمۡ وَ عَنۡ اَیۡمَانِہِمۡ وَ عَنۡ شَمَآئِلِہِمۡ” অতঃপর আমি পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাদের সম্মুখ দিয়ে, পেছন দিয়ে, ডান দিক দিয়ে এবং বাম দিক দিয়ে আসব’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৭)।যে কোনো কাজে সফলতার মূল শর্ত হলো মনোযোগ ও একনিষ্ঠতা; আর সালাতের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক। কারণ ইবাদতের আসল স্বাদ আস্বাদনের জন্য একাগ্রতার কোনো বিকল্প নেই। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো এই ব্যস্ত ও যান্ত্রিক যুগে মনোযোগ সহকারে সালাত আদায় ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ একাগ্রতা বিহীন সালাত প্রায়শই দায়সারা একটি শারীরিক ব্যায়ামে পরিণত হয় যা হৃদয়ে সঞ্চারিত করে না প্রভুর সান্নিধ্যের প্রশান্তি, জাগায় না নেকীর পথে অগ্রসর হওয়ার অনুপ্রেরণা, এবং বাধা হয়ে দাঁড়ায় না অশ্লীলতা ও অন্যায়ের পথে।এমন পরিস্থিতি আজ আমাদের মাঝে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এই হাদীসকে এক কঠিন বাস্তবে পরিণত করেছে—أَوَّلُ شَيْءٍ يُرْفَعُ مِنْ هذِهِ الأُمَّةِ الْخُشُوعُ، حَتَّى لَا تَرَى فِيهَا خَاشِعًا“এই উম্মতের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম যে জিনিস উঠিয়ে নেওয়া হবে তা হলো খুশূ‘ (সালাতের একাগ্রতা), এমনকি তুমি তাদের মধ্যে কোনো একাগ্রচিত্ত মুছল্লি খুঁজে পাবে না।”(ত্বাবারাণী; সহীহুল জামে‘ হা/২৫৬৯) তাছাড়া শয়তানের মূল চক্রান্ত ও উদ্দেশ্য হল মানুষকে যেকোন উপায়ে অন্য মনষ্ক করে সালাত থেকে দূরে রাখা এবং মুছল্লির মাঝে বিভিন্ন ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা সৃষ্টি করে সালাতের মত মহান ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ ও বিশাল সওয়াব থেকে বঞ্চিত রাখা। যাতে করে সালাত আদায়ের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়।তাই এইবিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যক।আল্লাহ তা‘আলা বলেন,قَدۡ اَفۡلَحَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ, الَّذِیۡنَ ہُمۡ فِیۡ صَلَاتِہِمۡ خٰشِعُوۡنَ “অবশ্যই মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে। যারা নিজেদের ছালাতে একনিষ্ট’ (সূরা আল-মুমিনূন: ১-২)। অর্থাৎ যারা ভীত-সন্ত্রস্ত এবং প্রশান্ত হৃদয় নিয়ে সালাতে স্থির থাকে। আর সালাতে খুশূ‘ বা একাগ্রতার অর্থ হল- প্রশান্ত থাকা, নিশ্চিন্ত থাকা, ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা, সুস্থির থাকা, বিনয়ী থাকা এবং গাম্ভীর্যতা অবলম্বন করা। মূলত আল্লাহর ভয় ও তাঁর সম্পর্কে যথাযথ সচেতনতা বান্দাকে সালাতে একাগ্রতা অবলম্বন করতে উৎসাহ যোগায় এবং খুশূ‘-একাগ্রতা অর্জনে সহযোগিতা করে। আর খুশূ‘ বা একাগ্রতার প্রকৃত রূপ হল- মহান আল্লাহর সামনে বান্দার অন্তরকে বিনম্র, হীন ও অপমানিত অবস্থায় দাঁড় করানো।

.
শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তাভাবনা করলে সালাতের মধ্যে নড়াচড়া বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে; নড়াচড়ার ধরন ও প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই এর হুকুম নির্ধারিত হবে।”
.
সালাতের মধ্যে নড়াচড়ার হুকুম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] উল্লেখ করেন যে প্রয়োজন ছাড়া নামাযে নড়াচড়া করার মূলবিধান মাকরূহ। তবে এই নড়াচড়া পাঁচ ভাগে বিভক্ত:
القسم الأول : حركة واجبة.
القسم الثاني : حركة محرمة.
القسم الثالث : حركة مكروهة.
القسم الرابع : حركة مستحبة.
القسم الخامس : حركة مباحة.
فأما الحركة الواجبة : فهي التي تتوقف عليها صحة الصلاة ، مثل أن يرى في غترته نجاسة ، فيجب عليه أن يتحرك لإزالتها ويخلع غترته ، وذلك لأن النبي صلى الله عليه وسلم أتاه جبريل وهو يصلي بالناس فأخبره أن في نعليه خبثاً فخلعها صلى الله عليه وسلم وهو في صلاته واستمر فيها [ رواه أبو داود 650 ، وصححه الألباني في الإرواء 284 ] .
ومثل أن يخبره أحد بأنه اتجه إلى غير القبلة ؛ فيجب عليه أن يتحرك إلى القبلة .
وأما الحركة المحرمة : فهي الحركة الكثيرة المتوالية لغير ضرورة ؛ لأن مثل هذه الحركة تبطل الصلاة ، وما يبطل الصلاة فإنه لا يحل فعله ؛ لأنه من باب اتخاذ آيات الله هزواً .
وأما الحركة المستحبة : فهي الحركة لفعل مستحب في الصلاة ، كما لو تحرك من أجل استواء الصف ، أو رأى فرجة أمامه في الصف المقدم فتقدم نحوها وهو في صلاته ، أو تقلص الصف فتحرك لسد الخلل ، أو ما أشبه ذلك من الحركات التي يحصل بها فعل مستحب في الصلاة ؛ لأن ذلك من أجل إكمال الصلاة ، ولهذا لما صلى ابن عباس رضي الله عنهما مع النبي صلى الله عليه وسلم ، فقام عن يساره أخذ رسول الله صلى الله عليه وسلم برأسه من ورائه فجعله عن يمينه . [ متفق عليه ]
وأما الحركة المباحة : فهي اليسيرة لحاجة ، أو الكثيرة للضرورة ، أما اليسيرة لحاجة فمثلها فعل النبي صلى الله عليه وسلم حين كان يصلي وهو حامل أمامة بنت زينب بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم وهو جدها من أمها فإذا قام حملها ، وإذا سجد وضعها [ البخاري 5996 ومسلم 543 ]
وأما الحركة الكثيرة للضرورة : فمثالها الصلاة في حال القتال ؛ قال الله تعالى : (حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلاةِ الْوُسْطَى وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ* فَإِنْ خِفْتُمْ فَرِجَالاً أَوْ رُكْبَاناً فَإِذَا أَمِنْتُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ) البقرة/238-239 ؛ فإن من يصلي وهو يمشي لا شك أن عمله كثير ولكنه لما كان للضرورة كان مباحاً لا يبطل الصلاة .
وأما الحركة المكروهة : فهي ما عدا ذلك وهو الأصل في الحركة في الصلاة ، وعلى هذا نقول لمن يتحركون في الصلاة إن عملكم مكروه ، منقص لصلاتكم ، وهذا مشاهد عند كل أحد فتجد الفرد يعبث بساعته ، أو بقلمه ، أو بغترته ، أو بأنفه ، أو بلحيته ، أو ما أشبه ذلك ، وكل ذلك من القسم المكروه إلا أن يكون كثيراً متوالياً فإنه محرم مبطل للصلاة .
وقد ذكر رحمه الله أيضا أن الحركة المبطلة للصلاة ليس لها عدد معين ، وإنما هي الحركة التي تنافي الصلاة ، بحيث إذا رؤى هذا الرجل فكأنه ليس في صلاة ، هذه هي التي تبطل؛ ولهذا حدده العلماء رحمهم الله بالعرف ، فقالوا : ” إن الحركات إذا كثرت وتوالت فإنها تبطل الصلاة ” ، بدون ذكر عدد معين ، وتحديد بعض العلماء إياها بثلاث حركات ، يحتاج إلى دليل ؛ لأن كل من حدد شيئاً بعدد معين ، أو كيفية معينة ، فإن عليه الدليل ، وإلا صار متحكماً في شريعة الله .
প্রথম প্রকার: ওয়াজিব নড়াচড়া
দ্বিতীয় প্রকার: হারাম নড়াচড়া
তৃতীয় প্রকার: মাকরূহ নড়াচড়া
চতুর্থ প্রকার: মুস্তাহাব নড়াচড়া
পঞ্চম প্রকার: জায়েয নড়াচড়া
ওয়াজিব নড়াচড়া: যে নড়াচড়ার উপর সালাতের বিশুদ্ধতা নির্ভর করে। যেমন: (সালাতে শুরু করার পর) সে যদি তার মাথার রুমালে নাপাকি দেখতে পায় তাহলে সেটি খুলে ফেলার জন্য নড়াচড়া করা ওয়াজিব। এর দলীল হচ্ছে: একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (জুতা পায়ে) সালাতের ইমামতি করছিলেন। এমন সময়ে জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে তাঁকে সংবাদ দিলেন, তাঁর জুতায় নাপাকী রয়েছে। তিনি সালাত পড়া অবস্থাতেই জুতা খুলে ফেললেন এবং সালাতে চালিয়ে গেলেন।(হাদীসটি আবু দাউদ হা/৬৫০) বর্ণনা করেন আর শাইখ আলবানী ইরওয়া গ্রন্থে হা/২৮৪) এটিকে সহিহ বলে গণ্য করেছেন) অনুরূপভাবে কেউ যদি তাকে জানায় যে সে কিবলার দিকে নয়; অন্য দিকে মুখ করে আছে, তাহলে তার জন্য কিবলার দিকে মুখ ফেরানো ওয়াজিব।
.
হারাম নড়াচড়া: প্রয়োজন ছাড়া লাগাতার অধিক পরিমাণে নড়াচড়া করা। কারণ এ ধরনের নড়াচড়া সালাত বিনষ্ট করে দেয়। আর যা সালাত নষ্ট করে দেয় তা করা জায়েয নেই। কারণ এটি আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার নামান্তর।
.
মুস্তাহাব নড়াচড়া: সালাতে মুস্তাহাব কিছু করার জন্য নড়াচড়া করা। যেমন: কাতার সোজা করার জন্য নড়াচড়া করা। সালাতরত অবস্থায় সামনের কাতারে ফাঁকা স্থান দেখতে পেয়ে সেটি পূর্ণ করার জন্য সামনের কাতারে চলে যাওয়া অথবা কাতারে ফাঁকা স্থান সৃষ্টি হলে সেটি পূরণ করতে নড়াচড়া করা। এ ধরণের অন্য যে কোন নড়াচড়া যার মাধ্যমে নামাযের কোন একটি মুস্তাহাব আমল সম্পাদিত হয়। কারণ এই নড়াচড়া সালাতেকে পরিপূর্ণ করার জন্য। তাই ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সালাত পড়ছিলেন তখন তিনি বামপাশে দাঁড়ালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মাথা ধরে তাকে পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে ডানপাশে নিয়ে এলেন।[বুখারী ও মুসলিম]
.
জায়েয নড়াচড়া: আর এটি হলো প্রয়োজনে সামান্য নড়াচড়া অথবা জরুরী কারণে বেশি নড়াচড়া করা। প্রয়োজনে সামান্য নড়াচড়ার উদাহরণ হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন উমামা বিনতে যাইনাব বিনতে রাসূলুল্লাহকে বহন করে সালাত পড়তেন। তিনি উমামার নানা ছিলেন। দাঁড়ানো অবস্থায় তিনি তাকে বহন করতেন। আর সিজদায় গেলে তাকে নামিয়ে রাখতেন।[হাদীসটি বুখারী হা/৫৯৯৬; ও মুসলিম হা/৫৪৩) বর্ণনা করেন) আর জরুরী কারণে বেশি নড়াচড়ার উদাহরণ হলো যুদ্ধরত অবস্থায় সালাত পড়া। আল্লাহ তাআলা বলেন:“তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হবে; বিশেষতঃ মধ্যবর্তী সালাতের প্রতি। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে। তোমরা যদি ভয় করো তাহলে হেঁটে কিংবা আরোহী অবস্থায় সালাত আদায় করবে। যখনই নিরাপদ হবে তখন তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করবে ঠিক যেভাবে তিনি তোমাদেরকে শিখিয়েছেন, যা তোমরা পূর্বে জানতে না।”(সূরা বাকারা: ২৩৮-২৩৯) হেঁটে সালাত পড়া নিঃসন্দেহে সালাতে বেশি নড়াচড়ার অন্তর্ভুক্ত। তবে সেটি জরুরী প্রয়োজনের কারণে হওয়ায় বৈধ এবং এতে সালাত বাতিল হবে না।
.
মাকরূহ নড়াচড়া: উপর্যুক্ত নড়াচড়া ছাড়া সব ধরনের নড়াচড়া মাকরূহ। সালাতে নড়াচড়ার এটাই মূল বিধান। সুতরাং যারা সালাতে নড়াচড়া করে তাদেরকে আমরা বলব: আপনাদের কাজটি মাকরূহ তথা অপছন্দনীয়। এটি আপনাদের সালাতে ঘাটতি সৃষ্টি করে। এমনটি প্রত্যেকের মাঝে দেখা যায়। দেখবেন কেউ তার ঘড়ি নিয়ে, কলম নিয়ে, মাথার রুমাল নিয়ে, নাক নিয়ে, দাড়ি নিয়ে বা এরূপ অন্য কিছু নিয়ে অযথা খেলতামাশা করছেন। এগুলো সবই অপছন্দনীয় নড়াচড়ার অন্তর্ভুক্ত। তবে যদি লাগাতার ও অতিরিক্ত হয়ে যায় তাহলে সেটি হারাম হবে এবং সালাতকে নষ্ট করে দিবে। এছাড়া তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে সালাতকে বাতিলকারী নড়াচড়ার কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। বরং সেটা এমন নড়াচড়া যা সালাতের পরিপন্থী। যে নড়াচড়া দেখলে মনে হবে এই ব্যক্তি সালাতে নেই, এ ধরণের নড়াচড়া নামাযকে বাতিল করে দেয়। তাই আলেমরা উরফ তথা প্রথার মাধ্যমে বিষয়টি নির্ধারণ করেছেন। তারা বলেছেন: ‘নড়াচড়া বেশি পরিমাণে এবং লাগাতার হলে সালাত বাতিল হয়ে যায়।’ তারা কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করেননি। কিছু আলেমগণ যে, এটাকে ‘তিন’ সংখ্যায় সীমাবদ্ধ করেছেন এর পক্ষে দলীল প্রয়োজন। কারণ যে কেউ কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা বা নির্দিষ্ট ধরন নির্ধারণ করলে এর সপক্ষে দলীল প্রদান করা তার উপর আবশ্যক। নতুবা সে আল্লাহর শরীয়তে স্বেচ্ছাচারিতাকারী বলে গণ্য হবে।”(ইবনু উসাইমীন,মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৩০৯-৩১১)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে নামাযে বেশি বেশি নড়াচড়া করে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে কিনা? এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কী? তিনি উত্তর দেন:
( السنة للمؤمن أن يقبل على صلاته ويخشع فيها بقلبه وبدنه ، سواء كانت فريضة أو نافلة ، لقول الله سبحانه : ( قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ * الَّذِينَ هُمْ فِي صَلاتِهِمْ خَاشِعُون ) المؤمنون/1-2 ، وعليه أن يطمئن فيها ، وذلك من أهم أركانها وفرائضها ، لقول النبي صلى الله عليه وسلم للذي أساء في صلاته ولم يطمئن فيها : ( ارجع فصلِّ فإنك لم تصل ) ، فعل ذلك ثلاث مرات ، فقال الرجل : يا رسول الله ، والذي بعثك بالحق لا أحسن غير هذا فعلمني ، فقال النبي صلى الله عليه وسلم : ( إِذَا قُمْتَ إِلَى الصَّلاةِ فَأَسْبِغْ الْوُضُوءَ ، ثُمَّ اسْتَقْبِلْ الْقِبْلَةَ فَكَبِّرْ ، وَاقْرَأْ بِمَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنْ الْقُرْآنِ ، ثُمَّ ارْكَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ رَاكِعًا ثُمَّ ارْفَعْ رَأْسَكَ حَتَّى تَعْتَدِلَ قَائِمًا ، ثُمَّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا ، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَسْتَوِيَ وَتَطْمَئِنَّ جَالِسًا ، ثُمَّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا ، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَسْتَوِيَ قَائِمًا ، ثُمَّ افْعَلْ ذَلِكَ فِي صَلاتِكَ كُلِّهَا ) متفق عليه ، وفي رواية لأبي داود قال فيها : ( ثم اقرأ بأم القرآن ، وبما شاء الله ) .
وهذا الحديث الصحيح يدل على أن الطمأنينة ركن في الصلاة ، وفرض عظيم فيها ، لا تصح بدونه ، فمن نقر صلاته فلا صلاة له ، والخشوع هو لب الصلاة وروحها ، فالمشروع للمؤمن أن يهتم بذلك ، ويحرص عليه .
أما تحديد الحركات المنافية للطمأنينة وللخشوع بثلاث حركات فليس ذلك بحديث عن النبي صلى الله عليه وسلم ، وإنما ذلك كلام لبعض أهل العلم ، وليس عليه دليل يعتمد .
ولكن يكره العبث في الصلاة ، كتحريك الأنف واللحية والملابس والاشتغال بذلك ، وإذا كثر العبث أبطل الصلاة ، وأما إذا كان قليلا عرفا ، أو كان كثيرا ولم يتوال ، فإن الصلاة لا تبطل به ، ولكن يشرع للمؤمن أن يحافظ على الخشوع ، ويترك العبث ، قليله وكثيره ، حرصا على تمام الصلاة وكمالها .
ومن الأدلة على أن العمل القليل والحركات القليلة في الصلاة لا تبطلها ، وهكذا العمل والحركات المتفرقة غير المتوالية ، ما ثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم ، أنه فتح الباب يوما لعائشة وهو يصلي [ أبو داود 922 والنسائي 3/11 والترمذي 601 ، وحسنه الشيخ الألباني في صحيح الترمذي 601] .
وثبت عنه من حديث أبي قتادة رضي الله عنه أنه صلى ذات يوم بالناس ، وهو حامل أمامة بنت ابنته زينب ، فكان إذا سجد وضعها ، وإذا قام حملها
“মুমিনের জন্য সুন্নাহ হলো সালাতে শরীর ও মন নিয়ে প্রবেশ করা; হোক সেটা ফরয সালাত কিংবা নফল সালাত। কারণ আল্লাহ বলেছেন:“অবশ্যই মুমিনরা সফল হয়েছে, যারা তাদের সালাতে বিনয়াবনত।”(সূরা মুমিনূন: ১-২) তার উচিত সালাতে প্রশান্ত ও স্থির হওয়া। কারণ এই স্থিরতা সালাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ও ফরয কাজ। যে ব্যক্তি ধীরস্থিরতা ছাড়া সালাত পড়েছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেন: “তুমি ফিরে গিয়ে সালাত পড়ো; কারণ তুমি সালাত পড়োনি।” তিনি এই কথা তিন বার বলেছিলেন। লোকটি বলল: হে আল্লাহর রাসূল! যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তার শপথ: আমি এর চেয়ে ভালোভাবে সালাত পড়তে জানি না। আমাকে শিখিয়ে দিন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যখন তুমি সালাতে দাঁড়ানোর ইচ্ছা করবে তখন প্রথমে তুমি পূর্ণভাবে অযু করবে। তারপর কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে তাকবীর বলবে। তারপর কুরআন থেকে যতটুকু তেলাওয়াত করা তোমার পক্ষে সহজ হয় তিলাওয়াত করবে। তারপর তুমি রুকূ করবে এবং রুকুতে গিয়ে স্থির হবে। তারপর মাথা উঠাবে এবং ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তারপর সিজদাহ করবে এবং সিজদায় গিয়ে স্থির হবে। তারপর আবার মাথা তুলবে এবং স্থিরভাবে বসবে। এরপর আবার সিজদা দিবে এবং সিজদায় গিয়ে স্থির হবে। এরপর উঠে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। এরপর ঠিক এভাবেই তোমার সালাতের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করবে।”(হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন। আবু দাউদের বর্ণনায় আছে: ‘তারপর ফাতিহা এবং আল্লাহ যতটুকু চান ততটুকু তেলাওয়াত করবে’) এই সহিহ হাদীস প্রমাণ করে যে ধীরস্থিরতা সালাতের স্তম্ভ ও গুরুত্বপূর্ণ ফরয। এটি ছাড়া সালাত শুদ্ধ হয় না। যে ব্যক্তি সালাতে ঠোকর দেয় তার সালাত হয় না। সালাতে খুশু-খুযু সালাতের সারবস্তু ও প্রাণ। সুতরাং মুমিনের উচিত এটাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং এ ব্যাপারে সচেতন থাকা। তবে ধীরস্থিরতা ও মনোযোগ নষ্টকারী নড়াচড়াকে তিন সংখ্যাতে সীমাবদ্ধ করা এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো হাদীস নেই। এটি কিছু আলেমের বক্তব্য। এর পক্ষে নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল নেই। তবে সালাতে অনর্থক কাজ করা মাকরূহ। যেমন: নাক, দাড়ি, কাপড়-চোপড় নাড়াচাড়া করা এবং তা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। অনর্থক কাজ বেশি হলে সালাত বাতিল হয়ে যায়। আর যদি কম পরিমাণে হয় অথবা বেশি হলেও লাগাতার না হয় তাহলে সালাত বাতিল হয় না। তবে মুমিনের উচিত খুশু-খুযু রক্ষা করা এবং কম হোক বা বেশি হোক অনর্থক কাজ ছেড়ে দেওয়া; সালাত পরিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে। অল্প কাজে, সামান্য নড়াচড়ায় বা বিচ্ছিন্ন নড়াচড়ায় যে সালাত বাতিল হয় না এর দলীল হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীস: তিনি একদিন সালাতরত অবস্থায় আয়েশার জন্য দরজা খুলে দিয়েছিলেন।[আবু দাউদ হা/৯২২; তিরমিযী হা/৬০১)। শাইখ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) সহীহুত তিরমিযীতে হা/৬০১) হাদীসটি হাসান বলেছেন) আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, একদিন তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানুষদের নিয়ে সালাত পড়ার সময়ে তার মেয়ের মেয়ে (নাতনি) উমামা বিনতে যাইনাবকে বহন করেছিলেন। সিজদায় গেলে নামিয়ে রাখতেন, আর উঠে দাঁড়ালে বহন করতেন।”(ফাতাওয়া উলামাইল বালাদিল হারাম ১৬২-১৬৪) পরিশেষে বলব, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যেন সালাতের ব্যাপারে যত্নবান হওয়ার তাওফীক্ব দান করেন এবং সাথে সাথে সালাত আদায়ের মাধ্যমে আমাদেরকে জান্নাতে দাখিল করে নেন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

Translate