প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর মূলনীতি হলো: স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা সর্বাবস্থায় ও সব সময় বৈধ; তবে শরীয়তে যেসব অবস্থায় তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেসব ব্যতীত। যেমন পায়ুপথে সহবাস করা, কিংবা ঋতুকাল (হায়েয) ও প্রসব পরবর্তী রক্তস্রাব (নিফাস) চলাকালীন সহবাস করা, রমজান মাসে দিনের বেলায় রোজা রেখে সহবাস করা এবং হজ্জ বা উমরাহর ইহরাম অবস্থায় সহবাস করা নিষিদ্ধ।
.
আর গর্ভবতী স্ত্রীর ব্যাপারে: গর্ভবতী স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো শরঈ দলিল নেই। তবে যদি সহবাসের ফলে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাহলে অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত নারী চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যদি তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মত দেন যে গর্ভাবস্থায় সহবাসে স্ত্রীর ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে,তাহলে সে ক্ষেত্রে তা পরিহার করা (সহবাস থেকে বিরত থাকা) আবশ্যক।কিন্তু এমন কোনো আশঙ্কা না থাকলে গর্ভবতী স্ত্রীর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সহবাস করা শরিয়তসম্মত ও বৈধ। দলিল হচ্ছে মহান আল্লাহর বানী;(نِسَاؤُكُمْ حَرْثٌ لَكُمْ فَأْتُوا حَرْثَكُمْ أَنَّى شِئْتُمْ )”তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছে গমন করতে পার।”(সূরা বাকারাহ: ২২৩) আল্লাহ তাআলা এখানে স্বামীকে তার স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাসের কোনো নির্দিষ্ট ভঙ্গি বা অবস্থানে সীমাবদ্ধ করেননি। শোয়া, বসা কিংবা কাত হয়ে যে কোনো ভঙ্গিতেই সহবাস বৈধ। তবে স্ত্রীর যৌনাঙ্গ ব্যতীত অন্য অঙ্গে, যেমন পায়ুপথ বা মুখে সহবাস করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ, কারণ তা বিকৃত প্রবৃত্তি ও অস্বাভাবিক কামনার প্রকাশ। এ বিষয়ে একাধিক সহীহ হাদীসে স্পষ্ট নিষেধ এসেছে।হাফিয ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:قال ابن عباس : الحرث موضع الولد .( فَأْتُوا حَرْثَكُمْ أَنَّى شِئْتُمْ ) أي : كيف شئْتم ، مقبلة ومدبرة في صِمام واحد ، كما ثبتت بذلك الأحاديث ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন:‘শস্যক্ষেত্র’ বলতে বোঝানো হয়েছে সন্তান উৎপন্ন হওয়ার স্থান। আল্লাহর বানী: “তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছে গমন করতে পার।” এর অর্থ হলো,“তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে যেভাবে ইচ্ছা সহবাস করতে পারো সামনের দিক থেকে বা পেছন দিক থেকে, তবে তা একই ছিদ্রপথে (যোনিপথে) হতে হবে। এই অর্থে সহিহ হাদীসসমূহে প্রমাণ রয়েছে।”(তাফসির ইবনু কাসীর; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫৮৮)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:গর্ভাবস্থায় কোন সময়ে স্বামীর জন্য স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস থেকে বিরত থাকা জরুরি? এবং বিশেষত গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে সহবাস করলে ভ্রূণের কোনো ক্ষতি হয় কি?
“لا بأس بجماع الحامل ما لم يكن فيه ضرر على الحمل ، وإنما الممنوع جماع الحائض ؛ لقوله تعالى : ( فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّى يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّهُ ) البقرة/ 222 .ومثلها النفساء حتى تطهر من النفاس ، والمحرمة بحج أو عمرة”
“গর্ভবতী নারীর সঙ্গে সহবাসে কোনো অসুবিধা নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত এতে গর্ভের ক্ষতি হবে না। নিষিদ্ধ কেবলমাত্র ঋতুমতী নারীর সঙ্গে সহবাস করা, কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “তোমরা হায়েজকালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকো এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হইও না। অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে, তখন তাদের নিকট আস, যেমনভাবে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।”(সূরা আল-বাকারা: ২২২) একই নিয়ম প্রসূতি (নিফাসগ্রস্ত) নারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যতক্ষণ না তিনি পবিত্র হন। এছাড়াও হজ্জ বা ওমরাহ পালনরত অবস্থায় সহবাস নিষিদ্ধ।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ১৯; পৃষ্ঠা: ৩৫৩)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:আমার স্ত্রী এখন গর্ভাবস্থার অ্যাডভান্সড স্টেজে আছে, এখন তার সপ্তম মাস চলছে। আমি কি তার সাথে সহবাস (যৌন মিলন) করতে পারি? আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। জবাবে শাইখ বলেন:
الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله، وبعد:يجوز للإنسان أن يُجامع زوجته الحامل متى شاء إلا إذا كان ذلك يضرّها ، فإنه يحرم عليه أن يفعل ما يضر بها ، وإن كان لا يضرها ولكن يشق عليها فإن الأولى عدم مجامعتها ، لأن اجتناب ما يشق عليها من حسن العشرة ، وقد قال تعالى : ( وعاشروهن بالمعروف ) النساء /19 ولكن المحرّم أن يجامع الرجل زوجته وهي حائض ، أو يجامعها في دبرها ، أو يجامعها وهي نفساء ، فإن ذلك محرم ولا يجوز ، وعلى المرء أن يتجنّب ذلك إلى ما أباحه الله . وإذا كانت حائضاً فله أن يستمتع بها فيما دون الفرج والدبر ، لقول النبي صلى الله عليه وسلم : ( اصنعوا كل شيء إلا النكاح ) رواه مسلم (الحيض /455)
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের প্রতি। পর সমাচার:”(গর্ভবতী স্ত্রীর সাথে সহবাসের বিধান হলো) মানুষ যখন ইচ্ছা তার গর্ভবতী স্ত্রীর সাথে সহবাস করতে পারে, যদি না তা স্ত্রীর জন্য ক্ষতিকর হয়। যদি সহবাস স্ত্রীর জন্য ক্ষতিকর হয়, তবে তা তার জন্য হারাম (নিষিদ্ধ) হয়ে যাবে, কারণ এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকতে হবে যা স্ত্রীর ক্ষতি করে।যদি সহবাস স্ত্রীর জন্য ক্ষতিকর না হয়, তবে তা যদি স্ত্রীর জন্য কষ্টকর বা কঠিন হয়, তাহলে সহবাস না করাই উত্তম। কারণ, স্ত্রীর জন্য যা কষ্টকর, তা পরিহার করাই হলো উত্তম দাম্পত্য আচরণের অংশ। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “আর তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবনযাপন করো।” (সূরা নিসা: ১৯) কিন্তু নিষিদ্ধ হলো যে পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে যখন সে হায়েযে (ঋতুমতী) থাকে,অথবা তার মলদ্বারে সহবাস করে,অথবা তার নিফাস (প্রসব পরবর্তী রক্তস্রাব) অবস্থায় সহবাস করে।নিশ্চয়ই এগুলো হারাম এবং বৈধ নয়।একজন মানুষের উচিত এসব থেকে বিরত থাকা এবং যা আল্লাহ বৈধ করেছেন, তাতেই সীমাবদ্ধ থাকা।আর যদি স্ত্রী হায়েয অবস্থায় থাকে,তবে স্বামীর জন্য বৈধ যে সে যোনিপথ ও মলদ্বার ছাড়া অন্যভাবে স্ত্রীর কাছ থেকে উপভোগ গ্রহণ করবে।কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন “তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সঙ্গম ছাড়া সবকিছু করতে পারো।”(সহীহ মুসলিম,কিতাবুল হায়েয, হা/ ৪৫৫ ইমাম ইবনু উসাইমীন,ফাতাওয়া আল-উলামা ফি ‘ইশরাতিন নিসা,পৃষ্ঠা: ৫৫)
.
সৌদি আরবের অন্যতম আলেম শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনু মানীঈ (হাফিযাহুল্লাহ)-কে গর্ভবতী স্ত্রীর সাথে সহবাসের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল।
”ليس في الشريعة الإسلامية نهي عن جماع الرجل زوجته الحامل ، وإنما النهي خاص بجماع المرأة الحائض أو النفساء ، وأما إذا قرر الأطباء لامرأة معينة لظروفها الصحية أن جماع زوجها يضر بها : فهذه حالة خاصة لا يقاس عليها
”ইসলামী শরীয়তে পুরুষ তার গর্ভবতী স্ত্রীর সাথে সহবাস করার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, বরং নিষেধাজ্ঞা কেবল ঋতুমতী (মাসিক চলাকালীন) বা নিফাস অবস্থায় থাকা (সন্তান প্রসবের পর রক্তস্রাবকালে) নারীর সাথে সহবাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে, যদি ডাক্তাররা কোনো নির্দিষ্ট নারীর স্বাস্থ্যগত অবস্থার কারণে এই সিদ্ধান্ত দেন যে স্বামীর সহবাস তার জন্য ক্ষতিকর হবে: তাহলে এটি একটি বিশেষ পরিস্থিতি এবং এর উপর ভিত্তি করে সাধারণ কোনো বিধান প্রয়োগ করা যাবে না।”(ফাতাওয়া ওয়া বুহুস শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনু মানীঈ; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২২৮)।
.
দ্বিতীয়ত: গর্ভকালীন অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাসের কি কোনো সুবিধা বা অসুবিধা আছে?
.
কেউ কেউ বলে থাকেন,গর্ভাবস্থার শেষ মাসে সহবাস করা স্ত্রীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই বিষয়ে বলা যায়, গর্ভাবস্থার শেষ মাসগুলোতে সহবাসের ফলে স্ত্রীর ক্ষতি হয় কিনা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বিশস্ত মহিলা ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞাসা করা উচিত।কেননা এটি নারীর প্রকৃতি, তার গর্ভধারণের ধরন এবং গর্ভাবস্থা থেকে সৃষ্ট প্রভাবের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন হতে পারে। তবে, নীতিগতভাবে বলতে গেলে: গর্ভাবস্থায় সহবাসের কারণে নারী বা ভ্রূণের কোনো ক্ষতি হয় না। বরং,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর ভ্রূণকে ফসলের সাথে এবং পুরুষের বীর্যকে সেই ফসলকে সেচ দেওয়া পানির সাথে তুলনা করেছেন। এটি বোঝায় যে ভ্রূণ পুরুষের বীর্য থেকে উপকৃত হয়, যার মানে গর্ভবতী স্ত্রীর সাথে সহবাস ও বীর্যপাত উপকারী।
.
ইমাম ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যা,(রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,قال الإمام أحمد : الوطء يزيد في سمعه وبصره “ইমাম আহমাদ বলেছেন: সহবাস ভ্রূণের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে।”(ইবনু ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ, খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১৪০)
.
যদি প্রশ্ন ওঠে যে, গর্ভবতী অবস্থায় সহবাস কি শিশুর জন্মকে ত্বরান্বিত করে কি না, তবে সাধারণভাবে এর উত্তর হলো না, এটি সাধারণত সত্য নয়। শুধুমাত্র যদি সহবাস অত্যন্ত তীব্র হয় এবং স্ত্রীর জরায়ু যদি দুর্বল থাকে, তখনই এর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, স্বামীকে গর্ভবতী স্ত্রীর মানসিক অবস্থা, শারীরিক ক্লান্তি এবং স্বাচ্ছন্দ্য বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, বিশেষ করে গর্ভধারণের শেষ পর্যায়ে। সুতরাং সহবাসের সময় এমন অবস্থান বেছে নেওয়া উচিত যা স্ত্রী বা ভ্রূণের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ না হয়। কারণ ইসলামের একটি মূলনীতি হলো; কারও ক্ষতি করা যাবেনা এবং নিজের উপরও কোনো ক্ষতি আসতে দেয়া যাবেনা। দলিল হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “ক্ষতি করা নয় এবং ক্ষতির বিপরীতে ক্ষতি করাও নয়”(মুসনাদে আহমাদ ও সুনানে ইবনে মাজাহ হা/২৩৪১), ইমাম আলবানী ‘সহিহ সুনানে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায় ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।