জুয়ার পরিচয় ও ভয়াবহতা, অর্থ প্রদানের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ এবং প্রতিযোগিতা সংক্রান্ত কতিপয় জরুরি বিধি-বিধান।
নিম্নে জুয়ার পরিচয়, ইসলামে এর নিষিদ্ধতা, অর্থ প্রদানের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করার বিধান এবং প্রতিযোগিতা সংক্রান্ত কতিপয় জরুরি মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল। وبالله التوفيق
❑ জুয়া কাকে?
শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিরা রাহ. বলেন,
أن يؤخذ مال الإنسان وهو على مخاطرة : هل يحصل له عوضه أو لا يحصل
“জুয়া (قمار) বলা হয়, এমনভাবে মানুষের নিকট অর্থ গ্রহণ করা যে, সে তার বিনিময় পাবে নাকি না সে ব্যাপারে ঝুঁকিতে থাকে।” [মাজমুল ফাতাওয়া ১৯/২৮৩]
❑ জুয়া সম্পর্কে ইসলামের বিধান:
ইসলামে জুয়া জাহেলি কর্ম, কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ- إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ
“হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কর্ম ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক-যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব, তোমরা এখন ও কি নিবৃত্ত হবে?” [সূরা মায়িদা: ৯০]
❑ জুয়ার নেতীবাচক প্রভাব:
জরীপে জানা গেছে প্রাথমিকভাবে যারা কেবল বিনোদনের জন্য জুয়া খেলা শুরু করেছিল তাদের অনেকেই এটাতে আসক্ত হয়ে গেছে।এই আসক্তি তাদের বিভিন্ন কুকর্মের দিকে ঠেলে দেয়। জুয়ার অর্থ জোগারের জন্য তারা খারাপ কাজ করতে শুরু করে। জুয়ায় হারানো অর্থ ফেরত পাবার জন্য জুয়ারীরা বারবার জুয়া খেলে। জুয়া ব্রেইনে মারাত্মক প্রভাব পরে, জুয়ারীরা চিন্তাগ্রস্থ ও অসহায়ত্ব অনুভব করে অসুস্থ হয়ে যায়।
❑ তিনটি প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধ জুয়ার অন্তর্ভুক্ত নয়:
ইসলামে কোনও একপক্ষ বিজয়ী হলে পরাজিত পক্ষ থেকে অর্থ গ্রহণ করার পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতা করা হারাম। কারণ এটা হল, জুয়া। তবে তিনটি ক্ষেত্রে তা জায়েজ- যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথক উক্ত বিধান থেকে পৃথক করেছেন। তা হল,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا سَبَقَ إِلَّا فِي نَصْلٍ أَوْ حَافِرٍ أَوْ خُفٍّ
আবু হুরায়রা রা. সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তীর, ঘোড়া এবং উট ব্যতীত অন্য কোনও কিছুতে বাজি ধরা যাবে না।” (অর্থাৎ এ তিনটি বিষয় ছাড়া অন্য কোনও কিছুতে দু পক্ষের বাজি ধরার মাধ্যমে বিনিময় (অর্থকড়ি) অর্জন করা জায়েজ নয়)।[সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ২৮/ ঘোড়া, পরিচ্ছেদ: ১৪. প্রতিযোগিতা]
শাইখ উসাইমিন রাহ. বলেন,
سَبَقَ : بالفتح، السَّبَق هو العوض الذي يؤخذ عن المسابقة
❑ অর্থ প্রদানের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের বিধান এবং এ বিষয়ে কতিপয় ফতোয়া:
এ বিষয়ে নিম্নে কতিপয় ফতোয়া প্রদান করা হল:
◈ ১. আহকামুল জাওয়ায়েয ওয়াল মুসাবাকাত (পুরস্কার ও প্রতিযোগিতার বিধিবিধান), লেখক: প্রফেসর ডক্টর খালিদ আল মুশাইকিহ বলেন,
النوع الأوَّل: أن تكون الجائزةُ عن طريق دفْع رسوم للدُّخول في المسابقة وهذا النَّوْع من الميسِر المحرَّم
“১ম প্রকার হল, প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের জন্য ফি প্রদানের মাধ্যমে পুরস্কার দেওয়া হলে এই প্রকার প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধ জুয়ার অন্তর্ভুক্ত।” [আহকামুল জাওয়ায়েয ওয়াল মুসাবাকাত, প্রথম প্রকাশ, প্রকাশকাল ১৪৩৪ হিজরি-দাম্মাম, সৌদি আরব]
◈ ২. সৌদি আরবের হাইয়াতুল কিবারিল ওলামা বা সিনিয়র স্কলারস এসোশিয়েশন-এর সদস্য ডক্টর শাইখ নাসের বিন সাদ আস শিসরি বলেন,
المسابقات التي يدفع جميع المتسابقين رسماً لدخولها وتكون الجائزة محددة سلفاً قبل الدخول وقبل العلم بعدد المتسابقين لا يجوز الدخول فيها بالإجماع
“যে প্রতিযোগিতায় সকল প্রতিযোগী অংশগ্রহণের জন্য একটা ফি প্রদান করে এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং প্রতিযোগীদের সংখ্যা জানার আগেই পুরস্কারটি পূর্ব-নির্ধারিত থাকে তাহলে ইজমা বা আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে তাতে অংশগ্রহণ করা জায়েজ নয়।” [উৎস: midad-৪ নম্বর প্রশ্নের উত্তর]
◈ ৩. কাতার ভিত্তিক ফতোয়া বিষয়ক ওয়েব সাইটের ফতোয়া:
“এই প্রতিযোগিতার পদ্ধতিটি জুয়ার পদ্ধতি। জুয়ার ব্যাপারে আলেমগণ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন এভাবে যে, জুয়া হল, একজন ব্যক্তি এমন বিষয়ে অংশ গ্রহণ করবে যেখানে সে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হলে লাভবান হবে আর পরাজিত হলে লোকসানের শঙ্কার মধ্যে থাকে। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি হয় যে অর্থ প্রদান করেছিলো তা হারাবে যদি সে পরাজিত হয়। অথবা সে তার এবং অন্যান্য প্রতিযোগীদের প্রদত্ত অর্থ পেয়ে লাভবান হবে যদি সে বিজয়ী হয়। সুতরাং এ পদ্ধতিতে গৃহীত অর্থ হারাম।
সুতরাং যদি কোনও প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীদের নিকট নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ গ্রহণের শর্তারোপ করা হয় (যাকে রেজি. ফি বলা হয়)-যা প্রদান ব্যতিরেকে কেউ তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারবে না তাহলে এ জাতীয় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা এবং সেগুলোতে অংশ গ্রহণ করা হারাম ও কবিরা গুনাহ। কারণ তা জুয়া। আর আল্লাহ তাআলা কুরআনের জুয়াকে মদের সাথে যুক্ত করে নাপাক এবং শয়তানের কর্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।
❑ প্রতিযোগিতায় যে কোনও পক্ষের দান গ্রহণ করা জায়েজ:
কোনও প্রতিযোগিতায় যদি দান বা উপহার হিসেেব প্রতিযোগীদের মধ্যে থেকে কেউ বা তৃতীয় কোনও পক্ষ (স্পন্সর) বিজয়ীকে উৎসাহিত করার জন্য অর্থ বা পুরস্কার সামগ্রী প্রদান করে তাহলে তা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং তা জায়েজ। কারণ এখানে প্রতিযোগীদের কেউ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
শাইখ জিবরিন রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়:
প্রশ্ন: সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীদের একজনের পক্ষ থেকে অথবা সকলের পক্ষ থেকে অথবা বাইরের অন্য কোনও পক্ষ থেকে বিনিময় গ্রহণ করার বিধান কী?
তিনি উত্তরে বলেন,
اذا كانت هذه المسابقة مفيدة للمتسابقين يكتسبون منها علماً نافعاً وسعة اطلاع، وفوائد دينية أو ثقافية، جاز أخذ العوض فيها، سواء كان ذلك العوض من المتسابقين أو أحدهما أو من غيرهما. والله أعلم
“যদি এই প্রতিযোগিতা প্রতিযোগীদের জন্য উপকারী হয়-যাতে তারা উপকারী ইলম অর্জন, ব্যাপক জানাশোনা এবং দীন বা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে লাভবান হয় তাহলে তাতে বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ। চাই তা প্রতিযোগীদের নিকট থেকে নেওয়া হোক অথবা তাদের কোনও একজন থেকে নেওয়া হোক অথবা অন্য কারও নিকট থেকে নেওয়া হোক।” [cms.ibn-jebreen]
➧ দৃষ্টি আকর্ষণী:
এখানে ‘দান’ উদ্দেশ্য না হলে একজন ব্যক্তি ও তৃতীয় পক্ষের প্রসঙ্গ আসতো না।
মোটকথা, প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে কেউ একজন অথবা তৃতীয় কোনও পক্ষ যদি প্রতিযোগীদের পুরস্কার বাবদ সমূদয় অর্থ ও ব্যয়ভার বহন করে তাহলে তাতে কোনও সমস্যা নেই। এমনকি সকল প্রতিযোগীও সম্মিলিতভাবে যদি এই ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নেয় তাতেও কোনও সমস্যা নেই।
শাইখের ফতোয়ায় প্রতিযোগীর নিকট আবশ্যিকভাবে গৃহীত ফি (যা রেজিস্ট্রেশন বাবদ নেওয়া হয়) সম্পর্কে বক্তব্য নেই। এটা ফতোয়ার উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং উক্ত ফতোয়া ভুল অর্থে গ্রহণ করার সুযোগ নাই।
➧ উল্লেখ্য যে, বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ইসলামি সংগঠন, সামাজিক ক্লাব ইত্যাদি কর্তৃক ছাত্র-ছাত্রী ও যুবকদের জন্য যে সব প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে এবং তারা নিজেদের পক্ষ থেকে পুরস্কারের আয়োজন করে এতে অংশ গ্রহণ করায় কোনও সমস্যা নেই। (যদি প্রতিযোগিতায় অন্য কোনও হারামের সংশ্লিষ্টতা না থাকে)। কারণ এখানে প্রতিযোগীদের নিকট থেকে কোনও অর্থকড়ি নেওয়া হয় না। ফলে বিজয়ী হলেও কোনও প্রতিযোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
❑ পুরস্কার ছাড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনে ব্যয়ভার উত্তোলনের উদ্দেশ্যে প্রতিযোগীদের নিকট থেকে অর্থ নেওয়া জায়েজ?
❑ প্রতিযোগীদের কেউ যদি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তাহলে তা জায়েজ: