Friday, February 21, 2025

যাদের দুআ কবুল হয় না

 যাদের দুআ কবুল হয় না—এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বেশ কিছু কারণ ও শ্রেণির উল্লেখ রয়েছে। নিচে হাদিসের রেফারেন্সসহ বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:

◈ ১. হারাম সম্পদ ভক্ষণকারী এবং হারাম পোশাক পরিধানকারীর দুআ কবুল হয় না:
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا، وَإِنَّ اللَّهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ}، وَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ}، ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِّيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لَهُ؟”

“নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র এবং তিনি কেবল পবিত্র জিনিসই গ্রহণ করেন। আল্লাহ মুমিনদের প্রতি ঐ একই নির্দেশ দিয়েছেন যা তিনি রসুলদের দিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, “হে রসুলগণ, পবিত্র জিনিসগুলো খাও এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আমি ভালো করেই জানি।” [সূরা মুমিনুন: ৫১]। তিনি আরও বলেন, “হে ঈমানদারগণ, আমি তোমাদের যা রিজিক দিয়েছি, তার পবিত্র অংশ খাও।’” [সূরা বাকারা: ১৭২]

এরপর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, যে দীর্ঘ সফর করে, তার চুল এলোমেলো এবং শরীর ধুলায় ধূসরিত। সে আকাশের দিকে হাত তুলে আল্লাহকে ডাকে: ‘হে আমার রব! হে আমার রব!’ অথচ তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং তার পেট হারাম খাবার দ্বারা পূর্ণ। তাহলে কিভাবে তার দুআ কবুল হতে পারে?” [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০১৫]

◈ ২. যে ব্যক্তি দুআ কবুলের জন্য তাড়াহুড়া করে:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“يُسْتَجَابُ لِأَحَدِكُمْ مَا لَمْ يَعْجَلْ، يَقُولُ: دَعَوْتُ فَلَمْ يُسْتَجَبْ لِي”

“তোমাদের দুআ কবুল করা হবে, যতক্ষণ না কেউ তাড়াহুড়া করে বলে ফেলে: ‘আমি দুআ করলাম, কিন্তু তা কবুল হলো না।’” [সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৪০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৩৫]

সুতরাং দুআ কবুলের জন্য তাড়াহুড়া করা যাবে না। বরং ধৈর্যের সাথে রবের দরবারে বারবার আকুতি-মিনতি সহকারে চাইতে হবে। দুআ কবুল হয় না এমন হতাশা থেকে দুআ বাদ দেওয়া যাবে না।

◈ ৩. উদাসীনতা ও অবহেলার সাথে দুআ করলে তা কবুল করা হয় না:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ادْعُوا اللَّهَ وَأَنْتُمْ مُوقِنُونَ بِالإِجَابَةِ، وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ لَا يَسْتَجِيبُ دُعَاءً مِنْ قَلْبٍ غَافِلٍ لَاهٍ.”

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত: রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“তোমরা আল্লাহর কাছে দুআ করো, আর দুআ করার সময় তোমরা নিশ্চিত থাকো যে, তা কবুল হবে। এবং জেনে রাখো, আল্লাহ এমন দুআ কবুল করেন না, যা উদাসীন এবং অমনোযোগী হৃদয় থেকে আসে।” [তিরমিজি-ইমাম আলবানি এটিকে হাসান বলেছেন]

ব্যাখ্যা:

❂ মুমিনের বিশ্বাস: দুআ করার সময় পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ দুআ কবুল করবেন।
❂ দুআ করতে হবে আন্তরিকভাবে, এমন অবস্থায় যাতে অন্তর সচেতন ও উপস্থিত থাকে।
❂ উদাসীন হৃদয়ের দুআ প্রত্যাখ্যান: যে ব্যক্তি দুআ করে অথচ তার মনোযোগ আল্লাহর প্রতি থাকে না বা দুআর গুরুত্ব উপলব্ধি করে না, তার দুআ আল্লাহ কবুল করেন না।
❂ দুআর শর্তাবলী ও পরিবেশ: তুহফাতুল আহওয়াযি-তে বলা হয়েছে: “দুআ করার সময় এমন অবস্থায় থাকতে হবে যাতে তা কবুল হওয়ার উপযুক্ত হয়। অর্থাৎ ভালো কাজ করা, মন্দ কাজ এড়িয়ে চলা, দুআর শর্তগুলো পূরণ করা, হৃদয়ের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং বরকতময় সময় ও স্থানের সুযোগ গ্রহণ করা, যেমন সেজদার মুহূর্ত।”

❂ দৃঢ় সংকল্প ও আল্লাহর উদারতা: দুআ করার সময় দৃঢ়তার সাথে চাইতে হবে এবং আল্লাহর প্রতি বড় আশা রাখতে হবে। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“ولكن ليعزم المسألة، وليعظم الرغبة، فإن الله لا يتعاظمه شيء أعطاه”

“তবে দুআ দৃঢ়তার সাথে করো এবং চাওয়ার মধ্যে বড় আশা রাখো। কারণ, আল্লাহর কাছে এমন কিছু নেই যা তিনি দিতে অক্ষম।” [সহিহ মুসলিম: ৬৯৮৮]

এখান থেকে যে সব শিক্ষা পাই সেগুলো হলো—
◆ ক. দুআ করার সময় বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা কবুল করবেন।
◆ খ. মনোযোগ ও আন্তরিকতা ছাড়া দুআ কবুল হয় না।
◆ গ. দুআর শর্তগুলো পূরণ করা আবশ্যক।
◆ ঘ. আল্লাহর কাছ থেকে বড় কিছু চাইতেও দ্বিধা করা উচিত নয়।

◈ ৪. নিষিদ্ধ জিনিস বা পাপের জন্য দুআ করলে দুআ প্রত্যাখ্যাত হয়:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“مَا مِنْ عَبْدٍ يَدْعُو اللَّهَ بِدُعَاءٍ إِلَّا آتَاهُ اللَّهُ إِيَّاهُ، أَوِ ادَّخَرَ لَهُ فِي الآخِرَةِ، مَا لَمْ يَدْعُ بِإِثْمٍ أَوْ قَطِيعَةِ رَحِمٍ”

“কোনও বান্দা আল্লাহর কাছে দুআ করলে আল্লাহ তাকে তিনটি জিনিসের একটিই দান করেন: হয় তার দুআ কবুল করেন, না হয় তা আখিরাতের জন্য সংরক্ষণ করেন, অথবা তার থেকে কোনও বিপদ দূর করেন। তবে শর্ত হলো, সে পাপ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার দুআ না করবে।” [তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৭৩]

◈ ৫. সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে বাধা দান ত্যাগ করা দুআ কবুল না হওয়ার অন্যতম কারণ:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
والَّذي نَفسي بيدِهِ لتأمُرُنَّ بالمعروفِ ولتَنهوُنَّ عنِ المنكرِ أو ليوشِكَنَّ اللَّهُ أن يبعثَ عليكُم عقابًا منهُ ثُمَّ تَدْعُونَهُ فَلَا يُسْتَجَابُ لَكُمْ

“ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। অন্যথায়, আল্লাহ তোমাদের ওপর শাস্তি পাঠাবেন। এরপর তোমরা আল্লাহকে ডাকবে, কিন্তু তোমাদের দুআ কবুল করা হবে না।” [সহিহ তিরমিজি, হা/২১৬৯]

এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, দুআ কবুল না হওয়ার একটি কারণ হলো, মানুষ যদি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা বন্ধ করে দেয়। যখন মানুষ অন্যায়কে সহ্য করে এবং তা সংশোধনের চেষ্টা করে না, তখন আল্লাহ তাদের ওপর শাস্তি নাজিল করেন এবং তাদের দুআ কবুল হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

◈ ৬. দুআকে শর্তযুক্ত করা:

দুআ করার সময় দুআতে শর্তারোপ করা (যেমন: “হে আল্লাহ, যদি আপনি চান তাহলে আমাকে ক্ষমা করুন”) এটি নিষিদ্ধ। বরং আল্লাহর কাছে দৃঢ়তার সাথে চাওয়া এবং আন্তরিকতা ও একাগ্রতার সাথে দুআ করা আবশ্যক।
لَا يَقُولَنَّ أَحَدُكُمْ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي إِنْ شِئْتَ اللَّهُمَّ ارْحَمْنِي إِنْ شِئْتَ، لِيَعْزِمِ الْمَسْأَلَةَ فَإِنَّهُ لَا مُسْتَكْرِهَ لَهُ
“তোমাদের কেউ যেন না বলে: ‘হে আল্লাহ, যদি আপনি চান, আমাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ, যদি আপনি চান, আমার প্রতি রহম করুন।’ বরং দুআতে দৃঢ়ভাবে চাওয়া উচিত, কারণ আল্লাহকে কেউ বাধ্য করতে পারে না।” [সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৩৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৭]

❂ এই হাদিস থেকে শিক্ষা:

ক. দুআতে দৃঢ়তা: দুআ করার সময় আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার ব্যাপারে পূর্ণ বিশ্বাস রাখা উচিত। শর্তযুক্ত শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা দরকার।
খ. আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি আস্থা: আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং কারো দ্বারা প্রভাবিত হন না। তিনি তাঁর বান্দার দুআ কবুল করেন যখন বান্দা আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সাথে তাঁর কাছে প্রার্থনা করে।
গ. আন্তরিক প্রচেষ্টা: দুআ করার সময় একাগ্রতা এবং অবিরাম অনুরোধ করতে হবে।
মোটকথা, দুআর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আমাদের চাওয়া ইবাদতের অংশ। এটি দৃঢ়তার সঙ্গে এবং আন্তরিকভাবে করতে হবে, যেন আমরা আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারি। আল্লাহ আমাদের দুআ কবুল করুন। আমিন।

◈ ৭. দুআ কবুলের শর্তাবলী অনুপস্থিত থাকা:

যাদের মধ্যে দুআ কবুলের শর্তাবলী অনুপস্থিত থাকবে তাদের দুআ কবুল হবে না। দুআ কবুলের শর্তাবলী হল, ইখলাস তথা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুআ করা, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পদ্ধতি অনুসারে দুআ করা এবং হালাল খাবার গ্রহণ করা।

উপরে বর্ণিত শর্তগুলো যার মধ্যে পাওয়া যাবে না তার দুআ আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না।

❑ বিশেষ তিন ব্যক্তির দুআ কবুল হবে না:

উপরোল্লিখিত কারণগুলো ছাড়াও আরও তিনজন ব্যক্তির কথা হাদিসে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে যাদের দুআ কবুল করা হবে না। তারা হল: রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
” ثلاثة يدعون فلا يستجاب لهم : رجل كانت تحته امرأة سيئة الخلق فلم يطلقها , و رجل كان له على رجل مال فلم يشهد عليه ، و رجل آتى سفيها ماله و قد قال الله: وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمُ
“তিন ব্যক্তি এমন যে তাদের দুআ কবুল করা হয় না। যথা:

— এক. যে ব্যক্তির অধীনে দুশ্চরিত্রা নারী আছে কিন্তু সে তাকে তালাক দেয় না।
— দুই. যে ব্যক্তি অন্য লোকের কাছে তার পাওনা আছে কিন্তু সে তার সাক্ষী রাখেনি।
— তিন. যে ব্যক্তি নির্বোধ ব্যক্তিকে সম্পদ দিয়ে দেয়। অথচ আল্লাহ বলেন,
وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمُ
“তোমরা নির্বোধদেরকে তোমাদের সম্পদ দিও না।”

হাদিসটি ইমাম হাকিম তার মুস্তাদরাক কিতাবে উল্লেখ করে তাকে ইমাম বুখারি ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক সহিহ বলেছেন, আর ইমাম যাহাবি তাতে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি বলেন, এটি মাউকুফ বা সাহাবির উক্তি। আর ইমাম আলবানি বলেন, হাদিসটি সহিহ-মারফু বা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উক্তি। [সিলসিলা সহীহা ৪/৪২০]

◈ হাদিসটির ব্যাখ্যা:

◆ এই হাদিসের অর্থ হল, কেউ যদি নিজের দুশ্চরিত্রা স্ত্রীর বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বদদুআ করে তাহলে তা গৃহীত হবে না। কারণ তার ক্ষমতা ছিল, তাকে তালাক দেওয়ার কিন্তু সে তা করেনি।

◆ কেউ যদি সাক্ষী এবং প্রমাণ ছাড়া কাউকে ঋণ দেয় এবং সে ঋণগ্রহীতা তা অস্বীকার করে তাহলে সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে ঋণদাতা যদি আল্লাহর কাছে বদদুআ করে তাহলে গৃহীত হবে না। কারণ আল্লাহ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সে তা পালন করেনি।

◆ অনুরূপভাবে, কেউ যদি নির্বোধের হাতে তার অর্থ-সম্পদ তুলে দেয় ফলে সে তা আত্মসাৎ করে বা নষ্ট করে তাহলে সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে বদদুআ আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। কারণ আল্লাহ নির্বোধদের হাতে সম্পদ তুলে দেওয়া বারণ করেছেন।

মোটকথা, এই ব্যক্তি আল্লাহর বিধান উপেক্ষা করে নিজের উপরে নিজেই শাস্তি চাপিয়ে নিয়েছে। যার ফলে এই সকল ক্ষেত্রে তার দুআ আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। [ইমাম মুনাবি]
এই হাদিস দ্বারা এটা বোঝায় না যে, তার অন্য কোন দুআ কবুল হবে না। তার অন্যান্য দুআর ক্ষেত্রে এই হাদিস প্রয়োগ করা ঠিক নয়।

❑ আল্লাহ কেন দুনিয়াতেই আমাদের সব চাওয়া পূরণ করেন না?

আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তার অসীম ভবিষ্যৎ জ্ঞানের আলোকে জানেন, কোথায় আমাদের কল্যাণ আছে। কেননা তিনিই আমাদের তকদির লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি অবশ্যই আমাদের কল্যাণ চান। তিনি তার হেকমত অনুযায়ী আমাদের দুআতে সাড়া দিয়ে থাকেন। তাই কখনো কখনো বান্দার দুনিয়াবি চাওয়া পূরণ না করে এর বিনিময়ে তাকে অনাগত বিপদ থেকে রক্ষা করেন অথবা আখিরাতে তার জন্য অনন্ত পুরস্কার জমা রাখেন যা তার জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কখনো কখনো আমরা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমানের অভাবে ও অজ্ঞতা বশত: দুনিয়াতেই সব চাওয়া-পাওয়া পূরণের জন্য অস্থির হয়ে যাই!
সুতরাং দুআতে হতাশ হওয়া যাবে না বা বিরক্ত হয়ে দুআ পরিত্যাগ করা যাবে না। বরং ধৈর্যের সাথে দুআ করে যেতে হবে।
আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

জোহরের পূর্বে চার রাকাত এবং পরে চার রাকাত সালাতে রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি

 প্রশ্ন:

ক. হাদিস পড়েছি, “যে ব্যক্তি জোহরের পরে ৪ রাকআতের সুন্নত পড়বে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।” প্রশ্ন হল, এ ৪ রাকাত নামাজ কি জোহরের ফরজের পরের দু রাকাত সুন্নতে রাতিবা (নিয়মিত সুন্নতে মুয়াক্কাদা) এর পরে অতিরিক্ত পড়তে হবে নাকি সে দু রাকাতের সাথে আরও দু রাকাত যুক্ত করে মোট ৪ রাকাত পড়তে হবে?
খ. জোহরের পরে এই ৪ রাকাত নামাজের নিয়ত কীভাবে করব?
উত্তর:
❑ ক. জোহরের পূর্বে ৪ রাকাত এবং পরে ৪ রাকাত সালাত পড়ার ব্যাপারে হাদিসে বিশাল ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে এ ব্যাপারে দুটি হাদিস পেশ করা হল:

❂ ১. উম্মুল মুমিনিন উম্মে হাবিবা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

مَنْ صَلَّى أَرْبَعًا قَبْلَ الظُّهْرِ وَأَرْبَعًا بَعْدَهَا لَمْ تَمَسَّهُ النَّارُ

“যে ব্যক্তি জোহরের আগে চার রাকাত এবং পরে চার রাকাত নামাজ পড়বে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।”
উম্মে হাবিবা রা. বলেন, فما ترَكتُهنَّ منذُ سمعتُهنَّ “এ হাদিস শোনার পর আমি কখনো এ নামজগুলো ছাড়িনি।” [সুনান নাসাঈ, হা/ ১৮১৭ ও তিরমিজি হা/৪২৮, সহিহ নাসায়ি, হা/ ১৮১১]

❂ ২. আবু দাউদ ও তিরমিজিতে বর্ণিত হয়েছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

مَنْ حَافَظَ عَلَى أَرْبَعِ رَكَعَاتٍ قَبْلَ الظُّهْرِ وَأَرْبَعٍ بَعْدَهَا حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّارِ

“যে ব্যক্তি জোহরের আগে চার রাকাত ও পরে চার রাকাতের উপর যত্নশীল হবে আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিবেন।” [ইমাম তিরমিজি বলেন, এ হাদিসটি হাসান-সহিহ, শাইখ আলবানিও উক্ত হাদিসটিকে সহিহ বলে সাব্যস্ত করেছেন]
◈ এই চার রাকাত হল, জোহরের পরে দু রাকাত সুন্নতে রাতিবা (নিয়মিত সুন্নতে মুয়াক্কাদা) এর সাথে আরও দু রাকাত যুক্ত করে মোট ৪ রাকাত।

◈ এই ৪ রাকাত পড়ার নিয়ম হল, জোহরের চার রাকাত ফরজ সালাত শেষে দু রাকাত পড়ে সালাম ফিরানোর পরে আরও দু রাকাত আদায় করা।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-যা কখনো ছাড়া উচিত নয়-তা হল, জোহরের আগে চার রাকাত আর পরে দু রাকাত। তবে কেউ যদি পরে আরও দু রাকাত যুক্ত করে চার রাকাত পড়ে তবে সে সুন্নত মোতাবেক আমল করবে এবং এর মাধ্যমে লাভ করবে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার বিশাল মর্যাদা। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।
❑ খ. জোহরের পরে চার রাকাত নামাজের নিয়ত কীভাবে করবো?
উত্তর:
জোহরের পরে দু রাকাত নিয়মিত সুন্নতে রাতিবা বা নিয়মিত সুন্নতে মুয়াক্কাদার অন্তর্ভুক্ত। তাই এ দু রাকাত সুন্নতে রাতিবা বা সুন্নতে মুয়াক্কাদার নিয়তেই আদায় করবেন। কিন্তু তার পরের দু রাকাত সুন্নতে রাতিবা নয় বরং সাধারণ নফল। তাই তা সাধারণ নফলের নিয়তে আদায় করবেন। এভাবে যদি মোট ৪ রাকাত আদায় করা হয় তাহলে উপরোক্ত হাদিস অনুসারে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের সকলকে জাহান্নামের আগুন থেকে হিফাজত করেন। আমিন।
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, KSA

আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনা রামাদান দুআর এ হাদিসটি কি জয়িফ

 প্রশ্ন: “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী-রাজাবা ওয়া শা’বানা ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।” দুআর এ হাদিসটি কি জয়িফ? আর তা কি পাঠ করা যাবে?

উত্তর:
اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَبٍ، وَشَعْبَانَ، وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ
উচ্চারণ: “আল্লা-হুম্মা বা-রিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শাবা-না ও বাল্লিগনা রামাযা-ন।”
অর্থ: “হে আল্লাহ তুমি রজব ও শাবানে আমাদেরকে বরকত দাও। আর আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও।” [মুসনাদ আহমাদ ১/২৫৯, হিলইয়াতুল আওলিয়া, তবাকাতুল আসফিয়া] হাদিসটি জয়িফ বা দুর্বল।
● এ হাদিসের সনদে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যার নাম যায়েদাহ বিন আবুর রিকাদ। তার ব্যাপারে ইমাম বুখারি রহ. বলেন: মুনকারুল হাদিস।
● ইমাম নাসাঈ তার সুনান গ্রন্থে তার নিকট থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করার পর বলেন, “চিনি না এই ব্যক্তি কে?” আর তিনি তার যুয়াফা কিতাবে বলেন, “মুনকারুল হাদিস।” কুনা গ্রন্থে বলেন, “তিনি নির্ভরযোগ্য নন।”
● ইবনে হিব্বান বলেন, “তার বর্ণিত কোন হাদিসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।”
[দ্রষ্টব্য: তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী ফযলি রাজাব, ১২ পৃষ্ঠা। আয যুয়াফাউল কাবীর (২/৮১) তাহযীবুত তাহযীব (৩/৩০)]
➧ জয়িফ সনদে বর্ণিত এ দুআটি কি পাঠ করা যাবে?
দুআর ক্ষেত্রে জয়িফ হাদিস অনুযায়ী আমল করা যায় যদি তার অর্থের মধ্যে কোন সমস্যা না থাকে। কিন্তু উক্ত দুআর ব্যাপারে কথা হল, আমরা রমজান পর্যন্ত পৌছার জন্য এবং রমজানে অধিক পরিমাণে নেক আমল‌ করার তৌফিক কামনা করে দুআ করতে পারি। এতে সমস্যা নাই। সালাফ বা পূর্বসুরীগণ এই দুআ করতেন। মুআল্লা ইবনুল ফযল বলেন,
كانوا يدعون الله تعالى ستة أشهر أن يبلغهم رمضان ، ويدعونه ستة أشهر أن يتقبل منهم
“তারা (সালাফগণ) আল্লাহর কাছে ছয় মাস দুয়া করতেন, তিনি যেন তাদেরকে রমজান পর্যন্ত উপনীত করেন এবং বাকি ছয় মাস দুআ করতেন যেন, (রমজানের ইবাদত-বন্দেগি) কবুল করেন।”
[হাফেজ ইবনে রজব-লাতায়েফুল মায়ারেফ, পৃষ্ঠা নং ১৪৮]
আর বারো মাসের মধ্যে কেবল রজব ও শাবান মাস নয় বরং সারা বছরই আমাদের বরকত প্রয়োজন।
সুতরাং কেবল এই দু মাস নির্দিষ্ট না করে সারা বছরের প্রতিটি দিন বরকত মণ্ডিত হওয়ার জন্য আমরা আল্লাহর দরবারে দুআ করতে পারি।
❑ শাইখ আব্দুল করিম আল খুযাইয়ের (হাফিযাহুল্লাহ) কে প্রশ্ন করা হয়:
“আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শাবানা ও বাল্লিগনা রামাযান।” এ হাদিসটি কি সহিহ?
তিনি বলেন:
” هذا حديث لا يثبت ، لكن إن دعا المسلم بأن يبلغه الله عز وجل رمضان، وأن يوفقه لصيامه وقيامه، وأن يوفقه لإدراك ليلة القدر ، أي بأن يدعو أدعية مطلقة فهذا إن شاء الله لا بأس به
“এটি সহিহ হিসেবে সাব্যস্ত নয়। কিন্তু কোনও মুসলিম যদি এই দুআ করে যে, আল্লাহ যেন তাকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেন এবং সে মাসে সিয়াম ও কিয়াম (রোজা ও তারাবিহ/কিয়ামুল লায়ল ইত্যাদি ইবাদত)-এর তাওফিক দান করেন, লাইলাতুল কদর পাওয়ার তাওফিক দেন। অর্থাৎ যদি সাধারণভাবে দুআ করা হয় (রমজান ছাড়া কেবল রজব, শাবান বা অন্য কোনো মাসকে নির্দিষ্টভাবে নয়) তাহলে ইনশাল্লাহ এতে কোনও সমস্যা নেই।” আল্লাহু আলাম।
– আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

বিড়ালের প্রতি ভালোবাসা এবং বিড়াল প্রতিপালন

 বিড়ালের প্রতি ভালোবাসা এবং বিড়াল প্রতিপালন: বাড়াবাড়ি পরিত্যাজ্য।

প্রশ্ন: আমরা যে বিড়ালগুলো ঘরে রেখে পালন করি সাধারণত সেগুলোর জন্য আলাদাভাবে মাছ কিনে সিদ্ধ করে ভাত দিয়ে মেখে খেতে দেই। সবসময় ঘরে থাকার কারণে এবং মানুষের সংস্পর্শে থাকার কারণে বাহিরের অন্যান্য বিড়ালদের মতো করে এই পোষ মানা বিড়ালগুলো নিজেদের খাবার খুঁজে নিতে পারে না। তাই যাতে তারা পেট ভরে খেতে পারে এজন্য আলাদাভাবে মাছ কিনে সিদ্ধ করে ভাত দিয়ে মেখে খেতে দেওয়া হয়। এতে কি অতিরঞ্জন করা হয়?
উত্তর: আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক হাদিসে বিড়ালকে পাক-পবিত্র প্রাণী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এবং আল্লাহর সৃষ্টি জীবের প্রতি দয়া করা এবং সেগুলোকে কষ্ট না দেওয়ার প্রতি নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তবে অবশ্যই তা হতে হবে সীমার মধ্যে। এতে ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করা যাবে না।
যাহোক, প্রশ্নের আলোকে বলব, কোন বিড়াল যদি নিজে নিজে খাবার সংগ্রহ করে খেতে অভ্যস্ত না হয় বা এমন সুযোগ না থাকে তাহলে বাড়াবাড়ি বা অতিরঞ্জন ব্যতিরেকে তার প্রয়োজন ও পছন্দ অনুযায়ী তাকে খাবার সরবরাহ করতে কোন বাধা নেই। সে হিসেবে বিড়ালকে আলাদা ভাবে মাছ সিদ্ধ করে ভাত খাওয়ানো অতিরঞ্জন নয় যদি কারো সামর্থ্য থাকে। কেননা পোষা প্রাণীদের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ করা মালিকের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। যেহেতু সাধারণত শহরের বাসা বাড়িতে থাকা বিড়ালরা বাহির থেকে প্রাকৃতিকভাবে খাবার সংগ্রহ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে সেই সুযোগ থাকে না তাই তাদের জন্য মালিকের পক্ষ থেকে সুষম খাবার সরবরাহ করা প্রয়োজন। মাছ সিদ্ধ করে ভাতের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো একটি সাধারণ এবং স্বাস্থ্যকর উপায়। বিশেষ করে যদি এটি বিড়ালের পছন্দ অনুযায়ী হয়। তবে নিশ্চিত হতে হবে যে বিড়ালের খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যেমন প্রোটিন, ফ্যাট, এবং ভিটামিন-খনিজ আছে। শুধুমাত্র ভাত এবং মাছ যথেষ্ট নয়; মাঝে মাঝে বিড়ালের জন্য সঠিক পুষ্টি সম্পন্ন খাবারও দেওয়া উচিত। এটা অতিরঞ্জন নয় বরং দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়। সাধারণভাবে বিড়াল প্রতিপালনে সেগুলোর প্রতি যত্ন নেওয়া ভালো। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যেতে পারে। এমন কয়েকটি উদাহরণ হলো:
◍ ১. অত্যধিক বিলাসবহুল খাবার সরবরাহ করা:
বিড়ালের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল বা মানুষের জন্য তৈরি খাবার কেনা, যা তাদের পুষ্টির চাহিদার চেয়ে বেশি। যেমন: চড়া মূল্যে আমদানিকৃত বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাবার, প্রতিদিন স্টিক, চিজ বা অন্যান্য দামী খাবার খাওয়ানো।
◍ ২. ব্যয়বহুল খেলনা ও সরঞ্জাম কেনা:
বিড়ালের জন্য অত্যন্ত দামী ইলেকট্রনিক খেলনা, ক্যাট ট্রি, পিং পিং বল, মাল্টি সাউন্ড যুক্ত খেলনা, বিভিন্ন ধরনের স্প্রিং, বিশেষায়িত আসবাবপত্র ইত্যাদি ক্রয় করা।
◍ ৩. বিড়ালের জন্য ডিজাইনার পোশাক বা গয়না কেনা:
অনেক সময় মানুষ বিড়ালকে মানুষের মতো পোশাক পরানোর প্রবণতা দেখায়, যা প্রয়োজনীয় নয়। বিশেষ করে বিড়ালের জন্য দামী ডিজাইনের পোশাক বা অলঙ্কার কিনে দেওয়া বাড়াবাড়ি।
◍ ৪. অতিরিক্ত চিকিৎসা বা সৌন্দর্য চর্চার পেছনে খরচ করা:
গৃহপালিত পশু পাখির নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি হলেও অপ্রয়োজনীয় প্রসাধনী সার্ভিস, স্পা ট্রিটমেন্ট বা ফ্যান্সি হেয়ার কাট ইত্যাদিতে অনেক টাকা খরচ করা বাড়াবাড়ি হতে পারে।
◍ ৫. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য অপ্রয়োজনীয় শো অফ:
বিড়ালকে বিখ্যাত করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে সেটের মতো পরিবেশ তৈরি করা, প্রফেশনাল ফটো শুট করানো বা অপ্রয়োজনীয় ভিডিও প্রোডাকশন করাও এক ধরনের বাড়াবাড়ি।
◍ ৬. বিড়ালের জন্য আলাদা ঘর বা অত্যন্ত দামী আবাস তৈরি করা:
অনেক সময় বিড়ালের জন্য আলাদা এয়ার-কন্ডিশন্ড রুম, দামী বিছানা বা বিশেষ ঘর তৈরি করা হয়-যা বাড়তি খরচ।
◍ ৭. কুকুর বিড়াল ইত্যাদির পেছনে এতটাই ব্যতিব্যস্ত থাকা যে, নিজের পেশাগত বা সাংসারিক দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন না করা। পরিবারকে ঠিকমতো সময় না দিয়ে এগুলোর পিছনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা।
◍ ৮. এগুলোর পেছনে ব্যস্ত থাকার কারণে সালাত, দুআ, জিকির, কুরআন তেলাওয়াত, ইলম চর্চা ইত্যাদির ব্যাপারে গাফেল থাকা। এগুলো অগ্রহণযোগ্য আচরণ এবং বাড়াবাড়ি পর্যায়ের কাজ।
◍ ৯. কিছু মানুষ বিড়াল-কুকুরের পেছনে অঢেল অর্থ খরচ করে। কিন্তু বাড়ির পাশে অসহায়-দরিদ্র মানুষ, এতিম শিশু অথবা বিধবা মহিলাটির জন্য সামান্য কিছু খরচ করতে কার্পণ্য করে। এগুলো সবাই বাড়াবাড়ি উদাহরণ যা অবশ্যই নিন্দনীয়।
বিড়াল এবং অন্যান্য হালাল পোষা প্রাণীর প্রতি সঠিক যত্ন নেওয়া এবং সেগুলোকে ভালোবাসায় দোষ নেই। তবে বাড়াবাড়ি না করে তাদের প্রকৃত প্রয়োজন বুঝে খরচ এবং যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তৌফিক দানকারী।
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

সাধারণ মানুষের জন্য দাওয়াতি কাজের কিছু পদ্ধতি

 দাওয়াতি কাজ সকল মুসলিমের জন্য ফরজ: সাধারণ মানুষের জন্য দাওয়াতি কাজের কিছু পদ্ধতি

প্রশ্ন: সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করা কি সবার জন্য ফরজ? যাদের দ্বীনের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই, যেমন: জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করা মানুষ। তবে তারা দ্বীন জানার চেষ্টা করে এবং শাইখদের লেকচার শোনে—তারা কীভাবে দাওয়াত দিবে? দাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো কী? তারা যদি দাওয়াত না দেয় এবং অসৎ কাজ দেখে উপেক্ষা করে-যেহেতু এই বিষয়ে তারা জ্ঞান অর্জন করেনি-তবে কি তারা গুনাহগার হবে?
উত্তর: প্রত্যেক মুসলমানের জন্য দ্বীন প্রচার করা ফরজ বা একটি আবশ্যিক দায়িত্ব। প্রত্যেকে নিজের জ্ঞান, যোগ্যতা এবং সাধ্যানুযায়ী এই কাজে অংশগ্রহণ করবেন। আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের দাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে কুরআন ও হাদিসে অনেক সওয়াবের কথা বর্ণিত হয়েছে।
❂ আল্লাহর দ্বীন প্রচারের গুরুত্ব ও মর্যাদা:
◆ আল্লাহ তাআলা বলেন,
ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
“তোমার পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান কর হিকমত (প্রজ্ঞা) ও উপদেশপূর্ণ কথার মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন সুন্দরতম পন্থায়।” [সূরা নহল: ১২৫]
◆ তিনি আরও বলেন,
مَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ ‎
“তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার আছে যে, আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি একজন মুসলিম বা আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত?” [সূরা ফুসসিলাত/হা-মী-ম সাজদাহ: ৩৩]
◆ আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ وَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُشرِكِيْنَ
“আর আপনি আপনার পালনকর্তার দিকে (মানুষকে) দাওয়াত দিন। আর আপনি অবশ্যই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।” [সূরা কাসাস: ৮৭]
◆ আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُروْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ
“তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দিবে ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। [আলে ইমরান: ১১০]
◆ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ»
“তোমাদের মধ্যে যে অন্যায় দেখবে সে যেন তা তার হাত দিয়ে বাধা দেয়, আর তা সম্ভব না হলে যেন মুখ দিয়ে বাধা দেয়। তাও সম্ভব না হলে যেন অন্তর ঘৃণা করে (এবং এর অন্যায় থাকার জন্য চিন্তা ভাবনা করে)। এটি হলো, দুর্বল ঈমানের পরিচয়।” [সহিহ মুসলিম, হা/৪৯]
◆ তিনি আরও বলেন,
بَلِّغُوا عَنِّي ولو آيَةً
“আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছিয়ে দাও।” [সুনান তিরমিজি-সহীহ]
◆ আল্লাহর দ্বীনের প্রচার-প্রসারের মর্যাদা অনেক বেশি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَأَنْ يَهْدِيَ اللَّهُ بِكَ رَجُلًا وَاحِدًا خَيْرٌ لَكَ مِنْ أَنْ يَكُونَ لَكَ حُمْرُ النَّعَمِ
“তোমার মাধ্যমে যদি আল্লাহ একজন লোককেও হেদায়েত দেন (সুপথ দেখান) তবে তা তোমার জন্য একটি লাল উট পাওয়া থেকেও উত্তম।” [সহিহ বুখারী]
◆ তিনি আরও বলেন,
مَنْ دَعَا إِلَى هُدىً كانَ لهُ مِنَ الأجْر مِثلُ أُجورِ منْ تَبِعهُ لاَ ينْقُصُ ذلكَ مِنْ أُجُورِهِم شَيْئًا رواهُ مسلمٌ
“যে ব্যক্তি মানুষকে হেদায়েতের দিকে আহ্বান করে, সে ওই সকল লোকের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে, যারা তা অনুসরণ করে। তবে অনুসরণকারীদের সওয়াবের কোনও ঘাটতি হবে না।” [সহীহ মুসলিম]
❂ দাওয়াতি কাজ থেকে বিরত থাকলে গুনাহগার হতে হবে:
উপরের আলোচনার ভিত্তিতে বোঝা যায়, আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা অত্যন্ত কাজ। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য সাধ্যানুযায়ী তা সম্পাদন করা ফরজ। যদি কেউ এই দায়িত্ব পালন না করে তবে ফরজ লঙ্ঘন করার কারণে সে গুনাহগার হবে।
❂ সাধারণ মানুষের জন্য দাওয়াতি কাজের পদ্ধতি:
১. দ্বীনের কাজে আর্থিক সাহায্য প্রদান।
২. দাওয়াতি কাজে নিজের শ্রম ও সময় ব্যয় করা।
৩. পরিবারে দাওয়াত: একজন গৃহিণীর জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হলো তার পরিবার।
৪. কর্মস্থলে দাওয়াত:
— একজন শিক্ষক তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
— একজন ডাক্তার তার চেম্বারে।
— একজন ছাত্র তার সহপাঠীদের মধ্যে।
—একজন চাকরিজীবী তার সহকর্মী এবং বন্ধুদের মাঝে।‌
এভাবে প্রত্যেকেই সাধ্য অনুযায়ী তার আশেপাশের লোকদের নিকটে দাওয়াতের কাজ করবে।
৫. আচরণের মাধ্যমে দাওয়াত: কর্মক্ষেত্রে সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য প্রদর্শন করা। এভাবে প্রত্যেক মুসলমান নিজের সাধ্য ও সুযোগ অনুযায়ী এই মহান দায়িত্ব পালন করবে।
আল্লাহ তৌফিক দান করুন আমিন। আল্লাহু আলাম।
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

দাওয়াতের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি

দাওয়াতের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি: দাওয়াতি ময়দানে যেগুলো লক্ষ্য রাখা অপরিহার্য
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আমরা অনেকেই দাওয়াতের কাজে আগ্রহ প্রকাশ করি। নিঃসন্দেহে এটি প্রশংসনীয়। তবে দাওয়াতের মূলনীতিগুলো সম্পর্কে সচেতন না থাকা কিংবা এগুলোর প্রতি অবহেলা করার ফলে অনেক সময় এই মহৎ পথ ঝগড়া, কোন্দল ও বিদ্বেষ দ্বারা কলুষিত হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর দ্বীনের উপকারের থেকে ক্ষতিই বেশি হয়।
তাই এখানে সংক্ষেপে দাওয়াতের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি তুলে ধরা হলো:
১. সালাফে-সালেহিনের অনুসরণ: দাওয়াতি কাজে সালাফে-সালেহিন অর্থাৎ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এবং এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ দুই প্রজন্ম সাহাবি ও তাবেয়িদের মানহাজ (পন্থা) ও মূলনীতি অনুসরণ করুন। তাদের মানহাজ এবং মূলনীতিই আমাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ।
২. তাওহিদ ও সুন্নাহর প্রতি আহ্বান: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল বিষয় তথা তাওহিদ ও সুন্নাহর পথে সর্বসাধারণকে আহ্বান করুন এবং শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার থেকে সাবধান করুন। সর্বক্ষেত্রে এটিকে প্রাধান্য দিন। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিষয়ের দিকে দাওয়াত দিন।
৩. মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস: মুসলিম উম্মাহর ঐক্যকে গুরুত্ব দিন। ঐক্য একটি বিশাল শক্তি, যা অনৈক্যের মাধ্যমে দুর্বল হয়ে যায়। অনৈক্য ও কোন্দল কাফিরদের জন্য মুসলিমদের বিপর্যয় ঘটানোর সুযোগ সৃষ্টি করে।
৪. মতবিরোধে সহনশীলতা: শাখাগত মতবিরোধে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন। ভদ্রতার সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করুন। ঝগড়া, অশ্লীল ভাষা বা সহিংসতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
৫. আল্লাহর দ্বীনকে কেন্দ্রীভূত করুন: মানুষকে আল্লাহ এবং তাঁর শাশ্বত মহান দ্বীনের প্রতি আহ্বান করুন; কোনও ব্যক্তি, দল, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান কিংবা বিশেষ কোন মতাদর্শের প্রতি প্রতি নয়। আল্লাহ আমাদেরকে দাওয়াতের ক্ষেত্রে এ নীতিই শিক্ষা দিয়েছেন। [সূরা নাহল: ১২৫]
৬. ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা: ইসলামের সৌন্দর্যময় দিকগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরুন, যা তাদেরকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করবে।
৭. সত্য ও সাহসিকতা: বুকে অদম্য সাহস নিয়ে সত্য পথে অটল থাকুন। যদি সত্য বলতে অপারগ হন তবে কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না।
৮. ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তা: দাওয়াতের কাজে ধৈর্য অপরিহার্য। ধৈর্যের অভাবে দাওয়াতের কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।
৯. কাফে**রদের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি: শরিয়তের আলোকে কা**ফেরদের সঙ্গে আচরণ করুন। তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে উপকৃত হওয়া ইসলামবিরোধী নয়। দাওয়াতের স্বার্থে তাদের সাথে সদাচরণ করুন। কিন্তু তাদের বাতিল ধর্ম, অপসংস্কৃতি এবং কুসংস্কার সম্পর্কে নিজে সতর্ক থাকা এবং অন্যদের সতর্ক করা আবশ্যক।
১০. সহজতা ও নম্রতা: ইসলামকে সহজ, নম্র ও ভদ্রভাবে উপস্থাপন করুন। রুক্ষ আচরণ, আক্রমণাত্মক ভাষা বা হেয় প্রতিপন্ন করার মাধ্যমে দাওয়াতি কাজ করা যায় না। এতে শুধু নিজের ক্রোধ প্রকাশিত হয়।
১১. দাওয়াতের পাশাপাশি মানুষের সাথে সদাচরণ করুন এবং সুন্দর ভাষায় কথা বলুন। তাদের কল্যাণে যথাসম্ভব অবদান রাখুন এবং তাদের কষ্ট লাঘবে কাজ করুন। সুন্দর আচার-ব্যবহার এবং মানুষের উপকার আপনাকে তাদের কাছে সন্মানের পাত্র, বিশ্বস্ত ও গ্রহনযোগ্য করে তুলবে।
১২. জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনীয়তা: কথা বলা বা আমল করার আগে বিজ্ঞ আলেমদের নিকট থেকে সঠিক পন্থায় জ্ঞানার্জন করুন। প্রচুর পড়াশোনা করুন। জ্ঞান দ্বারা নিজেকে সুসজ্জিত করুন। কোনও বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান না থাকলে যোগ্য আলেমদেরকে প্রশ্ন করুন এবং তাদের থেকে পরামর্শ নিন। শুধুমাত্র বই পড়ে বা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছু ভিডিও দেখেই শরিয়তের কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ।
১৩. আন্তরিকতা: খালেস নিয়তে ও দরদ ভরা বুকে পথভ্রষ্ট মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে দাওয়াত দিন এবং সংশোধন প্রচেষ্টা অব্যহত রাখুন।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমলে সালেহ (সৎকর্ম) করার পাশাপাশি দাওয়াতি ময়দানে কাজ করা এবং ইসলাম প্রচারে অবদান রাখার তাওফিক দিন এবং তা কবুল করুন। আমিন।
গ্রন্থনা: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যান্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব। 

শবে মিরাজ পালন করা বিদআত

 মিরাজ দিবস কিংবা শবে মিরাজ উদযাপন করা রজব মাসের অন্যতম বিদআত। জাহেলরা এই বিদআতকে ইসলামের উপর চাপিয়ে দিয়ে প্রতি বছর তা পালন করে যাচ্ছে! এরা রজব মাসের সাতাইশ তারিখকে শবে মিরাজ পালনের জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে। এ উপলক্ষে এরা একটি নয় একাধিক বিদআত তৈরি করেছে। যেমন:

— শবে মিরাজ উপলক্ষে মসজিদে মসজিদে একত্রিত হওয়া।
— মসজিদে কিংবা মসজিদের মিনারে মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালানো বা আলোকসজ্জা করা।
— এ উপলক্ষে অর্থ খরচ করা।
— কুরআন তিলাওয়াত বা জিকিরের জন্য একত্রিত হওয়া।
— ‘মিরাজ দিবস’ উপলক্ষে মসজিদে বা বাইরে সভা-সেমিনার আয়োজন করে তাতে মিরাজের ঘটনা বয়ান করা ইত্যাদি। এগুলো সবই গোমরাহি এবং বাতিল কর্মকাণ্ড। এ প্রসঙ্গে কুরআন-সুন্নাহতে ন্যূনতম কিছু বর্ণিত হয়নি। তবে এভাবে দিবস পালন না করে যে কোন সময় মিরাজের ঘটনা বা শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা দোষণীয় নয়।

❑ ক. কোন রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসরা ও মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল?

যে রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসরা ও মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল সেটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্ব যুগ থেকেই ওলামাগণের মাঝে মত পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন হাদীস না থাকায় আলেমগণ বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন।

◈ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন, মিরাজের সময় নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
কেউ বলেছেন, নবুওয়তের আগে। কিন্তু এটা একটি অপ্রচলিত মত। তবে যদি উদ্দেশ্য হয়, যে সেটা স্বপ্ন মারফত হয়েছিল সেটা ভিন্ন কথা।

◈ অধিকাংশ আলেমগণের মত হল, তা হয়েছিল নবুওয়তের পরে। তবে নবুওয়তের পরে কখন সেটা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।

◈ কেউ বলেছেন, হিজরতের এক বছর আগে। ইবনে সা’দ প্রমুখ এ মতের পক্ষে। ইমাম নওয়াবি রহ. এই মতটির পক্ষে জোর দিয়ে বলেছেন। তবে ইবনে হাজাম এর পক্ষে আরও শক্ত অবস্থান নিয়ে বলেন, “এটাই সর্ব সম্মত মত।” এই মতের আলোকে বলতে হয় মিরাজ হয়েছিল রবিউল আওয়াল মাসে।

কিন্তু তার কথা অগ্রহণ যোগ্য। কারণ, এটা সর্ব সম্মত মত নয়। বরং এক্ষেত্রে প্রচুর মতবিরোধ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশটির অধিক মত পাওয়া যায়।

◈ ইবনুল জাওজি বলেন, হিজরতের আট মাস আগে মিরাজ হয়েছিল। এ মতানুসারে সেটা ছিল রজব মাসে।

◈ কেউ বলেন, হিজরতের ছয় মাস আগে। এ মত অনুযায়ী সেটা ছিল রমাযানে। এ পক্ষে মত দেন আবুর রাবী বিন সালেম।

◈ আরেকটি মত হল, হিজরতের এগার মাস আগে। এ পক্ষে দৃঢ়তার সাথে মত ব্যক্ত করেন, ইবরাহীম আল হারবি। তিনি বলেন, হিজরতের এক বছর আগে রবিউস সানিতে মিরাজ সংঘটিত হয়।

◈ কারো মতে, হিজরতের এক বছর তিন মাস আগে। ইবনে ফারিস এ মত পোষণ করেন।

এভাবে আরও অনেক মতামত পাওয়া যায়। কোন কোন মতে রবিউল আওয়াল মাসে, কোন মতে শাওয়াল মাসে, কোন মতে রমজান মাসে, কোন মতে রজব মাসে।

◈ আর তাই শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, “ইবনে রজব বলেন, রজব মাসে বড় বড় ঘটনা ঘটেছে মর্মে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায় কিন্তু কোনটির পক্ষেই সহীহ দলীল নাই। বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রজবের প্রথম রাতে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন, সাতাইশ বা পঁচিশ তারিখে নবুওয়ত প্রাপ্ত হয়েছেন অথচ এ সব ব্যাপারে কোন সহীহ দলিল পাওয়া যায় না।” [লাতাইফুল মায়ারেফ, ১৬৮ পৃষ্ঠা]

◈ আবু শামাহ বলেন, গল্পকারেরা বলে থাকে যে, ইসরা ও মিরাজের ঘটনা ঘটেছিল রজব মাসে। কিন্তু ‘ইলমুল জারহে ওয়াত তাদিল’ (علم الجرح والتعديل বা বর্ণনাকারীর নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ের শাস্ত্র) বিশেষজ্ঞ আলেমগণের মতে এটা ডাহা মিথ্যা। [আল বায়িস: ১৭১]

❑ খ. শবে মিরাজ পালন করার বিধান:

সালফে সালেহিনগণ এ মর্মে একমত যে, ইসলামি শরিয়তে অনুমোদিত দিন ছাড়া অন্য কোন দিবস উদযাপন করা বা আনন্দ-উৎসব পালন করা বিদআত। কারণ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

“مَنْ أَحْدَثَ فِي دِينِنَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ”

“যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করে, যা এর অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” [বুখারি, অধ্যায়: সন্ধি-চুক্তি।]

আর সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে:

“مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ”

“যে এমন কোনো কাজ করে যা আমাদের আদেশের সাথে সঙ্গত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।”
[মুসলিম, অধ্যায়: বিচার-ফয়সালা]

সুতরাং মিরাজ দিবস অথবা শবে মিরাজ পালন করা দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট বিদআতের অন্তর্ভুক্ত সাহাবিগণ, তাবেঈনগণ বা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী সালফে সালেহীনগণ তা পালন করেন নি। অথচ সকল ভাল কাজে তারা ছিলেন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী।

◈ ইবনুল কাইয়েম জাওযিয়া রহ. বলেন, “ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, পূর্ববর্তী যুগে এমন কোন মুসলমান পাওয়া যাবে না যে শবে মিরাজকে অন্য কোন রাতের উপর মর্যাদা দিয়েছে। বিশেষ করে শবে কদরের চেয়ে উত্তম মনে করেছে এমন কেউ ছিল না। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের একনিষ্ঠ অনুগামী তাবেয়িনগণ এ রাতকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন কিছু করতেন না।এমনকি তা আলাদাভাবে স্মরণও করতেন না। যার কারণে জানাও যায় না যে, সে রাতটি কোনটি।

নি:সন্দেহে ইসরা ও মিরাজ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার প্রমাণ বহন করে। কিন্তু এজন্য এর মিরাজের স্থানকালকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত করা বৈধ নয়। এমনকি যে হেরা পর্বতে ওহি নাজিলের সূচনা হয়েছিল এবং নবুওয়তের আগে সেখানে তিনি নিয়মিত যেতেন নবুওয়ত লাভের পর মক্কায় অবস্থান কালে তিনি কিংবা তাঁর কোন সাহাবি সেখানে কোন দিন যাননি। তারা ওহি নাজিলের দিনকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত-বন্দেগি করেন নি বা সেই স্থান বা দিন উপলক্ষে বিশেষ কিছুই করেননি।

যারা এ জাতীয় দিন বা সময়ে বিশেষ কিছু ইবাদত করতে চায় তারা ঐ আহলে কিতাবদের মত যারা ঈসা আলাইহিস সালাম এর জন্ম দিবস (Chisthomas) বা তাদের দীক্ষাদান অনুষ্ঠান (Baptism) পালন ইত্যাদি পালন করে।

উমর ইবনুল খাত্তাব রা. দেখলেন, কিছু লোক একটা জায়গায় নামাজ পড়ার জন্য হুড়াহুড়ি করছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী?

তারা বলল, এখানে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ পড়েছিলেন।

তিনি বললেন, তোমরা কি তোমাদের নবীদের স্মৃতি স্থলগুলোকে সাজদার স্থান বানাতে চাও? তোমাদের পূর্ববর্তী জমানার লোকেরা এ সব করতে গিয়েই ধ্বংস হয়ে গেছে। এখানে এসে যদি তোমাদের কারো নামাজের সময় হয় তবে সে যেন নামাজ পড়ে অন্যথায় সামনে অগ্রসর হয়।” [মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, ২য় খণ্ড, ৩৭৬, ৩৭৭]

◈ ইবনুল হাজ্জ বলেন,“রজব মাসে যে সকল বিদআত আবিষ্কৃত হয়েছে সবগুলোর মধ্যে সাতাইশ তারিখের লাইলাতুল মিরাজের রাত অন্যতম।”[আল মাদখাল, ১ম খণ্ড, ২৯৪পৃষ্ঠা]

পরিশেষে বলব, যেহেতু রজব মাসে নফল নামাজ, রোজা করা, মসজিদ, ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট দোকান-পাট ইত্যাদি সাজানো, সেগুলোকে আলোক সজ্জা করা কিংবা ছাব্বিশ তারিখের দিবাগত রাত তথা সাতাইশে রজবকে শবে মিরাজ নির্ধারণ করে তাতে রাত জেগে ইবাদত করার ব্যাপারে কোন গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নাই। তাই আমাদের কর্তব্য হবে সেগুলো থেকে দূরে থাকা। অন্যথায় আমরা বিদআত করার অপরাধে আল্লাহ তাআলার দরবারে গুনাহগার হিসেবে বিবেচিত হব। অবশ্য কোন ব্যক্তি যদি প্রতি মাসে কিছু নফল রোজা রাখে সে এমাসেও সেই ধারাবাহিকতা অনুযায়ী এ মাসে রোজা রাখতে পারে, শেষ রাতে উঠে যদি নফল নামাজের অভ্যাস থাকে তবে তবে এ মাসের রাতগুলিতেও নামাজ পড়তে পারে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকল অবস্থায় তাওহিদ ও সুন্নাহর উপর আমল করার তাওফিক দান করুন এবং শিরক ও বিদআত থেকে হেফাজত করুন। আমিন।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উৎস: আল বিদা’ আল হাওলিয়াহ
লেখক: শাইখ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ আত তুওয়াইজিরি।
অনুবাদ ও সংক্ষেপায়ন: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডন্সে সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate