Monday, May 6, 2024

প্রচণ্ড গরমের সময় নামাজ সংক্রান্ত ১০টি জরুরি মাসায়েল

 দেশব্যাপী স্মরণকালের ভয়াবহ দাবদাহ চলছে। প্রচণ্ড উত্তাপের কারণে মানুষ ও পশুপাখি অতিষ্ঠ। প্রখর সূর্যের কিরণ এবং লু হাওয়ায় জনজীবনের বেহালদশা। (আল্লাহ হেফাজত করুন।‌ আমিন)। এমতবস্থায় সালাত আদায় সম্পর্কে, বিশেষভাবে দ্বিপ্রহরের জোহর সালাত আদায় করার ব্যাপারে ইসলাম কী দিকনির্দেশনা দিয়েছে সেটি আমরা জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

নিম্নে এ সংক্রান্ত জরুরি কিছু মাসায়েল উল্লেখ করা হলো:

▪️১. হাদিসে কি প্রচণ্ড গরমের সময় কি বেশি করে নামাজ পড়তে বলা হয়েছে?
উত্তর: প্রচণ্ড গরমের সময় বেশি বেশি নামাজ পড়ার ব্যাপারে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা হাদিস ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, হাদিস গ্রন্থ সমূহে এমন কোনও হাদিস নেই। অন্য কোনও হাদিসের মমার্থ থেকেও তা প্রমাণিত হয় না। বরং কিছু মানুষ একটি হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এমনটি বলছে।
উক্ত হাদিসটি হলো, আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا اشْتَدَّ الْحَرُّ فَأَبْرِدُوا بِالصَّلَاةِ, فَإِنَّ شِدَّةَ الْحَرِّ مِنْ فَيْحِ جَهَنَّمَ»
“যখন প্রচণ্ড গরম পড়ে তখন সালাতকে ঠাণ্ডা করবে। কেননা প্রচণ্ড গরম জাহান্নামের আগুনের নিঃশ্বাস থেকে আসে।” [বুখারি ও মুসলিম]

এ হাদিস অনুযায়ী কেউ কেউ বলছে যে, যখন খুব গরম পড়ে তখন সালাতের মাধ্যমে গরমকে ঠাণ্ডা করো। অর্থাৎ বেশি করে সালাত আদায় করো! কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা। হাদিসের ভাষাগত দিক খেয়াল করলেও এমন অর্থ বুঝা যায় না।
কারণ এখানে বলা হয়নি, فَأَبْرِدُوه بِالصَّلَاةِ “তোমরা গরমকে সালাতের মাধ্যমে ঠাণ্ডা করো।”

▪️২. তাহলে উক্ত হাদিসে উল্লেখিত হাদিসে সালাতকে ঠাণ্ডা করার অর্থ কী?
উত্তর:
– ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রাহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন,
( فأبردوا ) بقطع الهمزة وكسر الراء ، أي أخروا إلى أن يبرد الوقت
”ঠাণ্ডা করো” অর্থ: সময়টা ঠাণ্ডা হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করো।” [ফাতহুল বারি]
– তিনি অন্যত্র বলেন,
«الإبراد» تأخير صلاة الظهر إلى أن يبرد الوقت
ইবরাদ «الإبراد» শব্দের অর্থ, “সময় ঠাণ্ডা হওয়া পর্যন্ত জোহর সালাত বিলম্ব করা।” [বুলুগুল মারাম]
এ ব্যাখ্যাটি সঠিক।‌ কেননা তা অন্য হাদিস থেকে স্পষ্ট হয়। তা হলো, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“أَبْرِدُوا بِالظُّهْرِ فَإِنَّ شِدَّةَ الْحَرِّ مِنْ فَيْحِ جَهَنَّمَ
“জোহরের সালাতকে ঠাণ্ডা করে আদায় করো। কেননা প্রচণ্ড গরম জাহান্নামের নিঃশ্বাস।” [সহীহ মুসলিম]

তাহলে এখান থেকে প্রমাণিত হলো যে, হাদিসে মূলত প্রচণ্ড গরমের সময় জোহরের সালাত বিলম্ব করার কথা বলা হয়েছে।
এই হাদিসের মর্মার্থ অনুযায়ী,‌ প্রচণ্ড গরমের সময় অধিক পরিমাণ সালাত পড়ার কথা পূর্ববর্তী আলেমগণ কেউ বলেছেন বলে জানা নেই।

▪️৩. প্রচণ্ড গরমের সময় জোহরের সালাত বিলম্ব করে পড়ার বিধান কী?

এ ব্যাপারে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন,

جمهور أهل العلم يستحب تأخير الظهر في شدة الحر إلى أن يبرد الوقت وينكسر الوهج
“বেশির ভাগ আহলে ইলমের মতে, প্রচণ্ড গরমের সময় জোহরের সালাত দেরিতে আদায় করা উত্তম যতক্ষণ না সময় ঠাণ্ডা হয় এবং সূর্যের কিরণের তিব্রতা কমে যায়।” [ফাতহুল বারী)

▪️৪. উক্ত হাদিসের আলোকে প্রচণ্ড গরমের কারণে কেবল জোহরের সালাত বিলম্ব করা যাবে; আসর, মাগরিব, ইশা, ফজর ইত্যাদি অন্য কোনো সালাত নয়। কেননা হাদিসে ষ্পষ্টভাবে কেবল জোহরের সালাতের কথা এসেছে।
অতএব অন্যান্য সালাত যথাসময়ে আদায় করতে হবে।

▪️ ৫. অনুরূপভাবে এ হাদিস কেবল গ্রীষ্মকালেই প্রযোজ্য; শীতকালে নয়।‌যেমটি বলেছেন ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহ.
تؤخر في الصيف دون الشتاء
“গ্রীষ্মকালে বিলম্ব করা যাবে; শীতকালে নয়।”‌ [ফাতফুল বারি]

▪️৬. পুরুষগণ মসজিদে জামাতে সালাত পড়ুক কিংবা মহিলারা বাড়িতে পড়ুক সর্বাবস্থায় গ্রীস্মকালে যদি প্রচণ্ড দাবাদহ পড়ে তবে জোহরের সালাত বিলম্ব করা মুস্তাহাব (মতান্তরে ওয়াজিব)। কেননা হাদিসটি আম বা ব্যাপক যা নারী-পুরুষ উভয়কেই শামিল করে। এটি অধিক বিশুদ্ধ মত।

▪️৭. মসজিদে বা বাড়িতে ফ্যান বা এয়ার কন্ডিশন থাকলেও উক্ত বিধানের পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ হাদিস পালনার্থে এ ক্ষেত্রেও বিলম্বে জোহরের সালাত আদায় করা উচিত।

▪️৮. প্রচণ্ড গরম না থাকলে বা স্বাভাবিক অবস্থায় কিংবা শীত মওসুমে আওয়াল ওয়াক্তে তথা সালাতের সময় হওয়ার পর কাল বিলম্ব না করে আদায় করবে। কেননা তখন সালাত বিলম্ব করার মূল কারণ অনুপস্থিত।
আর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বাভাবিক অবস্থায় আওয়াল ওয়াক্তে জোহরের সালাত আদায় করতেন। যেমন: আয়েশা রা. বলেন,

ما رأيت أحدا كان أشد تعجيلا للظهر من رسول الله صلى الله عليه وسلم، ولا من أبي بكر، ولا من عمر

“আগেভাগে‌ (আওয়াল ওয়াক্তে) জোহরের সালাত আদায় করার ক্ষেত্রে আমি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আর কাউকে এতটা তাড়াহুড়া করতে দেখিনি। আবু বকর ওমর রা. থেকেও নয় (অর্থাৎ তাদের থেকেও তিনি আগেভাগে জোহরের সালাত আদায় করতেন)। ” [তিরমিজী হাদিস নম্বর: ১৫৫ (আল মাদানী প্রকাশনী)]

▪️৯. যে সব অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে আবহাওয়া খুব বেশি উত্তপ্ত হয় না বা নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় উক্ত হাদিস প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ সে সব অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে যথাসময়েই জোহরের সালাত আদায় করবে; বিলম্ব করবে না।

▪️১০. প্রচণ্ড গরমের সময়েও যদি কোথাও যথাসময়েই আজান দেওয়া হয় (বিলম্ব না করা হয়) তাহলে কষ্ট হলেও পুরুষগণ জামাতের সাথে সালাত আদায় করার উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করবে। শরিয়ত সম্মত ওজর ছাড়া জামাত পরিত্যাগ করবে না। কেননা ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন যাপন করা ফরজ। বিচ্ছিন্নতা ও দ্বিমত করা হারাম। [সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড]। আল্লাহ আমাদেরকে তার রহমতের বারিধারায় সিক্ত করুন এবং জাহান্নামের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। আমিন। আল্লাহু আলম।
– আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল –

ইস্তিসকার সালাতে‌র পর বৃষ্টি হওয়া না‌ হওয়া সম্পর্কে যে বিশ্বাস রাখা জরুরি

 অনাবৃষ্টির সময় সালাতুল ইস্তিসকা বা বৃষ্টি প্রার্থনার নামাজ পড়া সুন্নত।‌ কেননা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদেরকে নিয়ে সালাতুল ইস্তিসকা আদায় করেছেন। কেউ যদি পড়ে তাহলে সে সুন্নত পালন করার কারণে সওয়াব পাবে। বিশেষ করে যখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি মৃত প্রায় সুন্নতকে পুনর্জীবিত করা হয় এবং শেষ জমানায় সুন্নত অনুযায়ী আমল করা হয় তখন এর মর্যাদা ও নেকি অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। যেমন: হাদিসে এসেছে,আবু সা’লাবাহ খুশানি রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ أَيَّامَ الصَّبْرِ الصَّبْرُ فِيهِ مِثْلُ قَبْضٍ عَلَى الْجَمْرِ لِلْعَامِلِ فِيهِمْ مِثْلُ أَجْرِ خَمْسِينَ رَجُلاً يَعْمَلُونَ مِثْلَ عَمَلِهِ قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ أَجْرُ خَمْسِينَ مِنْهُمْ قَالَ أَجْرُ خَمْسِينَ مِنْكُمْ

“তোমাদের পরবর্তীতে আছে ধৈর্যের যুগ। সে (যুগে) ধৈর্যশীল হবে মুষ্টিতে অঙ্গার ধারণকারীর মতো। সে যুগের আমলকারীর হবে পঞ্চাশ জন পুরুষের সমান সওয়াব। জিজ্ঞাসা করা হল, হে আল্লাহর রসুল, পঞ্চাশ জন পুরুষ আমাদের মধ্য হতে, নাকি তাদের মধ্য হতে? তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্য হতে।” [আবু দাউদ ৪৩৪৩, তিরমিযী ৩০৫৮, ইবনে মাজাহ ৪০১৪, ত্বাবারানী ১৮০৩৩, সহীহুল জামে’ ২২৩৪]

উল্লেখ্য যে, উম্মতের বিশৃঙ্খলার সময় সুন্নতকে আঁকড়ে ধরবে তার জন্য রয়েছে একশ শহিদের সমপরিমাণ সওয়াব।” এ হাদিসটি জইফ।

➤ ইস্তিসকার সালাত আদায় করলে বৃষ্টি হওয়া আবশ্যক নয়। কেননা এটি কিছুটা ব্যতিক্রমী ও বিশেষ পদ্ধতিতে মহান আল্লাহর কাছে একটি দুআ। আল্লাহ চাইলে দুআ কবুল করবেন অথবা করবেন না। এটি সম্পূর্ণ তাঁর ইচ্ছাধীন বিষয়।

অতএব কোথাও ইস্তিসকার নামাজ পড়ার পরও যদি বৃষ্টি না হয় তখন এ ধারণা করা যাবে না যে, দুআ কারীদের মধ্যে ইমান ও ইখলাসের ত্রুটি ছিল বা আল্লাহ তাদের দুআ প্রত্যাখ্যান করেছেন কিংবা তারা ব্যর্থ হয়েছে…ইত্যাদি।

আবার ইস্তিসকার নামাজের পরে বৃষ্টি বর্ষিত হলে যেন এই ধারণা না করা হয় যে, যিনি নামাজ পড়িয়েছেন তিনি আল্লাহর কামেল ওলি, বিরাট বুজুর্গ বা আল্লাহর খুব পছন্দনীয় মানুষ। তিনি আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্কের কারণে আল্লাহর নিকট থেকে বৃষ্টি নিয়ে এসেছেন!
বৃষ্টি হলেও এই বিশ্বাস করার সুযোগ নাই। কেননা বৃষ্টি দেওয়া-না দেওয়া সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছার উপরে নির্ভরশীল। আমাদের কর্তব্য তো কেবল, নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দুআ করা। ইস্তিসকার নামাজ পড়ার পর বৃষ্টি না হলেও সুন্নত আদায়ের কারণে সওয়াব অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ।

তাছাড়া এ সালাতের মাধ্যমে এই স্বীকৃতি প্রদান করা হয় যে, মহান আল্লাহ এ বিশ্ব চরাচরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক। তিনি সর্বময় দয়ালু ও দাতা। তার দয়া ও অনুগ্রহ ছাড়া সৃষ্টি জগত নিতান্তই অচল। আমরা অতিশয় দুর্বল, অসহায় এবং তাঁর করুণার ভিখারি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَنتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّهِ – وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ
“হে মানবজাতি, তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী আর আল্লাহ হলেন অভাব মুক্ত ও সর্বময় প্রশংসিত।” [সূরা ফাতির: ১৫]

ইস্তিসকার সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ চাওয়ার পাশাপাশি এই অনাবৃষ্টির ফলে আরও বড় ধরনের বিপদ-বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতি থেকেও আল্লাহর নিকট পরিত্রাণ কামনা করা হয়।
আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
ما من مسلم يدعو بدعوة، ليس فيها إثم ولا قطيعة رحم إلا أعطاه الله بـها إحدى ثلاث : إما أن يعجل له دعوته، وإما أن يدخرها له في الآخرة وإما أن يصرف عنه من السوء مثلها. قالوا : إذا نكثر قال : الله أكثر
“যখন কোনও মুমিন ব্যক্তি দুআ করে, যে দুআতে কোনও পাপ থাকে না ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় থাকে না, তাহলে আল্লাহ তিন পদ্ধতির কোনও এক পদ্ধতিতে তার দুআ অবশ্যই কবুল করে নেন। যে দুআ সে করেছে হুবহু সেভাবে তা কবুল করেন অথবা তার দুআর প্রতিদান আখিরাতের জন্য সংরক্ষণ করেন কিংবা এ দুআর মাধ্যমে তার ওপর আগত কোনও বিপদ তিনি দূর করে দেন। এ কথা শুনে সাহাবিগণ বললেন, আমরা তাহলে অধিক পরিমাণে দুআ করতে থাকবো। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা যত প্রার্থনাই করবে আল্লাহ তার চেয়ে অনেক বেশি কবুল করতে পারেন।” [বুখারী : আল-আদাবুল মুফরাদ ও আহমদ, সহীহ-আলবানি]

এ হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কোনো মুসলিম ব্যক্তির দুআ কখনো বৃথা যায় না।

সুতরাং আল্লাহর নবির সুন্নত পালনের মাধ্যমে সওয়াব অর্জন, নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরে মহান দয়ালু ও দাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের করুণা প্রার্থনা এবং অনাবৃষ্টির ফলে অনাগত বিপদ-বিপর্যয়, ক্ষয়-ক্ষতি, দুর্ভিক্ষ, রোগব্যাধী-মহামারী ইত্যাদি থেকে পরিত্রাণ কামনা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে আমাদের ইস্তিসকার সালাত আদায় করা উচিত।
মোটকথা, এখানে প্রাপ্তি ছাড়া ব্যর্থতা এবং লাভ ছাড়া ক্ষতির কিছু নাই। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

প্রচণ্ড গরম ও ঠাণ্ডার উৎস কী এবং এ সময় কি বিশেষ কোন দুআ পাঠ করা যায়

 প্রচণ্ড গরম ও ঠাণ্ডার উৎস কী? এ সময় কি বিশেষ কোন দুআ পাঠ করা যায়? (সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচলিত একটি দুর্বল হাদিস সম্পর্কে পর্যালোচনা)।

প্রতিবারই গরমের মওসুমে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি হাদিস ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে দেখা যায়। কিন্তু হাদিস বিশারদগণের দৃষ্টিতে তা বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়।
নিম্নে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা পেশ করা হলো

প্রচলিত হাদিসটি নিম্নরূপ:

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“إذا كانَ يومٌ حارٌّ ألقى اللهُ تعالى سمعَه وبصرَه إلى أهلِ السماءِ وأهل الأرضِ فإذا قال العبدُ فقالَ الرَّجلُ لا إلَه إلَّا اللَّهُ ما أشدَّ حرَّ هذا اليومِ اللَّهمَّ أجرني من حرِّ جَهنَّمَ، قالَ اللَّهُ عزَّ وجلَّ لجَهنَّمَ إنَّ عبدًا من عبادي استجارني منك وإنِّي اشهدِك أنِّي قد أجرتُه، فإذا كانَ يومٌ شديدُ البردِ ألقى الله تعالى سمعَه وبصرَه إلى أهلِ السماء والأرض، فإذا قالَ العبدُ لا إلَه إلَّا اللَّهُ ما أشدَّ بردَ هذا اليومِ اللَّهمَّ أجرني من زمهريرِ جَهنَّمَ، قالَ اللَّهُ عزَّ وجلَّ لجَهنَّم، إنَّ عبدًا من عبادي استجارني من زمهريرِك وإنِّي أشهدُك أنِّي قد أجرتُه، فقالوا وما زمهريرُ جَهنَّمَ، قالَ بيتٌ يلقى فيهِ الكافرُ فيتميَّزُ من شدَّةِ بردِها بعضُه من بعضٍ”

“গরমের সময় যখন কঠিন গরম পড়ে তখন আল্লাহ জমিনবাসীর প্রতি কর্ণ ও দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। যখন কোনো বান্দা বলে যে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ! আজ কত গরম পড়েছে!! اللَّهمَّ أجرني من حرِّ جَهنَّمَ (আল্লাহুম্মা আজিরনী মিন হাররি জাহান্নাম) “হে আল্লাহ, তুমি আমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দাও।” তখন আল্লাহ জাহান্নামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমার বান্দাদের মধ্য থেকে এক বান্দা আমার নিকট তোমার শাস্তি থেকে আশ্রয় চেয়েছে। আমি তোমাকে সাক্ষী রাখছি যে, আমি তাকে মুক্তি দিলাম।

আবার যখন কঠিন ঠাণ্ডা পড়ে তখন আল্লাহ আল্লাহ জমিনবাসীর প্রতি স্বীয় কর্ণ ও দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। যখন কোন বান্দা বলে যে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ! আজ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছে!!
اللَّهمَّ أجرني من زمهريرِ جَهنَّمَ
(আল্লাহুম্মা আজিরনী মিন যামহারিরে জাহান্নাম) “হে আল্লাহ, তুমি আমাকে যামহারির (জাহান্নামের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা) থেকে মুক্তি দাও।” তখন আল্লাহ জাহান্নামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমার বান্দাদের মধ্য থেকে এক বান্দা আমার নিকট তোমার যামহারির থেকে আশ্রয় চেয়েছে। আমি তোমাকে সাক্ষী রাখছি যে, আমি তাকে মুক্তি দিলাম।

সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে রসুল, জাহান্নামের যামহারির কী?

তিনি বললেন, এটি এমনটি ঘর যেখানে কাফেরকে নিক্ষেপ করা হবে। ফলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তার এক অংশ অন্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।”
[বায়হাকী-আসমা ওয়াস সিফাত ১/৪৫৯, ইবনুস সুন্নি-আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লায়লা, আন নিহায়া ফিল ফিতানে ওয়াল মালাহিম, দ্বিতীয় খণ্ড, হাদিস নং ৩০৭]”

❑ উক্ত হাদিসটির মান:

বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে উক্ত হাদিসটি সহিহ নয়। যেমন:

– ইমাম সাখাবি বলেন, سنده ضعيف “এর সনদ দুর্বল।” [আল মাকাসিদুল হাসানা, ৭/১১৪]
– আজলুনিও এটিকে জইফ (দুর্বল) বলে আখ্যায়িত করেছে। [কাশফুল খাফা, ২/৪২৬]
– শাইখ আলবানি বলেন, এটি মুনকার বা মারাত্মক দুর্বল। [সিলসিলা যাইফা, হা/৬৪২৮]

❑ প্রচণ্ড গরম ও প্রচণ্ড ঠাণ্ডার উৎস কী?

হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী গ্রীষ্মের দাবদাহ এবং শীতের হিমশীতল ঠাণ্ডা জাহান্নামের নিঃশ্বাস থেকে উৎসারিত। যেমন: হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

اشْتَكَتِ النَّارُ إِلَى رَبِّهَا فَقَالَتْ يَا رَبِّ أَكَلَ بَعْضِي بَعْضًا ‏.‏ فَأَذِنَ لَهَا بِنَفَسَيْنِ نَفَسٍ فِي الشِّتَاءِ وَنَفَسٍ فِي الصَّيْفِ فَهُوَ أَشَدُّ مَا تَجِدُونَ مِنَ الْحَرِّ وَأَشَدُّ مَا تَجِدُونَ مِنَ الزَّمْهَرِيرِ

“জাহান্নামের আগুন তার রবের কাছে অভিযোগ করে বলল, হে রব, আমার একাংশ আরেকাংশকে খেয়ে ফেলল। তখন তিনি তাকে দুটি নিঃশ্বাস ফেলার অনুমতি দিলেন। একটি নিঃশ্বাস শীতকালে এবং আরেকটি নিঃশ্বাস গ্রীষ্মকালে। এ কারণেই তোমরা গ্রীষ্মের প্রখরতা ও ঠাণ্ডার তীব্রতা (যামহারির) অনুভব করে থাক।” [ সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৫/ মসজিদ ও সালাতের স্থান, পরিচ্ছেদ: ৩২. তীব্র গ্রীষ্মের সময় তাপ কমে আসলে জোহর আদায় করা মোস্তাহাব]

❑ প্রচণ্ড উত্তাপ বা ঠাণ্ডার সময় কি বিশেষ কোন দুআ পাঠ করা যায়?

সাধারণভাবে প্রচণ্ড গরম কিংবা আগুনের উত্তাপ দেখে জাহান্নামের আগুনের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করত: তা থেকে মুক্তি কামনা করে আল্লাহর কাছে দুআ করা শরিয়ত সম্মত। কেননা কুরআন ও হাদিসে জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে পর্যাপ্ত আয়াত-হাদিস রয়েছে। বিশেষভাবে জাহান্নামের আগুনের শাস্তি থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহ দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,

رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ ۖ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তিকে দূরে সরিয়ে দিন। কারণ এর শাস্তি তো নিশ্চিতভাবে ধ্বংসাত্মক। বসবাস ও অবস্থানস্থল হিসেবে তা কত নিকৃষ্ট জায়গা!” [সূরা ফুরকান: ৬৫-৬৬]

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ سَأَلَ اللَّهَ الْجَنَّةَ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ قَالَتْ الْجَنَّةُ اللَّهُمَّ أَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ وَمَنْ اسْتَجَارَ مِنْ النَّارِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ قَالَتْ النَّارُ اللَّهُمَّ أَجِرْهُ مِنْ النَّارِ

“যে ব্যক্তি তিনবার আল্লাহর নিকট জান্নাত প্রার্থনা করে, জান্নাত বলে, হে আল্লাহ, আপনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। আর যে ব্যক্তি তিনবার জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ চায়, জাহান্নাম বলে, হে আল্লাহ, আপনি তাকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ দিন।” [সুনানে নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৫১/ আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করা, পরিচ্ছেদ: ৫৫. জাহান্নামের আগুনের উত্তাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা-সহিহ]

সুতরাং কেউ যদি প্রচণ্ড গরমের সময় কিংবা আগুনের উত্তাপ দেখে জাহান্নামের কথা স্মরণ করে উপরোক্ত হাদিসে বর্ণিত দুআ দুটি পাঠ করে তাহলে তাতে কোনও সমস্যা নেই-যদিও হাদিসটি সনদগতভাবে দুর্বল। তবে হাদিসে তার যে ফজিলত বর্ণিত হয়েছে তা বিশ্বাস করা যাবে না। কারণ সনদগতভাবে বিশুদ্ধ সূত্রে তা প্রমাণিত নয়।

দুআ দুটি হলো:

● ১. প্রচণ্ড গরমের সময়:

اللَّهمَّ أجرني من حرِّ جَهنَّمَ
(আল্লাহুম্মা আজিরনী মিন হাররি জাহান্নাম)
“হে আল্লাহ, তুমি আমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দাও।”

● ২. প্রচণ্ড ঠাণ্ডার সময়:

اللَّهمَّ أجرني من زمهريرِ جَهنَّمَ
(আল্লাহুম্মা আজিরনি মিন যামহারিরে জাহান্নাম)
“হে আল্লাহ, তুমি আমাকে যামহারির (জাহান্নামের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা) থেকে মুক্তি দাও।”

জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষার জন্য এ দুআগুলো কেবল গরম বা ঠাণ্ডার মওসুম নয় বরং যে কোনও সময় পাঠ করা যায়।

উল্লেখ্য যে, উক্ত দুআগুলো গরম ও ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নয় বরং জাহান্নামের শাস্তি থেকে পরিত্রাণের দুআ।

➤ বি. দ্র. যামহারির শব্দের অর্থ: প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। যেমন: মহান আল্লাহ বলেন,

مُّتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ ۖ لَا يَرَوْنَ فِيهَا شَمْسًا وَلَا زَمْهَرِيرًا

“তারা (জান্নাতবাসীগণ) সেখানে সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে রৌদ্র ও শৈত্য অনুভব করবে না।” [সূরা দাহার: ১৩]

روي عن ابن مسعود قال: الزمهرير: لون من العذاب . وعن عكرمة ، قال: هو البرد الشديد

ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, যামহারির হল, এক প্রকার শাস্তি। ইকরিমা রাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তা হলো, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা।” [তাফসিরে ইবনে রজব, পৃষ্ঠা নং ৫৩১]
আল্লাহ আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। আমিন।▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Translate