প্রশ্ন: ইসলামে কুকুর পালনের বিধান কী? কুকুর কি প্রকৃতিগতভাবে নাপাক? তার নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়ার উপায় কী? ঘর পাহারার জন্য কুকুর রাখা কি বৈধ?
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর আমরা ইসলামী শরীয়তে কুকুর সংক্রান্ত বিধান কয়েকটি পয়েন্টে আলোচনা করব।
.
প্রথমত: কুকুর পালনের শারঈ হুকুম:.
পবিত্র শরীয়ত সাধারণভাবে মুসলিমের জন্য কুকুর পালন হারাম করেছে। যে ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করবে শরিয়ত তার নেক আমল থেকে এক কীরাত বা দুই কীরাত নেকী হ্রাস করার শাস্তি নির্ধারণ করেছে। তবে এর থেকে শিকারের জন্য এবং গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর প্রতিপালনকে ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য করেছে। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি গৃহপালিত পশুর রক্ষণাবেক্ষণ বা শিকার করার জন্য অথবা শস্য ক্ষেত পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে কুকুর পোষে প্রতিদিন তার নেক আমল থেকে এক কীরাত পরিমাণ কমতে থাকবে।”[হাদীসটি মুসলিম হা/১৫৭৫) বর্ণনা করেন] অপর বর্ননায়,আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি পালিত পশুর রক্ষাকারী কিংবা শিকারী কুকুর ছাড়া অন্য কুকুর পালে তার আমল থেকে প্রতিদিন দুই কীরাত পরিমাণ সওয়াব কমে যায়।”[হাদীসটি বুখারী হা/৫১৬৩; ও মুসলিম হা/১৫৭৪) বর্ণনা করেন] তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:“যে ঘরে কুকুর রয়েছে তাতে কোনো ফেরেশতা প্রবেশ করে না।”[হাদীসটি বুখারী (৩২২৫) ও মুসলিম (২১০৬) বর্ণনা করেন] ঘরে কুকুর থাকার কারণে রহমতের ফেরেশতারা তার সঙ্গী হবে না; এমনটি কি কোনো মুসলিম পছন্দ করতে পারে? শুধু তাই নয়,রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুকুরকে হত্যা করতে কঠোরভাবে নির্দেশ করেছেন (সহীহ মুসলিম, হা/১৫৭১; মিশকাত, হা/৪১০১)।খুব কালো এবং দুই চোখের উপর দু’টি চিহ্নিত বিশিষ্ট কুকুর হল শয়তান। তাকেও হত্যা করতে হবে (সহীহ মুসলিম, হা/১৫৭২; মিশকাত, হা/৪১০০)।
.
এক কীরাত ও দুই কীরাতের বর্ণনার মাঝে কিভাবে সামঞ্জস্য করা হবে:
.
প্রিয় পাঠক! উল্লেখিত একটি হাদীসে বলা হয়েছে, কুকুর প্রতিপালনের কারণে মানুষের নেকী থেকে এক ক্বীরাত কমে যায়। আবার অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, দুই ক্বীরাত নেকী কমে যায়। এ পার্থক্যের ব্যাখ্যা নিয়ে আলেমদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ বলেছেন—বাড়িতে কুকুর থাকলে ফেরেশতাগণ প্রবেশ করেন না; ফলে সে যে নেকী অর্জন করত, তা থেকে বঞ্চিত হয়, তাই নেকী কমে যায়। আর কেউ বলেছেন—কুকুর প্রতিপালনের কারণে পথচারী ও মানুষের যে ক্ষতি হয়, সেটিই নেকী হ্রাসের কারণ।আরেক দলের মতে—শিকার বা পাহারা দেওয়ার মতো বৈধ প্রয়োজন ছাড়া কুকুর প্রতিপালন নিষিদ্ধ; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই নিষেধ অমান্য করার শাস্তিস্বরূপ তার আমল থেকে নেকী ক্রমাগত কমতে থাকে।আরও এক ব্যাখ্যা হলো—নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে “এক ক্বীরাত” কমে যাওয়ার কথা বলেছেন, তখনকার সাহাবি তা যেমন শুনেছেন, তেমনি বর্ণনা করেছেন। পরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “দুই ক্বীরাত” কমে যাওয়ার কথা বলেছেন, আরেকজন সাহাবি সেটি শুনে বর্ণনা করেছেন।অন্য এক মত অনুযায়ী, দু’টি ভিন্ন পরিস্থিতিতে দু’টি ভিন্ন বিধান এসেছে। অর্থাৎ, যেসব কুকুরের মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি বেশি হয়, সেগুলো প্রতিপালনের কারণে দুই ক্বীরাত নেকী কমে যাবে; আর যেসব কুকুর দ্বারা ক্ষতি তুলনামূলক কম, সেগুলোর ক্ষেত্রে এক ক্বীরাত কমবে।আর কেউ কেউ বলেছেন—মদীনাহয় কুকুর প্রতিপালনের ক্ষেত্রে দুই ক্বীরাত নেকী কমবে, আর মদীনার বাইরে হলে এক ক্বীরাত কমবে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনু হাজার; ফাতহুল বারী; খণ্ড: ৫; হাদীস নং ২৩২২; শারহুন নাবাবী; ১০ম খন্ড; হা/ ১৫৭৪/৫০)
.
এক কীরাত ও দুই কীরাতের বর্ণনার মাঝে সামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে হাফেয আইনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:يجوز أنْ يكونا في نوعين مِن الكلاب، أحدُهما أشدُّ إيذاءً. وقيل: القيراطان في المدن والقرى، والقيراط في البوادي.وقيل: هما في زمانين، ذكر القيراط أولاً، ثم زاد التغليظ، فذكر القيراطين”এটি দুই শ্রেণীর কুকুরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে; দুই শ্রেণীর মধ্যে এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীর চেয়ে বেশি কষ্টদায়ক।কারো মতে: শহরাঞ্চলে ও গ্রামাঞ্চলে দুই কীরাত, আর মরু অঞ্চলে এক কীরাত।কারো কারো মতে: ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উদ্ধৃত। প্রথমে এক কীরাত উল্লেখ করা হয়েছিল। পরে তীব্রতা বৃদ্ধি করে দুই কীরাত উল্লেখ করেছেন।”(উমদাতুল কারী: (১২/১৫৮)
.
দ্বিতীয়ত: ঘর বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য কি কুকুর পালন করা জায়েয?.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুকুর পালন নিষিদ্ধ করার বিধান থেকে মাত্র তিনটি বিষয়কে ব্যতিক্রম করেছেন— শিকারের জন্য কুকুর, গবাদি পশু পাহারা দেওয়া কুকুর, এবং শস্যক্ষেত পাহারা দেওয়া কুকুর।কিছু আলেমের মতে, এই তিনটি ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো কারণে কুকুর রাখা বৈধ নয়, কারণ হাদীসগুলোতে কেবল এই তিন কারণই স্পষ্টভাবে ব্যতিক্রম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে,অপর কিছু আলেম মনে করেন, এই তিনটির ওপর ক্বিয়াস (তুলনা ও অনুরূপতা) করে অনুরূপ বা তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা থাকলে কুকুর পালন বৈধ হতে পারে— যেমন বাড়ি পাহারার উদ্দেশ্যে। তাঁদের যুক্তি হলো: যদি গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত রক্ষার জন্য কুকুর পালন বৈধ হয়, তবে বাড়ি ও সম্পদ রক্ষার মতো আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের জন্য তা অবশ্যই অধিকতর অনুমোদনযোগ্য হওয়া উচিত।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,اختلف في جواز اقتنائه لغير هذه الأمور الثلاثة كحفظ الدور والدروب، والراجح: جوازه قياساً على الثلاثة عملاً بالعلَّة المفهومة من الحديث وهي: الحاجة
এই তিনটি উদ্দেশ্যে ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে কুকুর পালন করার বৈধতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন: ঘর ও রাস্তা পাহারা দেয়া। প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত হচ্ছে হাদীসে উল্লিখিত তিনটি উদ্দেশ্যের কারণের উপর কিয়াস করে এটি জায়েয। সেই কারণটি হচ্ছে: ‘প্রয়োজন’।”(ইমাম নববী, শারহু সহীহ মুসলিম; খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ২৩৬)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
وعلى هذا فالمنـزل الذي يكون في وسط البلد لا حاجة أنْ يتخذ الكلب لحراسته، فيكون اقتناء الكلب لهذا الغرض في مثل هذه الحال محرماً لا يجوز وينتقص من أجور أصحابه كل يوم قيراط أو قيراطان، فعليهم أنْ يطردوا هذا الكلب وألا يقتنوه، وأما لو كان هذا البيت في البر خالياً ليس حوله أحدٌ فإنَّه يجوز أنْ يقتني الكلب لحراسة البيت ومَن فيه، وحراسةُ أهلِ البيت أبلغُ في الحفاظ مِن حراسة المواشي والحرث
“সুতরাং যে ঘর নগরের অভ্যন্তরে থাকে সেটি পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর পালনের প্রয়োজন নেই। এমন অবস্থায় এই উদ্দেশ্যে কুকুর পালন করা হারাম; নাজায়েয। এমন কুকুর প্রতিপালনকারীদের নেকী থেকে প্রতিদিন এক কীরাত বা দুই কীরাত করে কমবে। সুতরাং তাদের উচিত এই কুকুর পালন না করে তাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু. যদি ঘরটি এমন জনশূন্য স্থানে হয় যার আশপাশে মানুষজন নেই, তাহলে তার জন্য ঘর ও ঘরের মানুষের পাহারার জন্য কুকুর পালন করা জায়েয। গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত পাহারা দেওয়ার চেয়ে ঘরের লোকজন পাহারা দেওয়া বেশি দরকারী।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৪৬)
.
তৃতীয়ত: কুকুর কি সত্তাগতভাবে নাপাক?.
যদিও কেউ কেউ বলেন, কুকুর পালন নাপাকির অন্তর্ভুক্ত — তবে এই বক্তব্য শর্তহীনভাবে সঠিক নয়।কারণ কুকুরের সত্তা নাপাক নয়; বরং কুকুরের লালায় নাপাকি আছে; যখন সে কোনো পাত্র থেকে পান করে। সুতরাং যে ব্যক্তি কুকুর স্পর্শ করল কিংবা কুকুর তাকে স্পর্শ করল তার জন্য নিজেকে মাটি কিংবা পানি দিয়ে পবিত্র করা আবশ্যক নয়। যদি কুকুর কোনো পাত্র থেকে পান করে, আর কেউ ঐ পাত্রটি ব্যবহার করতে চায়; তাহলে সেই পাত্রের পানি ফেলে দিয়ে সাতবার পানি দিয়ে এবং অষ্টমবার মাটি দিয়ে ঐ পাত্র ধুয়ে ফেলতে হবে। আর যদি সেটি কুকুরের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয় তাহলে সেটি ধোয়া আবশ্যকীয় নয়। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:طُهُورُ إِنَاءِ أحَدِكُمْ إِذَا وَلَغَ فِيهِ الكَلْبُ أنْ يَغْسِلَهُ سَبْعَ مَرَّاتٍ أُولاَهُنَّ بِالتُّرَابِ“কুকুর কোন পাত্রে পান করলে সেই পাত্রকে পবিত্র করতে হলে সেটাকে সাতবার ধৌত করতে হবে। এর মধ্যে প্রথমবার মাটি দিয়ে (মাজতে হবে)।”(হাদীসটি মুসলিম হা/২৭৯) বর্ণনা করেন] মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে:إِذَا وَلَغَ الكُلْبُ في الإِنَاءِ فَاغْسِلُوهُ سَبْعَ مَرَّاتٍ، وَعَفِّرُوهُ الثَّامِنَةَ بِالتُّرَابِ”কুকুর যদি কোনো পাত্রে পান করে তাহলে সেটি সাতবার ধৌত করতে হবে। আর অষ্টমবার মাটি দিয়ে ধৌত করতে হবে।”(সহীহ মুসলিম হা/২৮০)
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ বলেন:وأما الكلب فقد تنازع العلماء فيه على ثلاثة أقوال: أحدها: أنَّه طاهرٌ حتى ريقه، وهذا هو مذهب مالك. والثانـي: نجس حتى شعره، وهذا هو مذهب الشافعي، وإحدى الروايتين عن أحمد. والثالث: شعره طاهـر، وريقه نجسٌ، وهذا هو مذهب أبي حنيفة وأحمد في إحدى الروايتين عنه.وهذا أصحُّ الأقوال، فإذا أصاب الثوبَ أو البدنَ رطوبةُ شعره لم ينجس بذلك “কুকুরের ব্যাপারে আলেমরা তিনটি মতে বিভক্ত। প্রথম মত হচ্ছে: কুকুর পবিত্র; এমনকি কুকুরের লালাও। এটি মালেকের মাযহাব। দ্বিতীয় মত হচ্ছে: এটি অপবিত্র; এমনকি পশমও। এটি শাফেয়ীর মাযহাব এবং ইমাম আহমদের বর্ণনাদ্বয়ের একটি। তৃতীয় মত হচ্ছে: এর পশম পবিত্র; লালা অপবিত্র। এটি ইমাম আবু হানীফা ও আহমাদের অন্য বর্ণনা। এই মতটি বিশুদ্ধতম। তাই যদি কোনো পোশাকে বা কাপড়ে কুকুরের পশমের সিক্ততা স্পর্শ করে তাতে সেটি অপবিত্র হয়ে যায় না।”(ইবনু তাইমিয়া; মাজমুউল ফাতাওয়া; খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ৫৩০)
.
অন্য স্থানে তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন:
وذلك لأنَّ الأصل في الأعيان الطهارة، فلا يجوز تنجيس شيء ولا تحريمه إلا بدليلٍ؛ كما قال تعالى: (وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلاَّ مَا اضْطُّرِرْتُم إِلَيْهِ) الأنعام/119، وقال تعالى: (وَمَا كَانَ اللهُ لِيُضِلَّ قَوْماً بَعْدَ إِذْ هَدَاهُم حَتَّى يُبَيِّنَ لَهُم مَا يَتَّقُونَ) التوبة/115… وإذا كان كذلك: فالنَّبيُّ صلى الله عليه وسلم قال: (طُهُورُ إِنَاءِ أحَدِكُمْ إِذَا وَلَغَ فِيهِ الكَلْبُ أنْ يَغْسِلَهُ سَبْعاً، أولاَهُنَّ بِالتُّرَابِ)، وفي الحديث الآخر: (إذَا وَلَغَ الكَلْبُ…) فأحاديثُه كلُّها ليس فيها إلا ذكر الولوغ لم يذكر سائر الأجزاء، فتنجيسها إنما هو بالقياس…وأيضاً: فالنَّبيُّ صلى الله عليه وسلم رخَّص في اقتناء كلب الصيد والماشية والحرث، ولا بد لمن اقتناه أنْ يصيبه رطوبةُ شعوره كما يصيبه رطوبةُ البغل والحمار وغير ذلك، فالقول بنجاسة شعورها والحال هذه من الحرج المرفوع عن الأمة “
“কেননা বস্তুর মূল অবস্থা হচ্ছে পবিত্রতা। সুতরাং কোনো দলীল ছাড়া কোনো কিছুকে অপবিত্র বা হারাম বলা জায়েয নেই। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেন:
“আল্লাহ তোমাদের জন্য যা যা হারাম করেছেন বিস্তারিতভাবে সেগুলোর বিবরণ দিয়েছেন; অবশ্য নিরুপায় হয়ে তোমরা কিছু খেতে বাধ্য হলে তার কথা আলাদা।”[সূরা আন’আম: ১১৯] তিনি আরো বলেন:“কোনো সম্প্রদায়কে পথ দেখানোর পর তারা কি কি পরিহার করবে তা স্পষ্টভাবে বলে না দেওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে বিপথগামী করেন না। আল্লাহ সবকিছু ভালোভাবে জানেন।”[সূরা তাওবাহ: ১১৫]… বিষয়টি যেহেতু এমন তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “কুকুর কোন পাত্রে পান করলে সেই পাত্রকে পবিত্র করতে হলে সেটাকে সাতবার ধৌত করতে হবে। এর মধ্যে প্রথমবার মাটি দিয়ে (মাজতে হবে)।” অন্য হাদীসে বলেছেন: “যদি কুকুর পান করে…” এ সংক্রান্ত সমস্ত হাদীসে কেবল ولوغ (জিহ্বা দিয়ে পান করা)-এর কথা বলা হয়েছে; বাকি কোনো অঙ্গের কথা উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং অন্যান্য অঙ্গকে নাপাক বলার ভিত্তি হচ্ছে কিয়াস।অধিকন্তু, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিকারের কুকুর এবং গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত পাহারার কুকুর প্রতিপালনে ছাড় দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এ ধরণের কুকুর পালে নিঃসন্দেহে তার শরীরে কুকুরের পশমের সিক্ততা লেগে যায়; যেমনিভাবে খচ্চর, গাধা বা অন্যান্য প্রাণীর সিক্ততা লাগে। তাই কুকুরের পশম নাপাক বলার মত এমন সংকীর্ণ পরিস্থিতি থেকে এ উম্মাহকে মুক্ত রাখা হয়েছে।”(মাজমুউল ফাতাওয়া; খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ২১৭, ২১৯)। তবে কেউ যদি হাতে সিক্ততা থাকা অবস্থায় কুকুরকে স্পর্শ করে অথবা কুকুর সিক্ত থাকা অবস্থায় সেটিকে স্পর্শ করে তাহলে সতর্কতা হিসেবে হাতকে সাতবার ধুয়ে ফেলবে। এর মধ্যে একবার মাটি দিয়ে ধৌত করবে।
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:وأما مس هذا الكلب فإن كان مسه بدون رطوبة فإنه لا ينجس اليد، وإن كان مسه برطوبة فإن هذا يوجب تنجيس اليد على رأي كثير من أهل العلم، ويجب غسل اليد بعده سبع مرات، إحداهن بالتراب”কুকুর স্পর্শ করার প্রসঙ্গে কথা হলো: যদি সিক্ততা ছাড়া স্পর্শ করে তাহলে হাত নাপাক হয় না। আর যদি সিক্তা থাকা অবস্থায় স্পর্শ করে তাহলে অনেক আলেমের মতে এতে করে হাত নাপাক হয়ে যায় এবং হাত সাতবার ধৌত করা ওয়াজিব হয়; এর মধ্যে একবার মাটি দিয়ে ধোয়া।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ২৪৬)
.
চতুর্থত: কুকুরের নাপাকি থেকে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি:.
ইসলামি শরিয়ত নাপাকি ধৌত করার ক্ষেত্রে সংখ্যাকে ধর্তব্যে আনেনি; কেবল কুকুরের কারণে নাপাক হওয়া জিনিস ব্যতীত। কুকুরের কারণে নাপাক হওয়া জিনিস সাতবার ধৌত করতে হবে;এক্ষেত্রে সাতবার কুকুরের নাপাকি ধুয়ে ফেলার পর একবার মাটি দিয়ে ঘষেমেজে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলা ওয়াজিব। মাটি থাকলে সেটি ব্যবহার করা ওয়াজিব; অন্য কিছু মাটির বিকল্প হবে না। আর যদি মাটি না পায় তাহলে পবিত্র করে এমন অন্যান্য বস্তু যেমন সাবান ব্যবহার করতে সমস্যা নেই।দলিল হলো:আবূ হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিতঃরসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ( طَهُورُ إِنَاءِ أَحَدِكُمْ إِذَا وَلَغَ فِيهِ الْكَلْبُ أَنْ يَغْسِلَهُ سَبْعَ مَرَّاتٍ ، أُولاهُنَّ بِالتُّرَابِ ) “তোমাদের কারো পাত্রে যখন কুকুরে মুখ লাগিয়ে পান করবে তখন (সে পাত্র পবিত্র করার পদ্ধতি হল) সাত বার তা ধুয়ে ফেলা। তবে প্রথমবার মাটি দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করতে হবে।”(সহিহ মুসলিম হা/৫৩৮;ই.ফা. ৫৪২) অপর বর্ননায়,ইবনুল মুগাফফাল (রা.) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন,একদা রসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুকুর হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে বললেন, তাদের কি হয়েছে যে, তারা কুকুরের পিছনে পড়লো? তারপর শিকারী কুকুর এবং বকরীর (পাহারা দেয়ার) কুকুর পোষার অনুমতি দেন এবং বলেন যে, যখন তোমাদের কারো পাত্রে কুকুর মুখ লাগিয়ে পান করবে তখন সাতবার ধুয়ে ফেলবে এবং অষ্টমবার মাটি দিয়ে মেজে ফেলবে।”(সহিহ মুসলিম হা/৫৪০;ই.ফা.৫৪৪) এই দুটি হাদীসে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কুকুরের নাপাকী (অপবিত্রতা) থেকে কীভাবে পবিত্রতা অর্জন করতে হয় তা ব্যাখ্যা করেছেন,আর তা হলো পাত্রটি সাতবার ধৌত করা, যার মধ্যে একবার হবে মাটি দিয়ে। আর উভয়টিই ফরয।”
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন:” لا يختلف المذهب أن نجاسة الكلب يجب غسلها سبعاً ، إحداهن بالتراب ، وهو قول الشافعي “)হাম্বলী) মাযহাবে এই বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, কুকুরের নাপাকী সাতবার ধৌত করা ওয়াজিব, যার মধ্যে একবার মাটি দিয়ে। আর এটিই ইমাম শাফেয়ীর (রহিমাহুল্লাহ)-এরও অভিমত।”(ইবনু কুদামাহ; আল-মুগনী; খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৭৩)
.
শাইখ ইবনে উছাইমিন (রহঃ) বলেন:إذا كانت النجاسة على غير الأرض وهي نجاسة كلب ، فإنه لا بد لتطهيرها من سبع غسلات إحداها بالتراب “যদি নাপাকি মাটি ছাড়া অন্য কিছুর উপরে থাকে এবং তা যদি কুকুরের নাপাকি হয়, তাহলে সাতবার ধুয়ে পবিত্র করতে হবে, যার মধ্যে একটি মাটি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ২৪৫)
.
আর মাটি দিয়ে ধোয়ার কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে:
.
এ বিষয়ে ইমাম ইবনু উসাইমিন (রাহিমাহুল্লাহ) ফাতহু জিল জালালি ওয়াল ইকরাম বি শারহি বুলুগিল মারাম
হা/১৪)-তে বলেন:মাটি দিয়ে ধোয়ার কাজটি কয়েকটি উপায়ে করা যেতে পারে:
1- أن يغسل بالماء ثم نذر التراب عليه
2- أن نذر التراب عليه ثم نتبعه الماء .
3- أن نخلط التراب بالماء ثم نغسل به الإناء “
(১)- প্রথমে পানি দিয়ে ধোয়া, তারপর তার উপর মাটি ছড়িয়ে দেওয়া।
(২)- প্রথমে তার ওপর মাটি ছিটিয়ে দেওয়া, তার পরে পানি দিয়ে ধোয়া।
3. পানি ও মাটি মিশিয়ে,তারপর সেই মিশ্রণ দিয়ে পাত্রটি ধোয়া।”(ইবনে উসাইমীন,”শারহু বুলুগুল মারাম” হাদীস নং ১৪)
.
পঞ্চমত: কুকুরকে চুম্বন করা কি জায়েয? .
গবেষণায় প্রমাণিত,কুকুরের মুখ স্পর্শ করা ও চুম্বন করা বহুবিধ রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।সুতরাং শরীয়তের বিধান লঙ্ঘন করে কুকুরকে চুম্বন করা অথবা কুকুরের পান করা পাত্র পবিত্র করার আগে তা থেকে পান করার ফলে মানুষ বহু রোগে আক্রান্ত হয়।এর মধ্যে রয়েছে: পাস্তুরেলোসিস রোগ। এটি হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ। এর জীবাণু সাধারণত পশু ও মানুষের শ্বাসতন্ত্রে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান থাকে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে এই জীবাণু শরীরকে আক্রান্ত করে রোগ সৃষ্টি করে।এর মধ্যে আরো রয়েছে: ইচিনোকোকোসিস রোগ। এটি পরজীবীঘটিত একটি রোগ যা মানুষ ও প্রাণীর অন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায় এবং সাধারণত লিভার, ফুসফুস, পেটের গহ্বর এবং শরীরের অন্যান্য অংশে প্রভাব ফেলে।এই রোগের কারণে ‘ইকাইন্কুস ক্রানিলোসিস’ নামক এক ধরনের ফিতাকৃমির উৎপত্তি হয়। এগুলো ছোট কীট, দৈর্ঘ্যে প্রায় ২ থেকে ৯ মিলিমিটার। তিনটি অংশ নিয়ে এগুলো গঠিত: মাথা, গলা ও দেহ। মাথায় চারটি শোষক অঙ্গ থাকে।এই শ্রেণীর প্রাপ্তবয়স্ক কৃমিগুলো তাদের বাহক প্রাণী যেমন- কুকুর, বিড়াল, শিয়াল ও নেকড়ের অন্ত্রে বাস করে।যখন কোন কুকুর প্রতিপালক কুকুরকে চুমু খায় বা তাদের পাত্র থেকে পানি পান করে তখন এই রোগ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।[দেখুন: ড. আলী ইসমাঈল উবাইদ আস-সিনাফী রচিত ‘আমরাদুল হাইওয়ানাতুল আলীফা আল্লাতি তুসীবুল ইনসান’ গ্রন্থ; গৃহীত’ ইসলাম সাওয়াল জবাব ফাতওয়া নং-৬৯৮৪০)
.
পরিশেষে, আমরা আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর রাসূলের ভালোবাসা দান করেন, আমাদের কাছে তাঁকে সন্তানসন্ততি, পিতামাতা, পরিবার-পরিজন ও নিজেদের জানের চেয়ে বেশি প্রিয় করে দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানী।
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।