Saturday, November 8, 2025

জ্ঞান শেখার আগে আদব বা শিষ্টাচার শেখার গুরুত্ব

 ইসলামের দৃষ্টিতে আদব তথা শিষ্টাচার, ভদ্রতা এবং সুন্দর আচার-আচরণ বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষের জ্ঞানের বহর কম থাকলেও যদি তার মধ্যে থাকে, বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, মানবতাবোধ, পরোপকার এবং সুন্দর আচার-আচরণ তাহলে তার মধ্যে বেশি কল্যাণ রয়েছে—ওই ব্যক্তির চেয়ে, যার উচ্চ শিক্ষার সনদ এবং বিশাল জ্ঞানের বহর আছে কিন্তু সে বেয়াদব ও চরিত্রহীন। এইজন্যেই বলা হয়,“দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।” প্রকৃতপক্ষে যে শিক্ষা মানুষকে সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা, ক্ষমা, ভদ্রতা ও ন্যায়পরায়নতা ইত্যাদি মানবিক গুণে অলংকৃত করে না তা কোন শিক্ষা নয়। যে শিক্ষা মানুষকে মানুষের প্রতি মানুষের সম্মানবোধ, মানুষের অধিকার রক্ষা এবং মানবতা শেখায় না তা কোন শিক্ষা নয়। যে শিক্ষা মানুষকে অহংকারী, অসভ্য ও বেয়াদব করে তোলে তা হল, শিক্ষার নামে কুশিক্ষা।

তাই জ্ঞান শেখার চেয়ে ভালো ব্যবহার ও চরিত্র গঠনকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নিম্নে জ্ঞানের পাহাড় জমানোর চেয়ে আদব-কায়দা এবং ভদ্রতা ও চরিত্র শেখার প্রতি আমাদের সালাফ বা পূর্বসূরিগণ কতটা গুরুত্ব দিতেন তার কিছু চিত্র তুলে ধরা হল:
✪ ১. ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. বলেন:
طلبت الأدب ثلاثين سنةً, وطلبت العلم عشرين سنةً, وكانوا يطلبون الأدب قبل العلم
“আমি ত্রিশ বছর ধরে আদব শিখেছি, আর বিশ বছর জ্ঞান (ইলম) শিখেছি। সালাফগণ তথা পূর্বসূরিগণ জ্ঞানের আগে আদব শিখতেন।”
[ইবনু জাযারী, গায়াতুন নিহায়া, ১/৪৪৬]
✪ ২. তিনি আরও বলেন:
“نحن إلى قليل من الأدب أحوج منا إلى كثير من العلم
“আমাদের বেশি জ্ঞানের চেয়ে অল্প আদবের বেশি প্রয়োজন।”
[ইবনুল কায়্যিম, মাদারিজুস সালিকীন, ২/৩৫৬]
✪ ৩. খতিব আল বাগদাদী তাঁর ‘আল জামে’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, ইবনু সিরিন বলেছেন:
“সালাফগণ যেমন জ্ঞান শিখতেন, তেমনি সুন্দর চালচলন ও উত্তম চরিত্র শিখতেন। ইবনে সিরিন একজনকে পাঠিয়েছিলেন যেন সে বিশিষ্ট তাবেয়ী কাসেম (মুহাম্মদ বিন আবু বকর সিদ্দিক রা.) এর চালচলন ও অবস্থা দেখে আসে।”
[খতিব আল বাগদাদি, আল জামে, ১/৭৯]
✪ ৪. ইবরাহিম ইবনে হাবিব ইবনুশ শহিদ বলেন, তাঁর পিতা তাঁকে বলেছিলেন:
يا بنيَّ، ايتِ الفقهاءَ والعلماء، وتعلم منهم، وخُذْ مِن أدبهم وأخلاقهم وهَدْيِهم؛ فإن ذاك أحبُّ إليَّ لك من كثير من الحديث
“হে আমার সন্তান, তুমি ফকিহ ও উলামাদের কাছে যাও, তাদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করো এবং তাদের আদব, নৈতিকতা ও চালচলন থেকে শিক্ষা নাও। কারণ আমার কাছে, এটি তোমার জন্য প্রচুর পরিমাণ হাদিস শেখার চেয়েও বেশি পছন্দনীয়।”
[খতিব আল বাগদাদী, আল জামে, ১/৮০]
✪ ৫. ইমাম ইবনু মুফলিহ আল মাকদিসি রাহ. এই মহান আদবের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ইলমের অলঙ্কার পরার আগে আদবের অলঙ্কার পরিধান করা উচিত।
এবং প্রত্যেক মুমিনের উচিত, সকল অবস্থায় এই আদবগুলো (শিষ্টাচার/নিয়মগুলো) মেনে চলা/অনুসরণ করা।
✪ ৬. উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন,
تأدبوا ثم تعلموا
“তোমরা প্রথমে আদব শিখো, তারপর জ্ঞান (ইলম) অর্জন করো।”
✪ ৭. আবু আব্দুল্লাহ আল বালখি বলেছেন:
أدبُ العلم أكثرُ من العلم
“জ্ঞানের আদব জ্ঞানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
✪ ৮. আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন:
إذا وُصِف لي رجلٌ له علم الأولين والآخِرين لا أتأسَّف على فَوْت لقائه، وإذا سمعت رجلاً له أدب القسِّ أتمنى لقاءَه وأتأسَّف على فَوته
“যদি আমাকে এমন ব্যক্তির কথা বলা হয়, যার পূর্বাপর সকল জ্ঞান আছে, তার সাথে দেখা না হলেও আমি দুঃখ করি না। কিন্তু যদি শুনি কারো উত্তম আদব আছে, তাহলে তার দেখা পেতে ইচ্ছা করি এবং সাক্ষাৎ না হলে আফসোস করি।”
[আল-মাকদিসী, আল-আদাবুশ শারইয়্যাহ, ৪/২০৭]
✪ ৯. আলি ইবনে আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সূরা তাহরিম-এর নিমোক্ত ৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা করো”) অর্থাৎ তাদেরকে আদব (শিষ্টাচার) শিক্ষা দাও এবং তাদেরকে জ্ঞান (ইলম) শিক্ষা দাও।”
[আল-মাকদিসী, আল-আদাবুশ শারইয়্যাহ, ৪/২০৮-২০৯]
তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত, জ্ঞানের চেয়ে সন্তানদের আদব ও নৈতিকতার ওপর বেশি জোর দেওয়া, যাতে এমন একটি প্রজন্ম তৈরি হয় যারা জ্ঞান অর্জনের আগেই জ্ঞানী ও জ্ঞানের মূল্য বুঝতে পারে।
মূল উৎস: alukah
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদ আরব।

তাসবিহ দানা ও কাউন্টার মেশিন ইত্যাদি দ্বারা তাসবিহ গণনা করা কি বিদআত

 প্রশ্ন: পুঁথির মালা, কাউন্টার মেশিন, নুড়ি পাথর, খেজুর বা তেঁতুলের বীজ ইত্যাদি দ্বারা তাসবিহ গণনা করা কি বিদআত?

উত্তর: তাসবিহ দানা বা পুঁথির মালা দ্বারা তাসবিহ গণনা করাকে সরাসরি বিদআত বলা ঠিক নয়। তবে এভাবে বলা যায় যে, আঙ্গুলের কর দ্বারা গণনা ভালো। বরং এটাই সুন্নত। কিন্তু প্রয়োজনবোধে তাসবিহ দানা, কাউন্টার মেশিন কিংবা নুড়ি পাথর, খেজুর বা তেঁতুলের বীজ ইত্যাদি দ্বারা তাসবিহ গণনা করা জায়েজ আছে। যেমন: বয়োবৃদ্ধ বা অসুস্থ হওয়ার কারণে আঙ্গুল দ্বারা তাসবি গণনা করা কষ্ট হয় বা সংখ্যা মনে রাখতে না পারে ইত্যাদি। তবে শর্ত হল, মনকে রিয়া বা লোক দেখানো মনোভাব থেকে দূরে রাখবে। এ ব্যাপারে সাহাবিদের আমল পাওয়া যায়। অন্যথায় তাসবিহ দানা বা কাউন্টার মেশিন ইত্যাদি ব্যবহার না করাই ভালো। এতে রিয়া বা লোক দেখানোর মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
❖❖ এ বিষয়ে কয়েকটি বিশ্ব বরেণ্য কয়েকজন আলেমের ফতোয়া:
❑ ১. সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা শাইখ আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ.
প্রশ্ন: পূঁথির মালা দ্বারা তাসবিহ পাঠ করার হুকুম কী? এটা কি বিদআত?
উত্তর:
الراجح أنه لا حرج في ذلك؛ لأنه ورد عن بعض الصحابيات وعن بعض السلف التسبيح بالحصى، وبالنوى، والعقد لا بأس، لكن الأصابع أفضل، كونه يسبح بأصابعه كما كان النبي ﷺ يسبح بأصابعه، هذا هو الأفضل، هذا هو السنة بالأصابع.
وإن سبح بالسبحة، أو بالحصى، أو بالنواة بعض الأحيان في بيته؛ فلا بأس؛ لكن في المساجد عند الناس الأفضل بالأصابع كما كان النبي يفعل، عليه الصلاة والسلام.
“অগ্রগণ্য মতানুসারে এতে কোনও দোষ নেই। কারণ কিছু মহিলা সাহাবি এবং কিছু সালাফ থেকে পাথর, খেজুরের আঁটি এবং সুতায় গিঁটের তাসবিহ পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে।
সুতরাং এতে কোনও সমস্যা নেই। তবে আঙ্গুল উত্তম। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন আঙ্গুল দিয়ে তসবিহ গণনা করতেন, তেমনি আঙ্গুল দিয়ে তসবিহ গণনা করা। এটাই সবচেয়ে উত্তম-এটাই সুন্নাহ। আর যদি কেউ মাঝে মাঝে নিজের ঘরে পুঁথির মালা, পাথর বা খেজুরের আঁটি দিয়ে তসবিহ গণনা করে তাহলে কোনও দোষ নেই। কিন্তু মসজিদে লোকদের মাঝে আঙ্গুল দিয়ে তসবিহ গণনা করাই উত্তম—যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন।”
❑ ২. আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ.
বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ শাইখুল ইসলাম আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রহ. বলেন,
التسبيح بالمسبحة لا نقول إنه بدعة لأن التسبيح بالمسبحة لا يقصد به االتعبد إنما يقصد به ضبط العدد فهو وسيلةٌ وليس بغاية فعلى هذا لا نقول إنه بدعة ولكننا نقول إن التسبيح بالأصابع أفضل لأن هذا هو الذي أرشد إليه رسول الله صلى الله عليه وسلم في قوله (اعقدن بالأنامل فإنهن مستنطقات) وهذا يدل على أن الأفضل العقد بالأنامل لأنها سوف تشهد يوم القيامة بالعمل الذي حركت فيه والتسبيح بالمسبحة فيه شيء.
أولاً أنه خلاف ما أرشد إليه النبي صلى الله عليه وسلم.
وثانياً أنه قد يجر إلى الرياء كما يشاهد بعض الناس الذين يتقلدون مسابح في أعناقهم في المسبحة ألف خرزة كأنما يقول للناس انظروا فإننا نسبح ألف مرة فهو يحمل على الرياء.
ثالثاً أن من يسبح بالمسبحة تجد قلبه غافلاً يفرغ هذا الخرز وعيناه تدوران يميناً وشمالاً أويتجول يميناً وشمالاً فاستعمال المسبحة أقرب للغفلة من استعمال الأصابع ولهذا ينبغي للإنسان أن يعقد التسبيح بأصابعه والأفضل أن يكون ذلك باليد اليمنى وإن عقد باليدين جميعاً فلا بأس.
“তাসবিহ দানা বা পুঁথির মালা দিয়ে তাসবিহ গণনা করাকে আমরা বিদআত বলব না। কারণ তাসবি দানা দিয়ে তাসবিহের উদ্দেশ্য ইবাদত নয় বরং এটি শুধুমাত্র সংখ্যা গণনার একটি উপায়।
এটি একটি মাধ্যম মাত্র; মূল লক্ষ্য নয়। তাই এটিকে বিদআত বলা যায় না। কিন্তু আমরা বলব যে, আঙ্গুল দিয়ে তাসবিহ গণনা করা অধিক উত্তম। কারণ এটিই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশিত পথ। তিনি বলেছেন: “আঙ্গুল দিয়ে গণনা করো। কারণ আঙ্গুলগুলো সাক্ষ্যদানকারী।” এটা প্রমাণ করে যে, আঙ্গুল দিয়ে গণনা করা উত্তম। কারণ কিয়ামতের দিন এই আঙ্গুলগুলো সাক্ষ্য দেবে যে, তাদের মাধ্যমে কী কাজ করা হয়েছে।
কিন্তু তাসবি দানা ব্যবহারে কিছু সমস্যা রয়েছে। যেমন:
◆ প্রথমত: এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুতি।
◆ দ্বিতীয়ত: এটি রিয়া বা লোক দেখানোর দিকে নিয়ে যেতে পারে।
আমরা দেখি, কিছু লোক গলায় হাজার দানার মতো বড় তাসবিহ দানা ঝুলিয়ে রাখে, যেন লোকদের বলছে: “দেখো, আমি হাজার বার তাসবিহ পাঠ করি!” এটি রিয়া বা লোক দেখানো মনোভাবের সৃষ্টি করে।
◆ তৃতীয়ত: যে ব্যক্তি তাসবিহ দানা দিয়ে তাসবিহ পড়ে কিন্তু তার অন্তর উদাসীন থাকে। এ অবস্থায় সে এদিক-সেদিক তাকায় আর ঘোরাঘুরি করে।
তাই আঙ্গুল ব্যবহারের থেকে তাসবিহ দানা ব্যবহার বেশি উদাসীনতার দিকে নিয়ে যায়।
অতএব, মানুষের উচিত আঙ্গুল দিয়ে তাসবিহ গণনা করা‌। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম হল, ডান হাত দিয়ে তাসবিহ গণনা করা। যদি দুই হাতেই করে তাতেও কোনও সমস্যা নেই।”
[উৎস: কিতাবুল আজকার/ ফাতাওয়া নূর আলাদ দারব, ২৪র্থ খণ্ড/২য় পৃষ্ঠা]
❑ ৩. সৌদি আরবের বর্তমান প্রধান মুফতি আল্লামা শাইখ সালেহ আল ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ):
প্রশ্ন: আল্লাহর জিকির স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাসবিহ দানা (পুঁথির মালা) ব্যবহার করার হুকুম কী?
উত্তর: যদি কোনও ব্যক্তি এই বিশ্বাসে তাসবিহ দানা ব্যবহার করে যে, এটি ব্যবহার করায় কোনও ফজিলত রয়েছে এবং এটি আল্লাহ তাআলার জিকিরের অন্যতম মাধ্যম, তাহলে এটি বিদ’আত।
কিন্তু যদি কেউ এটিকে মুবাহ (বৈধ) কাজ হিসেবে ব্যবহার করে অথবা যে সংখ্যা গণনা করা তার জন্য জরুরি, তা গণনা করার জন্য ব্যবহার করে তাহলে এটি বৈধ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু এটিকে যদি দ্বীন (ধর্ম) বা নৈকট্যের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাহলে এটি নব-আবিষ্কৃত বিদ’আত বলে গণ্য হবে।
যখন কোনও ব্যক্তি তাসবিহ করতে চায়, তখন তার উচিত হল, তা আঙুল গুনে (আঙুলের গিঁট বা কর গুনে) আল্লাহর তাসবিহ গণনা করা। এটাই করা উচিত।
কিন্তু তাসবিহকে এই বিশ্বাসে গ্রহণ করা যে, এটির মধ্যে কোনও ফজিলত রয়েছে, যেমনটা কিছু সুফি এবং তাদের অনুসারীরা বিশ্বাস করে—যার ফলে আপনি তাদের অনেককে বিশাল বিশাল পুঁথির দানা বহন করতে এবং গলায় ঝুলিয়ে রাখতে দেখবেন—এটি এমন একটি ভিত্তিহীন বিদ’আত । এটি রিয়া (লোক দেখানো)-এর অন্তর্ভুক্তও হতে পারে। আল্লাহই ভালো জানেন।
❑ শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেছেন:
عد التسبيح ‏بالأصابع سنة‎…‎‏ وأما عده بالنوى والحصى ونحو ذلك فحسن، وكان من ‏الصحابة رضي الله عنهم من يفعل ذلك، وقد رأى النبي صلى الله عليه وسلم ‏أم المؤمنين تسبح بالحصى، وأقرها على ذلك. وروي أن أبا هريرة كان يسبح ‏به. وأما التسبيح بما يجعل في نظام الخرز ونحوه، فمن الناس من كرهه، ومنهم ‏من لم يكرهه، وإذا أحسنت فيه النية فهو حسن غير مكروه، وأما اتخاذه من ‏غير حاجة، أو إظهاره للناس مثل: تعليقه في العنق، أو جعله كالسوار في اليد، ‏أو نحو ذلك، فهذا إما رياء للناس، أو مظنة المراءاة ومشابهة المرائين من غير ‏حاجة، والأول محرم، والثاني أقل أحواله الكراهة‎…‎‏) انتهى من مجموع الفتوى ( ‏‏22/506
“আঙ্গুলের মাধ্যমে তাসবিহ গণনা করা সুন্নত…। আর বীজ, পাথর ইত্যাদি দিয়ে তাসবিহ গণনা করা ভালো।
সাহাবায়ে কেরামের রা. মধ্যে কেউ কেউ এটি করতেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মুল মুমিনিনকে পাথর দিয়ে তাসবিহ গণনা করতে দেখেছিলেন এবং তিনি তাকে সে ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন।
আরও বর্ণিত আছে যে, আবু হুরায়রা (রা.) পাথর দিয়ে তাসবিহ গণনা করতেন। আর দানা/পুঁতি গেঁথে তৈরি করা জিনিস (যেমন: বর্তমানের তাসবিহ) দিয়ে তাসবিহ গণনার বিষয়ে কথা হল, কিছু মানুষ এটিকে অপছন্দ করেছেন, আবার কিছু মানুষ এটিকে অপছন্দ করেননি। তাদের মতে যদি এতে সৎ নিয়ত থাকে তবে তা ভালো; অপছন্দনীয় নয়। কিন্তু এটি প্রয়োজন ছাড়া গ্রহণ করা অথবা মানুষের কাছে প্রকাশ করা, যেমন: গলায় ঝুলিয়ে রাখা বা হাতে চুড়ির মতো পরে থাকা অথবা এ জাতীয় কিছু তাহলে এটি হয় মানুষকে দেখানোর জন্য (রিয়া), অথবা রিয়ার সুযোগ তৈরি করা এবং প্রয়োজন ছাড়া রিয়াকারীর সাথে সাদৃশ্য তৈরি করা। প্রথমটি (রিয়া) হারাম আর দ্বিতীয়টি (রিয়ার সুযোগ তৈরি করা) অন্ততপক্ষে মকরুহ (অপছন্দনীয়)।” [মাজমু’উল ফাতাওয়া ২২/৫০৬ থেকে]
তাসবিহ গণনার জন্য আঙ্গুল ব্যবহার করাই সর্বোত্তম সুন্নাহ হলেও, প্রয়োজন হলে (যেমন—অসুস্থতা বা সংখ্যা মনে রাখতে না পারা) পুঁথির মালা, কাউন্টার মেশিন বা নুড়ি পাথর, খেজুর বা তেঁতুল বীজ ইত্যাদি ব্যবহার করা জায়েজ আছে। তবে রিয়া (লোক দেখানো মনোভাব) থেকে মুক্ত থাকতে হবে এবং সাধারণ অবস্থায় এটি ব্যবহার না করাই উত্তম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

তথাকথিত প্রেমের টানে বাংলাদেশে ছুটে আসার গল্প পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়াবহ প্রতারণা ও আন্তর্জাতিক চক্রের ফাঁদ

 তথাকথিত প্রেমের টানে বাংলাদেশে ছুটে আসার গল্প: পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়াবহ প্রতারণা ও আন্তর্জাতিক চক্রের ফাঁদ।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রায়শই খবরের শিরোনামে দেখি, “বিদেশ থেকে প্রেমের টানে ছুটে এলেন…।” আপাতদৃষ্টিতে চমকপ্রদ মনে হলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তথাকথিত ‘প্রেমের গল্প’-এর অধিকাংশই নিছক প্রতারণা, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক চক্রের সূক্ষ্ম পরিকল্পনার ফসল। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই সম্পর্কগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে আপনার বা আপনার পরিবারের জন্য মারাত্মক বিপদ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চক্রগুলো সাধারণত নিম্নোক্ত ভয়াবহ উদ্দেশ্য নিয়ে সক্রিয় থাকে:
✪ ১. ধর্মীয় মিশন ও স্থায়ী বসবাসের কৌশল:
বিদেশী মিশনারি সংস্থা বা ব্যক্তিরা কূটনীতির মাধ্যমে সরাসরি ভিসা বা দীর্ঘমেয়াদী বসবাসের অনুমতি পেতে ব্যর্থ হলে, তারা এই ‘প্রেমের কৌশল’ ব্যবহার করে।
তারা স্থানীয় কোনো ব্যক্তির (ছেলে বা মেয়ে) সাথে তথাকথিত প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে এবং এদেশে এসে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
তারপর একবার বসবাস নিশ্চিত হলে, তারা ধীরে ধীরে তাদের ধর্ম প্রচারের আসল মিশন শুরু করে। তারা সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে, এমনকি পুরো পরিবারকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করে। এই মিশনে অনেক ক্ষেত্রে বিদেশী খৃষ্টান মিশনারী ও এনজিওগুলোর যোগসাজশ থাকে।
✪ ২. বিদেশে নারী পাচার ও অবৈধ কাজে বাধ্য করা:
অনেক ক্ষেত্রে তথাকথিত এই প্রেম ব্যবহৃত হয় দেশ থেকে নারীদের পাচারের মাধ্যম হিসেবে।
বিদেশী প্রতারকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদ পাতে এবং উন্নত জীবন, চাকরি বা ভালো ভবিষ্যতের প্রলোভন দেখিয়ে দেশ থেকে নারীদের বিদেশে নিয়ে যায়।
বিদেশে নেওয়ার পর তাদেরকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয় অথবা নানা ধরনের অবৈধ ও অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হয়, যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।
✪ ৩. সাময়িক উপভোগ ও প্রতারণামূলক বিবাহ:
অনেক বিদেশী কেবল সাময়িক মনোরঞ্জন বা উপভোগের জন্য এদেশে আসে।
তথাকথিত প্রেম এবং দ্রুত বিয়ের মাধ্যমে তারা এদেশে ‘জামাই আদরে’ কিছুদিনের জন্য বিলাসী জীবনযাপন করে।
অতঃপর কিছুদিন সেই নারীকে উপভোগ করার পর, তারা কোনো ধরনের যোগাযোগ না রেখেই হঠাৎ নিজ দেশে ফিরে যায়। ফলে স্থানীয় মেয়েটি চরম হতাশা ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
✪ ৪. অর্থ আত্মসাৎ ও উন্নত জীবনের লোভ:
অনেক সময় এই চক্রগুলো প্রেমের নাটক করে বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়।
প্রেমিক/প্রেমিকা বা তাদের পরিবারের সদস্যদের বিদেশে নিয়ে যাওয়া, সেখানে উন্নত জীবন, চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদির মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তারা বিশ্বাস অর্জন করে।
অতঃপর বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হওয়ার পর তারা বিশাল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যায় এবং ভুক্তভোগীরা সর্বস্বান্ত হন।
❑ ইসলামি দৃষ্টিকোণ ও বিশেষজ্ঞদের চূড়ান্ত সতর্কতা:
বিশেষজ্ঞগণ তাই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিদেশীদের সাথে এই ধরনের সম্পর্ক গড়ার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ এর পেছনে কেবল প্রতারণাই নয়, জীবনের বড় ধরনের ঝুঁকিও থাকে।
মনে রাখতে হবে, ইসলামে নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহের বন্ধন ছাড়া তথাকথিত প্রেম, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে হারাম। প্রেমের নামে জিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া ইসলামে এক ভয়ানক কবিরা গুনাহ (গুরুতর পাপ), যা পার্থিব ও পরকালে কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তাই কোনো প্রকার প্রলোভন বা আবেগের বশে না গিয়ে, অপরিচিত বিদেশী বা আন্তর্জাতিক চক্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক থাকুন এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলুন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

টাক মাথা সম্পর্কে সঠিক ইসলামি দৃষ্টিভ্ঙ্গী

 টাক পড়া একটি স্বাভাবিক বিষয় যা কিছু পুরুষের ক্ষেত্রে বয়স বাড়ার কারণে অথবা কোনো রোগ বা অন্য কোনো কারণে ঘটে থাকে। এটি তাদের মর্যাদাকে একটুও কমিয়ে দেয় না।

বরং আরববাসীরা এটিকে নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ হিসেবে গণ্য করতেন। তাদের একজন কবি বলেছেন:
بنى لنا المجد آباء لنا سلفوا صلع الرؤوس وسيما السادة الصلع
“আমাদের টাক মাথার পূর্বপুরুষেরা আমাদের জন্য গৌরব ও মহিমা প্রতিষ্ঠা করেছেন। টাক পড়া ছিল সম্মানিত নেতাদের নিদর্শন।”
অনেক বিশিষ্ট সাহাবা ও তাবেয়িও ছিলেন টাক মাথার অধিকারী। অথচ তাঁরা ছিলেন মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং ইসলামের ইমাম। ইতিহাস গ্রন্থ, জীবনী গ্রন্থ এবং জীবনচরিতসমূহে যে সকল সাহবির মাথায় টাক ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:
১. উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)। তাঁর টাক খুব বেশি ছিল।
২. তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ ( রা.)।
৩. উসমান ইবনে আফফান (রা.)।
৪. আলি ইবনে আবি তালিব (রা.)।
৫. আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.)।
৬. মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা (রা.)।
৭. আল আহনাফ ইবনে কায়েস (রা.) এ ছাড়াও সাহাবিদের মধ্যে অনেকেই।
অনুরূপভাবে বিশিষ্ট তাবেয়িদের মধ্যেও অনেকে ছিলেন টাক মাথার অধিকারী। তাবে তাবেয়ি এবং অন্যান্য হেদায়েতের ইমামগণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
যেমন: ইমাম মালিক ইবনে আনাস রাহ.। তাঁর জীবনীর বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী, বিশাল মস্তকবিশিষ্ট, টাক মাথার অধিকারী। তার মাথা ও দাড়িতে সাদা চুল ছিল। এমন আরও অনেকেই ছিলেন।
তাঁরা টাককে কোনো ত্রুটি বা দোষ হিসেবে গণ্য করতেন না। এমনকি টাক বলে কাউকে ডাকাও অপমান বা হেয় করা মনে করা হতো না। অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও বড় মাপের তাবেয়ি, যির ইবনে হুবাইশ রাহ. বলেন: আমি প্রখ্যাত সাহাবি হুযাইফা রাহ.-এর কাছে এলাম। তিনি বললেন: “হে টাক মাথা, তুমি কার লোক?” আমি বললাম: “আমি যির ইবনে হুবাইশ।” সহিহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে সারজিস রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: আমি টাক মাথার ব্যক্তিকে অর্থাৎ উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-কে হাজরে আসওয়োদে চুম্বন করতে দেখেছি। তখন তিনি বলছিলেন: “আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে চুম্বন করছি যদিও আমি জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র-যা কোনো ক্ষতিও করতে পারে না-কোনো উপকারও করতে পারে না। যদি আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম তবে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।” [সূত্র: ইসলাম ওয়েব]
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
অনুবাদ: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

আল্লাহর দিকে দাওয়াতের উদ্দেশ্যে নারীর ঘর থেকে বের হওয়ার বিধান

 প্রশ্ন: মুসলিম নারীর জন্য কি আল্লাহর দিকে দাওয়াতের (ইসলাম প্রচারের) উদ্দেশ্যে বেশি বেশি ঘর থেকে বের হওয়া বৈধ?

উত্তর: এটি একটি সৎকর্ম বা নেকির কাজ। দাওয়াতের জন্য নারীর ঘর থেকে বের হওয়া একটি ভালো কাজ। তবে যে আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ
“আর তোমরা তোমাদের ঘরের মধ্যে অবস্থান করো।” [সূরা আল আহযাব: ৩৩]
সেখানে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, যখন কোনও প্রয়োজন না থাকে তখনই ঘরে থাকা উচিত। কিন্তু যদি প্রয়োজন থাকে তবে তা ভিন্ন কথা। যেমন: অন্য নারীদের মাঝে ওয়াজ-নসিহত করার জন্য বের হওয়া। অথবা: কোনও (শরিয়ত সম্মত) কল্যাণের স্বার্থে পুরুষদের সাথে সালাতে অংশ নেওয়ার জন্য বের হওয়া। (যেমন: ঈদের সালাত)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে সাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীগণ পর্দা ও আব্রু রক্ষা করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মসজিদে তাঁর সাথে সালাত আদায় করতেন।
অনুরূপভাবে নিম্নোক্ত ভালো কাজগুলোর জন্য বের হওয়াও বৈধ:
✪ পর্দা রক্ষা করে পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করতে যাওয়া।
✪ অসুস্থ ব্যক্তিকে (অন্য মহিলা বা যে পুরুষকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখা-সাক্ষাত করা জায়েজ) দেখতে যাওয়া।
✪ বিপদগ্রস্থ মানুষদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে।
✪ আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া কিংবা এই ধরনের অন্যান্য সৎ উদ্দেশ্য।
তবে শর্ত হল: অবশ্যই আল্লাহ তাআলা যেভাবে পর্দা রক্ষার আদেশ দিয়েছেন তা মেনে চলতে হবে। রূপসজ্জা ও প্রদর্শন করা যাবে না এবং ফিতনার কারণ হতে পারে এমন কোনও কাজ করা যাবে না।
পুরুষদের যেমন দাওয়াতের প্রয়োজন, তেমনি নারীদেরও দাওয়াতের প্রয়োজন। সবাই দাওয়াতের মুখাপেক্ষী।
আর যদি (দাওয়াত দেওয়ার সময়) নারীরা পুরুষদেরকেও ওয়াজ-নসিহত করেন তাতেও কোনও ক্ষতি নেই। পূর্বে বলা হয়েছে যে, নারীর কণ্ঠস্বর সতর (আওরাহ) নয়। আল্লাহর দিকে দাওয়াতের ক্ষেত্রে বা কল্যাণের পথে ডাকার ক্ষেত্রে এবং অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে নারীর কণ্ঠস্বর সতর নয়। সতর হল, কেবল কোমলতা পূর্ণ নরম কণ্ঠস্বর এবং মোহনীয়তা পূর্ণ ভাবভঙ্গী যেমনটি পূর্বে বলা হয়েছে (যা ফিতনার কারণ হতে পারে)। মূল কথা, শরিয়ত সম্মত প্রয়োজন এবং পূর্ণ পর্দা পালনের শর্তে নারীর দাওয়াতের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়া বৈধ ও উত্তম কাজ।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
ফতোয়া প্রদানে: সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি বিশ্ববরেণ্য আলেম আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রহ.
অনুবাদ: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদনি।

ইসলামে কুকুর পালন সম্পর্কে বিস্তারিত

 প্রশ্ন: ইসলামে কুকুর পালনের বিধান কী? কুকুর কি প্রকৃতিগতভাবে নাপাক? তার নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়ার উপায় কী? ঘর পাহারার জন্য কুকুর রাখা কি বৈধ?

▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর আমরা ইসলামী শরীয়তে কুকুর সংক্রান্ত বিধান কয়েকটি পয়েন্টে আলোচনা করব।
.
▪️প্রথমত: কুকুর পালনের শারঈ হুকুম:
.
পবিত্র শরীয়ত সাধারণভাবে মুসলিমের জন্য কুকুর পালন হারাম করেছে। যে ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করবে শরিয়ত তার নেক আমল থেকে এক কীরাত বা দুই কীরাত নেকী হ্রাস করার শাস্তি নির্ধারণ করেছে। তবে এর থেকে শিকারের জন্য এবং গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর প্রতিপালনকে ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য করেছে। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি গৃহপালিত পশুর রক্ষণাবেক্ষণ বা শিকার করার জন্য অথবা শস্য ক্ষেত পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে কুকুর পোষে প্রতিদিন তার নেক আমল থেকে এক কীরাত পরিমাণ কমতে থাকবে।”[হাদীসটি মুসলিম হা/১৫৭৫) বর্ণনা করেন] অপর বর্ননায়,আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি পালিত পশুর রক্ষাকারী কিংবা শিকারী কুকুর ছাড়া অন্য কুকুর পালে তার আমল থেকে প্রতিদিন দুই কীরাত পরিমাণ সওয়াব কমে যায়।”[হাদীসটি বুখারী হা/৫১৬৩; ও মুসলিম হা/১৫৭৪) বর্ণনা করেন] তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:“যে ঘরে কুকুর রয়েছে তাতে কোনো ফেরেশতা প্রবেশ করে না।”[হাদীসটি বুখারী (৩২২৫) ও মুসলিম (২১০৬) বর্ণনা করেন] ঘরে কুকুর থাকার কারণে রহমতের ফেরেশতারা তার সঙ্গী হবে না; এমনটি কি কোনো মুসলিম পছন্দ করতে পারে? শুধু তাই নয়,রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুকুরকে হত্যা করতে কঠোরভাবে নির্দেশ করেছেন (সহীহ মুসলিম, হা/১৫৭১; মিশকাত, হা/৪১০১)।খুব কালো এবং দুই চোখের উপর দু’টি চিহ্নিত বিশিষ্ট কুকুর হল শয়তান। তাকেও হত্যা করতে হবে (সহীহ মুসলিম, হা/১৫৭২; মিশকাত, হা/৪১০০)।
.
এক কীরাত ও দুই কীরাতের বর্ণনার মাঝে কিভাবে সামঞ্জস্য করা হবে:
.
প্রিয় পাঠক! উল্লেখিত একটি হাদীসে বলা হয়েছে, কুকুর প্রতিপালনের কারণে মানুষের নেকী থেকে এক ক্বীরাত কমে যায়। আবার অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, দুই ক্বীরাত নেকী কমে যায়। এ পার্থক্যের ব্যাখ্যা নিয়ে আলেমদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ বলেছেন—বাড়িতে কুকুর থাকলে ফেরেশতাগণ প্রবেশ করেন না; ফলে সে যে নেকী অর্জন করত, তা থেকে বঞ্চিত হয়, তাই নেকী কমে যায়। আর কেউ বলেছেন—কুকুর প্রতিপালনের কারণে পথচারী ও মানুষের যে ক্ষতি হয়, সেটিই নেকী হ্রাসের কারণ।আরেক দলের মতে—শিকার বা পাহারা দেওয়ার মতো বৈধ প্রয়োজন ছাড়া কুকুর প্রতিপালন নিষিদ্ধ; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই নিষেধ অমান্য করার শাস্তিস্বরূপ তার আমল থেকে নেকী ক্রমাগত কমতে থাকে।আরও এক ব্যাখ্যা হলো—নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে “এক ক্বীরাত” কমে যাওয়ার কথা বলেছেন, তখনকার সাহাবি তা যেমন শুনেছেন, তেমনি বর্ণনা করেছেন। পরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “দুই ক্বীরাত” কমে যাওয়ার কথা বলেছেন, আরেকজন সাহাবি সেটি শুনে বর্ণনা করেছেন।অন্য এক মত অনুযায়ী, দু’টি ভিন্ন পরিস্থিতিতে দু’টি ভিন্ন বিধান এসেছে। অর্থাৎ, যেসব কুকুরের মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি বেশি হয়, সেগুলো প্রতিপালনের কারণে দুই ক্বীরাত নেকী কমে যাবে; আর যেসব কুকুর দ্বারা ক্ষতি তুলনামূলক কম, সেগুলোর ক্ষেত্রে এক ক্বীরাত কমবে।আর কেউ কেউ বলেছেন—মদীনাহয় কুকুর প্রতিপালনের ক্ষেত্রে দুই ক্বীরাত নেকী কমবে, আর মদীনার বাইরে হলে এক ক্বীরাত কমবে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনু হাজার; ফাতহুল বারী; খণ্ড: ৫; হাদীস নং ২৩২২; শারহুন নাবাবী; ১০ম খন্ড; হা/ ১৫৭৪/৫০)
.
এক কীরাত ও দুই কীরাতের বর্ণনার মাঝে সামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে হাফেয আইনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:يجوز أنْ يكونا في نوعين مِن الكلاب، أحدُهما أشدُّ إيذاءً. وقيل: القيراطان في المدن والقرى، والقيراط في البوادي.وقيل: هما في زمانين، ذكر القيراط أولاً، ثم زاد التغليظ، فذكر القيراطين”এটি দুই শ্রেণীর কুকুরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে; দুই শ্রেণীর মধ্যে এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীর চেয়ে বেশি কষ্টদায়ক।কারো মতে: শহরাঞ্চলে ও গ্রামাঞ্চলে দুই কীরাত, আর মরু অঞ্চলে এক কীরাত।কারো কারো মতে: ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উদ্ধৃত। প্রথমে এক কীরাত উল্লেখ করা হয়েছিল। পরে তীব্রতা বৃদ্ধি করে দুই কীরাত উল্লেখ করেছেন।”(উমদাতুল কারী: (১২/১৫৮)
.
▪️দ্বিতীয়ত: ঘর বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য কি কুকুর পালন করা জায়েয?
.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুকুর পালন নিষিদ্ধ করার বিধান থেকে মাত্র তিনটি বিষয়কে ব্যতিক্রম করেছেন— শিকারের জন্য কুকুর, গবাদি পশু পাহারা দেওয়া কুকুর, এবং শস্যক্ষেত পাহারা দেওয়া কুকুর।কিছু আলেমের মতে, এই তিনটি ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো কারণে কুকুর রাখা বৈধ নয়, কারণ হাদীসগুলোতে কেবল এই তিন কারণই স্পষ্টভাবে ব্যতিক্রম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে,অপর কিছু আলেম মনে করেন, এই তিনটির ওপর ক্বিয়াস (তুলনা ও অনুরূপতা) করে অনুরূপ বা তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা থাকলে কুকুর পালন বৈধ হতে পারে— যেমন বাড়ি পাহারার উদ্দেশ্যে। তাঁদের যুক্তি হলো: যদি গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত রক্ষার জন্য কুকুর পালন বৈধ হয়, তবে বাড়ি ও সম্পদ রক্ষার মতো আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের জন্য তা অবশ্যই অধিকতর অনুমোদনযোগ্য হওয়া উচিত।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,اختلف في جواز اقتنائه لغير هذه الأمور الثلاثة كحفظ الدور والدروب، والراجح: جوازه قياساً على الثلاثة عملاً بالعلَّة المفهومة من الحديث وهي: الحاجة
এই তিনটি উদ্দেশ্যে ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে কুকুর পালন করার বৈধতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন: ঘর ও রাস্তা পাহারা দেয়া। প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত হচ্ছে হাদীসে উল্লিখিত তিনটি উদ্দেশ্যের কারণের উপর কিয়াস করে এটি জায়েয। সেই কারণটি হচ্ছে: ‘প্রয়োজন’।”(ইমাম নববী, শারহু সহীহ মুসলিম; খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ২৩৬)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
وعلى هذا فالمنـزل الذي يكون في وسط البلد لا حاجة أنْ يتخذ الكلب لحراسته، فيكون اقتناء الكلب لهذا الغرض في مثل هذه الحال محرماً لا يجوز وينتقص من أجور أصحابه كل يوم قيراط أو قيراطان، فعليهم أنْ يطردوا هذا الكلب وألا يقتنوه، وأما لو كان هذا البيت في البر خالياً ليس حوله أحدٌ فإنَّه يجوز أنْ يقتني الكلب لحراسة البيت ومَن فيه، وحراسةُ أهلِ البيت أبلغُ في الحفاظ مِن حراسة المواشي والحرث
“সুতরাং যে ঘর নগরের অভ্যন্তরে থাকে সেটি পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর পালনের প্রয়োজন নেই। এমন অবস্থায় এই উদ্দেশ্যে কুকুর পালন করা হারাম; নাজায়েয। এমন কুকুর প্রতিপালনকারীদের নেকী থেকে প্রতিদিন এক কীরাত বা দুই কীরাত করে কমবে। সুতরাং তাদের উচিত এই কুকুর পালন না করে তাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু. যদি ঘরটি এমন জনশূন্য স্থানে হয় যার আশপাশে মানুষজন নেই, তাহলে তার জন্য ঘর ও ঘরের মানুষের পাহারার জন্য কুকুর পালন করা জায়েয। গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত পাহারা দেওয়ার চেয়ে ঘরের লোকজন পাহারা দেওয়া বেশি দরকারী।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৪৬)
.
▪️তৃতীয়ত: কুকুর কি সত্তাগতভাবে নাপাক?
.
যদিও কেউ কেউ বলেন, কুকুর পালন নাপাকির অন্তর্ভুক্ত — তবে এই বক্তব্য শর্তহীনভাবে সঠিক নয়।কারণ কুকুরের সত্তা নাপাক নয়; বরং কুকুরের লালায় নাপাকি আছে; যখন সে কোনো পাত্র থেকে পান করে। সুতরাং যে ব্যক্তি কুকুর স্পর্শ করল কিংবা কুকুর তাকে স্পর্শ করল তার জন্য নিজেকে মাটি কিংবা পানি দিয়ে পবিত্র করা আবশ্যক নয়। যদি কুকুর কোনো পাত্র থেকে পান করে, আর কেউ ঐ পাত্রটি ব্যবহার করতে চায়; তাহলে সেই পাত্রের পানি ফেলে দিয়ে সাতবার পানি দিয়ে এবং অষ্টমবার মাটি দিয়ে ঐ পাত্র ধুয়ে ফেলতে হবে। আর যদি সেটি কুকুরের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয় তাহলে সেটি ধোয়া আবশ্যকীয় নয়। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:طُهُورُ إِنَاءِ أحَدِكُمْ إِذَا وَلَغَ فِيهِ الكَلْبُ أنْ يَغْسِلَهُ سَبْعَ مَرَّاتٍ أُولاَهُنَّ بِالتُّرَابِ“কুকুর কোন পাত্রে পান করলে সেই পাত্রকে পবিত্র করতে হলে সেটাকে সাতবার ধৌত করতে হবে। এর মধ্যে প্রথমবার মাটি দিয়ে (মাজতে হবে)।”(হাদীসটি মুসলিম হা/২৭৯) বর্ণনা করেন] মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে:إِذَا وَلَغَ الكُلْبُ في الإِنَاءِ فَاغْسِلُوهُ سَبْعَ مَرَّاتٍ، وَعَفِّرُوهُ الثَّامِنَةَ بِالتُّرَابِ”কুকুর যদি কোনো পাত্রে পান করে তাহলে সেটি সাতবার ধৌত করতে হবে। আর অষ্টমবার মাটি দিয়ে ধৌত করতে হবে।”(সহীহ মুসলিম হা/২৮০)
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ বলেন:وأما الكلب فقد تنازع العلماء فيه على ثلاثة أقوال: أحدها: أنَّه طاهرٌ حتى ريقه، وهذا هو مذهب مالك. والثانـي: نجس حتى شعره، وهذا هو مذهب الشافعي، وإحدى الروايتين عن أحمد. والثالث: شعره طاهـر، وريقه نجسٌ، وهذا هو مذهب أبي حنيفة وأحمد في إحدى الروايتين عنه.وهذا أصحُّ الأقوال، فإذا أصاب الثوبَ أو البدنَ رطوبةُ شعره لم ينجس بذلك “কুকুরের ব্যাপারে আলেমরা তিনটি মতে বিভক্ত। প্রথম মত হচ্ছে: কুকুর পবিত্র; এমনকি কুকুরের লালাও। এটি মালেকের মাযহাব। দ্বিতীয় মত হচ্ছে: এটি অপবিত্র; এমনকি পশমও। এটি শাফেয়ীর মাযহাব এবং ইমাম আহমদের বর্ণনাদ্বয়ের একটি। তৃতীয় মত হচ্ছে: এর পশম পবিত্র; লালা অপবিত্র। এটি ইমাম আবু হানীফা ও আহমাদের অন্য বর্ণনা। এই মতটি বিশুদ্ধতম। তাই যদি কোনো পোশাকে বা কাপড়ে কুকুরের পশমের সিক্ততা স্পর্শ করে তাতে সেটি অপবিত্র হয়ে যায় না।”(ইবনু তাইমিয়া; মাজমুউল ফাতাওয়া; খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ৫৩০)
.
অন্য স্থানে তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন:
وذلك لأنَّ الأصل في الأعيان الطهارة، فلا يجوز تنجيس شيء ولا تحريمه إلا بدليلٍ؛ كما قال تعالى: (وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلاَّ مَا اضْطُّرِرْتُم إِلَيْهِ) الأنعام/119، وقال تعالى: (وَمَا كَانَ اللهُ لِيُضِلَّ قَوْماً بَعْدَ إِذْ هَدَاهُم حَتَّى يُبَيِّنَ لَهُم مَا يَتَّقُونَ) التوبة/115… وإذا كان كذلك: فالنَّبيُّ صلى الله عليه وسلم قال: (طُهُورُ إِنَاءِ أحَدِكُمْ إِذَا وَلَغَ فِيهِ الكَلْبُ أنْ يَغْسِلَهُ سَبْعاً، أولاَهُنَّ بِالتُّرَابِ)، وفي الحديث الآخر: (إذَا وَلَغَ الكَلْبُ…) فأحاديثُه كلُّها ليس فيها إلا ذكر الولوغ لم يذكر سائر الأجزاء، فتنجيسها إنما هو بالقياس…وأيضاً: فالنَّبيُّ صلى الله عليه وسلم رخَّص في اقتناء كلب الصيد والماشية والحرث، ولا بد لمن اقتناه أنْ يصيبه رطوبةُ شعوره كما يصيبه رطوبةُ البغل والحمار وغير ذلك، فالقول بنجاسة شعورها والحال هذه من الحرج المرفوع عن الأمة “
“কেননা বস্তুর মূল অবস্থা হচ্ছে পবিত্রতা। সুতরাং কোনো দলীল ছাড়া কোনো কিছুকে অপবিত্র বা হারাম বলা জায়েয নেই। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেন:
“আল্লাহ তোমাদের জন্য যা যা হারাম করেছেন বিস্তারিতভাবে সেগুলোর বিবরণ দিয়েছেন; অবশ্য নিরুপায় হয়ে তোমরা কিছু খেতে বাধ্য হলে তার কথা আলাদা।”[সূরা আন’আম: ১১৯] তিনি আরো বলেন:“কোনো সম্প্রদায়কে পথ দেখানোর পর তারা কি কি পরিহার করবে তা স্পষ্টভাবে বলে না দেওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে বিপথগামী করেন না। আল্লাহ সবকিছু ভালোভাবে জানেন।”[সূরা তাওবাহ: ১১৫]… বিষয়টি যেহেতু এমন তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “কুকুর কোন পাত্রে পান করলে সেই পাত্রকে পবিত্র করতে হলে সেটাকে সাতবার ধৌত করতে হবে। এর মধ্যে প্রথমবার মাটি দিয়ে (মাজতে হবে)।” অন্য হাদীসে বলেছেন: “যদি কুকুর পান করে…” এ সংক্রান্ত সমস্ত হাদীসে কেবল ولوغ (জিহ্বা দিয়ে পান করা)-এর কথা বলা হয়েছে; বাকি কোনো অঙ্গের কথা উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং অন্যান্য অঙ্গকে নাপাক বলার ভিত্তি হচ্ছে কিয়াস।অধিকন্তু, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিকারের কুকুর এবং গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত পাহারার কুকুর প্রতিপালনে ছাড় দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এ ধরণের কুকুর পালে নিঃসন্দেহে তার শরীরে কুকুরের পশমের সিক্ততা লেগে যায়; যেমনিভাবে খচ্চর, গাধা বা অন্যান্য প্রাণীর সিক্ততা লাগে। তাই কুকুরের পশম নাপাক বলার মত এমন সংকীর্ণ পরিস্থিতি থেকে এ উম্মাহকে মুক্ত রাখা হয়েছে।”(মাজমুউল ফাতাওয়া; খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ২১৭, ২১৯)। তবে কেউ যদি হাতে সিক্ততা থাকা অবস্থায় কুকুরকে স্পর্শ করে অথবা কুকুর সিক্ত থাকা অবস্থায় সেটিকে স্পর্শ করে তাহলে সতর্কতা হিসেবে হাতকে সাতবার ধুয়ে ফেলবে। এর মধ্যে একবার মাটি দিয়ে ধৌত করবে।
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:وأما مس هذا الكلب فإن كان مسه بدون رطوبة فإنه لا ينجس اليد، وإن كان مسه برطوبة فإن هذا يوجب تنجيس اليد على رأي كثير من أهل العلم، ويجب غسل اليد بعده سبع مرات، إحداهن بالتراب”কুকুর স্পর্শ করার প্রসঙ্গে কথা হলো: যদি সিক্ততা ছাড়া স্পর্শ করে তাহলে হাত নাপাক হয় না। আর যদি সিক্তা থাকা অবস্থায় স্পর্শ করে তাহলে অনেক আলেমের মতে এতে করে হাত নাপাক হয়ে যায় এবং হাত সাতবার ধৌত করা ওয়াজিব হয়; এর মধ্যে একবার মাটি দিয়ে ধোয়া।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ২৪৬)
.
▪️চতুর্থত: কুকুরের নাপাকি থেকে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি:
.
ইসলামি শরিয়ত নাপাকি ধৌত করার ক্ষেত্রে সংখ্যাকে ধর্তব্যে আনেনি; কেবল কুকুরের কারণে নাপাক হওয়া জিনিস ব্যতীত। কুকুরের কারণে নাপাক হওয়া জিনিস সাতবার ধৌত করতে হবে;এক্ষেত্রে সাতবার কুকুরের নাপাকি ধুয়ে ফেলার পর একবার মাটি দিয়ে ঘষেমেজে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলা ওয়াজিব। মাটি থাকলে সেটি ব্যবহার করা ওয়াজিব; অন্য কিছু মাটির বিকল্প হবে না। আর যদি মাটি না পায় তাহলে পবিত্র করে এমন অন্যান্য বস্তু যেমন সাবান ব্যবহার করতে সমস্যা নেই।দলিল হলো:আবূ হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিতঃরসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ( طَهُورُ إِنَاءِ أَحَدِكُمْ إِذَا وَلَغَ فِيهِ الْكَلْبُ أَنْ يَغْسِلَهُ سَبْعَ مَرَّاتٍ ، أُولاهُنَّ بِالتُّرَابِ ) “তোমাদের কারো পাত্রে যখন কুকুরে মুখ লাগিয়ে পান করবে তখন (সে পাত্র পবিত্র করার পদ্ধতি হল) সাত বার তা ধুয়ে ফেলা। তবে প্রথমবার মাটি দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করতে হবে।”(সহিহ মুসলিম হা/৫৩৮;ই.ফা. ৫৪২) অপর বর্ননায়,ইবনুল মুগাফফাল (রা.) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন,একদা রসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুকুর হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে বললেন, তাদের কি হয়েছে যে, তারা কুকুরের পিছনে পড়লো? তারপর শিকারী কুকুর এবং বকরীর (পাহারা দেয়ার) কুকুর পোষার অনুমতি দেন এবং বলেন যে, যখন তোমাদের কারো পাত্রে কুকুর মুখ লাগিয়ে পান করবে তখন সাতবার ধুয়ে ফেলবে এবং অষ্টমবার মাটি দিয়ে মেজে ফেলবে।”(সহিহ মুসলিম হা/৫৪০;ই.ফা.৫৪৪) এই দুটি হাদীসে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কুকুরের নাপাকী (অপবিত্রতা) থেকে কীভাবে পবিত্রতা অর্জন করতে হয় তা ব্যাখ্যা করেছেন,আর তা হলো পাত্রটি সাতবার ধৌত করা, যার মধ্যে একবার হবে মাটি দিয়ে। আর উভয়টিই ফরয।”
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন:” لا يختلف المذهب أن نجاسة الكلب يجب غسلها سبعاً ، إحداهن بالتراب ، وهو قول الشافعي “)হাম্বলী) মাযহাবে এই বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, কুকুরের নাপাকী সাতবার ধৌত করা ওয়াজিব, যার মধ্যে একবার মাটি দিয়ে। আর এটিই ইমাম শাফেয়ীর (রহিমাহুল্লাহ)-এরও অভিমত।”(ইবনু কুদামাহ; আল-মুগনী; খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৭৩)
.
শাইখ ইবনে উছাইমিন (রহঃ) বলেন:إذا كانت النجاسة على غير الأرض وهي نجاسة كلب ، فإنه لا بد لتطهيرها من سبع غسلات إحداها بالتراب “যদি নাপাকি মাটি ছাড়া অন্য কিছুর উপরে থাকে এবং তা যদি কুকুরের নাপাকি হয়, তাহলে সাতবার ধুয়ে পবিত্র করতে হবে, যার মধ্যে একটি মাটি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ২৪৫)
.
আর মাটি দিয়ে ধোয়ার কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে:
.
এ বিষয়ে ইমাম ইবনু উসাইমিন (রাহিমাহুল্লাহ) ফাতহু জিল জালালি ওয়াল ইকরাম বি শারহি বুলুগিল মারাম
হা/১৪)-তে বলেন:মাটি দিয়ে ধোয়ার কাজটি কয়েকটি উপায়ে করা যেতে পারে:
1- أن يغسل بالماء ثم نذر التراب عليه
2- أن نذر التراب عليه ثم نتبعه الماء .
3- أن نخلط التراب بالماء ثم نغسل به الإناء “
(১)- প্রথমে পানি দিয়ে ধোয়া, তারপর তার উপর মাটি ছড়িয়ে দেওয়া।
(২)- প্রথমে তার ওপর মাটি ছিটিয়ে দেওয়া, তার পরে পানি দিয়ে ধোয়া।
3. পানি ও মাটি মিশিয়ে,তারপর সেই মিশ্রণ দিয়ে পাত্রটি ধোয়া।”(ইবনে উসাইমীন,”শারহু বুলুগুল মারাম” হাদীস নং ১৪)
.
 ▪️পঞ্চমত: কুকুরকে চুম্বন করা কি জায়েয?
.
গবেষণায় প্রমাণিত,কুকুরের মুখ স্পর্শ করা ও চুম্বন করা বহুবিধ রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।সুতরাং শরীয়তের বিধান লঙ্ঘন করে কুকুরকে চুম্বন করা অথবা কুকুরের পান করা পাত্র পবিত্র করার আগে তা থেকে পান করার ফলে মানুষ বহু রোগে আক্রান্ত হয়।এর মধ্যে রয়েছে: পাস্তুরেলোসিস রোগ। এটি হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ। এর জীবাণু সাধারণত পশু ও মানুষের শ্বাসতন্ত্রে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান থাকে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে এই জীবাণু শরীরকে আক্রান্ত করে রোগ সৃষ্টি করে।এর মধ্যে আরো রয়েছে: ইচিনোকোকোসিস রোগ। এটি পরজীবীঘটিত একটি রোগ যা মানুষ ও প্রাণীর অন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায় এবং সাধারণত লিভার, ফুসফুস, পেটের গহ্বর এবং শরীরের অন্যান্য অংশে প্রভাব ফেলে।এই রোগের কারণে ‘ইকাইন্‌কুস ক্রানিলোসিস’ নামক এক ধরনের ফিতাকৃমির উৎপত্তি হয়। এগুলো ছোট কীট, দৈর্ঘ্যে প্রায় ২ থেকে ৯ মিলিমিটার। তিনটি অংশ নিয়ে এগুলো গঠিত: মাথা, গলা ও দেহ। মাথায় চারটি শোষক অঙ্গ থাকে।এই শ্রেণীর প্রাপ্তবয়স্ক কৃমিগুলো তাদের বাহক প্রাণী যেমন- কুকুর, বিড়াল, শিয়াল ও নেকড়ের অন্ত্রে বাস করে।যখন কোন কুকুর প্রতিপালক কুকুরকে চুমু খায় বা তাদের পাত্র থেকে পানি পান করে তখন এই রোগ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।[দেখুন: ড. আলী ইসমাঈল উবাইদ আস-সিনাফী রচিত ‘আমরাদুল হাইওয়ানাতুল আলীফা আল্লাতি তুসীবুল ইনসান’ গ্রন্থ; গৃহীত’ ইসলাম সাওয়াল জবাব ফাতওয়া নং-৬৯৮৪০)
.
পরিশেষে, আমরা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর রাসূলের ভালোবাসা দান করেন, আমাদের কাছে তাঁকে সন্তানসন্ততি, পিতামাতা, পরিবার-পরিজন ও নিজেদের জানের চেয়ে বেশি প্রিয় করে দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানী।
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

হজ্জ করার সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে

 ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর হজ্জ একটি উত্তম ও মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত। এটি ইসলামের পঞ্চখুঁটির অন্যতম। যে ইসলাম দিয়ে আল্লাহ তাআলা নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছেন। যে খুঁটিগুলো ব্যতীত কোন ব্যক্তির দ্বীনদারি পূর্ণতা পেতে পারে না। যে কোন ইবাদত দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হতে হলে ও ইবাদত কবুল হতে হলে দুইটি বিষয় আবশ্যক: (১).আল্লাহর জন্য মুখলিস বা একনিষ্ঠ হওয়া। অর্থাৎ সে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের কল্যাণকে উদ্দেশ্য করা; প্রদর্শনেচ্ছা, প্রচারপ্রিয়তার উদ্দেশ্যেনা করা অথবা অন্য কোন দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে না-করা। (২).কথা ও কাজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ জানা ছাড়া তাঁকে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি হজ্ব পালনের মাধ্যমে অথবা অন্যকোন ইবাদত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চায় তার কর্তব্য হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ জেনে নেয়া। নিম্নে আমরা সুন্নাহ মোতাবেক হজ্ব আদায় করার পদ্ধতি সংক্ষেপে তুলে ধরব।

.
▪️হজ্জের রুকন, ওয়াজিব ও সুন্নতসমূহ:
.
হজ্জের রুকন ৪টি, ওয়াজিব ৭টি এবং রুকন ও ওয়াজিব ছাড়া বাকী আমলগুলো সুন্নত। রুকন, ওয়াজিব ও সুন্নতের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- রুকন পালন করা ব্যতীত হজ্জ সহিহ হবে না। ওয়াজিব বাদ পড়লেও হজ্জ সহিহ হবে; তবে জমহুর আলেমের মতানুযায়ী দম (ছাগল জবাই) দিতে হবে। আর সুন্নত বাদ পড়লে কোন কিছু করতে হয় না।বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ:
.
হজ্জের রুকন ৪টি: ইহরাম করা; ইহরাম হচ্ছে- হজ্জের কার্যাবলী শুরু করার নিয়ত করা। দলিল হচ্ছে- “সকল আমল নিয়্যত অনুযায়ী হয়ে থাকে।”[আল-হাদিস] আরাফাতে অবস্থান করা; দলিল হচ্ছে- “হজ্জ মানে- আরাফা”[আল-হাদিস] তাওয়াফে যিয়ারা (এটাকে তওয়াফে ইফাযাও বলা হয়) আদায় করা; দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী: “এবং তাওয়াফ করে প্রাচীন গৃহের”[সূরা হাজ্জ : ২৯] সায়ী করা; দলিল হচ্ছে- “তোমরা সায়ী কর, কেননা নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর সায়ী করা ফরয করে দিয়েছেন”[মুসনাদে আহমাদ]”(ইমাম বুহুতি; আর-রওদুল মুরবি; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৮৫)
.
হজ্জের ওয়াজিব ৭টি: (১) যার যার মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা। অর্থাৎ মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা ওয়াজিব; আর ইহরাম বাঁধা হচ্ছে- রুকন। (২).যে ব্যক্তি দিনের বেলায় আরাফার ময়দানে অবস্থান নিয়েছে তার জন্য সূর্য ডোবা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করা। (৩).যাদের যমযম পানি পান করানো কিংবা হাদির পশু চরানোর দায়িত্ব নেই তাদের জন্য তাশরিকের দিনগুলোতে মীনার ময়দানে রাত্রি যাপন করা। (৪).যারা মধ্যরাতের পূর্বে মুযদালিফাতে পৌঁছেছেন তাদের জন্য মধ্যরাতের পর পর্যন্ত মুযদালিফাতে রাত্রিযাপন করা; যমযম পানি পান করানো ও হাদির পশু চরানোর দায়িত্বে যারা রয়েছেন তারা ছাড়া।[কোন কোন আলেম মুযদালিফাতে রাত্রি যাপন করাকে হজ্জের রুকন গণ্য করেন; যা ছাড়া হজ্জ শুদ্ধ হবে না। ইবনুল কাইয়্যেম তাঁর ‘যাদুল মাআ’দ’ গ্রন্থে (২/২৩৩) এ মতটির প্রতি ঝুঁকেছেন]। (৫).ক্রমধারা রক্ষা করে জমরাতগুলোতে কংকর নিক্ষেপ করা। (৬).মাথা ন্যাড়া করা কিংবা মাথার চুল ছোট করা। এবং (৭).বিদায়ী তাওয়াফ করা। [আর তামাত্তু কিংবা কিরান হজ্জপালনকারী হলে তার উপর হাদি (ছাগল জবাই করা) ওয়াজিব। দলিল হচ্ছে- আল্লাহ তাআলার বাণী: “তোমাদের মধ্যে যে কেউ উমরাকে হজ্জের সঙ্গে মিলিয়ে লাভবান হতে চায় সে সহজলভ্য হাদি জবাই করবে। কিন্তু যদি কেউ তা না পায়, তবে তাকে হজ্জের সময় তিনদিন এবং ঘরে ফেরার পর সাতদিন এ পূর্ণ দশদিন রোযা পালন করতে হবে। এটা তাদের জন্য, যাদের পরিজনবর্গ মসজিদুল হারামের বাসিন্দা নয়।”[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯৬] হজ্জের অবশিষ্ট কার্যাবলী ও কথামালা হচ্ছে- সুন্নত। যেমন, তাওয়াফে কুদুম, আরাফার রাত্রিতে মীনাতে রাত্রিযাপন করা, যথাযথসময়ে ইযতিবা ও রমল করা, হাজারে আসওয়াদকে চুমু খাওয়া, দোয়া ও যিকির পড়া, সাফা-মারমওয়া পাহাড়ে আরোহন করা।(উল্লেখিত রুকন, ওয়াজিব ও সুন্নতসমূহের দলিল ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী জানার জন্য দেখুন ‘আস-শারহুল মুমতি’; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৩৮০-৪১০)
.
▪️হজ্জের প্রকারভেদ: হজ্ব তিন প্রকার: তামাত্তু, ইফরাদ ও ক্বিরান।
.
(১).তামাত্তু হজ্জ: হজ্জের মাসসমূহে (হজ্বের মাস হচ্ছে- শাওয়াল, জ্বিলক্বদ, জ্বিলহজ্ব (দেখুন আল-শারহুল মুমতি ৭/৬২) এককভাবে উমরার ইহরাম বাঁধা, মক্কায় পৌঁছে তওয়াফ করা, উমরার সায়ী করা, মাথা মুণ্ডন করা অথবা চুল ছাটাই করে উমরা থেকে হালাল হয়ে যাওয়া। এরপর তারবিয়ার দিন অর্থাৎ ৮ জ্বিলহজ্ব এককভাবে হজ্বের ইহরাম বাঁধা এবং হজ্বের যাবতীয় কার্যাবলী শেষ করা। অতএব, তামাত্তু হজ্বকারী পরিপূর্ণ একটি উমরা পালন করেন এবং পরিপূর্ণ একটি হজ্ব পালন করেন।
.
(২).ইফরাদ হজ্জ: এককভাবে হজ্জের ইহরাম বাঁধা, মক্কায় পৌঁছে তাওয়াফে কুদুম করা, হজ্বের সায়ী করা, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট না করে তথা ইহরাম থেকে হালাল না হয়ে ইহরাম অবস্থায় থেকে যাওয়া এবং ঈদের দিন জমরা আকাবাতে কংকর নিক্ষেপের পর ইহরাম থেকে হালাল হওয়া। আর যদি হজ্বের সায়ীকে হজ্বের তওয়াফের পরে আদায় করতে চায় সেটাতেও কোন অসুবিধা নেই।
.
(৩).ক্বিরান হজ্জ: উমরা ও হজ্জের জন্য একত্রে ইহরাম বাঁধা অথবা প্রথমে উমরার ইহরাম বাঁধা এরপর তওয়াফ শুরু করার আগে হজ্বকে উমরার সাথে সম্পৃক্ত করা (অর্থাৎ তওয়াফ ও সায়ীকে হজ্ব ও উমরার সায়ী হিসেবে নিয়ত করা)। ক্বিরান হজ্বকারীর আমলগুলো ইফরাদ হজ্বকারীর আমলের মত। তবে ক্বিরান হজ্বকারীর উপর হাদি আছে; ইফরাদ হজ্বকারীর উপর হাদি নেই।
.
হজ্জের উপরোক্ত প্রকারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে- তামাত্তু হজ্ব।কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে এই হজ্ব আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এই হজ্ব আদায় করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। এমনকি যদি কেউ ক্বিরান হজ্ব বা ইফরাদ হজ্বের নিয়ত করে ফেলে তিনি তার ইহরামকে উমরার ইহরামে পরিবর্তন করে হালাল হয়ে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। যাতে করে সে ব্যক্তি তামাত্তু হজ্ব পালনকারী হতে পারেন। এমনকি সেটা তাওয়াফে কুদুম ও সায়ীর পরও হতে পারে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি তাঁর বিদায়ী হজ্বে তওয়াফ ও সায়ী করার পর তাঁর সাহাবীগণকে নির্দেশ দেন- তোমাদের মধ্যে যার যার সাথে হাদি নেই সে যেন তার ইহরামকে উমরার ইহরামে পরিবর্তন করে মাথার চুল ছোট করে হালাল হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন: আমি যদি হাদি না নিয়ে আসতাম তাহলে তোমাদেরকে যে নির্দেশ দিচ্ছি আমিও সেটা পালন করতাম।
.
▪️ইহরাম: ইহরাম মানে হচ্ছে- নুসুকে তথা হজ্ব বা উমরাতে প্রবেশের নিয়ত। কেউ যদি ইহরাম করতে চায় তখন সুন্নত হচ্ছে- সে ব্যক্তি কাপড়-চোপড় ছেড়ে ফরজ গোসলের মত গোসল করবে, মাথা বা দাঁড়িতে মিসক বা অন্য যে সুগন্ধি তার কাছে থাকে সেটা লাগাবে। সুগন্ধির আলামত যদি ইহরাম করার পরেও থেকে যায় তাতে কোন অসুবিধা নেই। যেহেতু সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইহরাম করতে চাইতেন তখন নিজের কাছে সবচেয়ে ভাল যে সুগন্ধিটা আছে সেটা ব্যবহার করতেন। ইহরাম করার পরে আমি তাঁর মাথা ও দাঁড়িতে সে সুগন্ধির ঝিলিকদেখতে পেতাম।(সহিহ বুখারি হা/২৭১) ও সহিহ মুসলিম হা/১১৯০) নর-নারী উভয়ের ক্ষেত্রে ইহরামের জন্য গোসল করা সুন্নত। এমনকি হায়েয ও নিফাসগ্রস্ত নারীদের ক্ষেত্রেও। কেননা আসমা বিনতে উমাইস (রাঃ) নিফাসগ্রস্ত ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ইহরামের জন্য গোসল করার ও রক্ত প্রবাহের স্থান একটি কাপড় দিয়ে বেঁধে নিয়ে ইহরাম করার নির্দেশ দিয়েছেন।”(সহিহ মুসলিম (১২০৯) গোসল ও সুগন্ধি ব্যবহারের পর ইহরামের কাপড় পরিধান করবে। এরপর ফরজ নামাযের ওয়াক্ত হলে ফরজ নামায আদায় করবে। ফরজ নামাযের ওয়াক্ত না হলে ওজুর সুন্নত হিসেবে দুই রাকাত নামায আদায় করবে। নামাযের পর কিবলামুখি হয়ে ইহরাম বাঁধবে। ইচ্ছা করলে বাহনে (গাড়ীতে) উঠে যাত্রার প্রাক্কালে ইহরাম করতে পারেন। তবে মীকাত থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার আগে ইহরাম করতে হবে।এরপর যদি তামাত্তু হজ্বকারী হয় তাহলে বলবে:لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ بِعُمْرَةٍ”লাব্বাইকাল্লাহুম্মা বি উমরাতিন” (অর্থ- হে আল্লাহ! উমরাকারী হিসেবে আপনার দরবারে হাজির)। আর যদি ক্বিরান হজ্ব আদায়কারী হয় তাহলে বলবে:لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ بِحَجَّةٍ وَعُمْرَةٍ”লাব্বাইকাল্লাহুম্মা বি হাজ্জাতিন ওয়া উমরাতিন”(হে আল্লাহ! হজ্ব ও উমরাকারী হিসেবে আপনার দরবারে হাজির) আর যদি ইফরাদ হজ্বকারী হয় তাহলে বলবে:لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ حَجًّا”লাব্বাইকাল্লাহুম্মা হাজ্জান (হে আল্লাহ! হজ্বকারী হিসেবে আপনার দরবারে হাজির)। এরপর বলবেন: اللهم هذه حجة لا رياء فيها ولا سمعةআল্লাহুম্মা হাযিহি হাজ্জাতুন লা রিয়াআ ফি-হা ওয়ালা সুমআ (হে আল্লাহ! এ হজ্বকে এমন হজ্ব হিসেবে কবুল করুন যার মধ্যে লৌকিকতা ও প্রচারপ্রিয়তা নেই)।
.
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে তালবিয়া পড়েছেন সেভাবে তালবিয়া পড়বে। সেই তালবিয়া হচ্ছে-لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ ، لَبَّيْكَ لا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لا شَرِيكَ لَكَ”লাব্বাইকাল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক।” (অর্থ- হে আল্লাহ! আমি আপনার দরবারে হাজির। আমি আপনার দরবারে হাজির। আমি আপনার দরবারে হাজির। আপনি নিরঙ্কুশ। আমি আপনার দরবারে হাজির। নিশ্চয় যাবতীয় প্রশংসা, যাবতীয় নেয়ামত আপনার-ই জন্য এবং রাজত্ব আপনার-ই জন্য। আপনি নিরঙ্কুশ।) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও একটি তালবিয়া পড়তেন সেটা হচ্ছে-لَبَّيْكَ إِلَهَ الْحَقِّ”লাব্বাইকা ইলাহাল হাক্ব (অর্থ- ওগো সত্য উপাস্য! আপনার দরবারে হাজির)।ইবনে উমর (রাঃ) আরেকটু বাড়িয়ে বলতেন:لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ بِيَدَيْكَ وَالرَّغْبَاءُ إِلَيْكَ وَالْعَمَلُ”লাব্বাইকা ওয়া সাদাইক। ওয়াল খাইরু বি ইয়াদাইক। ওয়ার রাগবাউ ইলাইকা ওয়াল আমাল। (অর্থ- আমি আপনার দরবারে হাজির, আমি আপনার সৌজন্যে উপস্থিত। কল্যাণ আপনার-ই হাতে। আকাঙ্ক্ষা ও আমল আপনার প্রতি নিবেদিত)। পুরুষেরা উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়বে।আর নারীরা এভাবে পড়বে যেন পাশের লোক শুনতে পায়। যদি পাশে বেগানা পুরুষ থাকে তাহলে গোপনে তালবিয়া পড়বেন। ইহরামকারী যদি কোন প্রতিবন্ধকতার আশংকা করেন যেমন রোগ, শত্রু বা গ্রেফতার ইত্যাদি তাহলে ইহরামকালে শর্ত করে নেয়া ভাল। ইহরামকালে তিনি বলবেন:إِنْ حَبَسَنِيْ حَابِسٌ فَمَحِلِّيْ حَيْثُ حَبَسْتَنِيْ”ইন হাবাসানি হাবেস ফা মাহিল্লি হাইসু হাবাসতানি”(অর্থ- যদি কোন প্রতিবন্ধকতা – যেমন রোগ, বিলম্ব ইত্যাদি আমার হজ্ব পালনে- বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে আমি যেখানেপ্রতিবন্ধকতার শিকার হই সেখানে ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাব)।কেননা দুবাআ বিনতে যুবাইর (রাঃ) অসুস্থ থাকায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহরাম করাকালে তাকে শর্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন: “তুমি যে শর্ত করেছ সেটা তোমার রবের নিকট গ্রহণযোগ্য।”(সহিহ বুখারি হা/৫০৮৯) ও সহিহ মুসলিম হা/১২০৭) যদি ইহরামকারী শর্ত করে থাকে এবং নুসুক পালনে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় তাহলে সে ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাবে। এতে করে তার উপর অন্য কোন দায়িত্ব আসবে না। আর যদি প্রতিবন্ধকতার কোন আশংকা না থাকে তাহলে শর্ত না করাই বাঞ্ছনীয়। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শর্ত করেননি এবং সাধারণভাবে সবাইকে শর্ত করার নির্দেশও দেননি। দুবাআ বিনতে যুবাইর (রাঃ) অসুস্থ থাকায় তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। ইহরামকারীর উচিত অধিক তালবিয়া পাঠ করা। বিশেষতঃ সময় ও অবস্থার পরিবর্তনগুলোতে। যেমন উঁচুতে উঠার সময়। নীচুতে নামার সময়। রাত বা দিনের আগমনকালে। তালবিয়া পাঠের পর আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত প্রার্থনা করা এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিত। উমরার ইহরামের ক্ষেত্রে ইহরামের শুরু থেকে তওয়াফ শুরু করার আগ পর্যন্ত তালবিয়া পড়ার বিধান রয়েছে। আর হজ্বের ক্ষেত্রে ইহরাম করার পর হতে ঈদের দিন জমরা আকাবাতে কংকর নিক্ষেপ করা পর্যন্ত তালবিয়া পড়ার বিধান।
.
মক্কায় প্রবেশের জন্য গোসল: মক্কারকাছাকাছি পৌঁছলে সম্ভব হলে মক্কায় প্রবেশের জন্য গোসল করে নিবে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা প্রবেশের সময় গোসল করেছিলেন।(সহিহ মুসলিম হা/ ১২৫৯) এরপর মসজিদে হারামে প্রবেশের সময় ডান পা আগে দিবে এবং বলবে:بِسْمِ اللهِ والصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ الَّلهُمَّ اغْفِرْ لِيْ ذُنُوْبِيْ وافْتَحْ لِى أَبْوَابَ رَحْمَتِكَأَعُوذُ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ”(অর্থ- আল্লাহর নামে শুরু করছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। হে আল্লাহ! আমার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিন। আমার জন্য আপনার রহমতের দুয়ারগুলো খুলে দিন। আমি বিতাড়িত শয়তান হতে মহান আল্লাহর কাছে তাঁর মহান চেহারার মাধ্যমে, তাঁর অনাদি রাজত্বেরমাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।) এরপর তওয়াফ শুরু করার জন্য হাজারে আসওয়াদের দিকে এগিয়ে যাবে।ডান হাত দিয়ে হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করবে ও চুমু খাবে। যদি হাজারে আসওয়াদে চুমু খেতে না পারে হাত দিয়ে স্পর্শ করবে ও হাতে চুমু খাবে (স্পর্শ করার মানে হচ্ছে- হাত দিয়ে ছোঁয়া)। যদি হাত দিয়ে স্পর্শ করতে না পারে তাহলে হাজারে আসওয়াদের দিকে মুখ করে হাত দিয়ে ইশারা করবে এবং তাকবির বলবে; কিন্তু হাতে চুমু খাবে না। হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করার ফজিলত অনেক। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “আল্লাহ তাআলা হাজার আসওয়াদকে পুনরুত্থিত করবেন। তার দুইটি চোখ থাকবে যে চোখ দিয়ে পাথরটি দেখতে পাবে।তার একটি জিহ্বা থাকবে যে জিহ্বা দিয়ে পাথরটি কথা বলতে পারবে। যে ব্যক্তি সঠিকভাবে পাথরটিকে স্পর্শ করেছে পাথরটি তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে।[আলবানী আল-তারগীব ও আল-তারহীব (১১৪৪) গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন] তবে উত্তম হচ্ছে- ভিড়না করা। মানুষকে কষ্ট না দেয়া এবং নিজেও কষ্ট না পাওয়া। যেহেতু হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি উমরকে লক্ষ্য করে বলেছেন- “হে উমর! তুমি শক্তিশালী মানুষ। হাজারে আসওয়াদের নিকট ভিড় করে দুর্বল মানুষকে কষ্ট দিও না। যদি ফাঁকা পাও তবে স্পর্শ করবে; নচেৎ হাজারে আসওয়াদমুখি হয়ে তাকবীর বলবে।[মুসনাদে আহমাদ (১৯১), আলবানী তাঁর ‘মানাসিকুল হাজ্জ ও উমরা’ গ্রন্থে হাদিসটিকে ‘কাওয়ি’ (শক্তিশালী) মন্তব্য করেছেন] এরপর ডানদিক ধরে চলতে থাকবে। বায়তুল্লাহকে বামদিকে রাখবে। যখন রুকনে ইয়ামেনীতে (হাজারে আসওয়াদের পর তৃতীয় কর্নার) পৌঁছবে তখন সে কর্নারটি চুমু ও তাকবীর ছাড়া শুধু স্পর্শ করবে। যদি স্পর্শ করা সম্ভব না হয় তাহলে তওয়াফ চালিয়ে যাবে; ভিড় করবে না। রুকনে ইয়ামেনী ও হাজারে আসওয়াদের মাঝখানে এলেবলবেন:(رَبَّنَا آَتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآَخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ) (অর্থ- হে আমাদের রব! আমাদিগকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান করুন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং আমাদিগকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা করুন।)[সুনানে আবু দাউদ, আলবানী ‘সহিহ আবু দাউদ’ গ্রন্থে হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন] যখনই হাজারে আসওয়াদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে তখনই হাজারে আসওয়াদ অভিমুখী হয়ে তাকবীর বলবে। তওয়াফের অন্য অংশে যা কিছু খুশি যিকির, দুআ ও কুরআন তেলাওয়াত করবে। বায়তুল্লাহতে তওয়াফের বিধান দেয়া হয়েছে আল্লাহর যিকিরকে সমুন্নত করার জন্য। তওয়াফের মধ্যে পুরুষকে দুইটি জিনিস করতে হয়।
১. তওয়াফের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইজতেবা করা। ইজতেবা মানে- ডান কাঁধ খালি রেখে চাদরের মাঝের অংশ বগলের নীচ দিয়ে এনে চাদরের পার্শ্ব বাম কাঁধের উপর ফেলে দেয়া। তওয়াফ শেষ করার পর চাদর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিবে। কারণ ইজতেবা শুধু তওয়াফের মধ্যে করতে হয়।
২. তওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল করা। রমল মানে হচ্ছে- ছোট ছোট পদক্ষেপে দ্রুত হাঁটা। আর বাকী চার চক্করে রমল নেই বিধায় স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবে। সাত চক্কর তওয়াফ শেষ করার পর ডান কাঁধ ঢেকে নিয়ে মাকামে ইব্রাহিমে আসবে এবং পড়বে-( وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِإِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى )(অর্থ- আর তোমরা মাকামে ইব্রাহিমকে তথা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা বানাও।) [সূরা বাকারা, আয়াত: ১২৫]অতঃপর মাকামে ইব্রাহিমের পিছনে দুই রাকাত নামায আদায় করবে। প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা কাফিরুন পড়বে। দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস পড়বে। নামায শেষ করার পর হাজারে আসওয়াদের নিকট এসে সম্ভব হলে হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করবে। এক্ষেত্রে শুধু স্পর্শ করা সুন্নত। যদি স্পর্শ করা সম্ভবপর না হয় তাহলে ফিরে আসবে; ইশারা করবে না।
.
তওয়াফের পর ও তওয়াফের দুই রাকাত নফল নামাযের পর মাসআ (সায়ী করার স্থান) এর দিকে এগিয়ে যাবে, যখন সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হবে তখন পড়বে (إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ) (অর্থ-“নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা’আলার নিদর্শনগুলোর অন্যতম”)[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৫৮]এরপর বলবে: (نبدأ بما بدأ الله به)(অর্থ- আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন আমরাও তা দিয়ে শুরু করছি) অতঃপর সাফা পাহাড়ে উঠবে যাতে করে কাবা শরিফ দেখতে পায়। কাবা নজরে আসলে কাবাকে সামনে রেখে দুই হাত তুলে দুআ করবে। দুআর মধ্যে আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং যা ইচ্ছা দুআ করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুআর মধ্যে ছিল-لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ أَنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الأَحْزَابَ وَحْدَهُ.”লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। লাহুল মুলকু, ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহ, আনজাযা ওয়াদাহ, ওয়া নাসারা আবদাহ, ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহদা।”(অর্থ- “নেই কোন উপাস্য এক আল্লাহ ব্যতীত। তিনি নিরঙ্কুশ। রাজত্ব তাঁর-ই জন্য। প্রশংসা তাঁর-ই জন্য। তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। নেই কোন উপাস্য এক আল্লাহ ছাড়া। তিনি প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন। তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি একাই সর্ব দলকে পরাজিত করেছেন।)(সহিহ মুসলিম হা/১২১৮) এই যিকিরটি তিনবার উচ্চারণ করবেন এবং এর মাঝে দুআ করবেন। একবার এই যিকিরটি বলবেনএরপর দোয়া করেন। দ্বিতীয়বার যিকিরটি বলবেন এবং এরপর দুআ করবেন। তৃতীয়বার যিকিরটি বলে মারওয়া পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাবেন। তৃতীয়বারে আর দুআ করবেন না। যখন সবুজ কালার চিহ্নিত স্থানে পৌঁছবেন তখন যত জোরে সম্ভব দৌঁড়াবেন। কিন্তু কাউকে কষ্ট দিবেন না। দলিল হচ্ছে- হাদিসে সাব্যস্ত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাফা-মারওয়ার মাঝখানে সায়ী (প্রদক্ষিণ) করেছেন এবং বলেছেন: “আবতাহ দৌঁড়িয়ে পার হতে হবে।”(সুনানে ইবনে মাজাহ হা/২৪১৯), আলবানী হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন] আবতাহ হচ্ছে- বর্তমানে দুইটি সবুজ রঙে চিহ্নিত স্থান। দ্বিতীয় সবুজ রঙ চিহ্নিত স্থান থেকে স্বাভাবিক গতি হাঁটবে। এভাবে মারওয়াতে পৌঁছবে। মারওয়ার উপরে উঠে কিবলামুখি হয়ে হাত তুলে দুআ করবে। সাফা পাহাড়ের উপর যা যা পড়েছে ও বলেছে এখানে তা তা পড়বে ও বলবে। এরপর মারওয়া থেকে নেমে সাফার উদ্দেশ্যে হেঁটে যাবে। স্বাভাবিকভাবে হাঁটার স্থানে হেঁটে পার হবে; আর দৌঁড়াবার স্থানে দৌঁড়ে পার হবে। সাফাতে পৌঁছার পর পূর্বে যা যা করেছে তা তা করবে। মারওয়ার উপরেও আগের মত তা তা করবে। এভাবে সাত চক্কর শেষ করবে। সাফা থেকে মারওয়া গেলে এক চক্কর। মারওয়া থেকে সাফাতে এলে এক চক্কর। তার সায়ীর মধ্যে যা খুশি যিকির, দুআ, কুরআন তেলাতেয়াত করতে পারবে। জ্ঞাতব্যঃ (إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ)(অর্থ-“নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা’আলার নিদর্শনগুলোর অন্যতম”)[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৫৮] এই আয়াতটি শুধু সায়ীর শুরুতে সাফার নিকটবর্তী হলে পড়বে। সাফা-মারওয়াতে প্রতিবার আয়াতটি পড়বে না যেমনটি কিছু কিছু মানুষ করে থাকে।
.
তামাত্তু হজ্বকারী উমরার সায়ী করবেন। আর ইফরাদ ও ক্বিরান হজ্বকারী হজ্বের সায়ী করবেন এবং ইচ্ছা করলে সায়ীটি হজ্বের ফরজ তওয়াফের পরেও আদায় করতে পারেন।
.
▪️মাথা মুণ্ডন করা বা চুল ছোট করা:তামাত্তু হজ্বকারী যখন সায়ীর সাত চক্কর শেষ করবেন তখন তিনি পুরুষ হলে মাথা মুণ্ডন করতে পারেন অথবা চুল ছোট করতে পারেন। যদি মাথা মুণ্ডন করলে মাথার সর্বাংশমুণ্ডন করতে হবে। অনুরূপভাবে চুল ছোট করলেও মাথার সর্বাংশের চুল ছোট করতে হবে। চুল ছোট করার চেয়ে মাথা মুণ্ডন করা উত্তম। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্য তিনবার দুআ করেছেন। আর চুল ছোটকারীদের জন্য একবার দুআ করেছেন।”(সহিহ মুসলিম হা/১৩০৩) তবে হজ্বের সময় যদি অতি নিকটবর্তী হয় এবং নতুন চুল গজাবার মত সময় না থাকে তাহলে চুল ছোট করা উত্তম; যাতে হজ্বের সময় মাথা মুণ্ডন করতে পারেন। দলিল হচ্ছে- বিদায় হজ্বকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে উমরার জন্য মাথার চুল ছোট করার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ তাঁরা জ্বিলহজ্ব মাসের ৪ তারিখ সকাল বেলায় মক্কা পৌঁছেছিলেন। আর নারীরা আঙ্গুলের এক কর পরিমাণ চুল কেটে নিবে। এর মাধ্যমে তামাত্তু হজ্বকারীর উমরার কাজ শেষ হলো এবং তামাত্তু হজ্বকারী সম্পূর্ণরূপে হালাল হয়ে গেলেন। অর্থাৎ হালাল অবস্থায় একজন মানুষ যা যা করতে পারে (যেমন- সেলাইকৃত পোশাক পরা, সুগন্ধি লাগানো, স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি)এখন তামাত্তু হজ্বকারীও সেসব পারবেন।পক্ষান্তরে ইফরাদ ও ক্বিরান হজ্বকারী মাথা মুণ্ডন করবেন না; কিংবা মাথার চুল ছোট করবেন না; তারা ইহরাম থেকে হালাল হবেন না। বরং ইহরাম অবস্থায় থাকবেন এবং ঈদের দিন জমরা আকাবাতে কংকর নিক্ষেপ করার পর মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটাই এর মাধ্যমে হালাল হবেন।
.
তারপর তারবিয়ার দিন তথা জ্বিলহজ্বের ৮ তারিখে তামাত্তু হজ্বকারী মক্কায় তার অবস্থানস্থল থেকে ইহরাম বাঁধবে। উমরার ইহরামকালে যা যা করা মুস্তাহাব ছিল হজ্বের ইহরামের সময়ও তা তা করা (যেমন- গোসল, সুগন্ধি লাগানো, নামায ইত্যাদি)মুস্তাহাব। এই ইহরামের সময় হজ্বের নিয়ত করবেন, তালবিয়া পড়বেন এবং মুখে বলবেন: لبيك اللهم حجاً(হে আল্লাহ! হজ্বকারী হিসেবে আপনার দরবারে হাজির)। যদি হজ্ব সমাপ্তকরণে কোন প্রতিবন্ধকতার আশংকা করে তবে শর্ত করে নিবে। وإن حبسني حابس فمحلي حيث حبستني(অর্থ- যদি কোন প্রতিবন্ধকতা আমাকে আটক করে তাহলে আমি যেখানে আটক হই সেখানে হালাল হয়ে যাব)। আর যদি এমন কোন আশংকা না থাকে তাহলে শর্ত করবে না। হাজ্বীর জন্য মুস্তাহাব হলো ঈদের দিন জমরা আকাবাতে কংকর নিক্ষেপের পূর্ব পর্যন্ত উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করা।
.
▪️মীনায় গমন: এরপর মীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। সেখানে পৌঁছে জোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের নামায কসর (৪ রাকাতের স্থলে ২ রাকাত) করে ঠিক ঠিক ওয়াক্তে আদায় করবে। দলিল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মীনাতে নামাযগুলো কসর করতেন; কিন্তু একত্রে আদায় করতেন না।
সালাত কসর: ৪ রাকাত বিশিষ্ট নামাযগুলো ২ রাকাত করে আদায় করা। মক্কাবাসী এবং অন্য সকলে মীনা, আরাফা ও মুজদালিফাতে নামায কসর করবেন। দলিল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্ব আদায়কালে লোকদের নিয়ে নামায আদায় করতেন। তাঁর সাথে মক্কাবাসীরাও ছিল। কিন্তু তিনি তাদেরকে পরিপূর্ণ নামায পড়ার নির্দেশ দেননি। যদি তা ফরজ হতো তাহলে তিনি তাদেরকে সে নির্দেশ দিতেন যেভাবে মক্কা বিজয়ের বছর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু মক্কার দালানকোঠা প্রসারিত হতে হতে মীনা মক্কার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। যেন মীনা মক্কারই একটি মহল্লা। তাই মক্কাবাসীরা সেখানে কসর করবে না।
.
▪️আরাফায় গমন: আরাফার দিন সূর্যোদয়ের পর মীনা থেকে আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। সম্ভব হলে জোহরের পূর্ব পর্যন্ত নামিরাতে অবস্থান করবে (নামিরা হচ্ছে- আরাফার সম্মুখভাগের একটি স্থান)। আর যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে কোন অসুবিধা নেই। কারণ নামিরাতে অবস্থান করা সুন্নত; ওয়াজিব নয়। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর (অর্থাৎ জোহরের ওয়াক্ত হওয়ার পর) জোহর ও আসর উভয় নামায একত্রে জোহরের ওয়াক্তে দুই রাকাত দুই রাকাত করে আদায় করে নিবে; ঠিক যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদায় করেছিলেন যাতে করে আরাফার মাঠে লম্বা সময় অবস্থান করে দুআ করতে পারেন। নামাযের পর আল্লাহর যিকির ও দুআতে মশগুল হবে। আল্লাহর কাছে রোনাজারি করবে, দু হাত তুলে কিবলামুখি হয়ে যা ইচ্ছা দুআ করবে। যদি কিবলামুখি হতে গিয়ে জাবালে আরাফা পিছনে পড়ে যায় কোন অসুবিধা নেই। যেহেতু দুআর ক্ষেত্রে সুন্নত হচ্ছে- কিবলামুখি হওয়া; পাহাড়মুখি হওয়া নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাহাড়ের নিকটে অবস্থান করেছেন এবং বলেছেন: “আমি এখানে অবস্থান করলাম; আরাফার ময়দানের সর্বাংশঅবস্থানস্থল।”সেই মহান দিনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দুআটি সবচেয়ে বেশি করেছেন সেটা হচ্ছে-لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ ، وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ ، لَهُ الْمُلْكُ ، وَلَهُ الْحَمْدُ ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহুলা শরিকা লাহ। লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু। ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদির। (অর্থ- এক আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। তিনি নিরঙ্কুশ। রাজত্ব তাঁর-ই জন্য। প্রশংসা তাঁর-ই জন্য। তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান)। যদি কিছুটা একগেঁয়েমি এসে যায় এবং সঙ্গি-সাথীদের কথাবার্তা বলে কিছুটা সতেজ হতে চায় তাহলে ভাল কথা বলবে এবং ভাল কোন বই পড়বে। বিশেষতঃ আল্লাহ তাআলার বদান্যতা, তাঁর মহান অনুগ্রহ বিষয়ক কোন বই পড়বে। যাতে সে মহান দিনে আল্লাহর প্রতি আশার দিকটা ভারী থাকে। এরপর পুনরায় আল্লাহর কাছে রোনাজারি ও দুআতে ফিরে আসবে এবং দিনের শেষভাগকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হবে। কেননা সবচেয়ে উত্তম দুআ হচ্ছে- আরাফা দিবসের দুআ।
.
▪️মুজদালিফাতে গমন: সূর্য ডোবার পরে মুজদালিফাতে গমন করবে। মুজদালিফাতে পৌঁছে মাগরিব ও এশার নামায এক আযান দুই ইকামতে আদায় করবে। যদি এই আশংকা হয় যে, মুজদালিফাতে পৌঁছতে পৌঁছতে মধ্যরাত পার হয়ে যাবে সেক্ষেত্রে রাস্তায় নামায আদায় করে নিবে। কারণ নামাযকে মধ্যরাতের বেশি বিলম্ব করে পড়া জায়েয হবে না। মুজদালিফাতে এসে রাত্রি যাপন করবে। ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পরবিলম্ব না করে এক আযান ও এক ইকামতে ফজরের নামায পড়ে নিবে। এরপর আল-মাশআর আল-হারামের দিকে এগিয়ে যাবে (বর্তমানে মুজদালিফাতে মসজিদটি যে স্থানে রয়েছে এটি সেই জায়গা)। সেখানে গিয়ে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিবে, আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করবে তথা তাকবীর বলবে এবং ইসফার (ইসফার মানে- সূর্যোদয়ের আগেপূবদিক ফর্সা হয়ে উঠা) হওয়া পর্যন্ত যা খুশি দুআ করবে। যদি আল-মাশআর আল-হারামে যাওয়া সম্ভব না হয় তাহলে নিজ স্থানে অবস্থান করে দুআ করবে। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “আমি এ স্থানে অবস্থান করলাম। জাম্মতথা গোটা মুজদালিফাই অবস্থানস্থল।”হাত উঁচু করে কিবলামুখি হয়ে দুআ ও যিকির করবে।
.
মীনায় গমন: সূর্যোদয়ের পূর্বে আকাশ ভালভাবে ফর্সা হয়ে উঠলে মীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। ওয়াদি মুহাসসার (মুজদালিফা ও মীনার মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা) দ্রুত পার হবে। মীনায় পৌঁছে অপেক্ষাকৃত মক্কার নিকটবর্তী‘আকাবা’ নামক জমরাতেএকটির পর একটি করে মোট৭টি কংকর নিক্ষেপ করবে। প্রতিটি কংকরের আকার হবে প্রায় ছোলার সম-পরিমান। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সাথে তাকবীর বলবে। জমরা আকাবাতে কংকর নিক্ষেপ করার সুন্নত পদ্ধতি হলো- জমরাকে সামনে রাখবে, মক্কাকে বামে রাখবে এবং মীনাকে ডানে রাখবে। কংকর নিক্ষেপ সম্পন্ন করার পর হাদি যবেহ করবে। এরপর পুরুষ হলে মাথা মুণ্ডন করবে অথবা মাথার চুল ছোট করবে। আর মহিলা হলে আঙ্গুলের এক কর পরিমাণ চুল কাটবে। (এর মাধ্যমে ইহরাম থেকে প্রাথমিক হালাল অর্জিত হবে; অর্থাৎ এ হালাল হওয়ার মাধ্যমে স্ত্রী সহবাস ছাড়া আর সবকিছু হাজী সাহেবের জন্য হালাল হলো।)এরপর মক্কা গমন করে হজ্বের তওয়াফ ও সায়ী করবে। (এর মাধ্যমে হাজী সাহেব দ্বিতীয় হালাল হবে। এ হালালের মাধ্যমে ইহরামের কারণে যা কিছু হারাম হয়েছিল সবকিছু হাজীর জন্য হালাল হবে)। কংকর নিক্ষেপ ও মাথা মুণ্ডনের পর তওয়াফ করার জন্য মক্কায় যেতে চাইলে সুন্নত হচ্ছে- সুগন্ধি লাগানো। দলিল হচ্ছে আয়েশা (রাঃ) এর হাদিস “আমি ইহরাম করার আগে ইহরামের জন্য এবং হালাল হওয়ার পর তওয়াফের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম।”(সহিহ বুখারি হা/১৫৩৯) ও সহিহ মুসলিম হা/১১৮৯)। এরপর তওয়াফ ও সায়ী করার পর মীনাতে ফিরে আসবে। জ্বিলহজ্বের একাদশ ও দ্বাদশ রজনী মীনাতে কাটাবে এবং সে দু’দিন সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর তিনটি জমরাতে কংকর নিক্ষেপ করবে। উত্তম হচ্ছে- কংকর নিক্ষেপের জন্য হেঁটে যাওয়া। বাহনে চড়ে গেলেও অসুবিধা নেই। প্রথমে প্রথম জমরাতে এক এক করে পরপর ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবে। এই জমরাটি মক্কা থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে ও মসজিদে খাইফের নিকটে। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপকালে তাকবীর বলবে। এরপর একটু অগ্রসর হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে যা ইচ্ছা দুআ করবে। যদি দীর্ঘ সময় দাঁড়ানো ও দুআ করা কারো জন্য কষ্টকর হয় তাহলে সাধ্যানুযায়ী অল্প সময়ের জন্য হলেও দুআ করবে; যেন সুন্নত পালন হয়। এরপর মধ্যবর্তী জমরাতে একের পর এক মোট ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবে। প্রতিটি কংকরের সাথে তাকবীর বলবে। এরপর সামান্য বামে সরে গিয়ে কিবলামুখি হয়ে দাঁড়াবে এবং হাত উঁচু করে সম্ভব হলে লম্বা সময় ধরে দুআ করবে। লম্বা সময় দুআ করা সম্ভব না হলে সামান্য সময়ের জন্য হলেও দাঁড়িয়ে দুআ করবে। এই দুআটি ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। যেহেতু এটি সুন্নত। অনেক মানুষ না জানার কারণে অথবা অবহেলা করে এ সুন্নতটি ছেড়ে দেয়। কখনো কোন সুন্নত যদি অপ্রচলিত হয়ে পড়ে তখন সে সুন্নতের উপর আমল করা ও মানুষের মাঝে এর প্রসার করাঅধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। যেন এ সুন্নতটি একেবারে মিটে না যায়।
.
এরপর জমরা আকাবাতে একের পর এক মোট ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবে। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সাথে তাকবীর বলবে। এই জমরাতে কংকর নিক্ষেপ করার পর দাঁড়াবে না ও দুআ করবে না। এভাবে ১২ই জ্বিলহজ্ব ৩টি জমরাতে কংকর নিক্ষেপ করার পর ইচ্ছা করলে দেরী না করে সেদিনই মীনা ত্যাগ করে চলে আসতে পারে। আর চাইলে ১৩ই জ্বিলহজ্ব রাত্রি মীনাতে অবস্থান করে পরদিন সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর ৩টি জমরাতে কংকর নিক্ষেপ করে মীনা ত্যাগ করতে পারে। একদিন দেরী করে মীনা ত্যাগ করাটা উত্তম; তবে ওয়াজিব নয়। কিন্তু ১২ ই জ্বিলহজ্ব সূর্যোদয়ের সময়েও কেউ যদি মীনাতে অবস্থান করে তাহলে তার জন্য ১৩ ই জ্বিলহজ্ব রাত্রি মীনাতে কাটানো ও পরদিন ৩টি জমরাতে কংকর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। তবে মীনাতে সূর্য ডুবে যাওয়া যদি তার এখতিয়ারের বাইরের কোন কারণে হয় যেমন কেউ তাবু ত্যাগ করে গাড়ীতে চড়েছে কিন্তু রাস্তায় জ্যাম বা এ জাতীয় কোন কারণে আটকা পড়ে যায় তাহলে ১৩ তারিখ পর্যন্ত দেরি করা তার উপর ওয়াজিব হবে না। কারণ এ বিলম্বটা তার এখতিয়ারভুক্ত নয়। অতঃপর যখন মক্কা ত্যাগ করে নিজ দেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছা করবে তখন বিদায়ী তওয়াফ না করে মক্কা ত্যাগ করবে না। দলিল হচ্ছে- “তোমাদের কেউ প্রস্থান করবে নাযতক্ষণ না সে শেষ কাজ বায়তুল্লাহতে (তওয়াফ) না করে।”(সহিহ মুসলিম হা/১৩২৭) অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে- “লোকদেরকে আদেশ করা হয়েছে- তাদের সর্বশেষ আমল যেন হয় বায়তুল্লাহতে (তওয়াফ)। তবে হায়েযগ্রস্ত নারীকে এ ব্যাপারে ছাড় দেয়া হয়েছে।”(সহিহ বুখারি হা/১৭৫৫) ও সহিহ মুসলিম হা/১৩২৮) হায়েয ও নিফাসগ্রস্ত নারীদের উপর বিদায়ী তওয়াফ নেই এবং তাদের জন্য মসজিদে হারামের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বিদায় জানানোটাও উচিত নয়। কারণ এ ধরনের পদ্ধতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত হয়নি। যখন দেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছা করবে তখন হাজী সাহেবের সর্বশেষ কাজ হবে তওয়াফ। যদি বিদায়ী তওয়াফ করার পর সঙ্গিদের অপেক্ষা করতে হয় অথবা মালপত্র বাহনে উঠানোর জন্য অপেক্ষা করতে হয় অথবা পথের সম্বল হিসেবে কিছু কিনতে হয় এতে কোন অসুবিধা নেই। এর জন্য পুনরায় তওয়াফ করতে হবে না। তবে যদি সফর বিলম্বের নিয়ত করতে হয় (উদাহরণতঃ সফর ছিল দিনের পূর্বাহ্ণে এবং বিদায়ী তওয়াফ করে নিয়েছে কিন্তু পরে যদি সফর দিনের অপরাহ্ণে) করতে হয় তাহলে পুনরায় বিদায়ী তওয়াফ করে নেয়া ওয়াজিব; যাতে সর্বশেষ আমলটা তওয়াফ হয়।
.
হজ্ব বা উমরার ইহরাম বাঁধার পর ইহরামকারীর উপর নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ওয়াজিব:
(১).ইসলামী যাবতীয় অনুশাসন পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা। যেমন- ঠিক সময়ে নামাযগুলো আদায় করা। (২).আল্লাহ যা যা নিষেধ করেছেন যেমন পাপ কথা, পাপ কাজ ও অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকা। দলিল হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বাণী: “অতএব, এই মাসসমূহে যে ব্যক্তি নিজের উপর হজ্বকে আবশ্যক করে নিল তার জন্য হজ্বে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়।”[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯৭) (৩). পবিত্র স্থানগুলোর ভিতরে অথবা বাইরে কথা বা কাজের মাধ্যমে মুসলমানকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা। (৪). ইহরাম অবস্থায় যা যা নিষিদ্ধ সেগুলো থেকে বিরত থাকা: যেমন:
(ক). চুল বা নখ না কাটা। তবে কাঁটা বা এ জাতীয় কিছু তুলে ফেললে রক্ত বের হলেও গুনাহ হবে না। (খ). ইহরাম বাঁধার পর শরীরে, পরিধেয় পোশাকেবা খাবার-দাবারে সুগন্ধি ব্যবহার করবে না। সুগন্ধিযুক্ত সাবান ব্যবহার করবে না। তবে ইহরামের আগে ব্যবহারকৃত সুগন্ধির কোন আলামত যদি থেকে যায় এতে কোন অসুবিধা নেই। (গ). শিকার করবে না। (ঘ). স্ত্রী সহবাস করবে না। (ঙ). উত্তেজনাসহ স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরবে না, চুমু খাবে না বা এ জাতীয় কিছু করবে না। (চ). নিজে বিয়ের চুক্তি করবে না অথবা অন্য কারো বিয়ের আকদ পড়াবে না অথবা কোন নারীকে নিজের জন্য অথবা অন্য কারো জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিবে না। (ছ). হাতমোজা পরবে না। তবে কোন ন্যাকড়া দিয়ে হাত পেঁচালে গুনাহ হবে না।এই সাতটি নিষিদ্ধ কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ে সমান।
.
তবে বিশেষভাবে পুরুষের জন্য কাজগুলো হচ্ছে:
-এঁটে থাকা কোন কিছু দিয়ে মাথা ঢাকবে না। তবে ছাতা দিয়ে, গাড়ীর ছাদের আড়ালে, তাবুর আড়ালে ছায়া নিতে অথবা মাথায় বোঝা বহন করতে কোন দোষ নেই। সেলাইকৃত জামা, পাগড়ী, টুপি, পায়জামা, মোজা পরা যাবে না। তবে লুঙ্গি না পেলে পায়জামা পরবে। জুতা না পেলে মোজা পরবে। ইতিপূর্বে উল্লেখিত পোশাকগুলোর স্থলাভিষিক্ত কোন পোশাকও পরা যাবে না। যেমন- জুব্বা, ক্যাপ, টুপি, গেঞ্জি ইত্যাদি। জুতা, আংটি, চশমা, হেডফোন ইত্যাদি পরা যাবে। হাতে ঘড়ি পরা যাবে, গলায় হার পরা যাবে। টাকা-পয়সা রাখার জন্য বেল্ট পরা যাবে।
-সুগন্ধিহীন কিছু দিয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া যাবে। মাথা ও শরীর ধোয়া যাবে ও চুলকানো যাবে। এতে করে অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন চুল পড়ে গেলে তাতে কোন দোষ নেই। নারীরা নেকাব পরবে না। নেকাব হচ্ছে- এমন কাপড় যা দিয়ে নারীরা তাদের মুখ ঢেকে রাখে; শুধু চোখ দুটি দেখা যায়। নারীদের জন্য সুন্নত হচ্ছে- মুখ ঢেকে রাখা। তবে যদি বেগানা পুরুষদের দৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে ইহরাম অবস্থায় অথবা ইহরামের বাইরে মুখ ঢেকে রাখা ওয়াজিব। আমরা আল্লাহ তাআলার প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে নেক আমল করার তাওফিক দেন। তিনি যেন আমাদের আমলগুলো কবুল করে নেন। নিশ্চয় তিনি নিকটবর্তী ও প্রার্থনা কবুলকারী। আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ‘মানাসিকুল হাজ্জ ওয়াল উমরা’ এবং ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ‘আল-মানহাজ লি মুরিদিল উমরা ওয়াল হাজ্ব)। গৃহীত: ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩১৮১৯ ও ৩১৮২২)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Translate