Saturday, November 8, 2025

তাসবিহ দানা ও কাউন্টার মেশিন ইত্যাদি দ্বারা তাসবিহ গণনা করা কি বিদআত

 প্রশ্ন: পুঁথির মালা, কাউন্টার মেশিন, নুড়ি পাথর, খেজুর বা তেঁতুলের বীজ ইত্যাদি দ্বারা তাসবিহ গণনা করা কি বিদআত?

উত্তর: তাসবিহ দানা বা পুঁথির মালা দ্বারা তাসবিহ গণনা করাকে সরাসরি বিদআত বলা ঠিক নয়। তবে এভাবে বলা যায় যে, আঙ্গুলের কর দ্বারা গণনা ভালো। বরং এটাই সুন্নত। কিন্তু প্রয়োজনবোধে তাসবিহ দানা, কাউন্টার মেশিন কিংবা নুড়ি পাথর, খেজুর বা তেঁতুলের বীজ ইত্যাদি দ্বারা তাসবিহ গণনা করা জায়েজ আছে। যেমন: বয়োবৃদ্ধ বা অসুস্থ হওয়ার কারণে আঙ্গুল দ্বারা তাসবি গণনা করা কষ্ট হয় বা সংখ্যা মনে রাখতে না পারে ইত্যাদি। তবে শর্ত হল, মনকে রিয়া বা লোক দেখানো মনোভাব থেকে দূরে রাখবে। এ ব্যাপারে সাহাবিদের আমল পাওয়া যায়। অন্যথায় তাসবিহ দানা বা কাউন্টার মেশিন ইত্যাদি ব্যবহার না করাই ভালো। এতে রিয়া বা লোক দেখানোর মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
❖❖ এ বিষয়ে কয়েকটি বিশ্ব বরেণ্য কয়েকজন আলেমের ফতোয়া:
❑ ১. সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা শাইখ আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ.
প্রশ্ন: পূঁথির মালা দ্বারা তাসবিহ পাঠ করার হুকুম কী? এটা কি বিদআত?
উত্তর:
الراجح أنه لا حرج في ذلك؛ لأنه ورد عن بعض الصحابيات وعن بعض السلف التسبيح بالحصى، وبالنوى، والعقد لا بأس، لكن الأصابع أفضل، كونه يسبح بأصابعه كما كان النبي ﷺ يسبح بأصابعه، هذا هو الأفضل، هذا هو السنة بالأصابع.
وإن سبح بالسبحة، أو بالحصى، أو بالنواة بعض الأحيان في بيته؛ فلا بأس؛ لكن في المساجد عند الناس الأفضل بالأصابع كما كان النبي يفعل، عليه الصلاة والسلام.
“অগ্রগণ্য মতানুসারে এতে কোনও দোষ নেই। কারণ কিছু মহিলা সাহাবি এবং কিছু সালাফ থেকে পাথর, খেজুরের আঁটি এবং সুতায় গিঁটের তাসবিহ পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে।
সুতরাং এতে কোনও সমস্যা নেই। তবে আঙ্গুল উত্তম। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন আঙ্গুল দিয়ে তসবিহ গণনা করতেন, তেমনি আঙ্গুল দিয়ে তসবিহ গণনা করা। এটাই সবচেয়ে উত্তম-এটাই সুন্নাহ। আর যদি কেউ মাঝে মাঝে নিজের ঘরে পুঁথির মালা, পাথর বা খেজুরের আঁটি দিয়ে তসবিহ গণনা করে তাহলে কোনও দোষ নেই। কিন্তু মসজিদে লোকদের মাঝে আঙ্গুল দিয়ে তসবিহ গণনা করাই উত্তম—যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন।”
❑ ২. আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ.
বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ শাইখুল ইসলাম আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রহ. বলেন,
التسبيح بالمسبحة لا نقول إنه بدعة لأن التسبيح بالمسبحة لا يقصد به االتعبد إنما يقصد به ضبط العدد فهو وسيلةٌ وليس بغاية فعلى هذا لا نقول إنه بدعة ولكننا نقول إن التسبيح بالأصابع أفضل لأن هذا هو الذي أرشد إليه رسول الله صلى الله عليه وسلم في قوله (اعقدن بالأنامل فإنهن مستنطقات) وهذا يدل على أن الأفضل العقد بالأنامل لأنها سوف تشهد يوم القيامة بالعمل الذي حركت فيه والتسبيح بالمسبحة فيه شيء.
أولاً أنه خلاف ما أرشد إليه النبي صلى الله عليه وسلم.
وثانياً أنه قد يجر إلى الرياء كما يشاهد بعض الناس الذين يتقلدون مسابح في أعناقهم في المسبحة ألف خرزة كأنما يقول للناس انظروا فإننا نسبح ألف مرة فهو يحمل على الرياء.
ثالثاً أن من يسبح بالمسبحة تجد قلبه غافلاً يفرغ هذا الخرز وعيناه تدوران يميناً وشمالاً أويتجول يميناً وشمالاً فاستعمال المسبحة أقرب للغفلة من استعمال الأصابع ولهذا ينبغي للإنسان أن يعقد التسبيح بأصابعه والأفضل أن يكون ذلك باليد اليمنى وإن عقد باليدين جميعاً فلا بأس.
“তাসবিহ দানা বা পুঁথির মালা দিয়ে তাসবিহ গণনা করাকে আমরা বিদআত বলব না। কারণ তাসবি দানা দিয়ে তাসবিহের উদ্দেশ্য ইবাদত নয় বরং এটি শুধুমাত্র সংখ্যা গণনার একটি উপায়।
এটি একটি মাধ্যম মাত্র; মূল লক্ষ্য নয়। তাই এটিকে বিদআত বলা যায় না। কিন্তু আমরা বলব যে, আঙ্গুল দিয়ে তাসবিহ গণনা করা অধিক উত্তম। কারণ এটিই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশিত পথ। তিনি বলেছেন: “আঙ্গুল দিয়ে গণনা করো। কারণ আঙ্গুলগুলো সাক্ষ্যদানকারী।” এটা প্রমাণ করে যে, আঙ্গুল দিয়ে গণনা করা উত্তম। কারণ কিয়ামতের দিন এই আঙ্গুলগুলো সাক্ষ্য দেবে যে, তাদের মাধ্যমে কী কাজ করা হয়েছে।
কিন্তু তাসবি দানা ব্যবহারে কিছু সমস্যা রয়েছে। যেমন:
◆ প্রথমত: এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুতি।
◆ দ্বিতীয়ত: এটি রিয়া বা লোক দেখানোর দিকে নিয়ে যেতে পারে।
আমরা দেখি, কিছু লোক গলায় হাজার দানার মতো বড় তাসবিহ দানা ঝুলিয়ে রাখে, যেন লোকদের বলছে: “দেখো, আমি হাজার বার তাসবিহ পাঠ করি!” এটি রিয়া বা লোক দেখানো মনোভাবের সৃষ্টি করে।
◆ তৃতীয়ত: যে ব্যক্তি তাসবিহ দানা দিয়ে তাসবিহ পড়ে কিন্তু তার অন্তর উদাসীন থাকে। এ অবস্থায় সে এদিক-সেদিক তাকায় আর ঘোরাঘুরি করে।
তাই আঙ্গুল ব্যবহারের থেকে তাসবিহ দানা ব্যবহার বেশি উদাসীনতার দিকে নিয়ে যায়।
অতএব, মানুষের উচিত আঙ্গুল দিয়ে তাসবিহ গণনা করা‌। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম হল, ডান হাত দিয়ে তাসবিহ গণনা করা। যদি দুই হাতেই করে তাতেও কোনও সমস্যা নেই।”
[উৎস: কিতাবুল আজকার/ ফাতাওয়া নূর আলাদ দারব, ২৪র্থ খণ্ড/২য় পৃষ্ঠা]
❑ ৩. সৌদি আরবের বর্তমান প্রধান মুফতি আল্লামা শাইখ সালেহ আল ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ):
প্রশ্ন: আল্লাহর জিকির স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাসবিহ দানা (পুঁথির মালা) ব্যবহার করার হুকুম কী?
উত্তর: যদি কোনও ব্যক্তি এই বিশ্বাসে তাসবিহ দানা ব্যবহার করে যে, এটি ব্যবহার করায় কোনও ফজিলত রয়েছে এবং এটি আল্লাহ তাআলার জিকিরের অন্যতম মাধ্যম, তাহলে এটি বিদ’আত।
কিন্তু যদি কেউ এটিকে মুবাহ (বৈধ) কাজ হিসেবে ব্যবহার করে অথবা যে সংখ্যা গণনা করা তার জন্য জরুরি, তা গণনা করার জন্য ব্যবহার করে তাহলে এটি বৈধ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু এটিকে যদি দ্বীন (ধর্ম) বা নৈকট্যের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাহলে এটি নব-আবিষ্কৃত বিদ’আত বলে গণ্য হবে।
যখন কোনও ব্যক্তি তাসবিহ করতে চায়, তখন তার উচিত হল, তা আঙুল গুনে (আঙুলের গিঁট বা কর গুনে) আল্লাহর তাসবিহ গণনা করা। এটাই করা উচিত।
কিন্তু তাসবিহকে এই বিশ্বাসে গ্রহণ করা যে, এটির মধ্যে কোনও ফজিলত রয়েছে, যেমনটা কিছু সুফি এবং তাদের অনুসারীরা বিশ্বাস করে—যার ফলে আপনি তাদের অনেককে বিশাল বিশাল পুঁথির দানা বহন করতে এবং গলায় ঝুলিয়ে রাখতে দেখবেন—এটি এমন একটি ভিত্তিহীন বিদ’আত । এটি রিয়া (লোক দেখানো)-এর অন্তর্ভুক্তও হতে পারে। আল্লাহই ভালো জানেন।
❑ শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেছেন:
عد التسبيح ‏بالأصابع سنة‎…‎‏ وأما عده بالنوى والحصى ونحو ذلك فحسن، وكان من ‏الصحابة رضي الله عنهم من يفعل ذلك، وقد رأى النبي صلى الله عليه وسلم ‏أم المؤمنين تسبح بالحصى، وأقرها على ذلك. وروي أن أبا هريرة كان يسبح ‏به. وأما التسبيح بما يجعل في نظام الخرز ونحوه، فمن الناس من كرهه، ومنهم ‏من لم يكرهه، وإذا أحسنت فيه النية فهو حسن غير مكروه، وأما اتخاذه من ‏غير حاجة، أو إظهاره للناس مثل: تعليقه في العنق، أو جعله كالسوار في اليد، ‏أو نحو ذلك، فهذا إما رياء للناس، أو مظنة المراءاة ومشابهة المرائين من غير ‏حاجة، والأول محرم، والثاني أقل أحواله الكراهة‎…‎‏) انتهى من مجموع الفتوى ( ‏‏22/506
“আঙ্গুলের মাধ্যমে তাসবিহ গণনা করা সুন্নত…। আর বীজ, পাথর ইত্যাদি দিয়ে তাসবিহ গণনা করা ভালো।
সাহাবায়ে কেরামের রা. মধ্যে কেউ কেউ এটি করতেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মুল মুমিনিনকে পাথর দিয়ে তাসবিহ গণনা করতে দেখেছিলেন এবং তিনি তাকে সে ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন।
আরও বর্ণিত আছে যে, আবু হুরায়রা (রা.) পাথর দিয়ে তাসবিহ গণনা করতেন। আর দানা/পুঁতি গেঁথে তৈরি করা জিনিস (যেমন: বর্তমানের তাসবিহ) দিয়ে তাসবিহ গণনার বিষয়ে কথা হল, কিছু মানুষ এটিকে অপছন্দ করেছেন, আবার কিছু মানুষ এটিকে অপছন্দ করেননি। তাদের মতে যদি এতে সৎ নিয়ত থাকে তবে তা ভালো; অপছন্দনীয় নয়। কিন্তু এটি প্রয়োজন ছাড়া গ্রহণ করা অথবা মানুষের কাছে প্রকাশ করা, যেমন: গলায় ঝুলিয়ে রাখা বা হাতে চুড়ির মতো পরে থাকা অথবা এ জাতীয় কিছু তাহলে এটি হয় মানুষকে দেখানোর জন্য (রিয়া), অথবা রিয়ার সুযোগ তৈরি করা এবং প্রয়োজন ছাড়া রিয়াকারীর সাথে সাদৃশ্য তৈরি করা। প্রথমটি (রিয়া) হারাম আর দ্বিতীয়টি (রিয়ার সুযোগ তৈরি করা) অন্ততপক্ষে মকরুহ (অপছন্দনীয়)।” [মাজমু’উল ফাতাওয়া ২২/৫০৬ থেকে]
তাসবিহ গণনার জন্য আঙ্গুল ব্যবহার করাই সর্বোত্তম সুন্নাহ হলেও, প্রয়োজন হলে (যেমন—অসুস্থতা বা সংখ্যা মনে রাখতে না পারা) পুঁথির মালা, কাউন্টার মেশিন বা নুড়ি পাথর, খেজুর বা তেঁতুল বীজ ইত্যাদি ব্যবহার করা জায়েজ আছে। তবে রিয়া (লোক দেখানো মনোভাব) থেকে মুক্ত থাকতে হবে এবং সাধারণ অবস্থায় এটি ব্যবহার না করাই উত্তম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate