Saturday, November 8, 2025

জ্ঞান শেখার আগে আদব বা শিষ্টাচার শেখার গুরুত্ব

 ইসলামের দৃষ্টিতে আদব তথা শিষ্টাচার, ভদ্রতা এবং সুন্দর আচার-আচরণ বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষের জ্ঞানের বহর কম থাকলেও যদি তার মধ্যে থাকে, বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, মানবতাবোধ, পরোপকার এবং সুন্দর আচার-আচরণ তাহলে তার মধ্যে বেশি কল্যাণ রয়েছে—ওই ব্যক্তির চেয়ে, যার উচ্চ শিক্ষার সনদ এবং বিশাল জ্ঞানের বহর আছে কিন্তু সে বেয়াদব ও চরিত্রহীন। এইজন্যেই বলা হয়,“দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।” প্রকৃতপক্ষে যে শিক্ষা মানুষকে সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা, ক্ষমা, ভদ্রতা ও ন্যায়পরায়নতা ইত্যাদি মানবিক গুণে অলংকৃত করে না তা কোন শিক্ষা নয়। যে শিক্ষা মানুষকে মানুষের প্রতি মানুষের সম্মানবোধ, মানুষের অধিকার রক্ষা এবং মানবতা শেখায় না তা কোন শিক্ষা নয়। যে শিক্ষা মানুষকে অহংকারী, অসভ্য ও বেয়াদব করে তোলে তা হল, শিক্ষার নামে কুশিক্ষা।

তাই জ্ঞান শেখার চেয়ে ভালো ব্যবহার ও চরিত্র গঠনকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নিম্নে জ্ঞানের পাহাড় জমানোর চেয়ে আদব-কায়দা এবং ভদ্রতা ও চরিত্র শেখার প্রতি আমাদের সালাফ বা পূর্বসূরিগণ কতটা গুরুত্ব দিতেন তার কিছু চিত্র তুলে ধরা হল:
✪ ১. ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. বলেন:
طلبت الأدب ثلاثين سنةً, وطلبت العلم عشرين سنةً, وكانوا يطلبون الأدب قبل العلم
“আমি ত্রিশ বছর ধরে আদব শিখেছি, আর বিশ বছর জ্ঞান (ইলম) শিখেছি। সালাফগণ তথা পূর্বসূরিগণ জ্ঞানের আগে আদব শিখতেন।”
[ইবনু জাযারী, গায়াতুন নিহায়া, ১/৪৪৬]
✪ ২. তিনি আরও বলেন:
“نحن إلى قليل من الأدب أحوج منا إلى كثير من العلم
“আমাদের বেশি জ্ঞানের চেয়ে অল্প আদবের বেশি প্রয়োজন।”
[ইবনুল কায়্যিম, মাদারিজুস সালিকীন, ২/৩৫৬]
✪ ৩. খতিব আল বাগদাদী তাঁর ‘আল জামে’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, ইবনু সিরিন বলেছেন:
“সালাফগণ যেমন জ্ঞান শিখতেন, তেমনি সুন্দর চালচলন ও উত্তম চরিত্র শিখতেন। ইবনে সিরিন একজনকে পাঠিয়েছিলেন যেন সে বিশিষ্ট তাবেয়ী কাসেম (মুহাম্মদ বিন আবু বকর সিদ্দিক রা.) এর চালচলন ও অবস্থা দেখে আসে।”
[খতিব আল বাগদাদি, আল জামে, ১/৭৯]
✪ ৪. ইবরাহিম ইবনে হাবিব ইবনুশ শহিদ বলেন, তাঁর পিতা তাঁকে বলেছিলেন:
يا بنيَّ، ايتِ الفقهاءَ والعلماء، وتعلم منهم، وخُذْ مِن أدبهم وأخلاقهم وهَدْيِهم؛ فإن ذاك أحبُّ إليَّ لك من كثير من الحديث
“হে আমার সন্তান, তুমি ফকিহ ও উলামাদের কাছে যাও, তাদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করো এবং তাদের আদব, নৈতিকতা ও চালচলন থেকে শিক্ষা নাও। কারণ আমার কাছে, এটি তোমার জন্য প্রচুর পরিমাণ হাদিস শেখার চেয়েও বেশি পছন্দনীয়।”
[খতিব আল বাগদাদী, আল জামে, ১/৮০]
✪ ৫. ইমাম ইবনু মুফলিহ আল মাকদিসি রাহ. এই মহান আদবের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ইলমের অলঙ্কার পরার আগে আদবের অলঙ্কার পরিধান করা উচিত।
এবং প্রত্যেক মুমিনের উচিত, সকল অবস্থায় এই আদবগুলো (শিষ্টাচার/নিয়মগুলো) মেনে চলা/অনুসরণ করা।
✪ ৬. উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন,
تأدبوا ثم تعلموا
“তোমরা প্রথমে আদব শিখো, তারপর জ্ঞান (ইলম) অর্জন করো।”
✪ ৭. আবু আব্দুল্লাহ আল বালখি বলেছেন:
أدبُ العلم أكثرُ من العلم
“জ্ঞানের আদব জ্ঞানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
✪ ৮. আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন:
إذا وُصِف لي رجلٌ له علم الأولين والآخِرين لا أتأسَّف على فَوْت لقائه، وإذا سمعت رجلاً له أدب القسِّ أتمنى لقاءَه وأتأسَّف على فَوته
“যদি আমাকে এমন ব্যক্তির কথা বলা হয়, যার পূর্বাপর সকল জ্ঞান আছে, তার সাথে দেখা না হলেও আমি দুঃখ করি না। কিন্তু যদি শুনি কারো উত্তম আদব আছে, তাহলে তার দেখা পেতে ইচ্ছা করি এবং সাক্ষাৎ না হলে আফসোস করি।”
[আল-মাকদিসী, আল-আদাবুশ শারইয়্যাহ, ৪/২০৭]
✪ ৯. আলি ইবনে আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সূরা তাহরিম-এর নিমোক্ত ৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা করো”) অর্থাৎ তাদেরকে আদব (শিষ্টাচার) শিক্ষা দাও এবং তাদেরকে জ্ঞান (ইলম) শিক্ষা দাও।”
[আল-মাকদিসী, আল-আদাবুশ শারইয়্যাহ, ৪/২০৮-২০৯]
তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত, জ্ঞানের চেয়ে সন্তানদের আদব ও নৈতিকতার ওপর বেশি জোর দেওয়া, যাতে এমন একটি প্রজন্ম তৈরি হয় যারা জ্ঞান অর্জনের আগেই জ্ঞানী ও জ্ঞানের মূল্য বুঝতে পারে।
মূল উৎস: alukah
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদ আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate