Friday, October 31, 2025

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম এবং তাঁর দাফনের স্থান কি কাবাঘরের চেয়ে অধিক মর্যাদা সম্পন্ন

 প্রশ্ন: রাসূল (ﷺ) কি আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম এবং তাঁর দাফনের স্থান কি কাবাঘরের চেয়ে অধিক মর্যাদা সম্পন্ন?

▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর প্রথমেই বলা প্রয়োজন—এটি মূলত একটি অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর জানার মধ্যে কোনো শারঈ কল্যাণ বা বাস্তব উপকার নেই। বরং আমাদের কর্তব্য হলো এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন থেকে দূরে থাকা এবং পরিবর্তে দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহ—যেমন আকীদা, মানহাজ ও আমলের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া।
.
দ্বিতীয়ত: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা, ফযীলত ও বিশেষ গুণাবলীর ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহতে অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে যা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল স্পষ্টভাবে আমাদেরকে জানিয়েছেন, তা থেকে কোনো সুস্পষ্ট নস নেই যেখানে সরাসরি বলা হয়েছে যে তিনি আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। বরং কুরআন সুন্নাহর দলিল দ্বারা যা পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত হয়েছে তা হলো—তিনি মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ, আদম সন্তানের নেতা এবং মানুষের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন রাসূল। যেমন আবু হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: (أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، وَأَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ ﷺ وَأَوَّلُ شَافِعٍ ، وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ) “কিয়ামতের দিন আমি হব বনী আদমের নেতা। আমার কবর প্রথম উন্মুক্ত করা হবে, আমিই হব প্রথম সুপারিশকারী ব্যক্তি এবং প্রথম যার সুপারিশ গৃহীত হবে”।(সহীহ মুসলিম হা/৫৮৩৪) একদল আলেম এই হাদিস এবং নবী (ﷺ)-এর ফযীলত সম্পর্কিত অন্যান্য প্রমাণাদি থেকে এটি ব্যাখ্যা করেছেন যে, তিনিই সৃষ্টির সেরা। উদাহরণস্বরূপ:
.
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর শরহে মুসলিম-এ ‘আমি আদম সন্তানের সরদার’ মর্মে বর্ণিত হাদীছের উপর এই নামে অধ্যায় রচনা করেছেন,باب تَفْضِيلِ نَبِيِّنَا صلى الله عليه وسلم عَلَى جَمِيعِ الْخَلاَئِقِ রাসূল (ﷺ) -এর সকল সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব’ অধ্যায়। এরপর হাদিসটির ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর “শারহু সহীহ মুসলিম” গ্রন্থে বলেন:وهذا الحديث دليل لتفضيله صلى الله عليه وسلم على الخلق كلهم ، لأن مذهب أهل السنة أن الآدميين أفضل من الملائكة ، وهو صلى الله عليه وسلم أفضل الآدميين وغيرهم”এই হাদীসটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমগ্র সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়ার প্রমাণ, কারণ আহলে সুন্নাহর মত হলো:মানুষ ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর মুহাম্মাদ (ﷺ) সকল মানুষ ও অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ’।”(নববী শারহু সহীহ মুসলিম খণ্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ৪১৩)
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:وقد اتفق المسلمون على أنه صلى الله عليه وسلم أعظم الخلق جاها عند الله، لا جاه لمخلوق أعظم من جاهه، ولا شفاعة أعظم من شفاعته”মুসলিমদের মধ্যে এ বিষয়ে সর্বসম্মত মত (ইজমা) রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আল্লাহর নিকট সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন। সৃষ্ট কোন কিছুর মর্যাদা তাঁর মর্যাদার ঊর্ধ্বে নয়, এবং কোন শাফাআত (সুপারিশ) তাঁর শাফাআতের চেয়ে মহান নয়।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৪৫)
.
একদল আহালুল আলেমদের কলম সর্বদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে “সৃষ্টির সেরা” বলে বর্ণনা করে আসছেন। আলোচনা দীর্ঘায়িত হবে বলে আমরা কেবল তাদের উক্তির কিছু নিদর্শনের দিকেই ইঙ্গিত করছি। উদাহরণস্বরূপ দেখুন: (১).ইমাম শাফিঈ,”আল-উম্ম” খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৬৭)। (২).ইমাম আব্দুর রাজ্জাক আল-সান’আনি, তাঁর “মুসান্নাফ” খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪১৯)। (৩).শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩১৩; এবং খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১২৭, ৪৬৮)। (৪).ইমাম ইবনু কাইয়িম,”তাহযীবুস সুনান” হাদীস নং ১৭৮৭?। (৫).হাফিয ইবনে হাজার,ফাতহুল বারী” হাদীস নং ৬২২৯)-এর ব্যাখ্যা। (৬).আল-মিরদাওয়ী ‘আল-ইনসাফ’ খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৪২২)। (৭).আল-আলূসী, রুহুল মা’আনী; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা; ২৮৪। (৮).শাইখ তাহির ইবনু ‘আশূর (রাহিমাহুল্লাহ) তার তাফসীর; আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪২০)। (৯).শাইখ আব্দুর রহমান আস-সা’দী;তাফসিরে সা’দী; পৃষ্ঠা: ৫১, ১৮৫, ৬৯৯)। (১০).শাইখ মুহাম্মদ আল-আমীন আস-শানক্বিতী; আযওয়াউল বায়ান; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ২১৫। (১১).ইমাম আব্দুল আযীয বিন বায, মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৭৬, ৩৮৩)।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে প্রশ্ন করা হয়েছিল:আমরা কি বলতে পারি যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি, নাকি তিনি সমগ্র সৃষ্টির মধ্যেই শ্রেষ্ঠ? আর অনেকে যেমন বলেন:“তিনি সমগ্র সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ”—এই কথার কোনো শারঈ প্রমাণ কি রয়েছে?
জবাবে তারা বলেছেন:
:”جاء في نصوص كثيرة من الكتاب والسنة بيان عظم قـدر نبينا محمد صلى الله عليه وسلم ورفعة مكانته عند ربه تعالى من خلال الفضائل الجليلـة والخصائص الكريمة التي خصه الله بها ، مما يدل على أنه أفضل الخلق وأكرمهم على الله وأعظمهم جاها عنده سبحانه ، قال الله سبحانه : (وَأَنْزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا) النساء/113 ، وأجنـاس الفضل التي فضله الله بها يصعب استقصاؤها ؛ فمن ذلك : أن الله عز وجل اتخذه خليلا ، وجعله خاتم رسله ، وأنزل عليه أفضل كتبه ، وجعل رسالته عامة للثقلين إلى يوم القيامة ، وغفر له ما تقدم من ذنبه وما تأخر ، وأجرى على يديه من الآيات ما فاق به جميع الأنبياء قبله ، وهو سيد ولد آدم ، وأول من ينشق عنه القبر ، وأول شافع ، وأول مشفع ، وبيده لواء الحمد يوم القيامة ، وأول من يجوز الصراط، وأول من يقرع باب الجنة ، وأول مـن يدخلها . . . إلى غير ذلك مـن الخصائص والكرامات الواردة في الكتاب والسنة ، مما جعل العلماء يتفقون على أن النبي صلى الله عليه وسلم هو أعظم الخلق جاها عند الله تعالى ، قـال شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله تعالى : “وقد اتفق المسلمون على أنه صلى الله عليه وسلم أعظم الخلق جاها عند الله ، لا جاه لمخلوق أعظم من جاهه ، ولا شفاعة أعظم من شفاعته” .فمما ذُكر وغيره يتبين أن نبينا محمدا صلى الله عليه وسلم هو أفضل الأنبياء ، بل وأفضل الخلق ، وأعظمهم منزلة عند الله تعالى ، ولكن مع هذه الفضائل والخصائص العظيمة فإنه صلى الله عليه وسلم لا يرقى عن درجة البشرية ، فلا يجـوز دعاؤه والاستغاثة به من دون الله عز وجل ، كما قـال تعالى: ( قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا ) الكهف/110، وبالله التوفيق ، وصلى الله على نبينا محمد وآله وصحبه وسلم”
“কুরআন ও সুন্নাহর বহু নস (দলিল)-এ আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহান মর্যাদা ও তাঁর রবের নিকট তাঁর উচ্চ স্থান সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে—যে মর্যাদা প্রকাশ পেয়েছে মহান সব গুণাবলি ও সম্মানজনক বৈশিষ্ট্যসমূহের মাধ্যমে, যা আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন।এসবই প্রমাণ করে যে, তিনি সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বোত্তম, আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত এবং তাঁর নিকট সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী।আল্লাহ তাআলা বলেন:”আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না তা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আপনার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে।”(সূরা আন-নিসা: ১১৩) অর্থাৎ:“আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং আপনাকে সে সমস্ত বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন যা আপনি জানতেন না। আর আপনার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ তো মহা অনুগ্রহ।”আল্লাহ তাঁকে যে সকল ফযীলত দ্বারা ভূষিত করেছেন, সেগুলোর সংখ্যা গণনা করা কঠিন। এর মধ্যে রয়েছে—আল্লাহ তাঁকে তাঁর খলীল (অন্তরঙ্গ বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করেছেন,তাঁকে তাঁর রাসূলদের মধ্যে সর্বশেষ রাসূল বানিয়েছেন, তাঁর উপর তাঁর শ্রেষ্ঠ কিতাব (আল কুরআন) নাযিল করেছেন, তাঁর রিসালাতকে কিয়ামত পর্যন্ত জিন ও মানবজাতির জন্য সাধারণ করেছেন, তাঁর আগের ও পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন, এবং তাঁর হাতে এমন সব মু’জিযা প্রকাশ করেছেন যা তাঁর পূর্বের সমস্ত নবীকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি আদম-সন্তানদের নেতা, সর্বপ্রথম তাঁর থেকে কবর বিদীর্ণ হবে,তিনিই সর্বপ্রথম সুপারিশকারী এবং সর্বপ্রথম যার সুপারিশ কবুল হবে। কিয়ামতের দিন তাঁর হাতে থাকবে প্রশংসার পতাকা (লিওয়াউল হামদ), সর্বপ্রথম তিনিই সিরাত (পুলসিরাত) পার হবেন, সর্বপ্রথম তিনিই জান্নাতের দরজায় কড়া নাড়বেন এবং সর্বপ্রথম তিনিই জান্নাতে প্রবেশ করবেন। …এছাড়াও কুরআন ও সুন্নাহতে তাঁর আরও বহু বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা উল্লেখিত হয়েছে।এসব প্রমাণের আলোকে আলেমগণ একমত হয়েছেন যে,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার কাছে সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী।শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যা (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন: “সমস্ত মুসলমান এ বিষয়ে একমত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই আল্লাহর নিকট সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান। কোনো মাখলুকের মর্যাদা তাঁর মর্যাদার চেয়ে বড় নয়, এবং কোনো শাফাআত (সুপারিশ) তাঁর শাফাআতের চেয়ে মহত্তর নয়।”অতএব, উপরোক্ত বিষয়াবলির দ্বারা এটি স্পষ্ট হয় যে—আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবল নবীদের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ নন, বরং সমগ্র সৃষ্টির মধ্যেই শ্রেষ্ঠতম এবং আল্লাহর নিকট সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী।তবে এই মহান মর্যাদা ও অসংখ্য ফযীলত থাকা সত্ত্বেও তিনি মানুষই;তিনি মানবতার সীমানা অতিক্রম করেননি।সুতরাং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাঁকে ডাকা, তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা কিংবা তাঁর উদ্দেশে ইবাদত করা জায়েয নয়।কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন:”বলুন, আমি তো তোমাদের মত একজন মানুষ, আমার প্রতি ওহী হয় যে, তোমাদের ইলাহ একমাত্র সত্য ইলাহ। কাজেই যে তার রব-এর সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকাজ করে ও তার রব-এর ইবাদাতে কাউকেও শরীক না করে।”(সূরা আল-কাহাফ: ১১০) অর্থাৎ:“বলুন: আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। আমার প্রতি ওহি প্রেরিত হয় যে, তোমাদের ইলাহ কেবল একজনই ইলাহ। সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে”।আল্লাহ্‌ই সবচেয়ে ভাল জানেন। আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সাহাবীবর্গের উপর আল্লাহ্‌র রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ২৬; পৃষ্ঠা: ৩৫)স্বাক্ষরকারী আলেমগণ: শাইখ আব্দুল আযিয বিন আব্দুল্লাহ্‌ আলে-শাইখ;শাইখ আব্দুল্লাহ্‌ বিন আব্দুর রহমান আল-গাদইয়ান,শাইখ সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান,শাইখ বকর বিন আব্দুল্লাহ্‌ আবু যাইদ (রাহিমাহুমুল্লাহ)।
.
প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা পরিষ্কার যে,অধিকাংশ আলেমদের মত হচ্ছে, আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ।তবে,কুরআন ও সুন্নাহতে সরাসরি এমন কোনো প্রমাণ নেই যা আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করে। তাই এই মাসালায় সর্বোত্তম এবং নিরাপদ মত হচ্ছে—নবী (ﷺ) সৃষ্টির সেরা” বলা অনেক আলেমের কাছে প্রচলিত হলেও,এর পক্ষে স্পষ্ট দলিল না থাকায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলা নিরাপদ নয়। বরং দলিল অনুযায়ী বলা উচিত: “নবী ﷺ হচ্ছেন আদম সন্তানদের নেতা, নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও আল্লাহর নিকট সর্বাধিক মর্যাদাবান। যেমনটি আমাদের ইমাম সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইবনু উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন। যেমন:
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন;
“المشهور عند كثير من العلماء إطلاق أن محمداً صلى الله عليه وسلم أفضل الخلق ، كما قال الناظم :وأفضل الخلق على الإطلاق *** نبينا فمل عن الشقاقلكن الأحوط والأسلم أن نقول: محمد صلى الله عليه وسلم سيد ولد آدم، وأفضل البشر، وأفضل الأنبياء، أو ما أشبه ذلك اتباعا لما جاء به النص، ولم أعلم إلى ساعتي هذه أنه جاء أن النبي صلى الله عليه وسلم أفضل الخلق مطلقاً في كل شيء . . . فالأسلم أن الإنسان في هذه الأمور يتحرى ما جاء به النص. مثلاً لو قال قائل: هل فضل الله بني آدم عموماً على جميع المخلوقات؟ قلنا: لا؛ لأن الله تعالى قال: (وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلاً) الإسراء/70 ، لم يقل : على كل من خلقنا، فمثل هذه الإطلاقات ينبغي على الإنسان أن يتقيد فيها بما جاء به النص فقط ولا يتعدى . والحمد لله ، نحن نعلم أن محمداً صلى الله عليه وسلم خاتم النبيين ، وأشرف الرسل وأفضلهم وأكرمهم عند الله عز وجل ، وأدلة ذلك من القرآن والسنة الصحيحة معروفة مشهورة ، وأما ما لم يرد به دليل صحيح فإن الاحتياط أن نتورع عنه ، لكنه مشهور عند كثير من العلماء ، تجدهم يقولون : إن محمداً أشرف الخلق”
“অনেক আলেমের মধ্যে এটাই প্রসিদ্ধ যে,তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টির সেরা বলে আখ্যায়িত করেন, যেমন কবি বলেছেন: وأفضل الخلق على الإطلاق نبينا فمل عن الشقاق অর্থাৎ:”সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছেন আমাদের নবী, সুতরাং এ বিষয়ে মতবিরোধ করো না।” কিন্তু সতর্ক ও নিরাপদ অবস্থান হলো এই বলা: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদম-সন্তানদের নেতা, মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ, নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, অথবা এই জাতীয় কিছু বলা,যা স্পষ্ট দলিল দ্বারা প্রমাণিত।আমার জানা মতে, এই মুহূর্ত পর্যন্ত এমন কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ আমার কাছে আসেনি যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিঃশর্তভাবে সব কিছুর মধ্যে সৃষ্টির সেরা…(অর্থাৎ, সব কিছু ও সব সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে সর্বোচ্চ) অতএব, এই বিষয়গুলিতে মানুষের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ হলো কেবল নসে যা এসেছে তার অনুসরণ করা এবং এর বাইরে না যাওয়া। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ প্রশ্ন করে: আল্লাহ কি সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতিকে সব সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন?’ তাহলে আমরা বলব: না, কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন—“আর অবশ্যই আমরা আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সাগরে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; এবং তাদেরকে উত্তম রিযক দান করেছি এবং আমরা যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর তাদেরকে শ্ৰেষ্ঠত্ব দিয়েছি।”(সূরা ইসরা ১৭: ৭০) এখানে আল্লাহ বলেননি,“আমার সমস্ত সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি”বরং বলেছেন,“অনেকের ওপর”।তাহলে বোঝা যায়, এই ধরনের সর্বজনীন বাক্য (মুতলাক বাক্য) ব্যবহার করার সময় মানুষকে অবশ্যই কুরআন ও সহীহ সুন্নাহতে যেমনভাবে এসেছে, তেমনভাবেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে, তার বাইরে যাওয়া উচিত নয়।আর সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য,আমরা জানি,মুহাম্মাদ (ﷺ) হচ্ছেন নবীদের সীলমোহর (শেষ নবী), রসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ,আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাবান। এর প্রমাণসমূহ কুরআন ও সহীহ হাদীসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত ও সুবিদিত।কিন্তু যেসব বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ও সহীহ প্রমাণ নেই, সেখানে সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বনই উত্তম পথ। তবে এটি (অর্থাৎ “মুহাম্মাদ ﷺ সৃষ্টির সেরা”)—অনেক আলেমদের মাঝে প্রচলিত বা সুপরিচিত বিষয়, আপনি দেখবেন,তারা বলে থাকেন “মুহাম্মাদ ﷺ হচ্ছেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম (অশরাফুল খলক)”।(ইবনু উসাইমীন; লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-৫৩/১১)
.
পরিশেষে, আমরা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর রাসূলের ভালোবাসা দান করেন, আমাদের কাছে তাঁকে সন্তানসন্ততি, পিতামাতা, পরিবার-পরিজন ও নিজেদের জানের চেয়ে বেশি প্রিয় করে দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানী।
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

আম্মাজান খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহা কি কখনও সালাত আদায় করেননি

 ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর, আমি দুটি বিষয়ে স্পষ্টভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব। প্রথমত, মিরাজের পূর্বে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ওপর সালাত আদায় ফরজ ছিল কি না এবং সে সময় তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ সালাত আদায় করতেন কি না; দ্বিতীয়ত, আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর জীবদ্দশায় সালাত আদায় করতেন কি না।

.
▪️প্রথমত: রাসূলুল্লাহ ﷺ মিরাজে যাওয়ার পূর্বে তাঁর ওপর সালাত আদায় ফরজ ছিল কি না; রাসূল (ﷺ) এবং তার সাহাবীগন সালাত আদায় করেছেন কিনা:
.
আলেমগণ সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছেন যে,রাসূল (ﷺ)-এর মিরাজ সংগঠিত হওয়ার পূর্বে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়নি। তবে কুরআন ও সুন্নাহর দলিল প্রমাণ করে যে,পুর্ববর্তী নবী-রাসূল ও তাঁদের উম্মতের উপর এবং একইভাবে সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (ﷺ) ও তার উম্মতের উপর সালাত ফরয ছিল।যেমন আল্লাহ বলেন,”আর আমরা ইব্রাহীম ও ইসমাঈলের কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারীদের জন্য, এখানে অবস্থানকারীদের জন্য এবং রুকূকারী ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।”(সূরা বাক্বারাহ ২/১২৫)। তিনি মূসা (আঃ)-কে বলেন,”আমরা মূসা ও তার ভাইয়ের প্রতি নির্দেশ পাঠালাম যে, তোমরা তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য মিসরের মাটিতে বাসস্থান নির্মাণ কর এবং তোমাদের ঘরের মধ্যেই ক্বিবলা নির্ধারণ কর ও সেখানে ছালাত আদায় কর। আর তুমি মুমিনদের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও”(সূরা ইউনুস: ১০/৮৭)। তিনি ঈসা (আঃ)-এর মা মারিয়ামকে বলেন, ‘হে মারিয়াম! তোমার প্রতিপালকের ইবাদতে রত হও এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ ও সিজদা কর’ (সূরা আলে ইমরান ৩/৪৩)। রাসূল (ﷺ) বলেন, আমরা নবীগণ আদিষ্ট হয়েছি যেন আমরা দ্রুত ইফতার করি, দেরীতে সাহারী করি এবং ছালাতে বাম হাতের উপর ডান হাত রাখি”।(ত্বাবারাণী কাবীর হা/১১৪৮৫; সহীহুল জামে‘ হা/২২৮৬)
.
আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবিগণ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার আগেও নামাজ আদায় করতেন। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই মুসলিমদের জন্য নামাজ একটি ফরজ ইবাদত ছিল।এর প্রমাণ সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে পাওয়া যায়— যখন বাদশাহ হিরাক্লিয়াস (Heraclius) আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “তিনি (মুহাম্মাদ ﷺ) তোমাদের কী করতে নির্দেশ দেন?
জবাবে মুশরিক থাকা অবস্থায় আবু সুফিয়ান বলেন:তিনি বলেন:اعْبُدُوا اللَّهَ وَحْدَهُ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَاتْرُكُوا مَا يَقُولُ آبَاؤُكُمْ ؛ وَيَأْمُرُنَا بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ وَالصِّدْقِ وَالْعَفَافِ وَالصِّلَةِ”তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সঙ্গে কোন কিছুর অংশীদার সাব্যস্ত করো না এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা যা বলে তা ত্যাগ কর। আর তিনি আমাদের সালাত আদায়ের, সত্য বলার, চারিত্রিক নিষ্কলুষতার এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করার নির্দেশ দেন।”(সহীহ বুখারী হা/৭; সহীহ মুসলিম হা/১৭৭৩) এই হাদিসটি প্রমাণ করে যে,পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার আগেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন এবং অন্যদেরকেও ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানাতেন।
.
হাদিসটির ব্যাখ্যায় হাফিয ইবনু রজব আল-হাম্বালী আল-বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ [জন্ম: ৭৩৬ হি.মৃত:৭৯৫ হি:] বলেছেন:وهو يدل على أن النبي كان أهم ما يأمر به أمته الصلاة ، كما يأمرهم بالصدق والعفاف ، ، واشتُهر ذلك حتى شاع بين الملل المخالفين له في دينه ، فإن أبا سفيان كان حين قال ذلك مشركا ، وكان هرقل نصرانيا . ولم يزل منذ بُعث يأمر بالصدق والعفاف ، ولم يزل يصلي أيضا قبل أن تفرض الصلاة ​”আর এটি প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতের প্রতি যেসব বিষয়ের আদেশ দিতেন,সেগুলোর মধ্যে সালাত (নামাজ) ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ,যেমন তিনি তাদের সত্যবাদিতা ও সচ্চরিত্রতার (পবিত্রতার) আদেশ করতেন। এবং এই বিষয়টি এতটাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, এটি তাঁর ধর্মের বিরোধী জাতিগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল।কেননা, আবু সুফিয়ান যখন এ কথা বলেছিলেন,তখন তিনি ছিলেন একজন মুশরিক (বহু-ঈশ্বরবিশ্বাসী), আর হিরাক্লিয়াস ছিলেন একজন নাসারা (খ্রিস্টান)।আর তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রেরিত হওয়ার পর থেকেই মানুষকে সর্বদা সত্যবাদিতা ও সচ্চরিত্রতার (পবিত্রতার) নির্দেশ দিতেন, এবং সালাত ফরজ হওয়ার আগেও তিনি নিয়মিত সালাত আদায় করতেন।”​(ইবনু রজব আল-হাম্বালী, ফাতহুল বারী শারহু সাহীহিল বুখারী; খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১০১)
.
আহালুল আলেমগন বলেছেন, হিজরতের স্বল্পকাল পূর্বে মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ফজর ও আসরের সালাত দুই রাকআত করে আদায় করার বিধান কার্যকর ছিল। আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বর্ণনা করেন,”শুরুতে সালাত বাড়ীতে ও সফরে দু’ দু’ রাক‘আত করে ছিল।”(সহীহ মুসলিম হা/৬৮৫; আবূ দাঊদ হা/১১৯৮) অতঃপর মি‘রাজের রাত্রিতে চূড়ান্তভাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়। হাদিসে এসেছে,আনাস ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত।তিনি বলেন, মিরাজের রাতে রাসূল (ﷺ)-এর উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়েছিল। অতঃপর তা কমাতে কমাতে পাঁচ ওয়াক্তে সীমাবদ্ধ করা হয়। অতঃপর ঘোষণা করা হল, হে মুহাম্মাদ! আমার নিকট কথার কোনো অদল বদল নাই। তোমার জন্য এই পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব রয়েছে।”(সহীহ বুখারী হা/৩২০৭; মুসলিম হা/১৬২) অতঃপর মিরাজে রাসূল (ﷺ) তাঁর উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয হওয়ার পর সর্বপ্রথম যোহরের সালাত আদায় করেছিলেন।যেমন হাদীসে এসেছে,আবু বারাযাহ আসলামী (রাঃ)-কে রাসূল (ﷺ)-এর সালাতের সময় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যোহরের সালাত যাকে তোমরা প্রথম সালাত বলে থাক,সূর্য ঢলে পড়লে আদায় করতেন।”(সহীম বুখারী হা/৫৪৭; মিশকাত হা/৫৮৭)
.
▪️দ্বিতীয়ত: আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর জীবদ্দশায় সালাত আদায় করতেন কি না!
.
আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ছিলেন ইসলামের প্রথম মুমিনা নারী —আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনয়নে সর্বাগ্রে যিনি সাড়া দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নবী (ﷺ)-এর প্রথম স্ত্রী, তাঁর সন্তানদের জননী, এবং পূর্ণতার এক অনন্য প্রতীক। বুদ্ধিমত্তা, মহত্ত্ব, ধার্মিকতা ও মর্যাদার এক অসাধারণ সমন্বয় তাঁর চরিত্রে দীপ্তিমান ছিল।ইসলামের সূচনালগ্নে খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ছিলেন নবী ﷺ-এর অকুতোভয় সহচর ও অবিচল সমর্থক। যখন নবী ﷺ প্রথম ওহি লাভ করে উদ্বিগ্ন হয়ে ফিরে আসেন, তখন তিনিই ছিলেন তাঁর শান্তি ও সাহসের আশ্রয়স্থল। তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন— এমন মহৎ গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ কখনো অপমান বা কষ্ট বর্ষণ করবেন না। রাসূল ﷺ কে সান্তনা দানের ভাষা ছিল: وَاللهِ لاَيُخْزِيْكَ اللهُ اَبَدًا إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ وَتَحْمِلُ الْكَلَّ وَتَكْسِبُ الْمَعْدُوْمَ وَتَقْرِى الضَّيْفَ وَتُعِيْنُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ-“কখনোই না। আল্লাহর কসম! তিনি কখনোই আপনাকে অপদস্থ করবেন না। আপনি আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করেন, দুস্থদের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের কর্মসংস্থান করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন”।(সহীহ বুখারী হা/৩ সহীহ মুসলিম হা/১৬০; ইবনু হিশাম; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৭৩)।
.
নবী (ﷺ) খাদিজা (রা.)-কে জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও বারবার স্মরণ করতেন এবং তাঁর গুণাবলীর প্রশংসা করতেন।উদাহরণস্বরূপ; ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) সহিহ গ্রন্থে একটি পরিচ্ছেদের নাম দিয়েছেন: ‘খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহার সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবাহ ও তাঁর মর্যাদা’। উক্ত পরিচ্ছেদে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন: তিনি বলেন: “আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী খাদীজার প্রতি যে ঈর্ষা করেছি অন্য কোন স্ত্রীর প্রতি তেমন ঈর্ষা করিনি। কেননা আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর কথা বারবার আলোচনা করতে শুনেছি। অথচ আমাকে বিবাহ করার আগেই তিনি ইন্তিকাল করেছিলেন।”[হাদীসটি বুখারী (৩৮১৫) বর্ণনা করেন] শুধু তাই নয়,আম্মাজান খাদিজা (রাদিআল্লাহু আনহা) ছিলেন বিশ্বসেরা চারজন সম্মানিতা মহিলার অন্যতম। রাসূল (ﷺ) বলেন,أَفْضَلُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ وَفَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ وَمَرْيَمُ بِنْتُ عِمْرَانَ وَآسِيَةُ بِنْتُ مُزَاحِمٍ امْرَأَةُ فِرْعَوْنَ “জান্নাতী মহিলাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’লেন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম”। (মুসনাদে আহমাদ হা/২৬৬৮; তিরমিযী হা/৩৮৭৮) তিনি ছিলেন সেই মহীয়সী মহিলা যাকে জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) নিজের পক্ষ হতে ও আল্লাহর পক্ষ হতে রাসূল (ﷺ)-এর মাধ্যমে তাঁকে সালাম সালাম পাঠিয়েছিলেন” (বুখারী হা/১৭৯২, মুসলিম হা/২৪৩৩) পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতে এক মনোমোহন মতি দিয়ে তৈরি এমন একটি ঘরের সুসংবাদ দিয়েছেন যেখানে কোন শোরগোল থাকবে না এবং কোন প্রকার কষ্ট ক্লেশও থাকবে না— থাকবে শুধুই চিরন্তন শান্তি ও আনন্দ। অতঃপর, তিনি রাসূল (ﷺ)-এর নবুওয়াত শুরু হওয়ার সাত বছর পরে, অথবা বলা হয়েছে: দশ বছর পরে (এটিই অধিক সহিহ),পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এবং পর্দার বিধান ফরজ হওয়ার পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন।মৃত্যুর সময় আম্মাজানের বয়স ছিল পঁয়ষট্টি বছর। ​তাঁর জীবনী ও গুণাবলী সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: ইবনে আব্দুল বার-এর আল ইস্তিজকার; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৮১৭; এবং ইমাম যাহাবী-এর সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১০৯)
.
প্রিয় পাঠক, আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর উপরোক্ত গুণাবলীর আলোকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ছিলেন একাধারে ধার্মিক, নৈতিকভাবে দৃঢ় ও চরিত্রে অনন্য এক তাকওয়াবান নারী। তাঁর এই মহৎ চরিত্র, ধর্মনিষ্ঠা ও আল্লাহভীতির প্রেক্ষিতে সহজেই অনুমান করা যায় যে,তিনি নিয়মিত সালাত আদায় করতেন। সীরাত ইবনে হিশাম ও তাফসির ইবনে কাসীরের বর্ণনা অনুযায়ী, মক্কায় প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা গোপনে ও ব্যক্তিগতভাবে সালাত আদায় করতেন; মদিনায় হিজরতের পরই তারা প্রকাশ্যে ও জামায়াতে সালাত আদায়ের প্রথা শুরু করেন। সুতরাং, আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) মক্কা অবস্থাতেই নবী ﷺ-এর নির্দেশ অনুসারে নিয়মিত ইবাদত করতেন—যদিও সে সময় জামায়াতে সালাত আদায়ের প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি সহীহ হাদীস ও নির্ভরযোগ্য সীরাতগ্রন্থসমূহে তাঁর সালাত আদায়ের স্পষ্ট প্রমাণও পাওয়া যায়। বহু বর্ণনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো—খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সেই সালাত আদায় করতেন যা তখন ফরজ ছিল; অর্থাৎ দিনের শুরুতে দুই রাকাআত ও দিনের শেষে দুই রাকাআত। এটি ছিল পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার আগের আমলের কথা।আমি আমার প্রিয় পাঠকদের উদ্দেশ্যে এখানে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত এমনই একটি রেওয়ায়াত উল্লেখ করছি—যেখান থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হবে আম্মাজান খাদিজা সালাত আদায় করেছেন।
.
আমাদেরকে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আমার পিতা (ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল) আমাকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আমাদেরকে ইয়াকুব ইবনু ইব্রাহিম আল-হানযলী (আবু ইউসুফ) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আমাকে আমার পিতা ইব্রাহিম ইবনু সা‘দ বর্ণনা করেছেন।তিনি বলেন: আমাকে মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেছেন।তিনি বলেন: আমাকে ইয়াহইয়া ইবনু আল-আশ্য‘আত বর্ণনা করেছেন, তিনি ইসমাঈল ইবনু ইয়া‘স ইবনু আফিফ আল-কিন্দি থেকে বর্ণনা করেছেন,তিনি তার পিতা ইয়া‘স থেকে, আর তিনি তার দাদা আফিফ আল-কিন্দি থেকে বর্ণনা করেন—যিনি বলেছেন:
كنت امرأً تاجرًا، فقدمت الحج، فأتيت العباس بن عبد المطلب رضي الله عنه لأبتاع منه بعض التجارة، وكان امرأً تاجرًا، فوالله إني لعنده بمنى، إذ خرج رجل من خباء قريب منه، فنظر إلى الشمس، فلما رآها مالت -يعني قام يصلي- قال: ثم خرجت امرأةٌ من ذلك الخباء الذي خرج منه ذلك الرجل، فقامت خلفه تصلي، ثم خرج غلام حين راهق الحلم من ذلك الخباء، فقام معه يصلي. قال: فقلت للعباس: من هذا يا عباس؟ قال: هذا محمد بن عبد الله بن عبد المطلب ابن أخي، قال: فقلت: من هذه المرأة؟ قال: هذه امرأته خديجة ابنة خويلد. قال: قلت: من هذا الفتى؟ قال: هذا علي بن أبي طالب ابن عمه. قال: فقلت: فما هذا الذي يصنع؟ قال: يصلي، وهو يزعم أنه نبي، ولم يتبعه على أمره إلا امرأته، وابن عمه هذا الفتى، وهو يزعم أنه سيفتح عليه كنوز كسرى، وقيصر”. قال: فكان عفيف رضي الله عنه-وهو ابن عم الأشعث بن قيس رضي الله عنه- يقول -وأسلم بعد ذلك، فحسن إسلامه-: “لو كان الله رزقني الإسلام يومئذٍ، فأكون ثالثًا مع علي بن أبي طالب رضي الله عنه”
আমি একজন ব্যবসায়ী ছিলাম।একবার হজের উদ্দেশ্যে (মক্কায়) এসে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে গেলাম, তাঁর কাছ থেকে কিছু বাণিজ্যিক সামগ্রী কিনবার জন্য। তিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। আল্লাহর কসম, আমি যখন মিনায় তাঁর কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন তাঁর কাছের একটি তাঁবু থেকে একজন ব্যক্তি বেরিয়ে আসতে দেখলাম। সে সূর্যের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াল; যখন সে দেখল সূর্য হেলে পড়েছে, (অর্থাৎ দুপুরের ওয়াক্ত হয়েছে), তখন তিনি নামাজ পড়তে দাঁড়ালেন।এরপর সেই তাঁবু থেকে একজন নারী বেরিয়ে এল এবং তিনি তার পিছনে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে লাগলেন। এরপরে সেই তাঁবু থেকে এক যুবক বেরিয়ে এল,যে সবেমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কাছাকাছি (কিশোর) হয়েছে,এবং তিনি তাদের সাথে সালাত আদায় করতে লাগলেন। আমি আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলাম:‘এই ব্যক্তি কে?’ তিনি বললেন, ‘এটি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম: ‘আর এই মহিলাটি কে?’ তিনি বললেন: ‘ইনি তার স্ত্রী খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম: ‘আর এই কিশোরটি কে?’ তিনি বললেন: ‘ইনি তার চাচাতো ভাই আলী ইবনে আবী তালিব।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম: ‘এরা কী করছে?’ তিনি বললেন: ‘ইনি (মুহাম্মদ) নামাজ পড়ছেন এবং তিনি দাবী করেন যে তিনি একজন নবী। তার স্ত্রী এবং এই কিশোর চাচাতো ভাই ছাড়া আর কেউ তার অনুসারী হয়নি। আর তিনি (মুহাম্মদ) দাবী করেন যে খুব শীঘ্রই তার জন্য কিসরা (পারস্য সম্রাট) ও কাইসারের (রোম সম্রাট) ধনভান্ডার জয় হবে।” বর্ণনাকারী বলেন, পরে আফীফ (যিনি আশ’আস ইবনে কায়েসের চাচাতো ভাই) ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার ইসলাম গ্রহণ ছিল অত্যন্ত চমৎকার। তিনি আফসোস করে বলতেন:”যদি আল্লাহ সেদিনই আমাকে ইসলামের সৌভাগ্য দিতেন, তবে আমি আলী ইবনে আবী তালিবের সাথে দ্বিতীয় অনুসারী হতাম।” (অন্য বর্ণনায়: তৃতীয় হতাম,কেননা খাদীজা রা: প্রথম)।(মুসনাদে আহমেদ হা/১৭৮৭;তাবারানি কাবীর খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ১০০ হা/১৮১; হাইছামী; ‘মাজমাউয যাওয়ায়েদ’ খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ১০২; ইমাম বুখারী; তারীখুল কাবীর; খণ্ড: ৭: পৃষ্ঠা: ৭৩)
তাহক্বীক: হাদীসটি সহীহ জয়ীফ নিয়ে কথা থাকলেও বহু ইমাম বিশুদ্ধ বলেছেন। উদাহরণস্বরূপ: শাইখ আহমাদ শাকির (রাহিমাহুল্লাহ) শারহু মুসনাদ আহমাদ (হা/১৭৮৭) এ বলেছেন: “এই হাদিসের সনদ সহীহ। ইমাম হাকিম তার মুস্তাদরক হাকিমে খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৮৩ হা/৪৮৪২ বর্ননা করে বুখারি মুসলিমের শর্তে হাদিসটি সহীহ বলেছেন।ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) তালখিস আল-মুস্তাদরক-এ সনদ সঠিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন; “এই হাদীসটি আবু ইয়ালা তাঁর মুসনাদে খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১১৭; হাদীস নং ১৫৪৭)-এ বর্ণনা করেছেন। শাইখ হুসাইন সালিম আসাদ, যিনি মুসনাদ আবু ইয়ালা-এর তাহকীক করেছেন, তিনি বলেছেন: ‘এর সনদ (ইসনাদ) হাসান। এবং ইমাম ইবনে আব্দিল বার আল ইস্তিজকার; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১২৪১-এ আফিফ আল-কিনদির জীবনী উল্লেখ করেছেন এবং এই হাদিসটি উল্লেখ করে বলেছেন:এই হাদিস অত্যন্ত উৎকৃষ্ট।
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার আলোকে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর জীবদ্দশায় নিয়মিত সালাত আদায় করতেন। অতএব, যারা বলেন যে তিনি জীবনে একবারও সালাত আদায় করেননি—তাদের এই বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভিত্তিহীন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক বোধ ও সঠিক উপলব্ধি দান করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানী।
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের বিবরণ এবং মৃতের সম্পদে জীবিতদের করণীয়

 মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের বিবরণ, মৃতের সম্পদে জীবিতদের করণীয় এবং তিনি যদি বিশেষ কোনও ব্যক্তিকে তার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণা দিয়ে যান তাহলে সে ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান।

প্রশ্ন: পবিত্র কুরআনের আলোকে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশ কারা? একজন মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের দায়িত্ব পরিবারের কার উপর বর্তায়? জীবিত থাকাকালীন যদি সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির কোনও নিষেধাজ্ঞা থাকে তবে কি তার মৃত্যুর পর তা দায়িত্ব পালনকৃত ব্যক্তি পালন করতে বাধ্য? ইসলামের আলোকে এর বিধি-বিধান সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। দয়া করে জানাবেন ইনশাআল্লাহ।
উত্তর: আপনার প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে পয়েন্ট আকারে এর উত্তর দেওয়া হল:
❑ কুরআনের আলোকে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশ কারা?
পবিত্র কুরআনের সূরা নিসা এর ১১, ১২ এবং ১৭৬ নং আয়াতে মৃত ব্যক্তির প্রধান ওয়ারিশ এবং তাদের প্রাপ্য অংশের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। মূলতঃ মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা উত্তরাধিকারী হন:
✪ ১. স্বামী বা স্ত্রী:
ক. স্বামী: মৃত স্ত্রীর যদি কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তান না থাকে তবে স্বামী সম্পত্তির অর্ধেক (১/২) পাবেন। সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকলে স্বামী এক-চতুর্থাংশ (১/৪) পাবেন।
খ. স্ত্রী: মৃত স্বামীর যদি কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তান না থাকে। তবে স্ত্রী এক-চতুর্থাংশ (১/৪) পাবেন। সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকলে স্ত্রী এক-অষ্টমাংশ (১/৮) পাবেন।
[সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১২]
✪ ২. সন্তান-সন্ততি:
মৃত ব্যক্তির পুত্র ও কন্যা উভয়ই ওয়ারিশ হবে।
বণ্টনের ক্ষেত্রে পুরুষ (পুত্র) নারীর (কন্যা) দ্বিগুণ অংশ লাভ করবে।
[সূরা আন-নিসা: ১১]
✪ ৩. পিতা-মাতা:
ক. মৃত ব্যক্তির যদি সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকে তবে পিতা ও মাতা প্রত্যেকেই এক-ষষ্ঠাংশ (১/৬) করে পাবেন।
খ. যদি মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান না থাকে এবং তার পিতা-মাতাই ওয়ারিশ হন তবে মাতা এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) পাবেন এবং বাকি অংশ পিতা পাবেন।
গ. মৃতের যদি ভাই বা বোন থাকে তবে মাতা এক-ষষ্ঠাংশ (১/৬) পাবেন।
[সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১]
✪ ৪. অন্যান্য দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজন:
উপরে উল্লিখিত প্রধান ওয়ারিশদের অনুপস্থিতিতে কিংবা অংশ দেওয়ার পরে বাকি সম্পদের জন্য অন্য নিকটাত্মীয়রা ওয়ারিশ হন। যেমন: দাদা-দাদি, নানা-নানি, ভাই-বোন (আংশিক বা সম্পূর্ণ), ভাতিজা-ভাতিজি চাচা-ফুফু প্রমূখগণ।
(চাচা-ফুফু এবং চাচাতো ভাই-বোনেরা কখন কীভাব মিরাস পায় তা টিকা থেকে দেখুন)
দ্রষ্টব্য: ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী, ওয়ারিশ নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট ক্রম ও পদ্ধতি (ফারাইয বা মিরাস) রয়েছে। নিকটতম ওয়ারিশের উপস্থিতিতে দূরবর্তী ওয়ারিশরা অনেক সময় সম্পদ থেকে বঞ্চিত হন।
❑ মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টনের দায়িত্ব কার?
মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের দায়িত্ব পরিবারের কারো উপর এককভাবে বর্তায় না। বরং মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ বণ্টন করার পূর্বে সেই সম্পদের উপর নিম্নলিখিত চারটি ক্রমানুসারে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কাজগুলো সম্পাদনের দায়িত্ব সাধারণত পরিবারের দায়িত্বশীল ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি (যেমন: পুত্র, স্বামী/স্ত্রী, বা নিকটাত্মীয়) ও এলাকার বিজ্ঞ ইসলামি স্কলার বা বিচারক যৌথভাবে পালন করবেন:
◈ ১. দাফন-কাফনের খরচ:
মৃত ব্যক্তিকে শরিয়ত মোতাবেক দাফন-কাফন করার জন্য প্রয়োজনীয় যুক্তিসঙ্গত খরচ প্রথমেই মৃত ব্যক্তির মোট সম্পত্তি থেকে আলাদা করতে হবে।
◈ ২. ঋণ পরিশোধ:
মৃত ব্যক্তির যদি কোনও ঋণ (আল্লাহর হক যেমন: কাফফারার ঋণ অথবা বান্দার হক্ব যেমন: মানুষের পাওনা ঋণ, স্ত্রী অপরিশোধিত মোহর ইত্যাদি ) থাকে, তবে তা দাফন-কাফনের খরচ বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি থেকে অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে। ঋণ পরিশোধে কোনও ধরনের বিলম্ব করা যাবে না।
◈ ৩. উইল বা অসিয়ত (যদি থাকে):
ঋণ পরিশোধের পর অবশিষ্ট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) পর্যন্ত সম্পদ থেকে মৃত ব্যক্তির বৈধ অসিয়ত (উইল) কার্যকর করতে হবে। তবে
– উইল বা অসিয়ত অবশ্যই শরিয়ত বিরোধী হওয়া যাবে না। শরিয়ত বিরোধী ওসিয়ত হলে তা বাস্তবায়ন করা জরুরি নয়।
অনুরূপভাবে ওয়ারিশদের জন্য কোনও অসিয়ত করা যাবে না। নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَعْطَى كُلَّ ذِي حَقٍّ حَقَّهُ ، فَلَا وَصِيَّةَ لِوَارِثٍ
“আল্লাহ প্রত্যেক হকদারকে তার হক দিয়েছেন, সুতরাং ওয়ারিশের জন্য কোনও অসিয়ত নেই।” [সহিহ সুনানে আবু দাউদ]
◈ ৪. ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন:
উপরে উল্লিখিত তিনটি কাজ সম্পন্ন করার পর যে সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে, তা কুরআনের আইন (ফারাইয) অনুযায়ী ওয়ারিশদের মধ্যে তাদের নির্ধারিত অংশ অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে।
❑ জীবিত থাকাকালীন সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা:
আপনার প্রশ্ন অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তি জীবিত থাকাকালীন যদি কোনও বৈধ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যান তবে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিকে তা পালন করতে হবে কি না:
◆ ১. বৈধ অসিয়তের ক্ষেত্রে: মৃত ব্যক্তি যদি তার মোট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) এর মধ্যে কোনও বৈধ অসিয়ত করে থাকেন (যেমন: কোনও দরিদ্রকে দান করা বা কোনও মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দেওয়া ইত্যাদি ) তবে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি সেই অসিয়ত পালন করতে বাধ্য। এটি একটি ঋণ পরিশোধের মতোই গণ্য হবে।
◆ ২. ওয়ারিশদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে: যদি কোনও ব্যক্তি তার জীবিতাবস্থায় কোনও ওয়ারিশকে তার প্রাপ্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার জন্য নিষেধাজ্ঞা বা অসিয়ত করে যান তবে ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী সেই নিষেধাজ্ঞা অবৈধ ও বাতিল বলে গণ্য হবে।
কারণ ওয়ারিশের অধিকার আল্লাহ তা’আলা নিজেই পবিত্র কুরআনে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কোনও মানুষের পক্ষে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এই অধিকার বাতিল করার বা পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই। দায়িত্বশীল ব্যক্তি এই ধরনের অবৈধ নিষেধাজ্ঞা পালন করতে বাধ্য নন। বরং তিনি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ওয়ারিশদের প্রাপ্য অংশ বণ্টন করতে বাধ্য।
দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীও এই নিষেধাজ্ঞা বাতিল।
মোটকথা, ওয়ারিশদের অংশ কমিয়ে দেওয়া বা সম্পূর্ণ বঞ্চিত করার নিষেধাজ্ঞা মৃত্যুর পর বাতিল হয়ে যাবে। তবে যদি তিনি দান বা জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য ১/৩ অংশের মধ্যে অসিয়ত করে যান তা অবশ্যই পালন করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর বিধান মেনে চলার তৌফিক দিন। আমিন।
————–
টিকা: মিরাসে চাচা ফুফু এবং তাদের ছেলে-মেয়েরা কখন অংশ পাবে?
আমাদের জানা দরকার যে, ইসলামি উত্তরাধিকার আইনে ওয়ারিশদের দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। যথা:
✪ ১. আসহাবুল ফুরুজ (নির্দিষ্ট অংশের অংশীদারগণ): এরা হলেন, যারা কুরআনে নির্ধারিত নির্দিষ্ট অংশ পাবেন (যেমন: আপনার স্ত্রী, সন্তান, বাবা, মা)।
✪ ২. আসাবা (অবশিষ্টভোগী): এরা নির্দিষ্ট অংশের অংশীদারদের অংশ দেওয়ার পর বাকি সম্পত্তি পান। এরাই মূলত মৃত ব্যক্তির বংশের পুরুষ আত্মীয়, যেমন: আপনার ছেলে, বাবা, দাদা, ভাই, চাচা ইত্যাদি।
◈ ১. আপনার চাচা (পিতার আপন ভাই) কখন মিরাস পাবেন?
আমরা জেনেছি যে, চাচা হলেন আসাবা (অবশিষ্টভোগী) শ্রেণীর ওয়ারিশ।
মৃত ব্যক্তির ছেলে বা ছেলের ঘরের ছেলে (নাতি) জীবিত থাকলে আপনার চাচা সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হবেন এবং কোনো অংশ পাবেন না।
কিন্তু যদি মৃত ব্যক্তির কোনো ছেলে বা ছেলের ঘরের ছেলে জীবিত না থাকে তাহলে আসহাবুল ফুরুজদের (যেমন: আপনার মা, মেয়ে বা স্ত্রী) নির্ধারিত অংশ দেওয়ার পর যে সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকবে তা আপনার চাচা (পিতার আপন ভাই) পাবেন।
◈ ২. আপনার ফুফু (পিতার আপন বোন) কখন মিরাস পাবেন?
ফুফুরা হলেন “জাবিল আরহাম” বা রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়ের অন্তর্ভুক্ত।
প্রথম স্তরের ওয়ারিশগণ তথা আপনার বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে, দাদা, দাদী, চাচা এদের মধ্যে কেউ জীবিত থাকলে সাধারণত ফুফু মিরাস থেকে বঞ্চিত হন।
কিন্তু যদি প্রথম স্তরের কোনো ওয়ারিশ তথা আসহাবুল ফুরুজ বা আসাবা শ্রেণীর কোনো ওয়ারিশ (অর্থাৎ, ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, বাবা, মা, চাচা, ভাই) জীবিত না থাকে তখন কেবলমাত্র সে ক্ষেত্রেই ফুফুরা নিকটতম রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় হিসেবে মিরাস পাবেন।
◈ ৩. চাচাতো ভাই/বোন এবং ফুফাতো ভাই/বোন (তাদের ছেলে-মেয়েরা) কখন মিরাস পাবেন?
মৃত ব্যক্তির ছেলে, মেয়ে বা চাচা জীবিত থাকলে চাচাতো ভাই/বোন বা ফুফাতো ভাই/বোনেরা সম্পত্তি থেকে কোনো অংশই পান না। কিন্তু যখন আসহাবুল ফুরুজ বা আসাবা কেউই জীবিত না থাকে কেবল তখনই কেবল ফুফাতো ভাই/বোন হলো জাবিল আরহাম। তারা ফুফুর মতোই অংশ পাবে। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

ইসলামের দৃষ্টিতে পাকা চুলের মর্যাদা এবং এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা

 পাকা চুল হল, মুমিন ব্যক্তির জীবনে গৌরব, সৌন্দর্য এবং বিশেষ মর্যাদার প্রতীক। এই শুভ্রতা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এক বিশেষ নিয়ামত যা একজন মুসলিমের জীবনে এনে দেয় স্থিরতা ও গাম্ভীর্য। এটি মানুষের জীবনের পরিণত বয়সে উপনীত হওয়ার আলামত। এছাড়া সামাজিকভাবেও বয়স্ক মানুষ আমাদের মানুষের সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র। আর ইসলামেও এটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হাদিসের আলোকে কোনও মুসলিম যদি ইসলামের উপর জীবন পরিচালিত করে এবং এ অবস্থায় তার চুল পেকে যায় অর্থাৎ পরিণত বয়সে উপনীত হয় তাহলে সে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। আর তা হল, প্রতিটি পাকা চুলের বিনিময়ে তার আমলনামায় একটি করে নেকি লেখা হয়, একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং একটি করে গুনাহ মোচন করা হয়। নিশ্চয় আল্লাহ অতিশয় অনুগ্রহ শীল, পরম দয়ালু ও ক্ষমাপরায়ন।

নিম্নে পাকা চুলের মর্যাদা প্রসঙ্গে দুটি হাদিস উল্লেখ করা হল:
✪ ১. প্রথম হাদিস:
আমর ইবনে শুআইব রা. তার পিতা থেকে, তিনি তার দাদা আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
الشَّيْبُ نُورُ المُؤْمِنِ، لاَ يَشِيبُ رَجُلٌ شَيْبَةً فِي الإِسْلاَمِ إِلاَّ كَانَتْ لَهُ بِكُلِّ شَيْبَةٍ حَسَنَةٌ، ورُفِعَ بِهَا دَرَجَةً
“পাকা চুল (বা বার্ধক্যের শুভ্রতা) হল, মুমিনের নূর (জ্যোতি)। ইসলামের মধ্যে থেকে কোনও ব্যক্তি যে একটিও চুল পাকায় তার প্রতিটি পাকা চুলের বিনিময়ে তার জন্য একটি করে নেকি লেখা হয় এবং এর দ্বারা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়।”
[সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস নং ৩১১]
✪ ২. দ্বিতীয় হাদিস:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
: لاَ تَنْتِفُوا الشَّيْبَ، فَإِنَّهُ نُورٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ شَابَ شَيْبَةً فِي الْإِسْلاَمِ كُتِبَ لَهُ بِهَا حَسَنَةٌ، وَحُطَّ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ، وَرُفِعَ لَهُ بِهَا دَرَجَةٌ
“তোমরা পাকা চুল উপড়ে ফেলো না। কারণ এটি কিয়ামতের দিন নূর (জ্যোতি)। আর যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে থেকে একটিও চুল পাকায়, তার জন্য এর বিনিময়ে একটি নেকি লেখা হয়, একটি গুনাহ মোচন করা হয় এবং এর দ্বারা তার মর্যাদা এক ধাপ উন্নীত করা হয়।” [বায়হাকি, শুআবুল ঈমান, ৫/২০৫, হাদিস নং ৬৩৮৭, এবং ইমাম আলবানি এটিকে হাসান বলেছেন, সিলসিলা সাহীহা, হাদিস নং ১২৪৩। আবু দাউদও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন, কিতাবুত তারাজ্জুল, বাব ফী নাতিফিশ শাইব, ৪/৮৫, হাদিস নং ৪২০২]। উক্ত হাদিস থেকে আমরা আরেকটি বিষয় পাই্। তা হল, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সম্মানিত প্রতীককে সম্মান করতে শিখিয়েছেন। তিনি উক্ত মাথা বা দাড়ি থেকে পাকা চুল তুলে ফেলতে নিষেধ করেছেন। অন্য হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই শুভ্রতাকে লুকিয়ে না রেখে বরং সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যমে এর প্রতি যত্ন নিতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি হেনা (মেহেদি) এবং কাতাম (এক ধরনের প্রাকৃতিক হলুদ রং) এর মতো উপাদান ব্যবহার করে পাকা চুল পরিবর্তন বা রং করার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তিনি কালো রং ব্যবহার করে চুল রং করতে নিষেধ করেছেন। এর মূল কারণ হল, কালো রং বার্ধক্যকে সম্পূর্ণরূপে গোপন করে ফেলে যা অন্যকে ধোঁকা দেওয়া বা প্রতারণার শামিল। হাদিসের এসব নির্দেশনার মাধ্যমে মূলত বার্ধক্যকে যথাযোগ্য সম্মান জানাতে এবং যারা ইসলামের পথে অবিচল থেকে পরিণত বয়সে পৌঁছেছেন তাদের উচ্চ মর্যাদার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। আল্লাহ আমাদেরকে মৃত্যু অবধি ইসলামের উপর জীবন পরিচালনার তওফিক দান করুন। আমিন। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।

Translate