Friday, October 31, 2025

আম্মাজান খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহা কি কখনও সালাত আদায় করেননি

 ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর, আমি দুটি বিষয়ে স্পষ্টভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব। প্রথমত, মিরাজের পূর্বে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ওপর সালাত আদায় ফরজ ছিল কি না এবং সে সময় তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ সালাত আদায় করতেন কি না; দ্বিতীয়ত, আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর জীবদ্দশায় সালাত আদায় করতেন কি না।

.
▪️প্রথমত: রাসূলুল্লাহ ﷺ মিরাজে যাওয়ার পূর্বে তাঁর ওপর সালাত আদায় ফরজ ছিল কি না; রাসূল (ﷺ) এবং তার সাহাবীগন সালাত আদায় করেছেন কিনা:
.
আলেমগণ সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছেন যে,রাসূল (ﷺ)-এর মিরাজ সংগঠিত হওয়ার পূর্বে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়নি। তবে কুরআন ও সুন্নাহর দলিল প্রমাণ করে যে,পুর্ববর্তী নবী-রাসূল ও তাঁদের উম্মতের উপর এবং একইভাবে সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (ﷺ) ও তার উম্মতের উপর সালাত ফরয ছিল।যেমন আল্লাহ বলেন,”আর আমরা ইব্রাহীম ও ইসমাঈলের কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারীদের জন্য, এখানে অবস্থানকারীদের জন্য এবং রুকূকারী ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।”(সূরা বাক্বারাহ ২/১২৫)। তিনি মূসা (আঃ)-কে বলেন,”আমরা মূসা ও তার ভাইয়ের প্রতি নির্দেশ পাঠালাম যে, তোমরা তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য মিসরের মাটিতে বাসস্থান নির্মাণ কর এবং তোমাদের ঘরের মধ্যেই ক্বিবলা নির্ধারণ কর ও সেখানে ছালাত আদায় কর। আর তুমি মুমিনদের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও”(সূরা ইউনুস: ১০/৮৭)। তিনি ঈসা (আঃ)-এর মা মারিয়ামকে বলেন, ‘হে মারিয়াম! তোমার প্রতিপালকের ইবাদতে রত হও এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ ও সিজদা কর’ (সূরা আলে ইমরান ৩/৪৩)। রাসূল (ﷺ) বলেন, আমরা নবীগণ আদিষ্ট হয়েছি যেন আমরা দ্রুত ইফতার করি, দেরীতে সাহারী করি এবং ছালাতে বাম হাতের উপর ডান হাত রাখি”।(ত্বাবারাণী কাবীর হা/১১৪৮৫; সহীহুল জামে‘ হা/২২৮৬)
.
আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবিগণ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার আগেও নামাজ আদায় করতেন। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই মুসলিমদের জন্য নামাজ একটি ফরজ ইবাদত ছিল।এর প্রমাণ সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে পাওয়া যায়— যখন বাদশাহ হিরাক্লিয়াস (Heraclius) আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “তিনি (মুহাম্মাদ ﷺ) তোমাদের কী করতে নির্দেশ দেন?
জবাবে মুশরিক থাকা অবস্থায় আবু সুফিয়ান বলেন:তিনি বলেন:اعْبُدُوا اللَّهَ وَحْدَهُ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَاتْرُكُوا مَا يَقُولُ آبَاؤُكُمْ ؛ وَيَأْمُرُنَا بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ وَالصِّدْقِ وَالْعَفَافِ وَالصِّلَةِ”তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সঙ্গে কোন কিছুর অংশীদার সাব্যস্ত করো না এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা যা বলে তা ত্যাগ কর। আর তিনি আমাদের সালাত আদায়ের, সত্য বলার, চারিত্রিক নিষ্কলুষতার এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করার নির্দেশ দেন।”(সহীহ বুখারী হা/৭; সহীহ মুসলিম হা/১৭৭৩) এই হাদিসটি প্রমাণ করে যে,পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার আগেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন এবং অন্যদেরকেও ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানাতেন।
.
হাদিসটির ব্যাখ্যায় হাফিয ইবনু রজব আল-হাম্বালী আল-বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ [জন্ম: ৭৩৬ হি.মৃত:৭৯৫ হি:] বলেছেন:وهو يدل على أن النبي كان أهم ما يأمر به أمته الصلاة ، كما يأمرهم بالصدق والعفاف ، ، واشتُهر ذلك حتى شاع بين الملل المخالفين له في دينه ، فإن أبا سفيان كان حين قال ذلك مشركا ، وكان هرقل نصرانيا . ولم يزل منذ بُعث يأمر بالصدق والعفاف ، ولم يزل يصلي أيضا قبل أن تفرض الصلاة ​”আর এটি প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতের প্রতি যেসব বিষয়ের আদেশ দিতেন,সেগুলোর মধ্যে সালাত (নামাজ) ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ,যেমন তিনি তাদের সত্যবাদিতা ও সচ্চরিত্রতার (পবিত্রতার) আদেশ করতেন। এবং এই বিষয়টি এতটাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, এটি তাঁর ধর্মের বিরোধী জাতিগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল।কেননা, আবু সুফিয়ান যখন এ কথা বলেছিলেন,তখন তিনি ছিলেন একজন মুশরিক (বহু-ঈশ্বরবিশ্বাসী), আর হিরাক্লিয়াস ছিলেন একজন নাসারা (খ্রিস্টান)।আর তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রেরিত হওয়ার পর থেকেই মানুষকে সর্বদা সত্যবাদিতা ও সচ্চরিত্রতার (পবিত্রতার) নির্দেশ দিতেন, এবং সালাত ফরজ হওয়ার আগেও তিনি নিয়মিত সালাত আদায় করতেন।”​(ইবনু রজব আল-হাম্বালী, ফাতহুল বারী শারহু সাহীহিল বুখারী; খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১০১)
.
আহালুল আলেমগন বলেছেন, হিজরতের স্বল্পকাল পূর্বে মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ফজর ও আসরের সালাত দুই রাকআত করে আদায় করার বিধান কার্যকর ছিল। আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বর্ণনা করেন,”শুরুতে সালাত বাড়ীতে ও সফরে দু’ দু’ রাক‘আত করে ছিল।”(সহীহ মুসলিম হা/৬৮৫; আবূ দাঊদ হা/১১৯৮) অতঃপর মি‘রাজের রাত্রিতে চূড়ান্তভাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়। হাদিসে এসেছে,আনাস ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত।তিনি বলেন, মিরাজের রাতে রাসূল (ﷺ)-এর উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়েছিল। অতঃপর তা কমাতে কমাতে পাঁচ ওয়াক্তে সীমাবদ্ধ করা হয়। অতঃপর ঘোষণা করা হল, হে মুহাম্মাদ! আমার নিকট কথার কোনো অদল বদল নাই। তোমার জন্য এই পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব রয়েছে।”(সহীহ বুখারী হা/৩২০৭; মুসলিম হা/১৬২) অতঃপর মিরাজে রাসূল (ﷺ) তাঁর উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয হওয়ার পর সর্বপ্রথম যোহরের সালাত আদায় করেছিলেন।যেমন হাদীসে এসেছে,আবু বারাযাহ আসলামী (রাঃ)-কে রাসূল (ﷺ)-এর সালাতের সময় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যোহরের সালাত যাকে তোমরা প্রথম সালাত বলে থাক,সূর্য ঢলে পড়লে আদায় করতেন।”(সহীম বুখারী হা/৫৪৭; মিশকাত হা/৫৮৭)
.
▪️দ্বিতীয়ত: আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর জীবদ্দশায় সালাত আদায় করতেন কি না!
.
আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ছিলেন ইসলামের প্রথম মুমিনা নারী —আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনয়নে সর্বাগ্রে যিনি সাড়া দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নবী (ﷺ)-এর প্রথম স্ত্রী, তাঁর সন্তানদের জননী, এবং পূর্ণতার এক অনন্য প্রতীক। বুদ্ধিমত্তা, মহত্ত্ব, ধার্মিকতা ও মর্যাদার এক অসাধারণ সমন্বয় তাঁর চরিত্রে দীপ্তিমান ছিল।ইসলামের সূচনালগ্নে খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ছিলেন নবী ﷺ-এর অকুতোভয় সহচর ও অবিচল সমর্থক। যখন নবী ﷺ প্রথম ওহি লাভ করে উদ্বিগ্ন হয়ে ফিরে আসেন, তখন তিনিই ছিলেন তাঁর শান্তি ও সাহসের আশ্রয়স্থল। তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন— এমন মহৎ গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ কখনো অপমান বা কষ্ট বর্ষণ করবেন না। রাসূল ﷺ কে সান্তনা দানের ভাষা ছিল: وَاللهِ لاَيُخْزِيْكَ اللهُ اَبَدًا إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ وَتَحْمِلُ الْكَلَّ وَتَكْسِبُ الْمَعْدُوْمَ وَتَقْرِى الضَّيْفَ وَتُعِيْنُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ-“কখনোই না। আল্লাহর কসম! তিনি কখনোই আপনাকে অপদস্থ করবেন না। আপনি আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করেন, দুস্থদের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের কর্মসংস্থান করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন”।(সহীহ বুখারী হা/৩ সহীহ মুসলিম হা/১৬০; ইবনু হিশাম; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৭৩)।
.
নবী (ﷺ) খাদিজা (রা.)-কে জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও বারবার স্মরণ করতেন এবং তাঁর গুণাবলীর প্রশংসা করতেন।উদাহরণস্বরূপ; ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) সহিহ গ্রন্থে একটি পরিচ্ছেদের নাম দিয়েছেন: ‘খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহার সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবাহ ও তাঁর মর্যাদা’। উক্ত পরিচ্ছেদে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন: তিনি বলেন: “আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী খাদীজার প্রতি যে ঈর্ষা করেছি অন্য কোন স্ত্রীর প্রতি তেমন ঈর্ষা করিনি। কেননা আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর কথা বারবার আলোচনা করতে শুনেছি। অথচ আমাকে বিবাহ করার আগেই তিনি ইন্তিকাল করেছিলেন।”[হাদীসটি বুখারী (৩৮১৫) বর্ণনা করেন] শুধু তাই নয়,আম্মাজান খাদিজা (রাদিআল্লাহু আনহা) ছিলেন বিশ্বসেরা চারজন সম্মানিতা মহিলার অন্যতম। রাসূল (ﷺ) বলেন,أَفْضَلُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ وَفَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ وَمَرْيَمُ بِنْتُ عِمْرَانَ وَآسِيَةُ بِنْتُ مُزَاحِمٍ امْرَأَةُ فِرْعَوْنَ “জান্নাতী মহিলাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’লেন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম”। (মুসনাদে আহমাদ হা/২৬৬৮; তিরমিযী হা/৩৮৭৮) তিনি ছিলেন সেই মহীয়সী মহিলা যাকে জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) নিজের পক্ষ হতে ও আল্লাহর পক্ষ হতে রাসূল (ﷺ)-এর মাধ্যমে তাঁকে সালাম সালাম পাঠিয়েছিলেন” (বুখারী হা/১৭৯২, মুসলিম হা/২৪৩৩) পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতে এক মনোমোহন মতি দিয়ে তৈরি এমন একটি ঘরের সুসংবাদ দিয়েছেন যেখানে কোন শোরগোল থাকবে না এবং কোন প্রকার কষ্ট ক্লেশও থাকবে না— থাকবে শুধুই চিরন্তন শান্তি ও আনন্দ। অতঃপর, তিনি রাসূল (ﷺ)-এর নবুওয়াত শুরু হওয়ার সাত বছর পরে, অথবা বলা হয়েছে: দশ বছর পরে (এটিই অধিক সহিহ),পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এবং পর্দার বিধান ফরজ হওয়ার পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন।মৃত্যুর সময় আম্মাজানের বয়স ছিল পঁয়ষট্টি বছর। ​তাঁর জীবনী ও গুণাবলী সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: ইবনে আব্দুল বার-এর আল ইস্তিজকার; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৮১৭; এবং ইমাম যাহাবী-এর সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১০৯)
.
প্রিয় পাঠক, আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর উপরোক্ত গুণাবলীর আলোকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ছিলেন একাধারে ধার্মিক, নৈতিকভাবে দৃঢ় ও চরিত্রে অনন্য এক তাকওয়াবান নারী। তাঁর এই মহৎ চরিত্র, ধর্মনিষ্ঠা ও আল্লাহভীতির প্রেক্ষিতে সহজেই অনুমান করা যায় যে,তিনি নিয়মিত সালাত আদায় করতেন। সীরাত ইবনে হিশাম ও তাফসির ইবনে কাসীরের বর্ণনা অনুযায়ী, মক্কায় প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা গোপনে ও ব্যক্তিগতভাবে সালাত আদায় করতেন; মদিনায় হিজরতের পরই তারা প্রকাশ্যে ও জামায়াতে সালাত আদায়ের প্রথা শুরু করেন। সুতরাং, আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) মক্কা অবস্থাতেই নবী ﷺ-এর নির্দেশ অনুসারে নিয়মিত ইবাদত করতেন—যদিও সে সময় জামায়াতে সালাত আদায়ের প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি সহীহ হাদীস ও নির্ভরযোগ্য সীরাতগ্রন্থসমূহে তাঁর সালাত আদায়ের স্পষ্ট প্রমাণও পাওয়া যায়। বহু বর্ণনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো—খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সেই সালাত আদায় করতেন যা তখন ফরজ ছিল; অর্থাৎ দিনের শুরুতে দুই রাকাআত ও দিনের শেষে দুই রাকাআত। এটি ছিল পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার আগের আমলের কথা।আমি আমার প্রিয় পাঠকদের উদ্দেশ্যে এখানে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত এমনই একটি রেওয়ায়াত উল্লেখ করছি—যেখান থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হবে আম্মাজান খাদিজা সালাত আদায় করেছেন।
.
আমাদেরকে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আমার পিতা (ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল) আমাকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আমাদেরকে ইয়াকুব ইবনু ইব্রাহিম আল-হানযলী (আবু ইউসুফ) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আমাকে আমার পিতা ইব্রাহিম ইবনু সা‘দ বর্ণনা করেছেন।তিনি বলেন: আমাকে মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেছেন।তিনি বলেন: আমাকে ইয়াহইয়া ইবনু আল-আশ্য‘আত বর্ণনা করেছেন, তিনি ইসমাঈল ইবনু ইয়া‘স ইবনু আফিফ আল-কিন্দি থেকে বর্ণনা করেছেন,তিনি তার পিতা ইয়া‘স থেকে, আর তিনি তার দাদা আফিফ আল-কিন্দি থেকে বর্ণনা করেন—যিনি বলেছেন:
كنت امرأً تاجرًا، فقدمت الحج، فأتيت العباس بن عبد المطلب رضي الله عنه لأبتاع منه بعض التجارة، وكان امرأً تاجرًا، فوالله إني لعنده بمنى، إذ خرج رجل من خباء قريب منه، فنظر إلى الشمس، فلما رآها مالت -يعني قام يصلي- قال: ثم خرجت امرأةٌ من ذلك الخباء الذي خرج منه ذلك الرجل، فقامت خلفه تصلي، ثم خرج غلام حين راهق الحلم من ذلك الخباء، فقام معه يصلي. قال: فقلت للعباس: من هذا يا عباس؟ قال: هذا محمد بن عبد الله بن عبد المطلب ابن أخي، قال: فقلت: من هذه المرأة؟ قال: هذه امرأته خديجة ابنة خويلد. قال: قلت: من هذا الفتى؟ قال: هذا علي بن أبي طالب ابن عمه. قال: فقلت: فما هذا الذي يصنع؟ قال: يصلي، وهو يزعم أنه نبي، ولم يتبعه على أمره إلا امرأته، وابن عمه هذا الفتى، وهو يزعم أنه سيفتح عليه كنوز كسرى، وقيصر”. قال: فكان عفيف رضي الله عنه-وهو ابن عم الأشعث بن قيس رضي الله عنه- يقول -وأسلم بعد ذلك، فحسن إسلامه-: “لو كان الله رزقني الإسلام يومئذٍ، فأكون ثالثًا مع علي بن أبي طالب رضي الله عنه”
আমি একজন ব্যবসায়ী ছিলাম।একবার হজের উদ্দেশ্যে (মক্কায়) এসে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে গেলাম, তাঁর কাছ থেকে কিছু বাণিজ্যিক সামগ্রী কিনবার জন্য। তিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। আল্লাহর কসম, আমি যখন মিনায় তাঁর কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন তাঁর কাছের একটি তাঁবু থেকে একজন ব্যক্তি বেরিয়ে আসতে দেখলাম। সে সূর্যের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াল; যখন সে দেখল সূর্য হেলে পড়েছে, (অর্থাৎ দুপুরের ওয়াক্ত হয়েছে), তখন তিনি নামাজ পড়তে দাঁড়ালেন।এরপর সেই তাঁবু থেকে একজন নারী বেরিয়ে এল এবং তিনি তার পিছনে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে লাগলেন। এরপরে সেই তাঁবু থেকে এক যুবক বেরিয়ে এল,যে সবেমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কাছাকাছি (কিশোর) হয়েছে,এবং তিনি তাদের সাথে সালাত আদায় করতে লাগলেন। আমি আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলাম:‘এই ব্যক্তি কে?’ তিনি বললেন, ‘এটি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম: ‘আর এই মহিলাটি কে?’ তিনি বললেন: ‘ইনি তার স্ত্রী খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম: ‘আর এই কিশোরটি কে?’ তিনি বললেন: ‘ইনি তার চাচাতো ভাই আলী ইবনে আবী তালিব।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম: ‘এরা কী করছে?’ তিনি বললেন: ‘ইনি (মুহাম্মদ) নামাজ পড়ছেন এবং তিনি দাবী করেন যে তিনি একজন নবী। তার স্ত্রী এবং এই কিশোর চাচাতো ভাই ছাড়া আর কেউ তার অনুসারী হয়নি। আর তিনি (মুহাম্মদ) দাবী করেন যে খুব শীঘ্রই তার জন্য কিসরা (পারস্য সম্রাট) ও কাইসারের (রোম সম্রাট) ধনভান্ডার জয় হবে।” বর্ণনাকারী বলেন, পরে আফীফ (যিনি আশ’আস ইবনে কায়েসের চাচাতো ভাই) ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার ইসলাম গ্রহণ ছিল অত্যন্ত চমৎকার। তিনি আফসোস করে বলতেন:”যদি আল্লাহ সেদিনই আমাকে ইসলামের সৌভাগ্য দিতেন, তবে আমি আলী ইবনে আবী তালিবের সাথে দ্বিতীয় অনুসারী হতাম।” (অন্য বর্ণনায়: তৃতীয় হতাম,কেননা খাদীজা রা: প্রথম)।(মুসনাদে আহমেদ হা/১৭৮৭;তাবারানি কাবীর খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ১০০ হা/১৮১; হাইছামী; ‘মাজমাউয যাওয়ায়েদ’ খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ১০২; ইমাম বুখারী; তারীখুল কাবীর; খণ্ড: ৭: পৃষ্ঠা: ৭৩)
তাহক্বীক: হাদীসটি সহীহ জয়ীফ নিয়ে কথা থাকলেও বহু ইমাম বিশুদ্ধ বলেছেন। উদাহরণস্বরূপ: শাইখ আহমাদ শাকির (রাহিমাহুল্লাহ) শারহু মুসনাদ আহমাদ (হা/১৭৮৭) এ বলেছেন: “এই হাদিসের সনদ সহীহ। ইমাম হাকিম তার মুস্তাদরক হাকিমে খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৮৩ হা/৪৮৪২ বর্ননা করে বুখারি মুসলিমের শর্তে হাদিসটি সহীহ বলেছেন।ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) তালখিস আল-মুস্তাদরক-এ সনদ সঠিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন; “এই হাদীসটি আবু ইয়ালা তাঁর মুসনাদে খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১১৭; হাদীস নং ১৫৪৭)-এ বর্ণনা করেছেন। শাইখ হুসাইন সালিম আসাদ, যিনি মুসনাদ আবু ইয়ালা-এর তাহকীক করেছেন, তিনি বলেছেন: ‘এর সনদ (ইসনাদ) হাসান। এবং ইমাম ইবনে আব্দিল বার আল ইস্তিজকার; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১২৪১-এ আফিফ আল-কিনদির জীবনী উল্লেখ করেছেন এবং এই হাদিসটি উল্লেখ করে বলেছেন:এই হাদিস অত্যন্ত উৎকৃষ্ট।
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার আলোকে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, আম্মাজান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর জীবদ্দশায় নিয়মিত সালাত আদায় করতেন। অতএব, যারা বলেন যে তিনি জীবনে একবারও সালাত আদায় করেননি—তাদের এই বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভিত্তিহীন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক বোধ ও সঠিক উপলব্ধি দান করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানী।
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate