Friday, October 31, 2025

মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের বিবরণ এবং মৃতের সম্পদে জীবিতদের করণীয়

 মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের বিবরণ, মৃতের সম্পদে জীবিতদের করণীয় এবং তিনি যদি বিশেষ কোনও ব্যক্তিকে তার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণা দিয়ে যান তাহলে সে ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান।

প্রশ্ন: পবিত্র কুরআনের আলোকে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশ কারা? একজন মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের দায়িত্ব পরিবারের কার উপর বর্তায়? জীবিত থাকাকালীন যদি সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির কোনও নিষেধাজ্ঞা থাকে তবে কি তার মৃত্যুর পর তা দায়িত্ব পালনকৃত ব্যক্তি পালন করতে বাধ্য? ইসলামের আলোকে এর বিধি-বিধান সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। দয়া করে জানাবেন ইনশাআল্লাহ।
উত্তর: আপনার প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে পয়েন্ট আকারে এর উত্তর দেওয়া হল:
❑ কুরআনের আলোকে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশ কারা?
পবিত্র কুরআনের সূরা নিসা এর ১১, ১২ এবং ১৭৬ নং আয়াতে মৃত ব্যক্তির প্রধান ওয়ারিশ এবং তাদের প্রাপ্য অংশের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। মূলতঃ মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা উত্তরাধিকারী হন:
✪ ১. স্বামী বা স্ত্রী:
ক. স্বামী: মৃত স্ত্রীর যদি কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তান না থাকে তবে স্বামী সম্পত্তির অর্ধেক (১/২) পাবেন। সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকলে স্বামী এক-চতুর্থাংশ (১/৪) পাবেন।
খ. স্ত্রী: মৃত স্বামীর যদি কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তান না থাকে। তবে স্ত্রী এক-চতুর্থাংশ (১/৪) পাবেন। সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকলে স্ত্রী এক-অষ্টমাংশ (১/৮) পাবেন।
[সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১২]
✪ ২. সন্তান-সন্ততি:
মৃত ব্যক্তির পুত্র ও কন্যা উভয়ই ওয়ারিশ হবে।
বণ্টনের ক্ষেত্রে পুরুষ (পুত্র) নারীর (কন্যা) দ্বিগুণ অংশ লাভ করবে।
[সূরা আন-নিসা: ১১]
✪ ৩. পিতা-মাতা:
ক. মৃত ব্যক্তির যদি সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকে তবে পিতা ও মাতা প্রত্যেকেই এক-ষষ্ঠাংশ (১/৬) করে পাবেন।
খ. যদি মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান না থাকে এবং তার পিতা-মাতাই ওয়ারিশ হন তবে মাতা এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) পাবেন এবং বাকি অংশ পিতা পাবেন।
গ. মৃতের যদি ভাই বা বোন থাকে তবে মাতা এক-ষষ্ঠাংশ (১/৬) পাবেন।
[সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১]
✪ ৪. অন্যান্য দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজন:
উপরে উল্লিখিত প্রধান ওয়ারিশদের অনুপস্থিতিতে কিংবা অংশ দেওয়ার পরে বাকি সম্পদের জন্য অন্য নিকটাত্মীয়রা ওয়ারিশ হন। যেমন: দাদা-দাদি, নানা-নানি, ভাই-বোন (আংশিক বা সম্পূর্ণ), ভাতিজা-ভাতিজি চাচা-ফুফু প্রমূখগণ।
(চাচা-ফুফু এবং চাচাতো ভাই-বোনেরা কখন কীভাব মিরাস পায় তা টিকা থেকে দেখুন)
দ্রষ্টব্য: ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী, ওয়ারিশ নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট ক্রম ও পদ্ধতি (ফারাইয বা মিরাস) রয়েছে। নিকটতম ওয়ারিশের উপস্থিতিতে দূরবর্তী ওয়ারিশরা অনেক সময় সম্পদ থেকে বঞ্চিত হন।
❑ মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টনের দায়িত্ব কার?
মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের দায়িত্ব পরিবারের কারো উপর এককভাবে বর্তায় না। বরং মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ বণ্টন করার পূর্বে সেই সম্পদের উপর নিম্নলিখিত চারটি ক্রমানুসারে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কাজগুলো সম্পাদনের দায়িত্ব সাধারণত পরিবারের দায়িত্বশীল ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি (যেমন: পুত্র, স্বামী/স্ত্রী, বা নিকটাত্মীয়) ও এলাকার বিজ্ঞ ইসলামি স্কলার বা বিচারক যৌথভাবে পালন করবেন:
◈ ১. দাফন-কাফনের খরচ:
মৃত ব্যক্তিকে শরিয়ত মোতাবেক দাফন-কাফন করার জন্য প্রয়োজনীয় যুক্তিসঙ্গত খরচ প্রথমেই মৃত ব্যক্তির মোট সম্পত্তি থেকে আলাদা করতে হবে।
◈ ২. ঋণ পরিশোধ:
মৃত ব্যক্তির যদি কোনও ঋণ (আল্লাহর হক যেমন: কাফফারার ঋণ অথবা বান্দার হক্ব যেমন: মানুষের পাওনা ঋণ, স্ত্রী অপরিশোধিত মোহর ইত্যাদি ) থাকে, তবে তা দাফন-কাফনের খরচ বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি থেকে অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে। ঋণ পরিশোধে কোনও ধরনের বিলম্ব করা যাবে না।
◈ ৩. উইল বা অসিয়ত (যদি থাকে):
ঋণ পরিশোধের পর অবশিষ্ট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) পর্যন্ত সম্পদ থেকে মৃত ব্যক্তির বৈধ অসিয়ত (উইল) কার্যকর করতে হবে। তবে
– উইল বা অসিয়ত অবশ্যই শরিয়ত বিরোধী হওয়া যাবে না। শরিয়ত বিরোধী ওসিয়ত হলে তা বাস্তবায়ন করা জরুরি নয়।
অনুরূপভাবে ওয়ারিশদের জন্য কোনও অসিয়ত করা যাবে না। নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَعْطَى كُلَّ ذِي حَقٍّ حَقَّهُ ، فَلَا وَصِيَّةَ لِوَارِثٍ
“আল্লাহ প্রত্যেক হকদারকে তার হক দিয়েছেন, সুতরাং ওয়ারিশের জন্য কোনও অসিয়ত নেই।” [সহিহ সুনানে আবু দাউদ]
◈ ৪. ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন:
উপরে উল্লিখিত তিনটি কাজ সম্পন্ন করার পর যে সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে, তা কুরআনের আইন (ফারাইয) অনুযায়ী ওয়ারিশদের মধ্যে তাদের নির্ধারিত অংশ অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে।
❑ জীবিত থাকাকালীন সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা:
আপনার প্রশ্ন অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তি জীবিত থাকাকালীন যদি কোনও বৈধ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যান তবে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিকে তা পালন করতে হবে কি না:
◆ ১. বৈধ অসিয়তের ক্ষেত্রে: মৃত ব্যক্তি যদি তার মোট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) এর মধ্যে কোনও বৈধ অসিয়ত করে থাকেন (যেমন: কোনও দরিদ্রকে দান করা বা কোনও মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দেওয়া ইত্যাদি ) তবে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি সেই অসিয়ত পালন করতে বাধ্য। এটি একটি ঋণ পরিশোধের মতোই গণ্য হবে।
◆ ২. ওয়ারিশদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে: যদি কোনও ব্যক্তি তার জীবিতাবস্থায় কোনও ওয়ারিশকে তার প্রাপ্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার জন্য নিষেধাজ্ঞা বা অসিয়ত করে যান তবে ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী সেই নিষেধাজ্ঞা অবৈধ ও বাতিল বলে গণ্য হবে।
কারণ ওয়ারিশের অধিকার আল্লাহ তা’আলা নিজেই পবিত্র কুরআনে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কোনও মানুষের পক্ষে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এই অধিকার বাতিল করার বা পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই। দায়িত্বশীল ব্যক্তি এই ধরনের অবৈধ নিষেধাজ্ঞা পালন করতে বাধ্য নন। বরং তিনি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ওয়ারিশদের প্রাপ্য অংশ বণ্টন করতে বাধ্য।
দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীও এই নিষেধাজ্ঞা বাতিল।
মোটকথা, ওয়ারিশদের অংশ কমিয়ে দেওয়া বা সম্পূর্ণ বঞ্চিত করার নিষেধাজ্ঞা মৃত্যুর পর বাতিল হয়ে যাবে। তবে যদি তিনি দান বা জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য ১/৩ অংশের মধ্যে অসিয়ত করে যান তা অবশ্যই পালন করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর বিধান মেনে চলার তৌফিক দিন। আমিন।
————–
টিকা: মিরাসে চাচা ফুফু এবং তাদের ছেলে-মেয়েরা কখন অংশ পাবে?
আমাদের জানা দরকার যে, ইসলামি উত্তরাধিকার আইনে ওয়ারিশদের দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। যথা:
✪ ১. আসহাবুল ফুরুজ (নির্দিষ্ট অংশের অংশীদারগণ): এরা হলেন, যারা কুরআনে নির্ধারিত নির্দিষ্ট অংশ পাবেন (যেমন: আপনার স্ত্রী, সন্তান, বাবা, মা)।
✪ ২. আসাবা (অবশিষ্টভোগী): এরা নির্দিষ্ট অংশের অংশীদারদের অংশ দেওয়ার পর বাকি সম্পত্তি পান। এরাই মূলত মৃত ব্যক্তির বংশের পুরুষ আত্মীয়, যেমন: আপনার ছেলে, বাবা, দাদা, ভাই, চাচা ইত্যাদি।
◈ ১. আপনার চাচা (পিতার আপন ভাই) কখন মিরাস পাবেন?
আমরা জেনেছি যে, চাচা হলেন আসাবা (অবশিষ্টভোগী) শ্রেণীর ওয়ারিশ।
মৃত ব্যক্তির ছেলে বা ছেলের ঘরের ছেলে (নাতি) জীবিত থাকলে আপনার চাচা সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হবেন এবং কোনো অংশ পাবেন না।
কিন্তু যদি মৃত ব্যক্তির কোনো ছেলে বা ছেলের ঘরের ছেলে জীবিত না থাকে তাহলে আসহাবুল ফুরুজদের (যেমন: আপনার মা, মেয়ে বা স্ত্রী) নির্ধারিত অংশ দেওয়ার পর যে সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকবে তা আপনার চাচা (পিতার আপন ভাই) পাবেন।
◈ ২. আপনার ফুফু (পিতার আপন বোন) কখন মিরাস পাবেন?
ফুফুরা হলেন “জাবিল আরহাম” বা রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়ের অন্তর্ভুক্ত।
প্রথম স্তরের ওয়ারিশগণ তথা আপনার বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে, দাদা, দাদী, চাচা এদের মধ্যে কেউ জীবিত থাকলে সাধারণত ফুফু মিরাস থেকে বঞ্চিত হন।
কিন্তু যদি প্রথম স্তরের কোনো ওয়ারিশ তথা আসহাবুল ফুরুজ বা আসাবা শ্রেণীর কোনো ওয়ারিশ (অর্থাৎ, ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, বাবা, মা, চাচা, ভাই) জীবিত না থাকে তখন কেবলমাত্র সে ক্ষেত্রেই ফুফুরা নিকটতম রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় হিসেবে মিরাস পাবেন।
◈ ৩. চাচাতো ভাই/বোন এবং ফুফাতো ভাই/বোন (তাদের ছেলে-মেয়েরা) কখন মিরাস পাবেন?
মৃত ব্যক্তির ছেলে, মেয়ে বা চাচা জীবিত থাকলে চাচাতো ভাই/বোন বা ফুফাতো ভাই/বোনেরা সম্পত্তি থেকে কোনো অংশই পান না। কিন্তু যখন আসহাবুল ফুরুজ বা আসাবা কেউই জীবিত না থাকে কেবল তখনই কেবল ফুফাতো ভাই/বোন হলো জাবিল আরহাম। তারা ফুফুর মতোই অংশ পাবে। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate