ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী কোনো সালাফি আলেম যদি কোনো দলিল যথাযথভাবে না বুঝার কারণে বা বিষয়টি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ইলম না থাকার কারণে অথবা ভুল তাবিলের (ব্যাখ্যার) ফলে কোনও বিদআতে লিপ্ত হয় তাহলে তাকে ‘বিদআতি’ বলা যাবে না বরং তার উক্ত কাজটাকে ’বিদআত’ বলতে হবে। সেই বিদআত অনুসরণ করা বৈধ নয়।তবে তার সামনে কুরআন সুন্নাহর সঠিক দলিল-প্রমাণ পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করে ভুল ধারণা দূর করার পরও যদি তিনি সেই বিদআতের উপর অটল থাকেন, গোঁড়ামি করেন কিংবা মানুষকে সে দিকে আহ্বান করতে থাকেন তাহলে তাকে সতর্ক করা এবং প্রয়োজনে বর্জন করা আবশ্যক। কারণ শরিয়তে বিদআত সৃষ্টি করা অত্যন্ত গুরুতর এবং ভয়াবহ অপরাধ। তবে এ বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন যে, ইতিহাসে বহু বিশিষ্ট আলেম ঈমানিয়াতসহ গুরুতর মাসআলায় ভুল করেছেন; সম্ভব যে তাদের কাছে হক্ক স্পষ্টভাবে পৌঁছায়নি বা প্রমাণ যথাযথভাবে পৌঁছায়নি। তাই শুধুমাত্র কোনো ভুল মত বা তাবিলের কারণে সালাফি মানহাজের পরিচিত কোনো আলেমকে ‘বিদআতী’ হিসেবে অভিহিত করা এবং তার অন্যান্য খেদমতকে অস্বীকার করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নীতি নয়। এমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে উম্মাহর কেউই বিদ’আত থেকে রক্ষা পেত না।
.
ড. আহমাদ ইবনু আব্দুল আজিজ হুলায়বী,শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিদআতীদের উপর হুকুম আরোপের মূলনীতিসমূহ নিয়ে একটি বই লিখেছেন যার আরবি নাম হচ্ছে,”উসুলুল হুকমি আলাল মুবতাদিআহ” অতঃপর এই বইয়ের চতুর্থ মূলনীতি হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন:الأصل الرابع عدم الحكم على من وقع في بدعة أنه من أهل الأهواء والبـدع، ولا معاداته بسببها، إلا إذا كانت البدعة مشتهرة مغلظة عند أهل العلم بالسنة অর্থাৎ “যে ব্যক্তি কোনো বিদআতে লিপ্ত হয়েছে, তাকে সরাসরি আহলে আহওয়া ও আহলে বিদআতের অন্তর্ভুক্ত বলে রায় দেওয়া উচিত নয়,তদ্রূপ,শুধুমাত্র সেই কারণে তার সাথে শত্রুতা করাও উচিত নয়, যতক্ষণ না সেই বিদআত এমন সুপরিচিত ও গুরুতর হয় যা আহলে সুন্নাহর আলেমদের কাছে স্পষ্টভাবে নিন্দিত ও স্বীকৃত।”(উসুলুল হুকমি আলাল মুবতাদিআহ” খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৮২)
.
অতঃপর তিনি ফাতওয়া উল্লেখ করেছেন, যেখানে হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:(البدعة التي يُعد بها الرجل من أهل الأهواء: ما اشتهر عند أهل العلم بالسنة مخالفتها للكتاب والسنة؛ كبدعة الخوارج والروافض والقدرية والمرجئة) “যে বিদআতের কারণে কোনো ব্যক্তিকে আহলুল আহওয়া (ভ্রান্ত মতের অনুসারী) হিসেবে গণ্য করা হয়, তা হলো এমন বিদআত যা আহলে সুন্নাহর আলেমদের কাছে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বিরোধী হিসেবে সুপরিচিত ও সুস্পষ্ট। যেমন খারেজী, রাফেযী, (শিয়া) ক্বাদরীয়া এবং মুরজিয়া সম্প্রদায়ের বিদআতসমূহ।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৩৫; পৃষ্ঠা: ৪১৪)
.
কারণ এগুলো এমন ধরনের বিদআত যেগুলোর কারণে তাদের অনুসারীদের বক্তব্য এত গুরুতর হয়ে উঠেছিল যে তারা আহলে সুন্নাহর পরিসর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মুরজিয়ারা তেমন কোনো মারাত্মক বিদআতের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তাদের বক্তব্যে ফকীহ ও এবাদতমূলক লোকদের বহু দল অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদেরকে পূর্বে আহলে সুন্নাহ হিসেবেই গণ্য করা হতো। পরে যখন তারা তাদের কথায় অতিরিক্ত ও গুরুতর বক্তব্য যোগ করল, তখন তাদের অবস্থা কঠোর হয়ে গেল। এর সাথে তুলনা করলে যারা কবরে যাত্রা করে, কবরকে পূজার স্থান, মসজিদ বা উৎসবস্থল বানায় তারা তো এর চেয়েও বড় বিদআতের অধিকারী। কারণ, সাহাবী, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনদের যুগে এমন কোনো দল ছিল না যারা কবরে হজ্জ করত, কিংবা ইসলামে এমন কোনো কবর বা মাযার ছিল না যাকে হজ্জ বা যিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা হতো। এ ধরনের বিদআত পরে, তিন উত্তম যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেখা দেয়। সাধারণ নীতি হলো, যত বেশি কোনো বিদআত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরোধী, তত দেরিতে তা প্রকাশ পায় আর যে বিদআতগুলো বই ও সুন্নাহর তুলনায় কম বিরোধী, সেগুলোই আগে দেখা দেয় যেমন খারেজীদের বিদআত। অতএব, বিদআতের গুরুতরতা কেবল প্রাথমিক যুগের বিদআতগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয় বরং শিরকের বিদআতগুলো পরবর্তীতে দেখা দিয়েছে, যেগুলো আরও গুরুতর, কঠিন ও বিপদজনক। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
ان الذين يعدون من اهل البدع والاهواء هم من اتصف بما يلي:-
1:- انهم يجعلون ما ابتدعوه قولا يفارقون به جماعة المسلمين يوالون عليه ويعادون. 2:- انهم ينازعون فيما توافرت به السنة.
আহলে আহওয়া ও বিদআতের অন্তর্ভুক্ত তারা, যারা নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে..
(ক) তারা তাদের উদ্ভাবিত মতবাদকে এমন একটি বিশ্বাসে রূপ দেয়, যার মাধ্যমে তারা মুসলিম সমাজ থেকে আলাদা হয়ে যায়। এর ওপর ভিত্তি করে তারা বন্ধুত্ব স্থাপন করে ও শত্রুতা পোষণ করে।
(খ) তারা সেই বিষয়গুলোতে বিতর্ক করে যা সুন্নাহ দ্বারা নির্ভরযোগ্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে (যেমন মুতাওয়াতির হাদিস)”।(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩৪৯; এবং খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৪২৫)।
.
এইভাবেই আহলে সুন্নাহ ও আহলে বিদআতের পার্থক্য নির্ধারিত হয়। যারা কোনো বিদআতে পতিত হয়েছে কিন্তু যদি তারা তাদের উদ্ভাবিত বিষয়ে এমন কোনো মত না বানায় যার মাধ্যমে তারা মুসলিম সমাজ থেকে আলাদা হয়, বন্ধুত্ব ও শত্রুতা গড়ে তোলে, তাহলে সেটা কেবল একটি ভুলের ধরন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বিশ্বাসী বান্দাদের এমন ভুল ক্ষমা করে দেন।এ কারণেই পূর্বসূরী সালাফ ও ইমামদের অনেকেই কিছু বিষয়ে ইজতিহাদ করে এমন মত পোষণ করেছেন যা কিতাব ও সুন্নাহর বিপরীত ছিল। তবে তারা এমন ছিল না যে, নিজের মতকে সমর্থনকারীকে বন্ধুত্ব করত এবং ভিন্নমতাবলম্বীকে শত্রু ভাবত, মুসলিম সমাজে বিভাজন আনত, মতবিরোধীদের কাফের বা ফাসিক বলত, কিংবা তাদের সঙ্গে যুদ্ধকে বৈধ মনে করত।যারা এভাবে আচরণ করে, তারাই হলো প্রকৃত বিভাজনকারী ও বিদআতী সম্প্রদায়ের লোক। এছাড়াও মুসলিম ইমামরা একমত যে, যে ব্যক্তি এমন বিষয়ে বিরোধিতা করে যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ জানা আলেমদের নিকট জরুরীভাবে জানা ও নিশ্চিত, তাকে বিদআতী গণ্য করা হবে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শাফা‘আত (সুপারিশ), হাউয কাওসার, বড় পাপের লোকদের জাহান্নাম থেকে বের হওয়া এবং আল্লাহর সিফাত (গুণাবলী), তাকদীর, উচ্চতা ও দর্শন এর মতো বিষয়গুলোতে মুতাওয়াতির হাদীসসমূহে বিশ্বাস।এসব বিষয়গুলো আহলে সুন্নাহর আলেমদের মধ্যে ঐক্যমত্যে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যারা এমন বিষয়ে মতবিরোধ করে যেগুলো এ পর্যায়ে পৌঁছেনি, যেমন একজন সাক্ষী ও শপথের ভিত্তিতে রায় প্রদান, কিসামাহ (রক্তপণ দাবির বিশেষ শপথপ্রথা), ক্বরআহ (লটারির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত) ইত্যাদি বিষয়ে এসব বিষয়ে মতবিরোধ বিদআতের পর্যায়ে পড়ে না।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] জিজ্ঞেস করা হয়েছিল;
প্রশ্নকারী: কোন ব্যক্তিকে বিদ’আতী নির্ধারণ করার মানদণ্ড কী?
প্রশ্নকারী: আল্লাহ আপনার উপকার করুন, হে সম্মানিত শাইখ! আমার প্রশ্ন হচ্ছে কখন বা কীভাবে কোনো ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে যে সে বিদ’আতী? অর্থাৎ, কাউকে চিহ্নিত করে বলা যে সে বিদ’আতী এর মূল মানদণ্ড কী?
শাইখ: যখন তার মানহাজ এমন হয় যে, সে কথা, কাজ ও অনুমোদনের দিক থেকে সুন্নাহর ব্যাপক অর্থে বিরোধিতা করে তখনই তাকে বিদ’আতী বলা হয়।কিন্তু যদি কেউ কোনো এক বা একাধিক বিদ’আতে জড়িয়ে পড়ে ইজতিহাদের মাধ্যমে, যদিও সে তাতে ভুল করেছে তাহলে তাকে বিদ’আতী বলা হবে না।না হলে কোনো মানুষই বিদ’আত থেকে রক্ষা পেত না।
প্রশ্নকারী: যখন সে কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধিতা করে, তখন কি?
শাইখ: না, আমি কুরআন কথাটি উল্লেখ করিনি, কারণ এটি তো স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। আমরা জানি কুরআন সুন্নাহ ছাড়া বোঝা যায় না। আর সুন্নাহ তিন প্রকার: কথা , কাজ ও অনুমোদন। এই তিন দিক থেকেই সুন্নাহর বিরোধিতা করে নিজের মতামত বা খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে এবং সে সুন্নাহর প্রতি উদাসীন থাকে, বরং এটাকেই নিজের জীবনের পথ হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে সেই বিদ’আতী ব্যক্তি। কিন্তু কেউ যদি কোনো কারণে সুন্নাহর বিরোধিতা করে এবং তাতে কোনো বিদ’আতে পড়ে যায়, বরং কখনো সরাসরি হারামেও লিপ্ত হয় তবুও তাকে বিদ’আতী বলা হবে না, এবং সে এজন্য ফাসিকও হবে না, যদিও সে একটি হারাম কাজ করেছে।
প্রশ্নকারী: ভালো, হে শাইখ! আগের যুগের বিদ’আতীদের ব্যাপারে কী বলবেন? কীভাবে সালাফগণ তাদেরকে বিদ’আতী বলে অভিহিত করলেন? তারা কীভাবে জানলেন যে তারা বিদ’আতী?
শাইখ: কারণ তারা সালাফে সালিহীনের মানহাজের বিরোধিতা করেছিল।
প্রশ্নকারী: কিন্তু আমরা কীভাবে জানব কেউ খেয়াল-খুশির অনুসারী, নাকি শুধু ভুল করেছে?
শাইখ: আমরা তো জানি না এবং তুমি যদি বলো আমরা জানি না, তাহলে আমি তোমার সঙ্গে একমত। সত্যিই, আমরা জানি না। তাই আমরা বলি: আল্লাহই তাদের হিসাব নেবেন। তবে তারা বিদ’আতী কি না এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তারা বিদ’আতীই, কারণ তারা সালাফে সালিহীনের মানহাজের বিরোধিতা করেছে। আর আমি তোমাকে এমন একটি বিষয় শোনাবো, যা হয়তো তুমি আগে শোনোনি: অনেক আলেম দ্বীনকে ভাগ করেছেন মূলনীতি ও শাখাতে। তারপর তারা এই বিভাজনের ওপর আরেকটি ভিত্তি দাঁড় করিয়েছেন যে শাখা বিষয়ে ভুল করলে তা ক্ষমাযোগ্য, কিন্তু মূলনীতিতে ভুল ক্ষমাযোগ্য নয়।কিন্তু বাস্তবে, এই বিভাজনের কোনো ভিত্তি নেই। কারণ: দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতা যেমন শাখা বিষয়ে হতে পারে, তেমনি মূলনীতিতেও হয়। উভয় ক্ষেত্রেই কোনো পার্থক্য নেই যতক্ষণ না কেউ এমন কোনো বিষয়ে বিরোধিতা করে, যা কুরআন, সুন্নাহ বা সালাফে সালিহীনের সর্বসম্মত মতের বিরুদ্ধে যায়।
সে যদি তা জেনেশুনে করে তাহলে সে দোষী, তা মূলনীতি হোক বা শাখা উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান।
প্রশ্নকারী: (যে বিরোধিতা করছে) সে তো জানে যে এটি (নসের) বিরোধী।
শাইখ: সে নস (দলীল) জানে, তারপরও সে তার বিরোধিতা করছে, এক্ষেত্রে সে যে গুনাহ করছে, সে গুনাহ ফুরু‘ (শাখা) হোক বা উসূল (মূলনীতি) হোক—কোনো পার্থক্য নেই। উভয় ক্ষেত্রেই একই রকম গুনাহ।
এর বিপরীত চিত্র হলো: কেউ ফুরু‘ বা উসূলের কোনো বিষয়ে নসের বিরোধিতা করল, কিন্তু সে ছিল একজন মুজতাহিদ—সত্যকে জানতে চেয়েছে, কিন্তু তার বিরোধিতার বিপরীত কোনো নস তার সামনে আসেনি, সে সেটি জানতে পারেনি। এমন ব্যক্তি নসের বিরোধিতা করলেও, যেহেতু সে তা জানত না—তার ওপর কোনো গুনাহ নেই।
প্রশ্নকারী: ঠিক আছে শাইখ, যদি নসটি উভয় দিক বা অর্থ বহন করে?
শাইখ: এপর্যন্ত বুঝতে পেরেছো তো?
প্রশ্নকারী: জি শাইখ বুঝতে পেরেছি।
শাইখ: আমি তোমার আগের প্রশ্নের উত্তর শেষ করতে চাই, তার আগে তুমি বিস্তারিত প্রশ্নে ঢুকে যাচ্ছ।
এখন, যেমন কিছু ব্যক্তি, দল কিংবা জামাআত আছে যারা কুরআন-সুন্নাহ এবং সালাফুস সালিহীনের পদ্ধতির বিরোধিতা করে। আমরা তাদের সম্পর্কে বলি যে তারা মুবতাদি‘ (বিদ‘আতকারী)—এখন তুমি জানলে মুবতাদি‘ কে? সে-ই মুবতাদি‘, যে সালাফদের পথের বিপরীত একটি পদ্ধতি নিজের জন্য গ্রহণ করে। এমন লোকদের ব্যাপারে—আমরা তো তাদের অন্তরের খবর জানি না, তাদের নিয়ত সম্পর্কে জানি না। আমরা জানি না তারা মুজতাহিদ ছিল, নাকি প্রকৃতপক্ষে আহলুল আহওয়া (বিভ্রান্ত মতের অনুসারী)। এটি ঠিক যেমন—কেউ কোনো মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কিসাস/হত্যার দণ্ড পেলেও, আল্লাহর কাছে সে হয়তো নির্দোষ। কিন্তু শরীয়াহর আইন প্রয়োগ হয় বাহ্যিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে। তুমি জানো, আমরা বাহ্যিক চেহারা অনুযায়ী হুকুম দিই, আর অন্তরের বিষয় আল্লাহর হাতে।সুতরাং আমাদের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ—তার অন্তর ভাল কি মন্দ নয়; বরং তার ব্যবহারিক মানহাজ সালাফের বিরোধী কি না। যদি বিরোধী হয়, তবে সে মুবতাদি‘। অবশ্যই, হতে পারে কোনো ব্যক্তি মুবতাদি‘ হলেও মুজতাহিদ—যেমন আমি উত্তরের শুরুতে ইঙ্গিত করেছিলাম। আর কেউ হয়তো কোনো হারাম কাজ করল, কিন্তু ছিল মুজতাহিদ—তবুও সে গুনাহগার নয়; বরং সে পুরস্কৃতই হয়।কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:“হাকিম যখন ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়, তার জন্য দুই পুরস্কার; আর ভুল হলে এক পুরস্কার।” এখন, এই বিষয়ে বা অন্য কোনো বিষয়ে যদি তোমার আরও প্রশ্ন থাকে, করতে পারো। আমি আমার ব্যাখ্যা শেষ করেছি।আর এবারের পর আবু উবায়দাহকে আমরা কথা বলার সুযোগ দেবো, যখন সে তার কথাগুলো শেষ করবে—ঠিক আছে।
প্রশ্নকারী: আল্লাহ আপনাকে বরকত দান করুন, শাইখ। যদি সেই নস, যেটি নিয়ে আহলুস সুন্নাহ ও মুবতাদি‘দের মধ্যে মতভেদ হয়—তার দুটি সম্ভাব্য অর্থ থাকে। এবং মুবতাদি‘ ওই দ্বিতীয় অর্থের ভিত্তিতে তার বিদ‘আতকে প্রমাণ করে এবং বলে—“এটাই আমার বুঝ।সুতরাং তুমি তোমার বুঝ নাও, আমি আমারটি নিই। আর এই বিষয়ে সালাফদের কোনো স্পষ্ট বক্তব্যও নেই।”তাহলে, হে শাইখ, এ ক্ষেত্রে মানদণ্ড কী?
শাইখ: যদি তুমি যা বলছো তা সত্যিই তাই হয়, তাহলে—তোমার তার ওপর কোনো আপত্তি নেই।
প্রশ্নকারী: অর্থাৎ সে মুবতাদি‘ নয়, শাইখ?
শাইখ: না, সে মুবতাদি‘ নয়—মুবতাদি‘ তখনই হয় যখন সে সালাফের মানহাজ জানে এবং তবুও তার বিরোধিতা করে।কিন্তু তুমি তোমার কথায় বলেছো—এই বিষয়ে সালাফদের কোনো বক্তব্য নেই। তাহলে তোমারও সালাফের কোনো দলীল নেই, তারও নেই। এখানে তোমার একটি বুঝ আছে, তারও একটি বুঝ আছে। তাহলে তোমরা দুজনই একই অবস্থায়। না সে মুবতাদি‘, না তুমি মুবতাদি‘।তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আসে—সেটি হলো: সে (বা অন্য কেউ), তোমার কথা নয়—সে কি আহলুল ইলমের অন্তর্ভুক্ত? যদি সে আলিম হয়—তাহলে আগের উত্তরের মতোই হুকুম হবে। কিন্তু যদি সে আলিম না হয়—তাহলে তাকে বলা হবে আল্লাহর বাণী: “তোমরা যদি না জান তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর।”(সূরা নাহল: ৪৩) পরিষ্কার?
প্রশ্নকারী: জ্বি শেষ।”(ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, ক্যাসেট নং-৬১৪)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:যদি কোনো আলেম কোনো বিদআত বিষয়ে কথা বলেন, অথবা বিদআতিদের সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট বিদআতে একমত হন, তাহলে কি তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য হবেন?
জবাবে শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
إذا تكلم العالم ببدعة أو سلك مسلك المبتدعة في مسألة من المسائل فهل يعد منهم ؟
الجواب : لا . لا يعد منهم ، ولا يُنسب إليهم ، إذا وافقهم في مسألة من المسائل فإنه وافقهم في هذه المسالة ولا يصح أن يُنسب إليهم نسبة مطلقة .
مثال : من كان على مذهب الإمام أحمد ، لكنه أخذ في مسألة معينة بقول الإمام مالك ، فهل يُعد مالكياً ؟ لا .
وكذلك لو أن فقيهاً على مذهب أبي حنيفة لكنه أخذ في مسالة معينة بمذهب الشافعي هل نقول إنه شافعي ؟ لا .
فإذا رأينا عالماً معتبراً معروفاً بنصحه أخذ بشيءٍ مما ذهب إليه أهل البدع فلا يصح أن نقول هو منهم ، وعلى مذهبهم ، بل نقول : هؤلاء لما نرى لهم من النصيحة لكتاب الله وسنة رسول الله وعباد الله إذا أخطأوا في هذه المسألة فخطؤهم هذا صادرٌ عن اجتهاد والمجتهد من هذه الأمة إن أصاب فله أجران وإن أخطأ فله أجرٌ واحد .
ومن ردَّ جميع الحق لكلمة أخطأ فيها من قال بالحق فإنه ضال ، خصوصاً إذا كان هذا الخطأ الذي ظنه خطـأ ليس بخطأ . لأن بعض الناس إذا خالفه أحد قال هو على خطأ ، وخطَّأه أو ضلله أو ربما كفَّره والعياذ بالله ، وهذا مذهبٌ سيئٌ للغاية . هذا أيضاً ـ الذي يكفر الناس لأي سبب أو لأي معصية ـ إذا صدق هذا التعبير لأي معصية كانت صار مذهبه أشد من مذهب الخوارج ؛ لأن مذهب الخوارج أنهم يكفرون فاعل الكبيرة وليس أي معصية فإذا وجد الآن من يكفر المسلمين بأي معصية فإنه ضال مخالف للكتاب والسنة زائد على مذهب الخوارج الذين قاتلهم علي بن أبي طالب واختلف المسلمون في تكفيرهم فمنهم من كفرهم ومنهم من فسقهم وجعلهم من البغاة الظلمة . أوليس الله يقول : إن تجتنبوا كبائر ما تنهون عنه نكفر عنكم سيئاتكم وندخلكم مدخلاً كريماً . فالإنسان باجتنابه الكبائر يكفر عنه الصغائر إذا لم يُصر على الصغيرة أما إذا أصر فقد قال العلماء إن الإصرار على الصغيرة يجعلها كبيرة . فهذا القول لاشك أنه ضلال . ثم ليعلم هذا القائل ـ بتكفير المسلمين بالمعاصي ـ أن الرسول صلى الله عليه وسلم قال : ” من دعى أخاه بالكفر ـ يعني وليس كما قال ـ إلا رجع عليه ” وهذا الكلام قاله الرسول ، فإنه إن لم يكن كافراً في الدنيا صار كافراً عند الله .
প্রশ্নটি দুটি দিক থেকে বিবেচ্য: যদি কোনো আলেম কোনো বিদআত বিষয়ে কথা বলেন, অথবা কোনো বিষয়ে বিদআতিদের পথ অনুসরণ করেন তবে কি তাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত ধরা হবে?
উত্তর: না। তাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হবে না, এবং তাদের সঙ্গে তার সম্পূর্ণ সম্পর্কও স্থাপন করা যাবে না। যদি তিনি কোনো একটি বিষয়ে তাদের সঙ্গে একমত হন, তবে তিনি সেই নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন, কিন্তু এ কারণে তাকে সামগ্রিকভাবে তাদের অন্তর্ভুক্ত বলা সঠিক নয়।
উদাহরণ: যে ব্যক্তি ইমাম আহমাদের মাযহাব অনুসরণ করেন, কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ইমাম মালিকের মত গ্রহণ করেন তাকে কি মালিকী বলা যাবে? না। তেমনি, যদি কোনো ফকীহ আবু হানিফার মাযহাব অনুসরণকারী হন, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে ইমাম শাফেয়ীর মত নেন তাহলে কি আমরা বলব, তিনি শাফেয়ী? না। তাই, যদি আমরা কোনো স্বীকৃত ও সম্মানিত আলেমকে দেখি যিনি কুরআন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ ও বান্দাদের কল্যাণে আন্তরিক পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিত এবং তিনি কোনো বিষয়ে বিদআতিদের মতের সঙ্গে মিল রেখেছেন, তবে আমরা বলতে পারি না যে তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত, বা তাদের মাযহাবে আছেন। বরং আমরা বলব, যেহেতু আমরা তার মধ্যে কুরআন, সুন্নাহ ও বান্দাদের প্রতি আন্তরিক পরামর্শের মানসিকতা দেখি তাই যদি তিনি ঐ বিষয়ে ভুল করেন, তবে তার এই ভুলটি ইজতিহাদের ফল। আর এই উম্মতের মুজতাহিদ যদি সঠিক হন, তবে তার জন্য দুইটি সওয়াব আর যদি ভুল করেন, তবে একটি সওয়াব। আর যে ব্যক্তি এমন লোকের সমস্ত সত্য কথাকেও প্রত্যাখ্যান করে, শুধুমাত্র এজন্য যে তিনি কোনো একটি বিষয়ে ভুল বলেছেন সে ব্যক্তি বিভ্রান্ত। বিশেষ করে তখন, যখন যেটাকে সে ভুল মনে করছে, আসলে সেটি ভুল নয়। কারণ, কিছু মানুষ আছে কেউ যদি তার মতের বিরোধিতা করে, সঙ্গে সঙ্গে বলে দেয়: সে ভুল করেছে, তাকে বিভ্রান্ত বলে, এমনকি কখনো তাকে কাফেরও বলে ফেলে নাউযুবিল্লাহ, এটি অত্যন্ত নিকৃষ্ট এক পন্থা। আর যারা সামান্য কারণেই মানুষকে কাফের বলে বসে যদি যে কোনো পাপের জন্যই এই অভিব্যক্তি সত্য হয় তবে তার মতবাদ খারেজিদের চেয়েও ভয়াবহ। কারণ, খারেজিরা কেবল বড় পাপের কারণে কাউকে কাফের বলে কিন্তু এখন যদি কেউ কোনো ছোট পাপের কারণেও মুসলমানদের কাফের বলে বসে, তবে সে বিভ্রান্ত, কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী, এবং খারেজিদের পথের চেয়েও বেশি সীমালঙ্ঘনকারী। যাদের বিরুদ্ধে আলী ইবনু আবি তালিব (রাদিআল্লাহু আনহু) যুদ্ধ করেছিলেন। মুসলমানরা খারেজিদের ব্যাপারে মতভেদ করেছিলেন কেউ তাদের কাফের বলেছেন, আবার কেউ বলেছেন তারা ফাসিক ও অবিচারী বিদ্রোহী। আল্লাহ কি বলেননি:”তোমরা যদি সেসব কবীরা গুনাহ পরিহার কর, যা থেকে তোমাদের বারণ করা হয়েছে, তাহলে আমি তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাব সম্মানজনক প্রবেশস্থলে”(সুরা নিসা: ৩১)
অতএব, মানুষ যদি বড় পাপ থেকে বেঁচে থাকে, তবে তার ছোট পাপগুলো মাফ হয়ে যায় যতক্ষণ না সে ছোট পাপে অবিচল থাকে। কিন্তু যদি সে ছোট পাপে অবিচল থাকে, তখন আলেমরা বলেছেন, ছোট পাপে স্থির থাকা সেটিকেও বড় পাপে পরিণত করে। সুতরাং, মুসলমানদের কেবল পাপের কারণে কাফের ঘোষণা করা এতে কোনো সন্দেহ নেই, এটি স্পষ্ট বিভ্রান্তি।আর এই ব্যক্তির জেনে রাখা উচিত যে মুসলমানদের পাপের কারণে কাফের বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি তার ভাইকে কাফের বলে ডাকে অথচ বাস্তবে তা সত্য নয় তবে সেই কথা তার নিজের দিকেই ফিরে আসে। অর্থাৎ, যদি সে প্রকৃতপক্ষে কাফের না হয়, তাহলে এই কথা বলার কারণে বলনে ওয়ালা নিজেই আল্লাহর কাছে কাফের গণ্য হয়।”(ইবনু উসাইমিন; আল-লিক্বাউশ শাহরী লিক্বা নং-১৫)
.
পরিশেষে আল্লাহ আমাদেরকে এবং আপনাকে এমন কাজ করার তৌফিক দান করুন যা তিনি পছন্দ করেন এবং যাতে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।