Monday, November 24, 2025

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া ফটো কার্ডের সয়লাব এবং সমাজে এর কুপ্রভাব ও ইসলামের বিধান

 ❑ বিনোদনের নামে ভুয়া কার্ড সংস্কৃতি: সামাজিক কুপ্রভাব যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তারা অবশ্যই অবগত আছে যে, বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন ভুয়া ফটো কার্ড, এআই-সৃষ্ট ছবি ও ভিডিও ছড়ানোর এক নিরাপদ প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে। এর ব্যাপকতা এত বেশি যে, এটাকে ভয়ানক মহামারী বললে অত্যুক্তি হবে না। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজলভ্য বিভিন্ন অ্যাপস ও টুলস ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ও সংগঠিত ভাবে অল্প সময়েই মূলধারার গণমাধ্যমের মতো দেখতে বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যা কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হল, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করা, জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বকে বিতর্কিত করা এবং জনমতকে প্রভাবিত করা। যদিও এসব কাজে জড়িত অনেকে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে ‘বিনোদন’ বলে দাবি করছে। কিন্তু বাস্তবে বিশ্বাসযোগ্যতার ছদ্মবেশে ছড়ানো এই মিথ্যাচার সমাজে নিঃশব্দে ভুল তথ্য, গুজব ও বিভ্রান্তির বিষ ছড়াচ্ছে। এই ‘ভুয়া কার্ড ছড়ানো’ সংস্কৃতি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গন পর্যন্ত সর্বত্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হল— মূলধারার গণমাধ্যমের লোগো ও টাইপোগ্রাফি নিখুঁতভাবে নকল করার কারণে সাধারণ মানুষ সহজেই সত্য-মিথ্যা আলাদা করতে পারছে না। ফলে গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এছাড়া নারীদের নিয়ে কটূক্তি এবং ধর্মীয় উসকানিও এসব ভুয়া কনটেন্টের অংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষকের মতে, দেশের বিরাট অংশ এসব না জেনে-বুঝে বা তথ্য যাচাই না করেই বিশ্বাস করে। যার কারণে অপতথ্য খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। ইডিট করা আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে দিয়ে কুরুচিপূর্ণ, অশালীন ও মানহানিকর পোস্টের কারণে সমাজে মামলা-হামলা, রক্তপাত, হত্যাকাণ্ড এবং নানা ধরণের বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরিতে অবদান রাখতে এসব ভুয়া ফটো কার্ড।
❑ ইসলামের বিধান:
কোনও ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান বা দলের নামে মিথ্যা ছবি বা ফটোশপ করা ফটো কার্ড তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হারাম এবং এটি মারাত্মক গুনাহের কাজ। কারণ মিথ্যাচারের মাধ্যমে কৌতুকের আড়ালে মানুষকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয় এবং তার উপর নানা ভিত্তিহীন অপবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয় ভুক্তভোগীগণ। হ্যাঁ, ইসলাম নির্দোষ হাসি-মস্করা ও আনন্দ-বিনোদন করা দোষণীয় নয়। তবে সে জন্য মিথ্যা বলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও সাহাবিদের সাথে নির্মল কৌতুক ও হাসি-মস্করা করতেন। কিন্তু তিনি মিথ্যাকে সর্বদা পরিহার করতেন।
✪ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
إنِّي لأمزَحُ ولا أقولُ إلَّا حقًّا
“নিশ্চয়ই আমি কৌতুক করি বা হাসি-মজাক করি। তবে আমি সত্য ব্যতীত আর কিছুই বলি না।” [আলবানি হাদিসটিকে সহিহুল জামে’ (২৪৯৪) গ্রন্থে সহিহ বলেছেন]
✪ মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলার পরিণতি ধ্বংসাত্মক। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«وَيْلٌ لِلَّذِي يُحَدِّثُ بِالحَدِيثِ لِيُضْحِكَ بِهِ القَوْمَ فَيَكْذِبُ، وَيْلٌ لَهُ وَيْلٌ لَهُ»
“যে ব্যক্তি মানুষ হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে তার জন্য ধ্বংস! তার জন্য ধ্বংস! তার জন্য ধ্বংস!” [তিরমিজি আস সুনান ৪/৫৫৭; হাদিস নং ২৩১৫; আবু দাউদ, আস সুনান ৪/২৯৭; হাদিস নং ৪৯৯০]
✪ মজাকের ছলেও যদি কেউ মিথ্যা পরিহার করে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য সুসংবাদ দান করেছেন। তিনি বলেছেন,
«أَنَا زَعِيمٌ بِبَيْتٍ فِي رَبَضِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا، وَبِبَيْتٍ فِي وَسَطِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَإِنْ كَانَ مَازِحًا…»
‘‘যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা বর্জন করে, এমনকি মস্করা বা কৌতুক করতেও মিথ্যা বলে না— তার জন্য জান্নাতের মধ্যদেশে একটি বাড়ির জন্য আমি দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’’ [আবু দাউদ, আস-সুনান, ৪/২৫৩; হাদিস নং ৪৮০০]।
✪ যখন কোনও ব্যক্তির নামে মিথ্যা ফটো কার্ড বা ভুয়া খবর প্রচার করা হয় তখন তা অপবাদ, সম্মানহানি ও ঠাট্টা-বিদ্রূপের মতো আরও মারাত্মক অপরাধে রূপ নেয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ…
“হে মুমিনগণ, কোনও পুরুষ যেন অপর কোনও পুরুষকে উপহাস না করে; হতে পারে তারা এদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর কোনও নারী যেন অপর কোনও নারীকে উপহাস না করে; হতে পারে তারা এদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।” [সূরা হুজুরাত: ১১]। সুতরাং তথাকথিত এই সকল ফানি পেজ, যেগুলো কৌতুকের ছলে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে অথবা বিভিন্ন প্রসিদ্ধ গণমাধ্যমের ফটো কার্ড বিকৃতভাবে তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ায়, সেগুলোর কোনও পোস্ট করা বা সেগুলোকে কোনোভাবে প্রোমট করা জায়েজ (বৈধ) নয়। কারণ এগুলো সমাজে অসত্যতা, বিভ্রান্তি ও পারস্পরিক বিদ্বেষ ও সহিংসতা ছড়াতে ভূমিকা রাখে।
❑ ভুয়া ফটো কার্ড ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট সম্পর্কে সতর্কতা:
❖ ক. বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, যারা অনলাইনের বিভিন্ন টুলস বা অ্যাপ ব্যবহার করে ভুয়া ফটো কার্ড তৈরি করছে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হওয়া এবং হ্যাকিং-এর শিকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
তাই নিজেরা এসব কাজ থেকে বিরত থাকুন এবং অন্যদেরকে সতর্ক করুন।
❖ খ. সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত কোনও ফটো কার্ড দেখেই আবেগপ্রবণ বা প্রভাবিত হবেন না।
পোস্ট করার আগে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখুন:
◆ ১. কোনও ফটো কার্ড দেখেই বিশ্বাস করবেন না। যাচাই করুন এটি কোনও মূলধারার গণমাধ্যম বা বিশ্বস্ত অফিসিয়াল পেইজ থেকে এসেছে কি না। সন্দেহ হলে সরাসরি সেই সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট বা মূল চ্যানেলে গিয়ে তথ্যটি খুঁজুন।
২. ভুয়া কার্ডগুলোতে সাধারণত লোগো, ফন্ট (টাইপোগ্রাফি) বা রঙের ব্যবহারে সূক্ষ্ম ভুল থাকে। ছবির রেজোলিউশন কম বা অতিরিক্ত সম্পাদনার চিহ্ন দেখলে সতর্ক হন। মূলধারার মিডিয়ার লোগো নিখুঁতভাবে নকল করা হলেও, খবরের বাক্য বিন্যাস বা শিরোনামের ভাষা মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক লাগতে পারে।
◆ ৩. ভুয়া কনটেন্ট প্রায়শই এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে তা আপনার রাজনৈতিক বা ধর্মীয় আবেগকে উসকে দেয়। আবেগের বশবর্তী হয়ে তাৎক্ষণিক বিশ্বাস করা বা শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।
◆ ৪. মিথ্যা বা যাচাই বিহীন কোনও কনটেন্ট শেয়ার করা মানে আপনিও মিথ্যা প্রচারে অংশীদার হচ্ছেন। এর মাধ্যমে সমাজে অপবাদ, উসকানি এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর দায়ভার আপনার ওপরও বর্তাবে।
◆ ৫. ভুয়া কার্ডগুলোর মূল লক্ষ্য হল মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করা। তাই বিভ্রান্ত হবেন না; বরং সঠিক তথ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করুন।
◆ ৬. যদি নিশ্চিত হন যে, কোনও কার্ড বা কনটেন্ট ভুয়া এবং সমাজের ক্ষতি করছে, তবে সাথে সাথেই সেই পোস্টটি বা পেইজটি প্ল্যাটফর্মের (যেমন ফেসবুক বা ইউটিউব) কাছে রিপোর্ট করুন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
গ্রন্থনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।
Share:

মৃত ব্যক্তির পোশাক-আশাক ফেলে দেওয়া কিংবা ব্যবহার করা কিংবা স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করার বিধান

 মানুষ মারা গেলে তার পরিধেয় বস্ত্র বা জামাকাপড় বাইরে ফেলে দেওয়া হিন্দু সংস্কৃতি; মুসলিমদের নয়। যার ভিত্তি হচ্ছে, কুসংস্কার। ইসলাম এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না।

বরং তার পরিধেয় বস্ত্র বা পোশাক-আশাক ব্যবহার উপযোগী হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ব্যবহার করায় কোন দোষ নেই। একই কথা তার ব্যবহৃত বিছানা এবং অন্যান্য আসবাবপত্রের ক্ষেত্রেও।
সুতরাং এগুলো ফেলে না দিয়ে বা নষ্ট না করে প্রয়োজনে তার পরিবারের লোকজন ব্যবহার করতে পারে অথবা তারা কোন গরিবকে দান করতে পারে কিংবা চাইলে বিক্রয়ও করতে পারে। এ ব্যাপারে তার ওয়ারিশগণ সিদ্ধান্ত নিবে। কিন্তু সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া বা বাইরে ফেলে দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। কেননা তা অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। আর ইসলামে অপচয় হারাম। অনুরূপভাবে সেগুলো স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করা জায়েজ নাই। এসব ব্যাপারে নিম্নে বিজ্ঞ আলেমদের কয়েকটি ফতওয়া উল্লেখ করা হল:
❑ আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ.-এর ফতওয়া:
সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়━ (প্রশ্নকারী বলেন), আমার বাবার ব্যবহৃত পোশাক-আশাক যেগুলো তিনি তার জীবদ্দশায় পরিধান করতেন সেগুলো আমার জন্য পরিধান কি জায়েজ হবে? উল্লেখ্য যে, কিছু পোশাক এখনো নতুন রয়ে গেছে।
উত্তরে শাইখ বলেন,
ك أن تلبسها إذا كنت وحدك، أما إن كان معك شركاء فاستأذنهم إن سمحوا لك وإلا تباع مع التركة كلها، أما إذا كنت وحدك ما ورثه إلا أنت فلك أن تلبسها ولك أن تتصدق بها، ولك أن تبيعها، أما إذا كان معك ورثة فلا بد من استئذانهم إذا سمحوا لك فلا بأس وإلا تباع مع التركة
“যদি আপনি একমাত্র উত্তরাধিকারী (ওয়ারিশ) হন তবে আপনার জন্য সেগুলো পরিধান করা জায়েজ। কিন্তু যদি আপনার সাথে অন্যান্য অংশীদার (অন্যান্য ওয়ারিশ) থাকে তবে আপনাকে তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। যদি তারা আপনাকে অনুমতি দেয় তবে কোনও অসুবিধা নেই। অন্যথায় সেই পোশাকগুলো অন্যান্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির সাথে বিক্রি করে দিতে হবে। যদি আপনি একমাত্র উত্তরাধিকারী হন অর্থাৎ শুধুমাত্র আপনিই তার সম্পত্তির ওয়ারিশ হন তাহলে আপনার জন্য সেগুলো পরিধান করা অথবা দান করে দেওয়া অথবা বিক্রি করে দেওয়া—সবই জায়েজ। কিন্তু যদি আপনার সাথে অন্যান্য ওয়ারিশ থাকে তবে অবশ্যই তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। যদি তারা আপনাকে অনুমতি দেয় তবে কোনও অসুবিধা নেই। অন্যথায় তা অন্যান্য পরিত্যক্ত সম্পদের সাথে বিক্রি করে দিতে হবে। মোটকথা মৃত ব্যক্তির পোশাকের ব্যবহার নির্ভর করে ওয়ারিশদের সংখ্যা ও তাদের সম্মতির উপর। যদি আপনি একমাত্র ওয়ারিশ হন তবে আপনি স্বাধীনভাবে তা ব্যবহার করতে পারেন। একাধিক ওয়ারিশ থাকলে সকলের অনুমতি আবশ্যক।
❑ আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ.-এর ফতোয়া
শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল-উসাইমিন রাহ-কে প্রশ্ন করা হয়—”মৃত ব্যক্তির পরিবার-পরিজনের জন্য কি মৃত ব্যক্তির পোশাক-আশাক ব্যবহার করা জায়েজ?”
উত্তরে তিনি বলেন:
نعم إذا مات الميت فجميع ما يملكه ملك للورثة من ثياب وفرش وكتب وأدوات كتابة وماصة ( منضدة ) وكرسي كل شيء حتى شماغه وغترته التي عليه ، تنتقل إلى الورثة ، وإذا انتقلت إلى الورثة فهم يتصرفون فيها كما يتصرفون بأموالهم ، فلو قالوا – أي الورثة – وهم مرشدون : ثياب الميت لواحد منهم ، ولبسها ، فلا بأس . ولو اتفقوا على أن يتصدقوا بها فلا بأس ، ولو اتفقوا على أن يبيعوها فلا بأس ، هي ملكهم يتصرفون فيها تصرف الملاك في أملاكهم “
“হ্যাঁ, যখন কোনও ব্যক্তি মারা যায় তখন তার মালিকানাধীন সবকিছু—তার পোশাক, বিছানাপত্র, বই-পুস্তক, লেখার সরঞ্জাম, টেবিল-ডেক্স, চেয়ার, তার মাথার রুমাল (শিমাগ/গুতরা)—সবই ওয়ারিশদের মালিকানায় চলে যায়। যখন তা ওয়ারিশদের মালিকানায় স্থানান্তরিত হয় তখন তারা তাদের নিজেদের সম্পদের মতোই এর ব্যবহার বা ব্যবস্থাপনা করতে পারে। সুতরাং যদি প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন ওয়ারিশগণ যদি বলে যে, মৃতের পোশাক-আশাক তাদের মধ্যে কোনও একজন ব্যবহার করবে এবং সে তা পরিধান করে তাহলে কোনও অসুবিধা নেই। আর যদি তারা ঐকমত্যে পৌঁছায় যে, তারা পোশাকগুলো দান করে দেবে তাতেও কোনও অসুবিধা নেই। আর যদি তারা ঐকমত্যে পৌঁছায় যে তারা পোশাকগুলো বিক্রি করে দেবে তাতেও কোনও অসুবিধা নেই। এটি তাদের সম্পদ। সুতরাং তারা মালিক হিসেবে তাদের সম্পদে যেভাবে ব্যবহার করতে চায় সেভাবে ব্যবহার করতে পারে।”
❑ শাইখ সালেহ আল ফাওজান (হাফিযাহুল্লাহ)-এর ফতোয়া:
সৌদি আরবের নবনিযুক্ত প্রধান মুফতি এবং ফতওয়া ও গবেষণা কমিটির প্রধান আল্লামা ডক্টর শাইখ সালেহ আল ফাওজান (হাফিযাহুল্লাহ)-কে প্রশ্ন করা হয়━মৃত ব্যক্তির পোশাক সংরক্ষণ করে রাখা কি জায়েজ? আর যদি তা জায়েজ না হয় তবে এর দ্বারা কী করা উত্তম?
উত্তরে তিনি বলেন:
يجوز الانتفاع بملابس الميت لمن يلبسها من أسرته ، أو أن تعطى لمن يلبسها من المحتاجين ولا تهدر ، وعلى كل حال هي من التركة إذا كانت ذات قيمة فإنها تصبح من التركة تلحق بتركته وتكون للورثة . والاحتفاظ بها للذكرى لا يجوز ولا ينبغي ، وقد يحرم إذا كان القصد منها التبرك بهذه الثياب ، وما أشبه ذلك ، ثم أيضًا هذا إهدار للمال ، لأن المال ينتفع به ، ولا يجعل محبوسًا لا ينتفع به
“মৃত ব্যক্তির পোশাক-আশাক তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যার জন্য উপযুক্ত তার জন্য তা ব্যবহার করা জায়েজ। অথবা যাদের প্রয়োজন আছে তাদের মধ্য থেকে যার জন্য উপযুক্ত তাকে দিয়ে দেওয়া যায়। এগুলো নষ্ট করা উচিত নয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে যদি পোশাকগুলোর কোনও মূল্য থাকে তবে তা তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির অংশ বলে গণ্য হবে এবং ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। আর স্মৃতি হিসেবে এই পোশাকগুলো সংরক্ষণ করে রাখা জায়েজ নয় এবং তা করা উচিতও নয়। যদি এই পোশাকগুলো থেকে বরকত লাভের উদ্দেশ্যে বা এই জাতীয় অন্য কোনও উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করা হয় তাহলে তা হারামও হতে পারে। এছাড়া এটি সম্পদের অপচয়ও বটে। কারণ সম্পদকে ব্যবহার করা উচিত। এগুলোকে জমা রেখে ব্যবহার থেকে বিরত রাখা উচিত নয়।” [আল-মুনতাকা, ২/২৭১]। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

সুদ সম্পর্কে বিস্তারিত

 প্রশ্ন: সুদের সংজ্ঞা কি? সুদ কত প্রকার ও কী কী? ইসলামে সুদ (রিবা) আদান-প্রদানের শরয়ী হুকুম কী? যদি কেউ সুদকে হালাল মনে করে, তবে তার ইসলামী বিধান কী?

▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর সূদের আরবী হচ্ছে ‘রিবা’। আর ‘রিবা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল- বৃদ্ধি, অতিরিক্ত, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি। মূলধনের অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করাকে সূদ বলে। কুরআন মাজীদেও উক্ত শব্দ ‘বৃদ্ধি’র অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:﴿يَمْحَقُ اللهُ الرِّبا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ﴾অর্থাৎ, আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সদকাহকে বৃদ্ধি করে দেন।”(সূরা বাক্বারাহ: ২৭৬) শরী‘আতের পরিভাষায়-كل قرض جر نفعا فهو ربوا ‘প্রত্যেক ঋণ যা লাভ আনয়ন করে, সেটাই রিবা’।ফিক্বহের পরিভাষায়, الزيادة في أشياء مخصوصة “নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের মধ্যে অতিরিক্ত গ্রহণ করাকে রিবা বলা হয়”(তাহযীবুল লুগাহ, খণ্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ১৯৫)। প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক ‘উমর চাপড়া’র মতে- শরী‘আতে ‘রিবা’ বলতে ঐ অর্থকে বোঝায়, যা ঋণের শর্ত হিসাবে মেয়াদ শেষে ঋণগ্রহীতা মূল অর্থসহ অতিরিক্ত অর্থ ঋণদাতাকে পরিশোধ করতে বাধ্য হয়।
হাদীসেও সূদের প্রকৃতি সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, مَا زَادَ فَهُوَ رِبَا ‘যা (প্রদত্ত অর্থ বা পণ্যের চেয়ে) অতিরিক্ত (নেয়া হয়) তাই সূদ”। ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে প্রদেয় অতিরিক্ত পণ্য বা অর্থই হল রিবা।
.
পারিভাষিক অর্থে রিবা হল: রিবায়ী (সূদ-সম্পর্কিত) বস্তুকে একই জাতীয় বস্তুর বিনিময়ে অতিরিক্ত গ্রহণ করা অথবা রিবায়ী বস্তুর লেনদেনে যে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক বিনিময় (কাবয) আবশ্যক, সেখানে বিনিময় বিলম্বিত করা। অথবা এটি কিছু নির্দিষ্ট বস্তুর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত গ্রহণকেও বলা হয় (মুনতাহাল ইরাদাত,খণ্ড;২;পৃষ্ঠা;৩৪৭; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ২৩/৫৭৫; আল-মুগনী, ৪/৩; আশ-শারহুল কাবীর আলা মাতনিল মুক্বনি, ৪/১২২ পৃ.)।বুঝা এই গেল যে, মূল থেকে যে পরিমাণ অংশ বেশী নেওয়া বা দেওয়া হবে সেটাকেই সুদ বলা হবে। সুতরাং সুদের সংজ্ঞা হল এইরূপ; ‘‘ঋণ দেওয়া মূল অর্থের চেয়ে সময়ের বিনিময়ে যে অতিরিক্ত অর্থ শর্ত ও নির্দিষ্টরূপে নেওয়া হয় তার নাম হল সুদ।’’
.
হাদিসে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) আব্দুল্লাহ্‌ বিন সালাম (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন:إِذَا كَانَ لَكَ عَلَى رَجُلٍ حَقٌّ فَأَهْدَى إِلَيْكَ حِمْلَ تِبْنٍ أَوْ حِمْلَ شَعِيرٍ أَوْ حِمْلَ قَتٍّ فَلا تَأْخُذْهُ فَإِنَّهُ رِبًا“যদি কোন লোকের কাছে তোমার কোন পাওনা থাকে এবং সে তোমাকে এক বাহন ঘাস, বা এক বাহন যব বা এক বাহন খড় উপহার দেয় তবে তুমি তা গ্রহণ করবে না, কেননা সেটা সুদ।”।(সহীহ বুখারী হা/৩৮১৪)হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ,শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন:وَكُلُّ قَرْضٍ شَرَطَ فِيهِ أَنْ يَزِيدَهُ ، فَهُوَ حَرَامٌ بِغَيْرِ خِلَافٍ ، قَالَ ابْنُ الْمُنْذِرِ : أَجْمَعُوا عَلَى أَنَّ الْمُسَلِّفَ إذَا شَرَطَ عَلَى الْمُسْتَسْلِفِ زِيَادَةً أَوْ هَدِيَّةً ، فَأَسْلَفَ عَلَى ذَلِكَ : أَنَّ أَخْذَ الزِّيَادَةِ عَلَى ذَلِكَ رَبًّا .وَقَدْ رُوِيَ عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ ، وَابْنِ عَبَّاسٍ ، وَابْنِ مَسْعُودٍ ، أَنَّهُمْ نَهَوْا عَنْ قَرْضٍ جَرَّ مَنْفَعَةً “যে ঋণের মধ্যে ঋণের চেয়ে বেশি পরিশোধ করার শর্তারোপ করা হয় কোন মতভেদ ছাড়া সেটা সুদ। ইবনুল মুনযির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: তারা (আলেমগণ) এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, ধারদাতা যদি ধারগ্রহীতার কাছে অতিরিক্ত বা উপহারের শর্ত করে এবং সেটার উপর ভিত্তি করে ধার দেয়; তাহলে অতিরিক্ত অংশ গ্রহণ করা সুদ বলে গণ্য হবে। উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ), ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত আছে যে, তারা এমন ঋণ থেকে নিষেধ করেছেন যেটা কোন প্রকার উপকার দেয়।”(ইবনু কুদামাহ আল-মুগনী; খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৪০)
.
সুদ কত প্রকার ও কী কী?
ইসলামে সূদ মূলত দুই প্রকার। যথা: (১) রিবাল ফাযল (رِبا الفَضلِ) ও রিবান নাসীআহ (رِبا النَّسيئةِ)।
.
রিবাল ফাযল বলতে বুঝায় নগদে বেশী নেয়া। যেমন বলা হয়,وهو الزِّيادةُ في أحَدِ العِوَضَينِ في النَّوعِ الواحِدِ مُتَّحِدِ الجِنسِ، كالذَّهبِ بالذَّهبِ”এটি হল- একই জাতের এবং একই ধরণের বস্তুর এক পক্ষে অতিরিক্ত প্রদান, যেমন স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ। শাব্দিক অর্থে ফাযল (অতিরিক্ত) শব্দটি কমতির বিপরীত। যেমন ১ কিলোগ্রাম সোনার বিনিময়ে দেড় কিলোগ্রাম সোনা বিক্রয় করা, অথবা গমের এক সা‘-এর বিনিময়ে দেড় সা গম বিক্রয় করার মত লেনদেন (ফাৎহুল আযীয, ৮/১৬২; আল-ইতকান ওয়াল ইহকাম ফী শারহি তুহফাতিল হুক্কাম, ১/২৯৪; আশ-শারহুল মুমতি‘, ৮/৩৯২ পৃ.)। এছাড়া হস্তগত রিবা (রিবাল ইয়াদ) নিষিদ্ধ। হস্তগত রিবার অর্থ হল- নগদ-বিনিময়ে একটি বস্তু বিক্রয় করা, কিন্তু লেনদেনের সময় এক পক্ষ তার প্রাপ্য গ্রহণ করবে, অন্যপক্ষ তার প্রাপ্য গ্রহণ করবে না (কিফায়াতুন নাবীহ; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ১২৫)।
.
অপরদিকে নাসিয়াহ” শব্দের অর্থ হলো “বিলম্ব” বা “স্থগিত করা”, তাই এই সুদের ক্ষেত্রে মূলত সময়ের বিপরীতে অতিরিক্ত মূল্য বা অর্থ ধার্য করা হয়। শরী‘আতের পরিভাষায় নির্দিষ্ট মেয়াদের বিপরীতে শরী‘আত সম্মত কোন বিনিময় ছাড়া চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যে অতিরিক্ত অর্থ বা মাল আদায় করা হয় তাকে ‘রিবান-নাসিয়াহ’ তথা মেয়াদি ঋনের সূদ বলে। রিবান নাসিয়া’ হল মূলত বর্তমান সমাজে বহুল প্রচলিত সূদ। পুরো ব্যাংকিং সিস্টেম টিকে আছে এই সূদী ব্যবস্থার উপর।সাধারণ মানুষেরা এ সূদেই ঋণ দিয়ে থাকে। মোটকথা রিবান নাসীআহ বলতে বুঝায়: বাকীতে বেশী নেয়া। যেমন বলা হয়,وهو تأْخيرُ القَبضِ فيما يَجْري فيه الرِّبا”এটি হল- রিবা (সূদ) সম্পর্কিত লেনদেনে বিলম্বিত গ্রহণ’। নাসী’আহ শব্দের অর্থ বাকী ও বিলম্বের সূদ। সূদসহ ঋণ ফেরত দিতে বিলম্বের বিনিময়ে ঋণের সূদের উপর অতিরিক্ত সূদ গ্রহণ করা। যেমন গমের এক সা‘ পরিমাণের বিনিময়ে চাল বা যবের এক সা‘ বিক্রি করা এবং ক্রয়-বিক্রয়ের মাজলিস থেকে বিলম্বে গ্রহণ করা।( বিস্তারিত জানতে দেখুন; তুহ্ফাতুল মুহতাজ, ৪/২৭৩; আল-ইকনা‘, ২/১২০; আশ-শারহুল মুমতি‘, খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৯২)।
.
ইসলামে এই দুই প্রকার সূদই নিষিদ্ধ। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘সূদ হল বাকীতে’ (সহীহ বুখারী, হা/২১৭৮; সহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৬)। তবে নগদে হলে সেটা সূদ হবে না। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘হাতে হাতে নগদ লেনদেনে কোন সূদ নেই’ (সহীহ বুখারী, হা/২১৭৯; সহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৬)। অনুরূপভাবে বিনিময়ের ক্ষেত্রে পণ্যের ভিন্নতা থাকলেও সেটা সূদ হবে না। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘যখন দ্রব্য ভিন্ন হবে, তখন তোমরা যেভাবে খুশী ক্রয়-বিক্রয় কর, যখন তা হাতে হাতে নগদে হবে’ (সহীহ মুসলিম হা/১৫৮৭; আবূ দাঊদ, হা/৩৩৫০)। একই জাতীয় পণ্য বিনিময়ে কম-বেশী যেহেতু বৈধ নয়, সুতরাং কেউ নিজের কাছে থাকা নিম্ন মানের জিনিস পরিবর্তন করে উন্নত মানের জিনিস নিতে চাইলে কী করবে এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, আবূ সাঈদ ও আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) খায়বার এলাকায় এক ব্যক্তিকে চাকুরী দিলেন। ঐ ব্যক্তি সেখান থেকে বেশ ভালো খেজুর নিয়ে আসল। রাসূল (ﷺ) তা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, খায়বারের সব খেজুর-ই কি এমন ভালো হয়? ঐ ব্যক্তি বলল, জি-না, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা এক সা‘ এরূপ খেজুর দুই সা‘ (খারাপ) খেজুরের বিনিময়ে গ্রহণ করে থাকি। অথবা ভালো দুই সা‘ খারাপ তিন সা‘র বিনিময়ে গ্রহণ করে থাকি। এ কথা শুনে তিনি বললেন, এভাবে বিনিময় করো না। বরং খারাপ খেজুর (দুই বা তিন সা‘) মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করে ঐ মুদ্রা দিয়ে ভালো খেজুর কিনে নাও’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৪)। উপরিউক্ত সব প্রকারের সূদ আল্লাহ্ তা‘আলা নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে হারাম ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আল্লাহ কেনাবেচা হালাল করেছেন এবং সূদ হারাম করেছেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৭৫)। জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী (ﷺ) সূদখোর, সূদদাতা, তার সাক্ষীদাতা ও তার লেখককে অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, ‘ওরা সবাই সমান’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৭-১৫৯৮; আবূ দাঊদ, হা/৩৩৩৩; তিরমিযী, হা/১২০৬; ইবনে মাজাহ, হা/২২৭৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪২৬৩)। সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘ঋণদাতার জন্য ঋণগ্রহীতার নিকট ঋণ প্রদানের বিনিময়ে লাভবান হওয়ার শর্তারোপ করা জায়েয নয় (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১৪/১৭৭-১৭৮ পৃ.)।
.
প্রশ্ন: ইসলামে সুদ (রিবা) আদান-প্রদানের শরয়ী হুকুম:
.
ইসলামে সুদ (রিবা) আদান-প্রদান করা হারাম ও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কুরআন-হাদিসে এ ব্যাপারে অনেক বেশি সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। এই বিষয়টি জানার পরেও মানুষ সূদ খায়। সূদী লেনদেন করে। দুনিয়া ও আখিরাতে এর পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আল্লাহ তাআলা কুরআনে সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন,
أَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন।”(সূরা বাকারা: ২৭৫)
আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন: یَمۡحَقُ اللّٰهُ الرِّبٰوا وَ یُرۡبِی الصَّدَقٰتِ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ اَثِیۡمٍ“আল্লাহ্‌ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন আর দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ্‌ কোন পাপিষ্ঠ কাফেরকে পছন্দ করেন না।”[সূরা বাকারা: ২৭৬] উক্ত আয়াতের তাফসিরে বিশিষ্ট তাফসিরকারক শাইখ মুহাম্মদ আল-আমীন আস-শানক্বিতী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:قوله تعالى: ( يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا )، صرح في هذه الآية الكريمة بأنه يمحق الربا أي: يذهبه بالكلية من يد صاحبه، أو يحرمه بركة ماله ، فلا ينتفع به كما قاله ابن كثير وغيره”আল্লাহ্‌র বাণী: “আল্লাহ্‌ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন” এ আয়াতে কারীমাতে আল্লাহ্‌ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি সুদকে সুদী কারবারকারীর হাত চূড়ান্তভাবে নিঃশেষ করবেন কিংবা তাকে তার সম্পদের বরকত থেকে বঞ্চিত করবেন; ফলে সে এ সম্পদ দিয়ে উপকৃত হতে পারবে না- যেমনটি বলেছেন ইবনে কাছির ও অন্যান্য আলেমগণ।”(আযওয়াউল বায়ান; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৭০)
অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন:اَلَّذِیۡنَ یَاۡكُلُوۡنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوۡمُوۡنَ اِلَّا كَمَا یَقُوۡمُ الَّذِیۡ یَتَخَبَّطُهُ الشَّیۡطٰنُ مِنَ الۡمَسِّ ؕ ذٰلِكَ بِاَنَّهُمۡ قَالُوۡۤا اِنَّمَا الۡبَیۡعُ مِثۡلُ الرِّبٰوا ۘ وَ اَحَلَّ اللّٰهُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا ؕ“যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।”(সূরা বাকারা: ২৭৫) আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَذَرُواْ مَا بَقِيَ مِنَ ٱلرِّبَوٰٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ – فَإِن لَّمۡ تَفۡعَلُواْ فَأۡذَنُواْ بِحَرۡبٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۖ وَإِن تُبۡتُمۡ فَلَكُمۡ رُءُوسُ أَمۡوَٰلِكُمۡ لَا تَظۡلِمُونَ وَلَا تُظۡلَمُونَ“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর যদি তোমরা ঈমানদার হও। আর যদি তোমরা তা না কর, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শোন” [সূরা আল-বাকারা: ২৭৮-২৭৯]
.
প্রখ্যাত সাহাবী জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন:لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آكِلَ الرِّبَا، وَمُؤْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ، وَشَاهِدَيْهِ، وَقَالَ: هُمْ سَوَاءٌ” রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদগ্রহীতা, সুদদাতা, সুদের লেখক ও সাক্ষীদ্বয়কে লানত করেছেন এবং বলেছেন: তারা সবাই সমান।”(সহিহ মুসলিম: ১৫৯৮) এ কারণেই সূদ লিপিবদ্ধ করা, এর আদান-প্রদানে সহায়তা করা, সূদী দ্রব্য গচ্ছিত রাখা ও এর পাহারাদারীর কাজে নিযুক্ত হওয়া জায়েয নেই। মোটকথা, সূদের কাজে অংশগ্রহণ ও যে কোনোভাবে এর সাহায্য-সহযোগিতা করা হারাম। হাদিসটির ব্যাখ্যায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,”هذا تصريح بتحريم كتابة المبايعة بين المترابيين والشهادة عليهما وفيه تحريم الإعانة على الباطل “সুদী কারবারকারী দুই পক্ষের চুক্তি লিপিবদ্ধ করা ও দুই পক্ষের সাক্ষী হওয়া হারাম— এ ব্যাপারে এ হাদিস সুস্পষ্ট। এ হাদিসে বাতিল কাজে সহযোগিতা করা হারাম হওয়ার দলিলও রয়েছে।”(ইমাম নববী; শারহু মুসলিম; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ২৬) ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘সূদ খাওয়া যিনার চেয়ে বড় অপরাধ। কারণ সূদের শাস্তি আল্লাহর দ্বারা ঘোষণা করা হয়েছে এবং যিনার শাস্তি মানুষের হাতে” (সহীহ মুসলিম, হা/১৬২)। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”সূদ খাওয়া অত্যন্ত কঠিন অপরাধ, যেরকম যিনা। উভয়েরই শাস্তি অত্যন্ত কঠিন”।(ইবন কুদামাহ, আল-মুগনী, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৮০)। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,الرِّبَا وَإِنْ كَثُرَ فَإِنَّ عَاقِبَتَهُ تَصِيرُ إِلَى قَلّ“সূদের দ্বারা সম্পদ যতোই বৃদ্ধি পাক না কেন তার শেষ পরিণতি হলো নিঃস্বতা”।(মুস্তাদরাকে হাকিম হা/২২৬২) সূদের হার কমই হোক আর বেশিই হোক সবই হারাম। সুতরাং মুসলিমের জন্য কোনভাবেই সুদি কারবারে জড়িত হওয়ার সুযোগ নাই। চাই ব্যাংকিং খাতে হোক বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে হোক। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি

সালাফিরা নাকি মাযহাব অস্বীকার করেন এবং সকল হুকুম সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ থেকে নিতে বলেন এ বিষয়ে মন্তব্য

 প্রশ্ন: সালাফিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয় তারা নাকি মাযহাব অস্বীকার করেন এবং সকল হুকুম সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ থেকে নিতে বলেন এ বিষয়ে আপনাদের মন্তব্য কী?

▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর যারা সালাফে সালেহীনদের পথ অনুসরণ করে কিতাব ও সুন্নাহর প্রতি দৃঢ়ভাবে অটল থাকার দাওয়াত দেন এবং মাযহাবের অন্ধ অনুকরণ থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করেন তাদের উদ্দেশ্য কখনোই মাযহাবের কিতাব না পড়া, মাযহাবের ইমামদের মতামতকে হালকা চোখে দেখা কিংবা তাদের ইজতিহাদকে অস্বীকার করা নয়। বরং তাদের দাওয়াতের ভিত্তি কয়েকটি সুস্পষ্ট মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
.
প্রথম মূলনীতি: দলিল প্রদানের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে—আল্লাহ’র কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সুন্নাহ’য় যা এসেছে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তার অনুসরণ করা। ব্যাপকভাবে মুহাজির ও আনসারদের সকল সাহাবী যে মতাদর্শের ওপর ছিলেন তা অনুসরণ করা, আর বিশেষভাবে সুপথপ্রাপ্ত খালীফাহদের অনুসরণ করা। যেহেতু নাবী (ﷺ) এ ব্যাপারে অসিয়ত করে বলেছেন,
فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ
“তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খালীফাহগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে।”(আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭) তারা আল্লাহ’র কথা এবং রাসূলের কথার ওপর কোনো মানুষের কথাকে প্রাধান্য দেয় না। একারণে তাদেরকে আহলুল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ বলা হয়। আল্লাহ’র কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাহকে ধারণ করার পর তারা উম্মাতের ‘আলিমগণের ইজমা‘কে (মতৈক্য) ধারণ করে। তারা প্রথম উৎস দুটি তথা কিতাব ও সুন্নাহ’র পর এই তৃতীয় উৎসের (ইজমা‘) ওপর নির্ভর করে। আর মানুষের মধ্যে যে বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) সৃষ্টি হয়, সে বিষয়কে তারা কিতাব ও সুন্নাহ’র কাছে সোপর্দ করে। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন,“যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সেই বিষয়কে আল্লাহ এবং রাসূলের (নির্দেশের) দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান এনে থাক; এটাই সবচেয়ে উত্তম পন্থা এবং সুন্দরতম মর্মকথা।” [সূরাহ নিসা: ৫৯] তারা আল্লাহ’র রাসূল ﷺ ছাড়া আর কারও নিকট (অনুসরণের) রশি বাঁধে না। তারা কোনো ব্যক্তির রায়ের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করে না, যতক্ষণ না সে কথা কিতাব ও সুন্নাহ’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তারা এই বিশ্বাস পোষণ করে যে, মুজতাহিদ ভুল করে, আবার সঠিকও করে। তারা কেবলমাত্র তাকেই ইজতিহাদের অনুমোদন দেয়, যার মধ্যে ‘আলিমদের মতে ইজতিহাদের সুবিদিত শর্তসমূহ একত্রিত হয়েছে। গ্রহণযোগ্য ইজতিহাদী মাসআলাহসমূহের ক্ষেত্রে তাদের (মধ্যে) কোনো বিরোধ নেই। ইজতিহাদী মাসআলাহগুলোতে তাদের মধ্যকার ইখতিলাফ (মতভেদ) নিজেদের মধ্যে শত্রুতা ও পারস্পরিক সম্পর্কচ্ছেদ আনয়ন করে না, যেমনটা গোঁড়া ও বিদ‘আতীরা করে থাকে। বরং তারা একে অপরকে ভালোবাসে, একে অপরের সাথে মিত্রতা পোষণ করে। তারা একে অপরের পিছনে সালাত আদায় করে। যদিও তাদের মধ্যে কিছু শাখাগত মাসআলাহ’য় মতদ্বৈধতা রয়েছে। বিদ‘আতীদের বিপরীতে, যারা তাদের বিরোধীদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট বা কাফির আখ্যা দেয়।
.
দ্বিতীয় মূলনীতি: ইসলামি উসূল অনুযায়ী ইমামগণ ও মাযহাবের আলেমদের ব্যক্তিগত মত বা ফাতওয়া স্বতন্ত্রভাবে কোনো শারঈ দলিল নয়। আর এই বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর আলেমদের মধ্যে সর্বসম্মত মত (ইজমা) রয়েছে যে, কোনো ইমামের বক্তব্য নিজে নিজে দলিল নয়—যতক্ষণ না তা কুরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
.
সালাফী মানহাজের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো শুধু হক্বের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করা অর্থাৎ হক্ব ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করা। এখানে হক্ব বলতে চূড়ান্ত হক্বকে বুঝানো হয়েছে। আর চূড়ান্ত হক্ব হচ্ছে আল্লাহর কিতাব কুরআন ও রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ।রাসূল (ﷺ)-ই হলেন একমাত্র মানুষ যার অন্ধ আনুগত্য করা যায় এবং করা শুধু বৈধই নয়, আবশ্যকও। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা পেয়েছেন এবং তাবলীগ করেছেন তারই শুধু পক্ষপাতিত্ব চলবে। কারণ একমাত্র অহীই হল চূড়ান্ত হক্ব। অন্য কিছু নয়। ইসলামে সাহাবীদের কথা, তাবিঈ, তাবি‘ তাবিঈ, মুজতাহিদ ইমামগণ, ফক্বীহ, মুফাসসির, মুহাদ্দিছ, আলিম, শাইখদের কথার মূল্য আছে। এই মূল্য ততক্ষণ, যতক্ষণ তাঁরা কুরআন ও সুন্নাহ-এর অনুকূলে কথা বলবেন, মতামত দিবেন। তাঁরা কেউই নিষ্পাপ নয়। তাঁরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নন। তাদের কথা গ্রহণযোগ্যও হতে পারে আবার অগ্রহণযোগ্যও হতে পারে। গ্রহণযোগ্য কি-না তা যাচাই করতে হবে কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) চমৎকার কথা বলেছেন। একদা তিনি রাসূল (ﷺ)-এর ক্ববরের দিকে ইশারা করে বলেন, ‘এই কবরবাসী ছাড়া বাকী প্রত্যেকের কথা গ্রহণও করা যেতে পারে আবার বর্জনও করা যেতে পারে’। তবে গ্রহণ ও বর্জনের এই সিদ্ধান্ত হতে হবে সালাফগণের মানহাজ অনুযায়ী কুরআন ও সুন্নাহর মাপকাঠিতে, নিজের খেয়ালখুশি অনুযায়ী নয়।
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:اتفق أهل العلم – أهل الكتاب والسنة – على أن كل شخص سوى الرسول فإنه يؤخذ من قوله ويترك ، إلا رسول الله صلى الله عليه وسلم ، فإنه يجب تصديقه في كل ما أخبر ، وطاعته في كل ما أمر ، فإنه المعصوم الذي لا ينطق عن الهوى ، إن هو إلا وحي يوحى “আহলে ইলম‌ যারা কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারী তাদের মধ্যে এ বিষয়ে ঐক্যমত আছে যে, রাসূল (ﷺ) ছাড়া অন্য সকল মানুষের কথা গ্রহণও করা হবে,আবার বর্জনও করা হবে। কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথাই সর্বাবস্থায় সত্য। তাঁর সমস্ত বক্তব্যকে অবশ্যই সত্য হিসেবে বিশ্বাস করতে হবে এবং যেসব নির্দেশ দিয়েছেন তা পালন করতে হবে। কারণ তিনিই সে ব্যক্তিত্ব, যিনি ভুল থেকে নিরাপদ এবং নিজের মন থেকে কথা বলেন না; তাঁর বাণী শুধুই ওহী থেকে প্রাপ্ত।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মিনহাজুস সুন্নাহ, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১৯০–১৯১)
.
তৃতীয় মূলনীতি: সত্য (হক্ব) কেবল নির্দিষ্ট চার মাযহাবের পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সত্য হলো সেই মত, যা কুরআন, সহীহ সুন্নাহ এবং সালাফে সালিহীন-এর প্রতিষ্ঠিত শরঈ প্রমাণসমূহের সাথে সুস্পষ্টভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতএব,যেখানে দলিল স্পষ্ট, সেখানেই সত্য; ব্যক্তি, মাযহাব বা কোনো নির্দিষ্ট ইমামের উপর সত্যকে আবদ্ধ করা সঠিক নয়।দলিল আল্লাহর বানী: فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ “তোমরা যদি কোনো বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হও, তবে সেটিকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও।”(সূরা নিসা ৪:৫৯) এখানেই স্পষ্ট হয়েছে:মতবিরোধের ক্ষেত্রে রেফারেন্স কেবল কুরআন ও সুন্নাহ—কোনো ব্যক্তির মাযহাব নয়। আবার রাসূল ﷺ বলেন:عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين “তোমরা আমার সুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের পথ আঁকড়ে ধরো।”(তিরমিযী হা/২৬৭৬) এখানেও নির্দেশনা হলো রেফারেন্স সুন্নাহ,কোনো নির্দিষ্ট মাযহাব নয়।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
أهل السنة لم يقل أحد منهم إن إجماع الأئمة الأربعة حج معصومة ، ولا قال: إن الحق منحصر فيها ، وإن ما خرج عنها باطل ، بل إذا قال: من ليس من أتباع الأئمة ، كسفيان الثوري والأوزاعي والليث بن سعد ومن قبلهم ومن بعدهم من المجتهدين قولا يخالف قول الأئمة الأربعة ، رد ما تنازعوا فيه إلى الله ورسوله ، وكان القول الراجح هو القول الذي قام عليه الدليل“আহলে সুন্নাহর কেউ বলেনি যে চার ইমামের (হানাফি, মালেকি,শাফি‘ঈ,হানবালী) ইজমা কোনো ভুল-অযোগ্য দলিল,অথবা সত্য কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ,এবং যা তাদের বাইরে তা অব্যর্থ বা বাতিল।বরং এমন যদি হয় যে, চার ইমামের অনুসারী নন‌ যেমন সুফিয়ান আস সাওরী, আওযায়ী, লায়স ইবনু সা‘দ অথবা তাদের আগে-পরে আসা কোনো মুজতাহিদ এমন কেউ চার ইমামের মতের বিরোধী কিছু বলেন, তখন বিরোধপূর্ণ সেই বিষয়কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, এবং যে মতের উপর যথাযথ দলিল প্রতিষ্ঠিত হবে সেটাই হবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য।”(মিনহাজুস সুন্নাহ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪১২)
.
চতুর্থ মূলনীতি: যে ব্যক্তি যথেষ্ট যোগ্যতা রাখে, তার জন্য প্রতিটি ইসলামী মাসআলার (ধর্মীয় সিদ্ধান্তের) জন্য সঠিক দলিল অনুসন্ধান করা ওয়াজিব। আর যে ব্যক্তি কুরআন ও হাদীস থেকে নিজে সঠিকভাবে দলিল আহরণে অক্ষম, তার জন্য কর্তব্য হলো এমন কোনো বিশ্বস্ত মাযহাবি আলেমের অনুসরণ করা, যার জ্ঞান ও দ্বীনি বিশ্বাসের ওপর সে পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন:فَاتَّقُوا اللّٰهَ مَا اسۡتَطَعۡتُمۡ সুতরাং তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর”(সূরা তাগাবুন ১৬) তিনি আরও বলেছেন:لَا یُكَلِّفُ اللّٰهُ نَفۡسًا اِلَّا وُسۡعَهَا ؕ”আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না।”(সূরা বাকারা: ২৮৬)
শাইখ মুহাম্মদ আল আমীন শানকিতী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:المضطر للتقليد الأعمى اضطرارا حقيقيّا ، بحيث يكون لا قدرة له ألبتّة على غيره ، مع عدم التّفريط ، لكونه لا قدرة له أصلا على الفهم ، أو له قدرة على الفهم وقد عاقته عوائق قاهرة عن التعلم ، أو هو في أثناء التعلّم ولكنّه يتعلّم تدريجيّا ؛ لأنه لا يقدر على تعلم كل ما يحتاجه في وقت واحد ، أو لم يجد كفؤا يتعلم منه ، فهو معذورٌ في التّقليد المذكور ، للضرورة ؛ لأنّه لا مندوحة له عنه . أما القادر على التعلم المفرط فيه ، والمقدم آراء الرجال على ما علم من الوحي ، فهذا الذي ليس بمعذور”যে ব্যক্তি প্রকৃতভাবে বাধ্য হয়ে অন্ধ অনুসরণ করছে,এমনভাবে যে তার মোটেই অন্য কোনো বিকল্প নেই—যেমন তার বুঝার কোনো সামর্থ্য নেই, অথবা বুঝার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তাকে এমন কোনো জোরপূর্বক বাধা প্রতিরোধ করছে যার কারণে সে শিখতে পারছে না; অথবা সে শিখছে, কিন্তু ধীরে ধীরে, কারণ একবারে সব কিছু শেখা তার পক্ষে সম্ভব নয়; অথবা সে এমন কোনো যোগ্য শিক্ষক খুঁজে পাননি যার কাছ থেকে শিখতে পারবে—সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি এই ধরনের অনুসরণে ক্ষমাপ্রাপ্ত, কারণ এটি তার জন্য অনিবার্য। কিন্তু যে ব্যক্তি শিখতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও শিখার বিষয়ে অলস বা গাফেল, এবং যাহা ওহী দ্বারা প্রমাণিত তা জানার পরও মানুষের মতামতকে তার চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়, সে মোটেই ক্ষমাপ্রাপ্ত নয়।”(আযওয়াউল বায়ান; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৫৮৮)
.
পঞ্চম মূলনীতি: একজন আলেম বা ছাত্রের ইলমের জন্য বিভিন্ন আলেমের মাযহাবসমূহ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। এর প্রয়োজনীয়তার কারণগুলো হলো:
.
(১).‌মাযহাবগুলোর মতামত এবং তাদের নির্দিষ্ট দলিল সম্পর্কে অজ্ঞতা মানুষের কাছে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে সে জানে না কোথায় মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ইজমা (ঐকমত্য) রয়েছে এবং কোথায় মতভেদ আছে। ফলে এমনও হতে পারে যে কেউ অবচেতনভাবে মুসলিমদের স্থির করা ঐকমত্যের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করবে অথবা তাদের নির্ধারিত পথের বাইরে চলে যাবে।ইমাম সুয়ূতী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,من شروط الاجتهاد معرفة أقوال العلماء من الصحابة فمن بعدهم ، إجماعا واختلافا ، لئلا يخرق الإجماع فيما يختار”ইজতিহাদ করার শর্তগুলোর মধ্যে একটি হলো সাহাবা এবং তাদের পরবর্তী আলেমদের মতামত জানা কোথায় ইজমা রয়েছে এবং কোথায় মতভেদ বিদ্যমান — যেন ব্যক্তি নিজের নির্বাচিত মতের দ্বারা কোনো স্থির ইজমা ভেঙে না ফেলে।”(সওনুল মানতিক: ৪৭)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:الذين أخذوا بالحديث دون أن يرجعوا إلى ما كتبه العلماء في الأحكام الشرعية … تجد عندهم من المسائل الغريبة : ما تكاد تجزم بأنها مخالفة للإجماع ، أو يغلب على ظنك أنها مخالفة للإجماع ، لهذا ينبغي للإنسان أن يربط فقهه بما كتبه الفقهاء رحمهم الله ، ولا يعني ذلك أن يجعل إمام هذا المذهب كالرسول عليه الصلاة والسلام يأخذ بأقواله وأفعاله على وجه الالتزام “যারা কেবল হাদীস নিয়েই কাজ করে এবং আলেমরা শরীয়তের হুকুম বিষয়ে যা লিখেছেন সেগুলোতে ফিরে যায় না তাদের কাছে এমনসব অদ্ভুত মাসআলা পাওয়া যায়, যার ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত হওয়া যায় যে তা ইজমার বিরোধী, অথবা অন্তত প্রবল ধারণা হয় যে তা ইজমার বিরোধী। সেজন্য মানুষের উচিত তার ফিকহকে ফুকাহাদের লেখার সাথে সংযুক্ত রাখা। তবে এর মানে এই নয় যে সে মাযহাবের ইমামকে রাসূলের মতো বানিয়ে ফেলবে যেন তার কথা-কার্য বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করতেই হবে।”(ইবনু উসাইমীন,মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ২৬; পৃষ্ঠা: ১৭৭)
(২).আলেমদের সাধারণ মতামত জানা অত্যন্ত জরুরি, যাতে ছাত্র বা আলেম কোনো মাসআলায় বা নসের ব্যাখ্যায় এমন একক মত প্রকাশ না করে, যা পূর্ববর্তী কোনো আলেমের সমর্থন পায়নি এবং যা আগের আলেমদের মতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:كل قول ينفرد به المتأخر عن المتقدمين ، ولم يسبقه إليه أحد منهم ، فإنه يكون خطأ ، كما قال الإمام أحمد بن حنبل: إياك أن تتكلم في مسألة ليس لك فيها إمام”যে কোনো মত যে পরে আসা ব্যক্তি শুধুমাত্র তারই, এবং যা আগে কোনো আলেম দ্বারা প্রস্তাবিত হয়নি, তা ভুল। যেমন ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্ভল বলেছেন:তুমি এমন বিষয়ে কথা বলো না, যেখানে তোমার আগে কোনো ইমাম নেই।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ২৯১)
.
(৩).ফিকহী মাসআলাগুলোর মধ্যে কিছু এমন রয়েছে, যার ওপর কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট দলিল রয়েছে। তবে, কোনো আলেমের পক্ষে সব হাদীস সম্পূর্ণভাবে জানা প্রায় অসম্ভব।আর ধরে নিলাম যে তা জানা সম্ভব তবুও কোনো নির্দিষ্ট মাসআলার হুকুম খুঁজতে গিয়ে সব হাদীস স্মরণে রাখা কঠিন।অনেক সময় হাদীসগুলোর স্থানও এমনসব কিতাবে থাকে যেখানে সাধারণত তা খোঁজার কথা নয়।এই কারণে, আলেম বা ছাত্র যখন মাযহাবগুলোর বক্তব্য এবং তাদের দলিলসমূহ পর্যবেক্ষণ করে, তখন তারা শত শত বছরের গবেষণার ফলাফল থেকে উপকৃত হয়। এভাবে তারা একটি মাসআলার বিভিন্ন দলিল একত্রিত করতে পারে, তুলনা করতে পারে এবং সর্বাধিক সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এ ধরনের কার্যক্রমকে বলা হয় ফিকহ তুলনামূলক গবেষণা (ফিকহ মুকারনা)।অনেক ফিকহী শাখা-মাসআলা রয়েছে যেখানে সরাসরি কোনো শারঈ নস নেই সেখানে দলিল হিসেবে ব্যবহার হয়:ইজমা, কিয়াস, ইস্তিসহাব ইত্যাদি ইলমী পদ্ধতি।তাই কেউ যদি কেবল নিজের মতামতের ওপর নির্ভর করে মাযহাবের কিতাব না দেখে, তাদের দলিল না জেনে, তাদের দিকনির্দেশনা না নিয়ে এভাবে কোনো মাসআলার হুকুম নির্ধারণ করতে চায়, তাহলে সে গবেষণায় যথেষ্ট চেষ্টা করা ব্যক্তির মর্যাদা পাবে না,ফলে, সত্য উদঘাটনের জন্য যে পরিশ্রম ওয়াজিব, তা সে সম্পন্ন করতে পারবে না।শাইখ মুহাম্মদ আল আমীন শানকিতী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:وأما المسائل التي لا نص فيها فالصواب النظر في اجتهادهم – أي أئمة المذاهب – فيها . وقد يكون اتباع اجتهادهم أصوب من اجتهادنا لأنفسنا ؛ لأنهم أكثر علما وتقوى منا”যেসব মাসআলায় সরাসরি কোনো নস নেই, সেখানে সঠিক হলো মাযহাবের ইমামদের ইজতিহাদ পর্যবেক্ষণ করা। অনেক সময় তাদের ইজতিহাদ অনুসরণ করা আমাদের নিজের ইজতিহাদ করার চেয়ে অধিক সঠিক হতে পারে, কারণ তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী এবং আল্লাহভীরু ছিলেন”।(আযওয়াউল বায়ান; খন্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৫৮৯) আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৩০৯৮৫)
.
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের ফিতনা থেকে হেফাজত করুন।এবং তিনি আমাদেরকে এমন কাজ করার তৌফিক দান করুন যা তিনি পছন্দ করেন এবং যাতে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

ক্রিকেট বা ফুটবলকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার বিধান এবং এসব খেলা দেখা সম্পর্কে শরিয়তের হুকুম কী

 প্রশ্ন: ক্রিকেট বা ফুটবলকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার বিধান কী? এবং এসব খেলা দেখা সম্পর্কে শরিয়তের হুকুম কী?

▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর কতিপয় শর্তসাপেক্ষে শুধুমাত্র শারীরিক সুস্থতা বা শরীর চর্চার উদ্দেশ্যে ক্রিকেট–ফুটবলসহ বিভিন্ন ক্রীড়া কার্যক্রমের মৌলিক হুকুম হলো জায়েজ। শর্তগুলো হল- (১) ইসলামের ফরয ইবাদত পালন থেকে উদাসীন না হওয়া। যেমন কোন ফরয সালাত ও সালাতের জামা‘আতের সময় খেলাধুলা করা। (২) শরী‘আতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রতি খেয়াল রাখা। অর্থাৎ খেলাটি হতে হবে ইসলামের জন্য জিহাদের প্রস্তুতি, শারীরিক সক্ষমতা অর্জন ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি বা বৈধ বিনোদনের উদ্দেশ্যে। (৩) সর্বদা সতর আবৃত রাখা। (৪) জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হওয়া। (৫) জুয়া বা হারাম মিশ্রিত না হওয়া। (৬) প্রতিযোগিতার জয়-পরাজয়ে শত্রুতা-মিত্রতা সৃষ্টি না হওয়া। যদি উক্ত বিষয়গুলোর কোন একটি পাওয়া যায়, তখন সে খেলা হারাম হবে।দুঃখজনক হলেও সত্যি বর্তমান ফুটবল, ক্রিকেট সহ প্রচলিত খেলাধুলায় ইসলামী শরী‘আতের উপরিউক্ত শর্তাবলী উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। বরং জীবনের ঝুঁকি, সালাতের প্রতি অবহেলা, সময় ও অর্থের অপচয়, জুয়া-বাজিধরা, রঙখেলা, গ্যালারিতে উদ্দাম নৃত্য-গান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, উল্কী আঁকা ইত্যাদিতে ভরপুর থাকে, যা শরী‘আতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম।
.
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৮৯ হি.] বলেছেন:الأصل في مثل هذه الألعاب الرياضية الجواز إذا كانت هادفة وبريئة ، كما أشار إلى ذلك ابن القيم في كتاب ” الفروسية ” وذكره الشيخ تقي الدين ابن تيمية وغيره ، وإن كان فيها تدريب على الجهاد والكر والفر وتنشيط للأبدان وقلع للأمراض المزمنة وتقوية للروح المعنوية : فهذا يدخل في المستحبات إذا صلحت نية فاعله ، ويشترط للجميع أن لا يضر بالأبدان ولا بالأنفس ، وأن لا يترتب عليه شيء من الشحناء والعداوة التي تقع بين المتلاعبين غالباً ، وأن لا يشغل عما هو أهم منه ، وأن لا يصد عن ذكر الله وعن الصلاة”এ ধরনের ক্রীড়া কার্যক্রমের মৌলিক হুকুম হলো—জায়েজ; যদি তা উদ্দেশ্যপূর্ণ, উপকারী এবং গুনাহ থেকে মুক্ত থাকে। যেমনটি ইবনু কাইয়্যিম তাঁর আল-ফুরুসিয়্যাহ গ্রন্থে এবং শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহসহ অন্যান্য আলেম এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন। আর যদি এসব খেলার মাধ্যমে জিহাদের প্রস্তুতি, আক্রমণ প্রতিহত করার দক্ষতা, শারীরিক সক্রিয়তা, দীর্ঘস্থায়ী রোগ দূরীকরণ বা মানসিক শক্তি বৃদ্ধি—এসব উপকার পাওয়া যায়, তাহলে সৎ নিয়ত থাকলে এগুলো মুস্তাহাব হিসেবে গণ্য হবে।তবে সব ক্ষেত্রেই শর্ত হলো—এটা যেন দেহ বা প্রাণের ক্ষতি না করে, খেলোয়াড়দের মধ্যে সাধারণত যে শত্রুতা-বিরোধ সৃষ্টি হয়, তা যেন না ঘটে। এটি যেন আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে বিরত না করে এবং যেন আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বাধা সৃষ্টি না করে।”(ফাতাওয়া ইবনু ইব্রাহিম; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১১৮)
.
▪️খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা বা খেলার বিনিময় গ্রহণ করা:
.
খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা বা খেলার বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণের বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করা জরুরি। সাধারণত পেশাদার খেলোয়াড়দেরকে বেতন তখনই দেওয়া হয় যখন তারা এমন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যেখানে জয়–পরাজয়ের ভিত্তিতে অর্থ লেনদেন হয়। এই ধরণের লেনদেন স্বভাবতই মাইসির (জুয়া)-এর অনুরূপ। আল্লাহ তাআলা বলেন:يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ… فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ“হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এ সব শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব, তোমরা এ গুলো থেকে বেঁচে থাকো-যাতে কল্যাণপ্রাপ্ত হও।” (সূরা মায়িদাহ: ৯০) বেতনভুক্ত খেলোয়াড়দের জীবনের প্রধান ব্যস্ততা হয়ে দাঁড়ায় খেলাধুলা। তারা প্রতিনিয়ত চিন্তা করে কেবল খেলা নিয়ে, তারই জন্য সময় ব্যয় করে; কারণ এটাই তাদের পেশা, নেশা ও জীবিকা। কিন্তু একজন মুসলিমের কি খেলাকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু বানানো উচিত? আল্লাহ কি আমাদেরকে এ জন্য সৃষ্টি করেছেন? কখনোই নয়। আল্লাহ তাআলা মানব ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তাঁর ইবাদতের জন্য। তিনি বলেন:وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ“আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদতের জন্য।”(সূরা যারিয়াত: ৫৬) কিন্তু যারা খেলাধুলাকে জীবন-জীবিকার অবলম্বন, নেশা, পেশা হিসেবে গ্রহণ করে এবং এর পেছনে জীবন-যৌবন ব্যয় করে তারা কিভাবে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করল? আল্লাহ তাআলা যথার্থই বলেছেন: اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ ۖ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا ۖ وَفِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللَّـهِ وَرِضْوَانٌ ۚ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ“জেনে রাখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ব্যতীত আর কিছু নয়, যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়।” (সূরা হাদীদ: ২০) এর পাশাপাশি এ সব খেলায় অসংখ্য শরিয়া বিরোধী ক্রিয়াকাণ্ড জড়িত তো আছেই। উদাহরণস্বরূপ: অঙ্গ-প্রদর্শন, সালাত নষ্ট হওয়া, জয়–পরাজয়ের ভিত্তিতে অর্থ লেনদেন, ফিতনা ও অনৈতিকতার মুখোমুখি হওয়া, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার ঝুঁকি, এবং আল্লাহর ইবাদত থেকে গাফিল হয়ে পড়া ইত্যাদি।অতএব, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা, কিংবা খেলায় জয়–পরাজয়ের ভিত্তিতে অর্থ লেনদেন করা দুটিই শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করলে এ বিষয়ে জায়েজ ফতোয়া দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এগুলো বাস্তবে বহু নিষিদ্ধ ও আপত্তিকর বিষয়ের সাথে জড়িত।
.
আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ,কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ‐এ ‘ইহতিরাফ’ (الاحتراف) এর সংজ্ঞা এসেছে এভাবে:
الاحتراف في اللغة : الاكتساب , أو طلب حرفة للكسب ، والحرفة : كل ما اشتغل به الإنسان واشتهر به , فيقولون حرفة فلان كذا , يريدون دأبه وديدنه ، وهي بهذا ترادف كلمتي صنعة , وعمل .أما الامتهان : فإنه لا فرق بينه وبين احتراف ; لأن معنى المهنة يرادف معنى الحرفة , وكل منهما يراد به حذق العمل .ويوافق الفقهاءُ اللغويين في هذا , فيطلقون الاحتراف على مزاولة الحرفة وعلى الاكتساب نفسه .
“ইহতিরাফ’ শব্দের ভাষাগত অর্থ হলো উপার্জন করা, অথবা জীবিকা অর্জনের জন্য কোনো পেশা অনুসন্ধান করা। আর হিরফাহ (الحرفة) (পেশা) বলতে বোঝায়—যে কোনো কাজ যার সঙ্গে মানুষ নিজেকে নিয়োজিত করে এবং যার মাধ্যমে সে পরিচিত হয়। তাই তারা বলে: অমুক ব্যক্তির (হিরফাহ) পেশা অমুক অর্থাৎ সে নিয়মিতভাবে যে কাজ করে থাকে।এ অর্থে এটি (সানআহ) অর্থাৎ কারিগরি ও কাজ কর্ম শব্দের সমার্থক।আর ইমতিহান (চাকরি/মেহনতি কাজ) এর সঙ্গে ইহতিরাফ এর কোনো পার্থক্য নেই, কারণ মিহনাহ (পেশা) অর্থও হিরফাহ–এরই সমতুল্য।উভয় শব্দেই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার অর্থ বোঝানো হয়।ফকিহরাও ভাষাবিদদের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত। তারা ইহতিরাফ শব্দটি ব্যবহার করেন পেশা চর্চার জন্য এবং উপার্জন করার কাজের জন্যও।”(আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৬৯)
.
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৮৯ হি.] বলেছেন:
اللعب بالكرة الآن يصاحبه من الأمور المنكرة ما يقضي بالنهي عن لعبها ، هذه الأمور نلخصها فيما يأتي :
أولاً : ثبت لدينا مزاولة لعبها في أوقات الصلاة مما ترتب عليه ترك اللاعبين ومشاهديهم للصلاة أو للصلاة جماعة أو تأخيرهم أداءها عن وقتها ، ولا شك في تحريم أي عمل يحول دون أداء الصلاة في وقتها أو يفوت فعلها جماعة ما لم يكن ثَمَّ عذر شرعي .
ثانياً : ما في طبيعة هذه اللعبة من التحزبات أو إثارة الفتن وتنمية الأحقاد ، وهذه النتائج عكس ما يدعو إليه الإسلام من وجوب التسامح والتآلف والتآخي وتطهير النفوس والضمائر من الأحقاد والضغائن والتنافر .
ثالثاً : ما يصاحب اللعب بها من الأخطار على أبدان اللاعبين بها نتيجة التصادم والتلاكم ، فلا ينتهي اللاعبون بها من لعبتهم في الغالب دون أن يسقط بعضهم في ميدان اللعب مغمى عليه أو مكسورة رجله أو يده ، وليس أدل على صدق هذا من ضرورة وجود سيارة إسعاف طبية تقف بجانبهم وقت اللعب بها .
رابعاً : الغرض من إباحة الألعاب الرياضية تنشيط الأبدان والتدريب على القتال وقلع الأمراض المزمنة ، ولكن اللعب بالكرة الآن لا يهدف إلى شيء من ذلك فقد اقترن به مع ما سبق ذكره ابتزاز المال بالباطل ، فضلاً عن أنه يعرض الأبدان للإصابات وينمي في نفوس اللاعبين والمشاهدين الأحقاد وإثارة الفتن ، بل قد يتجاوز أمر تحيز بعض المشاهدين لبعض اللاعبين إلى الاعتداء والقتل كما حدث في إحدى مباريات جرت في إحدى المدن منذ أشهر ويكفي هذا بمفرده لمنعها ، وبالله التوفيق “
“এখনকার ফুটবল খেলার সঙ্গে এমন কিছু নিন্দনীয় ব্যাপার যুক্ত আছে, যা এর খেলা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সংক্ষেপে এসব কারণ তুলে ধরছি:
প্রথমত: আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই খেলা অনেক সময় সালাতের সময়ে অনুষ্ঠিত হয়, যার ফলে খেলোয়াড় ও দর্শকরা সালাতই ছেড়ে দেয়, অথবা জামাআতে সালাত আদায় করতে পারে না, বা সালাত দেরিতে পড়ে। আর নিঃসন্দেহে সালাত সময়মতো আদায়ে বাধা সৃষ্টি করে অথবা জামাআতে আদায় নষ্ট করে এমন যে কোনো কাজই হারাম, যদি না কোনো শার‘ঈ ওজর থাকে।
.
দ্বিতীয়ত: এই খেলায় দলাদলি, ফিতনা-ফাসাদের উস্কানি এবং পারস্পরিক বিদ্ধেষ জন্মায়। অথচ ইসলাম মানুষকে ক্ষমাশীলতা, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব, এবং অন্তরকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পরিষ্কার রাখার দিকে আহ্বান করে। এসব ফলাফল ইসলামের দাওয়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত।
.
তৃতীয়ত: এই খেলার সঙ্গে খেলোয়াড়দের দেহের জন্য বিপদের সম্ভাবনা থাকে। ধাক্কা, সংঘর্ষ, হাতাহাতির কারণে। ফলে সাধারণত খেলোয়াড়রা মাঠ থেকে নামতে পারে না, কেউ না কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে অথবা কারো হাত-পা ভেঙে যায়। এর সত্যতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো খেলা চলার সময় মাঠের পাশে চিকিৎসা-সুবিধাযুক্ত অ্যাম্বুলেন্স রাখা হয়।
.
চতুর্থত: খেলার বৈধতা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো দেহকে সক্রিয় করা, যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেকে রক্ষা। কিন্তু বর্তমান সময়ে ফুটবল খেলার লক্ষ্য এসব কিছু নয়। বরং, উপরোক্ত ক্ষতিকর বিষয়গুলোর সঙ্গে এটি অন্যায়ভাবে অর্থ আদায়ের মাধ্যম হয়ে গেছে। পাশাপাশি এটি দেহকে আঘাতের ঝুঁকিতে ফেলে, খেলোয়াড় ও দর্শকদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ বাড়ায়, ফিতনা সৃষ্টি করে। এমনকি কিছু দর্শকের পক্ষপাতিত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তারা মারামারি বা হত্যাকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ে যেমন মাস কয়েক আগে এক শহরের খেলায় ঘটেছিল। শুধু এই কারণটিই এ খেলা নিষিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহই তাওফীক দানকারী।” (ফাতাওয়া ইবনু ইব্রাহিম; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১১৬–১১৭)
.
তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন:اللعب بالكرة على الصفة الخاصة المنظمة هذا التنظيم الخاص ، يجعل اللاعبين فريقين ، ويُجعل عوض – أو لا يجعل – : لا ينبغي ؛ لاشتماله عن الصد عن ذكر الله وعن الصلاة .وقد يشتمل مع ذلك على أكل المال بالباطل ، فيلحق بالميسر الذي هو القمار ، فيشبه اللعب بالشطرنج من بعض الوجوه .أما الشخص والشخصان يدحوان بالكرة ويلعبان بها اللعب الغير منظم : فهذا لا بأس به ، لعدم اشتماله على المحذور ، والله أعلم “ফুটবল খেলাকে বিশেষভাবে এমনভাবে সংগঠিত করা যাতে খেলোয়াড়রা দুই দলে বিভক্ত হয়, পুরস্কার রাখা হয় বা না-ও রাখা হয় এটি করা উচিত নয় কারণ এতে আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বাধা সৃষ্টি হয়। এছাড়া এতে অন্যায়ভাবে অর্থ গ্রহণও হতে পারে, যা জুয়ার সঙ্গে মিল রাখে। এই দিক থেকে এটি দাবা খেলার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।কিন্তু একজন-দুজন ব্যক্তি যদি সংগঠিত ম্যাচ ছাড়া সাধারণভাবে বল গড়িয়ে খেলে, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই, কারণ এতে নিষেধযোগ্য দিক নেই।আল্লাহই সর্বজ্ঞ।”(ফাতাওয়া ইবনু ইব্রাহিম; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১১৯)
.
▪️খেলা দেখার হুকুম কি? যেমন বিশ্বকাপ ও অন্যান্য খেলা-ধুলা।
.
যেসব ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচ এমন পুরস্কার বা আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়—যা শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম—সেসব খেলায় অংশগ্রহণ যেমন অবৈধ, তেমনি তা জেনেশুনে দেখা-শোনা করাও বৈধ নয়। কারণ, এ ধরনের খেলা দেখা মানে বাস্তবে সেই নিষিদ্ধ প্রতিযোগিতাকে সমর্থন ও উৎসাহ দেওয়ারই নামান্তর। আর ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী হারামের প্রতি কোনো ধরনের সমর্থন বা সহযোগিতা কখনোই অনুমোদিত নয়।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে প্রশ্ন করা হয়েছিল:বিশ্বকাপসহ বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতা দেখার হুকুম কী? তারা উত্তর দিয়েছেন: “مباريات كرة القدم التي على مال أو نحوه من جوائز حرام ؛ لكون ذلك قمارا ؛ لأنه لا يجوز أخذ السبق وهو العوض إلا فيما أذن فيه الشرع ، وهو المسابقة على الخيل والإبل والرماية ، وعلى هذا فحضور المباريات حرام ، ومشاهدتها كذلك ، لمن علم أنها على عوض ؛ لأن في حضوره لها إقرارا لها .أما إذا كانت المباراة على غير عوض ولم تشغل عما أوجب الله من الصلاة وغيرها ، ولم تشتمل على محظور : ككشف العورات ، أو اختلاط النساء بالرجال ، أو وجود آلات لهو – فلا حرج فيها ولا في مشاهدتها . وبالله التوفيق ، وصلى الله على نبينا محمد وآله وصحبه وسلم”যে সব ফুটবল ম্যাচ অর্থের বিনিময়ে হয় অথবা পুরস্কার ইত্যাদি থাকে সেগুলো হারাম কারণ এটি জুয়া (টাকার বিনিময়ে ফুটবল/ক্রিকেট খেলা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত।) শরীয়তে অনুমোদিত পুরস্কার কেবল তিন ক্ষেত্রেই বৈধ: ঘোড়দৌড়, উটদৌড় ও তীরন্দাজি প্রতিযোগিতা। এ কারণে এসব ম্যাচে উপস্থিত থাকা হারাম, এবং এগুলো দেখাও হারাম, যদি জানা থাকে যে এগুলো পুরস্কার/অর্থের বিনিময়ে হচ্ছে। কারণ এমন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা মানে সেটিকে স্বীকৃতি দেওয়া। কিন্তু যদি কোনো ম্যাচ পুরস্কারবিহীন হয় এবং তা সালাতসহ আল্লাহর ফরজ কাজগুলো থেকে বিরত না করে, এবং নিষিদ্ধ কোনো বিষয় যেমন অঙ্গপ্রকাশ, নারী-পুরুষের মিশ্রণ, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি না থাকে, তাহলে তাতে কোনো দোষ নেই এবং তা দেখাতেও সমস্যা নেই। আল্লাহই তাওফীকদাতা। আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার ও সাহাবীদের ওপর শান্তি বর্ষণ করুন।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ২৩৮)
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বর্তমান সময়ে ক্রিকেট ও ফুটবলে যে ধরনের পেশাদারিত্ব বিদ্যমান, তা বহু শরঈ নিষিদ্ধ বিষয়ে জড়িত হওয়ায় জায়েজ নেই। যদিও মূলত এসব খেলার প্রকৃত হুকুম হলো সেগুলো জায়েজ, যদি তা উদ্দেশ্যপূর্ণ, সীমার মধ্যে এবং গুনাহমুক্তভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পেশাদার খেলোয়াড় হতে হলে অনেক সময় আন্তর্জাতিক ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য কাফির দেশে যেতে হয়; আর সেসব দেশের কুফর, ফিস্ক ও গুনাহের পরিবেশ কারো অজানা নয়। একইভাবে, খ্যাতি, তারকামর্যাদা ও বিপুল অর্থ এসবের কারণে খেলোয়াড়রা নারীদের ফিতনা এবং নানান প্রকার শাহওয়াতে জড়িয়ে পড়ার বাস্তব ঝুঁকির সম্মুখীন হয় এটিও গোপন নয়। আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের ফিতনা থেকে হেফাজত করুন এবং তিনি আমাদেরকে এমন কাজ করার তৌফিক দান করুন যা তিনি পছন্দ করেন এবং যাতে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

যখন কোন সালাফি আলেম কোন বিদআতী কথা বলবে অথবা ধর্মীয় কোন একটি মাসআলার ক্ষেত্রে বিদআতিদের পথে চলবে তাহলে কি তাকে বা তাদেরকে বিদআতিদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হবে

 ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী কোনো সালাফি আলেম যদি কোনো দলিল যথাযথভাবে না বুঝার কারণে বা বিষয়টি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ইলম না থাকার কারণে অথবা ভুল তাবিলের (ব্যাখ্যার) ফলে কোনও বিদআতে লিপ্ত হয় তাহলে তাকে ‘বিদআতি’ বলা যাবে না বরং তার উক্ত কাজটাকে ’বিদআত’ বলতে হবে। সেই বিদআত অনুসরণ করা বৈধ নয়।তবে তার সামনে কুরআন সুন্নাহর সঠিক দলিল-প্রমাণ পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করে ভুল ধারণা দূর করার পরও যদি তিনি সেই বিদআতের উপর অটল থাকেন, গোঁড়ামি করেন কিংবা মানুষকে সে দিকে আহ্বান করতে থাকেন তাহলে তাকে সতর্ক করা এবং প্রয়োজনে বর্জন করা আবশ্যক। কারণ শরিয়তে বিদআত সৃষ্টি করা অত্যন্ত গুরুতর এবং ভয়াবহ অপরাধ। তবে এ বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন যে, ইতিহাসে বহু বিশিষ্ট আলেম ঈমানিয়াতসহ গুরুতর মাসআলায় ভুল করেছেন; সম্ভব যে তাদের কাছে হক্ক স্পষ্টভাবে পৌঁছায়নি বা প্রমাণ যথাযথভাবে পৌঁছায়নি। তাই শুধুমাত্র কোনো ভুল মত বা তাবিলের কারণে সালাফি মানহাজের পরিচিত কোনো আলেমকে ‘বিদআতী’ হিসেবে অভিহিত করা এবং তার অন্যান্য খেদমতকে অস্বীকার করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নীতি নয়। এমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে উম্মাহর কেউই বিদ’আত থেকে রক্ষা পেত না।

.
ড. আহমাদ ইবনু আব্দুল আজিজ হুলায়বী,শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিদআতীদের উপর হুকুম আরোপের মূলনীতিসমূহ নিয়ে একটি বই লিখেছেন যার আরবি নাম হচ্ছে,”উসুলুল হুকমি আলাল মুবতাদিআহ” অতঃপর এই বইয়ের চতুর্থ মূলনীতি হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন:الأصل الرابع عدم الحكم على من وقع في بدعة أنه من أهل الأهواء والبـدع، ولا معاداته بسببها، إلا إذا كانت البدعة مشتهرة مغلظة عند أهل العلم بالسنة অর্থাৎ “যে ব্যক্তি কোনো বিদআতে লিপ্ত হয়েছে, তাকে সরাসরি আহলে আহওয়া ও আহলে বিদআতের অন্তর্ভুক্ত বলে রায় দেওয়া উচিত নয়,তদ্রূপ,শুধুমাত্র সেই কারণে তার সাথে শত্রুতা করাও উচিত নয়, যতক্ষণ না সেই বিদআত এমন সুপরিচিত ও গুরুতর হয় যা আহলে সুন্নাহর আলেমদের কাছে স্পষ্টভাবে নিন্দিত ও স্বীকৃত।”(উসুলুল হুকমি আলাল মুবতাদিআহ” খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৮২)
.
অতঃপর তিনি ফাতওয়া উল্লেখ করেছেন, যেখানে হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:(البدعة التي يُعد بها الرجل من أهل الأهواء: ما اشتهر عند أهل العلم بالسنة مخالفتها للكتاب والسنة؛ كبدعة الخوارج والروافض والقدرية والمرجئة) “যে বিদআতের কারণে কোনো ব্যক্তিকে আহলুল আহওয়া (ভ্রান্ত মতের অনুসারী) হিসেবে গণ্য করা হয়, তা হলো এমন বিদআত যা আহলে সুন্নাহর আলেমদের কাছে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বিরোধী হিসেবে সুপরিচিত ও সুস্পষ্ট। যেমন খারেজী, রাফেযী, (শিয়া) ক্বাদরীয়া এবং মুরজিয়া সম্প্রদায়ের বিদআতসমূহ।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৩৫; পৃষ্ঠা: ৪১৪)
.
কারণ এগুলো এমন ধরনের বিদআত যেগুলোর কারণে তাদের অনুসারীদের বক্তব্য এত গুরুতর হয়ে উঠেছিল যে তারা আহলে সুন্নাহর পরিসর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মুরজিয়ারা তেমন কোনো মারাত্মক বিদআতের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তাদের বক্তব্যে ফকীহ ও এবাদতমূলক লোকদের বহু দল অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদেরকে পূর্বে আহলে সুন্নাহ হিসেবেই গণ্য করা হতো। পরে যখন তারা তাদের কথায় অতিরিক্ত ও গুরুতর বক্তব্য যোগ করল, তখন তাদের অবস্থা কঠোর হয়ে গেল। এর সাথে তুলনা করলে যারা কবরে যাত্রা করে, কবরকে পূজার স্থান, মসজিদ বা উৎসবস্থল বানায় তারা তো এর চেয়েও বড় বিদআতের অধিকারী। কারণ, সাহাবী, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনদের যুগে এমন কোনো দল ছিল না যারা কবরে হজ্জ করত, কিংবা ইসলামে এমন কোনো কবর বা মাযার ছিল না যাকে হজ্জ বা যিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা হতো। এ ধরনের বিদআত পরে, তিন উত্তম যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেখা দেয়। সাধারণ নীতি হলো, যত বেশি কোনো বিদআত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরোধী, তত দেরিতে তা প্রকাশ পায় আর যে বিদআতগুলো বই ও সুন্নাহর তুলনায় কম বিরোধী, সেগুলোই আগে দেখা দেয় যেমন খারেজীদের বিদআত। অতএব, বিদআতের গুরুতরতা কেবল প্রাথমিক যুগের বিদআতগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয় বরং শিরকের বিদআতগুলো পরবর্তীতে দেখা দিয়েছে, যেগুলো আরও গুরুতর, কঠিন ও বিপদজনক। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
ان الذين يعدون من اهل البدع والاهواء هم من اتصف بما يلي:-
1:- انهم يجعلون ما ابتدعوه قولا يفارقون به جماعة المسلمين يوالون عليه ويعادون. 2:- انهم ينازعون فيما توافرت به السنة.
আহলে আহওয়া ও বিদআতের অন্তর্ভুক্ত তারা, যারা নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে..
(ক) তারা তাদের উদ্ভাবিত মতবাদকে এমন একটি বিশ্বাসে রূপ দেয়, যার মাধ্যমে তারা মুসলিম সমাজ থেকে আলাদা হয়ে যায়। এর ওপর ভিত্তি করে তারা বন্ধুত্ব স্থাপন করে ও শত্রুতা পোষণ করে।
(খ) তারা সেই বিষয়গুলোতে বিতর্ক করে যা সুন্নাহ দ্বারা নির্ভরযোগ্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে (যেমন মুতাওয়াতির হাদিস)”।(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩৪৯; এবং খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৪২৫)।
.
এইভাবেই আহলে সুন্নাহ ও আহলে বিদআতের পার্থক্য নির্ধারিত হয়। যারা কোনো বিদআতে পতিত হয়েছে কিন্তু যদি তারা তাদের উদ্ভাবিত বিষয়ে এমন কোনো মত না বানায় যার মাধ্যমে তারা মুসলিম সমাজ থেকে আলাদা হয়, বন্ধুত্ব ও শত্রুতা গড়ে তোলে, তাহলে সেটা কেবল একটি ভুলের ধরন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বিশ্বাসী বান্দাদের এমন ভুল ক্ষমা করে দেন।এ কারণেই পূর্বসূরী সালাফ ও ইমামদের অনেকেই কিছু বিষয়ে ইজতিহাদ করে এমন মত পোষণ করেছেন যা কিতাব ও সুন্নাহর বিপরীত ছিল। তবে তারা এমন ছিল না যে, নিজের মতকে সমর্থনকারীকে বন্ধুত্ব করত এবং ভিন্নমতাবলম্বীকে শত্রু ভাবত, মুসলিম সমাজে বিভাজন আনত, মতবিরোধীদের কাফের বা ফাসিক বলত, কিংবা তাদের সঙ্গে যুদ্ধকে বৈধ মনে করত।যারা এভাবে আচরণ করে, তারাই হলো প্রকৃত বিভাজনকারী ও বিদআতী সম্প্রদায়ের লোক। এছাড়াও মুসলিম ইমামরা একমত যে, যে ব্যক্তি এমন বিষয়ে বিরোধিতা করে যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ জানা আলেমদের নিকট জরুরীভাবে জানা ও নিশ্চিত, তাকে বিদআতী গণ্য করা হবে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শাফা‘আত (সুপারিশ), হাউয কাওসার, বড় পাপের লোকদের জাহান্নাম থেকে বের হওয়া এবং আল্লাহর সিফাত (গুণাবলী), তাকদীর, উচ্চতা ও দর্শন এর মতো বিষয়গুলোতে মুতাওয়াতির হাদীসসমূহে বিশ্বাস।এসব বিষয়গুলো আহলে সুন্নাহর আলেমদের মধ্যে ঐক্যমত্যে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যারা এমন বিষয়ে মতবিরোধ করে যেগুলো এ পর্যায়ে পৌঁছেনি, যেমন একজন সাক্ষী ও শপথের ভিত্তিতে রায় প্রদান, কিসামাহ (রক্তপণ দাবির বিশেষ শপথপ্রথা), ক্বরআহ (লটারির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত) ইত্যাদি বিষয়ে এসব বিষয়ে মতবিরোধ বিদআতের পর্যায়ে পড়ে না।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] জিজ্ঞেস করা হয়েছিল;
প্রশ্নকারী: কোন ব্যক্তিকে বিদ’আতী নির্ধারণ করার মানদণ্ড কী?
শাইখ: তোমার প্রশ্নটা কী?
প্রশ্নকারী: আল্লাহ আপনার উপকার করুন, হে সম্মানিত শাইখ! আমার প্রশ্ন হচ্ছে কখন বা কীভাবে কোনো ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে যে সে বিদ’আতী? অর্থাৎ, কাউকে চিহ্নিত করে বলা যে সে বিদ’আতী এর মূল মানদণ্ড কী?
শাইখ: যখন তার মানহাজ এমন হয় যে, সে কথা, কাজ ও অনুমোদনের দিক থেকে সুন্নাহর ব্যাপক অর্থে বিরোধিতা করে তখনই তাকে বিদ’আতী বলা হয়।কিন্তু যদি কেউ কোনো এক বা একাধিক বিদ’আতে জড়িয়ে পড়ে ইজতিহাদের মাধ্যমে, যদিও সে তাতে ভুল করেছে তাহলে তাকে বিদ’আতী বলা হবে না।না হলে কোনো মানুষই বিদ’আত থেকে রক্ষা পেত না।
প্রশ্নকারী: যখন সে কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধিতা করে, তখন কি?
শাইখ: না, আমি কুরআন কথাটি উল্লেখ করিনি, কারণ এটি তো স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। আমরা জানি কুরআন সুন্নাহ ছাড়া বোঝা যায় না। আর সুন্নাহ তিন প্রকার: কথা , কাজ ও অনুমোদন। এই তিন দিক থেকেই সুন্নাহর বিরোধিতা করে নিজের মতামত বা খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে এবং সে সুন্নাহর প্রতি উদাসীন থাকে, বরং এটাকেই নিজের জীবনের পথ হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে সেই বিদ’আতী ব্যক্তি। কিন্তু কেউ যদি কোনো কারণে সুন্নাহর বিরোধিতা করে এবং তাতে কোনো বিদ’আতে পড়ে যায়, বরং কখনো সরাসরি হারামেও লিপ্ত হয় তবুও তাকে বিদ’আতী বলা হবে না, এবং সে এজন্য ফাসিকও হবে না, যদিও সে একটি হারাম কাজ করেছে।
প্রশ্নকারী: ভালো, হে শাইখ! আগের যুগের বিদ’আতীদের ব্যাপারে কী বলবেন? কীভাবে সালাফগণ তাদেরকে বিদ’আতী বলে অভিহিত করলেন? তারা কীভাবে জানলেন যে তারা বিদ’আতী?
শাইখ: কারণ তারা সালাফে সালিহীনের মানহাজের বিরোধিতা করেছিল।
প্রশ্নকারী: কিন্তু আমরা কীভাবে জানব কেউ খেয়াল-খুশির অনুসারী, নাকি শুধু ভুল করেছে?
শাইখ: আমরা তো জানি না এবং তুমি যদি বলো আমরা জানি না, তাহলে আমি তোমার সঙ্গে একমত। সত্যিই, আমরা জানি না। তাই আমরা বলি: আল্লাহই তাদের হিসাব নেবেন। তবে তারা বিদ’আতী কি না এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তারা বিদ’আতীই, কারণ তারা সালাফে সালিহীনের মানহাজের বিরোধিতা করেছে। আর আমি তোমাকে এমন একটি বিষয় শোনাবো, যা হয়তো তুমি আগে শোনোনি: অনেক আলেম দ্বীনকে ভাগ করেছেন মূলনীতি ও শাখাতে। তারপর তারা এই বিভাজনের ওপর আরেকটি ভিত্তি দাঁড় করিয়েছেন যে শাখা বিষয়ে ভুল করলে তা ক্ষমাযোগ্য, কিন্তু মূলনীতিতে ভুল ক্ষমাযোগ্য নয়।কিন্তু বাস্তবে, এই বিভাজনের কোনো ভিত্তি নেই। কারণ: দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতা যেমন শাখা বিষয়ে হতে পারে, তেমনি মূলনীতিতেও হয়। উভয় ক্ষেত্রেই কোনো পার্থক্য নেই যতক্ষণ না কেউ এমন কোনো বিষয়ে বিরোধিতা করে, যা কুরআন, সুন্নাহ বা সালাফে সালিহীনের সর্বসম্মত মতের বিরুদ্ধে যায়।
সে যদি তা জেনেশুনে করে তাহলে সে দোষী, তা মূলনীতি হোক বা শাখা উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান।
প্রশ্নকারী: (যে বিরোধিতা করছে) সে তো জানে যে এটি (নসের) বিরোধী।
শাইখ: সে নস (দলীল) জানে, তারপরও সে তার বিরোধিতা করছে, এক্ষেত্রে সে যে গুনাহ করছে, সে গুনাহ ফুরু‘ (শাখা) হোক বা উসূল (মূলনীতি) হোক—কোনো পার্থক্য নেই। উভয় ক্ষেত্রেই একই রকম গুনাহ।
এর বিপরীত চিত্র হলো: কেউ ফুরু‘ বা উসূলের কোনো বিষয়ে নসের বিরোধিতা করল, কিন্তু সে ছিল একজন মুজতাহিদ—সত্যকে জানতে চেয়েছে, কিন্তু তার বিরোধিতার বিপরীত কোনো নস তার সামনে আসেনি, সে সেটি জানতে পারেনি। এমন ব্যক্তি নসের বিরোধিতা করলেও, যেহেতু সে তা জানত না—তার ওপর কোনো গুনাহ নেই।
প্রশ্নকারী: ঠিক আছে শাইখ, যদি নসটি উভয় দিক বা অর্থ বহন করে?
শাইখ: এপর্যন্ত বুঝতে পেরেছো তো?
প্রশ্নকারী: জি শাইখ বুঝতে পেরেছি।
শাইখ: আমি তোমার আগের প্রশ্নের উত্তর শেষ করতে চাই, তার আগে তুমি বিস্তারিত প্রশ্নে ঢুকে যাচ্ছ।
এখন, যেমন কিছু ব্যক্তি, দল কিংবা জামাআত আছে যারা কুরআন-সুন্নাহ এবং সালাফুস সালিহীনের পদ্ধতির বিরোধিতা করে। আমরা তাদের সম্পর্কে বলি যে তারা মুবতাদি‘ (বিদ‘আতকারী)—এখন তুমি জানলে মুবতাদি‘ কে? সে-ই মুবতাদি‘, যে সালাফদের পথের বিপরীত একটি পদ্ধতি নিজের জন্য গ্রহণ করে। এমন লোকদের ব্যাপারে—আমরা তো তাদের অন্তরের খবর জানি না, তাদের নিয়ত সম্পর্কে জানি না। আমরা জানি না তারা মুজতাহিদ ছিল, নাকি প্রকৃতপক্ষে আহলুল আহওয়া (বিভ্রান্ত মতের অনুসারী)। এটি ঠিক যেমন—কেউ কোনো মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কিসাস/হত্যার দণ্ড পেলেও, আল্লাহর কাছে সে হয়তো নির্দোষ। কিন্তু শরীয়াহর আইন প্রয়োগ হয় বাহ্যিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে। তুমি জানো, আমরা বাহ্যিক চেহারা অনুযায়ী হুকুম দিই, আর অন্তরের বিষয় আল্লাহর হাতে।সুতরাং আমাদের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ—তার অন্তর ভাল কি মন্দ নয়; বরং তার ব্যবহারিক মানহাজ সালাফের বিরোধী কি না। যদি বিরোধী হয়, তবে সে মুবতাদি‘। অবশ্যই, হতে পারে কোনো ব্যক্তি মুবতাদি‘ হলেও মুজতাহিদ—যেমন আমি উত্তরের শুরুতে ইঙ্গিত করেছিলাম। আর কেউ হয়তো কোনো হারাম কাজ করল, কিন্তু ছিল মুজতাহিদ—তবুও সে গুনাহগার নয়; বরং সে পুরস্কৃতই হয়।কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:“হাকিম যখন ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়, তার জন্য দুই পুরস্কার; আর ভুল হলে এক পুরস্কার।” এখন, এই বিষয়ে বা অন্য কোনো বিষয়ে যদি তোমার আরও প্রশ্ন থাকে, করতে পারো। আমি আমার ব্যাখ্যা শেষ করেছি।আর এবারের পর আবু উবায়দাহকে আমরা কথা বলার সুযোগ দেবো, যখন সে তার কথাগুলো শেষ করবে—ঠিক আছে।
প্রশ্নকারী: আল্লাহ আপনাকে বরকত দান করুন, শাইখ। যদি সেই নস, যেটি নিয়ে আহলুস সুন্নাহ ও মুবতাদি‘দের মধ্যে মতভেদ হয়—তার দুটি সম্ভাব্য অর্থ থাকে। এবং মুবতাদি‘ ওই দ্বিতীয় অর্থের ভিত্তিতে তার বিদ‘আতকে প্রমাণ করে এবং বলে—“এটাই আমার বুঝ।সুতরাং তুমি তোমার বুঝ নাও, আমি আমারটি নিই। আর এই বিষয়ে সালাফদের কোনো স্পষ্ট বক্তব্যও নেই।”তাহলে, হে শাইখ, এ ক্ষেত্রে মানদণ্ড কী?
শাইখ: যদি তুমি যা বলছো তা সত্যিই তাই হয়, তাহলে—তোমার তার ওপর কোনো আপত্তি নেই।
প্রশ্নকারী: অর্থাৎ সে মুবতাদি‘ নয়, শাইখ?
শাইখ: না, সে মুবতাদি‘ নয়—মুবতাদি‘ তখনই হয় যখন সে সালাফের মানহাজ জানে এবং তবুও তার বিরোধিতা করে।কিন্তু তুমি তোমার কথায় বলেছো—এই বিষয়ে সালাফদের কোনো বক্তব্য নেই। তাহলে তোমারও সালাফের কোনো দলীল নেই, তারও নেই। এখানে তোমার একটি বুঝ আছে, তারও একটি বুঝ আছে। তাহলে তোমরা দুজনই একই অবস্থায়। না সে মুবতাদি‘, না তুমি মুবতাদি‘।তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আসে—সেটি হলো: সে (বা অন্য কেউ), তোমার কথা নয়—সে কি আহলুল ইলমের অন্তর্ভুক্ত? যদি সে আলিম হয়—তাহলে আগের উত্তরের মতোই হুকুম হবে। কিন্তু যদি সে আলিম না হয়—তাহলে তাকে বলা হবে আল্লাহর বাণী: “তোমরা যদি না জান তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর।”(সূরা নাহল: ৪৩) পরিষ্কার?
প্রশ্নকারী: জি পরিষ্কার।
শাইখ: শেষ?
প্রশ্নকারী: জ্বি শেষ।”(ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, ক্যাসেট নং-৬১৪)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:যদি কোনো আলেম কোনো বিদআত বিষয়ে কথা বলেন, অথবা বিদআতিদের সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট বিদআতে একমত হন, তাহলে কি তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য হবেন?
জবাবে শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
السؤال ذو شقين :
إذا تكلم العالم ببدعة أو سلك مسلك المبتدعة في مسألة من المسائل فهل يعد منهم ؟
الجواب : لا . لا يعد منهم ، ولا يُنسب إليهم ، إذا وافقهم في مسألة من المسائل فإنه وافقهم في هذه المسالة ولا يصح أن يُنسب إليهم نسبة مطلقة .
مثال : من كان على مذهب الإمام أحمد ، لكنه أخذ في مسألة معينة بقول الإمام مالك ، فهل يُعد مالكياً ؟ لا .
وكذلك لو أن فقيهاً على مذهب أبي حنيفة لكنه أخذ في مسالة معينة بمذهب الشافعي هل نقول إنه شافعي ؟ لا .
فإذا رأينا عالماً معتبراً معروفاً بنصحه أخذ بشيءٍ مما ذهب إليه أهل البدع فلا يصح أن نقول هو منهم ، وعلى مذهبهم ، بل نقول : هؤلاء لما نرى لهم من النصيحة لكتاب الله وسنة رسول الله وعباد الله إذا أخطأوا في هذه المسألة فخطؤهم هذا صادرٌ عن اجتهاد والمجتهد من هذه الأمة إن أصاب فله أجران وإن أخطأ فله أجرٌ واحد .
ومن ردَّ جميع الحق لكلمة أخطأ فيها من قال بالحق فإنه ضال ، خصوصاً إذا كان هذا الخطأ الذي ظنه خطـأ ليس بخطأ . لأن بعض الناس إذا خالفه أحد قال هو على خطأ ، وخطَّأه أو ضلله أو ربما كفَّره والعياذ بالله ، وهذا مذهبٌ سيئٌ للغاية . هذا أيضاً ـ الذي يكفر الناس لأي سبب أو لأي معصية ـ إذا صدق هذا التعبير لأي معصية كانت صار مذهبه أشد من مذهب الخوارج ؛ لأن مذهب الخوارج أنهم يكفرون فاعل الكبيرة وليس أي معصية فإذا وجد الآن من يكفر المسلمين بأي معصية فإنه ضال مخالف للكتاب والسنة زائد على مذهب الخوارج الذين قاتلهم علي بن أبي طالب واختلف المسلمون في تكفيرهم فمنهم من كفرهم ومنهم من فسقهم وجعلهم من البغاة الظلمة . أوليس الله يقول : إن تجتنبوا كبائر ما تنهون عنه نكفر عنكم سيئاتكم وندخلكم مدخلاً كريماً . فالإنسان باجتنابه الكبائر يكفر عنه الصغائر إذا لم يُصر على الصغيرة أما إذا أصر فقد قال العلماء إن الإصرار على الصغيرة يجعلها كبيرة . فهذا القول لاشك أنه ضلال . ثم ليعلم هذا القائل ـ بتكفير المسلمين بالمعاصي ـ أن الرسول صلى الله عليه وسلم قال : ” من دعى أخاه بالكفر ـ يعني وليس كما قال ـ إلا رجع عليه ” وهذا الكلام قاله الرسول ، فإنه إن لم يكن كافراً في الدنيا صار كافراً عند الله .
প্রশ্নটি দুটি দিক থেকে বিবেচ্য: যদি কোনো আলেম কোনো বিদআত বিষয়ে কথা বলেন, অথবা কোনো বিষয়ে বিদআতিদের পথ অনুসরণ করেন তবে কি তাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত ধরা হবে?
উত্তর: না। তাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হবে না, এবং তাদের সঙ্গে তার সম্পূর্ণ সম্পর্কও স্থাপন করা যাবে না। যদি তিনি কোনো একটি বিষয়ে তাদের সঙ্গে একমত হন, তবে তিনি সেই নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন, কিন্তু এ কারণে তাকে সামগ্রিকভাবে তাদের অন্তর্ভুক্ত বলা সঠিক নয়।
উদাহরণ: যে ব্যক্তি ইমাম আহমাদের মাযহাব অনুসরণ করেন, কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ইমাম মালিকের মত গ্রহণ করেন তাকে কি মালিকী বলা যাবে? না। তেমনি, যদি কোনো ফকীহ আবু হানিফার মাযহাব অনুসরণকারী হন, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে ইমাম শাফেয়ীর মত নেন তাহলে কি আমরা বলব, তিনি শাফেয়ী? না। তাই, যদি আমরা কোনো স্বীকৃত ও সম্মানিত আলেমকে দেখি যিনি কুরআন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ ও বান্দাদের কল্যাণে আন্তরিক পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিত এবং তিনি কোনো বিষয়ে বিদআতিদের মতের সঙ্গে মিল রেখেছেন, তবে আমরা বলতে পারি না যে তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত, বা তাদের মাযহাবে আছেন। বরং আমরা বলব, যেহেতু আমরা তার মধ্যে কুরআন, সুন্নাহ ও বান্দাদের প্রতি আন্তরিক পরামর্শের মানসিকতা দেখি তাই যদি তিনি ঐ বিষয়ে ভুল করেন, তবে তার এই ভুলটি ইজতিহাদের ফল। আর এই উম্মতের মুজতাহিদ যদি সঠিক হন, তবে তার জন্য দুইটি সওয়াব আর যদি ভুল করেন, তবে একটি সওয়াব। আর যে ব্যক্তি এমন লোকের সমস্ত সত্য কথাকেও প্রত্যাখ্যান করে, শুধুমাত্র এজন্য যে তিনি কোনো একটি বিষয়ে ভুল বলেছেন সে ব্যক্তি বিভ্রান্ত। বিশেষ করে তখন, যখন যেটাকে সে ভুল মনে করছে, আসলে সেটি ভুল নয়। কারণ, কিছু মানুষ আছে কেউ যদি তার মতের বিরোধিতা করে, সঙ্গে সঙ্গে বলে দেয়: সে ভুল করেছে, তাকে বিভ্রান্ত বলে, এমনকি কখনো তাকে কাফেরও বলে ফেলে নাউযুবিল্লাহ, এটি অত্যন্ত নিকৃষ্ট এক পন্থা। আর যারা সামান্য কারণেই মানুষকে কাফের বলে বসে যদি যে কোনো পাপের জন্যই এই অভিব্যক্তি সত্য হয় তবে তার মতবাদ খারেজিদের চেয়েও ভয়াবহ। কারণ, খারেজিরা কেবল বড় পাপের কারণে কাউকে কাফের বলে কিন্তু এখন যদি কেউ কোনো ছোট পাপের কারণেও মুসলমানদের কাফের বলে বসে, তবে সে বিভ্রান্ত, কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী, এবং খারেজিদের পথের চেয়েও বেশি সীমালঙ্ঘনকারী। যাদের বিরুদ্ধে আলী ইবনু আবি তালিব (রাদিআল্লাহু আনহু) যুদ্ধ করেছিলেন। মুসলমানরা খারেজিদের ব্যাপারে মতভেদ করেছিলেন কেউ তাদের কাফের বলেছেন, আবার কেউ বলেছেন তারা ফাসিক ও অবিচারী বিদ্রোহী। আল্লাহ কি বলেননি:”তোমরা যদি সেসব কবীরা গুনাহ পরিহার কর, যা থেকে তোমাদের বারণ করা হয়েছে, তাহলে আমি তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাব সম্মানজনক প্রবেশস্থলে”(সুরা নিসা: ৩১)
অতএব, মানুষ যদি বড় পাপ থেকে বেঁচে থাকে, তবে তার ছোট পাপগুলো মাফ হয়ে যায় যতক্ষণ না সে ছোট পাপে অবিচল থাকে। কিন্তু যদি সে ছোট পাপে অবিচল থাকে, তখন আলেমরা বলেছেন, ছোট পাপে স্থির থাকা সেটিকেও বড় পাপে পরিণত করে। সুতরাং, মুসলমানদের কেবল পাপের কারণে কাফের ঘোষণা করা এতে কোনো সন্দেহ নেই, এটি স্পষ্ট বিভ্রান্তি।আর এই ব্যক্তির জেনে রাখা উচিত যে মুসলমানদের পাপের কারণে কাফের বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি তার ভাইকে কাফের বলে ডাকে অথচ বাস্তবে তা সত্য নয় তবে সেই কথা তার নিজের দিকেই ফিরে আসে। অর্থাৎ, যদি সে প্রকৃতপক্ষে কাফের না হয়, তাহলে এই কথা বলার কারণে বলনে ওয়ালা নিজেই আল্লাহর কাছে কাফের গণ্য হয়।”(ইবনু উসাইমিন; আল-লিক্বাউশ শাহরী লিক্বা নং-১৫)
.
পরিশেষে আল্লাহ আমাদেরকে এবং আপনাকে এমন কাজ করার তৌফিক দান করুন যা তিনি পছন্দ করেন এবং যাতে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

Translate