❑ বিনোদনের নামে ভুয়া কার্ড সংস্কৃতি: সামাজিক কুপ্রভাব যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তারা অবশ্যই অবগত আছে যে, বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন ভুয়া ফটো কার্ড, এআই-সৃষ্ট ছবি ও ভিডিও ছড়ানোর এক নিরাপদ প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে। এর ব্যাপকতা এত বেশি যে, এটাকে ভয়ানক মহামারী বললে অত্যুক্তি হবে না। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজলভ্য বিভিন্ন অ্যাপস ও টুলস ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ও সংগঠিত ভাবে অল্প সময়েই মূলধারার গণমাধ্যমের মতো দেখতে বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যা কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হল, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করা, জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বকে বিতর্কিত করা এবং জনমতকে প্রভাবিত করা। যদিও এসব কাজে জড়িত অনেকে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে ‘বিনোদন’ বলে দাবি করছে। কিন্তু বাস্তবে বিশ্বাসযোগ্যতার ছদ্মবেশে ছড়ানো এই মিথ্যাচার সমাজে নিঃশব্দে ভুল তথ্য, গুজব ও বিভ্রান্তির বিষ ছড়াচ্ছে। এই ‘ভুয়া কার্ড ছড়ানো’ সংস্কৃতি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গন পর্যন্ত সর্বত্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হল— মূলধারার গণমাধ্যমের লোগো ও টাইপোগ্রাফি নিখুঁতভাবে নকল করার কারণে সাধারণ মানুষ সহজেই সত্য-মিথ্যা আলাদা করতে পারছে না। ফলে গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
Monday, November 24, 2025
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া ফটো কার্ডের সয়লাব এবং সমাজে এর কুপ্রভাব ও ইসলামের বিধান
এছাড়া নারীদের নিয়ে কটূক্তি এবং ধর্মীয় উসকানিও এসব ভুয়া কনটেন্টের অংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষকের মতে, দেশের বিরাট অংশ এসব না জেনে-বুঝে বা তথ্য যাচাই না করেই বিশ্বাস করে। যার কারণে অপতথ্য খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। ইডিট করা আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে দিয়ে কুরুচিপূর্ণ, অশালীন ও মানহানিকর পোস্টের কারণে সমাজে মামলা-হামলা, রক্তপাত, হত্যাকাণ্ড এবং নানা ধরণের বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরিতে অবদান রাখতে এসব ভুয়া ফটো কার্ড।
❑ ইসলামের বিধান:
কোনও ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান বা দলের নামে মিথ্যা ছবি বা ফটোশপ করা ফটো কার্ড তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হারাম এবং এটি মারাত্মক গুনাহের কাজ। কারণ মিথ্যাচারের মাধ্যমে কৌতুকের আড়ালে মানুষকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয় এবং তার উপর নানা ভিত্তিহীন অপবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয় ভুক্তভোগীগণ। হ্যাঁ, ইসলাম নির্দোষ হাসি-মস্করা ও আনন্দ-বিনোদন করা দোষণীয় নয়। তবে সে জন্য মিথ্যা বলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও সাহাবিদের সাথে নির্মল কৌতুক ও হাসি-মস্করা করতেন। কিন্তু তিনি মিথ্যাকে সর্বদা পরিহার করতেন।
✪ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
إنِّي لأمزَحُ ولا أقولُ إلَّا حقًّا
“নিশ্চয়ই আমি কৌতুক করি বা হাসি-মজাক করি। তবে আমি সত্য ব্যতীত আর কিছুই বলি না।” [আলবানি হাদিসটিকে সহিহুল জামে’ (২৪৯৪) গ্রন্থে সহিহ বলেছেন]
✪ মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলার পরিণতি ধ্বংসাত্মক। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«وَيْلٌ لِلَّذِي يُحَدِّثُ بِالحَدِيثِ لِيُضْحِكَ بِهِ القَوْمَ فَيَكْذِبُ، وَيْلٌ لَهُ وَيْلٌ لَهُ»
“যে ব্যক্তি মানুষ হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে তার জন্য ধ্বংস! তার জন্য ধ্বংস! তার জন্য ধ্বংস!” [তিরমিজি আস সুনান ৪/৫৫৭; হাদিস নং ২৩১৫; আবু দাউদ, আস সুনান ৪/২৯৭; হাদিস নং ৪৯৯০]
✪ মজাকের ছলেও যদি কেউ মিথ্যা পরিহার করে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য সুসংবাদ দান করেছেন। তিনি বলেছেন,
«أَنَا زَعِيمٌ بِبَيْتٍ فِي رَبَضِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا، وَبِبَيْتٍ فِي وَسَطِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَإِنْ كَانَ مَازِحًا…»
‘‘যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা বর্জন করে, এমনকি মস্করা বা কৌতুক করতেও মিথ্যা বলে না— তার জন্য জান্নাতের মধ্যদেশে একটি বাড়ির জন্য আমি দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’’ [আবু দাউদ, আস-সুনান, ৪/২৫৩; হাদিস নং ৪৮০০]।
✪ যখন কোনও ব্যক্তির নামে মিথ্যা ফটো কার্ড বা ভুয়া খবর প্রচার করা হয় তখন তা অপবাদ, সম্মানহানি ও ঠাট্টা-বিদ্রূপের মতো আরও মারাত্মক অপরাধে রূপ নেয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ…
“হে মুমিনগণ, কোনও পুরুষ যেন অপর কোনও পুরুষকে উপহাস না করে; হতে পারে তারা এদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর কোনও নারী যেন অপর কোনও নারীকে উপহাস না করে; হতে পারে তারা এদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।” [সূরা হুজুরাত: ১১]। সুতরাং তথাকথিত এই সকল ফানি পেজ, যেগুলো কৌতুকের ছলে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে অথবা বিভিন্ন প্রসিদ্ধ গণমাধ্যমের ফটো কার্ড বিকৃতভাবে তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ায়, সেগুলোর কোনও পোস্ট করা বা সেগুলোকে কোনোভাবে প্রোমট করা জায়েজ (বৈধ) নয়। কারণ এগুলো সমাজে অসত্যতা, বিভ্রান্তি ও পারস্পরিক বিদ্বেষ ও সহিংসতা ছড়াতে ভূমিকা রাখে।
❑ ভুয়া ফটো কার্ড ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট সম্পর্কে সতর্কতা:
❖ ক. বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, যারা অনলাইনের বিভিন্ন টুলস বা অ্যাপ ব্যবহার করে ভুয়া ফটো কার্ড তৈরি করছে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হওয়া এবং হ্যাকিং-এর শিকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
তাই নিজেরা এসব কাজ থেকে বিরত থাকুন এবং অন্যদেরকে সতর্ক করুন।
❖ খ. সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত কোনও ফটো কার্ড দেখেই আবেগপ্রবণ বা প্রভাবিত হবেন না।
পোস্ট করার আগে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখুন:
◆ ১. কোনও ফটো কার্ড দেখেই বিশ্বাস করবেন না। যাচাই করুন এটি কোনও মূলধারার গণমাধ্যম বা বিশ্বস্ত অফিসিয়াল পেইজ থেকে এসেছে কি না। সন্দেহ হলে সরাসরি সেই সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট বা মূল চ্যানেলে গিয়ে তথ্যটি খুঁজুন।
২. ভুয়া কার্ডগুলোতে সাধারণত লোগো, ফন্ট (টাইপোগ্রাফি) বা রঙের ব্যবহারে সূক্ষ্ম ভুল থাকে। ছবির রেজোলিউশন কম বা অতিরিক্ত সম্পাদনার চিহ্ন দেখলে সতর্ক হন। মূলধারার মিডিয়ার লোগো নিখুঁতভাবে নকল করা হলেও, খবরের বাক্য বিন্যাস বা শিরোনামের ভাষা মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক লাগতে পারে।
◆ ৩. ভুয়া কনটেন্ট প্রায়শই এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে তা আপনার রাজনৈতিক বা ধর্মীয় আবেগকে উসকে দেয়। আবেগের বশবর্তী হয়ে তাৎক্ষণিক বিশ্বাস করা বা শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।
◆ ৪. মিথ্যা বা যাচাই বিহীন কোনও কনটেন্ট শেয়ার করা মানে আপনিও মিথ্যা প্রচারে অংশীদার হচ্ছেন। এর মাধ্যমে সমাজে অপবাদ, উসকানি এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর দায়ভার আপনার ওপরও বর্তাবে।
◆ ৫. ভুয়া কার্ডগুলোর মূল লক্ষ্য হল মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করা। তাই বিভ্রান্ত হবেন না; বরং সঠিক তথ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করুন।
◆ ৬. যদি নিশ্চিত হন যে, কোনও কার্ড বা কনটেন্ট ভুয়া এবং সমাজের ক্ষতি করছে, তবে সাথে সাথেই সেই পোস্টটি বা পেইজটি প্ল্যাটফর্মের (যেমন ফেসবুক বা ইউটিউব) কাছে রিপোর্ট করুন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
গ্রন্থনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment