প্রশ্ন: ক্রিকেট বা ফুটবলকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার বিধান কী? এবং এসব খেলা দেখা সম্পর্কে শরিয়তের হুকুম কী?
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর কতিপয় শর্তসাপেক্ষে শুধুমাত্র শারীরিক সুস্থতা বা শরীর চর্চার উদ্দেশ্যে ক্রিকেট–ফুটবলসহ বিভিন্ন ক্রীড়া কার্যক্রমের মৌলিক হুকুম হলো জায়েজ। শর্তগুলো হল- (১) ইসলামের ফরয ইবাদত পালন থেকে উদাসীন না হওয়া। যেমন কোন ফরয সালাত ও সালাতের জামা‘আতের সময় খেলাধুলা করা। (২) শরী‘আতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রতি খেয়াল রাখা। অর্থাৎ খেলাটি হতে হবে ইসলামের জন্য জিহাদের প্রস্তুতি, শারীরিক সক্ষমতা অর্জন ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি বা বৈধ বিনোদনের উদ্দেশ্যে। (৩) সর্বদা সতর আবৃত রাখা। (৪) জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হওয়া। (৫) জুয়া বা হারাম মিশ্রিত না হওয়া। (৬) প্রতিযোগিতার জয়-পরাজয়ে শত্রুতা-মিত্রতা সৃষ্টি না হওয়া। যদি উক্ত বিষয়গুলোর কোন একটি পাওয়া যায়, তখন সে খেলা হারাম হবে।দুঃখজনক হলেও সত্যি বর্তমান ফুটবল, ক্রিকেট সহ প্রচলিত খেলাধুলায় ইসলামী শরী‘আতের উপরিউক্ত শর্তাবলী উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। বরং জীবনের ঝুঁকি, সালাতের প্রতি অবহেলা, সময় ও অর্থের অপচয়, জুয়া-বাজিধরা, রঙখেলা, গ্যালারিতে উদ্দাম নৃত্য-গান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, উল্কী আঁকা ইত্যাদিতে ভরপুর থাকে, যা শরী‘আতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম।
.
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৮৯ হি.] বলেছেন:الأصل في مثل هذه الألعاب الرياضية الجواز إذا كانت هادفة وبريئة ، كما أشار إلى ذلك ابن القيم في كتاب ” الفروسية ” وذكره الشيخ تقي الدين ابن تيمية وغيره ، وإن كان فيها تدريب على الجهاد والكر والفر وتنشيط للأبدان وقلع للأمراض المزمنة وتقوية للروح المعنوية : فهذا يدخل في المستحبات إذا صلحت نية فاعله ، ويشترط للجميع أن لا يضر بالأبدان ولا بالأنفس ، وأن لا يترتب عليه شيء من الشحناء والعداوة التي تقع بين المتلاعبين غالباً ، وأن لا يشغل عما هو أهم منه ، وأن لا يصد عن ذكر الله وعن الصلاة”এ ধরনের ক্রীড়া কার্যক্রমের মৌলিক হুকুম হলো—জায়েজ; যদি তা উদ্দেশ্যপূর্ণ, উপকারী এবং গুনাহ থেকে মুক্ত থাকে। যেমনটি ইবনু কাইয়্যিম তাঁর আল-ফুরুসিয়্যাহ গ্রন্থে এবং শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহসহ অন্যান্য আলেম এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন। আর যদি এসব খেলার মাধ্যমে জিহাদের প্রস্তুতি, আক্রমণ প্রতিহত করার দক্ষতা, শারীরিক সক্রিয়তা, দীর্ঘস্থায়ী রোগ দূরীকরণ বা মানসিক শক্তি বৃদ্ধি—এসব উপকার পাওয়া যায়, তাহলে সৎ নিয়ত থাকলে এগুলো মুস্তাহাব হিসেবে গণ্য হবে।তবে সব ক্ষেত্রেই শর্ত হলো—এটা যেন দেহ বা প্রাণের ক্ষতি না করে, খেলোয়াড়দের মধ্যে সাধারণত যে শত্রুতা-বিরোধ সৃষ্টি হয়, তা যেন না ঘটে। এটি যেন আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে বিরত না করে এবং যেন আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বাধা সৃষ্টি না করে।”(ফাতাওয়া ইবনু ইব্রাহিম; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১১৮)
.
.
খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা বা খেলার বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণের বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করা জরুরি। সাধারণত পেশাদার খেলোয়াড়দেরকে বেতন তখনই দেওয়া হয় যখন তারা এমন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যেখানে জয়–পরাজয়ের ভিত্তিতে অর্থ লেনদেন হয়। এই ধরণের লেনদেন স্বভাবতই মাইসির (জুয়া)-এর অনুরূপ। আল্লাহ তাআলা বলেন:يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ… فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ“হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এ সব শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব, তোমরা এ গুলো থেকে বেঁচে থাকো-যাতে কল্যাণপ্রাপ্ত হও।” (সূরা মায়িদাহ: ৯০) বেতনভুক্ত খেলোয়াড়দের জীবনের প্রধান ব্যস্ততা হয়ে দাঁড়ায় খেলাধুলা। তারা প্রতিনিয়ত চিন্তা করে কেবল খেলা নিয়ে, তারই জন্য সময় ব্যয় করে; কারণ এটাই তাদের পেশা, নেশা ও জীবিকা। কিন্তু একজন মুসলিমের কি খেলাকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু বানানো উচিত? আল্লাহ কি আমাদেরকে এ জন্য সৃষ্টি করেছেন? কখনোই নয়। আল্লাহ তাআলা মানব ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তাঁর ইবাদতের জন্য। তিনি বলেন:وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ“আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদতের জন্য।”(সূরা যারিয়াত: ৫৬) কিন্তু যারা খেলাধুলাকে জীবন-জীবিকার অবলম্বন, নেশা, পেশা হিসেবে গ্রহণ করে এবং এর পেছনে জীবন-যৌবন ব্যয় করে তারা কিভাবে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করল? আল্লাহ তাআলা যথার্থই বলেছেন: اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ ۖ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا ۖ وَفِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللَّـهِ وَرِضْوَانٌ ۚ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ“জেনে রাখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ব্যতীত আর কিছু নয়, যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়।” (সূরা হাদীদ: ২০) এর পাশাপাশি এ সব খেলায় অসংখ্য শরিয়া বিরোধী ক্রিয়াকাণ্ড জড়িত তো আছেই। উদাহরণস্বরূপ: অঙ্গ-প্রদর্শন, সালাত নষ্ট হওয়া, জয়–পরাজয়ের ভিত্তিতে অর্থ লেনদেন, ফিতনা ও অনৈতিকতার মুখোমুখি হওয়া, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার ঝুঁকি, এবং আল্লাহর ইবাদত থেকে গাফিল হয়ে পড়া ইত্যাদি।অতএব, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা, কিংবা খেলায় জয়–পরাজয়ের ভিত্তিতে অর্থ লেনদেন করা দুটিই শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করলে এ বিষয়ে জায়েজ ফতোয়া দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এগুলো বাস্তবে বহু নিষিদ্ধ ও আপত্তিকর বিষয়ের সাথে জড়িত।
.
আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ,কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ‐এ ‘ইহতিরাফ’ (الاحتراف) এর সংজ্ঞা এসেছে এভাবে:
الاحتراف في اللغة : الاكتساب , أو طلب حرفة للكسب ، والحرفة : كل ما اشتغل به الإنسان واشتهر به , فيقولون حرفة فلان كذا , يريدون دأبه وديدنه ، وهي بهذا ترادف كلمتي صنعة , وعمل .أما الامتهان : فإنه لا فرق بينه وبين احتراف ; لأن معنى المهنة يرادف معنى الحرفة , وكل منهما يراد به حذق العمل .ويوافق الفقهاءُ اللغويين في هذا , فيطلقون الاحتراف على مزاولة الحرفة وعلى الاكتساب نفسه .
“ইহতিরাফ’ শব্দের ভাষাগত অর্থ হলো উপার্জন করা, অথবা জীবিকা অর্জনের জন্য কোনো পেশা অনুসন্ধান করা। আর হিরফাহ (الحرفة) (পেশা) বলতে বোঝায়—যে কোনো কাজ যার সঙ্গে মানুষ নিজেকে নিয়োজিত করে এবং যার মাধ্যমে সে পরিচিত হয়। তাই তারা বলে: অমুক ব্যক্তির (হিরফাহ) পেশা অমুক অর্থাৎ সে নিয়মিতভাবে যে কাজ করে থাকে।এ অর্থে এটি (সানআহ) অর্থাৎ কারিগরি ও কাজ কর্ম শব্দের সমার্থক।আর ইমতিহান (চাকরি/মেহনতি কাজ) এর সঙ্গে ইহতিরাফ এর কোনো পার্থক্য নেই, কারণ মিহনাহ (পেশা) অর্থও হিরফাহ–এরই সমতুল্য।উভয় শব্দেই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার অর্থ বোঝানো হয়।ফকিহরাও ভাষাবিদদের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত। তারা ইহতিরাফ শব্দটি ব্যবহার করেন পেশা চর্চার জন্য এবং উপার্জন করার কাজের জন্যও।”(আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৬৯)
.
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৮৯ হি.] বলেছেন:
اللعب بالكرة الآن يصاحبه من الأمور المنكرة ما يقضي بالنهي عن لعبها ، هذه الأمور نلخصها فيما يأتي :
أولاً : ثبت لدينا مزاولة لعبها في أوقات الصلاة مما ترتب عليه ترك اللاعبين ومشاهديهم للصلاة أو للصلاة جماعة أو تأخيرهم أداءها عن وقتها ، ولا شك في تحريم أي عمل يحول دون أداء الصلاة في وقتها أو يفوت فعلها جماعة ما لم يكن ثَمَّ عذر شرعي .
ثانياً : ما في طبيعة هذه اللعبة من التحزبات أو إثارة الفتن وتنمية الأحقاد ، وهذه النتائج عكس ما يدعو إليه الإسلام من وجوب التسامح والتآلف والتآخي وتطهير النفوس والضمائر من الأحقاد والضغائن والتنافر .
ثالثاً : ما يصاحب اللعب بها من الأخطار على أبدان اللاعبين بها نتيجة التصادم والتلاكم ، فلا ينتهي اللاعبون بها من لعبتهم في الغالب دون أن يسقط بعضهم في ميدان اللعب مغمى عليه أو مكسورة رجله أو يده ، وليس أدل على صدق هذا من ضرورة وجود سيارة إسعاف طبية تقف بجانبهم وقت اللعب بها .
رابعاً : الغرض من إباحة الألعاب الرياضية تنشيط الأبدان والتدريب على القتال وقلع الأمراض المزمنة ، ولكن اللعب بالكرة الآن لا يهدف إلى شيء من ذلك فقد اقترن به مع ما سبق ذكره ابتزاز المال بالباطل ، فضلاً عن أنه يعرض الأبدان للإصابات وينمي في نفوس اللاعبين والمشاهدين الأحقاد وإثارة الفتن ، بل قد يتجاوز أمر تحيز بعض المشاهدين لبعض اللاعبين إلى الاعتداء والقتل كما حدث في إحدى مباريات جرت في إحدى المدن منذ أشهر ويكفي هذا بمفرده لمنعها ، وبالله التوفيق “
“এখনকার ফুটবল খেলার সঙ্গে এমন কিছু নিন্দনীয় ব্যাপার যুক্ত আছে, যা এর খেলা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সংক্ষেপে এসব কারণ তুলে ধরছি:
প্রথমত: আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই খেলা অনেক সময় সালাতের সময়ে অনুষ্ঠিত হয়, যার ফলে খেলোয়াড় ও দর্শকরা সালাতই ছেড়ে দেয়, অথবা জামাআতে সালাত আদায় করতে পারে না, বা সালাত দেরিতে পড়ে। আর নিঃসন্দেহে সালাত সময়মতো আদায়ে বাধা সৃষ্টি করে অথবা জামাআতে আদায় নষ্ট করে এমন যে কোনো কাজই হারাম, যদি না কোনো শার‘ঈ ওজর থাকে।
.
দ্বিতীয়ত: এই খেলায় দলাদলি, ফিতনা-ফাসাদের উস্কানি এবং পারস্পরিক বিদ্ধেষ জন্মায়। অথচ ইসলাম মানুষকে ক্ষমাশীলতা, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব, এবং অন্তরকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পরিষ্কার রাখার দিকে আহ্বান করে। এসব ফলাফল ইসলামের দাওয়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত।
.
তৃতীয়ত: এই খেলার সঙ্গে খেলোয়াড়দের দেহের জন্য বিপদের সম্ভাবনা থাকে। ধাক্কা, সংঘর্ষ, হাতাহাতির কারণে। ফলে সাধারণত খেলোয়াড়রা মাঠ থেকে নামতে পারে না, কেউ না কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে অথবা কারো হাত-পা ভেঙে যায়। এর সত্যতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো খেলা চলার সময় মাঠের পাশে চিকিৎসা-সুবিধাযুক্ত অ্যাম্বুলেন্স রাখা হয়।
.
চতুর্থত: খেলার বৈধতা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো দেহকে সক্রিয় করা, যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেকে রক্ষা। কিন্তু বর্তমান সময়ে ফুটবল খেলার লক্ষ্য এসব কিছু নয়। বরং, উপরোক্ত ক্ষতিকর বিষয়গুলোর সঙ্গে এটি অন্যায়ভাবে অর্থ আদায়ের মাধ্যম হয়ে গেছে। পাশাপাশি এটি দেহকে আঘাতের ঝুঁকিতে ফেলে, খেলোয়াড় ও দর্শকদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ বাড়ায়, ফিতনা সৃষ্টি করে। এমনকি কিছু দর্শকের পক্ষপাতিত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তারা মারামারি বা হত্যাকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ে যেমন মাস কয়েক আগে এক শহরের খেলায় ঘটেছিল। শুধু এই কারণটিই এ খেলা নিষিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহই তাওফীক দানকারী।” (ফাতাওয়া ইবনু ইব্রাহিম; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১১৬–১১৭)
.
তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন:اللعب بالكرة على الصفة الخاصة المنظمة هذا التنظيم الخاص ، يجعل اللاعبين فريقين ، ويُجعل عوض – أو لا يجعل – : لا ينبغي ؛ لاشتماله عن الصد عن ذكر الله وعن الصلاة .وقد يشتمل مع ذلك على أكل المال بالباطل ، فيلحق بالميسر الذي هو القمار ، فيشبه اللعب بالشطرنج من بعض الوجوه .أما الشخص والشخصان يدحوان بالكرة ويلعبان بها اللعب الغير منظم : فهذا لا بأس به ، لعدم اشتماله على المحذور ، والله أعلم “ফুটবল খেলাকে বিশেষভাবে এমনভাবে সংগঠিত করা যাতে খেলোয়াড়রা দুই দলে বিভক্ত হয়, পুরস্কার রাখা হয় বা না-ও রাখা হয় এটি করা উচিত নয় কারণ এতে আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বাধা সৃষ্টি হয়। এছাড়া এতে অন্যায়ভাবে অর্থ গ্রহণও হতে পারে, যা জুয়ার সঙ্গে মিল রাখে। এই দিক থেকে এটি দাবা খেলার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।কিন্তু একজন-দুজন ব্যক্তি যদি সংগঠিত ম্যাচ ছাড়া সাধারণভাবে বল গড়িয়ে খেলে, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই, কারণ এতে নিষেধযোগ্য দিক নেই।আল্লাহই সর্বজ্ঞ।”(ফাতাওয়া ইবনু ইব্রাহিম; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১১৯)
.
.
যেসব ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচ এমন পুরস্কার বা আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়—যা শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম—সেসব খেলায় অংশগ্রহণ যেমন অবৈধ, তেমনি তা জেনেশুনে দেখা-শোনা করাও বৈধ নয়। কারণ, এ ধরনের খেলা দেখা মানে বাস্তবে সেই নিষিদ্ধ প্রতিযোগিতাকে সমর্থন ও উৎসাহ দেওয়ারই নামান্তর। আর ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী হারামের প্রতি কোনো ধরনের সমর্থন বা সহযোগিতা কখনোই অনুমোদিত নয়।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে প্রশ্ন করা হয়েছিল:বিশ্বকাপসহ বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতা দেখার হুকুম কী? তারা উত্তর দিয়েছেন: “مباريات كرة القدم التي على مال أو نحوه من جوائز حرام ؛ لكون ذلك قمارا ؛ لأنه لا يجوز أخذ السبق وهو العوض إلا فيما أذن فيه الشرع ، وهو المسابقة على الخيل والإبل والرماية ، وعلى هذا فحضور المباريات حرام ، ومشاهدتها كذلك ، لمن علم أنها على عوض ؛ لأن في حضوره لها إقرارا لها .أما إذا كانت المباراة على غير عوض ولم تشغل عما أوجب الله من الصلاة وغيرها ، ولم تشتمل على محظور : ككشف العورات ، أو اختلاط النساء بالرجال ، أو وجود آلات لهو – فلا حرج فيها ولا في مشاهدتها . وبالله التوفيق ، وصلى الله على نبينا محمد وآله وصحبه وسلم”যে সব ফুটবল ম্যাচ অর্থের বিনিময়ে হয় অথবা পুরস্কার ইত্যাদি থাকে সেগুলো হারাম কারণ এটি জুয়া (টাকার বিনিময়ে ফুটবল/ক্রিকেট খেলা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত।) শরীয়তে অনুমোদিত পুরস্কার কেবল তিন ক্ষেত্রেই বৈধ: ঘোড়দৌড়, উটদৌড় ও তীরন্দাজি প্রতিযোগিতা। এ কারণে এসব ম্যাচে উপস্থিত থাকা হারাম, এবং এগুলো দেখাও হারাম, যদি জানা থাকে যে এগুলো পুরস্কার/অর্থের বিনিময়ে হচ্ছে। কারণ এমন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা মানে সেটিকে স্বীকৃতি দেওয়া। কিন্তু যদি কোনো ম্যাচ পুরস্কারবিহীন হয় এবং তা সালাতসহ আল্লাহর ফরজ কাজগুলো থেকে বিরত না করে, এবং নিষিদ্ধ কোনো বিষয় যেমন অঙ্গপ্রকাশ, নারী-পুরুষের মিশ্রণ, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি না থাকে, তাহলে তাতে কোনো দোষ নেই এবং তা দেখাতেও সমস্যা নেই। আল্লাহই তাওফীকদাতা। আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার ও সাহাবীদের ওপর শান্তি বর্ষণ করুন।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ২৩৮)
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বর্তমান সময়ে ক্রিকেট ও ফুটবলে যে ধরনের পেশাদারিত্ব বিদ্যমান, তা বহু শরঈ নিষিদ্ধ বিষয়ে জড়িত হওয়ায় জায়েজ নেই। যদিও মূলত এসব খেলার প্রকৃত হুকুম হলো সেগুলো জায়েজ, যদি তা উদ্দেশ্যপূর্ণ, সীমার মধ্যে এবং গুনাহমুক্তভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পেশাদার খেলোয়াড় হতে হলে অনেক সময় আন্তর্জাতিক ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য কাফির দেশে যেতে হয়; আর সেসব দেশের কুফর, ফিস্ক ও গুনাহের পরিবেশ কারো অজানা নয়। একইভাবে, খ্যাতি, তারকামর্যাদা ও বিপুল অর্থ এসবের কারণে খেলোয়াড়রা নারীদের ফিতনা এবং নানান প্রকার শাহওয়াতে জড়িয়ে পড়ার বাস্তব ঝুঁকির সম্মুখীন হয় এটিও গোপন নয়। আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের ফিতনা থেকে হেফাজত করুন এবং তিনি আমাদেরকে এমন কাজ করার তৌফিক দান করুন যা তিনি পছন্দ করেন এবং যাতে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।
No comments:
Post a Comment