প্রশ্ন: সালাফিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয় তারা নাকি মাযহাব অস্বীকার করেন এবং সকল হুকুম সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ থেকে নিতে বলেন এ বিষয়ে আপনাদের মন্তব্য কী?
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর যারা সালাফে সালেহীনদের পথ অনুসরণ করে কিতাব ও সুন্নাহর প্রতি দৃঢ়ভাবে অটল থাকার দাওয়াত দেন এবং মাযহাবের অন্ধ অনুকরণ থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করেন তাদের উদ্দেশ্য কখনোই মাযহাবের কিতাব না পড়া, মাযহাবের ইমামদের মতামতকে হালকা চোখে দেখা কিংবা তাদের ইজতিহাদকে অস্বীকার করা নয়। বরং তাদের দাওয়াতের ভিত্তি কয়েকটি সুস্পষ্ট মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
.
প্রথম মূলনীতি: দলিল প্রদানের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে—আল্লাহ’র কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সুন্নাহ’য় যা এসেছে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তার অনুসরণ করা। ব্যাপকভাবে মুহাজির ও আনসারদের সকল সাহাবী যে মতাদর্শের ওপর ছিলেন তা অনুসরণ করা, আর বিশেষভাবে সুপথপ্রাপ্ত খালীফাহদের অনুসরণ করা। যেহেতু নাবী (ﷺ) এ ব্যাপারে অসিয়ত করে বলেছেন,
فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ
“তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খালীফাহগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে।”(আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭) তারা আল্লাহ’র কথা এবং রাসূলের কথার ওপর কোনো মানুষের কথাকে প্রাধান্য দেয় না। একারণে তাদেরকে আহলুল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ বলা হয়। আল্লাহ’র কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাহকে ধারণ করার পর তারা উম্মাতের ‘আলিমগণের ইজমা‘কে (মতৈক্য) ধারণ করে। তারা প্রথম উৎস দুটি তথা কিতাব ও সুন্নাহ’র পর এই তৃতীয় উৎসের (ইজমা‘) ওপর নির্ভর করে। আর মানুষের মধ্যে যে বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) সৃষ্টি হয়, সে বিষয়কে তারা কিতাব ও সুন্নাহ’র কাছে সোপর্দ করে। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন,“যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সেই বিষয়কে আল্লাহ এবং রাসূলের (নির্দেশের) দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান এনে থাক; এটাই সবচেয়ে উত্তম পন্থা এবং সুন্দরতম মর্মকথা।” [সূরাহ নিসা: ৫৯] তারা আল্লাহ’র রাসূল ﷺ ছাড়া আর কারও নিকট (অনুসরণের) রশি বাঁধে না। তারা কোনো ব্যক্তির রায়ের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করে না, যতক্ষণ না সে কথা কিতাব ও সুন্নাহ’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তারা এই বিশ্বাস পোষণ করে যে, মুজতাহিদ ভুল করে, আবার সঠিকও করে। তারা কেবলমাত্র তাকেই ইজতিহাদের অনুমোদন দেয়, যার মধ্যে ‘আলিমদের মতে ইজতিহাদের সুবিদিত শর্তসমূহ একত্রিত হয়েছে। গ্রহণযোগ্য ইজতিহাদী মাসআলাহসমূহের ক্ষেত্রে তাদের (মধ্যে) কোনো বিরোধ নেই। ইজতিহাদী মাসআলাহগুলোতে তাদের মধ্যকার ইখতিলাফ (মতভেদ) নিজেদের মধ্যে শত্রুতা ও পারস্পরিক সম্পর্কচ্ছেদ আনয়ন করে না, যেমনটা গোঁড়া ও বিদ‘আতীরা করে থাকে। বরং তারা একে অপরকে ভালোবাসে, একে অপরের সাথে মিত্রতা পোষণ করে। তারা একে অপরের পিছনে সালাত আদায় করে। যদিও তাদের মধ্যে কিছু শাখাগত মাসআলাহ’য় মতদ্বৈধতা রয়েছে। বিদ‘আতীদের বিপরীতে, যারা তাদের বিরোধীদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট বা কাফির আখ্যা দেয়।
.
দ্বিতীয় মূলনীতি: ইসলামি উসূল অনুযায়ী ইমামগণ ও মাযহাবের আলেমদের ব্যক্তিগত মত বা ফাতওয়া স্বতন্ত্রভাবে কোনো শারঈ দলিল নয়। আর এই বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর আলেমদের মধ্যে সর্বসম্মত মত (ইজমা) রয়েছে যে, কোনো ইমামের বক্তব্য নিজে নিজে দলিল নয়—যতক্ষণ না তা কুরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
.
সালাফী মানহাজের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো শুধু হক্বের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করা অর্থাৎ হক্ব ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করা। এখানে হক্ব বলতে চূড়ান্ত হক্বকে বুঝানো হয়েছে। আর চূড়ান্ত হক্ব হচ্ছে আল্লাহর কিতাব কুরআন ও রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ।রাসূল (ﷺ)-ই হলেন একমাত্র মানুষ যার অন্ধ আনুগত্য করা যায় এবং করা শুধু বৈধই নয়, আবশ্যকও। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা পেয়েছেন এবং তাবলীগ করেছেন তারই শুধু পক্ষপাতিত্ব চলবে। কারণ একমাত্র অহীই হল চূড়ান্ত হক্ব। অন্য কিছু নয়। ইসলামে সাহাবীদের কথা, তাবিঈ, তাবি‘ তাবিঈ, মুজতাহিদ ইমামগণ, ফক্বীহ, মুফাসসির, মুহাদ্দিছ, আলিম, শাইখদের কথার মূল্য আছে। এই মূল্য ততক্ষণ, যতক্ষণ তাঁরা কুরআন ও সুন্নাহ-এর অনুকূলে কথা বলবেন, মতামত দিবেন। তাঁরা কেউই নিষ্পাপ নয়। তাঁরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নন। তাদের কথা গ্রহণযোগ্যও হতে পারে আবার অগ্রহণযোগ্যও হতে পারে। গ্রহণযোগ্য কি-না তা যাচাই করতে হবে কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) চমৎকার কথা বলেছেন। একদা তিনি রাসূল (ﷺ)-এর ক্ববরের দিকে ইশারা করে বলেন, ‘এই কবরবাসী ছাড়া বাকী প্রত্যেকের কথা গ্রহণও করা যেতে পারে আবার বর্জনও করা যেতে পারে’। তবে গ্রহণ ও বর্জনের এই সিদ্ধান্ত হতে হবে সালাফগণের মানহাজ অনুযায়ী কুরআন ও সুন্নাহর মাপকাঠিতে, নিজের খেয়ালখুশি অনুযায়ী নয়।
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:اتفق أهل العلم – أهل الكتاب والسنة – على أن كل شخص سوى الرسول فإنه يؤخذ من قوله ويترك ، إلا رسول الله صلى الله عليه وسلم ، فإنه يجب تصديقه في كل ما أخبر ، وطاعته في كل ما أمر ، فإنه المعصوم الذي لا ينطق عن الهوى ، إن هو إلا وحي يوحى “আহলে ইলম যারা কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারী তাদের মধ্যে এ বিষয়ে ঐক্যমত আছে যে, রাসূল (ﷺ) ছাড়া অন্য সকল মানুষের কথা গ্রহণও করা হবে,আবার বর্জনও করা হবে। কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথাই সর্বাবস্থায় সত্য। তাঁর সমস্ত বক্তব্যকে অবশ্যই সত্য হিসেবে বিশ্বাস করতে হবে এবং যেসব নির্দেশ দিয়েছেন তা পালন করতে হবে। কারণ তিনিই সে ব্যক্তিত্ব, যিনি ভুল থেকে নিরাপদ এবং নিজের মন থেকে কথা বলেন না; তাঁর বাণী শুধুই ওহী থেকে প্রাপ্ত।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মিনহাজুস সুন্নাহ, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১৯০–১৯১)
.
তৃতীয় মূলনীতি: সত্য (হক্ব) কেবল নির্দিষ্ট চার মাযহাবের পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সত্য হলো সেই মত, যা কুরআন, সহীহ সুন্নাহ এবং সালাফে সালিহীন-এর প্রতিষ্ঠিত শরঈ প্রমাণসমূহের সাথে সুস্পষ্টভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতএব,যেখানে দলিল স্পষ্ট, সেখানেই সত্য; ব্যক্তি, মাযহাব বা কোনো নির্দিষ্ট ইমামের উপর সত্যকে আবদ্ধ করা সঠিক নয়।দলিল আল্লাহর বানী: فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ “তোমরা যদি কোনো বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হও, তবে সেটিকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও।”(সূরা নিসা ৪:৫৯) এখানেই স্পষ্ট হয়েছে:মতবিরোধের ক্ষেত্রে রেফারেন্স কেবল কুরআন ও সুন্নাহ—কোনো ব্যক্তির মাযহাব নয়। আবার রাসূল ﷺ বলেন:عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين “তোমরা আমার সুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের পথ আঁকড়ে ধরো।”(তিরমিযী হা/২৬৭৬) এখানেও নির্দেশনা হলো রেফারেন্স সুন্নাহ,কোনো নির্দিষ্ট মাযহাব নয়।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
أهل السنة لم يقل أحد منهم إن إجماع الأئمة الأربعة حج معصومة ، ولا قال: إن الحق منحصر فيها ، وإن ما خرج عنها باطل ، بل إذا قال: من ليس من أتباع الأئمة ، كسفيان الثوري والأوزاعي والليث بن سعد ومن قبلهم ومن بعدهم من المجتهدين قولا يخالف قول الأئمة الأربعة ، رد ما تنازعوا فيه إلى الله ورسوله ، وكان القول الراجح هو القول الذي قام عليه الدليل“আহলে সুন্নাহর কেউ বলেনি যে চার ইমামের (হানাফি, মালেকি,শাফি‘ঈ,হানবালী) ইজমা কোনো ভুল-অযোগ্য দলিল,অথবা সত্য কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ,এবং যা তাদের বাইরে তা অব্যর্থ বা বাতিল।বরং এমন যদি হয় যে, চার ইমামের অনুসারী নন যেমন সুফিয়ান আস সাওরী, আওযায়ী, লায়স ইবনু সা‘দ অথবা তাদের আগে-পরে আসা কোনো মুজতাহিদ এমন কেউ চার ইমামের মতের বিরোধী কিছু বলেন, তখন বিরোধপূর্ণ সেই বিষয়কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, এবং যে মতের উপর যথাযথ দলিল প্রতিষ্ঠিত হবে সেটাই হবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য।”(মিনহাজুস সুন্নাহ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪১২)
.
চতুর্থ মূলনীতি: যে ব্যক্তি যথেষ্ট যোগ্যতা রাখে, তার জন্য প্রতিটি ইসলামী মাসআলার (ধর্মীয় সিদ্ধান্তের) জন্য সঠিক দলিল অনুসন্ধান করা ওয়াজিব। আর যে ব্যক্তি কুরআন ও হাদীস থেকে নিজে সঠিকভাবে দলিল আহরণে অক্ষম, তার জন্য কর্তব্য হলো এমন কোনো বিশ্বস্ত মাযহাবি আলেমের অনুসরণ করা, যার জ্ঞান ও দ্বীনি বিশ্বাসের ওপর সে পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন:فَاتَّقُوا اللّٰهَ مَا اسۡتَطَعۡتُمۡ সুতরাং তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর”(সূরা তাগাবুন ১৬) তিনি আরও বলেছেন:لَا یُكَلِّفُ اللّٰهُ نَفۡسًا اِلَّا وُسۡعَهَا ؕ”আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না।”(সূরা বাকারা: ২৮৬)
শাইখ মুহাম্মদ আল আমীন শানকিতী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:المضطر للتقليد الأعمى اضطرارا حقيقيّا ، بحيث يكون لا قدرة له ألبتّة على غيره ، مع عدم التّفريط ، لكونه لا قدرة له أصلا على الفهم ، أو له قدرة على الفهم وقد عاقته عوائق قاهرة عن التعلم ، أو هو في أثناء التعلّم ولكنّه يتعلّم تدريجيّا ؛ لأنه لا يقدر على تعلم كل ما يحتاجه في وقت واحد ، أو لم يجد كفؤا يتعلم منه ، فهو معذورٌ في التّقليد المذكور ، للضرورة ؛ لأنّه لا مندوحة له عنه . أما القادر على التعلم المفرط فيه ، والمقدم آراء الرجال على ما علم من الوحي ، فهذا الذي ليس بمعذور”যে ব্যক্তি প্রকৃতভাবে বাধ্য হয়ে অন্ধ অনুসরণ করছে,এমনভাবে যে তার মোটেই অন্য কোনো বিকল্প নেই—যেমন তার বুঝার কোনো সামর্থ্য নেই, অথবা বুঝার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তাকে এমন কোনো জোরপূর্বক বাধা প্রতিরোধ করছে যার কারণে সে শিখতে পারছে না; অথবা সে শিখছে, কিন্তু ধীরে ধীরে, কারণ একবারে সব কিছু শেখা তার পক্ষে সম্ভব নয়; অথবা সে এমন কোনো যোগ্য শিক্ষক খুঁজে পাননি যার কাছ থেকে শিখতে পারবে—সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি এই ধরনের অনুসরণে ক্ষমাপ্রাপ্ত, কারণ এটি তার জন্য অনিবার্য। কিন্তু যে ব্যক্তি শিখতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও শিখার বিষয়ে অলস বা গাফেল, এবং যাহা ওহী দ্বারা প্রমাণিত তা জানার পরও মানুষের মতামতকে তার চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়, সে মোটেই ক্ষমাপ্রাপ্ত নয়।”(আযওয়াউল বায়ান; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৫৮৮)
.
পঞ্চম মূলনীতি: একজন আলেম বা ছাত্রের ইলমের জন্য বিভিন্ন আলেমের মাযহাবসমূহ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। এর প্রয়োজনীয়তার কারণগুলো হলো:
.
(১).মাযহাবগুলোর মতামত এবং তাদের নির্দিষ্ট দলিল সম্পর্কে অজ্ঞতা মানুষের কাছে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে সে জানে না কোথায় মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ইজমা (ঐকমত্য) রয়েছে এবং কোথায় মতভেদ আছে। ফলে এমনও হতে পারে যে কেউ অবচেতনভাবে মুসলিমদের স্থির করা ঐকমত্যের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করবে অথবা তাদের নির্ধারিত পথের বাইরে চলে যাবে।ইমাম সুয়ূতী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,من شروط الاجتهاد معرفة أقوال العلماء من الصحابة فمن بعدهم ، إجماعا واختلافا ، لئلا يخرق الإجماع فيما يختار”ইজতিহাদ করার শর্তগুলোর মধ্যে একটি হলো সাহাবা এবং তাদের পরবর্তী আলেমদের মতামত জানা কোথায় ইজমা রয়েছে এবং কোথায় মতভেদ বিদ্যমান — যেন ব্যক্তি নিজের নির্বাচিত মতের দ্বারা কোনো স্থির ইজমা ভেঙে না ফেলে।”(সওনুল মানতিক: ৪৭)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:الذين أخذوا بالحديث دون أن يرجعوا إلى ما كتبه العلماء في الأحكام الشرعية … تجد عندهم من المسائل الغريبة : ما تكاد تجزم بأنها مخالفة للإجماع ، أو يغلب على ظنك أنها مخالفة للإجماع ، لهذا ينبغي للإنسان أن يربط فقهه بما كتبه الفقهاء رحمهم الله ، ولا يعني ذلك أن يجعل إمام هذا المذهب كالرسول عليه الصلاة والسلام يأخذ بأقواله وأفعاله على وجه الالتزام “যারা কেবল হাদীস নিয়েই কাজ করে এবং আলেমরা শরীয়তের হুকুম বিষয়ে যা লিখেছেন সেগুলোতে ফিরে যায় না তাদের কাছে এমনসব অদ্ভুত মাসআলা পাওয়া যায়, যার ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত হওয়া যায় যে তা ইজমার বিরোধী, অথবা অন্তত প্রবল ধারণা হয় যে তা ইজমার বিরোধী। সেজন্য মানুষের উচিত তার ফিকহকে ফুকাহাদের লেখার সাথে সংযুক্ত রাখা। তবে এর মানে এই নয় যে সে মাযহাবের ইমামকে রাসূলের মতো বানিয়ে ফেলবে যেন তার কথা-কার্য বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করতেই হবে।”(ইবনু উসাইমীন,মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ২৬; পৃষ্ঠা: ১৭৭)
(২).আলেমদের সাধারণ মতামত জানা অত্যন্ত জরুরি, যাতে ছাত্র বা আলেম কোনো মাসআলায় বা নসের ব্যাখ্যায় এমন একক মত প্রকাশ না করে, যা পূর্ববর্তী কোনো আলেমের সমর্থন পায়নি এবং যা আগের আলেমদের মতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:كل قول ينفرد به المتأخر عن المتقدمين ، ولم يسبقه إليه أحد منهم ، فإنه يكون خطأ ، كما قال الإمام أحمد بن حنبل: إياك أن تتكلم في مسألة ليس لك فيها إمام”যে কোনো মত যে পরে আসা ব্যক্তি শুধুমাত্র তারই, এবং যা আগে কোনো আলেম দ্বারা প্রস্তাবিত হয়নি, তা ভুল। যেমন ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্ভল বলেছেন:তুমি এমন বিষয়ে কথা বলো না, যেখানে তোমার আগে কোনো ইমাম নেই।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ২১; পৃষ্ঠা: ২৯১)
.
(৩).ফিকহী মাসআলাগুলোর মধ্যে কিছু এমন রয়েছে, যার ওপর কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট দলিল রয়েছে। তবে, কোনো আলেমের পক্ষে সব হাদীস সম্পূর্ণভাবে জানা প্রায় অসম্ভব।আর ধরে নিলাম যে তা জানা সম্ভব তবুও কোনো নির্দিষ্ট মাসআলার হুকুম খুঁজতে গিয়ে সব হাদীস স্মরণে রাখা কঠিন।অনেক সময় হাদীসগুলোর স্থানও এমনসব কিতাবে থাকে যেখানে সাধারণত তা খোঁজার কথা নয়।এই কারণে, আলেম বা ছাত্র যখন মাযহাবগুলোর বক্তব্য এবং তাদের দলিলসমূহ পর্যবেক্ষণ করে, তখন তারা শত শত বছরের গবেষণার ফলাফল থেকে উপকৃত হয়। এভাবে তারা একটি মাসআলার বিভিন্ন দলিল একত্রিত করতে পারে, তুলনা করতে পারে এবং সর্বাধিক সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এ ধরনের কার্যক্রমকে বলা হয় ফিকহ তুলনামূলক গবেষণা (ফিকহ মুকারনা)।অনেক ফিকহী শাখা-মাসআলা রয়েছে যেখানে সরাসরি কোনো শারঈ নস নেই সেখানে দলিল হিসেবে ব্যবহার হয়:ইজমা, কিয়াস, ইস্তিসহাব ইত্যাদি ইলমী পদ্ধতি।তাই কেউ যদি কেবল নিজের মতামতের ওপর নির্ভর করে মাযহাবের কিতাব না দেখে, তাদের দলিল না জেনে, তাদের দিকনির্দেশনা না নিয়ে এভাবে কোনো মাসআলার হুকুম নির্ধারণ করতে চায়, তাহলে সে গবেষণায় যথেষ্ট চেষ্টা করা ব্যক্তির মর্যাদা পাবে না,ফলে, সত্য উদঘাটনের জন্য যে পরিশ্রম ওয়াজিব, তা সে সম্পন্ন করতে পারবে না।শাইখ মুহাম্মদ আল আমীন শানকিতী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:وأما المسائل التي لا نص فيها فالصواب النظر في اجتهادهم – أي أئمة المذاهب – فيها . وقد يكون اتباع اجتهادهم أصوب من اجتهادنا لأنفسنا ؛ لأنهم أكثر علما وتقوى منا”যেসব মাসআলায় সরাসরি কোনো নস নেই, সেখানে সঠিক হলো মাযহাবের ইমামদের ইজতিহাদ পর্যবেক্ষণ করা। অনেক সময় তাদের ইজতিহাদ অনুসরণ করা আমাদের নিজের ইজতিহাদ করার চেয়ে অধিক সঠিক হতে পারে, কারণ তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী এবং আল্লাহভীরু ছিলেন”।(আযওয়াউল বায়ান; খন্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৫৮৯) আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৩০৯৮৫)
.
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের ফিতনা থেকে হেফাজত করুন।এবং তিনি আমাদেরকে এমন কাজ করার তৌফিক দান করুন যা তিনি পছন্দ করেন এবং যাতে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।
No comments:
Post a Comment