Tuesday, August 19, 2025

ইসলামের দৃষ্টিতে পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের অপরিহার্যতা

 জুমার খুতবা: ইসলামের দৃষ্টিতে পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের অপরিহার্যতা এবং তাদের অবাধ্যতার পরিণতি:

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আলহামদুলিল্লাহ, আস-সালাতু ওয়াস-সালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহ, আম্মা বাদ:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য, যিনি আমাদেরকে সালাতুল জুমা আদায় করার পর খুতবার অনুবাদ ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনায় অংশ নেওয়ার তাওফিক দান করেছেন। এজন্য আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি আলহামদুলিল্লাহ। সম্মানিত খতিব সাহেব খুতবার শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা ও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর দরুদ পেশ করার পর তাকওয়া সংক্রান্ত বেশ কিছু আয়াত উল্লেখ পূর্বক মুসলিম উম্মাহকে তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি অর্জনের নির্দেশ দেন। নিঃসন্দেহে তাকওয়া মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠ অলংকার। দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক কল্যাণ তাকওয়ার মাধ্যমেই লাভ করা যায়। এরপর সম্মানিত খতিব সাহেব জুমার খুতবায় আলোচনার মূল বিষয় হিসেবে বেছে নেন, বিরুল ওয়ালিদাইন বা পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ। নিন্মে উক্ত খুতবার অনুবাদ ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো:
————————–
আল্লাহ তাআলা কুরআনে একাধিক স্থানে পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এটি সন্তানের উপরে অপরিহার্য দায়িত্ব এবং পিতা-মাতার হক। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ۚ إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا
“আর তোমার রব আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদেরকে ‘উফ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না; আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো।” [সূরা বনি ইসরাইল: ২৩] পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই আয়াতে মহান আল্লাহর হক আদায় তথা একমাত্র তাঁর ইবাদতের পরেই স্থান দেওয়া হয়েছে, পিতা-মাতার হক আদায় অর্থাৎ তাদের সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশকে।
– তিনি আরও বলেন,
وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا
“আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছি।” [সূরা আহকাফ: ১৫]
– তিনি আরও বলেছেন,
وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا
“আর আমি মানুষকে তাদের পিতামাতার প্রতি সুন্দর আচরণের নির্দেশ দিয়েছি।” [সূরা আনকাবুত: ৮]
ইমাম তাবারী (রহ.) বলেছেন:
«أَيْ: وَصَّى اللَّهُ فِيهِمَا بِجَمِيعِ مَعَانِي الْحُسْنِ
‘অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা পিতামাতার সাথে সকল প্রকার সুন্দর আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন।'” অর্থাৎ উত্তম আচরণ বলতে যা বুঝায় সবই এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন: সুন্দর ও নম্র কথা, ভালো পোশাক, আন্তরিক সেবা ইত্যাদি সবকিছু।”
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন,
سَأَلْتُ النَّبِيَّ ﷺ أَيُّ الْعَمَلِ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ قَالَ: الصَّلَاةُ عَلَى وَقْتِهَا قُلْتُ ثُمَّ أَيٌّ قَالَ: بِرُّ الْوَالِدَيْنِ قُلْتُ ثُمَّ أَيٌّ قَالَ: الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ
“আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল কোনটি?
তিনি বললেন, যথাসময়ে নামাজ আদায় করা।
– আমি বললাম, এরপর কোনটি?
তিনি বললেন, পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করা।
– আমি বললাম, এরপর কোনটি?
তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা।”
[সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম]
একজন সাহাবি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে এসে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,
أحيّ والداك؟ قال: نعم. قال: ففيهما فجاهد
“তোমার পিতা-মাতা কি জীবিত আছেন?
তিনি বললেন: হ্যাঁ।
তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “তবে তোমার জিহাদ তাদের সেবায় করো।”
[সহিহ বুখারি ও মুসলিম]
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, পিতা-মাতার সেবা অনেক সময় জিহাদের থেকেও শ্রেষ্ঠ আমল হতে পারে।
✪ পিতামাতার সাথে নম্র আচরণ এবং তাদের জন্য দুআর নির্দেশ:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
”তুমি দয়া থেকে তাদের প্রতি নম্রতার ডানা বিস্তার কর এবং বল, হে আমার প্রতিপালক, তাদের প্রতি রহম কর যেমন তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছেন।” [সূরা বনী ইসরাইল: ২৪]।
✪ পিতামাতার অবাধ্যতা: কবিরা গুনাহ:
– নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
أَلا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ؟ قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ: الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ
“আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহর কথা জানাব? সাহাবিগণ বললেন: হ্যাঁ।
তিনি বললেন: আল্লাহর সাথে শিরক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা।” [সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম]।
– আরেক হাদিসে এসেছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
رِضَا اللَّهِ فِي رِضَا الْوَالِدِ، وَسَخَطُ اللَّهِ فِي سَخَطِ الْوَالِدِ
“আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত আছে পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত আছে পিতার অসন্তুষ্টিতে।”[সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৮৯৯ সহিহ]
তাই আমাদের উচিত, পিতা-মাতার সাথে নম্রতা পূর্ণ কথা বলা, তাদের পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনা, তাদের প্রয়োজন মেটানো, তাদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করা এবং যথাসাধ্য তাদের সেবা করা।
✪ পিতামাতার অবাধ্য সন্তানের ফরজ বা নফল কোনও ইবাদত কবুল হবে না:
আবু দারদা রা.থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«ثَلاثَةٌ لا يَقْبَلُ اللهُ مِنْهُمْ صَرْفًا وَلا عَدْلًا: عَاقٌّ، وَمَنَّانٌ، وَمُكَذِّبٌ بِالْقَدَرِ»
“তিন শ্রেণীর লোকের ফরজ বা নফল কোন ইবাদতই আল্লাহ কবুল করবেন না:
১. অবাধ্য সন্তান,
২. দান করে খোটা দানকারী (উপকারের কথা জাহির কারী),
৩. তাকদির (ভাগ্য) অস্বীকারকারী।
[তিরমিজি, হাদিস: ২১৪০; আহমদ৬/৪৪২; সহিহুল জামে: ৩০৭৭]
❑ পিতা-মাতার আনুগত্যের জন্য তিনটি শর্ত:
নিম্নোক্ত তিনটি শর্ত সাপেক্ষে পিতামাতার আনুগত্য করা ফরজ:
❖ ১. সাধ্যের অতিরিক্ত না হওয়া:
যদি পিতা-মাতা এমন কোনও আদেশ বা নিষেধ করেন যা সন্তানের সাধ্যের বাইরে বা পালন করা অসম্ভব তাহলে তা মানা আবশ্যক নয়।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন:
لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
“আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না।” [সূরা বাকারা: ২৮৬]
❖ ২. শিরক, বিদআত বা নাফরমানিমূলক কাজ না হওয়া:
যদি তারা আল্লাহর আনুগত্যের বাইরে, শিরক, বিদআত বা অন্য কোনও নাফরমানিমূলক (পাপ কাজ) কাজের আদেশ বা নিষেধ করেন তাহলে সেটা মানা যাবে না। বরং আল্লাহ তার রসুলের নির্দেশই এখানে প্রাধান্য পাবে।
– আল্লাহ তাআলা সূরা লুকমানের ১৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন:
وَإِن جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِۦ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِى الدُّنْيَا مَعْرُوفًا
“আর যদি তারা (পিতামাতা) তোমাকে আমার সাথে শিরক করতে বাধ্য করে-যে বিষয়ে তোমার কোনও জ্ঞান নেই-তবে তুমি তাদের আনুগত্য করো না। তবে দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করো।”
– নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ”
“স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে কোনও সৃষ্টির আনুগত্য নেই।”
[মুসনাদে আহমদ, হা/ ১০৯৫; সহীহ আল জামি, হা/ ৭৫২০]
❖ ৩. সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা না থাকা:
পিতা-মাতা যদি এমন কোনও কাজে আদেশ বা নিষেধ করেন যা পালন করতে গেলে সন্তানের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক বা দ্বীনি ক্ষতির সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবসম্মত আশঙ্কা থাকে তাহলে সেই আদেশ মান্য করা আবশ্যক নয়।
হাদিসে এসেছে,
قضَى أن لا ضررَ ولا ضِرارَ
“রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মর্মে ফয়সালা দিয়েছেন যে, অনিচ্ছা বশতঃ বা ইচ্ছাকৃত ভাবে কারও ক্ষতি সাধন করা যাবে না।”
সহিহ ইবনে মাজাহ, হা/১৯০৯]
◯ পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করলে দুনিয়ায় দুটি বড় উপকার লাভ হয়:
১. রিজিকে বরকত।
২. হায়াতে বরকত।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَن أَحَبَّ أَن يُبسَطَ لَهُ فِي رِزقِهِ، وَأَن يُنسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَليَصِلْ رَحِمَهُ
“যে ব্যক্তি চায় যে তার রিজিকে প্রাচুর্য আসুক এবং তার আয়ু দীর্ঘ হোক, সে যেন তার নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে।” [সহীহ বুখারি, হাদিস নং ২০৬৭] আর নিকটাত্ময়ীদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হল, পিতামাতা।
❑ মৃত পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের করণীয়:
যাদের পিতা-মাতা ইন্তেকাল করেছেন, তাদের জন্য দুআ করা, দান-সদকা করা, হজ-ওমরা করা, তাদের বন্ধুদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা, তাদের বৈধ ওসিয়ত পূরণ করা এসবই সন্তানের করণীয়।
হে আল্লাহ, আমাদেরকে পিতা-মাতার অনুগত সন্তান হিসেবে কবুল করুন, তাদের প্রতি দয়া করুন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তাদেরকে সর্বোত্তম প্রতিদান দান করুন। আমিন।
[জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন (সৌদি আরব) সংলগ্ন জামে আবু বকর সিদ্দিক রা. মসজিদে ১৫-৮-২০২৫ তারিখে প্রদত্ত জুমার খুতবার অনুবাদ ও বিশ্লেষণ]
– আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate