Wednesday, September 10, 2025

সালাতের মধ্যে কান্না করা সম্পর্কে শারঈ নীতিমালা

 প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর কান্না মানুষের একটি স্বভাবজাত বিষয় এবং অন্তরের লালিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। কান্নার বিভিন্ন কারণ ও উপলক্ষ থাকে। কখনো আনন্দ-বেদনায়, কখনো প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথায়, কখনো শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনায়, আবার কখনো স্বীয় সৃষ্টিকর্তার স্মরণে মুমিন বান্দার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। আবার কখনো কুরআনের অমিয় বাণীর সুমধুর মূর্ছনা তার হৃদয়জগতকে আন্দোলিত করে চক্ষুযুগলকে সিক্ত করে তোলে। বান্দা যখন স্বীয় পাপের কথা মনে করে অনুতপ্ত হয়, মৃত্যু-কবর-জান্নাত-জাহান্নাম ও আল্লাহর আযাবের কথা স্মরণ করে অশ্রু বর্ষণ করে, তখন সেই অশ্রুধারা তার জীবনকে স্নিগ্ধ করে তোলে। তবে আল্লাহর জন্য কান্নার অনুভূতিটা সবার মাঝে জাগ্রত হয় না। কিন্তু আল্লাহর ভয়ে কারো দু’চোখ থেকে যদি এক ফোটা অশ্রুও বর্ষিত হয় এবং তিনি যদি সেটা গোপন করতে পারেন, তবে তিনি পৃথিবীর সফল বান্দাদের একজন গণ্য হবেন। কেননা আল্লাহর রাসূল ﷺ) বলেছেন,”সেই ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশে নীচে ছায়া পাবে, যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে, ফলে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়”।(সহীহ বুখারী হা/৬৬০; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।

.
▪️দ্বিতীয়ত: সালাতরত অবস্থায় কান্না করার তিনটি অবস্থা হতে পারে।
.
(১).সালাতরত অবস্থায় যদি কেউ দুনিয়াবী দুঃখ-কষ্ট বা বিপদ-আপদ স্মরণ করে কিংবা অনুরূপ কোনো দুনিয়াবী কারণে উচ্চ আওয়াজে কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং কান্না থামানোর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে, তবে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। কারণ এটি সালাত-বহির্ভূত কাজ হিসেবে গণ্য হয়। অধিকাংশ ফিকাহবিদ এ বিষয়ে একমত।
.
(২).সালাতরত অবস্থায় যদি অসুখ-বিসুখ,শারীরিক ব্যথা-বেদনা, মানসিক কষ্ট বা দুনিয়ার বিপদ-মুসিবতের কথা স্মরণ করে ভুলবশত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কান্না আসে, তবে তা সম্ভব হলে প্রতিহত করার চেষ্টা করতে হবে। ইনশাআল্লাহ,এতেও সালাতের কোনো ক্ষতি হবে না। কারন এই উম্মতের অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্রুটি আল্লাহ ক্ষমা করবেন।দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী: “হে আমাদের রব্ব! যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তবে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না।”[সূরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬] আল্লাহ তাআলা বলেন: আমি সেটাই করব। আরও দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী: “আর এ ব্যাপারে তোমরা কোন অনিচ্ছাকৃত ভুল করলে তোমাদের কোন অপরাধ নেই; কিন্তু তোমাদের অন্তর যা স্বেচ্ছায় করেছে (তা অপরাধ), আর আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[সূরা আহযাব, আয়াত: ৫] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমার উম্মত থেকে ভুল ও বিস্মৃতি এবং যে ক্ষেত্রে তাদেরকে জবরদস্তি করা হয় সেটার গুনাহ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।
.
আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ গ্রন্থে এসেছে, وأما البكاء في الصلاة لمصاب دنيوي : فإن كان مغلوباً عليه ، ولا يمكن دفعه فلا حرج عليه ، ولا تبطل صلاته بذلك ، أما إن كان يقدر على دفعه فلم يدفعه واسترسل معه وكان بكاؤه بصوت فهو مبطل للصلاة عند الأئمة الأربعة رحمهم الله ، واشترط بعضهم كالشافعي وأحمد لبطلان الصلاة أن يظهر منه حرفان .আর যদি সালাতের মধ্যে দুনিয়াবী কোনো বিপদের কারণে কান্না আসে:যদি তা অনিচ্ছাকৃতভাবে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং সে তা দমন করতে অক্ষম হয়, তাহলে এতে কোনো দোষ নেই এবং তার সালাতও নষ্ট হবে না।কিন্তু যদি সে দমন করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও দমন না করে, বরং কান্নায় লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং সে কান্না শব্দযুক্ত হয়, তবে চার ইমামের মতে তা সালাত নষ্টকারী। তবে তাঁদের মধ্যে কিছুজন, যেমন ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ, শর্ত করেছেন যে সালাত বাতিল হওয়ার জন্য অন্তত দুই অক্ষর উচ্চারিত হওয়া আবশ্যক।”(আল-মাওসু‘আতুল ফিকহিয়্যাহ; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১৭০)
.
(৩).সালাতরত অবস্থায় যদি একজন বান্দা আল্লাহর ভয়, কবরের আযাব, জাহান্নামের শাস্তি, মৃত্যুর কষ্ট, আখিরাতের কঠোর পরিণতি বা কুরআনে বর্ণিত হুঁশিয়ারি স্মরণ করে অশ্রু ঝরায়, তবে এতে তার সালাতের কোনো ক্ষতি হবে না; বরং এটি মুস্তাহাব (উত্তম) হিসেবে গণ্য হয়। এমন অনুভূতি এবং কণ্ঠনিষ্ঠ অশ্রু ঝরানোই মুত্তাকী ও সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও সৎকর্মশীলদের থেকে এ ধরনের বহু ঘটনা বর্ণিত আছে।সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:

البكاء عند قراءة القرآن ، وعند السجود ، وعند الدعاء من صفات الصالحين ، والإنسان يحمد عليه
“কুরআন তিলাওয়াত করার সময়, সিজদায় এবং দু‘আ করার সময় কান্না করা এগুলো সৎকর্মশীলদের গুণাবলি, আর মানুষ এর জন্য প্রশংসিত হয়।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ২৩৮)
.
▪️উপরোল্লিখিত তিনটি বিষয়ের সমর্থনে আমরা কুরআন, সুন্নাহ ও প্রখ্যাত আলেমদের বক্তব্য থেকে দলিল উপস্থাপন করার প্রয়াস চালাবো।”
.
মহান আল্লাহ বলেন,اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتُ الرَّحۡمٰنِ خَرُّوۡا سُجَّدًا وَّ بُکِیًّا “তাদের নিকট করুণাময় (আল্লাহর) আয়াত পাঠ করা হলে তারা লুটিয়ে পড়ে সিজদা ও ক্রন্দন করত।” (সূরা মরিয়ম;১৯/৫৮) হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,عَنْ مُطَرِّفِ بْنِ عَبْدِ اللّهِ بْنِ الشِّخِّيرِ عَنْ أَبِيهِ قَالَ: أَتَيْتُ النَّبِيَّ ﷺ وَهُوَ يُصَلِّىْ وَلِجَوْفِه أَزِيْزٌ كَأَزِيزِ الْمِرْجَلِ يَعْنِىْ: يَبْكِىْ”মুত্বররিফ ইবনে ‘আবদুল্লাহ ইবনে শিখখীর (রহঃ) নিজের পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এলাম এমতাবস্থায় যে, তিনি সালাত আদায় করছিলেন এবং তাঁর ভিতর ডেগের ফুটন্ত পানির মত আওয়াজ হচ্ছিল। অর্থাৎ তিনি কান্নাকাটি করছিলেন।অন্য বর্ণনায় রয়েছে, বর্ণনাকারী বলেছেন,رَأَيْتُ النَّبِيَّ ﷺ يُصَلِّىْ وَفِىْ صَدْرِه أَزِيزٌ كَأَزِيزِ الرَّحَا مِنَ الْبُكَاءِ“আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সালাত আদায় করতে দেখছি। এমতাবস্থায় তাঁর সিনার মধ্যে চাক্কির আওয়াজের ন্যায় কান্নার আওয়াজ থাকত।”(মুসনাদে আহমদ হা/১৬৩১২; আবু দাউদ হা/৯০৪; নাসায়ী ১২১৪; সহীহ আত তারগীব হা/৫৪৪; সহীহ ইবনে হিব্বান ৭৫৩; শাইখ আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন) অপর বর্ননায় এসেছে, আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর অসুখ যখন খুব বেড়ে গিয়েছিল, তখন তাঁকে নামাযের সময় হয়েছে বললে তিনি বললেন, “তোমরা আবূ বাকারকে নামায পড়াতে বল।” আয়েশা رضي الله عنها বললেন, ‘আবূ বাকার তো নরম-দিলের মানুষ। উনি যখন কুরআন পড়েন, তখন কান্না রুখতে পারেন না।’ মহানবী (ﷺ) বললেন, “তোমরা ওকে বল, ওই নামায পড়াবে।” আয়েশা رضي الله عنها পুনরায় ঐ একই কথা বললে মহানবী (ﷺ) ও পুন: বললেন, “ওকে বল, ওই নামায পড়াবে।”(সহীহ বুখারী হা/৬৮৭-৭১৩; সহীহ মুসলিম হা/৪১৮)
.
হাদিসটির ব্যাখ্যায় হাফিয যাইনুদ্দীন আবুল ফারজ ‘আব্দুর রহমান বিন শিহাব যিনি ইবনু রজব আল-হাম্বালী আল-বাগদাদী নামে প্রসিদ্ধ রাহিমাহুল্লাহ [জন্ম: ৭৩৬ হি.মৃত:৭৯৫ হি:] তাঁর ফাতহুল বারী-এ বলেছেন:
والنشيج : هوَ رفع الصوت بالبكاء . قاله أبو عبيد وغيره …
(قالت عائشة : قلت : إن أبا بكر إذا قام مقامك لم يسمع الناس من البكاء) . مقصوده من إيراد هذا الحديث في هذا الباب : أن النبي صلى الله عليه وسلم أمر أبا بكر أن يصلي بالناس، مع تكرار القول لهُ أنه إذا قام مقامه لا يسمع الناس من البكاء ، فدل على أن البكاء من خشية الله في الصلاة لا يضر الصلاة ، بل يَزينها ؛ فإن الخشوع زينة الصلاة …وقد اختلف العلماء في البكاء في الصلاة على ثلاثة أقوال : …وما تقدم عن أبي بكر وعمر رضي الله عنهما يدل على أن البكاء في الصلاة من خشية الله حسن جميل ، ويقبح أن يقال : لا يبطلها ؛ فإن ما كانَ زينة الصلاة وزهرتها وجمالها؛ كيف يقنع بأن يقال فيهِ : غير مبطل ؟ ولم يزل السلف الصالح الخاشعون لله على ذَلِكَ . روى الإمام أحمد في “كتاب الزهد” بإسناده ، عن نافع ، قالَ : كانَ ابن عمر يقرأ في صلاته ، فيمر بالآية فيها ذكر الجنة ، فيقف عندها فيدعو ويسأل الله الجنة . قالَ: ويدعو ويبكي. قالَ : ويمر بالآية فيها ذكر النار، فيدعو ويستجير بالله منها. وبإسناده ، عن ابن أبي ملكية ، قالَ صحبت ابن عباس من مكة إلى المدينة . قالَ : وكان إذا نزل قام ينتظر الليل ، فسأله أيوب : كيف كانت قراءته ؟ قالَ: قرأ: (وَجَاءتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ذَلِكَ مَا كُنْتَ مِنْهُ تَحِيدُ) ق/19.فجعل يرتل، ويكثر في ذَلِكَ النشيج. وروى ابن أبي الدنيا بإسناده ، عن القاسم بن محمد ، قالَ : كنت غدوت يوما فإذا عائشة قائمة تسبح – يعني : تصلي – وتبكي ، وتقرأ : فَمَنَّ اللَّهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ [الطور:27 ]. وتدعو وتبكي، وترددها. فقمت حتى مللت القيام ، فذهبت إلى السوق لحاجتي، ثم رجعت، فإذا هي قائمة كما هي، تصلي وتبكي. والروايات في هذا عن التابعين ومن بعدهم كثيرة جدا ، وإنما ينكر ذَلِكَ من غلبت عليهِ الشقوة ، أو سبقت لهُ الشقوة
নাশীজ : এটি হলো কান্নার সময় স্বর উচ্চ করা। এ কথা বলেছেন আবু উবাইদ ও অন্যান্যরা।(আয়েশা রা. বলেছেন: আমি বললাম আবু বকর যদি আপনার স্থানে দাঁড়ান, তবে মানুষ তাঁর কান্নার কারণে তাঁর কুরআন পাঠ শুনতে পাবে না)। ইবনু রজব রাহিমাহুল্লাহ বলেন: তিনি এ হাদীসটি এই অধ্যায়ে আনার উদ্দেশ্য হলো: নবী (ﷺ) বারবার এ কথা বলার পরও যে, আবু বকর যদি তাঁর স্থানে দাঁড়ান তবে মানুষ কান্নার কারণে তাঁর কুরআন পাঠ শুনতে পাবে না তবুও নবী (ﷺ) তাঁকে ইমামতি করতে আদেশ দিয়েছেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর ভয়ে সালাতে কান্না করা সালাতের কোনো ক্ষতি করে না; বরং তা সালাতকে শোভিত করে। কেননা খুশূ-খুযূই হলো সালাতের সৌন্দর্য আর সালাতে কান্না করার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে তিনটি মতামত রয়েছে, আবু বকর ও হযরত উমর রা. থেকে যা বর্ণিত হয়েছে, তা এটাই প্রমাণ করে যে, আল্লাহভীতির কারণে সালাতে কান্না করা অত্যন্ত সুন্দর ও প্রশংসনীয় কাজ। এবং এটা বলা যে, ‘এতে সালাত ভঙ্গ হয় না’ খুবই অনুপযুক্ত উক্তি। কারণ, যা সালাতের অলংকার, সৌন্দর্য ও শোভা, তার ব্যাপারে শুধু ‘অবৈধ করে না’ বলা কীভাবে যথেষ্ট হতে পারে? সালাফে সালিহীনরা যারা আল্লাহভীরু ছিলেন, তারা এভাবেই ছিলেন।ইমাম আহমাদ তাঁর কিতাবুয-যুহদ-এ নিজ সনদে নাফি‘ থেকে বর্ণনা করেছেন: তিনি বলেন, ইবন উমর সালাতের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। যখন জান্নাতের উল্লেখ আসতো, তখন সেখানে থেমে দোয়া করতেন এবং আল্লাহর কাছে জান্নাত চাইতেন। তিনি দোয়া করতেন ও কাঁদতেন। আর যখন জাহান্নামের উল্লেখ আসতো, তখন তিনি দোয়া করতেন এবং আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন।এবং তাঁর সনদে ইবন আবি মুলায়কা থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন আমি ইবন আব্বাসের সঙ্গে মক্কা থেকে মদিনা সফর করেছি। আয়ূব তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন : তাঁর কুরআন তিলাওয়াত কেমন ছিল? তিনি বললেন: তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করতেন:”আর মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে এসেছে (সে) সত্যই; এটা (তা-ই) যা থেকে তুমি পালাতে চাচ্ছিলে।”(সূরা ক্বাফ: ১৯) তিনি ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করতেন এবং এ সময় অনেক বেশি কান্না করতেন। আর ইবনু আবি দুনইয়া তাঁর সনদে কাসিম ইবন মুহাম্মদ থেকে বর্ণনা করেছেন: তিনি বলেন একদিন আমি সকালে বের হলাম, দেখি আয়েশা রা. দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন (অর্থাৎ নফল নামাজ) এবং কাঁদছেন। তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করছিলেন: “অতঃপর আমাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন।” সূরা তূর: ২৭] তিনি দোয়া করছিলেন, কাঁদছিলেন এবং বারবার আয়াতটি পুনরাবৃত্তি করছিলেন।আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, যতক্ষণ না দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এরপর বাজারে নিজের কাজে গেলাম, আবার ফিরে এলাম। তখনও দেখি তিনি একইভাবে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন এবং কাঁদছেন।এ ব্যাপারে তাবে‘ঈন এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে অসংখ্য রেওয়ায়েত রয়েছে। আসলে, শুধু সেই মানুষই এটাকে অস্বীকার করবে, যার উপর শকওয়া (অভাগ্য) প্রাধান্য পেয়েছে বা যার জন্য পূর্ব থেকেই শকওয়া নির্ধারিত হয়ে গেছে।” (ইবনু রজব হাম্বলী; ফাতহুল বারী; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১৩৪-১৩৫)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,”َأَمَّا الْبُكَاءُ وَالتَّأَوُّهُ وَالْأَنِينُ الَّذِي يَنْتَظِمُ مِنْهُ حَرْفَانِ فَمَا كَانَ مَغْلُوبًا عَلَيْهِ لَمْ يُؤَثِّرْ ، وَمَا كَانَ مِنْ غَيْرِ غَلَبَةٍ فَإِنْ كَانَ لِغَيْرِ خَوْفِ اللَّهِ أَفْسَدَ الصَّلَاةَ”যেখানে কান্না, আর্তনাদ এবং গোঙানি থেকে দুটি অক্ষর উৎপন্ন হয় যদি তা চাপিয়ে দেওয়া (অনিয়ন্ত্রিত) হয় তবে এর কোনো প্রভাব নেই; আর যদি তা চাপিয়ে দেওয়া না হয় এবং আল্লাহর ভয়ের বাইরে অন্য কোনো কারণে হয়, তবে তা সালাত নষ্ট করে।”(ইবনু কুদামাহ; আল-মুগনী; খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৯৪-৩৯৫)
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:مَا يُغْلَبُ عَلَيْهِ الْمُصَلِّي مِنْ عُطَاسٍ وَبُكَاءٍ وَتَثَاؤُبٍ فَالصَّحِيحُ عِنْدَ الْجُمْهُورِ أَنَّهُ لَا يُبْطِلُ وَهُوَ مَنْصُوصُ أَحْمَد وَغَيْرِهِ”সালাতরত অবস্থায় হাঁচি, কান্না ও হাই ওঠা ইত্যাদি যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঘটে জুমহুরের (অধিকাংশ আলেমদের) সঠিক মত অনুযায়ী তা সালাত নষ্ট করে না। এবং এটি ইমাম আহমদ ও অন্যান্যদের স্পষ্ট বাণী।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ২২; পৃষ্ঠা: ৬২৩)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
“البكاء في الصلاة إذا كان من خشية الله عز وجل والخوف منه وتذكر الإنسان أمور الآخرة وما يمر به في القرآن الكريم من آيات الوعد والوعيد فإنه لا يبطل الصلاة . وأما إذا كان البكاء لتذكر مصيبة نزلت به أو ما أشبه ذلك فإنه يبطل الصلاة ؛ لأنه حدث لأمر خارج عن الصلاة ، وعليه أن يحاول علاج نفسه من هذا البكاء حتى لا يتعرض لبطلان صلاته ، ويشرع له أن لا يكون في صلاته مهتماً بغير ما يتعلق بها فلا يفكر في الأمور الأخرى ؛ لأن التفكير في غير ما يتعلق بالصلاة في حال الصلاة ينقصها كثيرا
“নামাজে কান্না যদি আল্লাহ তাআলা কে ভয় করা, তাঁর মহিমার ভীতি, পরকালের কথা স্মরণ করা, এবং কুরআন মাজীদের ওয়াদা-ওয়াঈদের আয়াতসমূহ থেকে প্রভাবিত হওয়ার কারণে হয় তাহলে এতে নামাজ ভঙ্গ হয় না। কিন্তু যদি কান্না হয় কোনো দুনিয়াবী বিপদ-আপদ স্মরণ করার কারণে অথবা এ জাতীয় কারণে, তবে তা নামাজ ভঙ্গ করবে; কেননা এটি নামাজের বাইরের কারণে ঘটে। এজন্য নামাজি ব্যক্তির উচিত এই ধরনের কান্না থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা, যাতে নামাজ বাতিল হয়ে না যায়। তার জন্য শরীয়তসম্মত বিষয় হলো, নামাজে এমন কোনো কিছুর প্রতি মনোযোগী না হওয়া যা নামাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়; যেন অন্য বিষয় নিয়ে চিন্তা না করে। কেননা নামাজের বাইরে অন্য বিষয়ে চিন্তা করা নামাজকে অনেক দুর্বল করে দেয়।”
(ইবনু উসাইমীন; ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব: ১৪১/৯)
.
ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে আরও জিজ্ঞেস করা হলো:তারাবীহ কিংবা অন্যান্য নামাযে উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ বের হওয়ার বিধান কী? উল্লেখ্য,এতে অন্যদের বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।”
তিনি জবাব দিলেন:
لا شك أن البكاء من خشية الله عز وجل من صفات أهل الخير والصلاح، وكان النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يخشع في صلاته ويكون لصدره أزيز كأزيز المرجل ، وقال الله تبارك وتعالى: (وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعاً) (الإسراء: 109).
فالبكاء عند قراءة القرآن، وعند السجود، وعند الدعاء من صفات الصالحين، والإنسان يحمد عليه، والأصوات التي تسمع أحياناً من بعض الناس هي بغير اختيارهم فيما يظهر، وقد قال العلماء رحمهم الله: إن الإنسان إذا بكى من خشية الله، فإن صلاته لا تبطل، ولو بان من ذلك حرفان فأكثر. لأن هذا أمر لا يمكن للإنسان أن يتحكم فيه، ولا يمكن أن نقول للناس : لا تخشعوا في الصلاة ولا تبكوا. بل نقول: إن البكاء الذي يأتي بتأثر القلب مما سمع، أو مما استحضره إذا سجد؛ لأن الإنسان إذا سجد استحضر أنه أقرب ما يكون إلى ربه عز وجل كما قال النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: (أقرب ما يكون العبد من ربه وهو ساجد) .والقلب إذا استحضر هذا وهو ساجد، لا شك أنه سيخشع ويحصل البكاء، ولا أستطيع أن أقول للناس : امتنعوا عن البكاء، ولكني أقول : إن البكاء من خشية الله والصوت الذي لا يمكن للإنسان أن يتحكم فيه لا بأس به، بل كما تقدم البكاء من خشية الله تعالى من صفات أهل الخير والصلاح”
“এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আল্লাহ তাআলার ভয়ে কান্না করা নেককার ও সৎ ব্যক্তিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নবী ﷺ নামাজে বিনয়াভরে দণ্ডায়মান হতেন, আর তাঁর বুক থেকে হাঁড়িতে ফুটন্ত পানির মতো শব্দ শোনা যেত। আর আল্লাহ তাআলা বলেছেন:“তারা কান্নাকাটি করতে করতে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং এতে তাদের বিনয় আরও বৃদ্ধি পায়।”(সূরা বনী ইসরাঈল: ১০৯) অতএব, কুরআন তিলাওয়াতের সময়, সিজদার সময় কিংবা দোয়ার সময় কান্না করা হলো সৎ ব্যক্তিদের গুণ। এর মাধ্যমে মানুষ প্রশংসিত হয়।মানুষের কাছ থেকে যে কান্নার শব্দ বের হয়, অনেক সময় তা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে এটিই পরিষ্কার বিষয়। আলেমগণ বলেছেন: যদি কেউ আল্লাহর ভয় থেকে কেঁদে ফেলে, তবে তার নামাজ ভঙ্গ হবে না যদিও সেই কান্নার মধ্যে থেকে দুই অক্ষর বা তার বেশি উচ্চারিত হয়ে যায়। কেননা এটা মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। আমরা তো তাকে বলতে পারি না: “তুমি নামাজে খুশূ করো না, কেঁদো না। বরং আমরা বলি: যদি কান্না আসে হৃদয়ের প্রভাব থেকে সে যা শুনেছে তার কারণে, অথবা সিজদার মুহূর্তে যা হৃদয়ে উদয় হয়েছে তার কারণে তাহলে এতে কোনো দোষ নেই। কারণ মানুষ যখন সিজদায় থাকে তখনই সে তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। যেমন নবী ﷺ বলেছেন: “বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় যখন সে সিজদায় থাকে।” সুতরাং সিজদার সময় যখন মানুষ এ বিষয়টি স্মরণ করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই হৃদয়ে বিনয় সৃষ্টি হয় এবং কান্না আসে। আমি তো কাউকে বলতে পারি না: “কান্না থেকে বিরত থাকো।”বরং আমি বলি: আল্লাহর ভয় থেকে আসা কান্না এবং যে শব্দ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এতে কোনো অসুবিধা নেই। বরং যেমন পূর্বেই বলা হয়েছে, আল্লাহর ভয় থেকে কান্না করা নেককার ও সৎ ব্যক্তিদের গুণ।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ২৩৮)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো সালাত। আল্লাহ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন তাঁর স্মরণে নিবেদিত থাকার জন্য—﴿وَأَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي﴾ (ত্বোয়া-হা ২০:১৪)। ইবাদতের প্রাণ হলো একাগ্রতা; তা ছাড়া সালাত কেবল দায়সারা শরীরচর্চায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, এনে দেয় না অন্তরের প্রশান্তি ও নেকীর অনুপ্রেরণা। কিন্তু আজকের ব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনে সালাতে খুশূ অর্জন কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে রাসূল (ﷺ) এর এই হাদীস বাস্তবে রূপ নিয়েছে: “এই উম্মত থেকে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি উঠিয়ে নেয়া হবে, তা হলো খুশূ এমনকি একাগ্রচিত্ত মুছল্লী খুঁজে পাওয়া যাবে না।” সুতরাং আমাদের উচিত সালাতে যত্নশীল হওয়া। আর সালাতের মধ্যে আল্লাহর ভয়, আখিরাতের শাস্তি ও কুরআনের আয়াতে প্রভাবিত হয়ে কান্না করা মুস্তাহাব এবং সালেহীনদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু দুনিয়াবি কষ্ট বা ব্যথায় কান্না এলে তা দমন করার চেষ্টা করবে। চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণে না এলে সালাত নষ্ট হবে না। তবে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জোরে জোরে কান্না করলে সালাত বাতিল হয়ে যাবে এ বিষয়ে অধিকাংশ ফকীহ একমত।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate