Wednesday, September 3, 2025

ইসলামে মেহমানদারীর বিধান ও আদব সমূহ

 প্রশ্ন: ইসলামে মেহমানদারীর বিধান কি? আতিথেয়তার আদব সমূহ সম্পর্কে শার’ই নির্দেশনা জানতে চাই?

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর প্রকৃত মুসলিম মেহমান আসলে কখনো বিরক্ত হয় না, মন খারাপও করে না। বরং সে খুশি হয় এবং মেহমানের সম্মান ও ইজ্জত যথাযথভাবে রক্ষা করে। কারণ সে জানে, মেহমান আসলে তার অধিকার অনুযায়ী সম্মান পাবে। আবু শুরাইহ আল আদাবী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) যখন এ হাদীসটি বলেছেন তখন আমার দু’কান তা শুনেছে এবং দু’চোখ তা দেখেছে। তিনি বলেছেন-من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فليكرم ضيفه جائزته. قالوا وما جائزته قال يومه وليله والضيافة ثلاثة ايام فما كان وراء ذٰلك فهو صدقة عليه. وقال من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فليقل خيرا أو ليصمت”যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে তার উচিত সাধ্যমত অতিথি আপ্যায়ন করা। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, সাধ্যমত কথার তাৎপর্য কী? তিনি বললেন, একদিন একরাত। মেহমানদারী সর্বোচ্চ তিন দিন। এর বেশী যদি কেউ করে সেটি তার বদান্যতা। তিনি আরও বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে তার উচিত ভালো কথা বলা অথবা চুপ থাকা”।(সহীহ বুখারী; হা/৫৬৭৩; সহীহ মুসলিম হা/৪৮) লোকমান হাকিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, চারটি বস্তু থেকে কারোরই অনীহা থাকা উচিৎ নয়, যদিও সে আমীর বা ভদ্রলোক হোক: (১).পিতার সম্মানে জায়গা ছেড়ে দেওয়া। (২).মেহমানের মেহমানদারি করা। (৩).স্বীয় বাহনের পরিচর্যা করা। (৪).আলিমের খেদমত করা। বকর বিন আব্দুল্লাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,‌إِذَا ‌أَتَاكَ ‌ضَيْفٌ فَلَا تَنْتَظِرْ بِهِ مَا لَيْسَ عِنْدَكَ، وَتَمْنَعْهُ مَا عِنْدَكَ، بَلْ قَدِّمْ إِلَيْهِ مَا حَضَرَ، وَانْتَظِرْ بِهِ بَعْدَ ذَلِكَ مَا يَزِيدُ مِنْ إِكْرَامِهِ، “যখন তোমার বাড়িতে কোন মেহমান আসবে, তখন তোমার ঘরে যা নেই তা আনার জন্য মেহমানকে অপেক্ষায় রেখো না। আর তোমার ঘরে যা আছে তা দিয়ে আপ্যায়ন করবে না এমনটি যেন না হয়; বরং উপস্থিত যা পাও, তা-ই তার সামনে পেশ কর। এরপর অন্য কিছু দিয়ে আরো আপ্যায়ন করার ব্যবস্থা করতে পার”।(বুরজুলানী, আল-কারামু ওয়াল জূদ, পৃষ্ঠা: ৫২)
.
▪️ইসলামে মেহমানদারি করার শারঈ হুকুম কি?
.
ইসলামে অতিথেয়তার গুরুত্ব অপরিসীম।শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে আতিথেয়তার হুকুম সম্পর্কে ইমামগনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।আলেমগন কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে এটিকে তিন স্তরে ভাগ করেছেন:
.
(১).বাধ্যতামূলক (ওয়াজিব) অধিকার: একজন অতিথিকে কমপক্ষে একদিন একরাত স্বাগত ও সেবা দেওয়া।
(২).সুন্নত আদব: অতিথিকে তিন দিনের জন্য যত্ন ও সম্মান প্রদর্শন করা।
(৩).সাধারণ সদকা:আর তিন দিনের পর থেকে তা হবে সদকা ও সৎকাজ,ব্যক্তি চাইলে করবে, চাইলে করবে না।
অর্থাৎ এটি ব্যক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। এইভাবে অতিথির সম্মান নিশ্চিত করা ইসলামে অত্যন্ত প্রিয় ও প্রশংসনীয় কাজ হিসেবে বিবেচিত।আর নবী (ﷺ) সহিহ হাদিসে, এ তিনটি স্তরই বর্ণনা করেছেন যা আবু শুরাইহ আল খুযায়ী থেকে এসেছে।(সহীহ বুখারী হা/৫৬৭৩; সহীহ মুসলিম হা/৪৮)
.
ইমাম খাত্তাবি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন বলেছেন:
قوله : (جائزته يوم وليلة) سئل مالك بن أنس عنه فقال : يُكرمه ، ويتحفه ، ويخصه ، ويحفظه ، يوماً وليلة ، وثلاثة أيام ضيافة .قلت : يريد أنه يتكلف له في اليوم الأول بما اتسع له من بِر ، وألطاف ، ويقدِّم له في اليوم الثاني والثالث ما كان بحضرته ، ولا يزيد على عادته ، وما كان بعد الثلاث : فهو صدقة ، ومعروف ، إن شاء فعل ، وإن شاء ترك .
(তার অতিথি সেবার অধিকার এক দিন ও এক রাত)। এ বিষয়ে মালিক ইবনে আনাসকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন: তাকে সম্মান করবে, উপহার দেবে, বিশেষভাবে যত্ন নেবে এবং তার হেফাজত করবে একদিন ও একরাত, আর তিন দিন হলো অতিথেয়তা।আমি (খাত্তাবি) বলি: তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে প্রথম দিনে তার জন্য সাধ্যানুযায়ী যত্ন ও অনুগ্রহ করবে, আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে তার সামনে যা উপস্থিত আছে তাই পরিবেশন করবে, অতিরিক্ত কিছু করবে না। আর তিন দিনের পর থেকে তা হবে সদকা ও সৎকাজ, চাইলে করবে, চাইলে করবে না।”(মাআলিমুস সুনান; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৩৮)
.
আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, আল-মুফাসসির, আল-ফাক্বীহ, ইমাম ইবনু ক্বাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন:
إن للضيف حقّاً على مَن نزل به ، وهو ثلاث مراتب : حق واجب ، وتمام مستحب ، وصدقة من الصدقات ، فالحق الواجب : يوم وليلة , وقد ذكر النبي صلى الله عليه وسلم المراتب الثلاثة في الحديث المتفق على صحته من حديث أبي شريح الخزاعي – وساق الحديث السابق –
“অতিথির অধিকার রয়েছে যে ব্যক্তি তার কাছে অবতরণ করে, আর এর তিনটি স্তর আছে: একটি হচ্ছে বাধ্যতামূলক অধিকার, আরেকটি পূর্ণাঙ্গ সুন্নত আদব, আরেকটি হলো সাধারণ সদকা। বাধ্যতামূলক অধিকার হলো: একদিন ও একরাত। আর নবী ﷺ এ তিনটি স্তরই বর্ণনা করেছেন সহিহ হাদিসে, যা আবু শুরাইহ আল খুযায়ী থেকে এসেছে এবং তিনি আগের হাদিস বর্ণনা করেছেন।”(ইবনু ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৬৫৮)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন;والواجب يوم ليلة ، والكمال ثلاثة أيام ؛ لما روى أبو شريح الخزاعي – وساق الحديث -“বাধ্যতামূলক হলো এক দিন ও এক রাত, আর পূর্ণতা হলো তিন দিন; কারণ আবু শুরাইহ আল-খুযায়ী থেকে হাদিস এসেছে এবং তিনি হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।”(ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খন্ড: ১১; পৃষ্ঠা: মুগনী ১১/৯১)
.
অতিথি যাকে সম্মান করা ওয়াজিব,এবং যার অধিকার গৃহস্বামীর ওপর প্রযোজ্য, তিনি হলেন ভ্রমণকারী অতিথি অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজের শহর বা গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গা থেকে এসেছে। সুতরাং যার ঘরে তিনি অবতরণ করবেন, তার কর্তব্য হলো তাকে আহার করানো ও যথাযথ সম্মান দেওয়া। যদি গৃহস্বামী তা না করে, তবে অতিথির তার সম্পদের ওপর অধিকার থাকে।তবে এ বিধান স্থানীয় দর্শনার্থীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, যে ভ্রমণকারী নয়। এ ধরনের অতিথিকে বলা যেতে পারে: “ফিরে যান।” যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:وَإِنْ قِيلَ لَكُمُ ارْجِعُوا فَارْجِعُوا هُوَ أَزْكَى لَكُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ
“যদি তোমাদেরকে বলা হয়: ‘ফিরে যাও’, তবে তোমরা ফিরে যাবে; এটা তোমাদের জন্য অধিক পবিত্র। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবগত।” (সূরা নূর: ২৮) আমাদের এ কথার সমর্থনে বহু সহীহ হাদিসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে অতিথির অধিকার মূলত ভ্রমণকারীর জন্য, স্থানীয় অধিবাসীর জন্য নয়। যেমন উকবাহ বিন আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বললাম, আপনি আমাদেরকে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে থাকেন। আমরা এমন সব জনপদে যাত্রাবিরতি করি যারা আমাদের আপ্যায়ন করে না। এ ব্যাপারে আপনার কি অভিমত? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে বলেনঃ যদি তোমরা কোন বসতি এলাকায় যাত্রাবিরতি করো এবং তারা মেহমানের আপ্যায়নযোগ্য ব্যবস্থা করলে তা তোমরা গ্রহণ করো। আর যদি তারা তা না করে, তবে তাদের থেকে তাদের সামর্থ্য অনুসারে মেহমানদারির ন্যায্য দাবি আদায় করো।”(সহীহুল বুখারী হা/২৪৬১, ৬১৩৭, সহীহ মুসলিম হা/১৭২৭) আতিথেয়তার (অতিথি আপ্যায়নের) বিধান এবং কার ওপর এটি প্রযোজ্য এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
.
আল মাওসু‘আতুল ফিকহিয়্যাহ-তে বলা হয়েছে:
“وقد ذهب الحنفية والمالكية والشافعية إلى أن الضيافة سنَّة ، ومدتها ثلاثة أيام ، وهو رواية عن أحمد .والرواية الأخرى عن أحمد – وهي المذهب – أنها واجبة ، ومدتها يوم ليلة ، والكمال ثلاثة أيام . وبهذا يقول الليث بن سعد .ويرى المالكية وجوب الضيافة في حالة المجتاز الذي ليس عنده ما يبلغه ويخاف الهلاك .والضيافة على أهل القرى والحضر ، إلا ما جاء عن الإمام مالك ، والإمام أحمد – في رواية – أنه ليس على أهل الحضر ضيافة ، وقال سحنون : الضيافة على أهل القرى ، وأما أهل الحضر فإن المسافر إذا قدم الحضر وجد نزلاً – وهو الفندق – فيتأكد الندب إليها ولا يتعين على أهل الحضر تعينها .
“হানাফি, মালিকি ও শাফেয়ি ফকিহদের মতে অতিথেয়তা সুন্নাত, আর এর মেয়াদ তিন দিন। ইমাম আহমদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এরও একটি বর্ণনা এ কথাই নির্দেশ করে। তবে তাঁর আরেকটি বর্ণনা যেটি তাঁর মাযহাব হিসেবেই গ্রহণ করা হয়েছে সেটা হলো: অতিথেয়তা ওয়াজিব; এর মেয়াদ এক দিন এক রাত। আর তিন দিন পর্যন্ত তা পূর্ণতা বা সম্পূর্ণ সুন্নাতরূপে গণ্য হবে। এ মতের সাথে ইমাম লাইস ইবনু সা‘দ রহ.-ও একমত। মালিকিরা আরও বলেছেন: যদি কোনো পথিক থাকে যার কাছে কিছুই নেই, আর আশঙ্কা থাকে যে সে ক্ষুধায় কষ্ট পেয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে, তখন তার জন্য অতিথেয়তা ওয়াজিব হবে। অতিথেয়তা গ্রামাঞ্চল ও শহরের লোকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে ইমাম মালিক রহ. এবং ইমাম আহমদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর একটি বর্ণনায় এসেছে: শহরের লোকদের জন্য অতিথেয়তা (ওয়াজিব হিসেবে) নেই। সানহুন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন: অতিথেয়তা গ্রামীণ লোকদের ওপর ওয়াজিব, কিন্তু নগরবাসীর ওপর নয়। কারণ, শহরে আগন্তুক এলে সেখানে সরাইখানা (হোটেল) পাওয়া যায়। তাই শহরে অতিথেয়তা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে ঠিকই, তবে তা শহরের অধিবাসীদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।(আল-মাউসু‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খণ্ড: ২৮, পৃষ্ঠা: ৩১৬–৩১৭)
.
সবচেয়ে সঠিক অভিমত আল্লাহই সর্বজ্ঞাত হলো: পথচারী মুসাফিরের জন্য আতিথেয়তা করা ওয়াজিব। এ হুকুমে শহরবাসী ও গ্রামবাসীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই; বরং সবার জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] হাজ্জাওয়ির (রহিমাহুল্লাহ) এই কথার ব্যাখ্যায় বলেছেন:
وَتَجِبُ ضِيَافَةُ المُسْلِمِ الْمُجْتَازِ بِهِ فِي الْقُرَى يَوْماً وَلَيْلَةً” .
قال : قوله : ” وتجب ضيافة المسلم ” : ” تجب ” هذا بيان حكم الضيافة ، والضيافة أن يَتلقَّى الإنسان مَن قدم إليه ، فيكرمه ، وينزله بيته ، ويقدم له الأكل ، وهي من محاسن الدين الإسلامي ، وقد سبقنا إليها إبراهيم عليه الصلاة والسلام ، كما قال الله تعالى : ( هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ ) الذاريات/ 24 ، أي : الذين أكرمهم إبراهيم ، ولا يمتنع أن يقال : والذين أكرمهم الله عزّ وجل بكونهم ملائكة .فحكم الضيافة واجب ، وإكرام الضيف – أيضاً – واجب ، وهو أمر زائد على مطلق الضيافة ، قال النبي عليه الصلاة والسلام : ( من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فليكرم ضيفه ) ، أي : من كان يؤمن إيماناً كاملاً : فليكرم ضيفه …. قوله : ” المجتاز به ” يعني : الذي مرَّ بك وهو مسافر ، وأما المقيم : فإنه ليس له حق ضيافة ، ولو كان المقيم له حق الضيافة : لكان ما أكثر المقيمين الذين يقرعون الأبواب ! فلا بد أن يكون مجتازاً ، أي : مسافراً ومارّاً ، حتى لو كان مسافراً مقيماً يومين ، أو ثلاثة ، أو أكثر : فلا حق له في ذلك ، بل لا بد أن يكون مجتازاً .قوله : ” في القرى ” دون الأمصار ، والقرى : البلاد الصغيرة ، والأمصار : البلاد الكبيرة ، قالوا : لأن القرى هي مظنة الحاجة ، والأمصار بلاد كبيرة فيها مطاعم ، وفنادق ، وأشياء يستغني بها الإنسان عن الضيافة ، وهذا – أيضاً – خلاف القول الصحيح ؛ لأن الحديث عامّ ، وكم من إنسان يأتي إلى الأمصار وفيها الفنادق ، وفيها المطاعم ، وفيها كل شيء ، لكن يكرهها ويربأ بنفسه أن يذهب إليها ، فينزل ضيفاً على صديق ، أو على إنسان معروف ، فلو نزل بك ضيف – ولو في الأمصار – : فالصحيح : الوجوب .
“গ্রামে পথিক মুসলিমের জন্য এক দিন এক রাতের আতিথেয়তা ওয়াজিব।তিনি বলেন: “আতিথেয়তা ওয়াজিব” বলতে বোঝানো হয়েছে যে, যখন কোনো ব্যক্তি তোমার কাছে আসে, তাকে সম্মান প্রদর্শন করা, তার জন্য ঘরে স্থান দেওয়া এবং খাবার পরিবেশন করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত। আতিথেয়তার সূচনা করেছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম।আল্লাহ বলেন: “আপনার কাছে কি ইবরাহীমের সম্মানীত মেহমানদের বৃত্তান্ত পৌঁছেছে?”(সূরা যারিয়াত: ২৪) অর্থাৎ ইবরাহীম যে মেহমানদের সম্মান করতেন, তারা আল্লাহর দৃষ্টিতেও সম্মানিত ছিলেন। কারণ তারা ছিলেন ফেরেশতা। অতএব আতিথেয়তার হুকুম ওয়াজিব। অতিথিকে সম্মান করাও ওয়াজিব, যা সাধারণ আতিথেয়তার অতিরিক্ত একটি শিষ্টাচার। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:”যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী, সে যেন তার অতিথিকে সম্মান করে।অর্থাৎ যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই অতিথিকে সম্মান করে। পথিক বলতে বোঝায় সেই ব্যক্তি, যে তোমার কাছে এসেছে কিন্তু সফরে আছে। স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ব্যক্তির জন্য আতিথেয়তার অধিকার প্রযোজ্য নয়। কারণ যদি স্থায়ীদের জন্যও তা প্রযোজ্য হত, তাহলে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ দরজায় কড়া নাড়ত। এমনকি যদি কেউ দু’দিন বা তিন দিন অবস্থান করে, তাহলেও তার জন্য আতিথেয়তার হক নেই; তিনি অবশ্যই পথচলতি হতে হবে।“গ্রামে” বলা হয়েছে শহরের বদলে,গ্রাম বলতে ছোট জনপদকে বোঝানো হয়েছে, আর শহর বলতে বড় নগরকে। তারা বলেন:কারণ গ্রামে সাধারণত সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকে। অন্যদিকে শহরে হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য ব্যবস্থা থাকে, যা মানুষের আতিথেয়তার ওপর নির্ভরশীলতা কমায়। তবে হাদীসের দিক থেকে এটিকে সীমাবদ্ধ করা ঠিক নয়। কারণ হাদীসের বক্তব্য সাধারণ। অনেক সময় এমন ঘটে যে কেউ বড় শহরে আসলেও হোটেল বা রেস্টুরেন্ট পছন্দ করে না, বরং কোনো বন্ধু বা পরিচিত জনের বাসায় অতিথি হতে চায়। সুতরাং, যদি শহরেও অতিথি আসে সঠিক মত হলো: তার আতিথেয়তা ওয়াজিব।”(ইবনু উসাইমীন; শারহুল মুমতি আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ৪৮–৫১)।
.
▪️এক নজরে আতিথেয়তার আদব সমূহ:
মানুষ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী বা অন্য কারো নিকটে অতিথি হয় ও আতিথ্য গ্রহণ করে। ইসলাম এক্ষেত্রে কিছু আদব পালন করার নির্দেশ দিয়েছে। এগুলি মেনে চলার মাধ্যমে পাস্পরিক সম্পর্ক সুন্দর করা এবং নেকী অর্জনের চেষ্টা করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। নিম্নে আতিথেয়তার আদব উল্লেখ করা হল:
.
(১).মেহমানকে স্বাগত জানানো: মেহমানকে অভ্যর্থনা জানানো মুস্তাহাব। রাসূল (ﷺ) তাঁর নিকটে আগত মেহমানদেরকে স্বাগত জানাতেন।(দেখুন সহীহ বুখারী হা/৩৫৭, ৩১৭১; সহীহ মুসলিম হা/৩৩৬)
.
(২).অতিথিকে সম্মান করা: অতিথিকে সম্মান করা রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশ। তাই সাধ্যমত মেহমানকে সম্মান করা মেযবানের জন্য যরূরী। রাসূল (ﷺ) বলেন,وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ،”যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন মেহমানের সম্মান করে”।(সহীহ বুখারী হা/৬০১৮-১৯; সহীহ মুসলিম হা/৪৭)
.
(৩).অতিথিকে দ্রুত খাবার পরিবেশন করা ও তার প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখা: অতিথি এলে বিলম্ব না করে খাবার পরিবেশন করা উচিত, যেমন নবী ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) তাঁর অতিথিদের জন্য দ্রুত গো-মাংস প্রস্তুত করে সামনে রেখেছিলেন।”(সূরা যারিয়াত: ২৪-২৭)।একইভাবে তাদের জন্য গোসলখানা, টয়লেট ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থাও করা উচিত।
.
(৪).সম্ভব হলে মেহমানের আপ্যায়ন নিজে করা: মেহমানের আপ্যায়ন সাধ্যপক্ষে মেযবানকে নিজেই করা উচিত। যেমন ইবরাহীম (আঃ) নিজেই মেহমানদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, فَرَاغَ إِلَى أَهْلِهِ فَجَاءَ بِعِجْلٍ سَمِينٍ، فَقَرَّبَهُ إِلَيْهِمْ قَالَ أَلَا تَأْكُلُونَ، ‘অতঃপর সে দ্রুত চুপিসারে নিজ পরিবারবর্গের কাছে গেল এবং একটি মোটা-তাজা গো-বাছুর (ভাজা) নিয়ে আসল। অতঃপর সে তা তাদের সামনে পেশ করল ও বলল, ‘তোমরা কি খাবে না’? (সূরা যারিয়াত: ২৬-২৭)। এজন্য ইমাম বুখারী অধ্যায় রচনা করেছেন,باب إِكْرَامِ الضَّيْفِ وَخِدْمَتِهِ إِيَّاهُ بِنَفْسِهِ ‘মেহমানের সম্মান করা এবং নিজেই মেহমানের খিদমত করা’ অনুচ্ছেদ।(সহীহ বুখারী, তরজমাতুল বাব, নং ৮৫)
.
(৫).অতিথির সাথে অভিনয় বা ভান না করা: অতিথির সাথে কৃত্রিম আচরণ না করা কিংবা এমন কোন ব্যবহার না করা যাতে তার নিকটে অভিনয় প্রকাশ পায়। আনাস (রাঃ) বলেন, كُنَّا عِنْدَ عُمَرَ فَقَالَ نُهِينَا عَنِ التَّكَلُّفِ، ‘আমরা ওমর (রাঃ)-এর কাছে ছিলাম। তখন তিনি বললেন, (যাবতীয়) কৃত্রিমতা হ’তে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে।(সহীহ বুখারী হা/৭২৯৩) অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেন,لاَ يَتَكَلَّفَنَّ أَحَدٌ لِضَيْفِهِ مَا لاَ يَقْدِرُ عَلَيْهِ-“কেউ যেন তার মেহমানের সাথে এমন কৃত্রিম আচরণ না করে, যা করার সাধ্য (প্রকৃতপক্ষে) তার নেই”।(সহীহুল জামে‘ হা/৭৬০৮; সিলসিলা সহীহাহ হা/২৪৪০)
.
(৬).অতিথিকে নিজেদের উপরে প্রাধান্য দেওয়া: নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনের উপরে অতিথিকে প্রাধান্য দেওয়া। এতে আল্লাহর সন্তোষ লাভ করা যায়। এক্ষেত্রে আবু তালহা (রাঃ) ও তার স্ত্রী কর্তৃক মেহমান আপ্যায়নের ঘটনা স্মর্তব্য।(দেখুন বুখারী হা/৩৭৯৮; সহীহ মুসলিম হা/২০৫৪)
.
(৭).ডানদিক থেকে খাবার পরিবেশন শুরু করা: প্রথমে ডান দিক থেকে খাবার পরিবেশন করা সুন্নাত।(সহীহ বুখারী হা/২৩৫১, ২৩৫২; সহীহ মুসলিম হা/২০২৯, ২০৩০; মিশকাত হা/৪২৭৩, ৪২৭৪)
.
(৮).মেহমানের সামনে রাগ না করা ও অসহনশীল না হওয়া: মেহমানের সামনে রাগ প্রকাশ করা এবং তার সম্মুখে অসহনশীল আচরণ করা সমীচীন নয়।(দেখুন: সহীহ বুখারী হা/৬০২, ৬১৪০)
.
(৯).সেবার মাধ্যমে অতিথিকে কষ্ট না দেওয়া: অতিথির সেবা-যত্ন করতে গিয়ে এমন অতিরিক্ত কিছু না করা যাতে সেটা তার কষ্টের কারণ হয়। যেমন জোর করে বেশী খাবার তুলে দেওয়া কিংবা তার সাথে বেশী সময় দিতে গিয়ে এবং তার সাথে আলাপচারিতা করতে গিয়ে তার বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানো ইত্যাদি।
.
(১০).মেহমানের কারণে বিরক্তি বা অস্বস্তি প্রকাশ না করা: মেহমানের আগমনের কারণে বিরক্তি প্রকাশ না করা এবং তার সাথে কথাবার্তা ও আচরণে যেন সেটা প্রকাশ না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা। তার সাথে হাসিমুখে ও ভালভাবে কথা বলা এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাক্ষাৎ করা। তার আগমনে মেযবান অসন্তুষ্ট নয়, এটা যাতে মেহমানের সামনে ফুটে ওঠে সেই চেষ্টা করা।আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,«الكلمة الطيبة صدقة»“সুন্দর কথা সদকা স্বরূপ।”(সহীহ বুখারী হা/২৯৮৯)
.
(১১).মেহমান খাবার গ্রহণ শেষ করার পূর্বে খাবার তুলে না নেওয়া: খাবার পরিবেশনের পরে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মেহমান তার প্রয়োজন মত খাবার গ্রহণ করেছেন কি-না। তার প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার পূর্বে খাবার উঠিয়ে নেওয়া সমীচীন নয়। অনেক ক্ষেত্রে মেহমান লজ্জায় খাবার কম খেতে পারে কিংবা খাদ্যের পাত্র তুলে নেওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করলে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তিনি লজ্জায় খাবার গ্রহণ শেষ করতে পারেন। তাই পাত্র তোলার পূর্বে এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
.
(১২).বিদায়কালে মেহমানের সাথে বাড়ীর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া: মেহমান যখন চলে যেতে চাইবেন তখন তার সাথে বাড়ীর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া মুস্তাহাব। এতে বদান্যতা যেমন প্রকাশ পায়, তেমনি এটা মেহমানের সমাদর ও যত্নের পূর্ণতা এবং তার উত্তম আতিথেয়তার বহিঃপ্রকাশ”(ফাৎহুল বারী; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ৫২৮)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate