Wednesday, October 29, 2025

ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ধর্ষকের শাস্তির বিধান ও তা থেকে সমাজকে রক্ষার উপায়সমূহ

▪️প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর ধর্ষণ বলতে বোঝায়—কোনো নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক অবৈধ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত করতে বাধ্য করা; এতে তার (নারীর) পবিত্রতা, মর্যাদা ও মানবিক সম্মান পদদলিত হয় এবং সে গভীর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
.
ধর্ষক দুই প্রকার:
▪️প্রথম প্রকার: যে ব্যক্তি অস্ত্র ব্যবহার না করে এবং নারীকে অপহরণ না করেও তাকে ব্যভিচারে বাধ্য করে। এই ক্ষেত্রে তার ওপর ব্যভিচারের হদ্দ শাস্তি প্রয়োগ হবে, যদি ব্যভিচার প্রমাণিত হয়। হোক তা তার নিজের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে, অথবা চারজন ন্যায়পরায়ণ পুরুষ সাক্ষীর সাক্ষ্যে। যদি সে অবিবাহিত হয়, তবে তাকে একশত বেত্রাঘাত করা হবে। আর যদি সে বিবাহিত হয়, তবে তাকে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। কিছু আলেম বলেছেন: ধর্ষককে নারীর মহর (যেমনটা সাধারণত বিয়ের সময় দেওয়া হয়) পরিশোধ করতে হবে।
.
শাইখুল ইসলাম হুজ্জাতুল উম্মাহ ইমামু দারিল হিজরাহ আবূ ‘আব্দুল্লাহ মালিক বিন আনাস আল-আসবাহী আল-মাদানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৭৯ হি.] বলেছেন:الأمر عندنا في الرجل يغتصب المرأة، بكراً كانت أو ثيبا : أنها إن كانت حرة : فعليه صداق مثلها…، والعقوبة في ذلك على المغتصِب، ولا عقوبة على المغتصبة في ذلك كله”আমাদের মতে,কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে জোরপূর্বক ব্যভিচারে বাধ্য করে সে নারী কুমারী হোক বা বিধবা হোক,তবে যদি সে স্বাধীন (দাসী নয়) নারী হয়, তার জন্য সমপর্যায়ের নারীদের মতোই মোহরানা নির্ধারিত হবে। এবং এ অপরাধের শাস্তি কেবল ধর্ষণকারী পুরুষের ওপরই প্রযোজ্য হবে; ধর্ষিত নারীর ওপর এর কোনো শাস্তি নেই।”(মুয়াত্তা ইমাম মালিক; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৭৩৪)
.
ইমাম আল-বাজী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:المستكرَهة ؛ إن كانت حرة : فلها صداق مثلها على من استكرهها، وعليه الحد، وبهذا قال الشافعي، وهو مذهب الليث، وروي عن علي بن أبي طالب رضي الله عنه .وقال أبو حنيفة والثوري: عليه الحد دون الصداق.والدليل على ما نقوله : أن الحد والصداق حقان: أحدهما لله، والثاني للمخلوق، فجاز أن يجتمعا، كالقطع في السرقة، وردها “যদি জোরপূর্বক ব্যভিচারে বাধ্য করা নারী স্বাধীন হয়, তবে তার সমপর্যায়ের নারীর মতোই তার জন্য মোহর নির্ধারিত হবে, আর যিনি তাকে বাধ্য করেছেন, তার ওপর ব্যভিচারের হদ্দ প্রয়োগ করা হবে। এই মতই ইমাম শাফেয়ী, ইমাম লায়স এবং আলী ইবনে আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা ও সুফিয়ান সাওরী (রহিমাহুমাল্লাহ) বলেছেন: তার উপর হদ্দ প্রযোজ্য হবে, কিন্তু মোহরানা প্রযোজ্য হবে না। আমাদের কথার দলিল হলো এই যে, হদ্দ এবং মোহর উভয়ই দুই ধরনের অধিকার: একটিতে আল্লাহর অধিকার, আর অন্যটিতে সৃষ্টির অধিকার। সুতরাং এ দুটি একসঙ্গে প্রযোজ্য হতে পারে, যেমন চুরির ক্ষেত্রে (হাত) কাটা হয় এবং চুরি করা জিনিস ফেরত দেওয়া হয়। (মুনতাকা শারহুল মুয়াত্তা; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৬৮–২৬৯)
.
ইমাম ইবনু আব্দুল বার (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:وقد أجمع العلماء على أن على المستكرِه المغتصِب الحدَّ، إن شهدت البينة عليه بما يوجب الحد، أو أقر بذلك. فإن لم يكن: فعليه العقوبة (يعني : إذا لم يثبت عليه حد الزنا لعدم اعترافه ، وعدم وجود أربعة شهود ، فإن الحاكم يعاقبه ويعزره العقوبة التي تردعه وأمثاله). ولا عقوبة عليها إذا صح أنه استكرهها وغلبها على نفسها ، وذلك يعلم بصراخها، واستغاثتها ، وصياحها”সমস্ত আলেম একমত হয়েছেন যে, যে ব্যক্তি জোরপূর্বক কোনো নারীকে ধর্ষণ করে, তার উপর হদ্দ প্রযোজ্য হবে যদি সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা সেটি প্রমাণিত হয়, অথবা সে নিজেই তা স্বীকার করে। যদি এমন প্রমাণ না থাকে, তবে তার উপর তাআযির শাস্তি (বিচারকের বিবেচনায় প্রদত্ত শাস্তি) প্রযোজ্য হবে অর্থাৎ, যদি ব্যভিচারের শাস্তি প্রমাণিত না হয় তার অস্বীকারের কারণে বা চারজন সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে, তাহলে বিচারক তাকে এমন শাস্তি দেবেন যা তাকে ও তার মতো অন্যদের নিবৃত্ত করবে। আর নারীর ওপর কোনো শাস্তি নেই যদি প্রমাণিত হয় যে সে জোরপূর্বক বাধ্য করা হয়েছে এবং সে নিজেকে রক্ষা করতে অক্ষম ছিল। এটা বোঝা যায় তার চিৎকার, সাহায্যের আবেদন ও আর্তনাদের মাধ্যমে। (আল ইস্তিজকার; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৪৬)
.
▪️দ্বিতীয় প্রকার: যে ব্যক্তি অস্ত্রের মাধ্যমে কোনো নারীকে জোরপূর্বক ব্যভিচারে বাধ্য করে, অথবা নারীকে অপহরণ করে সে তার সাথে ব্যভিচার করুক বা না করুক তার জন্য ডাকাতি বা সন্ত্রাসী হামলার শাস্তি প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় শাসক বা তার প্রতিনিধি চারটি বিকল্পের মধ্যে একটি বেছে নিতে পারেন:
১. কেবল হত্যা,
২. নতুবা শুলে চড়িয়ে হত্যা করা,
৩. বিপরীত দিকের হাত ও পা কেটে ফেলা,
৪. অথবা দেশ থেকে নির্বাসন দেওয়া।
দলিল হচ্ছে আল্লাহর বানী:اِنَّمَا جَزٰٓؤُا الَّذِیۡنَ یُحَارِبُوۡنَ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ یَسۡعَوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ فَسَادًا اَنۡ یُّقَتَّلُوۡۤا اَوۡ یُصَلَّبُوۡۤا اَوۡ تُقَطَّعَ اَیۡدِیۡهِمۡ وَ اَرۡجُلُهُمۡ مِّنۡ خِلَافٍ اَوۡ یُنۡفَوۡا مِنَ الۡاَرۡضِ ؕ ذٰلِكَ لَهُمۡ خِزۡیٌ فِی الدُّنۡیَا وَ لَهُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ”যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় তাদের শাস্তি কেবল এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে বা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে বা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে বা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও আখেরাতে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।”(সুরা মায়েদা;৩৩) হাদীসে এসেছে, একদল লোক মদীনায় আসল, তারা মদীনার আবহাওয়া সহ্য করতে পারল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে সাদকার উট যেখানে থাকে সেখানে অবস্থানের অনুমতি দিলেন। যাতে তারা উটের দুধ ও প্রস্রাব পান করতে পারে। কিন্তু তারা রাখালকে হত্যা করল এবং উটগুলোকে নিয়ে চলে যেতে লাগল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পিছু ধাওয়া করতে নির্দেশ দিলেন। পরে তারা ধৃত হলো। তখন তাদের হাত-পা কেটে দেয়া হলো, চোখ উপড়ে ফেলা হলো, এবং তাদেরকে মদীনার কালো পাথর বিশিষ্ট এলাকায় ফেলে রাখা হলো।”(সহীম বুখারী হা/১৫০১; মুসলিম হা/১৬৭১)
.
সৌদি আরবের হাইয়াতু কিবারিল উলামা কর্তৃক ডাকাতি ও অপহরণ অপরাধ বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে:
” إن جرائم الخطف والسطو لانتهاك حرمات المسلمين على سبيل المكابرة والمجاهرة: من ضروب المحاربة والسعي في الأرض فساداً، المستحقة للعقاب الذي ذكره الله سبحانه في آية المائدة ، سواء وقع ذلك على النفس أو المال أو العرض ، أو أحدث إخافة السبيل وقطع الطريق. ولا فرق في ذلك بين وقوعه في المدن والقرى، أو في الصحارى والقفار، كما هو الراجح من آراء العلماء رحمهم الله تعالى.
قال ابن العربي يحكي عن وقت قضائه : رُفِعَ إلي قومٌ خرجوا محاربين إلى رفقة، فأخذوا منها امرأة مغالَبة على نفسها من زوجها ومن جملة المسلمين معه ، فاحتملوها ، ثم جد فيهم الطلب، فأُخذوا، وجيء بهم ، فسألت من كان ابتلاني الله به من المفتين فقالوا : ليسوا محاربين ! لأن الحرابة إنما تكون في الأموال لا في الفروج ! فقلت لهم : إنا لله وإنا إليه راجعون ! ألم تعلموا أن الحرابة في الفروج أفحش منها في الأموال ؟! وأن الناس كلهم ليرضون أن تذهب أموالهم وتُحرب من بين أيديهم ولا يُحرب المرء من زوجته وبنته ، ولو كان فوق ما قال الله عقوبة، لكانت لمن يسلب الفروج”
“যেসব অপরাধ যেমন অপহরণ বা ডাকাতি মুসলিমদের জান-মাল ও সম্মান লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে ও জোর করে সংঘটিত হয়, সেগুলো ডাকাতি বা হামলা ও পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ ছড়ানোর অন্তর্ভুক্ত অপরাধ। এই ধরনের অপরাধের জন্য আল্লাহ তাআলা সূরা মায়িদায় যে কঠোর শাস্তির কথা বলেছেন, তা-ই প্রযোজ্য হবে সে অপরাধ জান-মাল বা সম্মানের (ইজ্জতের) উপর হোক, কিংবা মানুষের পথ চলা ভয়ঙ্কর করে তোলা বা পথ কেটে নেওয়ার মাধ্যমে হোক। এ ব্যাপারে কোনো পার্থক্য নেই যে অপরাধটি শহর বা গ্রামে সংঘটিত হয়েছে, নাকি মরুভূমি ও জনশূন্য প্রান্তরে ঘটেছে বরং এ বিষয়ে অধিকাংশ আলেমের মতে, উভয় ক্ষেত্রেই একই বিধান প্রযোজ্য হবে। ইবনুল আরাবী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর বিচারকত্বের সময়কার একটি ঘটনা বর্ণনা করে বলেন আমার নিকট কিছু লোককে হাজির করা হলো, যারা একদল সফরকারীর উপর আক্রমণ করেছিল। তারা ঐ কাফেলা থেকে এক মহিলাকে জোরপূর্বক তার স্বামী ও কাফেলার অন্য মুসলমানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর লোকেরা তাদের পিছু নেয়, অবশেষে তাদের ধরা হয় এবং আমার সামনে আনা হয়। তখন আল্লাহ আমাকে যাদের মাধ্যমে পরীক্ষা করেছিলেন, অর্থাৎ সেই সময়ের কিছু মুফতিদের কাছে আমি বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলাম। তারা বলল: এরা ডাকাত বা সশস্ত্র বিদ্রোহী নয়! কারণ সশস্ত্র ডাকাতি তো কেবল সম্পদের ব্যাপারে হয়, নারীদের বিষয়ে নয়।তখন আমি বললাম: ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন তোমরা কি জানো না যে নারীর ইজ্জতের উপর হামলাই তো সম্পদের উপর হামলার চেয়েও জঘন্য? মানুষ তো সবাই রাজি থাকবে তাদের সম্পদ চলে যাক, কিন্তু কেউই রাজি হবে না যে তার স্ত্রী বা কন্যাকে কেউ লাঞ্ছিত করুক। যদি আল্লাহ তাআলা যে শাস্তি নির্ধারণ করেছেন তার চেয়েও কঠিন কোনো শাস্তি থাকত, তবে তা এই লোকদেরই জন্য হতো।”(সিনিয়র আলেম বোর্ডের একটি গবেষণা থেকে সংগৃহীত, যার শিরোনাম: “ডাকাতি, অপহরণ ও মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত শরয়ি বিধান”(আরবি মূল:الحكم في السطو والاختطاف والمسكرات), পৃষ্ঠা ১৯২–১৯৪; গৃহীত; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪৫৩৭৫১)
.
▪️ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় শাস্তি (দন্ড) বাস্তবায়নের ক্ষমতা কার:
ইসলামী শরী‘আতের বিধান মোতাবেক রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তিগতভাবে কোন অবস্থাতেই কোন রায় বাস্তবায়ন করা যাবে না। শাস্তি (হদ্দ) বা দন্ডবিধি কার্যকর করার ক্ষমতা কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় মুসলিম প্রশাসনের। যে কেউ যখন তখন যেখানে ইচ্ছা এই বিধান কার্যকর করলে একটি দেশের প্রশাসনিক অবকাঠামো ধ্বংস হবে। সাথে সাথে সুষ্ঠু সমাজের স্বাভাবিক সুখ-শান্তি বিপর্যস্ত হবে। ফলে শাস্তির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। অর্থাৎ অপরাধীকে শাস্তি দানের মাধ্যমে অন্যদের শিক্ষা প্রদান পূর্বক সমাজ থেকে অপরাধ সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে। ফলে পরবর্তীতে শাস্তির মূল উদ্দেশ্য- সমাজের শান্তি-শৃংখলা ও সমৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং মানবতার মুক্তি ও কল্যাণ সাধিত হবে।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন:وَلا يُقِيمُ الحُدُودَ إِلَّا الحَاكِمُ المُسْلِمُ، أَوْ مَنْ يَقُومُ مَقَامَ الحَاكِمِ، وَلا يَجُوزُ لِأَفْرَادِ المُسْلِمِينَ أَنْ يُقِيمُوا الحُدُودَ؛ لِمَا يَلْزَمُ عَلَى ذَلِكَ مِنَ الفَوْضَى وَالفِتْنَةِ.”হাদ বা দণ্ডবিধি (শরী‘আত নির্ধারিত শাস্তি) মুসলিম শাসক বা শাসকের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ছাড়া আর কেউই কার্যকর করতে পারবে না। সাধারণ মুসলিমদের পক্ষে দণ্ডবিধি কার্যকর করা জায়েয নেই। কারণ এর ফলে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি হবে।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ;খণ্ড:২২;পৃষ্ঠা:৭;ফাতওয়া নং-১৭৭৪৩।
.
▪️দ্বিতীয়ত: কেউ কোন নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করার চেষ্টা করলে আত্মরক্ষার জন্য করণীয় কী? সে কি অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে?
.
যে নারীর সাথে জোরপূর্বক যেনা করার চেষ্টা করা হচ্ছে সে নারীর উপর আত্মরক্ষা করা ফরজ। তিনি কিছুতেই দুর্বৃত্তের কাছে হার মানবেন না। এজন্য যদিদুর্বৃত্তকে হত্যা করে নিজেকে বাঁচাতে হয় সেটা করবেন। এই আত্মরক্ষা ফরজ। ধর্ষণ করতে উদ্যত ব্যক্তিকে হত্যা করার কারণে তিনি দায়ী হবেন না। এমনকি কোন নারী প্রাণান্তকর চেষ্টা করার পর যদি নিজে নিহত হয়, তবে তিনি শহীদের মর্যাদা পাবেন।দলিল হচ্ছে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنْ قُتِلَ دُوْنَ مَالِهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ وَمَنْ قُتِلَ دُوْنَ أَهْلِهِ أَوْ دُوْنَ دَمِهِ أَوْ دُوْنَ دِيْنِهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেল সে শহীদ। যে ব্যক্তি তার পরিবার রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেল সে শহীদ। যে ব্যক্তি তার জীবন রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেল সে শহীদ। যে ব্যক্তি তার দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেল সে শহীদ’ (আবূ দাঊদ, হা/ ৪৭৭২)। অন্য হাদীসে এসেছে, উবাইদ ইবনু উমাইর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, أَنَّ رَجُلًا أَضَافَ نَاسًا مِنْ هُذَيْلٍ فَأَرَادَ امْرَأَةً عَلَى نَفْسِهَا فَرَمَتْهُ بِحَجَرٍ فَقَتَلَتْهُ فَقَالَ عُمَرُ وَاَللهِ لَا يُودَى أَبَدًا ‘হুযাইল গোত্রের এক ব্যক্তি কিছু লোককে মেহমান হিসাবে গ্রহণ করল। সে ব্যক্তি মেহমানদের মধ্য থেকে এক মহিলাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। তখন সে মহিলা তাকে পাথর ছুড়ে মেরে লোকটিকে হত্যা করল। সে মহিলার ব্যাপারে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! কখনই পরিশোধ গ্রহণ করা হবে না (মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৭৯১৯)।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] তাঁর মুগনী গ্রন্থে এসেছে-( وقال أحمد في امرأة أرادها رجل على نفسها فقتلته لتحصن نفسها ، قال أحمد : إذا علمت أنه لا يريد إلا نفسها فقتلته لتحصن نفسها فلا شئ عليها . وذكر أحمد حديثا يرويه الزهري عن القاسم بن محمد ، عن عبيد بن عمير أن رجلا أضاف ناسا من هذيل ، فأراد امرأة عن نفسها فرمته بحجر فقتلته . فقال عمر : و الله لا يودى أبدا – أي لا تدفع عنه دية – ؛ ولأنه إذا جاز الدفع عن ماله الذي يجوز بذله وإباحته ، فدفع المرأة عن نفسها وصيانتها عن الفاحشة وحفظ عرضها من الزنا الذي لا يباح بحال ولا يجوز به البذل أولى من دفع الرجل عن ماله . وإذا ثبت هذا فإنه يجب عليها أن تدفع عن نفسها إن أمكنها ذلك ؛ لأن التمكين منها محرم وفي ترك الدّفع تمكين )”যে নারীকে কোন পুরুষ ভোগ করতে উদ্যত হয়েছে ইমাম আহমাদ এমন নারীর ব্যাপারে বলেন: আত্মরক্ষা করতে গিয়ে সে নারীযদি তাকে মেরে ফেলে… ইমাম আহমাদ বলেন: যদি সে নারী জানতে পারেন যে, এ ব্যক্তি তাকে উপভোগ করতে চাচ্ছে এবং আত্মরক্ষার্থে তিনি তাকে মেরে ফেলেন তাহলে সে নারীর উপর কোন দায় আসবে না। এ প্রসঙ্গে ইমাম আহমাদ একটি হাদিস উল্লেখ করেন যে হাদিসটি যুহরি বর্ণনা করেছেন কাসেম বিন মুহাম্মদ থেকে তিনি উবাইদ বিন উমাইর থেকে। তাতে রয়েছে- এক ব্যক্তি হুযাইল গোত্রের কিছু লোককে মেহমান হিসেবে গ্রহণ করল। সে ব্যক্তি মেহমানদের মধ্য থেকে এক মহিলাকে ধর্ষণ করার চেষ্টাকরেছিল। তখন সে মহিলা তাকে পাথর ছুড়ে মারেন। যার ফলে লোকটি মারা যায়। সে মহিলার ব্যাপারে উমর (রাঃ) বলেন: আল্লাহর শপথ, কখনই পরিশোধ করা হবে না অর্থাৎ কখনোই এই নারীর পক্ষ থেকে দিয়ত (রক্তমূল্য) পরিশোধ করা হবে না। কারণ যদি সম্পদ রক্ষার্থে লড়াই করা জায়েয হয় যে সম্পদ খরচ করা, ব্যবহার করা জায়েয তাহলে কোন নারীর তার আত্মরক্ষার্থে, খারাপ কাজ থেকে নিজেকে হেফাযত করতে গিয়ে, যেনা থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে- যে গুনাহ কোন অবস্থায় বৈধ নয়- লড়াই করা সম্পদ রক্ষার লড়াই এর চেয়ে অধিক যুক্তিপূর্ণ। এইটুকু যখন সাব্যস্ত হল সুতরাং সে নারীর যদি আত্মরক্ষা করার সামর্থ্য থাকে তাহলে সেটা করা তার উপর ওয়াজিব। কেননা দুর্বৃত্তকে সুযোগ দেয়া হারাম। এক্ষেত্রে আত্মরক্ষা না করাটাই তো সুযোগ দেয়া।”(আল-মুগনি; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৩১) আল্লাহ ভাল জানেন। (আল-মুফাসসাল ফি আহকামিল মারআ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৪২-৪৩)
.
আর যদি কোন অসহায় নারী নিহত হওয়ার আশংকায় ধর্ষণের শিকার হয় তাহলে তার উপর কোন অপরাধ বা শাস্তি বর্তাবে না। তবে ধৈর্যধারণ করে মৃত্যুকে বরণ করে নিলে সেটা তার জন্য উত্তম হবে। কিন্তু মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া তার উপর ফরজ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَمَنِ اضۡطُرَّ غَیۡرَ بَاغٍ وَّ لَا عَادٍ فَلَاۤ اِثۡمَ عَلَیۡہِ ‘অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন পাপ নেই’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৭৩) সুনানে বাইহাকীতে এসেছে- আবু আব্দুর রহমান আল-সুলামি হতে বর্ণিত তিনি বলেন: উমর (রাঃ) এর নিকট এক মহিলাকে ধরে আনাহল। সে মহিলা তীব্র পিপাসায় কাতর ছিল এবংএক রাখালের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। মহিলাটি রাখালের কাছে পানি চাইল। রাখাল তাকে পানি দিতে অস্বীকৃতি জানাল- যদি না মহিলারাখালকে জৈবিক চাহিদাপূরণ করার সুযোগ না দেয়। উমর (রাঃ) এ মহিলাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করলেন। তখন আলী (রাঃ) বললেন: এ মহিলা অনন্যোপায় ছিল। আমার অভিমত হল- তাকে খালাস দিন। তখন উমর (রাঃ) মহিলাটিকে খালাস দিলেন। আমি বলব: এই বিধানএখনো চলমানআছে। যদি কোন নারী কোন পুরুষের কাছে থাকা খাবার বা পানীয়ের তীব্র প্রয়োজনের সম্মুখীন হয় এবং সে পুরুষ যেনা করা ছাড়া সেটা দিতে রাজি না হয়,আর সে নারীস্বীয়জীবন নাশের আশংকা করে নিজেকে সে পুরুষের হাতে তুলে দেয় সেক্ষেত্রে সে নারীর উপর শরয়ি হদ্দ (যেনার দণ্ড) কায়েম করা হবে না। কেউ যদি বলেন: এমতাবস্থায় নিজেকে তুলে দেয়া কি জায়েয; নাকি মৃত্যু হলেওধৈর্য রাখা ওয়াজিব? উত্তর হচ্ছে: এই নারীর ক্ষেত্রে শরয়ি হুকুম হচ্ছে- জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার নারীর হুকুম। যে নারীকে এই বলেহুমকি দেয়া হয়:‘সুযোগ দিলে দে; না হয় তোকে মেরে ফেলব’। ধর্ষণের শিকার নারীর উপর হদ্দ কায়েম করা হবে না। মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্য সে নারী নিজের ইজ্জত বিসর্জন দিতে পারে। তবে যদি কোন নারীধৈর্যধারণ করে মৃত্যুকেবরণ করে নেয় তবে সেটা তার জন্য উত্তম। কিন্তু এক্ষেত্রে ধৈর্য ধরা তার উপর ফরজ নয়। আল্লাহই ভাল জানেন।”(ইবনু কাইয়্যেম; “আত-তুরুকুলহুকমিয়্যা” অনুচ্ছেদ: ১৮; গৃহীত; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৪০১৭)
.
▪️তৃতীয়ত: ধর্ষনের মত জঘন্য অপরাধ থেকে সমাজকে রক্ষার উপায়সমূহ কি?
.
আমাদের যুবসমাজ ও পুরো সমাজকে এই ধ্বংসাত্মক অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এতে বিভিন্ন সংস্থা, সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিত্ব এবং নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এটি কেবল সমষ্টিগত দায়িত্ব নয়, ব্যক্তিগত দায়িত্বও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের নিরাপত্তা, নৈতিকতা ও পবিত্রতা তখনই নিশ্চিত করা সম্ভব, যখন ব্যভিচার ও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সকল কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই কার্যকর প্রতিরোধমূলক উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—
.
(১).সাধারণভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করা:মানুষকে জানানো যে ব্যভিচার কত বড় পাপ, এটি এমন একটি মহাপাপ যার কদর্যতা ও নিষিদ্ধতা সম্পর্কে বুদ্ধি ও শরীয়ত উভয়ই একমত। এটি জাতির ধ্বংস, বিপর্যয় ও দুর্যোগের কারণ। আর পরকালে এর প্রতিদান হলো জাহান্নাম।ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,ليس بعد قتل النفس أعظم من الزنا”আত্মহত্যা বা কাউকে হত্যা করার পর ব্যভিচারের চেয়ে বড় কোনো গুনাহ নেই।”(গিদাউল আলবাব; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪৩৫) তাছাড়া মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاء سَبِيلاً “আর যিনার ধারে-কাছেও যেও না, নিশ্চয় তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।”(সূরা বনি ইসরাইল: ৩২)
উক্ত আয়াতের তাফসিরে সৌদি আরবের প্রথিতযশা মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম ‘আব্দুর রহমান বিন নাসির আস-সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৭৬ হি./১৯৫৬ খ্রি.] বলেছেন:ووصف الله الزنى وقبحه بأنه ( كَانَ فَاحِشَةً ) أي إثم يستفحش في الشرع والعقل والفِطَر ؛ لتضمنه التجري على الحرمة في حق الله وحق المرأة وحق أهلها أو زوجها وإفساد الفراش واختلاط الأنساب وغير ذلك من المفاسد . وقوله: ( وَسَاءَ سَبِيلا ) أي : بئس السبيل سبيل من تجرأ على هذا الذنب العظيم “আল্লাহ তাআলা ব্যভিচারকে (যাকে তিনি বলেছেন কানা ফাহিশাহ) কুখ্যাত অশ্লীল কাজ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, কারণ এটি এমন এক অপরাধ যা শরীয়ত, বুদ্ধি ও প্রকৃতি তিনটি দিক থেকেই অত্যন্ত ঘৃণ্য। কারণ এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে:আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করা, নারীর অধিকার লঙ্ঘন করা ও তার পরিবার বা স্বামীর প্রতি অন্যায় করা,শয্যা ও গৃহের পবিত্রতা নষ্ট করা, বংশের মিলমিশ ও পরিচয়ের গোলযোগ সৃষ্টি করা, এবং আরও বহু ধরনের অনর্থ সৃষ্টি হয়।এছাড়াও আল্লাহ তাআলা বলেন: «وَسَاءَ سَبِيلا», অর্থাৎ এটি একটি অত্যন্ত কুখ্যাত ও বিপজ্জনক পথ। যে ব্যক্তি এই মহাপাপের দিকে এগিয়ে যায়, সে নিজের জন্য এমন একটি পথ বেছে নিয়েছে যা অসন্তোষ ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।”(তাফসিরু সা’দী; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৫৭)
.
(২).যুবসমাজকে সতর্ক করা:যুবকদের জানাতে হবে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়লে সমাজে যে ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসে যেমন:মারাত্মক ও প্রাণঘাতী রোগের বিস্তার,অবৈধ সন্তানের জন্ম,পারিবারিক কাঠামোর ধ্বংস, সন্তানদের অনিয়মিত বা ভবঘুরে হয়ে যাওয়া, নৈতিক অবক্ষয়,বিবাহবিচ্ছেদের বৃদ্ধি,এবং অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। সমাজে যদি অশ্লীলতা ও উন্মুক্ত যৌনাচার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে এটি পরিবার, সম্প্রদায় এবং সমগ্র সভ্যতার ভিত্তি নষ্ট করে,পরিণতিতে সমাজ ভেঙে পড়ে এবং সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়।তাই যুবসমাজকে সতর্ক করা জরুরি, যেন তারা সঠিক পথে চলতে পারে এবং সমাজ সুস্থ ও সুশৃঙ্খল থাকে।
.
(৩).বৈধ যৌন সম্পর্কের পথ সুগম করা: অর্থাৎ, বৈধ বিবাহের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপনকে উৎসাহিত করা। মানুষকে সচেতন করা যে বিয়ে করা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত, এবং যে ব্যক্তি বিয়ে করে সে নিজের দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করে। পাশাপাশি,বৈবাহিক সম্পর্ক তার ও তার স্ত্রীকে ব্যভিচার থেকে রক্ষা করে এবং আল্লাহর নিকট তা গ্রহণযোগ্য আমল ও পুরস্কারের কারণ হয়।
.
(৪).বিবাহে বাধা দূর করা:সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো বিয়েতে প্রতিবন্ধকতা দূর করা।দারিদ্র্য যদি বিয়ের পথে অন্তরায় হয়, তাহলে দরিদ্র যুবকদের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) আল্লাহর বাণী:وَ اَنۡكِحُوا الۡاَیَامٰی مِنۡكُمۡ وَ الصّٰلِحِیۡنَ مِنۡ عِبَادِكُمۡ وَ اِمَآئِكُمۡ ؕ اِنۡ یَّكُوۡنُوۡا فُقَرَآءَ یُغۡنِهِمُ اللّٰهُ مِنۡ فَضۡلِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ “আর তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন তাদের বিয়ে সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্ৰস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন; আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ”। (সূরা নুর;৩২) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন,زوجوا من لا زوج له منكم ، فإنه طريق التعفف”যার বিয়ে হয়নি,তাকে বিয়ে করাও এটি পবিত্রতা অর্জনের একটি মাধ্যম।”(তাফসিরে কুরতুবী; খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ২৩৯)
.
আবু উবাইদুল কাসিম ইবনু সাল্লামের আল আমওয়াল গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে,খলিফা উমর ইবনু আব্দুল আজীজ (রাহিমাহুল্লাহ) ইরাকের গভর্নরকে লিখেছিলেন,أن انظر كل بكر وليس له مال فشاء أن تزوجه فزوجه وأصدق عنه “যে কোনো অবিবাহিত যুবক আছে, যার কোনো সম্পদ নেই, এবং সে যদি বিবাহ করতে চায়, তাহলে তুমি তাকে বিবাহ করিয়ে দাও এবং তার পক্ষ থেকে মোহরানা প্রদান করো।”(আল আমওয়াল; পৃষ্ঠা: ২৫১)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] তাঁর মুগনী গ্রন্থে বলেছেন:يلزم الرجل إعفاف ابنه إذا احتاج إلى النكاح ، وهذا ظاهر مذهب الشافعي”যখন পুত্র বিবাহের প্রয়োজন অনুভব করে, তখন পিতার জন্য তার বিবাহের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। এটাই ইমাম শাফেয়ী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মাযহাবের স্পষ্ট মতামত।”(ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খন্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৫৮৭)
.
(৫).সমাজ ও অভিভাবকদের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ন্যূনতম দায়িত্ব হলো, মোহরানায় অতিরিক্ততা পরিহার করা, বিবাহের খরচ নিয়ে গর্ব বা অহঙ্কার না করা, এবং বিয়ের মাধ্যমে আর্থিক লাভের চেষ্টা না করা। আবুল আজফা আস্-সুলামী (রহ.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন,উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) একবার মিম্বারে খুতবা দিয়ে বলেছিলেন,أَلَا لَا تُغَالُوا بِصُدُقِ النِّسَاءِ، فَإِنَّهَا لَوْ كَانَتْ مَكْرُمَةً فِي الدُّنْيَا، أَوْ تَقْوَى عِنْدَ اللَّهِ لَكَانَ أَوْلَاكُمْ بِهَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَا أَصْدَقَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ امْرَأَةً مِنْ نِسَائِهِ، وَلَا أُصْدِقَتْ امْرَأَةٌ مِنْ بَنَاتِهِ أَكْثَرَ مِنْ ثِنْتَيْ عَشْرَةَ أُوقِيَّةً”সতর্ক হও! তোমরা নারীদের মোহর নির্ধারণে সীমালঙ্ঘন করো না। কারণ মোহরানা যদি দুনিয়ার মর্যাদার বস্তু হতো এবং আল্লাহর নিকট তাকওয়ার নিদর্শন হতো,তবে তোমাদের চেয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতেন এর যোগ্যতম ব্যক্তি। অথচ তিনি তাঁর স্ত্রীদের কারো মোহর এবং তাঁর কন্যাদের কারো মোহর বারো ঊকিয়ার (প্রায় ৪৮০ দিরহাম) অধিক ধার্য করেননি।”(আবু দাউদ হা/২১০৬; সনদ হাসান) আলেমদের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই যে, কন্যাদের মোহরানা আত্মসাৎ করা বা তা থেকে লাভের চেষ্টা করা সমাজে অশ্লীলতা ও অনৈতিকতার বিস্তারের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
.
(৬).পাপ ও অশ্লীলতা থেকে সমাজকে রক্ষা করার অন্যতম শক্তিশালী উপায় হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আন্তরিক ভালোবাসা ও স্নেহের পরিবেশ গড়ে তোলা। প্রেম, সম্মান, সততা, বিশ্বস্ততা এবং পরস্পরের অধিকার ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে পারিবারিক সুখ নিশ্চিত করা গেলে, পরিবারে বোঝাপড়া ও আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়। একটি সুখী ও পরিপূর্ণ দম্পতি সমাজে বিভ্রান্তিকর সুখের সন্ধানে অশ্লীলতার পথে চলা ও পতনের ঝুঁকি কমিয়ে দেয় এবং সমাজের জন্য এক প্রকার নিরাপত্তার ঢাল হিসেবে কাজ করে। মাবাহিসুল ফালসাফাহ নামক গ্রন্থে ইতিহাসের এক পর্যায়ে পাশ্চাত্য সমাজে অনৈতিকতা ছড়িয়ে পড়ার কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এর একটি কারণ ছিল এই যে, কিছু পিতা, যারা তাঁদের কন্যাদের প্রতি অত্যধিক স্নেহশীল ছিলেন, তাঁরা তাঁদের সতীত্বের বিনিময়ে অতিরিক্ত মোহর দাবি করতেন যখন বিবাহকে প্রকাশ্যে এক প্রকার ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয় হিসেবে দেখা হতো। সমাজকে ব্যভিচার ও অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করার অন্যতম প্রধান উপায় হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা, মমতা ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ সৃষ্টি করা, ভালোবাসা, সম্মান, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, এবং পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পারিবারিক সুখ বজায় রাখা। কারণ, সুখী পরিবার এবং পরস্পরকে বুঝে চলা স্বামী-স্ত্রী সমাজকে বিপথগামিতা ও কল্পিত সুখের আশায় ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে।
.
(৭).সবশেষে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সান্নিধ্যে এমন এক রক্ষণশীল ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পরিবেশ গঠন করা, যেখানে ইচ্ছাকৃত উন্মুক্ততা ও শরীর প্রদর্শনের প্রকাশ্য রূপ বিলুপ্ত হয়ে যায়, সতর্কতার সাথে শরীর আবৃত থাকে,এবং মদ্যপান ও বাদ্যযন্ত্র—যা ব্যভিচারের আহ্বান সৃষ্টি করে তা নিষিদ্ধ থাকবে। কারণ এই সমস্ত বিষয়ই অশ্লীলতার আগুনের জ্বালানি। তাই যখন সমাজ এই সমস্ত থেকে মুক্ত হবে, তখন সে সেই আগুন থেকে যুবক-যুবতী নিরাপদ থাকবে।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।

অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব। 

No comments:

Post a Comment

Translate