Thursday, July 25, 2024

মুসলিম সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ব্যাপারে কঠিন হুশিয়ারি এবং এ সংক্রান্ত কুরআনের আয়াত ও হাদিস

মুসলিম সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ, হানাহানি, হত্যাকাণ্ড, রক্তপাত, পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ব্যাপারে কঠিন হুশিয়ারি (এ সংক্রান্ত ২০টি কুরআনের আয়াত ও হাদিস)।

ভূমিকা: ইসলাম, মানবতা ও নৈতিকতার কোনও স্তরেই নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ও অহেতুক রক্তপাত সমর্থনযোগ্য নয়। মানবসমাজে কোনও রকম অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, উগ্রতা, বর্বরতা, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড কোনও বিবেকবান ও ধর্মপ্রাণ মানুষের কাম্য নয়। প্রাক-ইসলামি যুগে আরব সমাজে যখন ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির প্রচলন ছিল তখন পেশিশক্তির জোরে খুনখারাবি, হত্যাকাণ্ড, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, ঘুষ-দুর্নীতি সবকিছুই অবাধে চলত। ইসলামের আবির্ভাবে সব রকম হত্যা, রক্তপাত, অরাজকতা, সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে শরিয়ত সম্মত ইসলামি জি-হাদ হলে ভিন্ন কথা। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন বিধিবিধান রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক মতপার্থক্য, ধর্মীয় বিষয়ে দ্বিমত, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয়ে শত্রুতা, টাকাপয়সা লেনদেনকে কেন্দ্র করে ঝগড়াঝাঁটি, অর্থের বিনিময়ে মানুষ খুন বা সামান্য বিষয়ে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে রক্ত প্রবাহিত করা বা হত্যা করা নিঃসন্দেহে ইসলামি ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী যেমন মারাত্মক অপরাধ (কেসাস তথা হত্যার বিনিময়ে হত্যা, অঙ্গহানির বিনিময়ে অঙ্গহানি) তেমনি আখিরাতে খুনির পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।

নিম্নে ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা, রক্তপাত, মুসলিমদের পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ ও মারামারি-কাটাকাটিতে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে কতিপয় কুরআনের আয়াত ও হাদিস তুলে ধরা হল। যেন আমরা সতর্ক হই। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।

◈ ১. নিরপরাধ ইমানদারকে হত্যাকারীর ব্যাপারে আল্লাহর কঠিন হুমকি:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

«وَمَنْ يَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيْهَا وَغَضِبَ اللهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيْمًا»

“আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায়-জেনেবুঝে কোন ইমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করবে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে এবং আল্লাহ তাআলা তার প্রতি ক্রুদ্ধ হবেন ও তাকে অভিসম্পাত দিবেন। আর তিনি তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি।” [সূরা নিসা: ৯৩]

“সেখানে সে চিরকাল থাকবে” এ কথার অর্থ: এটাই তার উপযুক্ত পাওনা যদি আল্লাহ শাস্তি দেন। তবে তার মধ্যে যদি শিরক না থাকে তাহলে হয়ত আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন অথবা জাহান্নামে শাস্তি দেওয়ার পর সেখান থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অথবা এর অর্থ হলো, কেউ যদি এই হত্যাকে জায়েজ মনে করে তাহলে তার জন্য শাস্তি হলো, চিরস্থায়ী জাহান্নাম। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহর হারাম কৃত বিধানকে হালাল মনে করবে সে মুসলিম থাকে না; কাফের হয়ে যায়। আর কাফেরের শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম।

◈ ২. নিরপরাধ একজন মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করার শামিল:
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

مَن قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا

“যে ব্যক্তি প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ (মানুষ হত্যার শাস্তির বিনিময়ে কিসাস হিসেবে হত্যা) অথবা জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার অপরাধ ছাড়া কোনও মানুষকে হত্যা করল সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল এবং যে কারও জীবন রক্ষা করল সে যেন সব মানুষের জীবন রক্ষা করল।” [সূরা মায়িদা: ৩২]

◈ ৩. দু দল দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সন্ধি করার নির্দেশ। কোনও একপক্ষ সন্ধি প্রত্যাখ্যান করে অপর পক্ষের উপর বাড়াবাড়ি করলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ۖ فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ ۚ فَإِن فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا ۖ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ ‎

“যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দিবে এবং ইনসাফ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসফ কারীদেরকে পছন্দ করেন।” [সূরা হুজুরাত: ৯]

◈ ৪. আল্লাহর নিকট সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হওয়া নিরপরাধ এমন মুসলিমকে হত্যা করার চেয়ে সহজ:

আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لَزَوَالُ الدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللهِ مِنْ قَتْلِ رَجُلٍ مُسْلِمٍ

“আল্লাহ তাআলার নিকট একজন মুসলিমকে হত্যা করার চেয়ে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া অধিকতর সহজ।” [সুনানে নাসায়ী, অধ্যায়: ৩৮/ হত্যাকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে, পরিচ্ছেদ: ২. রক্তের মর্যাদা]

◈ ৫. একজন ইমানদার খুন হওয়া সারা পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার চেয়ে গুরুতর:

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَقَتْلُ مُؤْمِنٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ زَوَالِ الدُّنْيَا

“ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, কোন মুসলিমকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা আল্লাহর কাছে পৃথিবী ধ্বংস হওয়া অপেক্ষাও গুরুতর।” [সুনানে নাসায়ী, অধ্যায়: ৩৮/ হত্যাকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে, পরিচ্ছেদ: ২. রক্তের মর্যাদা]

◈ ৬. সারা পৃথিবীর মানুষ যদি একজন ইমানদার ব্যক্তিকে খুন করে তাহলে আল্লাহ তাদের সকলকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন:

আবু সাইদ ও আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তারা বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لَوْ أَنَّ أَهْلَ السَّمَاءِ وَأَهْلَ الْأَرْضِ اشْتَرَكُوْا فِيْ دَمِ مُؤْمِنٍ لَأَكَبَّهُمُ اللهُ فِيْ النَّارِ

“যদি আসমান-জমিনের সবাই মিলে একজন ইমানদার ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করে তবে আল্লাহ তাদের সকলকে মুখের ভরে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” [সুনানে তিরমিজি, অধ্যায়: ১৪/ দিয়ত বা রক্তপণ, পরিচ্ছেদ: ৮. খুনের বিচার-সহিহ]

◈ ৭. দু জন মানুষ পরস্পরকে হত্যার জন্য উদগ্রীব থাকলে হত্যাকারী ও নিহত উভয়ই জাহান্নামি:

আবু বাকরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إِذَا الْتَقَى الْـمُسْلِمَانِ بِسَيْفَيْهِمَا فَالْقَاتِلُ وَالْـمَقْتُوْلُ فِيْ النَّارِ، قِيْلَ: يَا رَسُوْلَ الله! هَذَا الْقَاتِلُ، فَمَا بَالُ الْـمَقْتُوْلِ؟ قَالَ: إِنَّهُ كَانَ حَرِيْصًا عَلَى قَتْلِ صَاحِبِهِ.

“যখন দু জন মুসলিম তরবারি (অস্ত্র) নিয়ে মুখোমুখি লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হয় তখন ঘাতক এবং নিহত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামি। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলা হল: হে আল্লাহর রসুল, হত্যাকারীর ব্যাপারটি তো বুঝলাম। তবে নিহত ব্যক্তির দোষ কী যার কারণে সে জাহান্নামে যাবে? রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কারণ সেও তো অপরপক্ষকে হত্যা করার জন্য উদগ্রীব ছিল” [বুখারী, হা/৩১, ৬৮৭৫, ৭০৮৩ ও মুসলিম, হা/২৮৮৮]

◈ ৮. কিয়ামের কোর্টে সর্বপ্রথম বিচার কার্য পরিচালিত হবে মানুষ খুনের ব্যাপারে:

আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

أَوَّلُ مَا يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيْ الدِّمَاءِ

“কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম বিচার-ফয়সালা করা হবে রক্তের।” [বুখারী ৬৫৩৩, ৬৮৬৪; মুসলিম, হা/ ১৬৭৮]

◈ ৯. মুসলিমদের রক্ত,অর্থ- সম্পদ ও মান-মর্যাদা অত্যন্ত মর্যাদার পাত্র:
তিনি আরও বলেন,

« كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ : دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ »

“প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির রক্ত (জীবন), ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান অপর সব মুসলিমের জন্য হারাম (বা সম্মানযোগ্য)।” [মুসলিম, হাদিস নং ৬৭০৬]

◈ ১০. মানুষ খুন দ্বীনের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনকে সংকীর্ণ করে তোলার নামান্তর:

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন,

لَنْ يَزَالَ الْمُؤْمِنُ فِي فُسْحَةٍ مِنْ دِينِهِ مَا لَمْ يُصِبْ دَمًا حَرَامًا

“একজন প্রকৃত মুমিন তার দ্বীনের ব্যাপারে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, যে পর্যন্ত সে অন্যায়ভাবে হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত না হয়।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৮৭/ রক্তপণ, পরিচ্ছেদ: ৮৭/১. আল্লাহর বাণী: “কেউ ইচ্ছা পূর্বক কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার শাস্তি হল জাহান্নাম।” (সূরা নিসা: ৯৩)]

এ হাদিসের অর্থ হলো, একজন মুসলিম জীবনে নানা ভুলত্রুটি ও পাপাচার করে। তারপরও সে দ্বীনের বিষয়ে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকে অর্থাৎ তার সামনে মুক্তির আশা বিদ্যমান থাকে। সে তখনো কল্যোণের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু যখন সে মানুষ হত্যা করার মত অপরাধ করে ফেলে তখন সে নিজেকে ভয়াবহ সংকীর্ণতায় ফেলে দেয়। অর্থাৎ সে অন্যায়ভাবে রক্তপাতের মাধ্যমে দুনিয়ায় দণ্ডনীয় অপরাধী, আল্লাহর ক্রোধ ও লানতের শিকার হয় এবং মানুষের হক বিনষ্ট করার কারণে আখিরাতে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ হেফাজত করুন। আমিন।।

◈ ১১. কোনও ইমানদারকে হত্যা করা ক্ষমাহীন অপরাধ:

আবুদ দারদা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি,

كُلُّ ذَنْبٍ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَغْفِرَهُ، إِلَّا مَنْ مَاتَ مُشْرِكًا، أَوْ مُؤْمِنٌ قَتَلَ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا

“আশা করা যায়, আল্লাহ সব গুনাহই ক্ষমা করবেন কিন্তু মুশরিক অবস্থায় কেউ মারা গেলে অথবা কোনও ইমানদার ব্যক্তি অপর কোনও ইমানদারকে ইচ্ছাকৃত ভাবে হত্যা করলে (তাকে ক্ষমা করবেন না)।” [সুনান আবু দাউদ (তাহকিককৃত), অধ্যায়: ৩০/ ফিতনা-ফ্যাসাদ, পরিচ্ছেদ: ৬. ইমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ]

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞ আলেমগণ বলেছেন, জুমহুর বা সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মতে, “কোনও ইমানদার ব্যক্তি অপর কোনও ইমানদারকে ইচ্ছাকৃত ভাবে হত্যা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না” বলার মাধ্যমে অন্যায়ভাবে হত্যা করার ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য আয়াত ও হাদিসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, শিরক ছাড়া অন্যান্য গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন যাকে ইচ্ছা। [দেখুন: সূরা নিসা এর ৪৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা]। যেহেতু হত্যাকাণ্ড বড় গুনাহ হলেও তা শিরক নয়। সুতরাং সে যদি তওবা করে তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন বলে আশা করা যায়। এখানে বনি ইসরাইলের এক খুনি কর্তৃক খৃষ্টান পাদ্রিকে হত্যার মাধ্যমে ১০০ খুন পূর্ণ করার পর তওবা করা সংক্রান্ত হাদিসটিও প্রযোজ্য।

◈ ১২. ইমানদারকে হত্যা করে আনন্দ লাভ করলে তার ফরজ ও নফল ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হবে না:

তিনি আরও বলেন,

مَنْ قَتَلَ مُؤْمِنًا فَاعْتَبَطَ بِقَتْلِهِ، لَمْ يَقْبَلِ اللَّهُ مِنْهُ صَرْفًا، وَلَا عَدْلًا

“যে ব্যক্তি কোনও ইমানদারকে হত্যা করে এতে উল্লসিত হল, আল্লাহ তার কোনও ফরজ বা নফল কোনও ইবাদত কবুল করবেন না।” [সুনান আবু দাউদ (তাহকিককৃত), অধ্যায়: ৩০/ ফিতনা-ফ্যাসাদ, পরিচ্ছেদ: ৬. ইমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ]

◈ ১৩. মানুষ হত্যা দ্বীনের পথে গতিময় জীবনকে স্তদ্ধ করে দেয়:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,

لَا يَزَالُ الْمُؤْمِنُ مُعْنِقًا صَالِحًا، مَا لَمْ يُصِبْ دَمًا حَرَامًا، فَإِذَا أَصَابَ دَمًا حَرَامًا بَلَّحَ

“একজন ইমানদার ব্যক্তি সততার সাথে দ্বীনের পথে দ্রুত বেগে চলতে থাকে যতক্ষণ না সে অন্যায়ভাবে কারো রক্ত ঝরায়। যখন সে অন্যায়ভাবে রক্ত ঝরাবে তখন দুর্বল ও ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে তার চলার গতি স্তব্ধ হয়ে যাবে।” [সুনান আবু দাউদ (তাহকিককৃত), অধ্যায়: ৩০/ ফিতনা-ফ্যাসাদ, পরিচ্ছেদ: ৬. ইমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ]

◈ ১৪. মানুষ হত্যা অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক অপরাধ:

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ قِيلَ يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ وَالسِّحْرُ وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِى حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ وَأَكْلُ الرِّبَا وَالتَّوَلِّى يَوْمَ الزَّحْفِ وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْغَافِلاَتِ الْمُؤْمِنَاتِ

“তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কার্যাবলী হতে দূরে থাক। বলা হল: হে আল্লাহর রসূল, সেগুলো কী কী? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শিরক করা, জাদু করা, ন্যায় সঙ্গত অধিকার ছাড়া আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা করা হারাম করেছেন তা হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিম শিশুর অর্থ লোপাট করা, যুদ্ধের দিন (জিহাদের ময়দান) থেকে পলায়ন করা এবং সতী-সাধ্বী ও সুচরিত্রা ইমানদার নারীর চরিত্রে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া।” [বুখারী, হা/২৭৬৬, ৬৮৫৭ ও মুসলিম, হা/২৭২]

◈ ১৫. মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণকারী মুসলিমদের দলভুক্ত নয়:

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

مَنْ حَمَلَ عَلَيْنَا السِّلاَحَ فَلَيْسَ مِنَّا

“যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” [সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী), অধ্যায়: ১। ইমান, পরিচ্ছেদ: ৪২. নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উক্তি: “যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”]

◈ ১৬. মুসলিম ব্যক্তির প্রতি অস্ত্র উঁচিয়ে ইশারা করা লানত যোগ্য অপরাধ:

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“‏ مَنْ أَشَارَ عَلَى أَخِيهِ بِحَدِيدَةٍ لَعَنَتْهُ الْمَلاَئِكَةُ ‏”

“যে ব্যক্তি তার ভাইকে লোহা (অস্ত্র) দ্বারা ইঙ্গিত করে ফেরেশতাগণ তার উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করেন।” [সুনানে তিরমিজি (তাহকীককৃত), অধ্যায়: ৩১/ ফিতনা-ফ্যাসাদ, পরিচ্ছেদ: ৪. কোন ব্যক্তির অস্ত্র দ্বারা মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ইশারা করা-সহিহ]

◈ ১৭. ইসলামি আইনে কাউকে ভয় দেখানোও নিষিদ্ধ:

ইসলামে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা তো বহু দূরের কথা, একজন নিরাপদে থাকা মানুষকে ভয় দেখানোও হারাম যদিও তা মজার ছলে হয়। যেমন: হাদিসে এসেছে,

আব্দুর রহমান ইবনে আবু লায়লা রহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার কাছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন সাহাবি বর্ণনা করেছেন যে,

أنَّهم كانوا يسيرون مع النَّبيِّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم فنام رجلٌ منهم فانطلق بعضُهم إلى حبلٍ معه فأخذه ففزِع فقال رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم لا يحِلُّ لمسلمٍ أن يُروِّعَ مسلمًا

“তারা এক সফরে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। তাদের থেকে এক ব্যক্তি ঘুমিয়ে গেলে, অপর একব্যক্তি রশি নিয়ে তার কাছে যায়, যা ধরার কারণে সে (সাপ মনে করে) ভয় পায়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কোন মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমকে ভয় দেখানো বৈধ নয়।” [সুনানে আবু দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৩৬/ আদব বা শিষ্টাচার, পরিচ্ছেদ: ৯০. ঠাট্টার ছলে কোন জিনিস নেওয়া সম্পর্কে-সহিহ]

◈ ১৮. তিনটি অপরাধ ছাড়া মানুষ হত্যা বৈধ নয়:

উসমান বিন আফফান রা. হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لاَ يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ إِلاَّ بِإِحْدَى ثَلاَثٍ زِنًا بَعْدَ إِحْصَانٍ أَوِ ارْتِدَادٍ بَعْدَ إِسْلاَمٍ أَوْ قَتْلِ نَفْسٍ بِغَيْرِ حَقٍّ فَقُتِلَ بِهِ

“এই তিন কারণে একটি ছাড়া মুসলিম ব্যক্তির খুন হালাল নয়: বিবাহিত করার পর পরনারীর সাথে জিনায় লিপ্ত হওয়া, ইসলাম গ্রহণের পর মুরতাদ হওয়া (ইসলাম ত্যাগ করা) এবং অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করার পর (কেসাস বা ইসলামি ফৌজদারি দণ্ড মোতাবেক) তাকেও হত্যা করা।” [বুখারি ও মুসলিম। সুনান আত তিরমিজি (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৩৬/ ফিতনা, পরিচ্ছেদ: তিনটি কারণের কোন একটি ছাড়া মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করা বৈধ নয়।]

◈ ১৯. ইসলামি ফৌজদারি আইনে অন্যায়ভাবে হত্যাকারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

ا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى ۖ الْحُرُّ بِالْحُرِّ وَالْعَبْدُ بِالْعَبْدِ وَالْأُنثَىٰ بِالْأُنثَىٰ ۚ فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ ۗ ذَٰلِكَ تَخْفِيفٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَرَحْمَةٌ ۗ فَمَنِ اعْتَدَىٰ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“হে ইমানদারগণ, তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কেসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তির বদলায়, দাস দাসের বদলায় এবং নারী নারীর বদলায়। অতঃপর তার ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কাউকে কিছুটা মাফ করে দেয়া হয়, তবে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং ভালভাবে তাকে তা প্রদান করতে হবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে সহজ এবং বিশেষ অনুগ্রহ। এরপরও যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করে, তার জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আজাব।” সূরা বাকারা: ১৭৮]

◈ ২০. ইসলামি ফৌজদারি আইনে অন্যায়ভাবে অঙ্গহানির শাস্তি অঙ্গহানি:

وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنفَ بِالْأَنفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ ۚ فَمَن تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَّهُ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ‎

“আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চোখের বিনিময়ে চোখ, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং জখম সমূহের বিনিময়ে সমান জখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গুনাহ থেকে পবিত্র হয়ে যায়। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করে না তারাই জালেম।” [সূরা মায়িদা: ৪৫]

আল্লাহ আমাদেরকে মুসলিম সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ, হানাহানি-রক্তপাত ও সব ধরণের বিশঙ্খলা সৃষ্টি হতে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার। সৌদি আরব। 

No comments:

Post a Comment

Translate