প্রশ্ন: যদি অজুর অঙ্গসমূহের কোন একটিতে যদি আঘাত, জখম বা ব্যান্ডেজ থাকে তখন অজুর সঠিক পদ্ধতি কী হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর যদি ওজুর কোনো অঙ্গে আঘাত বা জখম থাকে, তাহলে সেটি দুই অবস্থায় থাকতে পারে (১).জখম খোলা থাকবে, অথবা (২).জখমের ওপর ব্যান্ডেজ, কাপড় বা কোনো পট্টি পেঁচানো থাকবে। যদি জখমের ওপর ব্যান্ডেজ বা কাপড় পেঁচানো থাকে, তবে ওজুর সময় যা করতে হবে তা হলো: প্রথমে সেই অঙ্গের সুস্থ (অজখম) অংশগুলো ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।এরপর জখমযুক্ত অঙ্গটি ধোয়ার পালা যখন আসবে তখন পানি দিয়ে সেটি মাসেহ করবে। যদি পানি দিয়ে মাসেহ করা কষ্টকর হয় অথবা করলে ক্ষতি হয় তাহলে তায়াম্মুম করবে এবং তার জন্য এটাই যথেষ্ট হবে।যদিও ব্যান্ডেজের ওপর মাসেহ করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)–এর পক্ষ থেকে বর্ণিত হাদিসগুলো দুর্বল, তবে সাহাবি আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর থেকে এটি সহিহ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে।
.
ইমাম বায়হাকী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: وَلَا يَثْبُتُ فِي هَذَا الْبَابِ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم شَيْءٌ . . . وَإِنَّمَا فِيهِ قَوْلُ الْفُقَهَاءِ مِنْ التَّابِعِينَ فَمَنْ بَعْدَهُمْ مَعَ مَا رُوِّينَاهُ عَنْ ابْنِ عُمَرَ . فَذَكَر بِإِسْنَادِهِ أَنَّ ابْنَ عُمَرَ رضي الله عنهما تَوَضَّأَ وَكَفُّهُ مَعْصُوبَةٌ فَمَسَحَ عَلَيْهَا وَعَلَى الْعِصَابَةِ وَغَسَلَ مَا سِوَى ذَلِكَ . قَالَ : وَهَذَا عَنْ ابْنِ عُمَرَ صَحِيحٌ “এই বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। তবে তাবিয়ীগণ এবং তাঁদের পরবর্তী যুগের ফকীহদের কিছু বক্তব্য পাওয়া যায়। আমরা যে ঘটনা ইবনু উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছি, তাতে তিনি তাঁর সনদে উল্লেখ করেন ইবনু উমর (রাঃ) অজু করেছিলেন, অথচ তাঁর হাত কাপড়ে বাঁধা ছিল। তিনি সেই কাপড়সহ উক্ত স্থানে মাসেহ (চুলে হাত বুলানো) করেন এবং অন্যান্য অংশগুলো ধুয়ে ফেলেন। বায়হাকী বলেন: এটি ইবনু উমর (রাঃ) থেকে সহীহ সনদে প্রমাণিত।” (আল-মাজমু; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৬৮)
.
যদি ক্ষতস্থান খোলা থাকে এবং পানি ব্যবহারে ক্ষতি না হয়, তবে তা ধুতে হবে।পক্ষান্তরে যদি পানি ব্যবহার ক্ষতিকর হয় কিংবা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তবে সে স্থানটুকু মাসেহ করতে হবে। আর যদি মাসেহও সম্ভব না হয় তাহলে ঐ স্থানটি ধোয়া বা মাসেহ ছাড়া রেখে দিতে হবে। এরপর ওজু শেষ হলে তায়াম্মুম করতে হবে, যেন পূর্ণ পবিত্রতা অর্জিত হয়।”
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
” قال العلماء رحمهم الله تعالى : إن الجرح ونحوه إما أن يكون مكشوفاً أو مستوراً .فإن كان مكشوفاً فالواجب غسله بالماء , فإن تعذر غسله بالماء فالمسح للجرح , فإن تعذر المسح فالتيمم , وهذا على الترتيب .وإن كان مستوراً بما يسوغ ستره به , فليس فيه إلا المسح فقط ، فإن ضره المسح مع كونه مستوراً فيعدل إلى التيمم , كما لو كان مكشوفاً , هذا ما ذكره الفقهاء رحمهم الله “
“আলেমগণ (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেছেন:যখন কোনো জখম বা এজাতীয় কিছু থাকে, তখন তা হয় প্রকাশ্য (খোলা), নয়তো আবৃত (ঢাকা) থাকে। যদি তা খোলা থাকে তাহলে সেটিকে পানি দ্বারা ধোয়া ওয়াজিব।যদি পানি দিয়ে ধোয়া সম্ভব না হয়, তাহলে ঐ জখমের উপর মাসেহ করতে হবে। আর যদি মাসেহ করাও সম্ভব না হয়, তাহলে তায়াম্মুম করতে হবে। এগুলো একটি নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতার (ترتيب) ভিত্তিতে করা হবে।আর যদি জখমটি এমন কোনো বস্তু দিয়ে ঢাকা থাকে, যা দ্বারা ঢেকে রাখা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ, তাহলে এক্ষেত্রে কেবল মাসেহ করাই যথেষ্ট।কিন্তু যদি মাসেহ করাও ক্ষতির কারণ হয়, এমনকি সেটা ঢাকা অবস্থাতেও, তখন তায়াম্মুম করেই সন্তুষ্ট হতে হবে—যেমনটা খোলা থাকলে করতাম। এটাই ফুকাহাগণ (রহিমাহুমুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন।”(ইবনু উসাইমীন; আশ-শারহুল মুমতি খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৬৯)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:إن كان عليه جبيرة مسح عليها ، وإن كان مكشوفاً تيمم عنه “যদি সেখানে ব্যান্ডেজ বা প্লাস্টার থাকে, তাহলে তার ওপর মাসেহ করতে হবে।আর যদি খোলা থাকে (এবং ধোয়া/মাসেহ সম্ভব না হয়), তাহলে সেই অংশের জন্য তায়াম্মুম করতে হবে।”(ইমাম বিন বায; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ১১৮)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.]–কে জিজ্ঞাসা করা হয়:”ডাক্তার যখন আমার চিকিৎসা করছিলেন, তখন ইনজেকশন দেওয়ার পর আমার হাত থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। তাই তিনি একটি গজ (ব্যান্ডেজ) দিয়ে তা বেঁধে দেন। কিন্তু গজ খুললেই আবার রক্ত ঝরতে থাকে, এবং তা রাতভর বন্ধ হয় না। ফলে গজটি (ব্যান্ডেজ) হাতেই থেকে যায়। এখন আমার প্রশ্ন হলো, ওজুর সময় আমি কি এই ব্যান্ডেজের ওপর মাসেহ করতে পারবো? যদিও যখন এটি পরানো হয়েছিল, তখন আমি অযু অবস্থায় ছিলাম না; এবং কখনো কখনো ব্যান্ডেজের নিচে রক্তও লেগে থাকে। মাসেহ করার পদ্ধতিও জানতে চাই।
উত্তরে শাইখ বলেন:
” لا تنزع الشاشة التي ربطت على الجرح ، لا سيما إذا كان نزعها يَضُرُّ بك وينزف الدم ، ولا يجوز لك نزعها في هذه الحالة ؛ لأن في ذلك خطراً عليك ، فأَبْقها على وضعها ، وإذا توضأتَ تغسل الذي ليس عليه رباط من اليد ، وأما ما عليه رباط فيكفي أن تمسح على ظاهره بأن تبل يدك بالماء وتديرها على ظاهر الشاشة ، ويكفيك هذا عن غسل ما تحتها مدة بقائها لحاجة ولو عدة أوقات أو عدة أيام ، ولا يشترط أن توضع الشاشة على طهارة بل تمسح عليها على الصحيح ، ولو لم تكن عند وضعها على طهارة ، ولو كان تحتها دم على موضع الإبرة أو الجرح .
فالحاصل : أنه لا حرج عليك في أن تبقي الشاشة ، بل يتعين أن تبقيها للمصلحة ، وتمسح على ظاهرها عندما تغسل ما ظهر منها من اليد
“তুমি যেই পট্টি (ব্যান্ডেজ) জখমের ওপর বেঁধেছ, তা খুলবে না। বিশেষ করে যখন তা খোলা তোমার জন্য ক্ষতিকর এবং রক্ত ঝরার কারণ হয়। এই অবস্থায় তা খোলা তোমার জন্য বৈধ নয়, কেননা এতে তোমার জন্য ক্ষতি ও ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। অতএব,ব্যান্ডেজটি যেমন আছে, তেমনই রেখে দাও। যখন তুমি ওজু করবে, তখন হাতের যে অংশে ব্যান্ডেজ নেই, তা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলবে। আর যে অংশে ব্যান্ডেজ রয়েছে, তার ওপর ভেজা হাতে মাসেহ করাই যথেষ্ট হবে অর্থাৎ, হাত পানিতে ভিজিয়ে ব্যান্ডেজের ওপর হালকাভাবে হাত বুলিয়ে দেবে। এটাই যথেষ্ট হবে, এবং যতদিন প্রয়োজনবশত ব্যান্ডেজটি থাকবে, ততদিন এর ওপর মাসেহ করাই যথেষ্ট হবে—তা একাধিক ওজুর সময় হোক কিংবা একাধিক দিনের জন্য হোক।এক্ষেত্রে শর্ত নয় যে ব্যান্ডেজটি অবশ্যই ওজু অবস্থায় পরতে হবে। বরং বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী, ব্যান্ডেজ পরার সময় তুমি অযু অবস্থায় না থাকলেও তার ওপর মাসেহ বৈধ হবে এমনকি যদি ইনজেকশন বা জখমের স্থানে রক্ত লেগে থাকে।
সারসংক্ষেপ হল: তোমার জন্য ব্যান্ডেজ খোলা জরুরি নয়, বরং তা খোলা উচিতও নয়, কারণ তা তোমার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বরং তা রেখে দেওয়াই কর্তব্য। এরপর ওজুর সময় হাতের যে অংশ খোলা, তা ধুয়ে ফেলবে এবং ব্যান্ডেজে ঢাকা অংশে শুধু মাসেহ করবে।”(আল-মুনতাক্বা মিন ফাতাওয়াস শাইখ সালিহ আল-ফাওযান: খন্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১৫)
.
জেনে রাখা ভালো, অনেক মানুষই হাত-পা হারানোর কারণে কৃত্রিম অঙ্গ ব্যবহার করেন। ওযুর সময় এসব কৃত্রিম অঙ্গ ধোয়া আবশ্যক নয়, কেননা সেগুলো শরীরের প্রকৃত অংশ নয়।এ বিষয়ে ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.]–কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:আমার পা কেটে ফেলা হয়েছে। আলহামদু লিল্লাহ্। আমি এর বদলে একটি কৃত্রিম পা সংযোজন করেছি। এ পা ধৌত করা এবং মোজা পরা থাকলে এ পা মাসেহ করা কি আমার উপর আবশ্যক?
জবাবে শাইখ বলেন: “হাঁটু থেকে যদি পা কেটে ফেলা হয়, যার ফলে টাকনু ও পায়ের পাতা চলে যায় এর বদলে কৃত্রিম পায়ের পাতা লাগানো হয় সেক্ষেত্রে এ কৃত্রিম পা ধৌত করা আপনার উপর আবশ্যকীয় নয়। কর্তিত পা ধৌত করার দায়িত্ব আপনার থেকে রহিত। কৃত্রিম পায়ের উপর আপনি মাসেহ করবেন না। কিন্তু, যদি পায়ের টাকনুর নীচে কিছু অংশ অবশিষ্ট থাকে তাহলে সে অবশিষ্ট অংশ ধৌত করা আপনার উপর আবশ্যক। আপনি যদি সে অবশিষ্ট অংশের উপর কোন আচ্ছাদন যেমন চামড়ার মোজা বা কাপড়ের মোজা পরেন তাহলে আপনি সে অবশিষ্টাংশের উপর যে পরিধেয় রয়েছে সেটার উপর মাসেহ করবেন।”(শাইখ সালেহ আল-ফাওযানের ফতোয়াসমগ্র থেকে নির্বাচিত; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৬)।
▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
No comments:
Post a Comment