প্রশ্ন: মুহররম মাসের সিয়ামের ফযিলত কী? রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী এই মাসে কয়টি সিয়াম রাখা উত্তম এবং কোন কোন তারিখে সিয়াম রাখা উচিত?”
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ্র জন্য। আমাদের নবী, সর্বশেষ নবী, রাসূলদের সর্দার মুহাম্মদ ﷺ এর প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবায়ে কেরাম সকলের প্রতি আল্লাহ্র রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর আশূরা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। আশূরা নামটি উচ্চারিত হলেই অনেকের মনে কারবালার করুণ ঘটনা এবং হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাহাদত ভেসে ওঠে, যা শী‘আ সম্প্রদায়ের তাজিয়া ও মাতমের সাথে সম্পৃক্ত। অথচ প্রকৃতপক্ষে আশূরার এই শোকানুষ্ঠানের সাথে ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী কারবালার ঘটনার সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি,আশূরাকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন ধরণের আচার-আচরণ দেখা যায়—যেমন রয়েছে শরীয়তসম্মত কিছু ইবাদত ও স্মরণীয় ঘটনা, তেমনি রয়েছে অতিরঞ্জিত, বিদআতপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য কিছু কর্মকাণ্ডও। বিশেষত শী‘আ সম্প্রদায় আশূরার দিনটিকে ঘিরে তাজিয়া মিছিল, আতশবাজি, পটকাবাজি, এমনকি ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজের শরীর রক্তাক্ত করার মতো কার্যকলাপের আয়োজন করে থাকে, যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অথচ ইসলামে এই দিনটির রয়েছে বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব, যার প্রেক্ষিতে আমাদের জন্য রয়েছে কিছু করণীয় ইবাদত এবং কিছু বর্জনীয় বিদআত ও বাড়াবাড়ি। নিচে ইনশাআল্লাহ এই বিষয়ে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস থাকবে।
.
❑ (১).আশূরা কী? আশূরার দিন সিয়াম পালনের কারন কি?
.
আশূরা শব্দটির বিশ্লেষণ নিয়ে ভাষাবিদগণ বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। অধিকাংশের নিকট মুহাররম মাসের দশম তারিখই আশূরার দিন। এটা আরবী শব্দ (عشر) আশারা হতে নির্গত, যার অর্থ হলো দশ। সুতরাং হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররমের দশ তারিখকে আশূরা বা আশূরায়ে মুহাররম বলা হয়।আর আশূরার দিন সিয়াম পালনের কারন-আল্লাহর পক্ষ থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের অন্যতম ছিল ফেরাঊনের কওম। তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ তা‘আলা প্রেরণ করেছিলেন নবী মূসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর ভাই হারূন (আলাইহিস সালাম)-কে। তিনি তাদের কাছে নাযিল করেছিলেন আসমানী কিতাব তাওরাত। মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর জন্মের পূর্ব থেকেই ফেরাঊন বনী ইসরাঈলের উপর নানাভাবে অত্যাচার চালিয়ে আসছিল। পরবর্তীতে সে নিজেকে “ইলাহ” (প্রভু) দাবি করল এবং মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর অনুসারীদের উপর নির্যাতন আরও বেড়ে গেল। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে এক রাতে মূসা (আলাইহিস সালাম) তাঁর কওমসহ দেশত্যাগ করেন, পথে সমুদ্র তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তখন আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে তাঁর লাঠি দিয়ে সমুদ্রের উপর আঘাত করতে নির্দেশ দেন।তিনি আঘাত করলে সমুদ্র বিভক্ত হয়ে যায়, এবং প্রতিটি অংশ বিশাল পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে যায়, সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ফেরাঊন তাদের পিছনে ধাওয়া করল। আল্লাহ নবী মূসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর জাতিকে রক্ষা করলেন আর ফেরাঊন ও তার জাতিকে পানিতে নিমজ্জিত করে ধ্বংস করলেন। এই মহান দিনটি ছিল মুহাররম মাসের দশ তারিখ তথা আশূরার দিন। ইহুদীরা এই দিনকে সম্মান করত ও গুরুত্ব দিত।অতঃপর এই ঐতিহাসিক মুক্তির স্মৃতিতে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে মূসা (আলাইহিস সালাম) সেদিন (১০ মুহাররম) রোজা রেখেছিলেন।আর সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা থেকে মদিনায় আগমন করেন, তখন তিনি এ ঘটনা শুনতে পান। যেমন ইবনু আব্বাস (রযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় এসে ইয়াহূদীদের দেখতে পেলেন যে, তারা আশূরার সিয়াম পালন করছে। তিনি বললেন, এটা কী? তারা বলল, ‘এটা একটা ভালো দিন, এটা এমন একদিন, যেদিন আল্লাহ বানূ ইসরাঈলকে তাদের শত্রুদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। সুতরাং মূসা আলাইহিস সালাম এই দিন সিয়াম পালন করেছেন’। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের চেয়ে মূসা আলাইহিস সালাম-এর ব্যাপারে অধিক হক্বদার’। এরপর তিনি নিজে এই সিয়াম পালন করেন এবং সাহাবীদেরকেও সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন।”(সহীহ বুখারী, হা/২০০৪; ঘটনাগুলো বিস্তারিত জানতে দেখুন; সূরা ত্বা-হা: ৭৭; সূরা শু‘আরা ৫২ ও ৬৩ ,সূরা বাক্বারাহ: ৫০; সূরা ইউনুস: ৯০-৯১)।
.
❑ (২) আশূরার সিয়ামের হুকুম এবং ফজিলত কি?
.
ইসলামের পূর্বযুগ হতেই আশুরার সিয়ামের প্রচলন ছিল। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে তা উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। রামাযানের সিয়াম ফরয হওয়ার পূর্বে তার হুকুম সম্পর্কে বিদ্বানগণ বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। কেউ ওয়াজিব বলেছেন, আবার কেউ সুন্নাত বলেছেন। তবে রমাদানের সিয়াম ফরজ হওয়ার পর আশুরার সিয়াম সকলের ইজমা তথা ঐকমত্যে সুন্নাহ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এ সিয়াম রেখেছেন এবং সাহাবীদের রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে—আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, কুরায়শরা জাহেলী যুগে আশূরার দিন সিয়াম পালন করত। এসময় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ দিনে সিয়াম রেখেছেন। অতঃপর তিনি যখন মদীনায় আসেন, তখনও (প্রথমত) তিনি নিজে এ সিয়াম পালন করেন এবং সাহাবীদের তা পালন করার হুকুম দেন। তারপর যখন রামাযানের সিয়াম ফরয হয়, তখন তিনি আশূরার সিয়াম ছেড়ে দেন। অতঃপর যার ইচ্ছা সে তা রাখত আর যার ইচ্ছা সে তা ছেড়ে দিত”।(সহীহ বুখারী, হা/২০০২; মিশকাত, হা/২০৬৯ ‘সিয়াম’ অধ্যায়, ‘নফল সিয়াম’ অনুচ্ছেদ-৬) আর আশূরার সিয়াম বড় ফযীলতপূর্ণ।কেননা হাদীসে এসেছে—উবায়দুল্লাহ ইবনে আবূ ইয়াযীদ রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা-কে আশূরার দিনে সওম পালন করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এ দিন ব্যতীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো দিনকে অন্য দিনের তুলনায় উত্তম মনে করে সেদিনে সওম পালন করেছেন বলে আমার জানা নেই। অনুরূপভাবে রামাযান ব্যতীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো মাসকে অন্য মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করে সওম পালন করেছেন বলেও আমার জানা নেই।”(সহীহ মুসলিম, হা/১১৩২) আশুরার একটি সিয়াম বিগত এক বছরের সগীরা গুনাহ মোচন করে। দলিল হচ্ছে,রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ ‘আশূরার দিনের সওমের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা আগের বছরের গুনাহ মোচন করে দিবেন”।(সহীহ মুসলিম, হা/১১৬২; মিশকাত, হা/২০৪৪) এটি আমাদের উপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ একদিনের রোজার মাধ্যমে বিগত বছরের সকল সগীরা গুনাহ মার্জনা হয়ে যাবে।নিশ্চয় আল্লাহ মহান অনুগ্রহকারী।আশুরার রোজার মহান মর্যাদার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি এ রোজার ব্যাপারে খুব আগ্রহী থাকতেন।আর আশুরার রোজা দ্বারা শুধু সগিরা গুনাহ মার্জনা হবে। কবিরা গুনাহ বিশেষ তওবা ছাড়া মোচন হয় না।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,
يُكَفِّرُ (صيام يوم عرفة) كُلَّ الذُّنُوبِ الصَّغَائِرِ , وَتَقْدِيرُهُ يَغْفِرُ ذُنُوبَهُ كُلَّهَا إلا الْكَبَائِرَ.ثم قال رحمه الله: صَوْمُ يَوْمِ عَرَفَةَ كَفَّارَةُ سَنَتَيْنِ , وَيَوْمُ عَاشُورَاءَ كَفَّارَةُ سَنَةٍ , وَإِذَا وَافَقَ تَأْمِينُهُ تَأْمِينَ الْمَلائِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ… كُلُّ وَاحِدٍ مِنْ هَذِهِ الْمَذْكُورَاتِ صَالِحٌ لِلتَّكْفِيرِ فَإِنْ وَجَدَ مَا يُكَفِّرُهُ مِنْ الصَّغَائِرِ كَفَّرَهُ , وَإِنْ لَمْ يُصَادِفْ صَغِيرَةً وَلا كَبِيرَةً كُتِبَتْ بِهِ حَسَنَاتٌ وَرُفِعَتْ لَهُ بِهِ دَرَجَاتٌ ,.. وَإِنْ صَادَفَ كَبِيرَةً أَوْ كَبَائِرَ وَلَمْ يُصَادِفْ صَغَائِرَ , رَجَوْنَا أَنْ تُخَفِّفَ مِنْ الْكَبَائِرِ.
“আশুরার রোজা সকল সগিরা গুনাহ মোচন করে। হাদিসের বাণীর মর্ম রূপ হচ্ছে- কবিরা গুনাহ ছাড়া সকল গুনাহমোচন করে দেয়।এরপর তিনি আরও বলেন: আরাফার রোজা দুই বছরের গুনাহ মোচন করে। আর আশুরার রোজা এক বছরের গুনাহ মোচন করে। মুক্তাদির আমীন বলা যদি ফেরেশতাদের আমীন বলার সাথে মিলে যায় তাহলে পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়…উল্লেখিত আমলগুলোর মাধ্যমে পাপ মোচন হয়। যদি বান্দার সগিরা গুনাহ থাকে তাহলে সগিরা গুনাহ মোচন করে। যদি সগিরা বা কবিরা কোন গুনাহ না থাকে তাহলে তার আমলনামায় নেকি লেখা হয় এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়।…যদি কবিরা গুনাহ থাকে, সগিরা গুনাহ না থাকে তাহলে কবিরা গুনাহকে কিছুটা হালকা করার আশা করতে পারি।”(আল-মাজমু শারহুল মুহাযযাব, খণ্ড-৬) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: وَتَكْفِيرُ الطَّهَارَةِ، وَالصَّلاةِ، وَصِيَامِ رَمَضَانَ، وَعَرَفَةَ، وَعَاشُورَاءَ لِلصَّغَائِرِ فَقَطْ “পবিত্রতা অর্জন, সলাত আদায়, রমজানের সিয়াম রাখা, আরাফার দিন সিয়াম রাখা, আশুরার দিন সিয়াম রাখা ইত্যাদির মাধ্যমে শুধু সগিরা গুনাহ মোচন হয়।”(আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা, খণ্ড-৫)
.
❑ (৩) আশূরার সিয়ামের সংখ্যা কতটি এবং কোনদিন রাখতে হবে?
.
“আশুরার সিয়াম কোন দুইদিন রাখা উচিত; এই বিষয়ে আশুরার সিয়াম সংক্রান্ত হাদীসগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, তা তিনটি পন্থায় পালন করার কথা এসেছে।
✿ প্রথমত সর্বোত্তম এবং সুন্নাহ পদ্ধতি হলো,আশুরার আগের দিন (৯ তারিখ) ও আশুরার দিন (১০ তারিখে) সিয়াম রাখা। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১০ তারিখে সিয়াম রেখেছেন এবং ৯ তারিখে সিয়াম রাখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।
.
✿ দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো, অনিচ্ছায় যদি কারো ৯ তারিখের সিয়াম ছুটে যায় তাহলে একদল আলেমদের মতে ১০ এবং ১১ তারিখে রাখা যেতে পারে। যদিও এই মর্মে বর্নিত হাদিসটি দুর্বল তবুও একদল আলেম বলেন ১১ তারিখে সিয়াম রাখা সংক্রান্ত হাদীসটি মারফূ সূত্রে জয়ীফ হলেও মওকুফ সূত্রে সহীহ হিসেবে মুহররম মাসের ১১ তারিখে সিয়াম রাখা মুস্তাহাব।
✿ তৃতীয় পদ্ধতি হলো ৯ তারিখ রাখতে না পারলে অন্তত আশুরার দিন (১০ তারিখে) সিয়াম রাখা। শুধু আশুরার দিন সিয়াম রাখাও জায়েয; যদিও একদল আলেম মাখরুহ বলেছেন তবে শুধু আশুরার দিন (১০ তারিখ সিয়াম পালন করা যাবে এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে উত্তম হলো দুইটি সিয়াম রাখা। অর্থাৎ আশুরার দিন এবং এর আগের দিন তথা ৯ তারিখ।
.
প্রথম পদ্ধতি অনুযায়ী অর্থাৎ মহররম মাসের ৯ এবং ১০ তারিখে সিয়াম পালন করা সর্বোত্তম। এই মর্মে দলিল হচ্ছে,যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] বর্ণনা করেন যে,তিনি বলেন: حِينَ صَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ قَالَ فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتَّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.”যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার সিয়াম রাখলেন এবং সিয়াম পালন করার নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবীরা বলল: ইয়া রাসূলুল্লাহ্! এই দিনকে তো ইহুদী-নাসারারা মর্যাদা দিয়ে থাকে। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ইন্শাআল্লাহ্; আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সিয়াম রাখব। তিনি বলেন: আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা গেলেন।”(সহিহ মুসলিম হা/১৯১৬)
.
উক্ত হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম নাসিরুল হাদীস ফাক্বীহুল মিল্লাত ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফি‘ঈ আল-মাক্কী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২০৪ হি.] ও তাঁর অনুসারীরা, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মহান ইমাম, শাইখুল ইসলাম আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল আশ-শাইবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত্যু ২৪১ হি./৮৫৫ খ্রি.] ইমাম ইসহাক প্রমুখ (রাহিমাহুল্লাহ) আলেমগণ বলেন:يستحب صوم التاسع والعاشر جميعا؛ لأن النبي صلى الله عليه وسلم صام العاشر، ونوى صيام التاسع. ৯ তারিখ ও ১০ তারিখ উভয় দিন সিয়াম রাখা মুস্তাহাব। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১০ তারিখে সিয়াম রেখেছেন এবং ৯ তারিখে সিয়াম পালন করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন”। সুতরাং এ আলোচনার প্রেক্ষিতে আশুরার সিয়াম রাখার একাধিক স্তর রয়েছে। সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে- শুধু ১০ তারিখে সিয়াম পালন করা। এর উপরের স্তর হচ্ছে- ৯ তারিখের সাথে অন্য একদিনও সিয়াম রাখা। আর মুহররম মাসে যতবেশি সিয়াম রাখা যায় তত উত্তম ও ভাল।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২১৭৮৫)
.
এখন যদি কেউ বলেন যে, ১০ তারিখের সাথে ৯ তারিখ সিয়াম রাখার গূঢ় রহস্য কী?
.
উক্ত প্রশ্নের জবাব সম্পর্কে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,
ذَكَرَ الْعُلَمَاءُ مِنْ أَصْحَابِنَا وَغَيْرِهِمْ فِي حِكْمَةِ اسْتِحْبَابِ صَوْمِ تَاسُوعَاءَ أَوْجُهًا:
• ( أَحَدُهَا) أَنَّ الْمُرَادَ مِنْهُ مُخَالَفَةُ الْيَهُودِ فِي اقْتِصَارِهِمْ عَلَى الْعَاشِرِ , وَهُوَ مَرْوِيٌّ عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ..
• ( الثَّانِي) أَنَّ الْمُرَادَ بِهِ وَصْلُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ بِصَوْمٍ، كَمَا نَهَى أَنْ يُصَامَ يَوْمُ الْجُمُعَةِ وَحْدَهُ..
( الثَّالِثَ) الاحْتِيَاطُ فِي صَوْمِ الْعَاشِرِ خَشْيَةَ نَقْصِ الْهِلالِ، وَوُقُوعِ غَلَطٍ فَيَكُونُ التَّاسِعُ فِي الْعَدَدِ هُوَ الْعَاشِرُ فِي نَفْسِ الأَمْرِ.
“আমাদের মাযহাবের আলেমগণ ও অন্যান্য আলেমগণ ৯ তারিখে সিয়াম রাখার গূঢ় রহস্য সম্পর্কিত কয়েকটি দিক উল্লেখ করেছেন:
(১). এর পিছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে- ইহুদীদের সাথে পার্থক্য তৈরী করা। যেহেতু তারা শুধু ১০ তারিখে সিয়াম রাখে। এটি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত।
(২). আশুরার দিনের সাথে আরও একটি সিয়ামকে মিলানো। যেমনটি এককভাবে শুধু জুমার দিন রোযা রাখা থেকে নিষেধ করা হয়েছে।
(৩)। দশ তারিখের সিয়ামটির ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা এই আশংকায় যে, চাঁদের হিসাবে কমতি হতে পারে, ভুল হতে পারে। তখন হিসাবে যেদিনই ৯ তারিখ বাস্তবে সেই দিন ১০ তারিখ হবে।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং – ২১৭৮৫)
.
.
সুতরাং উল্লেখিত এ দিকগুলোর মধ্যে আহলে কিতাবদের সাথে পার্থক্য তৈরা করা এটি সবচেয়ে মজবুত। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:نَهَى صلى الله عليه وسلم عَنْ التَّشَبُّهِ بِأَهْلِ الْكِتَابِ فِي أَحَادِيثَ كَثِيرَةٍ مِثْلُ قَوْلِهِ.. فِي عَاشُورَاءَ: لَئِنْ عِشْتُ إلَى قَابِلٍ لأَصُومَنَّ التَّاسِعَ.”নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক হাদিসে আহলে কিতাবদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করা থেকে বারণ করেছেন। যেমন, আশুরার ব্যাপারে তাঁর বাণী: “যদি আমি আগামী বছর বাঁচি তাহলে অবশ্যই ৯ তারিখে সিয়াম রাখব।”(আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা; খণ্ড-০৫) শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ,হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] “যদি আমি আগামী বছর বাঁচি তাহলে অবশ্যই ৯ তারিখে সিয়াম রাখব।” এই হাদিসের উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:”ما همّ به من صوم التاسع يُحتمل معناه أن لا يقتصر عليه بل يُضيفه إلى اليوم العاشر إما احتياطاً له وإما مخالفةً لليهود والنصارى وهو الأرجح وبه يُشعر بعض روايات مسلم.”তিনি যে, ৯ তারিখে সিয়াম রাখার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন এর ব্যাখ্যা হচ্ছে- শুধু ৯ তারিখে সিয়াম রাখা নয়; বরং ১০ তারিখের সাথে ৯ তারিখেও সিয়াম রাখা; সতর্কতামূলক কিংবা ইহুদি-নাসারাদের বিরুদ্ধাচারণমূলক। শেষোক্ত কারণটি অগ্রগণ্য। সহিহ মুসলিমের কিছু রেওয়ায়েত থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায়”(ফাতহুল বারী ফী শারহিল বুখারী, খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৪৫)
.

তাহক্বীক: মুহাদ্দিস, আলেমগণ মুসনাদে আহমেদের এ হাদিসের শুদ্ধতা নিয়ে মতভেদ করেছেন। শাইখ আহমাদ শাকের (রাহিমাহুল্লাহ) হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। আর মুসনাদ গ্রন্থের মুহাক্কিকগণ হাদিসটিকে ‘যয়ীফ’ (দুর্বল) বলেছেন। এ হাদিসটি ইবনে খুযাইমাও এই ভাষায় বর্ণনা করেছেন। বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন: “إسناده ضعيف، لسوء حفظ ابن أبي ليلى، وخال عطاء وغيره فرواه عن ابن عباس موقوفاً، وسنده صحيح عند الطحاوي والبيهقي “ইবনে আবি লাইলা নামক বর্ণনাকারীর মুখস্তশক্তির দুর্বলতার কারণে হাদিসটির সনদ ‘যয়ীফ’। বর্ণনাকারী ‘আতা’ তার সাথে মতভেদ করেছেন এবং তিনি হাদিসটিকে ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর উক্তি (মাওকুফ) হিসেবে বর্ণনা করেছেন।তাহাবী ও বাইহাকী কর্তৃক সংকলিত সে সনদটি সহিহ।(সহীহ ইবনে খুযাইমাহ হা/২০৯৫ টীকা দ্রঃ)
.
সুতরাং যদি এ হাদিসটির সনদ ‘হাসান’ পর্যায়ের হয় তাহলে তো ভাল। আর যদি হাদিসটি ‘যয়ীফ’ হয় তাহলে এমন ক্ষেত্রে কিছু আলেমগণ সহনশীলতা অবলম্বন করেন। কেননা হাদিসটির দুর্বলতা যৎসামান্য। তারা বলেন, যেহেতু হাদিসটি মিথ্যা বা বানোয়াট নয়। এবং যেহেতু হাদিসটি ফাযায়েলে আমল এর ক্ষেত্রে। বিশেষত; যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মুহররম মাসে সিয়াম রাখার ব্যাপারে উৎসাহমূলক বর্ণনা এসেছে। এমনকি আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:” أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ ” .“রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম সিয়াম হচ্ছে- আল্লাহর মাস ‘মুহররম’ এর সিয়াম । আর ফরজ সলাতের পর সবচেয়ে উত্তম সলাত হচ্ছে- রাত্রিকালীন সলাত ।”(সহিহ মুসলিম হা/১১৬৩) উক্ত হাদিসে: ‘আল্লাহর মাস’ বলে মাসকে আল্লাহর সাথে সম্বন্ধিত করা হয়েছে মাসটির মর্যাদা তুলে ধরতে। আল-ক্বারী বলেন: হাদিস থেকে বাহ্যতঃ মনে হচ্ছে- গোটা মুহররম মাস (সিয়াম রাখা) উদ্দেশ্য। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি রমজান ছাড়া আর কোন মাসের গোটা সময় সিয়াম রাখেননি। তাই এ হাদিসের এ অর্থ গ্রহণ করতে হবে যে, মুহররম মাসে অধিক সিয়াম রাখার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে; গোটা মাস সিয়াম রাখা নয়।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২১৩১১)
.
কোনো কোননো আলেম ১১ তারিখে সিয়াম রাখা মুস্তাহাব হওয়ার আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তা হচ্ছে- ১০ তারিখের সিয়ামটির ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা। কারণ হতে পারে লোকেরা মুহররম মাসের চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে ভুল করে থাকবে। যার কারণে সুনির্দিষ্টভাবে কোন দিনটি ১০ তারিখ সেটা হয়তো জানা যাবে না। তাই মুসলিম ব্যক্তি যদি ৯ তারিখ ও ১১ তারিখ সিয়াম রাখে তাহলে নিশ্চিতভাবে তার আশুরা (১০ তারিখ) এর রোযা সিয়াম হল। ইবনে আবু শাইবা তাঁর ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে (২/৩১৩) তাউস (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি আশুরার আগে এক দিন ও পরে একদিন সিয়াম রাখতেন; ছুটে যাওয়ার ভয় থেকে।ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্ভল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “من أراد أن يصوم عاشوراء صام التاسع والعاشر إلا أن تشكل الشهور فيصوم ثلاثة أيام، ابن سيرين يقول ذلك” “যে ব্যক্তি আশুরার সিয়াম রাখতে চায় সে যেন ৯ তারিখ ও ১০ তারিখ সিয়াম রাখে। তবে মাসগুলো নিয়ে কোন অনিশ্চয়তা থাকলে তাহলে তিনদিন সিয়াম রাখবে। ইবনে সিরিন এই অভিমত ব্যক্ত করতেন।”(ইবনে কুদামাহ,আল-মুগনি; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৪৪১)
পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে ফুটে উঠল যে, ইমাম আহমেদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বক্তব্য অনুযায়ী তিন দিন সিয়াম রাখাকে বিদআত বলা ঠিক হবে না। যদিও জমহুর আলেমগন বিদআত বলেছেন।
.

.
পরিশেষে, উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা যে শিক্ষা নিব সেটা হচ্ছে- আল্লাহর মাস মহররম হারাম মাস হিসেবে তাকে সম্মান করা, আশুরায়ে মুহাররমের ২ দিন সিয়াম পালন করা, সিয়ামের নিয়ত অবশ্যই নাজাতে মূসা উপলক্ষে হওয়া, সিয়াম ৯-১০ রাখায় উত্তম তবে ৯ তারিখ অনিচ্ছাকৃত মিস হয়ে গেলে কারো মতে ১০-১১ তারিখও রাখা যেতে পারে, তবে আমরা বলবো ৯ এবং ১০ তারিখেই সিয়াম রাখুন কেননা এটাই সুন্নাহ। এখানে একটি বিষয় ভালো ভাবে মনে রাখবেন: আশুরার সিয়াম কিন্ত একদিন। সেটি হলো: মুহাররামের ১০ তারিখ।এর আগের দিন বা পরের দিনের সিয়াম সাধারণ নফলের নিয়তে রাখতে হবে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন এবং সৎ আমলগুলো কবুল করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
No comments:
Post a Comment