Saturday, July 19, 2025

ইয়াযিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং ইয়াযিদ সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহর সঠিক ও গ্রহণযোগ্য মানহাজ

 প্রশ্ন: ইয়াযিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়? ইয়াযিদ ইবনু মু‘আবিয়া সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহর সঠিক ও গ্রহণযোগ্য মানহাজ (পন্থা) কী?

▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি। অতঃপর ইয়াযিদের পরিপূর্ণ নাম হল “ইয়াযিদ ইবনে মু’য়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান ইবনে হারব ইবনে উমাইয়া আল-উমাবি আল-দিমাশকি” [জন্ম: ২৭ হি: মৃত্যু: ৬৪ হি.] তিনি তাবেঈ ছিলেন। তিনি উসমান ইবনু আফফান (রাদিয়াল্লহু আনহু) এর খেলাফতের সময় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ধার্মিকতা বা সালেহ হওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন না, আবার কাফের কিংবা মুনাফিকও ছিলেন না; তিনি ছিলেন অন্যান্য মুসলীম যুবকদেরই একজন। মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) যাকে নিজের পরে খিলাফতের উত্তরসূরি নির্ধারণ করেন, সে-ই তাঁর পুত্র ইয়াযিদ। ৬০ হিজরি, রজব মাসে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইন্তিকালের পর মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ইয়াযিদ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন। তাঁর বায়‘আত কারও কাছে গ্রহণযোগ্য, আবার কারও কাছে অগ্রহণযোগ্য এই মতবিরোধের পরিবেশেই তিনি ক্ষমতায় আসেন। সাহস ও দানশীলতাই ছিল তাঁর বড় গুণ; আর তাঁর বিরোধীরা তার সম্পর্কে প্রকাশ্যে গোনাহ করার সে সকল অভিযোগ উত্থাপন করেন, তার অধিকাংশই বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়।তার শাসনামল ছিল প্রায় চার বছর আর এই চার বছরেরও কম সময় স্থায়ী ইয়াযিদের শাসনামলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বেদনাদায়ক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, যার অন্যতম হলো হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর শাহাদাত। বিভিন্ন দলিল প্রমাণের আলোকে এ বিষয়ে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) কে ইয়াযিদ সরাসরি হত্যার নির্দেশ দেননি, সেই মর্মান্তিক ঘটনায় আনন্দও প্রকাশ করেননি, এমনকি হুসাইন (রাদিয়াল্লহু আনহু) এর কাটা মস্তক শামে পাঠানো সম্পর্কেও কোনো গ্রহণযোগ্য সূত্র নেই। তিনি কেবল তাঁর গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যেভাবেই হোক হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কে ক্ষমতা গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হলেেও। দুঃখজনকভাবে, গভর্নর ও সেনাপতিরা সেই নির্দেশের সীমা লঙ্ঘন করেন; বিশেষত শিমর ইবন যিল-জাওশন ও উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ হুসাইনের বিরুদ্ধে আক্রমণকে উসকে দেন। যখন উবায়দুল্লাহ অন্যায়ভাবে অগ্রাসন চালায়, হুসাইন (রাদিয়াল্লহু আনহু) তাঁদের সামনে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেন: (১) আমি নিজে ইয়াযিদের কাছে যেতে চাই, (২) সীমান্তে জিহাদে অংশ নিই, বা (৩) মক্কায় ফিরে যাই। তারা কোনটিই মেনে নেয়নি; বরং উল্টো শর্ত দিয়েছিল—বন্দি হতে হবে। অতঃপর উমর ইবনু সা‘দকে নেতৃত্বে রেখে যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং ফলস্বরূপ হুসাইন (রদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও তাঁর পরিবারের একদল মজলুম সদস্য শহীদ হন। হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-র শাহাদাতের মাধ্যমে ইয়াযিদের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব শুরু হয় এবং হাররার যুদ্ধের দ্বারা তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ইয়াযিদ যদিও হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন না তবুও তিনি এ হত্যাকাণ্ডের প্রকাশ্য নিন্দা করেননি বা কিসাস আদায়ের উদ্যোগ নেননি যা তাঁর ওপর ফরজ ছিল এই গাফলতির কারণে সত্যনিষ্ঠ ও ইনসাফ প্রিয় সালাফগন তাঁকে এ ফরয ত্যাগের জন্য তিরস্কার করেছেন; পাশাপাশি অন্যান্য নানা দোষও তাঁর প্রতি আরোপ করেছেন।তবে তার বিরোধীরা এর চেয়েও বড় বড় অপবাদ জুড়েছে ও বহু মিথ্যাচার ছড়িয়েছে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইবনু তাইমিয়াহ, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৫০; ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪১০-৪১৩; আল-ইরশাদ নিলমুদীদ পৃষ্ঠা: ২৪১)
.
◾ ইয়াযিদ ইবনু মু‘আবিয়া সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহর সঠিক ও গ্রহণযোগ্য মানহাজ (পন্থা) কী?
.
ইয়াযিদ ইবনু মু‘আবিয়াকে ঘিরে মুসলিম জগতে সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণে বহু ঘটনার প্রচলন রয়েছে, যার ফলে তাঁকে নিয়ে অতিরঞ্জন ও অবিচারের মধ্য দিয়ে এক ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করা একান্ত প্রয়োজন।তার ভালো খারাপ কর্মকান্ডের কারণে আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল-জামাআহের শীর্ষ আলেমগণ বলেছেন ইয়াযিদ এমন সব লোকদের মধ্যে একজন যাদেরকে আমরা গালাগালিও করব না আবার ভালোও বাসবো না। সে মুসলিম শাসকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।উমাইয়া ও আব্বাসী শাসনে এবং অন্যান্য যুগেও তার মত বা তার চেয়েও জঘন্য শাসক বিদ্যমান ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর মাত্র ঊনচল্লিশ বছর পরে অনেক যোগ্য সাহাবী জীবিত থাকা সত্বেও তিনি জোরপূর্বক শাসনভার গ্রহণ করায় তার ব্যাপারে এত সমালোচনা।ইতিহাসে দেখা যায় সে সময় আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) সহ অনেক সাহাবী জীবিত ছিলেন। অথচ আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) ইয়াযিদ ও তার বাপ-দাদার তুলনায় মুসলমানের আমির হওয়া অধিক যোগ্য ছিলেন।ইয়াযিদ কনস্টান্টিনোপলের যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন। সে যুদ্ধে আবূ আইয়ুব আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মত বিজ্ঞ সাহাবীও উপস্থিত ছিলেন।
.
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) ইয়াযিদ ইবন মু‘আবিয়া সম্পর্কে বলেন:
افترق الناس في يزيد بن معاوية بن أبى سفيان ثلاث فرق ، طرفان ووسط .فأحد الطرفين قالوا : إنه كان كافراً منافقاً ، وأنه سعى في قتل سبط رسول الله تشفِّياً من رسول الله وانتقاما منه ، وأخذاً بثأر جده عتبة وأخي جده شيبة ، وخاله الوليد بن عتبة وغيرهم ممن قتلهم أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم بيد على بن أبى طالب وغيره يوم بدر وغيرها . وأشياء من هذا النمط وهذا القول سهل على الرافضة الذين يكفرون أبا بكر وعمر وعثمان فتكفير يزيد أسهل بكثير .
والطرف الثاني : يظنون أنه كان رجلًا صالحاً وإمام عدل ، وأنه كان من الصحابة الذين ولدوا على عهد النبي وحمله على يديه وبرَّك عليه . وربما فضَّله بعضهم على أبى بكر وعمر ، وربما جعله بعضهم نبيَّا …
وكلا القولين ظاهر البطلان عند من له أدنى عقل وعلم بالأمور وسِيَر المتقدمين ، ولهذا لا ينسب إلى أحد من أهل العلم المعروفين بالسنة ولا إلى ذي عقل من العقلاء الذين لهم رأى وخبرة
والقول الثالث : أنه كان ملكا من ملوك المسلمين له حسنات وسيئات ولم يولد إلا في خلافة عثمان ، ولم يكن كافرا ، ولكن جرى بسببه ما جرى من مصرع الحسين وفعل ما فعل بأهل الحرة ، ولم يكن صاحبا ولا من أولياء الله الصالحين ، وهذا قول عامة أهل العقل والعلم والسنة والجماعة .
ثم افترقوا ثلاث فرق فرقة لعنته وفرقة أحبته وفرقة لا تسبه ولا تحبه وهذا هو المنصوص عن الإمام أحمد وعليه المقتصدون من أصحابه وغيرهم من جميع المسلمين قال صالح بن أحمد قلت لأبي : إن قوما يقولون : إنهم يحبون يزيد فقال يا بني وهل يحب يزيد أحدٌ يؤمن بالله واليوم الآخر !! فقلت يا أبت فلماذا لا تلعنه ؟ فقال : يا بني ومتى رأيت أباك يلعن أحداً .
وقال أبو محمد المقدسي لما سئل عن يزيد فيما بلغني لا يُسَب ولا يُحَب وقال : وبلغنى أيضا أن جدنا أبا عبد الله بن تيمية سئل عن يزيد فقال : لاننقص فيه ولا نزيد وهذا أعدل الأقوال فيه وفي أمثاله وأحسنها..
“ইয়াযিদ সম্পর্কে মানুষ তিনভাগে বিভক্ত: দু’দল অতি বাড়াবাড়ি করে আরেকদল মধ্যপন্থী। সীমাহীন বাড়াবাড়ি দলের প্রথম একদল মনে করেন, তিনি কাফির ও মুনাফিক ছিলেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রতিশোধ নিতে সর্বদা প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেন। তার মধ্যে দাদা ‘উতবা, দাদার ভাই শাইবা, খালু ওয়ালিদ ইবন উতবা ও অন্যান্য যাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও অন্যান্যরা বদরের যুদ্ধে হত্যা করেছিল সে হত্যার প্রতিশোধ নিতে সর্বদা কাজ করত। এ ধরণের আক্বিদা শিয়া (রাফেদী) সম্প্রদায়ের লোকেরা পোষণ করে থাকে। এ শিয়ারা [যারা বর্তমানে ইরান-ইরাকে ক্ষমতাশীল, তারা] আবূ বকর, উমর ও উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের মতো সাহাবীদেরকে কাফির বলে থাকেন। সুতরাং ইয়াযিদকে কাফির বলা তাদের জন্য আরো অধিক সহজ।
.
দ্বিতীয় সীমালঙ্ঘনকারী দল মনে করেন তিনি একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ইমাম ছিলেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কোলে নিয়েছেন ও তার জন্য বরকতের দো‘আ করেছেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ তাকে আবূ বকর ও ‘উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার উপরে মর্যাদা দিয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ তাকে নবী পর্যন্ত বলে থাকেন। [যার অনুসারীরা বর্তমানে ইয়াযিদিয়্যাহ ফির্কা নামে ইরাকে বিখ্যাত] যাদের সামান্য আক্বল, জ্ঞান ও পূর্বসূরীদের সম্পর্কে ধারণা আছে তারা সবাই জানেন যে, এ দু’দলই গোমরাহ ও বাতিল আক্বিদা পোষণকারী। এ কারণেই যাদের সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞান আছে ও জ্ঞানী গুণীগণ এ ধরণের মত পোষণ করেন না।
.
তৃতীয় দল: তারা মনে করেন যে, তিনি মুসলিম রাজা-বাদশাহদের একজন, তার দোষ-গুণ দু’টোই ছিল। তিনি উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর খিলাফতকালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কাফির ছিলেন না। তবে তার কারণেই হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু শহীদ হন এবং মাদীনার আহলে হাররার সাথে যা ঘটেছিল তার জন্য তিনিই দায়ী। তিনি সাহাবী বা আল্লাহর অলী ছিলেন না। এটা আক্বল, ইলম, সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞাত ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সর্বসম্মত রায়।
.
আহলে সুন্নাত তার ব্যাপারে আবার তিন দলে বিভক্ত। কেউ তাকে লা‘নত দিয়ে থাকে। আবার কেউ তাকে গালিও দেন না আবার ভালও বাসেন না। এটা ইমাম আহমদ (রাহিমাহুল্লাহ) এর মত। এ রায়ের সাথে তার অনুসারী ও অন্যান্য অধিকাংশ মুসলমান একমত পোষণ করেছেন। ইমাম আহমদ রহ. এর ছেলে সালিহ একদা পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, কতিপয় লোক বলছে যে, তারা ইয়াযিদকে ভালবাসে। তখন তিনি বললেন, হে প্রিয় বৎস! যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে সে কি তাকে ভাল বাসতে পারে? তখন তিনি (ছেলে) বললেন, হে পিতা তাহলে আপনি কেন তাকে লা‘নত দেন না? তিনি বললেন, হে প্রিয় বৎস! তুমি কি কখনও তোমার বাবাকে কাউকে লা‘নত দিতে দেখেছ? আবূ মুহাম্মদ মাকদিসী (রাহিমাহুল্লাহ) কে ইয়াযিদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমার কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, তাকে গাল মন্দও করা যাবে না আবার ভালোও বাসা যাবে না। আমার কাছে আরো সংবাদ পৌঁছেছে যে, আমার পূর্বপুরুষ আবূ আব্দুল্লাহ ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. কে ইয়াযিদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছেন, আমরা তার সম্পর্কে বেশি বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ি কোনোটাই করব না। এটাই ন্যায় সঙ্গত ও উত্তম কথা।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ, লমাজমূঊ ফাতাওয়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৮১-৪৮৪; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৪০০৭)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,
وأما يزيد بن معاوية فالناس فيه طرفان ووسط، وأعدل الأقوال الثلاثة فيه أنه كان ملكًا من ملوك المسلمين له حسنات وسيئات ولم يولد إلاَّ في خلافة عثمان رضي الله عنه، ولم يكن كافرًا ولكن جرى بسببه ما جرى من مصرع الحسين وفعل ما فعل بأهل الحرة، ولم يكن صاحبًا ولا من أولياء الله الصالحين. قال شيخ الإِسلام ابن تيمية رحمه الله : وهذا قول عامة أهل العقل والعلم والسنة والجماعة، وأما بالنسبة للعنه فالناس فيه ثلاث فرق: فرقة لعنته، وفرقة أحبته، وفرقة لا تسبه ولا تحبه، قال شيخ الإِسلام ابن تيمية رحمه الله تعالى: وهذا هو المنصوص عن الإِمام أحمد وعليه المقتصدون من أصحابه وغيرهم من جميع المسلمين، وهذا القول الوسط مبني على أنه لم يثبت فسقه الذي يقتضي لعنه أو بناء على أن الفاسق المعين لا يلعن بخصوصه إما تحريمًا وإما تنزيهًا، فقد ثبت في [ صحيح البخاري ] عن عمر في قصة عبد الله بن حمار الذي تكرر منه شرب الخمر وجلده رسول الله صلى الله عليه وسلم لما لعنه بعض الصحابة قال النبي صلى الله عليه وسلم: لا تلعنه، فإنه يحب الله ورسوله ، وقال صلى الله عليه وسلم: لعن المؤمن كقتله متفق عليه.وهذا كما أن نصوص الوعيد عامة في أكل أموال اليتامى والزنا والسرقة فلا يشهد بها على معين بأنه من أصحاب النار لجواز تخلف المقتضى عن المقتضي لمعارض راجح: إما توبته، وإما حسنات، وإما مصائب مكفرة، وإما شفاعة مقبولة، وغير ذلك من المكفرات للذنوب هذا بالنسبة لمنع سبه ولعنه. وأما بالنسبة لترك المحبة فلأنه لم يصدر منه من الأعمال الصالحة ما يوجب محبته، فبقي واحدًا من الملوك السلاطين، ومحبة أشخاص هذا النوع ليست مشروعة، ولأنه صدر عنه ما يقتضي فسقه وظلمه في سيرته، وفي أمر الحسين وأمر أهل الحرة. وبالله التوفيق. وصلى الله على نبينا محمد، وآله وصحبه وسلم.
“ইয়াযিদ বিন মু‘আবিয়াহর ব্যাপারে মানুষ দুটো প্রান্তিক ও একটি মধ্যপন্থি দলে বিভক্ত। ইয়াযিদের ব্যাপারে তিনটি অভিমতের মধ্যে সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ মত হলো সে মুসলিমদের একজন রাজা ছিল, তার ভালোকর্ম ছিল, আবার মন্দকর্মও ছিল। সে ‘উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র খেলাফত আমলে জন্মগ্রহণ করে। সে কাফির ছিল না। কিন্তু তার কারণে হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুর) হত্যাকাণ্ড ও হার্রাহ’র যুদ্ধের মতো ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। সে না ছিল সাহাবী, আর না ছিল সৎকর্মপরায়ণ আল্লাহ’র ওলি।শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,“এটাই অধিকাংশ প্রাজ্ঞ ও বিবেকবান আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অভিমত।” আর ইয়াযিদকে লানত করার ব্যাপারেও মানুষ তিনটি দলে বিভক্ত। একদল ইয়াযিদকে লানত করে। একদল ইয়াযিদকে ভালোবাসে। আরেক দল ইয়াযিদকে গালি দেয় না, আবার ভালোও বাসে না। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “ইমাম আহমাদ এই মত ব্যক্ত করেছেন। আর এই মতের ওপরই রয়েছেন ইমাম আহমাদের অনুসারী ও অন্যান্য মুসলিমদের মধ্য থেকে মধ্যপন্থি ব্যক্তিবর্গ।”এই মধ্যপন্থি মত এ বিষয়ের ওপর ভিত্তিশীল যে, ইয়াযিদের এমন কোনো পাপকাজ প্রমাণিত হয়নি, যা তাকে লানত করার দাবি করে; অথবা নির্দিষ্টভাবে একজন পাপী লোককে লানত করা হয় হারাম আর নাহয় মাকরূহে তানযীহী (অপছন্দনীয় কর্ম)। সাহীহ বুখারীতে ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ বিন হিমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বেশ কয়েকবার মদ্যপান করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে বেত্রাঘাত করেছিলেন। এ কারণে জনৈক সাহাবী ওই মদ্যপায়ী সাহাবীকে লানত করেন। তখন নাবী ﷺ বলেন, “তুমি ওকে লানত কোরো না। নিশ্চয় সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে।(সাহীহ বুখারী, হা/৬৭৮০)” নাবী ﷺ অন্যত্র বলেছেন, “মুমিনকে লানত করা হত্যার সমতুল্য।”(সাহীহ বুখারী, হা/৬১০৫; সাহীহ মুসলিম, হা/১১০) ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, যিনায় লিপ্ত হওয়া, চুরি করা প্রভৃতি পাপের ক্ষেত্রে যেসব ব্যাপকার্থবোধক ও শাস্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞাযুক্ত দলিল বর্ণিত হয়েছে, সেসব দলিলের ভিত্তিতে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ব্যাপারে এরকম সাক্ষ্য দেওয়া যায় না যে, সে ব্যক্তি জাহান্নামী। কেননা বিভিন্ন অগ্রাধিকারযোগ্য কারণে এরকম বিষয় বিমোচিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। হয়তো সে তওবা করেছে, অথবা তার পুণ্যকর্ম আছে, কিংবা সে পাপমোচনকারী দুর্যোগে পতিত হয়েছে, অথবা তার জন্য কারও কৃত শাফায়াত (সুপারিশ) গৃহীত হয়েছে, কিংবা এগুলো ছাড়াও তার অন্য কোনো পাপমোচনকারী বিষয় সংঘটিত হয়েছে। এটা গেল গালি না দেওয়া ও লানত না করার প্রসঙ্গ।পক্ষান্তরে ইয়াযিদকে না ভালোবাসার কারণ তার থেকে এমন কোনো ভালো কাজ প্রকাশিত হয়নি, যা তার ভালোবাসাকে জরুরি করে। সে একজন শাসক বা রাজা মাত্র। এ ধরনের লোককে ভালোবাসা শরিয়তসম্মত (বিধেয়) নয়। তাছাড়া ইয়াযিদের জীবনীতে এবং হুসাইন ও হার্রাহ-সংক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের ঘটনায় তার নিকট থেকে যা প্রকাশিত হয়েছে, তা দাবি করে যে, সে একজন ফাসেক ও জালেম ছিল।আর আল্লাহই তৌফিকদাতা। হে আল্লাহ, আমাদের নাবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার পরিজন ও সাহাবীগণের ওপর আপনি দয়া ও শান্তি বর্ষণ করুন।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৮৫-২৮৬; ফতোয়া নং: ১৪৬৬; ফতোয়ার আরবি টেক্সট আজুর্রি (ajurry) ডট কম থেকে সংগৃহীত আব্দুল্লাহ মৃধা ভাইয়ের অনুবাদকৃত)।
·
সালাফদের মতে ইয়াযিদ বিন মু‘আবিয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ঘোষিত সেই কনস্টানন্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) বিজয়ের যুদ্ধে আমীর হিসাবে অংশগ্রহণ করেছেন। যাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রশংসাসূচক বাক্য ব্যবহার করেছেন। আর এ যুদ্ধটি হয়েছিল ৪৯ হিজরী মোতাবেক ৬৬৯ সালে। মু‘আবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সেখানে ৩ বার সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। যার প্রথমে সেনাপতি ছিলেন ফুযালা বিন ওবাইদুল্লাহ আনসারী। ২য় বারে পাঠান সুফিয়ান ইবনু ‘আওফ এবং তৃতীয় বা সর্বশেষ যাদের পাঠান তাদের সেনাপতি ছিল ইয়াযিদ। এ অংশের সাথেই ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী আবূ আইয়ূব আনসারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু), যিনি এ যুদ্ধেই মৃত্যুবরণ করেন এবং ইস্তাম্বুলের প্রাচীরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। ইবনু ওমর, ইবনু আব্বাস, হুসাইন বিন আলী ও ইবনু যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)ও এ যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন।”(তারিখুত ত্বাবারী,তারিখুর রসূল ওয়াল মুলূক, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৩২; তারীখু খলীফাহ ইবনু খাইয়াত্ব, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৯৭) যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,أَوَّلُ جَيْشٍ مِنْ أُمَّتِىْ يَغْزُوْنَ مَدِيْنَةَ قَيْصَرَ مَغْفُوْرٌ لَهُمْ “আমার উম্মাতের প্রথম যে দলটি কায়সার-এর রাজধানী আক্রমণ করবে, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত”।(সহীহ বুখারী হা/২৯২৪) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,”অবশ্যই অবশ্যই ইস্তাম্বুল বিজয় হবে। আর সেই জয়ের যুদ্ধের আমীররা কতই না সুন্দর হবে, অনুরূপ ঐ যুদ্ধের সেনাবাহিনী হবে সৌভাগ্যবান”(মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৯৫৭ সদন বিশুদ্ধ)
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফিয ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,في هذا الحديث منقبة لمعاوية لأنه أول من غزا البحر ومنقبة لولده يزيد لأنه أول من غزا مدينة قيصر এই হাদীসে মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর কৃতিত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। কেননা তিনিই সর্বপ্রথম সমুদ্রপথে যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁর সন্তান ইয়াযিদের কৃতিত্ব। কেননা তিনিই সর্বপ্রথম কায়সার-এর রাজধানী (অর্থাৎ কনস্ট্যান্টিনোপল) আক্রমণ করেন’(ফাৎহুল বারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১০২) মুহাল্লাব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”এই হাদীসের মধ্যে মু‘আবিয়া (রাঃ) ও তাঁর পুত্র ইয়াযিদ এর মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা উসমান (রাঃ) এর খেলাফতকালে (২৩-৩৫ হিঃ) সিরিয়ার গভর্ণর থাকাকালীন সময়ে মু‘আবিয়া (রাঃ) ২৭ হিজরী সনে রোমকদের বিরুদ্ধে ১ম সমুদ্র অভিযান করেন। অতঃপর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (৪১-৬০হিঃ) ৫১ হিজরী মতান্তরে ৪৯ হিজরী সনে ইয়াযিদের নেতৃত্বে রোমকদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের উদ্দেশ্যে যুদ্ধাভিযান প্রেরিত হয়”।ইবনু হাজার, ফৎহুল বারী; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১২০-২১) অনুরূপ কথা ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) ও উল্লেখ করেছেন:(আল-বিদায়াহ; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১৫৩)। ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) ইয়াযিদ সম্পর্কে বলেন,لَهُ عَلَى هَنَاتِهِ حَسَنَةٌ وَهِيَ غَزْوُ القُسْطَنْطِيْنِيَّةِ وَكَانَ أَمِيْرَ ذَلِكَ الْجَيْشِ وَفِيْهِم مِثْلُ أَبِيْ أَيُّوْبَ الْأَنْصَارِيِّ,فكانت دولته أقل من أربع سنين…ويزيد ممن لا نسبُّه ولا نحبه “অর্থাৎ ‘সে বড় অপরাধী হওয়ার পরেও তার একটি ভাল অধ্যায় আছে। আর তা হচ্ছে কনস্টানন্টিনোপল-এর যুদ্ধ। আর এ যুদ্ধে সে ছিল সেনাপতি তাদের মধ্যে আরো একজন হলেন বিখ্যাত সাহাবী আবূ আইয়ূব আনসারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার শাসনকাল চার বছরের কাছাকাছি ছিল। অতএব ইয়াযিদ এমন একজন ব্যক্তি, যাকে আমরা গালিও দিব না এবং ভালোও বাসব না”(সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৬-৩৮)
.
অতএব সহীহ বুখারীর হাদিসের আলোকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ভবিষ্যবাণী ‘তারা সকলেই ক্ষমাপ্রাপ্ত’। তাই আমরা তার ব্যাপারে এই ধারণা পোষণ করতে পারি যে, যার যাবতীয় বিষয়গুলো আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন বিষয়, তিনি চাইলে তাকে ক্ষমা করতেও পারেন, আবার নাও পারেন। তার নামের শেষে আমরা ‘রাহিমাহুল্লাহ’ বা ‘লা‘আনাহুল্লাহ’ কোন কিছুই বলব না। আমরা সালাফে সালিহীনের মতানুযায়ী নীরব থাকব ইনশাআল্লাহ। এটাই আমাদের জন্য অধিক কল্যাণকর ও নিরাপদ। পরিশেষে ইয়াযিদ বিন মু‘আবিয়া ৬৪ হিজরীর ১৪ই রবীঊল আউয়াল ৩৫ বা ৩৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে ইয়াযিদের শেষ কথা ছিল। হাফিয ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) একটি সূত্র উল্লেখ করে বলেন, তিনি মৃত্যুর পূর্বে এ বিষয়ে আফসোস করেছেন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। যেমন তিনি বলেন,اَللّٰهُمَّ لَا تُؤَاخِذْنِيْ بِمَا لَمْ أُحِبُّهُ وَلَمْ أُرِدْهُ وَاحْكُمْ بَيْنِيْ وَبَيْنَ عُبَيْدِ اللهِ بْنِ زِيَادٍ وَكَانَ نَقْشُ خَاتَمِهِ آمَنْتُ بِاللهِ الْعَظِيْمِ “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে পাকড়াও করো না ঐ বিষয়ে যা আমি চাইনি এবং আমি এর প্রতিরোধও করতে পারিনি। হে আল্লাহ! তুমি আমার ও ওবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের মধ্যে ফায়সালা করো। তার আংটিতে নকশা করা ছিল ‘আমি মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি।”(আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১১তম খণ্ড,পৃষ্ঠা: ৬৫)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

No comments:

Post a Comment

Translate