Saturday, July 19, 2025

জুতার ওপর মাসেহ করার বিধান

 পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। অতঃপর এই মাসালাটা নিয়ে আমরা তিনটি পয়েন্ট আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

.
প্রথমত: জুতার উপর মাসাহ করার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো সহিহ ও সুস্পষ্ট হাদীস প্রমাণিত নয়। যদিও কিছু সাহাবি ও তাবেয়ীন (রাহিমাহুমুল্লাহ) থেকে মওকুফ বা তাঁদের ব্যক্তিগত আমল হিসেবে এ বিষয়ে একাধিক বিশুদ্ধ বর্ণনা পাওয়া যায়। এ কারণে ফিকহবিদদের মধ্যে এ বিষয়ে মতভেদ দেখা যায়। তবে চার মাযহাবের ইমামগণ ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম আশ-শাফিঈ ও ইমাম আহমদ (রহিমাহুমুল্লাহ) এ বিষয়ে একমত যে, সাধারণ জুতা বা স্যান্ডেলের উপর মাসাহ করা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। তাঁরা সাহাবাদের থেকে মাসাহ সংক্রান্ত কিছু বর্ণনা জানলেও, সেসবকে শরিয়তের অনুমোদিত ও নিয়মিত আমল হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং তাঁরা বলেছেন, পায়ে জুতা থাকলে তা খুলে পা ধৌত করাই সুন্নাহ অনুযায়ী সঠিক পদ্ধতি।আর এই বিষয়ে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সহীহ বুখারী’ তে অধ্যায় রচনা করেছেন যে, باب غَسْلِ الرِّجْلَيْنِ فِى النَّعْلَيْنِ وَلَا يَمْسَحُ عَلَى النَّعْلَيْنِ ‘ওযূতে পা ধৌত করতে হবে, জুতার উপর মাসাহ করা যাবে না’ (সহীহ বুখারী হা/১৬৬)। শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, আবুল ফাদল আহমাদ বিন আলি ইবনু হাজার আল-আসকালানি,(রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] বলেন, وأشار بذلك إلى ما روي عن علي وغيره من الصحابة أنهم مسحوا على نعالهم في الوضوء ، ثم صلوا “তিনি (ইমাম বুখারী) এর মাধ্যমে সেই বর্ণনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যাতে এসেছে যে, আলী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) এবং অন্যান্য সাহাবাগণ তাঁদের জুতার উপর মাসাহ করেছেন, তারপর সালাত আদায় করেছেন।”(ফাতহুল বারী খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৮৬)
.
চার ইমামসহ অধিকাংশ ফকীহগণ মনে করেন, জুতার উপর মাসাহ করার বিষয়ে যেসব হাদীস রয়েছে, তা পা ধোয়ার নির্দেশ সম্পর্কিত বিশুদ্ধ, সহিহ হাদীসসমূহের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এজন্য তাঁরা জুতার উপর মাসাহ করার দলীলগুলো গ্রহণ করেননি। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহিমাহুল্লাহ)-এর পুত্র সালেহ বলেন:“আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম: ‘আলী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে তিনি তার জুতার উপর মাসাহ করলেন, এরপর তা খুলে ফেললেন এবং নতুন করে ওযু না করেই লোকদের ইমামতি করলেন এ সম্পর্কে আপনার মত কী?’ তিনি (ইমাম আহমাদ) বললেন: এটি আলী (রা:)এর থেকে বর্ণিত একটি ঘটনা। আমি বললাম: ‘তাহলে কেউ যদি এমনটা করে? তিনি বলেন: নবী (ﷺ) থেকে যে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে তা আমাকে আশ্চর্য করে। রাসূল ﷺ বলেছেন:”পায়ের গোড়ালিগুলোর (শুকনো থাকার) জন্য জাহান্নামের শাস্তি রয়েছে” (বুখারী হা/৬০) অতএব,যদি এমনভাবে মাসাহ করা হয় যাতে গোড়ালি ঢাকা না পড়ে, তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে যদি গোড়ালিসহ পা ধোয়া হয়, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই।”(মাসায়িল ইমাম আহমাদ,সালেহ ইবনু আহমাদের রিওয়ায়াত, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৫৩)
.
জুতার উপর মাসাহ সম্পর্কে যেসব আসার (সাহাবীদের বর্ণনা) পাওয়া যায়, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফকীহগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো:“যদি জুতা এমন মোজার উপর পরা হয় যা শরঈভাবে মাসাহযোগ্য (যেমন খুফ বা মোটা মোজা), তবে সে অবস্থায় জুতার উপর মাসাহ করা বৈধ।”
.
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অপর পুত্র আবদুল্লাহ বলেন:“আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম: কেউ যদি জুতার উপর মাসাহ করে, এ বিষয়ে আপনার মত কী?” তিনি বলেন: “যদি তার পায়ে এমন মোজা থাকে যা শক্তভাবে পায়ে আটকে থাকে (এবং মাসাহযোগ্য), তাহলে জুতার উপর মাসাহ করায় কোনো দোষ নেই।” তিনি (আব্দুল্লাহ) আরো বলেন:“আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম: কেউ যদি সরাসরি তার জুতার উপর মাসাহ করে, এটা কি বৈধ?” তিনি বললেন: “না, এটা (মাখরুহ) অপছন্দনীয়।”(মাসায়িল ইমাম আহমাদ,আবদুল্লাহ ইবনু আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর রিওয়ায়াত, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৪; আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২২৮৫১৫)
.
দ্বিতীয়ত: পরবর্তী যুগের যেসকল আহলুস সুন্নাহর আলেমগণ জুতার ওপর মাসাহ বৈধ হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন, তাঁরা বিষয়টি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁরা বলেন: যদি জুতা পবিত্র হয় অর্থাৎ তাতে কোনো অপবিত্রতা না লেগে থাকে এবং তা যদি পায়ের গোঁড়ালি (টাখনা) পর্যন্ত ঢেকে রাখে, তাহলে ঐ জুতার উপর মাসাহ করা বৈধ হবে। কেননা, সে ক্ষেত্রে জুতাটি চামড়ার মোজার (خف) হুকুমে পরিণত হয়।তবে যদি জুতা পায়ের সেই অংশকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছাদন না করে যেটুকু ধৌত করা ওজুর ক্ষেত্রে ফরজ অর্থাৎ গোড়ালিসহ পুরো পায়ের পাতা না ঢাকে তাহলে অধিকাংশ ফকীহদের মতে এমন জুতার ওপর মাসাহ করা বৈধ নয়। এই অভিমতটিই ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) এবং সৌদি আরবের ফাতওয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির নির্বাচিত ও নির্ভরযোগ্য মত হিসেবে গৃহীত হয়েছে।(এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন; আল-মাওসু‘আতুল ফিকহিয়্যাহ আল-কুয়েতিয়্যাহ, খণ্ড: ৩৭, পৃষ্ঠা: ২৬৪; বিন বায; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ১১১; ফাতাওয়াল লাজনা আদ-দায়িমা; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩৯৬)
.
আবু যিবয়্যান আল-জানবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
رأيتُ عليًّا بال قائمًا حتَّى أرغى ، ثم توضَّأ ومسح على نعليه ، ثمَّ دخل المسجد فخلع نعليه فجعلهما في كمّه، ثمَّ صلَّى “আমি ‘আলী ইবনু আবূ তালিব (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-কে দেখেছি—তিনি দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করলেন, এমনকি প্রস্রাবে ফেনা উঠা পর্যন্ত,তারপর ওযু করলেন এবং জুতার উপর মাসাহ করলেন। অতঃপর মসজিদে প্রবেশ করে জুতা খুলে তাঁর কাপড়ের ভাঁজে (হাতা বা কুঁচকানো অংশে) রাখলেন, তারপর সালাত আদায় করলেন।”(মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা/৭৮৪; মুসান্নাফে ইবনু আবি শাইবাহ খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৭৩ হা/২০১২; ইমাম বায়হাকি (খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৮৮; ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন: উভয়ের সনদ শায়খাইন তথা বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহীহ সিলসিলা সহীহা; খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১১৫; হা/২৮৪১)
.
এছাড়াও জুলাস বিন আমর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, أَنَّ عُمَرَ، تَوَضَّأَ يَوْمَ جُمْعَةٍ، وَمَسَحَ عَلَى جَوْرَبَيْهِ وَنَعْلَيْهِ- উমর (রাঃ) জুম‘আর দিনে ওযূ করলেন এবং তার দুই (সুতার) মোযা ও জুতার উপর মাসাহ করলেন”।(মুশান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১৯৭৪; সনদ যঈফ, আবু জনাব ইয়াহইয়া ইবনু হায়াত নামে একজন যঈফ বর্ণনাকারী রয়েছে। তবে মতন সহীহ) অপর বর্ননায় কা‘ব ইবনু আব্দিল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, رَأَيْتُ عَلِيًّا بَالَ فَمَسَحَ عَلَى جَوْرَبَيْهِ وَنَعْلَيْهِ، ثُمَّ قَامَ يُصَلِّي- ‘আলী (রাঃ)-কে দেখলাম তিনি পেশাব করার পর (ওযূ শেষে) তার দুই মোযা ও জুতার উপর মাসাহ করলেন অতঃপর সালাতের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন’।(মুশান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৭৭৩; এর সনদে কা‘ব বিন আব্দুল্লাহ নামে একজন সমালোচিত বর্ণনাকারী থাকায় এর সনদকে কতিপয় বিদ্বান যঈফ বলেছেন (ইমাম আলবানী,সহীহ বলেছেন আবূ দাউদ; খণ্ড: ১পৃষ্ঠা: ২৭৮)।অন্য এক বর্ননায় ইসমাঈল বিন রাজা তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করে বলেন, رَأَيْتُ الْبَرَاءَ بْنَ عَازِبٍ يَمْسَحُ عَلَى جَوْرَبَيْهِ وَنَعْلَيْهِ-‘আমি বারা ইবনু আযেবকে দেখেছি, তিনি সুতার মোযা ও জুতার উপর মাসাহ করেছেন’।(মুশান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৭৭৮; সনদ সহীহ) হিশাম ইবনে আয়েয হ’তে বর্ণিত,তিনি বলেন, بَالَ وَنَحْنُ عِنْدَهُ، فَمَسَحَ عَلَى جَوْرَبَيْهِ وَنَعْلَيْهِ، ثُمَّ صَلَّى ‘ইবরাহীম নাখঈ (রহঃ) একদিন পেশাব করলেন যখন আমরা তার পাশেই ছিলাম। অতঃপর ওযূ করে সুতার দুই মোযা ও জুতার উপর মাসাহ করলেন এবং সালাত আদায় করলেন।(মুশান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৭৭৫, সনদ বিশুদ্ধ)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:”ومن شروط المسح على الخفين والجوربين: أن يكونا ساترين لمحل الفرض”চামড়ার মোজা ও কাপড়ের মোজার ওপর মাসেহ করার শর্ত হচ্ছে– যতটুকু স্থান ধোয়া ফরয ততটুকু স্থানকে ঢাকতে হবে।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ১১১; ফাতাওয়াল লাজনা আদ-দায়িমা; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩৯৬)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হলেছিল: সহীহ সনদে প্রমাণিত আছে যে, কিছু সাহাবী যেমন: ইবনু ‘উমর, আলী ইবনু আবী ত্বালিব এবং আওস ইবনু আওস সাকাফী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) নিজেদের জুতার উপর মাসাহ করেছেন; যেমনটা সুনান গ্রন্থসমূহ এবং অন্যান্য উৎসে তাদের থেকে বর্ণিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ জুতা খুলে মসজিদে প্রবেশ করে সলাত আদায় করেছেন। এসব ঘটনা বিশেষত হুসাইন ইবনু ‘আবদুর রাজ্জাকের হাদীস, যা শাইখাইন (বুখারী ও মুসলিম) এর শর্ত অনুযায়ী সহীহ এসবকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব?অথবা এটি কীভাবে সমন্বয় করব?
অতঃপর তিনি উত্তর দিলেন:
هذا له توجيه عند بعض أهل العلم : أنه يجوز المسح على النعلين إذا كانت تستر أكثر القدم . وبعضهم يقول : إن القدم إما أن تكون مستورة بالخف والجورب فتمسح ، أو غير مستورة بشيء فتغسل ، أو مستورة بالنعل فترش رشا بين الغسل والمسح ، وحملوا الحديث الوارد في المسح على النعلين على هذا ، وقالوا : إن المراد أنه رشها ، ثم مر بيده عليها ، وعلى كل حال : فالاحتياط للمرء ألا يقدم على شيء إلا وهو يعلم أن السنة جاءت به ، أو يغلب على ظنه أن السنة جاءت به .
وأما ما ورد عن الصحابة ، مما يخالف ظاهر السنة : فإنه لا يؤخذ به ؛ بل يعتذر عنهم ولا يحتج بفعلهم “
“এটি সেই বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত, যা কিছু আলেম ব্যাখ্যার মাধ্যমে সুসংগত করেছেন।কিছু আলেমের মতে যদি জুতা পায়ের অধিকাংশ অংশ ঢেকে রাখে, তাহলে তাতে মাসাহ করা বৈধ।আর কিছু আলেম বলেন:যদি পা এমন কিছু দিয়ে আবৃত থাকে যা মোজার মতো (চামড়ার মোজা বা পায়ে টাইট বসে যায় এমন কিছু), তাহলে তার উপর মাসাহ করা বৈধ হবে। কিন্তু যদি পায়ে কিছুই না থাকে, তাহলে অবশ্যই পা ধুতে হবে। আর যদি কেবল পায়ে জুতা থাকে (যা পা পুরোপুরি আবৃত করে না), তাহলে তা ধোয়ার আর মাসাহর মাঝামাঝি একটি অবস্থা অর্থাৎ, শুধু পানির ছিটা দেওয়া যায়।তাঁরা বলেন, সাহাবীদের পক্ষ থেকে জুতার উপর মাসাহ করার যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তা আসলে এ অর্থে তাঁরা প্রথমে জুতায় পানি ছিটিয়েছেন, তারপর হাত বুলিয়েছেন।সারসংক্ষেপে বলা যায়:সবচেয়ে উত্তম হলো, কোনো ব্যক্তি যেন এমন কোনো ইবাদতমূলক কাজ না করে যতক্ষণ না সে নিশ্চিত হয় যে, তা সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত; অথবা তার প্রবল ধারণা হয় যে, এটি সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত।আর যদি কোনো সাহাবীর পক্ষ থেকে এমন কোনো আমল বর্ণিত হয় যা স্পষ্ট সুন্নাহর বিরোধী, তবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না; বরং তাদের জন্য ওজর খোঁজা হবে, এবং তাদের সে আমলকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।”(ইবনু উসামীন লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-৬)
.
তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন:لا يجوز المسح على النعل ؛ بل لا بد من خلع النعل وغسل الرجل .أما الخف ، وهو ما يستر الرجل : فإنه يجوز المسح عليه ، سواء كان من جلد ، أو من قطن، أو من صوف ، أو من غيرها ؛ بشرط أن يكون مما يحل لبسه”জুতার উপর মাসাহ করা বৈধ নয়; বরং আবশ্যক হলো জুতা খুলে পা ধৌত করা।আর খুফ (মোজা জাতীয় পা ঢাকা বস্তু)—হোক তা চামড়ার, সুতির, উলের অথবা অন্য কোনো বৈধ বস্তু দিয়ে তৈরি এর উপর মাসাহ করা বৈধ, তবে শর্ত হলো: সেটি শরিয়তের দৃষ্টিতে পরিধানযোগ্য হতে হবে।”(ইবনু উসাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা: ২; মাকতাবা শামেলার ক্রম অনুযায়ী)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:সম্মানিত শাইখ,সেনাবাহিনীর
বুট জুতা পরে নামায আদায় করা কি বৈধ? এ অবস্থায় ওজুর পদ্ধতি কী হবে? এবং এটি পরে মাসাহ করার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে কি? তিনি উত্তর দিলেন:
تجوز الصلاة بالبسطار – أي : الخف – إذا كان طاهرًا وليس عليه نجاسة ، ويجوز المسح عليه في الوضوء إذا كان ساترًا سترًا كاملاً للرجل ، بأن يكون ضافيًا على الكعبين وما تحتهما ، وثابتًا على الرجل ، وقد لبسه على طهارة ، بأن يلبسه وهو على وضوء .وصفة المسح أن يضع أصابع يديه مبلولتين بالماء على أطراف أصابع رجله ، ثم يمررهما إلى ساقيه .ومدة المسح يوم وليلة بالنسبة للمقيم ، وثلاثة أيام بلياليها للمسافر ، وهو رخصة ثابتة بالسنة المتواترة عن النبي صلى الله عليه وسلم لم ينكره إلا المبتدعة ، وابتداء المدة على الصحيح من أول مسح بعد اللبس، والله أعلم “
সেনাবাহিনীর বুট, অর্থাৎ খুফ, যদি পবিত্র থাকে এবং তাতে কোনো নাপাকি না থাকে তাহলে তা পরে সালাত আদায় করা বৈধ।আর ওজুর সময় এই বুটের উপর মাসাহ করাও বৈধ, যদি এটি পুরো পা ঢেকে রাখে অর্থাৎ গোড়ালিসহ নিচের অংশসমূহ ঢেকে রাখে এবং পায়ে দৃঢ়ভাবে আটকানো থাকে, এবং তা এমন অবস্থায় পরিধান করা হয় যখন সে অজু অবস্থায় থাকে (অর্থাৎ অজু করে পরে পরেছে) তাহলে এর উপর মাসাহ করাও বৈধ। মাসাহ করার পদ্ধতি হলো: উভয় হাত পানিতে ভিজিয়ে আঙ্গুলের আগা থেকে পায়ের পিঠ বরাবর গোড়ালির দিকে মাসাহ করা। অর্থাৎ সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে, পায়ের উপরের অংশে মাসাহ করতে হবে। মেয়াদ: একজন মুকীম (অবস্থানে থাকা ব্যক্তি) এর জন্য মাসাহ করার সময়সীমা হচ্ছে একদিন একরাত (২৪ ঘণ্টা)। আর মুসাফির (ভ্রমণকারী) এর জন্য সময়সীমা হলো তিন দিন তিন রাত (৭২ ঘণ্টা)।এটি একটি শরিয়তপ্রদত্ত রুখসত (ছাড় বা সুবিধা), যা বহু সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং পরস্পরবর্ণনায় (মুতাওয়াতির) রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে নির্ভরযোগ্যভাবে বর্ণিত। কেবল বিদআতপন্থীরাই এই বিধানকে অস্বীকার করে থাকে। আর সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী, সময়সীমা গণনা শুরু হবে ওজুর পর জুতা পরিধান করার পর প্রথমবার যখন মাসাহ করা হবে তখন থেকে। আল্লাহই ভালো জানেন। (আল-মুনতাক্বা মিন ফাতাওয়াস শাইখ সালিহ আল-ফাওযান; খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৫৪)
.
তৃতীয়ত: যদি কেউ যতটুকু স্থান ধৌত করা ফরজ ততটুকু স্থান আচ্ছাদিত করে এমন জুতার উপর মাসেহ করে, এরপর পবিত্র অবস্থায় জুতা খুলে ফেলে সেক্ষেত্রে আলেমগণের সঠিক মতানুযায়ী তার পবিত্রতা নষ্ট হবে না। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, একবার খুলে ফেলার মাধ্যমে মাসেহ করার যে রুখসত (শিথিলতা) ছিল, তা শেষ হয়ে যাবে। অতএব, যদি সে পরে আবার সেই জুতা পরিধান করে এবং নতুন করে ওজু করতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই জুতা ও মোজা খুলে পা ধৌত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা দরকার। যদি কেউ মোজা পরে তার উপর খাটো জুতা পরিধান করে, যা টাখনু ঢাকে না, তবে সেই জুতার তিনটি সম্ভাব্য অবস্থা হতে পারে:
(১)। শুধু জুতার ওপর মাসেহ করা; ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটা জায়েয নেই।
(২)। শুধু মোজাদ্বয়ের ওপর মাসেহ করা। অর্থাৎ জুতা খুলে মোজাদ্বয়ের ওপর হাতদ্বয় দিয়ে মাসেহ করা। এরপর পুনরায় জুতা পরা। এটা জায়েয; এতে কোন অসুবিধা নেই। এ অবস্থায় তিনি জুতা খুলে ফেললেও তার ওজু ভাঙ্গবে না।
(৩)। জুতা ও মোজা উভয়টির ওপরে মাসেহ করা। এটাও জায়েয।
কেউ যদি খাটো জুতার ওপর মাসেহ করে অবশিষ্ট মাসেহ মোজাদ্বয়ের ওপর করার মাধ্যমে মাসেহ পরিপূর্ণ করে সেক্ষেত্রে এ দুটো জিনিসের সাথে বিধান সম্পৃক্ত হয়ে যাবে। যার ফলে সে ব্যক্তি যদি শুধু জুতা খুলে ফেলে কিংবা মোজাদ্বয়ের সাথে জুতা খুলে ফেলে তার পবিত্রতা ভঙ্গ হবে না; তার জন্য সালাত পড়া জায়েয হবে। কিন্তু পরবর্তীতে পাদ্বয় ধৌত করে পরিপূর্ণ ওজু করা ছাড়া জুতা বা মোজার ওপর মাসেহ করা জায়েয হবে না। সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন:
للمتوضئ أن يمسح فوق الجورب وحده، وفوق الكُندره [الحذاء] وحدها، إن كانت ساترة للكعبين، لا ترى من ورائها بشرة القدمين. وإن كانت غير ساترة للكعبين مسح عليها إذا كانت ملبوسة فوق جورب ساتر للكعبين وعلى ما ظهر من الجوربين فوق محل الغسل، وصلى فيهما جميعا “.
“ওজুকারী শুধু মোজার ওপরে মাসেহ করতে পারেন এবং শুধু বুট জুতার ওপরেও মাসেহ করতে পারেন; যদি বুট জুতা টাখনুদ্বয়কে আচ্ছাদন করে এবং পায়ের পাতার চামড়া দেখা না যায়। আর যদি টাখনুদ্বয় আচ্ছাদন না করে কিন্তু টাখনু ঢেকে রেখেছে এমন মোজা পায়ে থাকে সেক্ষেত্রে ধৌত করার স্থান পর্যন্ত মোজাদ্বয়ের ওপরেও মাসেহ করে তাহলে এ জুতা ও মোজা পরে সালাত পড়তে পারবে।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩৯৬)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:أما الكندرة، فهي كالنعل إذا كانت لا تستر القدم مع الكعبين، فإن مسح عليهما مع الشُرَّاب [ الجورب ] صار الحكم لهما… وإن اقتصر على مسح الشُرَّاب كفاه ذلك، وجاز له خلع الكندرة متى يشاء، والطهارة باقية بحالها؛ لأن حكم المسح قد تعلق بالشراب “যদি বুট জুতা সেন্ডেলের মত টাখনুসহ পায়ের পাতা না ঢাকে তখন কেউ যদি মোজাসহ বুটের উপর মাসেহ করে সেক্ষেত্রে এ দুটো জিনিসের সাথে হুকুম সম্পৃক্ত হয়ে যাবে। সে যদি শুধু মোজার ওপর মাসেহ করত তাহলে সেটাই তার জন্য যথেষ্ট হত, তার যখন ইচ্ছা তখন বুট জুতা খুলে ফেলাও জায়েয হত, কিন্তু তার পবিত্রতা অব্যাহত থাকত। যেহেতু মাসেহ করার হুকুম শুধু মোজা এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ২৯; পৃষ্ঠা: ৭৩)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

No comments:

Post a Comment

Translate