নিম্নে মুহররম মাসে নফল রোজা রাখা এবং বিশেষভাবে আশুরার রোজা রাখার ফজিলত ও সঠিক পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:
বিশ্ববরেণ্য ফকিহ এবং সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়—
❖ আশুরার রোজা কখন রাখতে হয়? মুহররম মাসের রোজা বা আশুরার রোজা কি ১ মুহররম থেকেই শুরু হয়, না মাঝখানে বা শেষে? আর কতদিন রোজা রাখতে হয়? কারণ আমি শুনেছি, আশুরার রোজা ১ মুহররম থেকে ১০ মুহররম পর্যন্ত রাখতে হয়। আল্লাহ তওফিক দান করুন।
❖ তিনি এই প্রশ্নের যে উত্তর দেন তা নিম্নরূপ:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ»
“রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা।” [সহিহ মুসলিম, হা/ ১১৬৩]
অর্থাৎ পুরো মুহররম মাস জুড়ে অর্থাৎ মুহাররমের ১ম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত নফল রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলত পূর্ণ আমল।
তবে কেউ পুরো মুহররম মাসব্যাপী রোজা না রাখলেও যেন এর মধ্যে বিশেষভাবে ৯ ও ১০ তারিখে অথবা ১০ ও ১১ তারিখে রাখে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহেলিয়াতের যুগে ১০ তারিখে রোজা রাখতেন, কুরাইশরাও তা করত। পরতীতে তিনি যখন মদিনায় আগমন করেন তখন দেখলেন—ইহুদিরাও ১০ তারিখে রোজা রাখে। তখন তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলল:
«هٰذَا يَوْمٌ نَجَّى اللَّهُ فِيهِ مُوسَىٰ وَقَوْمَهُ، وَأَهْلَكَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ، فَصَامَهُ مُوسَىٰ شُكْرًا لِلَّهِ، فَنَحْنُ نَصُومُهُ»
“এটা এমন একটি দিন, যেদিন আল্লাহ মুসা (আ.) ও তাঁর কওমকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে ধ্বংস করেছিলে। ফলে মুসা (আ.) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এ দিন রোজা রেখেছিলেন। সে কারণে আমরাও এ দিনটি রোজা পালন করি।
তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বলেন:
«نَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَىٰ بِمُوسَىٰ مِنْكُمْ»
“আমরাই মুসা (আ.) -এর তুলনায় তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার।”
অতঃপর তিনি আশুরার রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও রাখতে আদেশ দিলেন।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]
❖ সুতরাং—
সুন্নাহ অনুযায়ী আশুরার রোজা রাখার নিয়ম হলো: আশুরা তথা ১০ মুহররম রোজা রাখা সুন্নাহ। তবে ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য পরিহার করতে এর সঙ্গে আরও একদিন রোজা রাখা উত্তম। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«صُومُوا يَوْمًا قَبْلَهُ وَيَوْمًا بَعْدَهُ»
“তোমরা এর এক দিন আগে এবং এক দিন পরে রোজা রাখো”
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
يومًا قبله أو يومًا بعده
“এর এক দিন আগে অথবা এক দিন পরে রোজা রাখো।”
(উক্ত হাদিস দ্বয় জইফ বা দুর্বল। এ বিষয়ে তাহকিক দেখুন টিকাতে)
আর অন্য হাদিসে তিনি বলেন:
«لَئِنْ بَقِيتُ إِلَىٰ قَابِلٍ لَأَصُومَنَّ التَّاسِعَ»
“যদি আমি আগামী বছর জীবিত থাকি তবে অবশ্যই নবম দিন রোজা রাখব।” [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৩৪] অর্থাৎ তিনি দশম তারিখের সাথে নবম তারিখেও রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।
অতএব এটিই সবচেয়ে উত্তম যে,—আশুরা তথা ১০ মুহররম রোজা রাখা। কারণ এটি একটি মহিমান্বিত দিন, যেদিন মুসা (আলাইহিস সালাম) ও মুসলিমদের জন্য এক মহৎ কল্যাণ সংঘটিত হয়েছিল। আর আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিন রোজা রেখেছিলেন।তাই আমরাও তাঁর অনুসরণে এ রোজা রাখি এবং তিনি যা শরিয়ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, আমরা তা অনুসরণ করি।
আর আমরা এ রোজার সঙ্গে একদিন আগে বা পরে আরও একটি দিন রোজা রাখি — ইহুদিদের থেকে ভিন্নতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে।
সবচেয়ে উত্তম হলো নবম ও দশম মুহররম একসঙ্গে রোজা রাখা। এ হাদিসের কারণে, যেখানে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«لَئِنْ عِشْتُ إِلَىٰ قَابِلٍ لَأَصُومَنَّ التَّاسِعَ»
“যদি আমি আগামী বছর জীবিত থাকি তবে অবশ্যই নবম দিন রোজা রাখব।”
অতএব যদি কেউ দশম ও একাদশ দিন রোজা রাখে, কিংবা তিন দিন — নবম, দশম ও একাদশ — রোজা রাখে, তাহলে সবই ভালো।
আর কেউ যদি নবম, দশম ও একাদশ — তিন দিনই রোজা রাখে, তবে তা অত্যন্ত উত্তম এবং এতে ইহুদিদের থেকে স্পষ্ট ভিন্নতা বজায় থাকে। আর কেউ যদি পুরো মুহররম মাস রোজা রাখে তবে তা সবচেয়ে উত্তম এবং সর্বোচ্চ ফজিলত পূর্ণ।” (সমাপ্ত) [binbaz]
❖ মুহাররমের রোজা পালনের শরিয়ত সম্মত বিভিন্ন পদ্ধতি:
❂ ক. শুধু ১০ মুহররম রোজা রাখা। এটা জায়েজ। এতেও আশুরার পূর্ণ ফজিলত (পেছনের এক বছরের গুনাহ মোচন) পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। তবে ইহুদিদের সাদৃশ্য এড়িয়ে চলার দিক থেকে এটি এককভাবে রাখা মোস্তাহাব নয়।
❂ খ. ৯ ও ১০ মুহররম। এটা সবচেয়ে উত্তম। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরের বছর (দশম তারিখের সাথে) নবম দিন রোজা রাখার নিয়ত করেছিলেন।
❂ গ. ১০ ও ১১ মুহররম এ দু দিন রোজা রাখা ভালো। এতে ইহুদিদের ভিন্নতা অর্জনের উদ্দেশ্য পূরণ হয়।
❂ ঘ. ৯, ১০ ও ১১ মুহররম–আরও উত্তম। এ তিন দিন রোজা রাখলে আরও বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়।
❂ পুরো মুহররম মাস জুড়ে রোজা রাখ –সর্বোত্তম। কেননা হাদিসে রমজান মাসের পরেই মুহররম মাসের রোজাকে ‘সর্বোত্তম রোজা’ বলা হয়েছে।
মোটকথা, আশুরা বা ১০ মুহররম একটি অনন্য মর্যাদাপূর্ণ দিন। যেদিন আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদেরকে নাজাত দিয়েছেন এবং ফেরাউন এবং তার বাহিনীকে ধ্বংস করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে সেদিন রোজা রেখেছেন এবং মুসলিম জাতিকেও রোজা রাখতে আদেশ দিয়েছেন।
তাই সুন্নাহ হলো: দশম মুহাররমের সঙ্গে নবম অথবা একাদশ তারিখে রোজা রাখা, যেন ইহুদিদের অনুকরণ না হয়।
আর যার সামর্থ্য আছে, তিনি পুরো মুহররম মাসেই নফল রোজা রাখতে পারেন—এটি সর্বোত্তম কাজ।
—টিকা—
✪ ১ম হাদিস:
«صُومُوا يَوْمًا قَبْلَهُ وَيَوْمًا بَعْدَهُ» “তোমরা এর এক দিন আগে এবং এক দিন পরে রোজা রাখো” শাইখ শুয়াইব আরনাবাবুত যাদুল মায়াদ কিতাবের তাহকিক গ্রন্থে (২/৭২) এবং শাইখ আলবানি যইফুল জামে গ্রন্থে (হা/৩৫০৬) এ হাদিসটিকে জইফ (দুর্বল) বলে সাব্যস্ত করেছেন।
✪ ২য় হাদিস (২য় বর্ণনা)
يومًا قبله أو يومًا بعده
“এর এক দিন আগে অথবা এক দিন পরে রোজা রাখো।”
শাইখ শুয়াইব আরনাবুত যাদুল মায়াদ কিতাবের তাহহিক গ্রন্থে (২/৬৬) ’জইফ (দুর্বল) হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেন,
[فيه] ابن أبي ليلى وهو سيء الحفظ
“এই সনদে ইবনে আবি লাইলা নাম্নী যে বর্ণনাকারী রয়েছেন, আর তিনি দুর্বল স্মৃতির অধিকারী।”
এ ছাড়াও অনেক মুহাদ্দিস উক্ত হাদিস দ্বয়কে জইফ বা দুর্বল বলে চিহ্নিত করেছেন।
তবে হাদিস দ্বয় মুহাররমের রোজার ক্ষেত্রে জইফ হলেও জুমার একদিন আগে অথবা পরে রোজার রাখার হাদিস সহিহ যা সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। যেমন: রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«لَا تَخُصُّوا لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ بِقِيَامٍ، وَلَا تَخُصُّوا نَهَارَهَا بِصِيَامٍ، وَلَكِنْ صُومُوا يَوْمًا قَبْلَهُ أَوْ يَوْمًا بَعْدَهُ»
“তোমরা জুমার রাতকে কিয়াম (নফল ইবাদত) করার জন্য বিশেষ করে নিও না, আর জুমার দিনের রোজাকেও (এককভাবে) বিশেষ করে নিও না। বরং তোমরা এর আগে একদিন অথবা পরে একদিন রোজা রাখো।” [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৪৪] আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
অনুবাদ ও বিশ্লেষণ ও টিকা সহযোজন:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।
No comments:
Post a Comment