Saturday, July 19, 2025

মুমিন মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আল্লাহ তার কষ্ট বা ক্ষতি অপছন্দ করেন এর বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা

 প্রশ্ন: রাসূল (ﷺ) থেকে বর্নিত, আল্লাহ বলেন, يَكْرَهُ المَوْتَ، وَأَنَا) أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ) সে (মুমিন) মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার কষ্ট/ক্ষতি অপছন্দ করি।”(সহীহ বুখারী হা/ ৬৫০২, সিলসিলা সহীহাহ হা/১৬৪০) এর বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা কি?

▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন; يَكْرَهُ المَوْتَ، وَأَنَا) أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ) “মুমিন মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার কষ্ট/ক্ষতি অপছন্দ করি।”(বুখারী হা/৬৫০২) এটি একটি দীর্ঘ হাদীসের শেষের অংশ,পুরো হাদিসটিতে খাঁটি মুমিন বান্দাদের গুণাবলি বর্ণনা করা হয়েছে যার দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহ্‌র আদেশ ও নির্দেশনার বাইরে বিন্দুমাত্র অগ্রসর হয় না। মৃত্যু এটি একজন মু’মিনের জন্য স্বভাবতই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়।কারণ এর মাধ্যমেই তাকে বিদায় নিতে হয় পরিচিত মানুষদের মায়া থেকে, প্রিয়জনদের সান্নিধ্য থেকে এবং এই চেনা পৃথিবীর শান্ত আবরণ ও নির্ভরতার ছায়া থেকে। তাকে অজানার দিকে পা বাড়াতে হয় এক এমন জগতে, যার পরিবেশ, অনুভব, সঙ্গ ও অভিজ্ঞতা তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাই মুমিন মৃত্যুকে সহজে আলিঙ্গন করতে পারেন না। তবে মুমিনের এই মৃত্যুকে অপছন্দ করা দুনিয়ার মোহ থেকে নয়; বরং এটি আসে এক গভীর আত্মিক তাড়না থেকে—আরও বেশি নেক আমল করার, আরও অধিক আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের, এবং পরকালীন জীবনের জন্য আরও ভালো প্রস্তুতি নেওয়ার বাসনা থেকে। দুনিয়াতে বেঁচে থাকা তাঁর কাছে ইবাদত ও সৎকর্মের সুযোগ। অন্যদিকে অমুসলিমরাও মৃত্যুকে অপছন্দ করে; কিন্তু তাদের এ অপছন্দ মূলত দুনিয়ার ভোগ-বিলাস হারানোর ভয় থেকে উৎসারিত। তারা চান না এ জাগতিক সুখ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে। কিন্তু একজন মু’মিনের মৃত্যু-ভীতি, একেবারেই ভিন্ন মু‘মিনের অপছন্দ মূলত পরকালীন জীবনের প্রস্তুতি ও নেক আমল বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা থেকে আসে।
.
অন্যদিকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা যিনি পরম দয়ালু, অবারিত করুণার আধার তিনিও ভালোবাসেন তাঁর মু’মিন বান্দাকে। তাই তাঁর বান্দার যেকোন কষ্ট হোক তা দুনিয়ার পরীক্ষায়, কিংবা মৃত্যুর সময়কার বেদনায় তিনিও তা অপছন্দ করেন।কিন্তু মৃত্যু এমন এক অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতা, যার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। এই মৃত্যু-ই, যার আড়ালে লুকিয়ে থাকে মু’মিনের জন্য অফুরন্ত রহমত, চিরস্থায়ী পুরস্কার এবং আল্লাহর পরম হিকমতের দরজা। মৃত্যুর মাধ্যমেই বান্দা ফিরে আসে তার রবের দিকে, প্রবেশ করে অনন্ত শান্তির আবাস জান্নাতে। এই দ্বিমুখী বাস্তবতাই হাদীসে বর্ণিত “তরাদ্দুদ” অর্থাৎ “দ্বিধা” বা “দ্বিমুখিতা”-এর প্রকৃত তাৎপর্য। আল্লাহর তরফ থেকে এটি কোনো অক্ষমতা নয় বরং তাঁর অসীম দয়ার এক অপার্থিব, অতুলনীয় বহিঃপ্রকাশ। বান্দার কষ্টকে তিনি অপছন্দ করেন, কিন্তু সেই কষ্টের মধ্য দিয়েই বান্দাকে নিজের সান্নিধ্যে টেনে নেওয়াকেই তিনি চূড়ান্ত কল্যাণ মনে করেন।
.
হাদিসটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:
وَالرَّبُّ يَكْرَهُ أَنْ يَسُوءَ عَبْدَهُ وَمَحْبُوبَهُ، فَلَزِمَ مِنْ هَذَا أَنْ يَكْرَهَ الْمَوْتَ، لِيَزْدَادَ مِنْ محاب مَحْبُوبِهِ، وَاَللَّهُ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى قَدْ قَضَى بِالْمَوْتِ، فَكُلُّ مَا قَضَى بِهِ فَهُوَ يُرِيدُهُ، وَلَا بُدَّ مِنْهُ، فَالرَّبُّ مُرِيدٌ لِمَوْتِهِ لِمَا سَبَقَ بِهِ قَضَاؤُهُ، وَهُوَ مَعَ ذَلِكَ كَارِهٌ لِمسَاءَةِ عَبْدِهِ، وَهِيَ الْمسَاءَةُ الَّتِي تَحْصُلُ لَهُ بِالْمَوْتِ، فَصَارَ الْمَوْتُ مُرَادًا لِلْحَقِّ مِنْ وَجْهٍ، مَكْرُوهًا لَهُ مِنْ وَجْهٍ، وَهَذَا حَقِيقَةُ التَّرَدُّدِ، وَهُوَ: أَنْ يَكُونَ الشَّيْءُ الْوَاحِدُ مُرَادًا مِنْ وَجْهٍ مَكْرُوهًا مِنْ وَجْهٍ، وَإِنْ كَانَ لَا بُدَّ مِنْ تَرَجُّحِ أَحَدِ الْجَانِبَيْنِ كَمَا تَرَجَّحَ إرَادَةُ الْمَوْتِ؛ لَكِنْ مَعَ وُجُودِ كَرَاهَةِ مسَاءَةِ عَبْدِهِ، وَلَيْسَ إرَادَتُهُ لِمَوْتِ الْمُؤْمِنِ ، الَّذِي يُحِبُّهُ وَيَكْرَهُ مسَاءَتَهُ ، كَإِرَادَتِهِ لِمَوْتِ الْكَافِرِ الَّذِي يُبْغِضُهُ وَيُرِيدُ مُسَاءَتَهُ “
“প্রভু (আল্লাহ) অপছন্দ করেন যে, তাঁর কোনো বান্দা ও প্রিয়জনের কোনো ক্ষতি হোক। সুতরাং এখান থেকে এ কথা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় যে, (বান্দা) মৃত্যুকে অপছন্দ করবে যেন সে তার প্রিয় প্রভুর পছন্দনীয় বিষয়গুলো আরও বেশি করে অর্জন করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মৃত্যুর ফয়সালা দিয়ে দিয়েছেন এবং তিনি যা ফয়সালা করেন তা-ই তিনি চান, আর তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। অতএব প্রভু বান্দার মৃত্যু কামনা করেন, কারণ তাঁর পক্ষ থেকে পূর্বেই তা নির্ধারিত হয়েছে।তবে তা সত্ত্বেও, তিনি তাঁর বান্দার কষ্ট অপছন্দ করেন। আর সেই কষ্টটি হচ্ছে যেটি মৃত্যুর মাধ্যমে যা সে ভোগ করে।ফলে মৃত্যু এমন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক দিক দিয়ে চাওয়া হয়েছে, আবার অন্য দিক দিয়ে অপছন্দনীয়। এটাই হল ‘তরাদ্দুদ’ (দ্বিধা বা দ্বিমুখিতা) অর্থাৎ, কোনো একটি বস্তু এমন হতে পারে যা এক দিক থেকে কাম্য, আবার অন্য দিক থেকে অপছন্দনীয়। যদিও বাস্তবে একটি দিক অবশ্যই প্রাধান্য লাভ করে, যেমন এখানে মৃত্যুর প্রতি আল্লাহর ইচ্ছা প্রাধান্য পেয়েছে; তবুও বান্দার কষ্ট হওয়া এই দিক থেকেও অপছন্দ বজায় থাকে। তবে কোনো মুমিন বান্দার মৃত্যুতে যাকে তিনি ভালোবাসেন এবং যার কষ্ট তিনি অপছন্দ করেন আল্লাহর ইচ্ছা এমন নয়, যেমনটি একজন কাফিরের মৃত্যুর ব্যাপারে হয়ে থাকে যাকে তিনি ঘৃণা করেন এবং যার কষ্ট তিনি কামনা করেন।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ১৩১)
.
শাইখুল ইসলাম (রাহিমাহুল্লাহ)আরও বলেছেন:
فَهُوَ سُبْحَانَهُ لَمَّا كَرِهَ مسَاءَةَ عَبْدِهِ الْمُؤْمِنِ الَّذِي يَكْرَهُ الْمَوْتَ، كَانَ هَذَا مُقْتَضِيًا أَنْ يَكْرَهَ إمَاتَتَهُ مَعَ أَنَّهُ يُرِيدُ إمَاتَتَهُ؛ لِمَا لَهُ فِي ذَلِكَ مِنْ الْحِكْمَةِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى “
আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা যখন তাঁর সেই মু’মিন বান্দার কষ্ট অপছন্দ করেন যে বান্দা নিজেও মৃত্যুকে অপছন্দ করে তখন তার মৃত্যু আল্লাহর দৃষ্টিতে অপছন্দনীয় হয়ে ওঠে; তবুও তিনি চূড়ান্তভাবে তার মৃত্যু চান, কেননা এর মাধ্যমে তার অসীম হিকমাহ বাস্তবায়িত হয়”।(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ৪৮৩)
.
শাইখ, ফকীহ মোল্লা আলী আল-ক্বারী হানাফি (রাহিমাহুল্লাহ [মৃত: বিশুদ্ধ মতে ১০১৪ হি:] বলেন
:(وَأَنَا أَكْرَهُ مسَاءَتَهُ) : قَالَ ابْنُ الْمَلَكِ: أَيْ: إِيذَاءهُ بِمَا يَلْحَقُهُ مِنْ صُعُوبَةِ الْمَوْتِ وَكَرْبِهِ، وَقَالَ ابْنُ حَجَرٍ: أَيْ: أَكْرَهُ مَا يَسُوءُهُ؛ لِأَنِّي أَرْحَمُ بِهِ مِنْ وَالِدَيْهِ، لَكِنْ لَا بُدَّ لَهُ مِنْهُ لِيَنْتَقِلَ مِنْ دَارِ الْهُمُومِ وَالْكُدُورَاتِ إِلَى دَارِ النَّعِيمِ وَالْمَسَرَّاتِ “
”(আর আমি তার কষ্ট অপছন্দ করি) এ সম্পর্কে ইবনু মালিক বলেন: এর অর্থ হলো, তার সেই কষ্ট অপছন্দ করা, যা সে মৃত্যুর যন্ত্রণার মাধ্যমে ভোগ করে। আর ইবনু হাজার বলেন: এর অর্থ হলো, আমি তার কষ্ট পাওয়া অপছন্দ করি; কেননা আমি তার জন্য এমন মমতাশীল, যা তার বাবা-মায়ের মমতার চেয়েও গভীর।তবে মৃত্যু তার জন্য অপরিহার্য; কেননা তাকে দুঃখ-ক্লেশ ও বিপদের গৃহ থেকে বের করে নিয়ে সুখ-শান্তির আবাসস্থলে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই তাকে এই পথ পাড়ি দিতে হয়। “(মিরকাতুল মাফাতীহ, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৫৪৬)
.
আদম সন্তান যে স্বভাবতই মৃত্যুকে অপছন্দ করে—এ কথার সমর্থনে অন্যান্য হাদীসসমূহেও প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন:রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
اثْنَتَانِ يَكْرَهُهُمَا ابْنُ آدَمَ : الْمَوْتُ، وَالْمَوْتُ خَيْرٌ لِلْمُؤْمِنِ مِنَ الْفِتْنَةِ، وَيَكْرَهُ قِلَّةَ الْمَالِ، وَقِلَّةُ الْمَالِ أَقَلُّ لِلْحِسَابِ.
“আদম সন্তান স্বভাবত দুটো বিষয়কে অপছন্দ করে। একটি হলো মৃত্যু। অথচ ফেতনা থেকে তার জন্য মৃত্যুই উত্তম। আর সে স্বল্প ধন-দৌলত অপছন্দ করে। অথচ অল্প সম্পদ পরকালের হিসেবের জন্য সহজতর হবে।”(মুসনাদে আহমদ হা/২৩৬২৫)। অপর বর্ননায় আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাতকে ভালবাসে আল্লাহও তার সাক্ষাতকে ভালবাসেন। যে ব্যক্তির কাছে আল্লাহর সাক্ষাত প্রিয়, আল্লাহর নিকটও তার সাক্ষাত প্রিয়। আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! আপনি কি মৃত্যুর কথা বুঝাতে চাচ্ছেন? আমরা তো সবাই মৃত্যুকে অপছন্দ করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: না, সেটা না। মুমিন বান্দাকে যখন আল্লাহর রহমত, তাঁর সন্তুষ্টি, তাঁর জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তিনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করাকে ভালবাসেন। আর কাফের বান্দাকে যখন আল্লাহর শাস্তি, তাঁর অসন্তুষ্টির সংবাদ দেয়া হয় তখন সে আল্লাহর সাক্ষাতকে অপছন্দ করে এবং আল্লাহও তার সাক্ষাতকে অপছন্দ করেন।”(সহীহ বুখারী হা/৬৫০৭; এবং মুসলিম হা/২৬৮৩)
.
হাদিসটির ব্যাখ্যায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,معنى الحديث أن المحبة والكراهية التي تعتبر شرعا هي التي تقع عند النزع في الحالة التي لا تقبل فيها التوبة، حيث ينكشف الحال للمحتضر ، ويظهر له ما هو صائر إليه “হাদিসের অর্থ হচ্ছে- যখন মানুষের মৃত্যুর গড়গড়া শুরু হয়ে যায়, যে অবস্থায় আর তওবা কবুল হয় না, সে অবস্থার পছন্দ-অপছন্দকে এখানে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। মুমূর্ষু ব্যক্তির কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে পড়ে, তার পরিণতি কী হতে যাচ্ছে সেটা তার সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়”(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৯০৩)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

No comments:

Post a Comment

Translate